সমাজ চেতনা
সমাজ চেতনায় স্বামী বিবেকানন্দ
আন্তর্জাতিক সংহতি, আন্তর্জাতিক সভঘ, আন্তর্জাতিক বিধান—ইহাই এ যুগের মূল মন্ত্র। ৫|১৩৬
******
ব্যষ্টির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে কি না এবং কত পরিমাণে হওয়া উচিত, সমষ্টির নিকট ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও সুখ একেবারে ত্যাগ করা উচিত কি না—এই প্রশ্নই সমাজের অনাদিকালের বিচার্য। এই প্রশ্নের সিদ্ধান্ত লইয়াই সকল সমাজ ব্যস্ত; আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে ইহাই প্রবল-তরঙ্গ-রূপ ধারণ করিয়া সমুখিত হইয়াছে। যে মত ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সমাজের প্রভুতার সম্মুখে বলি দিতে চায়, তাহারই ইংরাজী নাম ‘সােশ্যালিজ (Socialism), ব্যক্তিত্ব-সমর্থক মতের নাম ইণ্ডিভিজুয়ালিজম্ (Individualism)। ৮।১৬৭
******
অতি প্রকাণ্ড কলের জাহাজ, মহাবলবান রেলের ইঞ্জিন—তাহারাও জড়; চলে, ফেরে, ধাবমান। হয়, কিন্তু জড়। আর ঐ যে ক্ষুদ্রকীটাণুটি রেলের গাড়ির পথ হইতে আত্মরক্ষার জন্য সরিয়া গেল, ওটি চৈতন্যশালী কেন? যন্ত্রে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ নাই, যন্ত্র নিয়মকে অতিক্রম করিতে চায় না; কীটটি নিয়মকে বাধা দিতে চায়, পারুক বা নাই পারুক, নিয়মের বিপক্ষে উখিত হয়, তাই সে চেতন। এই ইচ্ছাশক্তির যেথায় যত সফল বিকাশ, সেথায় সুখ তত অধিক, সে জীব তত বড়। ... চালিত যন্ত্রের ন্যায় ভাল হওয়ার চেয়ে স্বাধীন ইচ্ছা—চৈতন্য-শক্তির প্রেরণায় মন্দ হওয়াও আমার মতে কল্যাণকর। আর এই মৃতপিণ্ডপ্রায়, প্রাণহীন যন্ত্রগুলির মতাে, উপলরাশির ন্যায় স্তূপীকৃত মনুষ্য-সমষ্টির দ্বারা যা-সমাজ গঠিত হয়, সে কি সমাজ? ৮]১৬৮
******
কাহারও সাধ্য নাই যে, সামাজিক নিয়মের প্রবর্তন করেন। সমাজের পশ্চাতে যখন তাক্কালিক আবশ্যকতার বেগ লাগে, তখন [উহা] আত্মরক্ষার জন্য আপনা-আপনি কতকগুলি আচারের আশ্রয় লয়। ৮|২২
******
সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার বাহিরের চেষ্টা দ্বারা হইবে না, মনের উপর কার্য করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা যতই লম্বা লম্বা কথা বলি না কেন, বুঝিতে হইবে-সমাজের দোষ সংশােধন করিতে হইলে প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা না করিয়া শিক্ষাদানের দ্বারা পরােক্ষভাবে উহার চেষ্টা করিতে হইবে। ৫|১০২
******
আমরা নির্বোধের মতাে জড়-সভ্যতার বিরুদ্ধে চিৎকার করিতেছি। না করিবই বা কেন? হাত বাড়াইয়া না পাইলে আঙুর টক’ বলিব নাতাে কি! ... বাহ্য (material) সভ্যতা আবশ্যক, শুধু তাহাই নহে; প্রয়ােজনের অতিরিক্ত বস্তুর ব্যবহারও আবশ্যক, যাহাতে গরিব লােকের জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়।
অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন—ইহা আমি বিশ্বাস করি না। ৭।৯
******
রাজনীতিক ও সামাজিক পরিবর্তন যতই হউক না কেন, মনুষ্য-জীবনের দুঃখকষ্ট কিছুতেই দূর হইবে না। কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধান করিতে পারিলেই সর্ব প্রকার দুঃখকষ্ট ঘুচিবে। যতই শক্তি প্রয়ােগ, যতই শাসন প্রণালীর পরিবর্তন, যতই আইনের কড়াকড়ি কর না কেন, কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করিতে পারিবে না। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাই কেবল অসৎ প্রবৃত্তি পরিবর্তিত করিয়া জাতিকে সৎপথে চালিত করিতে পারে। ৫।৭০
******
আমি যে একজন সমাজতন্ত্রী (Socialist)—তার কারণ এই নয় যে, আমি ঐ মত সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে মনে করি, কেবল ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’–এই হিসাবে। ... অপর কয়টি প্রথাই জগতে চলেছে, পরিশেষে সেগুলির ত্রুটি ধরা পড়েছে। অন্ততঃ আর কিছুর জন্য না হলেও অভিনবত্বের দিক থেকে এটিরও একবার পরীক্ষা করা যাক। একই লােক চিরকাল সুখ বা দুঃখ ভােগ করবে, তার চেয়ে সুখদঃখটা যাতে পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে, সেইটাই ভাল। ৭।৩০২
******
যথার্থ সাম্যভাব জগতে কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, এবং কখনও হইতেও পারে না। ১।১৪২
******
মানুষে মানুষে প্রভেদের কারণ কি?—প্রধানতঃ মস্তিষ্কের ভিন্নতা। আজকাল পাগল ছাড়া কেহই বলিবে না যে, আমরা সকলেই একরূপ মস্তিষ্কের শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। কেহ বড়, কেহ বা সামান্য হইয়া আসিয়াছি, জন্মের পূর্বে নির্ধারিত পরিবেশ অতিক্রম করা যায় না। ১।১৪৩
******
ও তােমার পার্লামেন্ট’ দেখলুম, সেনেট’ দেখলুম; ভােট ব্যালট মেজরিটি দেখলুম, রামচন্দ্র! সব দেশেই ঐ এক কথা। শক্তিমান পুরুষরা যেদিকে ইচ্ছে সমাজকে চালাচ্ছে, বাকিগুলাে ভেড়ার দল। তবে ভারতবর্ষে শক্তিমান পুরুষ কে? না ধর্মবীর। তাঁরা আমাদের সমাজকে চালান। ৬।১৬১
******
আজকাল গণতন্ত্র এবং সাম্যের কথা সকলেই বলে থাকে, কিন্তু একজন যে আর একজনের সমান, এ-কথা সে জানবে কি করে? এজন্য তার থাকা চাই—সবল মস্তিষ্ক এবং আজেবাজে ধারণা হইতে মুক্ত স্বচ্ছ একটি মন। ৮।৩২২
******
কিন্তু সামাজিক বা রাজনীতিক সর্ববিধ বিষয়ে সফলতার মূলভিত্তি—মানুষের সততা। পার্লামেন্ট কর্তৃক বিধিবদ্ধ কোন আইন দ্বারা কখনও কোন জাতি উন্নত বা ভাল হয় না, কিন্তু সেই জাতির অন্তর্গত লােকগুলি উন্নত ও ভাল হইলেই জাতিও ভাল হইয়া থাকে। ৯।৪৪২
0 Comments