শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
প্রথম ভাগ
চতুর্দশ খণ্ড
শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তগৃহে আগমন ও তাঁহার সহিত নরেন্দ্র, গিরিশ, বলরাম, চুনিলাল, লাটু, মাস্টার, নারায়ণ প্রভৃতি ভক্তের কথোপকথন ও আনন্দ
===========
প্রথম পরিচ্ছেদ
ভক্তগৃহে - ভক্তসঙ্গে
ফাল্গুন কৃষ্ণা দশমী তিথি, পূর্বাষাঢ়ানক্ষত্র, ২৯শে ফাল্গুন, বুধবার — ইংরেজী ১১ই মার্চ, ১৮৮৫। আজ আন্দাজ বেলা দশটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর হইতে আসিয়া ভক্তগৃহে বসু বলরাম-মন্দিরে শ্রীশ্রীজগন্নাথের প্রসাদ পাইয়াছেন। সঙ্গে লাটু প্রভৃতি ভক্ত।
ধন্য বলরাম! তোমারই আলয় আজ ঠাকুরের প্রধান কর্মক্ষেত্র হইয়াছে। কত নূতন নূতন ভক্তকে আকর্ষণ করিয়া প্রেমডোরে বাঁধিলেন, ভক্তসঙ্গে কত নাচিলেন। গাইলেন। যেন শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীবাসমন্দিরে প্রেমের হাট বসাচ্ছেন!
দক্ষিণেশ্বরের কালীবাটীতে বসে বসে কাঁদেন, নিজের অন্তরঙ্গ দেখিবেন বলে ব্যাকুল! রাত্রে ঘুম নাই। মাকে বলেন, “মা, ওর বড় ভক্তি, ওকে টেনে নাও; মা, একে এখানে এনে দাও; যদি সে না আসতে পারে, তাহলে মা আমায় সেখানে লয়ে যাও, আমি দেখে আসি।” তাই বলরামের বাড়ি ছুটে ছুটে আসেন। লোকের কাছে কেবল বলেন, “বলরামের ৺জগন্নাথের সেবা আছে, খুব শুদ্ধ অন্ন।” যখন আসেন অমনি নিমন্ত্রণ করিতে বলরামকে পাঠান। বলেন, “যাও — নরেন্দ্রকে, ভবনাথকে, রাখালকে নিমন্ত্রণ করে এসো। এদের খাওয়ালে নারায়ণকে খাওয়ানো হয়। এরা সামান্য নয়, এরা ঈশ্বরাংশে জন্মেছে, এদের খাওয়ালে তোমার খুব ভাল হবে।”
বলরামের আলয়েই শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষের সঙ্গে প্রথম বসে আলাপ। এইখানেই রথের সময় কীর্তনানন্দ। এইখানেই কতবার “প্রেমের দরবারে আনন্দের মেলা” হইয়াছে।
[“পশ্যতি তব পন্থানম্” — ছোট নরেন ]
মাস্টার নিকটে একটি বিদ্যালয়ে পড়ান। শুনিয়াছেন আজ দশটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাটীতে আসিবেন। মাঝে অধ্যাপনার কিঞ্চিত অবসর পাইয়া বেলা দুই প্রহরের সময় ওইখানে আসিয়া উপস্থিত। আসিয়া দর্শন ও প্রণাম করিলেন। ঠাকুর আহারান্তে বৈঠকখানায় একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মাঝে মাঝে থলি থেকে কিছু মসলা বা কাবাবচিনি খাচ্ছেন; অলপবয়স্ক ভক্তেরা চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — তুমি যে এখন এলে? স্কুল নাই?
মাস্টার — স্কুল থেকে আসছি — এখন সেখানে বিশেষ কাজ নাই।
ভক্ত — না, মহাশয়! উনি স্কুল পালিয়ে এসেছেন! (সকলের হাস্য)।
মাস্টার (স্বগতঃ) — হায়! কে যেন টেনে আনলে!
ঠাকুর যেন একটু চিন্তিত হইলেন। পরে মাস্টারকে কাছে বসাইয়া কত কথা কহিতে লাগিলেন। আর বলিলেন, “আমার গামছাটা নিংড়ে দাও তো গা, আর জামাটা শুকোতে দাও, আর পাটা একটু কামড়াচ্ছে, একটু হাত বুলিয়ে দিতে পার?” মাস্টার সেবা করিতে জানেন না, তাই ঠাকুর সেবা করিতে শিখাইতেছেন। মাস্টার শশব্যস্ত হইয়া একে একে ওই কাজগুলি করিতেছেন। তিনি পায়ে হাত বুলাইতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথাচ্ছলে কত উপদেশ দিতে লাগিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ঐশ্বর্যত্যাগের পরাকাষ্ঠা — ঠিক সন্ন্যাসী ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — হ্যাঁগা, এটা আমার কদিন ধরে হচ্ছে, কেন বল দেখি? ধাতুর কোন জিনিসে হাত দেবার জো নাই। একবার একটা বাটিতে হাত দিছিলুম, — তা হাতে শিঙ্গিমাছের কাঁটা ফোটা মতো হল। ঝন্ঝন্ কন্কন্ করতে লাগল। গাড়ু না ছুঁলে নয়, তাই মনে করলুম, গামছাখানা ঢাকা দিয়ে দেখি, তুলতে পারি কিনা; যাই হাত দিয়েছি, অমনি হাতটা ঝন্ঝন্ কন্কন্ করতে লাগল, খুব বেদনা। শেষে মাকে প্রাথ্রনা করলুম, ‘মা আর অমন কর্ম করব না, মা এবার মাপ করো।’
“হ্যাঁগা, ছোট নরেন যাওয়া আসা কচ্ছে, বাড়িতে কিছু বলবে? খুব শুদ্ধ, মেয়ে সঙ্গ কখনও হয় নাই।”
মাস্টার — আর খোলটা বড়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, আবার বলে যে, ঈশ্বরীয় কথা একবার শুনলে আমার মনে থাকে। বলে, ছেলেবেলায় আমি কাঁদতুম — ঈশ্বর দেখা দিচ্ছেন না বলে।
মাস্টারের সঙ্গে ছোট নরেন সম্বন্ধে এইরূপ অনেক কথা হইল। এমন সময় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিলেন, “মাস্টার নহাশয়! আপনি স্কুলে যাবেন না?”
শ্রীরামকৃষ্ণ — কটা বেজেছে?
একজন ভক্ত — একটা বাজতে দশ মিনিট।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — তুমি এস, তোমার দেরি হচ্ছে। একে কাজ ফেলে এসেছো। (লাটুর প্রতি) — রাখাল কোথায়?
লাটু — চলে গেছে; — বাড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার সঙ্গে দেখা না করে?
==========
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অপরাহ্নে ভক্তসঙ্গে — অবতারবাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
স্কুলের ছুটির পর মাস্টার আসিয়া দেখিতেছেন — ঠাকুর বলরামের বৈঠকখানায় ভক্তের মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। ঠাকুরের মুখে মধুর হাসি, সেই হাসি ভক্তদের মুখে প্রতিবিম্বিত হইতেছে। মাস্টারকে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া ও তিনি প্রণাম করিলে, ঠাকুর তাহাকে তাঁহার কাছে আসিয়া বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ, সুরেশ মিত্র, বলরাম, লাটু, চুনিলাল ইত্যাদি ভক্ত উপস্থিত আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — তুমি একবার নরেন্দ্রের সঙ্গে বিচার করে দেখো, সে কি বলে।
গিরিশ (সহাস্যে) — নরেন্দ্র বলে, ঈশ্বর অনন্ত। যা কিছু আমরা দেখি, শুনি, — জিনিসটি, কি ব্যক্তিটি — সব তাঁর অংশ, এ পর্যন্ত আমাদের বলবার জো নাই। Infinity (অনন্ত আকাশ) — তার আবার অংশ কি? অংশ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর অনন্ত হউন আর যত বড় হউন, তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর ভিতরের সার বস্তু মানুষের ভিতর দিয়ে আসতে পারে ও আসে। তিনি অবতার হয়ে থাকেন, এটি উপমা দিয়ে বুঝান যায় না। অনুভব হওয়া চাই। প্রত্যক্ষ হওয়া চাই। উপমার দ্বারা কতকটা আভাস পাওয়া যায়। গরুর মধ্যে শিংটা যদি ছোঁয়, গরুকেই ছোঁয়া হল; পাটা বা লেজটা ছুঁলেও গরুটাকে ছোঁয়া হল। কিন্তু আমাদের পক্ষে গরুর ভিতেরের সার পদার্থ হচ্ছে দুধ। সেই দুধ বাঁট দিয়ে আসে।
“সেইরূপ প্রেমভক্ত শিখাইবার জন্য ঈশ্বর মানুষদেহ ধারণ করে সময়ে সময়ে অবতির্ণ হন।”
গিরিশ — নরেন্দ্র বলে, তাঁর কি সব ধারণা করা যায়। তিনি অনন্ত।
[PERCEPTION OF THE INFINITE][1]
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — ঈশ্বরের সব ধারণা কে করতে পারে? তা তাঁর বড় ভাবটাও পারে না, আবার ছোট ভাবটাও পারে না। আর সব ধারণা করা কি দরকার? তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে পারলেই হল। তাঁর অবতারকে দেখলেই তাঁকে দেখা হল। যদি কেউ গঙ্গার কাছে গিয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে, সে বলে — গঙ্গা দর্শন-স্পর্শন করে এলুম। সব গঙ্গাটা হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত, হাত দিয়ে ছুঁতে হয় না। (হাস্য)
“তোমার পাটা যদি ছুঁই, তোমায় ছোঁয়াই হল। (হাস্য)
“যদি সাগরের কাছে গিয়ে একটু জল স্পর্শ কর, তাহলে সাগর স্পর্শ করাই হল। অগ্নিতত্ত্ব সব জায়গায় আছে, তবে কাঠে বেশি।”
গিরিশ (হাসিতে হাসিতে) — যেখানে আগুন পাব, সেইখানেই আমার দরকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — অগ্নিতত্ত্ব কাঠে বেশি। ঈশ্বরতত্ত্ব খোঁজ, মানুষে খুঁজবে। মানুষে তিনি বেশি প্রকাশ হন। যে মানুষে দেখবে উর্জিতা ভক্তি — প্রেমভক্তি উথলে পড়ছে — ঈশ্বরের জন্য পাগল — তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা — সেই মানুষে নিশ্চিত জেনো, তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন।
(মাস্টার দৃষ্টে) — “তিনি তো আছেনই, তবে তাঁর শক্তি কোথাও বেশি প্রকাশ, কোথাও কম প্রকাশ। অবতারের ভিতর তাঁর শক্তি বেশি প্রকাশ; সেই শক্তি কখন কখন পূর্ণভাবে থাকে। শক্তিরই অবতার।”
গিরিশ — নরেন্দ্র বলে, তিনি অবাঙ্মনসোগোচরম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না; এ-মনের গোচর নয় বটে — কিন্তু শুদ্ধমনের গোচর। এ বুদ্ধির গোচর নয় — কিন্তু শুদ্ধবুদ্ধির গোচর। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি গেলেই, শুদ্ধমন আর শুদ্ধবুদ্ধি হয়। তখন শুদ্ধমন শুদ্ধবুদ্ধি এক। শুদ্ধমনের গোচর। ঋষি-মুনিরা কি তাঁকে দেখেন নাই? তাঁরা চৈতন্যের দ্বারা চৈতন্যের সাক্ষাৎকার করেছিলেন।
গিরিশ (সহাস্যে) — নরেন্দ্র আমার কাছে তর্কে হেরেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না; আমায় বলেছে, গিরিশ ঘোষের মানুষে অবতার বলে অত বিশ্বাস; এখন আমি আর কি বলব! অমন বিশ্বাসের উপর কিছু বলতে নাই।’
গিরিশ (সহাস্যে) — মহাশয়! আমরা সব হলহল করে কথা কচ্ছি, কিন্তু মাস্টার ঠোঁট চেপে বসে আছে। কি ভাবে? মহাশয়! কি বলেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — “মুখহলসা, ভেতরবুঁদে, কানতুলসে, দীঘল ঘোমটা নারী, পানা পুকুরের সীতল জল বড় মন্দকারী। (সকলের হাস্য) (সহাস্যে) — কিন্তু ইনি তা নন — ইনি ‘গম্ভীরাত্মা’ (সকলের হাস্য)
গিরিশ — মহাশয়! শ্লোকটি কি বললেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই ক’টি লোকের কাছে সাবধান হবে: প্রথম, মুখহলসা — হলহল করে কথা কয়; তারপর ভেতরবুঁদে — মনের ভিতর ডুবুরি নামালেও অন্ত পাবে না; তারপর কানতুলসে — কানে তুলসী দেয়, ভক্তি জানাবার জন্য; দীঘল ঘোমটা নারী — লম্বা ঘোমটা, লোকে মনে করে ভারী সতী, তা নয়; আর পানাপুকুরের জল — নাইলে সান্নিপাতিক হয়। (হাস্য)
চুনিলাল — এঁর (মাস্টারের) নামে কথা উঠেছে। ছোট নরেন, বাবুরাম ওঁর পোড়ো; নারায়ণ, পল্টু, তেজচন্দ্র — এরা সব ওঁর পোড়ো। কথা উঠেছে যে, উনি তাদের এইখানে এনেছেন, আর তাদের পড়াশুনা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এঁর নামে দোষ দিচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাদের কথা কে বিশ্বাস করবে?
এই সকল কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় নারাণ আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিল। নারাণ গৌরবর্ণ, ১৭/১৮ বছর বয়স, স্কুলে পড়ে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে বড় ভালবাসেন। তাকে দেখবার জন্য, তাকে খাওয়াবার জন্য ব্যাকুল। তার জন্য দক্ষিণেশ্বরে বসে বসে কাঁদেন। নারাণকে তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন।
গিরিশ (নারায়ণ দৃষ্টে) — কে খবর দিলে? মাস্টারই দেখছি সব সারলে। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — রোসো! চুপচাপ করে থাকো! এর (মাস্টারের) নামে একে বদনাম উঠেছে।
[অন্নচিন্তা চমৎকারা — ব্রাহ্মণের প্রতিগ্রহ করার ফল ]
আবার নরেন্দ্রের কথা পড়িল।
একজন ভক্ত — এখন তত আসেন না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা,
কালিদাস হয় বুদ্ধিহারা।’ (সকলের হাস্য)
বলরাম — শিব গুহর বাড়ির ছেলে অন্নদা গুহর কাছে খুব আনাগোনা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, একজন আফিসোয়ালার বাসায় নরেন্দ্র, অন্নদা এরা সব যায়। সেখানে তারা ব্রাহ্মসমাজ করে।
একজন ভক্ত — তাঁর (অফিসওয়ালার) নাম তারাপদ।
বলরাম (হাসিতে হাসিতে) — বামুনরা বলে, অন্নদা গুহ লোকটার বড় অহংকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বামুনদের ও-সব কথা শুনো না। তাদের তো জানো, না দিলেই খারাপ লোক, দিলেই ভাল! (সকলের হাস্য) অন্নদাকে আমি জানি ভালো লোক।
১ Compare discussion about the order of perception of the Infinite and of the Finite in Max-Muller’s Hibbert Lectures and Gifford Lectures.
=========
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ভক্তসঙ্গে ভজনানন্দে
ঠাকুর গান শুনিবেন ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। বলরামের বৈঠকখানায় একঘর লোক। সকলেই তাঁহার পানে চাহিয়া আছেন — কি বলেন শুনিবেন, কি করেন দেখিবেন।
শ্রীযুক্ত তারাপদ গাহিতেছেন:
কেশব কুরু করুণা দীনে, কুঞ্জকাননচারী।
মাধব মনোমোহন, মোহন মুরলীধারী ৷৷
(হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার)।
ব্রজকিশোর কালীয়হর কাতরভয়ভঞ্জন,
নয়ন-বাঁকা, বাঁকা শিখিপাখা রাধিকা-হৃদয়রঞ্জন —
গোবর্ধনধারণ, বনকুসুমভূষণ, দামোদর কংসদর্পহারী।
শ্যামরাসরসবিহারী। (হরিবোল, ইত্যাদি) ৷৷
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — আহা, বেশ গানটি! তুমিই কি সব গান বেঁধেছ?
একজন ভক্ত — হাঁ, উনিই চৈতন্যলীলার সব গান বেঁধেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — এ গানটি খুব উতরেছে।
(গায়কের প্রতি) — “নিতাই-এর গান গাইতে পারো?”
আবার গান হইল, নিতাই গেয়েছেন:
কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জুয়ার বয়ে যায়।
বইছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায় ৷৷
প্রেমের কিশোরী, প্রেম বিলায় সাধ করি, রাধার প্রেমে বলরে হরি;
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেম তরঙ্গে প্রাণ নাচায়।
রাধার প্রেমে হরি বলি, আয় আয় আয় ৷৷
শ্রীগৌরাঙ্গের গান হইল —
কার ভাবে গৌর বেশে জুড়ালে হে প্রাণ।
প্রেমসাগরে উঠলো তুফান, থাকবে না আর কুল মান ৷৷
(মন মজালে গৌর হে)
ব্রজ মাঝে, রাখাল সাজে, চরালে গোধন;
ধরলে করে মোহন বাঁশি, মজলো গোপীর মন;
ধরে গোবর্ধন, রাখলে বৃন্দাবন,
মানের দায়ে, ধরে গোপীর পায়, ভেসে গেল চাঁদ বয়ান ৷৷
(মন মজালে গৌর হে)।
সকলে মাস্টারকে অনুরোধ করিতেছেন, তুমি একটি গান গাও। মাস্টার একটু লাজুক, ফিস্ফিস্ করে মাপ চাহিতেছেন।
গিরিশ (ঠাকুরের প্রতি, সহাস্যে) — মহাশয়! মাস্টার কোন মতে গান গাইছে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া) — ও স্কুলে দাঁত বার করবে; গান গাইতে যত লজ্জা! মাস্টার মুখটি চুন করে খানিকক্ষণ বসিয়া রহিলেন।
শ্রীযুক্ত সুরেশ মিত্র একটু দূরে বসেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার দিকে সস্নেহ দৃষ্টিপাত করিয়া শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষকে দেখাইয়া সহাস্যবদনে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তুমি তো কি? ইনি (গিরিশ) তোমার চেয়ে!
সুরেশ (হাসিতে হাসিতে) — আজ্ঞা হাঁ, আমার বড়দাদা। (সকলের হাস্য)
গিরিশ (ঠাকুরের প্রতি) — আচ্ছা, মহাশয়! আমি ছেলেবেলায় কিছু লেখাপড়া করি নাই, তবু লোকে বলে বিদ্বান!
শ্রীরামকৃষ্ণ — মহিমা চক্রবর্তী অনেক শাস্ত্র-টাস্ত্র দেখেছে শুনেছে — খুব আধার! (মাস্টারের প্রতি) — কেমন গা?
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।
গিরিশ — কি? বিদ্যা! ও অনেক দেখেছি! ওতে আর ভুলি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে) — এখানকার ভাব কি জান? বই শাস্ত্র এ-সব কেবল ঈশ্বরের কাছে পৌঁছিবার পথ বলে দেয়। পথ, উপায়, জেনে লবার পর, আর বই শাস্ত্রে কি দরকার? তখন নিজে কাজ করতে হয়।
“একজন একখানা চিঠি পেয়েছিল, কুটুম বাড়ি তত্ত্ব করতে হবে, কি কি জিনিস লেখা ছিল। জিনিস কিনতে দেবার সময় চিঠিখানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কর্তাটি তখন খুব ব্যস্ত হয়ে চিঠির খোঁজ আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ ধরে অনেকজন মিলে খুঁজলে। শেষে পাওয়া গেল। তখন আর আনন্দের সীমা নাই। কর্তা ব্যস্ত হয়ে অতি যত্নে চিঠিখানা হাতে নিলেন আর দেখতে জাগলেন, কি লেখা আছে। লেখা এই, পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবে, একখানা কাপড় পাঠাইবে; আরও কত কি। তখন আর চিঠির দরকার নাই, চিঠি ফেলে দিয়ে সন্দেশ ও কাপড়ের আর অন্যান্য জিনিসের চেষ্টায় বেরুলেন। চিঠির দরকার কতক্ষণ? যতক্ষণ সন্দেশ, কাপড় ইত্যদির বিষয় না জানা জায়। তারপরই পাবার চেষ্টা।
“শাস্ত্রে তাঁকে পাবার উপায়ের কথা পাবে। কিন্তু খবর সব জেনে নিজে কর্ম আরম্ভ করতে হয়। তবে তো বস্তুলাভ!
“শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? অনেক শ্লোক, অনেক শাস্ত্র, পণ্ডিতের জানা থাকতে পারে; কিন্তু যার সংসারে আসক্তি আছে, যার কামিনী-কাঞ্চনে মনে মনে ভালবাসা আছে, তার শাস্ত্রে ধারণা হয় নাই– মিছে পড়া। পাঁজিতে লোখেছে, বিশ আড়া জল, কিন্তু পাঁজি টিপলে এক ফোঁটাও পড়ে না।” (সকলের হাস্য)
গিরিশ (সহাস্যে) — মহাশয়! পাঁজি টিপলে এক ফোঁটাও পড়ে না? (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — পণ্ডিত খুব লম্বা লম্বা কথা বলে, কিন্তু নজর কোথায়? কামিনী আর কাঞ্চনে, দেহের সুখ আর টাকায়।
“শকুনি খুব উঁচুতে উড়ে, কিন্তু নজর ভাগাড়, কোথায় মড়া।
(গিরিশের প্রতি) — “নরেন্দ্র খুব ভাল; গাইতে বাজাতে, পড়ায় শুনায় বিদ্যায়; এদিকে জিতেন্দ্রিয়, বিবেক-বৈরাগ্য আছে, সত্যবাদী। অনেক গুণ।
(মাস্টারের প্রতি) — কেমন রে? কেমন গা, খুব ভাল নয়?”
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (জনান্তিকে, মাস্টারের প্রতি) — দেখ, ওর (গিরিশের) খুব অনুরাগ আর বিশ্বাস।
মাস্টার অবাক হইয়া গিরিশকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন। গিরিশ ঠাকুরের কাছে কয়েকদিন আসিতেছেন মাত্র। মাস্টার কিন্তু দেখিলেন যেন পূর্বপরিচিত — অনেকদিনের আলাপ — পরমাত্মীয় — যেন একসূত্রে গাঁথা মণিগণের একটি মণি।
নারাণ বলিলেন — মহাশয়! আপনার গান হবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ সেই মধুর কণ্ঠে মায়ের নামগুণগান করিতেছেন:
যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে।
মাকে তুমি দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে ৷৷
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন মা বলে ডাকে (মাঝে মাঝে) ৷৷
কুরুচি কুমন্ত্রী যত, নিকট হতে দিও নাকো,
জ্ঞান-নয়নকে প্রহরী রেখো, সে যেন সাবধানে থাকে ৷৷
ঠাকুর ত্রিতাপে তাপিত সংসারী জীবের ভাব আরোপ করিয়া মার কাছে অভিমান করিয়া গাইতেছেন:
গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না।
(ওমা) ও দুটি চরণ বিনে আমার মন, অন্য কিছু আর জানে না ৷৷
তপন-তনয় আমায় মন্দ কয়, কি বলিব তায় বল না।
ভবানী বলিয়ে, ভবে যাব চলে, মনে ছিল এই বাসনা ৷৷
অকুলপাথারে ডুবাবি আমারে (ওমা) স্বপনেও তাতো জানি না ৷৷
অহরহর্নিশি, শ্রীদুর্গানামে ভাসি, তবু দুখরাশি গেল না।
এবার যদি মরি ও হরসুন্দরী, তোর দুর্গানাম আর কেউ লবে না ৷৷
আর নিত্যানন্দময়ী ব্রহ্মানন্দের কথা গাইতেছেন:
শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা,
সুধাপানে ঢল ঢল ঢলে কিন্তু পড়ে না (মা)।
বিপরীত রতাতুরা, পদভরে কাঁপে ধরা,
উভয়ে পাগলের পারা, লজ্জা ভয় আর মানে না (মা)।
ভক্তেরা নিস্তব্ধ হইয়া গান শুনিতেছেন। তাঁহারা একদৃষ্টে ঠাকুরের অদ্ভুত আত্মহারা মাতোয়ারা ভাব দেখিতেছেন।
গান সমাপ্ত হইল। কিয়ৎকালে পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “আমার আজ গান ভাল হল না — সর্দি হয়েছে।”
============
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যাসমাগমে
ক্রমে সন্ধ্যা হইল। সিন্ধুবক্ষে যথায় অনন্তের নীল ছায়া পড়িয়াছে, নিবিড় অরণ্যমধ্যে, অম্বরস্পর্শী পর্বত শিখরে, বায়ুবিকম্পিত নদীর তীরে, দিগন্তব্যাপী প্রান্তরমধ্যে, ক্ষুদ্র মানবের সহজেই ভাবান্তর হইল। এই সূর্য চরাচর বিশ্বকে আলোকিত করিতেছিলেন, কোথায় গেলেন? বালক ভাবিতেছে, আবার ভাবিতেছেন — বালকস্বভাবাপন্ন মহাপুরুষ। সন্ধ্যা হইল। কি আশ্চর্য! কে এরূপ করিল? — পাখিরা পাদপশাখা আশ্রয় করিয়া রব করিতেছে। মানুষের মধ্যে যাঁহাদের চৈতন্য হইয়াছে, তাঁহারাও সেই আদি কবি কারণের কারণ পুরুষোত্তমের নাম করিতেছেন।
কথা কহিতে কহিতে সন্ধ্যা হইল। ভক্তেরা যে যে-আসনে বসিয়াছিলেন, তিনি সেই আসনেই বসিয়া রহিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মধুর নাম করিতেছেন, সকলে উদগ্রীব ও উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছেন। আমন মিষ্ট নাম তাঁরা কখনও শুনেন নাই — যেন সুধাবর্ষণ হইতেছে। এমন প্রেমমাখা বালকের মা মা বলে ডাকা, তাঁরা কখনও শুনেন নাই, দেখেন নাই। আকাশ, পর্বত, মহাসাগর, প্রান্তর, বন আর দেখিবার কি প্রয়োজন? গরুর শৃঙ্গ, পদাদি ও শরীরের অন্যান্য অংশ আর দেখিবার কি প্রয়োজন? দয়াময় গুরুদেব যে গরুর বাঁটের কথা বলিলেন, এই গৃহমধ্যে কি তাই দেখিতেছি? সকলের অশান্ত মন কিসে শান্তিলাভ করিল? নিরানন্দ ধরা কিসে আনন্দে ভাসিল? কেন ভক্তদের দেখিতেছি শান্ত আর আনন্দময়? এই প্রেমিক সন্ন্যাসী কি সুন্দর রূপধারী অনন্ত ঈশ্বর? এইখানেই কি দুগ্ধপানপিপাসুর পিপাসা শান্তি হইবে? অবতার হউন, আর নাই হউন, ইঁহারই চরণপ্রান্তে মন বিকাইয়াছে, আর যাইবার জো নাই! ইঁহারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা। দেখি, ইঁহার হৃদয়-সরোবরে সেই আদিপুরুষ কিরূপ প্রতিবিম্বিত হইয়াছেন।
ভক্তেরা কেহ কেহ ওইরূপ চিন্তা করিতেছেন ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীমুখবিগলিত হরিনাম, আর মায়ের নাম শ্রবণ করিয়া কৃতকৃতার্থ বোধ করিতেছেন। নামগুণকীর্তনান্তে ঠাকুর প্রার্থনা করিতেছেন। যেন সাক্ষাৎ ভগবান প্রেমের দেহধারণ করিয়া জীবকে শিক্ষা দিতেছেন, কিরূপে প্রার্থনা করিতে হয়। বলিলেন, “মা আমি তোমার শরণাগত, শরণাগত! দেহসুখ চাই না মা! লোকমান্য চাই না, (অণিমাদি) অষ্টসিদ্ধি চাই না, কেবল এই করো যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় — নিষ্কাম অমলা, অহৈতুকী ভক্তি হয়। আর যেন মা, তোমার ভুবনমোহিনী মায়ার মুগ্ধ না হই — তোমার মায়ার সংসারে, কামিনী-কাঞ্চনের উপর ভালবাসা যেন কখন না হয়! মা! তোমা বই আমার আর কেউ নাই। আমি ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন — কৃপা করে শ্রীপাদপদ্মে আমায় ভক্তি দাও।”
মণি ভাবিতেছেন — ত্রিসন্ধ্যা যিনি তাঁর নাম করিতেছেন — যাঁর শ্রীমুখবিনিঃসৃত নামগঙ্গা তৈলধারার ন্যায় নিরবছিন্না, তাঁর আবার সন্ধ্যা কি? মণি পরে বুঝিলেন, লোকশিক্ষার জন্য ঠাকুর মানবদেহ ধারণ করিয়াছেন —
“হরি আপনি এসে, যোগীবেশে, করিলে নামসংকীর্তন।”
গিরিশ ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিলেন। সেই রাত্রেই যেতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — রাত হবে না?
গিরিশ — না, যখন ইচ্ছা আপনি যাবেন, আমায় আজ থিয়েটারে যেতে হবে। তাদের ঝগড়া মেটাতে হবে।
===========
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
রাজপথে শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত ঈশ্বরাবেশ
গিরিশের নিমন্ত্রণ! রাত্রেই যেতে হবে। এখন রাত ৯টা, ঠাকুর খাবেন বলে রাত্রের খাবার বলরামও প্রস্তুত করেছেন। পাছে বলরাম মনে কষ্ট পান, ঠাকুর গিরিশের বাড়ি যাইবার সময় তাই বুঝি বলিতেছেন, “বলরাম! তুমিও খাবার পাঠিয়ে দিও।”
দুতলা হইতে নিচে নামিতে নামিতেই ভগবদ্ভাবে বিভোর! যেন মাতাল। সঙ্গে নারাণ ও মাস্টার। পশ্চাতে রাম, চুনি ইত্যাদি অনেকে। একজন ভক্ত বলিতেছেন, “সঙ্গে কে যাবে?” ঠাকুর বলিলেন, “একজন হলেই হল।” নামিতে নামিতেই বিভোর। নারাণ হাত ধরিতে গেলেন, পাছে পড়িয়া যান। ঠাকুর বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে নারাণকে সস্নেহে বলিলেন, “হাত ধরলে লোকে মাতাল মনে করবে, আমি আপনি চলে যাব।”
বোসপাড়ার তেমাথা পার হচ্ছেন — কিছুদূরেই শ্রীযুক্ত গিরিশের বাড়ি। এত শীঘ্র চলছেন কেন? ভক্তেরা পশ্চাতে পড়ে থাকছে। না জানি হৃদয়মধ্যে কি অদ্ভুত দেবভাব হইয়াছে! বেদে যাঁহাকে বাক্য-মনের অতীত বলিয়াছেন, তাঁহাকে চিন্তা করিয়া কি ঠাকুর পাগলের মতো পাদবিক্ষেপ করিতেছেন? এইমাত্র বলরামের বাড়িতে বলিলেন যে, সেই পুরুষ বাক্য-মনের অতীত নহেন; তিনি শুদ্ধমনের, শুদ্ধবুদ্ধির, শুদ্ধ আত্মার গোচর। তবে বুঝি সেই পুরুষকে সাক্ষাৎকার করছেন! এই কি দেখছেন — “যো কুছ হ্যায়, সো তুঁহি হ্যায়?”
এই যে নরেন্দ্র আসিতেছেন। ‘নরেন্দ্র’ ‘নরেন্দ্র’ বলিয়া পাগল। কই, নরেন্দ্র সম্মুখে আসিলেন, ঠাকুর তো কথা কহিতেছেন না। লোকে বলে, এর নাম ভাব, এইরূপ কি শ্রীগৌরাঙ্গের হইত?
কে এ-ভাব বুঝিবে? গিরিশের বাড়ি প্রবেশ করিবার গলির সম্মুখে ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সঙ্গে ভক্তগণ। এইবার নরেন্দ্রকে সম্ভাষণ করিতেছেন।
নরেন্দ্রকে বলছেন, “ভাল আছ, বাবা? আমি তখন কথা কইতে পারি নাই।” — কথার প্রতি অক্ষর করুণা মাখা। তখনও দ্বারদেশে উপস্থিত হন নাই। এইবার হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িলেন।
নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, একটা কথা — এই একটি (দেহী?) ও একটি (জগৎ?)।
জীব জগৎ! ভাবে এ-সব কি দেখিতেছিলেন? তিনিই জানেন, অবাক্ হয়ে কি দেখছিলেন! দু-একটি কথা উচ্চারিত হইল, যেন বেদবাক্য — যেন দৈববানী — অথবা, যেন অনন্ত সমুদ্রের তীরে গিয়াছি ও অবাক্ হয়ে দাঁড়াইয়াছি; আর যেন অনন্ততরঙ্গমালোত্থিত অনাহত শব্দের একটি-দুটি ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল।
==========
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ঠাকুর ভক্তমন্দিরে — সংবাদপত্র — নিত্যগোপাল
আসন গ্রহণ করিতে গিয়া ঠাকুর দেখিলেন, একখানা খবরের কাগজ রহিয়াছে। খবরের কাগজে বিষয়ীদের কথা। বিষয়কথা, পরচর্চা, পরনিন্দা তাই অপবিত্র — তাঁহার চক্ষে। তিনি ইশারা করলেন, ওখানা যাতে স্থানান্তরিত করা হয়।
কাগজখানা সরানো হবার পর আসন গ্রহণ করিলেন।
নিত্যগোপাল প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নিত্যগোপালের প্রতি) — ওখানে?
নিত্য — আজ্ঞা হাঁ, দক্ষিণেশ্বরে যাই নাই। শরীর খারাপ। ব্যাথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেমন আছিস?
নিত্য — ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দুই-এক গ্রাম নিচে থাকিস।
নিত্য — লোক ভাল লাগে না। কত কি বলে — ভয় হয়। এক-একবার খুব সাহস হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হবে বইকি! তোর সঙ্গে কে থাকে?
নিত্য — তারক[1]। ও সর্বদা সঙ্গে থাকে, ওকেও সময়ে সময়ে ভাল লাগে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ন্যাংটা বলত, তাদের মঠে একজন সিদ্ধ ছিল। সে আকাশ তাকিয়ে চলে যেত; গণেশগর্জী — সঙ্গী যেতে বড় দুঃখ — অধৈর্য হয়ে গিছল।
বলিতে বলিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবান্তর হইল। কি ভাবে অবাক হয়ে রহিলেন। কিয়ৎ পরে বলিতেছেন, “তুই এসেছিস? আমিও এসেছি।”
এ কথা কে বুঝিবে? এই কি দেব-ভাষা?
১ শ্রী তারকনাথ ঘোষাল — শ্রীশিবানন্দ
==========
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পার্ষদসঙ্গে — অবতার সম্বন্ধে বিচার
ভক্তেরা অনেকেই উপস্থিত; — শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বসিয়া। নরেন্দ্র, গিরিশ, রাম, হরিপদ, চুনি, বলরাম, মাস্টার — অনেকে আছেন।
নরেন্দ্র মানেন না যে, মানুষদেহ লইয়া ঈশ্বর অবতার হন। এদিকে গিরিশের জ্বলন্ত বিশ্বাস যে, তিনি যুগে যুগে অবতার হন, আর মানবদেহ ধারণ করে মর্ত্যলোকে আসেন। ঠাকুরের ভারী ইচ্ছা যে, এ সম্বন্ধে দুজনের বিচার হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশকে বলিতেছেন, “একটু ইংরাজীতে দুজনে বিচার করো, আমি দেখবো!”
বিচার আরম্ভ হইল। ইংরেজীতে হইল না, বাংলাতেই হইল — মাঝে মাঝে দু-একটা ইংরেজী কথা। নরেন্দ্র বলিলেন, “ঈশ্বর অনন্ত। তাঁকে ধারণা করা আমাদের সাধ্য কি? তিনি সকলের ভিতরেই আছেন — শুধু একজনের ভিতর এসেছেন, এমন নয়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — ওরও যা মত আমারও তাই মত। তিনি সর্বত্র আছেন। তবে একটা কথা আছে — শক্তিবিশেষ। কোনখানে অবিদ্যাশক্তির প্রকাশ, কোনখানে বিদ্যাশক্তির। কোন আধারে শক্তি বেশি, কোন আধারে শক্তি কম। তাই সব মানুষ সমান নয়।
রাম — এ-সব মিছে তর্কে কি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্তভাবে) — না, না, ওর একটা মানে আছে।
গিরিশ (নরেন্দ্রের প্রতি) — তুমি কেমন করে জানলে, তিনি দেহধারণ করে আসেন না?
নরেন্দ্র — তিনি অবাঙ্মনোসোগোচরম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না; তিনি শুদ্ধবুদ্ধির গোচর। শুদ্ধবুদ্ধি শুদ্ধ-আত্মা একই, ঋষিরা শুদ্ধবুদ্ধি শুদ্ধ-আত্মা দ্বারা শুদ্ধ-আত্মাকে সাক্ষাৎকার করেছিলেন।
গিরিশ (নরেন্দ্রের প্রতি) — মানুষে অবতার না হলে কে বুঝিয়ে দেবে? মানুষকে জ্ঞানভক্তি দিবার জন্য তিনি দেহধারণ করে আসেন। না হলে কে শিক্ষা দেবে?
নরেন্দ্র — কেন? তিনি অন্তরে থেকে বুঝিয়ে দেবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — হাঁ হাঁ, অন্তর্যামীরূপে তিনি বুঝাবেন।
তারপর ঘোরতর তর্ক। ইনফিনিটি — তার কি অংশ হয়? আবার হ্যামিলটন্ কি বলেন? হার্বার্ট স্পেন্সার কি বলেন? টিণ্ডেল, হাক্সলে বা কি বলে গেছেন, এই কথা হতে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — দেখ, ইগুণো আমার ভাল লাগছে না। আমি সব তাই দেখছি। বিচার আর কি করবো? দেখছি — তিনিই সব। তিনিই সব হয়েছেন। তাও বটে, আবার তাও বটে। এক অবস্থায়, অখণ্ডে মনবুদ্ধিহারা হয়ে যায়! নরেন্দ্রকে দেখে আমার মন অখণ্ডে লীন হয়।
(গিরিশের প্রতি) — “তার কি করলে বল দেখি।”
গিরিশ (হাসিতে হাসিতে) — ওইটে ছাড়া প্রায় সব বুঝেছি কিনা। (সকলের হাস্য)
[রামানুজ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — আবার দু-থাক না নামলে কথা কইতে পারি না।
“বেদান্ত — শঙ্কর যা বুঝিয়েছেন, তাও আছে; আবার রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদও আছে।
নরেন্দ্র — বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রকে) — বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আছে — রামানুজের মত। কিনা, জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। সব জড়িয়ে একটি বেল। খোলা আলাদা, বীজ আলাদা, আর শাঁস আলাদা একজন করেছিল। বেলটি কত ওজনের জানবার দরকার হয়েছিল। এখন শুধু শাঁস ওজন করলে কি বেলের ওজন পাওয়া যায়? খোলা, বিচি, শাঁস সব একসঙ্গে ওজন করতে হবে। প্রথমে খোলা নয়, বিচি নয়, শাঁসটিই সার পদার্থ বলে বোধ হয়। তারপর বিচার করে দেখে, — যেই বস্তুর শাঁস সেই বস্তুরই খোলা আর বিচি। আগে নেতি নেতি করে যেতে হয়। জীব নেতি, জগৎ নেতি এইরূপ বিচার করতে হয়; ব্রহ্মই বস্তু আর সব অবস্তু। তারপর অনুভব হয়, যার শাঁস তারই খোলা, বিচি। যা থেকে ব্রহ্ম বলছো তাই থেকে জীবজগৎ। যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। তাই রামানুজ বলতেন, জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। এরই নাম বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।”
=============
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ঈশ্বরদর্শন (God Vision) — অবতার প্রত্যক্ষসিদ্ধ
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — আমি তাই দেখছি সাক্ষাৎ — আর কি বিচার করব? আমি দেখছি, তিনিই এইসব হয়েছেন। তিনিই জীব ও জগৎ হয়েছেন।
“তবে চৈতন্য না লাভ করলে চৈতন্যকে জানা যায় না। বিচার কতক্ষণ? যতক্ষণ না তাঁকে লাভ করা যায়; শুধু মুখে বললে হবে না, এই আমি দেখছি তিনিই সব হয়েছেন। তাঁর কৃপায় চৈতন্য লাভ করা চাই! চৈতন্য লাভ করলে সমাধি হয়, মাঝে মাঝে দেহ ভুল হয়ে যায়, কামিনী-কাঞ্চনের উপর আসক্তি থাকে না, ঈশ্বরীয় কথা ছাড়া কিছু ভাল লাগে না; বিষয়কথা শুনলে কষ্ট হয়।”
[প্রত্যক্ষ (Revelation) — নরেন্দ্রকে শিক্ষা –কালীই ব্রহ্ম [1]]
“চৈতন্য লাভ করলে তবে চৈতন্যকে জানতে পারা যায়।”
বিচারান্তে ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন —
“দেখেছি, বিচার করে একরকম জানা যায়, তাঁকে ধ্যান করে একরকম জানা যায়। আবার তিনি যখন দেখিয়ে দেব — এর নাম অবতার — তিনি যদি তাঁর মানুষলীলা দেখিয়ে দেন, তাহলে আর বিচার করতে হয় না, কারুকে বুঝিয়ে দিতে হয় না! কিরকম জানো? যেমন অন্ধকারের ভিতর দেশলাই ঘষতে ঘষতে দপ্ করে আলো হয়। সেইরকম দপ্ করে আলো যদি তিনি দেন, তাহলে সব সন্দেহ মিটে যায়। এরূপ বিচার করে কি তাঁকে জানা যায়?
ঠাকুর নরেন্দ্রকে কাছে ডাকিয়া বসাইলেন ও কুশল প্রশ্ন ও কত আদর করিতেছেন।
নরেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — কই কালীর ধ্যান তিন-চারদিন করলুম, কিছুই তো হল না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ক্রমে হবে। কালী আর কেউ নয়, যিনিই ব্রহ্ম, তিনিই কালী। কালী আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন তখন শক্তি বলে কই। যাঁকে তুমি ব্রহ্ম বলছো, তাঁকেই কালী বলছি।
“ব্রহ্ম আর কালী অভেদ। যেমন অগ্নি আর দাহিকাশক্তি। অগ্নি ভাবলেই দাহিকাশক্তি ভাবতে হয়। কালী মানলেই ব্রহ্ম মানতে হয়, আবার ব্রহ্ম মানলেই কালী মানতে হয়।
“ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। ওকেই শক্তি, ওকেই কালী আমি বলি।”
এদিকে রাত হয়ে গেছে। গিরিশ হরিপদকে বলিতেছেন, ভাই একখানা গাড়ি যদি ডেকে দিস — থিয়েটারে যেতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — দেখিস যেন আনিস! (সকলের হাস্য)
হরিপদ (সহাস্যে) — আমি আনতে যাচ্ছি — আর আনবো না?
[ঈশ্বরলাভ ও কর্ম — রাম ও কাম ]
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আপনাকে ছেড়ে আবার থিয়েটারে যেতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, ইদিক-উদিক দুদিক রাখতে হবে; ‘জনক রাজা ইদিক-উদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি।” (সকলের হাস্য)
গিরিশ — থিয়েটারগুলো ছোঁড়াদেরই ছেড়ে দিই মনে করছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না না, ও বেশ আছে; অনেকের উপকার হচ্ছে।
নরেন্দ্র (মৃদুস্বরে) — এই তো ঈশ্বর বলছে, অবতার বলছে! আবার থিয়েটার টানে।
১ কালী — God in His relations to the conditioned.
ব্রহ্ম — The Unconditioned, the Absolute.
============
নবম পরিচ্ছেদ
সমাধিমন্দিরে — গরগরমাতোয়ারা শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে কাছে বসাইয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন, হঠাৎ তাঁহার সন্নিকটে আরও সরিয়া গিয়া বসিলেন। নরেন্দ্র অবতার মানেন নাই — তায় কি এসে যায়? ঠাকুরের ভালবাসা যেন আরও উথলিয়া পড়িল। গায়ে হাত দিয়া নরেন্দ্রের প্রতি কহিতেছেন, ‘মান কয়লি তো কয়লি, আমরাও তোর মানে আছি (রাই)!’
[বিচার ঈশ্বরলাভ পর্যন্ত ]
(নরেন্দ্রের প্রতি) — “যতক্ষণ বিচার, ততক্ষণ তাঁকে পায় নাই। তোমরা বিচার করছিলে, আমার ভাল লাগে নাই।
“নিমন্ত্রণবাড়ির শব্দ কতক্ষণ শুনা যায়? যতক্ষণ লোকে খেতে না বসে। যাই লুচি তরকারী পড়ে, অমনি বার আনা শব্দ কমে যায়। (সকলের হাস্য) অন্য খাবার পড়লে আরও কমতে থাকে। দই পাতে পাতে পড়লে কেবল সুপ্ সাপ্। ক্রমে খাওয়া হয়ে গেলেই নিদ্রা।
“ঈশ্বরকে যত লাভ হবে, ততই বিচার কমবে। তাঁকে লাভ হলে আর শব্দ বিচার থাকে না। তখন নিদ্রা — সমাধি।”
এই বলিয়া নরেন্দ্রের গায় হাত বুলাইয়া, মুখে হাত দিয়া আদর করিতেছেন ও বলিতেছেন, “হরি ওঁ, হরি ওঁ, হরি ওঁ।”
কেন এরূপ করিতেছেন ও বলিতেছেন? শ্রীরামকৃষ্ণ কি নরেন্দ্রের মধ্যে সাক্ষাৎ নারায়ণ দর্শন করিতেছেন? এরই নাম কি মানুষে ঈশ্বরদর্শন? কি আশ্চর্য! দেখিতে দেখিতে ঠাকুরের সংজ্ঞা যাইতেছে। ওই দেখ বর্হিজগতের হুঁশ চলিয়া খাইতেছে। এরই নাম বুঝি অর্ধবাহ্যদশা — যাহা শ্রীগৌরাঙ্গের হইয়াছিল। এখনও নরেন্দ্রের পায়ের উপর হাত — যেন ছল করিয়া নারায়ণের পা টিপিতেছেন –আবার গায়ে হাত বুলাইতেছেন। এত গা-টেপা, পা-টেপা কেন? একি নারায়ণের সেবা করছেন, না শক্তি সঞ্চার করছেন?
দেখিতে দেখিতে আরও ভাবান্তর হইতেছে। এই আবার নরেন্দ্রের কাছে হাতজোড় করে কি বলছেন! বলছেন — “একটা গান (গা) — তাহলে ভাল হবো; — উঠতে পারবো কেমন করে! গোরাপ্রেমে গরগরমাতোয়ারা (নিতাই আমার) –”
কিয়ৎক্ষণ আবার অবাক্, চিত্রপুত্তলিকার মতো চুপ করে রহিয়াছেন। আবার ভাবে মাতোয়ারা হয়ে বলছেন —
“দেখিস রাই — যমুনায় যে পড়ে যাবি — কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী”।
আবার ভাবে বিভোর! বলিতেছেন —
“সখি! সে বন কত দূর! (যে বনে আমার শ্যামসুন্দর)।
(ওই যে কৃষ্ণগন্ধ পাওয়া যায়)! (আমি চলতে যে নারি)!”
এখন জগৎ ভুল হয়েছে — কাহাকেও মনে নাই — নরেন্দ্র সম্মুখে, কিন্তু নরেন্দ্রকে আর মনে নাই — কোথায় বসে আছেন, কিছুই হুঁশ নাই। এখন যেন মন-প্রাণ ঈশ্বরে গত হয়েছে! ‘মদ্গত-অন্তরাত্মা।’
“গোরা প্রেমে গরগরমাতোয়ারা!” এই কথা বলিতে বলিতে হঠাৎ হুঙ্কার দিয়া দণ্ডায়মান! আবার বসিতেছেন, বসিয়া বলিতেছেন —
“ওই একটা আলো আসছে দেখতে পাচ্ছি, — কিন্তু কোন দিক্ দিয়ে আলোটা আসছে এখনও বুঝতে পারছি না।”
এইবার নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন:
সব দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে — মোহিলে প্রাণ।
সপ্তলোক ভুলে শোক, তোমারে পাইয়ে —
কোথায় আমি অতি দীন-হীন ৷৷
গান শুনিতে শুনিতে শ্রীরামকৃষ্ণের বহির্জগত ভুল হইয়া আসিতেছে। আবার নিমীলিত নেত্র! স্পন্দহীন দেহ! সমাধিস্থ!
সমাধিভঙ্গের পর বলিতেছেন, “আমাকে কে লয়ে যাবে?” বালক যেমন সঙ্গী না দেখলে অন্ধকার দেখে সেইরূপ।
অনেক রাত হইয়াছে। ফাল্গুন কৃষ্ণা দশমী — অন্ধকার রাত্রি। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে যাইবেন। গাড়িতে উঠিবেন। ভক্তেরা গাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া। তিনি উঠিতেছেন — অনেক সন্তর্পণে তাঁহাকে উঠান হইতেছে। এখনও ‘গরগরমাতোয়ারা!’
গাড়ি চলিয়া গেল। ভক্তেরা যে যার বাড়ি যাইতেছেন।
===========
দশম পরিচ্ছেদ
সেবকহৃদয়ে
মস্তকের উপরে তারকামণ্ডিত নৈশগগন — হৃদয়পটে অদ্ভুত শ্রীরামকৃষ্ণ ছবি, স্মৃতিমধ্যে ভক্তের মজলিস — সুখস্বপ্নের ন্যায় নয়নপথে সেই প্রেমের হাট — কলিকাতার রাজপথে স্বগৃহাভিমুখে ভক্তেরা যাইতেছেন। কেহ সরস বসন্তানিল সেবন করিতে করিতে সেই গানটি আবার গাইতে গাইতে যাচ্ছেন —
“সব দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে — মোহিলে প্রাণ!”
মণি ভাবতে ভাবতে যাচ্ছেন, “সত্য সত্যই কি ঈশ্বর মানুষদেহ ধারণ করে আসেন? অনন্ত কি সান্ত হয়? বিচার তো অনেক হল। কি বুঝলাম বিচারের দ্বারা কিছুই বুঝলাম না।
“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বেশ বললেন, ‘যতক্ষণ বিচার ততক্ষণ বস্তুলাভ হয় নাই, ততক্ষণ ঈশ্বরকে পাওয়া যায় নাই।’ তাও বটে! এই তো এক ছটাক বুদ্ধি; এর দ্বারা আর কি বুঝবো ঈশ্বরের কথা! একসের বাটিতে কি চার সের দুধ ধরে? তবে আবতার বিশ্বাস কিরূপে হয়? ঠাকুর বললেন, ঈশ্বর যদি দেখিয়ে দেন দপ্ করে, তাহলে এক দণ্ডেই বুঝা যায়! Goethe মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, Light! More Light! তিনি যদি দপ্ করে আলো জ্বেলে দেখিয়ে দেন তবে — ‘ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।’
“যেমন প্যালেস্টাইন-এর মূর্খ ধীবরেরা Jesus-কেL অথবা যেমন শ্রীবাসাদি ভক্ত শ্রীগৌরাঙ্গকে পূর্ণাবতার দেখেছিলেন।
“যদি দপ্ করে তিনি না দেখান তাহলে উপায় কি? কেন, যেকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন ও-কথা, সেকালে অবতার বিশ্বাস করব। তিনিই শিখিয়েছেন — বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস! গুরুবাক্যে বিশ্বাস! আর —
“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ৷৷”
“আমার তাঁর বাক্যে — ইশ্বর কৃপায় বিশ্বাস হয়েছে; — আমি বিশ্বাস করব, অন্যে যা করে করুক; আমি এই দেবদুর্লভ বিশ্বাস কেন ছাড়ব? বিচার থাক। জ্ঞান চচ্চড়ি করে কি একটা Faust হতে হবে? গভীর রজনীমধ্যে বাতায়নপথে চন্দ্রকিরণ আসিতেছে, আর Faust নাকি একাকী ঘরের মধ্যে ‘হায় কিছু জানিতে পারিলাম না, সায়েন্স, ফিলসফি বৃথা অধ্যয়ন করিলাম, এই জীবনে ঘিক্!’ এই বলিয়া বিষের শিশি লইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিলেন! না, Alastor-Hlএর মতো অজ্ঞানের বোঝা বইতে না পেরেও শিলাখণ্ডের উপর মাথা রেখে মৃত্যুর অপেক্ষা করিব! না, আমার এ-সব ভয়ানক পণ্ডিতদের মতো একছটাক জ্ঞানের দ্বারা রহস্য ভেদ করতে যাবার প্রয়োজন নাই! বেশ কথা — গুরুবাক্যে বিশ্বাস। হে ভগবন্, আমায় ওই বিশ্বাস দাও; আর মিছামিছি ঘুরাইও না। যা হবার নয়, তা খুঁজতে যাওয়াইও না। আর ঠাকুর যা শিখিয়েছেন, ‘যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়, — অমলা অহৈতুকি ভক্তি; আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’ কৃপা করে এই আশীর্বাদ কর।
“শ্রীরামকৃষ্ণের অদৃষ্টপূর্ব প্রেমের কথা ভাবিতে ভাবিতে মণি সেই তমসাচ্ছন্ন রাত্রি মধ্যে রাজপথ দিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইতেছেন ও ভাবিতেছেন, ‘কি ভালবাসা গিরিশকে! গিরিশ থিয়েটারে চলে যাবেন, তবু তাঁর বাড়িতে যেতে হবে। শুধু তা নয়! এমনও বলছেন না যে, সব ত্যাগ কর — আমার জন্য গৃহ-পরিজন, বিষয়কর্ম সব ত্যাগ করে সন্ন্যাস অবলম্বন কর।’ বুঝেছি — এর মানে এই যে, সময় না হলে, তীব্র বৈরাগ্য না হলে, ছাড়লে কষ্ট হবে; ঠাকুর যেমন নিজে বলেন, ঘায়ের মাম্ড়ি ঘা শুকুতে না শুকুতে ছিঁড়লে, রক্ত পড়ে কষ্ট হয়, কিন্তু ঘা শুকিয়ে গেলে মাম্ড়ি আপনি খসে পড়ে যায়। সামান্য লোকে, যাদের অন্তর্দৃষ্টি নাই, তারা বলে, এখনি সংসারত্যাগ কর। ইনি সদ্গুরু, অহেতুক কৃপাসিন্ধু, প্রেমের সমুদ্র, জীবের কিসে মঙ্গল হয় এই চেষ্টা নিশিদিন করিতেছেন।
“আর গিরিশের কি বিশ্বাস! দুদিন দর্শনের পরই বলেছিলেন, ‘প্রভু, তুমিই ঈশ্বর — মানুষদেহ ধারণ করে এসেছ — আমার পরিত্রাণের জন্য।’ গিরিশ ঠিক তো বলেছেন, ঈশ্বর মানুষদেহ ধারণ না করলে ঘরের লোকের মতো কে শিক্ষা দেবে, কে জানিয়ে দেবে, ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু, কে ধরায় পতিত দুর্বল সন্তানকে হাত ধরে তুলবে? কে কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত পাশব-স্বভাবপ্রাপ্ত মানুষকে আবার পূর্ববৎ অমৃতের অধিকারী করবে? আর তিনি মানুষরূপে সঙ্গে সঙ্গে না বেড়ালে যাঁরা তদ্গতান্তরাত্মা, যাঁদের ঈশ্বর বই আর কিছু ভাল লাগে না তাঁরা কি করে দিন কাটাবেন? তাই —
‘পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ৷৷’[1]
“কি ভালবাসা! — নরেন্দ্রের জন্য পাগল, নারায়ণের কন্য ক্রন্দন। বলেন, ‘এরা ও অন্যান্য ছেলেরা — রাখাল, ভবনাথ, পূর্ণ, বাবুরাম ইত্যাদি — সাক্ষাৎ নারায়ণ, আমার জন্য দেহধারণ করে এসেছে!” এ প্রেম তো মানুষ জ্ঞানে নয়, এ প্রেম দেখছি ঈশ্বরপ্রেম! ছেলেরা শুদ্ধ-আত্মা, স্ত্রীলোক অন্যভাবে স্পর্শ করে নাই; বিষয়কর্ম করে এদের লোভ, অহংকার, হিংসা ইত্যাদি স্ফূর্তি হয় নাই, তাই ছেলেদের ভিতর ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ। কিন্তু এ-দৃষ্টি কার আছে? ঠাকুরের অন্তর্দৃষ্টি; সমস্ত দেখিতেছেন — কে বিষয়াসক্ত, কে সরল উদার, ঈশ্বরভক্ত! তাই এরূপ ভক্ত দেখলেই সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে সেবা করেন। তাদের নাওয়ান, শোয়ান, তাদের দেখিবার জন্য কাঁদেন; কলিকাতায় ছুটিয়া ছুটিয়া যান। লোকের খোশামোদ করে বেড়ান কলিকাতা থেকে তাদের গাড়ি করে আনতে; গৃহস্থ ভক্তদের সর্বদা বলেন, ‘ওদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াইয়ো; তাহলে তোমাদের ভাল হবে।’ একি মায়িক স্নেহ? না, বিশুদ্ধ ঈশ্বরপ্রেম? মাটির প্রতিমাতে এত ষোড়শোপচারে ঈশ্বরের পূজা ও সেবা হয়, আর শুদ্ধ নরদেহে কি হয় না? তা ছাড়া এরাই ভগবানের প্রত্যেক লীলার সহায়! জন্মে জন্মে সাঙ্গোপাঙ্গ!
“নরেন্দ্রকে দেখতে দেখতে বাহ্যজগৎ ভুলে গেলেন; ক্রমে দেহী নরেন্দ্রকে ভুলে গেলেন। বাহ্যিক মনুষ্যকে (Apparent man) ভুলে গেলেন; প্রকৃত মনুষ্যকে (Real man) দর্শন করতে লাগিলেন; অখণ্ড সচ্চিদানন্দে মন লীন হইল, যাঁকে দর্শন করে কখনও অবাক্ স্পন্দনহীন হয়ে চুপ করে থাকেন, কখনও বা ওঁ ওঁ বলেন; কখন বা মা মা করে বালকের মতো ডাকেন, নরেন্দ্রের ভিতর তাঁকে বেশি প্রকাশ দেখেন। নরেন্দ্র নরেন্দ্র করে পাগল!
“নরেন্দ্র অবতার মানেন নাই, তার আর কি হয়েছে। ঠাকুরের দিব্যচক্ষু; তিনি দেখিলেন যে, এ অভিমান হতে পারে। তিনি যে বড় আপনার লোক, তিনি যে আপনার মা, পাতানো মা তো নন। তিনি কেন বুঝিয়ে দেন না, তিনি কেন দপ্ করে আলো জ্বেলে দেন না! তাই বুঝি ঠাকুর বললেন —
‘মান কয়লি তো কয়লি, আমরাও তোর মানে আছি।’
“আত্মীয় হতে যিনি পরমাত্মীয় তাঁর উপর অভিমান করবে না তো কার উপর করবে? ধন্য নরেন্দ্রনাথ, তোমার উপর এই পুরুষোত্তমের এত ভালবাসা! তোমাকে দেখে এত সহজে ঈশ্বরের উদ্দীপন!”
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে সেই গভীর রাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ স্মরণ করিতে করিতে ভক্তেরা গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছেন।
১ গীতা, [৪।৮]
=========
0 Comments