শূদ্র-জাগরণে সমাজের ভূমিকা । স্বামী বিবেকানন্দ

শূদ্র-জাগরণ

শূদ্র-জাগরণ সমাজের ভূমিকা । স্বামী বিবেকানন্দ

শূদ্র-জাগরণ সমাজের ভূমিকা । স্বামী বিবেকানন্দ


মানুষ-সমাজ ক্রমান্বয়ে চারিটি বর্ণ দ্বারা শাসিত হয়—পুরােহিত (ব্রাহ্মণ), সৈনিক (ক্ষত্রিয়), ব্যবসায়ী (বৈশ্য), শ্রমিক (শূদ্র)। প্রত্যেকটির শাসনকালে রাষ্ট্রে দোষগুণ, উভয়ই বর্তমান।…

সর্বশেষে শূদ্ৰশাসন-যুগের আবির্ভাব হবে—এ যুগের সুবিধা এই যে, এ সময়ে শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিস্তার হবে, কিন্তু অসুবিধা এই যে, (হয়তাে) কৃষ্টির অবনতি ঘটবে। সাধারণ শিক্ষার পরিসর খুব বাড়বে বটে, কিন্তু সমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই কমে যাবে। ৭।৩০১
******
সত্ত্বাদি গুণত্রয়ের বৈষম্য-তারতম্য-প্রসূত ব্রাহ্মণাদি চতুর্বর্ণ সনাতন কাল হইতেই সকল সভ্য সমাজে বিদ্যমান আছে। কাল-প্রভাবে আবার দেশ-ভেদে ঐ চতুর্বর্ণের কোন কোনটির সংখ্যাধিক্য বা প্রতাপাধিক্য ঘটিতে থাকে, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস আলােচনায় বােধ হয় যে, প্রাকৃতিক নিয়মের বলে ব্রাহ্মণাদি চারি জাতি যথাক্রমে বসুন্ধরা ভােগ করিবে। ৬।২২৯
******
এ শূদ্রপূর্ণ দেশের শূদ্রদের কি কথা? ভারতের দেশের শূদ্রকুল যেন কিঞ্চিৎ বিনিদ্র হইয়াছে। কিন্তু তাহাদের বিদ্যা নাই, আর আছে শূদ্রসাধারণ স্বজাতিদ্বেষ। সংখ্যায় বহু হইলে কি হয়? যে একতাবলে দশ জনে দশ লক্ষ জনের শক্তি সংগ্রহ করে, সে একতা শূদ্রে এখনও বহু দূর; শূদ্রজাতি মাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।

কিন্তু আশা আছে। কালপ্রভাবে ব্রাহ্মণাদি বর্ণও শূদ্রের নির্মাসনে সমানীত হইতেছে এবং শূদ্রজাতিও উচ্চাসনে উত্তোলিত হইতেছে।..মহাবল চীন আমাদের সমক্ষেই দ্রুতপদসঞ্চারে ‘শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হইতেছে, নগণ্য জাপান খধূপতেজে শূদ্রত্ব দীরে ফেলিয়া ক্রমশঃ উচ্চবর্ণাধিকার আক্রমণ করিতেছে।

...এমন সময় আসিবে, যখন শূদ্রত্ব-সহিত শূদ্রের প্রাধান্য হইবে, অর্থাৎ বৈশ্যত্ব ক্ষত্রিয়ত্ব লাভ করিয়া শূদ্ৰজাতি যে প্রকার বলবীর্য বিকাশ করিতেছে তাহা নহে, শূদ্র-ধর্মকর্ম-সহিত সর্বদেশের শূদ্রেরা সমাজে একাধিপত্য লাভ করিবে।..যুগযুগান্তরে পেষণের ফলে শূদ্রমাত্রেয় হয় কুকুরবৎ পদলেহক, নতুবা হিংস্র পশুবৎ নৃশংস। আবার চিরকালই তাহাদের বাসনা নিষ্ফল, এজন্য দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় তাহাদের একেবারেই নাই! ৬।২৪১
******
এই যে চাষাভুষাে, মুচি-মুদ্দিফরাশ—এদের কর্মতৎপরতা ও আত্মনিষ্ঠা তােদের চেয়ে ঢের বেশি। এরা নীরবে চিরকাল কাজ করে যাচ্ছে, দেশের ধন-ধান্য উৎপন্ন করছে, মুখে কথাটি নেই। এরা শীঘ্রই তােদের উপরে উঠে যাবে। Capital (মূলধন) তাদের হাতে গিয়ে পড়ছে—ততাদের মতাে তাদের অভাবে তােদের অর্থাগমের উপায় হচ্ছে না। তারা নূতন নূতন উদ্বাবনী শক্তির অভাবে তােদের অর্থাগমের উপায় হচ্ছে না। তােরা এই সব সহিষ্ণু নীচ জাতদের ওপর এতদিন অত্যাচার করেছিস, এখন এরা তার প্রতিশােধ নেবে। আর তােরা ‘হা চাকরি, জো চাকরি করে করে লােপ পেয়ে যাবি।…

শ্রমজীবীরা কাজ বন্ধ করলে অন্নবস্ত্র জোটা না। এদের তােরা ‘ছােট লােক’ ভাবছিস, আর নিজেদের ‘শিক্ষিত’ বলে বড়াই করছিস? জীবন-সংগ্রামে সর্বদা ব্যস্ত থাকাতে নিম্ন শ্রেণীর লােকেদের এতদিন জ্ঞানােন্মেষ হয়নি। এরা মানবুদ্ধিনিয়ন্ত্রিত কলের মতাে একইভাবে এতদিন কাজ করে এসেছে, আর বুদ্ধিমান চতুর লােকেরা এদের পরিশ্রম ও উপার্জনের সারাংশ গ্রহণ করেছে; সকল দেশেই ঐ-রকম হয়েছে। কিন্তু এখন আর সেকাল নেই। ইতর জাতিরা ক্রমে ঐ-করা বুঝতে পাচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে সকলে মিলে দাঁড়িয়ে আপনাদের ন্যায্যগণ্ডা আদায় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।...

এখন হাজার চেষ্টা করলেও ভদ্রজাতেরা ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করলেই ভদ্রজাতদের কল্যাণ।...

তা না হলে কিন্তু তােদের (ভদ্রজাতিদের) কল্যাণ নেই।...এই জনসাধারণ যখন জেগে উঠবে, আর তাদের ওপর অত্যাচার বুঝতে পারবে—তখন তাদের ফুকারে তােরা কোথায় উড়ে যাবে! তারাই তােদের কোথায় উড়ে যাবি! তারাই তােদের ভেতর (সভ্যতা) এনে দিয়েছে, তারাই আবার তখন সব ভেঙে দেবে।...

এইজন্য বলি, এই সব নীচজাতদের ভিতর বিদ্যাদান জ্ঞানদান করে এদের ঘুম ভাঙাতে যত্নশীল হ। এরা যখন জাগবে—আর একদিন জাগবে নিশ্চয়ই—তখন তারাও তােদের কৃত উপকার বিস্মৃত হবে না, তােদের নিকট কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। ৯।১০৭
******

Post a Comment

0 Comments