হে ভারত, ভুলিও না
হে ভারত, ভুলিও না ~ স্বামী বিবেকানন্দ
অতি প্রাচীনকালে একবার ভারতীয় দর্শনবিদ্যা গ্রীক উৎসাহের সম্মিলনে রােমক, ইরানী প্রভৃতি মহাজাতিবর্গের অভ্যুদয় সূত্রিত করে। সিকন্দর-সাহের দিগ্বিজয়ের পর এই দুই মহাজলপ্রপাতের সংঘর্ষে প্রায় অর্ধভূভাগ ঈশাদি-নামাখ্যাত অধ্যাত্ম-তরঙ্গরাজি উপপ্লাবিত করে। আরবদিগের অভ্যুদয়ের সহিত পুনরায় ঐ প্রকার মিশ্রণ আধুনিক ইওরােপীয় সভ্যতার ভিত্তিস্থাপন করে এবং বােধহয় আধুনিক সময়ে পুনর্বার ঐ দুই মহাশক্তির সম্মিলনকাল উপস্থিত।
এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ।
ভারতের বায়ু শান্তিপ্রধান; যবনের প্রাণ শক্তিপ্রধান; একের গভীর চিন্তা, অপরের অদম্য কার্যকারিতা; একের মূলমন্ত্র ত্যাগ’, অপরের ‘ভােগ'; একের সর্বচেষ্টা অন্তর্মুখী, অপরের বহির্মুখী; একের প্রায় সর্ববিদ্যা অধ্যাত্ম, অপরে অধিভূত; একজন মুক্তিপ্রিয়, অপর স্বাধীনতাপ্রাণ; একজন ইহলােক-কল্যাণলাভে নিরুৎসাহ, অপর এই পৃথিবীকে স্বর্গভূমিতে পরিণত করিতে প্রাণপণ; একজন নিত্যসুখের আশায় ইহলােকের অনিত্য সুখকে উপেক্ষা করিতেছেন, অপর নিত্যসুখে সন্দিহান হইয়া বা দূরবর্তী জানিয়া যথাসম্ভব ঐহিক সুখলাভে সমুদ্যত।
এযুগে পূর্বোক্ত জাতিদ্বয়ই অন্তর্হিত হইয়াছেন, কেবল তাঁহাদের শারীরিক বা মানসিক বংশধরেরা বর্তমান।
ইওরােপ-আমেরিকা যবনদিগের সমুন্নত মুখােজ্জ্বলকারী সন্তান; আধুনিক ভারতবাসী আর্যকুলের গৌরব নহেন। কিন্তু এই ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় আধুনিক ভারতবাসীতেও অন্তর্নিহিত পৈত্রিক শক্তি বিদ্যমান। যথাকালে মহাশক্তির কৃপায় তাহার পুনঃস্ফুরণ হইবে। ৬।৩১
******
ব্যক্তির পক্ষে যেমন, প্রত্যেক জাতির পক্ষেও তেমনি জীবনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। উহাই তাহার জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ। উহাই যেন তাহার জীবন-সঙ্গীতের প্রধান সুর, অন্যান্য সুর যেন সেই প্রধান সুরের সহিত সঙ্গত হইয়া ঐকতান সৃষ্টি করিতেছে। কোন দেশের যথা ইংলণ্ডের জীবনীশক্তি রাজনীতিক অধিকার; কলাবিদ্যার উন্নতিই হয়তাে অপর কোন জাতির জীবনের মূল লক্ষ্য। ভারতে কিন্তু ধর্ম জাতীয় জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ, উহাই যেন জাতীয় জীবন-সঙ্গীতের প্রধান সুর। আর যদি কোন জাতি তাহার এই স্বাভাবিক জীবনীশক্তি-শত শতাব্দী ধরিয়া যেদিকে উহার বিশেষ গতি হইয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করিতে চেষ্টা করে এবং যদি সেই চেষ্টায় কৃতকার্য হয়, তবে তাহার মৃত্যু নিশ্চয়।... এই জগতে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ পথ বাছিয়া লয়; প্রত্যেক জাতিও সেইরূপ। আমরা শত শত যুগ পূর্বে নিজেদের পথ বাছিয়া লইয়াছি, এখন আমাদিগকে তদনুসারে চলিতেই হইবে। ৫|১০৯
******
রাজনীতিক বা সামরিক শ্রেষ্ঠতা কোন কালে আমাদের জাতীয় জীবনের উদ্দেশ্য নহে কখনও ছিলও না, আর জানিয়া রাখুন, কখনও হইবেও না। ৫।৭
******
এইটি বেশ স্মরণ রাখিবে, তােমরা যদি ধর্ম ছাড়িয়া দিয়া পাশ্চাত্যজাতির জড়বাদ-সর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হও, তােমরা তিন পুরুষ যাইতে না যাইতেই বিনষ্ট হইবে। ৫|৪৬
******
আমাদিগকে আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী উন্নতির চেষ্টা করিতে হইবে। বৈদেশিক সংস্থাগুলি জোর করিয়া আমাদিগকে যে প্রণালীতে চালিত করিতেছে, তদনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা বৃথা; উহা অসম্ভব। ৫|১০৯
******
যতদিন না হিন্দুজাতি একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং এক নূতন জাতি তাহার স্থান অধিকার করে, ততদিন প্রাচ্যে প্রতীচ্যে যতই চেষ্টা কর না কেন, জীবিত থাকিতে ভারত কখনও ইওরােপ হইতে পারে না। ৫|৪৬১
******
আমি বিশ্বাস করি না যে, হিন্দু কখনও নাস্তিক হইতে পারে। পাশ্চাত্য গ্রন্থাদি পড়িয়া সে মনে করিতে পারে, সে জড়বাদী হইয়াছে। কিন্তু তাহা দুদিনের জন্য, এভাব তােমাদের মজ্জাগত নহে; তােমাদের ধাতে যাহা নাই, তাহা তােমরা কখনই বিশ্বাস করিতে পার না, তাহা তােমাদের পক্ষে অসম্ভব চেষ্টা। ৫|২০৩
******
হিন্দুগণ ধর্মের ভাবে পানাহার করে, [এমন কি] ধর্মের ভাবে দস্যুবৃত্তি করে।... প্রত্যেক জাতিরই এ পৃথিবীতে একটি উদ্দেশ্য ও আদর্শ থাকে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সেই আদর্শ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে ঐ জাতির মৃত্যুও ঘটে।... যতদিন ভারতবর্ষ মত্যুপণ করিয়াও ভগবানকে ধরিয়া থাকিবে, ততদিন তাহার আশা আছে। ১০।১৫৮
******
এখন বুঝতে পারছ তাে, এ রাক্ষসীর প্রাণপাখিটি কোথায়?—ধর্মে। সেইটির নাশ কেউ করতে পারেনি বলেই জাতটা এত সয়ে এখনও বেঁচে আছে। আচ্ছা, একজন দেশী পণ্ডিত বলেছেন যে, ওখানটায় প্রাণটা রাখবার এত আবশ্যক কি? সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতায় রাখ না কেন?—যেমন অন্যান্য অনেক দেশে। কথাটি তাে হলাে সােজা।... আসল কথা হচ্ছে, যে নদীটা পাহাড় থেকে ১, ০০০ ক্রোশ নেমে এসেছে, সে কি আর পাহাড়ে ফিরে যায়, না যেতে পারে? যেতে চেষ্টা যদি একান্ত করে তাে ইদিক উদিকে ছড়িয়ে পড়ে মারা যাবে, এইমাত্র। সে নদী যেমন করে তােক সমুদ্রে যাবেই—দু-দিন আগে বা পরে, দুটো ভাল জায়গায় মধ্য দিয়ে, না হয় দু-একবার আঁস্তাকুড় ভেদ করে। যদি এ দশ-হাজার বৎসরের জাতীয় জীবনটা ভুল হয়ে থাকে তাে আর এখন উপায় নেই, এখন একটা নতুন চরিত্র গড়তে গেলেই মরে যাবে বই তাে নয়। ৬।১৬০
******
এদেশে সেই বুড়াে শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন। ঐ বুড়াে শিব ষাঁড় চড়ে ভারতবর্ষ থেকে একদিকে সুমাত্রা, বাের্নিও, সেলিবিস, মায় অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার কিনারা পর্যন্ত ডমরু বাজিয়ে এককালে বেড়িয়েছেন, আর একদিকে তিব্বত, চীন, জাপান, সাইবেরিয়া পর্যন্ত বুড়াে শিব ষাঁড় চরিয়েছেন; এখনও চরাচ্ছেন। ঐ যে মা কালী—উনি চীন জাপান পর্যন্ত পূজা খাচ্ছেন, ওঁকেই যীশুর-মা মেরী ক্রিশ্চানরা পূজা করছে। ঐ যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাস, সেথা বুড়াে শিবের প্রধান আড্ডা। ও কৈলাস দশমুণ্ড কুড়িহাত রাবণ নাড়াতে পারেন নি। ...ঐ বুড়াে শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এদেশে চিরকাল। ৬।১৫১
******
জাতটা ঠিক বেঁচে আছে, প্রাণ ধকধক করছে, ওপরে ছাই চাপা পড়েছে মাত্র। আর দেখবে যে, এদেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম; আর তােমার রাজনীতি, সমাজনীতি, রাস্তা বেঁটানাে, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান—এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তাে হবে; নইলে ঘােড়ার ডিম, তােমার চেঁচামেচিই সার। ৬।১৬১
******
এখন একে দারিদ্র্য, তার ওপর আমার ‘ইতেনষ্টস্ততে ভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছি। জাতির যে গুণগুলি ছিল, তাও যাচ্ছে—পাশ্চাত্য দেশেরও কিছুই পাচ্ছি না! চলা-বসা কথা-বার্তায় একটা সেকেলে কায়দা ছিল, তা উৎসন্ন গেছে, অথচ পাশ্চাত্য কায়দা নেবারও সামর্থ্য নেই। পূজা পাঠ প্রভৃতি যা কিছু ছিল, তা তাে আমরা বানের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি, অথচ কালের উপযােগী একটা নূতন রকমের কিছু এখনও হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, আমরা এই মধ্যরেখার দুর্দশায় এখন পড়ে। ৬।২১৩
******
দুর্ভেদ্য তমসাবরণ এখন সকলকে সমানভাবে আচ্ছন্ন করিয়াছে। এখন চেষ্টায় তেজ নাই, উদ্যোগে সাহস নাই, মনে বল নাই, অপমানে ঘৃণা নাই, দাসত্বে অরুচি নাই, হৃদয়ে প্রীতি নাই, প্রাণে আশা নাই; আছে প্রবল ঈর্ষা, স্বজাতিদ্বেষ, আছে দুর্বলের ‘যেন তেন প্রকারেণ’ সর্বনাশ-সাধনে একান্ত ইচ্ছা, আর বলবানের কুকুরবৎ পদলেহন। এখন তৃপ্তি ঐশ্বর্যপ্রদর্শনে, ভক্তি স্বার্থ-সাধনে, জ্ঞান অনিত্যবস্তুসংগ্রহে, যােগ পৈশাচিক আচারে, কর্ম পরের দাসত্বে, সভ্যতা বিজাতীয় অনুকরণে, বাগ্মিত্ব কটু-ভাষণে, ভাষার উৎকর্ষ ধনীদের অত্যদ্ভুত চাটুবাদে বা জঘন্য অশ্লীলতা-বিকীরণে। ৬।২৪০
******
আমরা গরিবদের, সামান্য লােকদের, পতিতদের কি ভাবিয়া থাকি! তাহাদের কোন উপায় নাই, পালাইবার কোন রাস্তা নাই, উঠিবার কোন উপায় নাই। ভারতের দরিদ্র, ভারতের পতিত, ভারতের পাপিগণের সাহায্যকারী কোন বন্ধু নাই। সে যতই চেষ্টা করুক, তাহার উঠিবার উপায় নাই। তাহারা দিন দিন ডুবিয়া যাইতেছে। রাক্ষসবৎ নৃশংস সমাজ তাহাদের উপর ক্রমাগত যে আঘাত করিতেছে, তাহার বেদনা তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছে, কিন্তু তাহারা জানে না—কোথা হইতে ঐ আঘাত আসিতেছে। তাহারাও যে মানুষ, ইহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহার ফল দাসত্ব ও পশুত্ব। ৬।৩৬৩
******
এই ভারতে কতকগুলি বিপদ আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে, উহাদের মধ্যে একদিকে ঘাের জড়বাদ, অপরদিকে উহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঘাের কুসংস্কার—দুই-ই পরিহার করিয়া চলিতে হইবে। একদিকে পাশ্চাত্যবিদ্যার মদিরাপানে মত্ত হইয়া আজকাল কতকগুলি ব্যক্তি মনে করিতেছে, তাহারা সব জানে; তাহারা প্রাচীন ঋষিগণের কথায় উপহাস করিয়া থাকে। তাহাদের নিকট হিন্দুজাতির সমুদয় চিন্তা কেবল কতকগুলি আবর্জনার স্তুপ, হিন্দুদর্শন কেবল শিশুর আধ-আধ কথা এবং হিন্দুধর্ম নির্বোধের কুসংস্কারমাত্র! অপরদিকে আবার কতকগুলি শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন, কিন্তু তাঁহারা কতকটা বাতিকগ্রস্ত, তাঁহারা আবার উহাদের সম্পূর্ণ বিপরীত; তাঁহারা সব ঘটনাকেই একটা শুভ বা অশুভ লক্ষণরূপে দেখিয়া থাকেন।.. তিনি যে জাতি-বিশেষের অন্তর্ভুক্ত, তাঁহার বিশেষ জাতীয় দেবতার অথবা তাঁহার গ্রামের যাহা কিছু কুসংস্কার আছে, তাহার দার্শনিক, আধ্যাত্মিক এবং সর্বপ্রকার ছেলেমানুষি ব্যাখ্যা করিতে তিনি প্রস্তুত। তাঁহার নিকট প্রত্যেক গ্রাম্য কুসংস্কারটিই বেদবাণীর তুল্য এবং তাঁহার মতে সেইগুলি প্রতিপালন করার উপর জাতীয় জীবন নির্ভর করিতেছে। এইসব হইতে তােমাদিগকে সাবধান হইতে হইবে। ৫|১৭৩
******
একদিকে নব্যভারত বলিতেছেন—পাশ্চাত্য ভাব, ভাষা, আহার, পরিচ্ছেদ ও আচার অবলম্বন করিলেই আমরা পাশ্চাত্য জাতিদের ন্যায় বলবীর্য-সম্পন্ন হইব; অপর দিকে প্রাচীন ভারত বলিতেছেন—মূখ! অনুকরণ দ্বারা পরের ভাব আপনার হয় না, অর্জন না করিলে কোন বস্তুই নিজের হয় না; সিংহচর্ম-আচ্ছাদিত হইলেই কি গর্দভ সিংহ হয়?
এদিকে নব্যভারত বলিতেছেন—পাশ্চাত্য জাতিরা যাহা করে তাহাই ভাল; ভাল না হইলে উহারা এত প্রবল কি প্রকারে হইল? অপর দিকে প্রাচীন ভারত বলিতেছেন—বিদ্যুতের আলােক অতি প্রবল, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী; বালক, তােমার চক্ষু প্রতিহত হইতেছে, সাবধান!!
...পাশ্চাত্য-অনুকরণ-মােহ এমনই প্রবল হওতেছে যে, ভাল বা মন্দের জ্ঞান আর বুদ্ধি বিচার শাস্ত্র বা বিবেকের দ্বারা নিষ্পন্ন হয় না। শ্বেতাঙ্গ যে ভাবের, যে আচারের প্রশংসা করে, তাহাই ভাল; তাহারা যাহার নিন্দা করে, তাহাই মন্দ। ৬।২৪৭
******
যদ্যপি ভয় আছে যে, এই পাশ্চাত্য-বীর্যতরঙ্গে আমাদের বহুকালার্জিত রত্নবা ভাসিয়া যায়, ভয় হয়, পাছে প্রবল আবর্তে পড়িয়া ভারতভূমিও ঐহিক ভােগলাভের রণভূমিতে আত্মহারা হইয়া যায়; ভয় হয়, পাছে অসাধ্য অসম্ভব এবং মূলােচ্ছেদকারী বিজাতীয় ঢঙের অনুকরণ করিতে যাইয়া আমরা ইতােনষ্টস্ততােভ্রষ্টঃ’ হইয়া যাই। এইজন্য ঘরের সম্পত্তি সর্বদা সম্মুখে রাখিতে হইবে; যাহাতে অসাধারণ সকলে তাহাদের পিতৃধন সর্বদা জানিতে ও দেখিতে পারে, তাহার প্রযত্ন করিতে হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে নির্ভীক হইয়া সর্বদ্বার উন্মুক্ত করিতে হইবে। আসুক চারিদিকে হইতে রশ্মিধারা, আসুক তীব্র পাশ্চাত্য কিরণ। যাহা দুর্বল দোষমুক্ত, তাহা মরণশীল—তাহা লইয়াই বা কি হইবে? যাহা বীর্যবান বলপ্রদ, তাহা। অবিনশ্বর; তাহার নাশ কে করে? ৬|৩৩
******
এখনকার কালে যদি কেহ মুশা, বুদ্ধ বা ঈশার শক্তি উদ্ধৃত করে, সে হাস্যাস্পদ হয়; কিন্তু হাক্সলি, টিণ্ডাল বা ডারুইনের নাম করিলেই লােকে সে কথা একেবারে নির্বিচারে গলাধঃকরণ করে। হাক্সলি এই কথা বলিয়াছেন—অনেকের পক্ষে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট! আমরা কুসংস্কার হইতে মুক্ত হইয়াছি বটে! আগে ছিল ধর্মের কুসংস্কার, এখন হইয়াছে। বিজ্ঞানের কুসংস্কার; আগের কুসংস্কার ভিতর দিয়া জীবনপ্রদ আধ্যাত্মিক ভাব আসিত; আধুনিক কুসংস্কারের ভিতর দিয়া কেবল কাম ও লােভ আসিতেছে। সে কুসংস্কার ছিল ঈশ্বরের উপাসনা লইয়া, আর আধুনিক কুসংস্কার—অতি ঘৃণিত ধন নাম-যশ বা ক্ষমতার উপাসনা। ইহাই প্রভেদ। ২|২৬
******
জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা।..সত্যিকারের জাতি—যাহারা কুটিরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে।...তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববােধের আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। ৬।৪৩৫
******
প্ৰপতিত নদীর জলরাশি সমধিক বেগবান হ্য, পুনরুত্থিত তরঙ্গ সমধিক বিস্ফারিত হয়। প্রত্যেক পতনের পর আর্যসমাজের শ্রীভগবানের কারুণিক নিয়তৃত্বে বিগতাময় হইয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর যশস্বী ও বীর্যবান হইতেছে—ইহা ইতিহাস-প্রসিদ্ধ।
বারংবার এই ভারতভূমি মূৰ্ছাপন্ন হইয়াছিলেন এবং বারংবার ভারতের ভগবান আত্মাভিব্যক্তির দ্বারা ইহাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন।
কিন্তু ঈষত্রযামা গতপ্রায় বর্তমান গভীর বিষাদরজনীর ন্যায় কোনও অমানিশা এই পুণ্যভূমিকে সমাচ্ছন্ন করে নাই। এ পতনের গভীরতায় প্রাচীন পতন-সমস্ত গােষ্পদের তুল্য। এবং সেইজন্য এই প্রবােধনের সমুজ্জ্বলতায় অন্য সমস্ত পুনর্বোধন সূর্যালােকে তারকাবলীর ন্যায়। এই পুনরুত্থানের মহাবীর্যের সমক্ষে পুনঃপুনর্লব্ধ প্রাচীন বীর্য বাললীলাপ্রায় হইয়া যাইবে। ৬।৫
******
আমরা সকলেই ভারতের অধঃপতন সম্বন্ধে শুনিয়া থাকি। এককালে আমিও ইহা বিশ্বাস করিতাম। কিন্তু আজ অভিজ্ঞতার দৃঢ়ভূমিতে দাঁড়াইয়া, সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি লইয়া সর্বোপরি দেশের সংস্পর্শে আসিয়া উহাদের অতিরঞ্জিত চিত্রসমূহের বাস্তবরূপ দেখিয়া সবিনয়ে স্বীকার করিতেছি, আমার ভুল হইয়াছিল। হে পবিত্র আর্যভূমি, তােমার তাে কখনও অবনতি হয় নাই। কত রাজদণ্ড চূর্ণ হইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, কত শক্তির দণ্ড এক হাত হইতে অন্য হাতে গিয়াছে কিন্তু ভারতবর্ষে রাজা-রাজসভা অতি অল্প লােককেই প্রভাবিত করিয়াছে। উচ্চতম হইতে নিম্নতম শ্রেণী অবধি বিশাল জনসমষ্টি আপন অনিবার্য গতিপথে ছুটিয়া চলিয়াছে, জাতীয় জীবনস্রোত কখনও মৃদু অর্ধচেতনভাবে, কখনও প্রবল জাগ্রতভাবে প্রবাহিত হইয়াছে। শত শতাব্দীর সমুজ্জ্বল শােভাযাত্রার সম্মুখে আমি স্তম্ভিত বিস্ময়ে দণ্ডায়মান। সে শােভাযাত্রার কোন কোনও অংশে আলােকরেখা স্তিমিতপ্রায়, পরক্ষণে দ্বিগুণ তেজে ভাস্বর, আর উহার মাঝখানে আমার দেশমাতৃকা রানীর মতাে পদবিক্ষেপে পশুমানবকে দেবমানবে রূপান্তরিত করিবার জন্য মহিমময় ভবিষ্যতের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন; স্বর্গ বা মর্তের কোন শক্তির সাধ্য নাই—এ জয়যাত্রার গতিরােধ করে।
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, সত্যই মহিমময় ভবিষ্যৎ! প্রাচীন উপনিষদের যুগ হইতে আমরা পৃথিবীর সমক্ষে স্পর্ধাপূর্বক এই আদর্শ প্রচার করিয়াছেঃ ‘ন প্রজয়া ন ধনেন ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ—পারে। জাতির পর জাতি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হইয়াছে এবং বাসনার জগতে থাকিয়া জগৎ-রহস্য সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছে। তাহারা সকলেই ব্যর্থ হইয়াছে, প্রাচীন জাতিসমূহ ক্ষমতা ও অর্থপ্লতার ফলে জাত অসাধুতা ও দুর্দশার চাপে বিলুপ্ত হইয়াছে—নূতন জাতিসমূহ পতনােন্মুখ । শান্তি অথবা যুদ্ধ, সহনশীলতা অথবা অসহিষ্ণুতা, সততা অথবা খলতা, বুদ্ধিবল অথবা বাহুবল, আধ্যাত্মিকতা অথবা ঐহিকতাএগুলির মধ্যে কোন্টির জয় হইবে, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও বাকি।
বহু পূর্বে আমরা এ-সমস্যার সমাধান করিয়াছি, সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়া সেই সমাধান অবলম্বন করিয়াই চলিয়াছি, শেষ অবধি ইহাই ধরিয়া রাখিতে চাই। আমাদর সমাধান—ত্যাগ, অপার্থিবতা।
সমগ্র মানবজাতির আধ্যাত্মিক রূপান্তর—ইহাই ভারতীয় জীবন-সাধনার মূলমন্ত্র, ভারতের চিরন্তন সঙ্গীতের মূল সুর, ভারতীয় সত্তার মেরুদণ্ড-স্বরূপ, ভারতীয়তার ভিত্তি, ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান প্রেরণা ও বাণী। তাতার, তুর্কী, মােগল, ইংরেজ-কাহারও শাসন কালেই ভারতের জীবনসাধনা এই আদর্শ হইতে কখনও বিচ্যুত হয় নাই।
ভারতের ইতিহাসে কেহ এমন একটি যুগ দেখাইয়া দিন দেখি, যে-যুগে সমগ্র জগৎকে আধ্যাত্মিকতা দ্বারা পরিচালিত করিতে পারেন, এমন মহাপুরুষের অভাব ছিল। কিন্তু ভারতের কার্যপ্রণালী আধ্যাত্মিক—সে-কাজ রণবিদ্যা বা সৈন্যবাহিনীর অভিযানের দ্বারা হইতে পারে না। ভারতের প্রভাব চিরকাল পৃথিবীতে নিঃশব্দ শিশিরপাতের ন্যায় সকলের অলক্ষ্যে সঞ্চারিত হইয়াছে, অথচ পৃথিবীর সুন্দরতম কুসুমগুলি ফুটাইয়া তুলিয়াছে। নিজস্ব শান্ত প্রকৃতির দরুন এ-প্রভাব বিদেশে ছড়াইয়া পড়িবার উপযুক্ত সময় ও সুযােগের প্রয়ােজন হইয়াছে, যদিও স্বদেশের গণ্ডিতে ইহা সর্বদাই সক্রিয় ছিল। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, ইহার ফলে যখনই তাতার, পারসীক, গ্রীক বা আরব জাতি এদেশের সঙ্গে বহির্জগতের সংযােগ-সাধন করিয়াছে, তখনই এদেশ হইতে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব বন্যাস্রোতের মতাে সমগ্র জগৎকে প্লাবিত করিয়াছে। সেই এক ধরনেরই ঘটনা আবার আমাদের সম্মুখে দেখা দিয়াছে। ইংরেজদের জলপথ ও স্থলপথ এবং ঐ ক্ষুদ্র দ্বীপের অধিবাসীদের অসাধারণ বিকাশের ফলে পুনরায় সমগ্র জগতের সঙ্গে ভারতেরসংযােগ সাধিত হইয়াছে, এবং সেই একই ব্যাপারের সূচনা মাত্র, বৃহত্তর ঘটনাপ্রবাহ আসিতেছে। ৫|৩৭৫
******
হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে? এই লজ্জাকর কাপুরুষতাসহায়ে তুমি বীরভােগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে? হে ভারত, ভুলিও না—তােমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, ভুলিও না—তােমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না—তােমার বিবাহ, তােমার ধন, তােমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের—নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে; ভুলিও না—তুমি জন্ম হইতেই মায়ের’ বলির জন্য বলিপ্রদত্ত; ভুলিও না—তােমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না—নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তােমার রক্ত, তােমার ভাই! হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল-মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল—ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমাদের আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ, আর বল দিনরাত, ‘হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।' ৬।২৪৯
******
0 Comments