সকলের রামকৃষ্ণ ~ Free PDF Online

সকলের রামকৃষ্ণ

সকলের রামকৃষ্ণ ~ Free PDF Online

**********

পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ 


বাংলা বানােশো বিয়াল্লিস সালের ছয়ুই ফাল্গুন, ইংরেজী আঠারাে শাে ছত্রিশ খৃষ্টাব্দের সতেরােই ফেব্রুয়ারী, বুধবার, ব্রাহ্মমুহূর্তে আবির্ভূত হলেন রামকৃষ্ণ।
বাপ ক্ষুদিরাম। মা চন্দ্রমণি। থাকেন কামারপুকুরে, হুগলী জেলার ছােট্ট অখ্যাত পল্লীতে।
রামকৃষ্ণ জন্ম নিলেন টেঁকিশালে। কিন্তু, এ কি, ছেলে কই ? ধাই ধনী কামারণী চেঁচিয়ে উঠলাে। দেখা দিয়েই অন্তর্হিত হয়ে গেলে নাকি ?
ও মা, দেখেছো? পিছল মাটিতে হড়কে হড়কে ধানসেদ্ধর উনুনের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে। উনুনে আগুন নেই এখন, কিন্তু ছাই আছে গাদা করা। ছেলেকে কোলে টেনে নিলাে ধনী। ছাই-মাখা ছেলে। ভাস্বর ভস্মভূষণ।
গয়ায় গিয়ে ক্ষুদিরাম স্বপ্ন দেখেছিলেন, গদাধর তাঁর ঘরে পুত্র হয়ে। তাই ছেলের নাম রাখলেন গদাধর। ডাক নাম গদাই। বড়াে-সড় হয়ে উঠেছে গদাধর। চন্দ্রমণি তাকে নতুন ধুতি পরিছেন। ফালা ফালা করে গদাধর তা ছিড়ে ফেলেছে। এক ফালা নিয়ে দিব্যি পরেছে ডাের কপনি করে। 
‘এ কি, এ তুই কী হয়েছিস ?” চন্দ্রমণি আঁৎকে উঠলেন। 
‘অতিথি হয়েছি।
 ‘অতিথি ? সে আবার কী?
বুঝিয়ে দিলাে গদাধর : ‘লাহাবাবুদের অতিথিশালায় যারা আসে তাদেরকে অতিথি বলে না?’
‘তারা তাে সব সন্যাসী। সন্যাসীর বেশ তুই পছন্দ করলি? মার মন দু করে উঠলো। আস্ত কাপড় দিলাম, তা ছিড়ে কৌপীন বানালি !
পাঁচ বছরের ছেলে গদাধর, পাততাড়ি বগলে করে ঢুকলাে পাঠশালায়।
শুভঙ্করীটাই গােলমেলে। দু'চক্ষে ওটা দেখতে পারে না গদাধর। তারপর কষ্টেসৃষ্টে যােগ যদি বা হলাে, বিয়ােগ কিছুতেই বাগে আনতে পারলাে না।
কী করেই বা পারবে ? যােগে আছে সর্বক্ষণ, তাই যােগ করায়। কিন্তু বিয়ােগ আবার কী! কোথাও লয়-ক্ষয় নেই, বিয়ােগ-বিচ্ছেদ নেই। কিছু থেকে কিছুই এখানে বাদ যায় না।
তার চেয়ে প্রহলাদ চরিত্র পড়তে দাও, মাথুর গাইতে দাও, সবাইকে মাতিয়ে দেবে গদাধর। শিবরাত্রিতে পাইনদের বাড়িতে যাত্রা হবে, কিন্তু শিব যে সাজবে সে ছোঁড়ার দেখা নেই। যাত্রা বন্ধ হলে রাত্রি জাগরণ হয় না, সবাই ধরাধরি করে গদাধরকে শিব সাজিয়ে নামিয়ে দিলাে আসরে।
বালক গদাধর কোথায়, অবিকল শিব। মাথায় রুক্ষবর্ণ জটাভার,
সকলের রামকৃষ্ণ গায়ে বিভূতির আচ্ছাদন। এক হাতে শিঙা অন্য হাতে ত্রিশূল। কণ্ঠে ও বাহুতে নাগ খেলা করছে ফণা তুলে, শেখরে খেলা করছে শশধর।
অভাবনীয় আনন্দের ঢেউ খেলে গেলাে চারিদিকে। মেয়েরা উলু দিয়ে উঠলাে। কেউ কেউ শাঁখ বাজালাে। হরিধ্বনি করে উঠলো পুরুষেরা। স্বয়ং অধিকারী শিবস্তুতি শুরু করলেন।

ধানক্ষেতের সরু আল ধরে চলেছে গদাধর। কেঁচড়ে মুড়ি, তাই তুলে তুলে চিবুচ্ছে থেকে থেকে। আকাশ কালাে মেঘে ছেয়ে গেছে, তাকালাে চোখ তুলে। দেখলাে, এক ঝাঁক সাদা বক সেই কালাে মেঘের গা ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে দূরে দূরান্তরে। কালােয় আর সাদায় এক দিব্য কাব্য রচিত হয়েছে আকাশের বুকে। গদাধরের সারা শরীরে শিহরণ জাগলাে। প্রাণ-মন উড়ে চললাে পাখা মেলে। দেহ পিঞ্জর লুটিয়ে পড়লাে মাটিতে। এই প্রথম ভাব সমাধি গদাধরের।
সাত পেরিয়ে আটে পড়েছে, পৈতে দিতে হয় ছেলেটাকে। দাদার কোমর বেঁধেছেন।
পৈতে তাে হলাে, কিন্তু ভিক্ষ দেবে কে ? গদাধর গোঁ ধরলাে, ‘ধনী কামারণী ছাড়া আর কারুর হাতে ভিক্ষে নেব না।' 
সে কি কথা! ধনী ছছাটো জাতের মেয়ে, সে কী করে ভিক্ষে দেবে ? কুলাচার লঙ্ঘন হয়ে যাবে যে ! 
কিসের কুলাচার ? কিসের জাত-বেজাত ? প্রাণ চাইছে ধনীকে মা বললাে, তার কাছে কোনাে বিধিনিষেধ মানবে না তােমরা তােমাদের বানাই নিয়ে থাকো, আমি না খেয়ে উপােস করে থাকবে। এই খিল দিলাম দরজায়।
কতো জনের কতাে কাকুতি-মিনতি, তবু দরজা খােলে না গদাধর। বালক অথচ বিপ্লবী গদাধর।
শেষকালে বড়দা রামকুমার বললেন, ‘বেশ, ধনী কামারণীই ভিক্ষে দেবে। খােল দরজা। কুলাচার নষ্ট হয় হােক, তবু তোকে উপপাসী দেখতে পারব না।'
দরজা খুলে দিলে গদাধর।

গ্রামে বিশেষ লেখাপড়া হচ্ছে না, গদাধরকে তাই কলকাতায় নিয়ে এসেছেন রামকুমার। নিজে পুরোতগিরি করে বিশেষ উপার্জন করতে পারছেন না, তাই টোল খুলেছেন। ইচ্ছে গদাধরকে সেই টোলে ভর্তি করে দেন। 
‘এবার একটু লেখাপড়া কর্। 
লেখাপড়া? গদাধর সরল চোখে তাকিয়ে রইলাে। 
‘হ্যা, এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম লেখাপড়ায় তাের একেবারে মন নেই। পাড়ার ছোঁড়াদের সঙ্গে গাঁ-ময় ঘুরে বেড়াস, নয়তাে যাত্রাদলে গিয়ে শিব সাজিস। ও-সবে পেট ভরবে না। লেখাপড়া করতে হবে।
“কিন্তু শিখবাে কী ?
 ‘শাস্ত্র—ব্যাকরণ— 
‘দাদা, চাল-কলা বাঁধা বিদ্যে শিখে আমার কী হবে? 
‘তার মানে ?
 ‘অর্থকরী বিদ্যে, ঘর সাজানাে বিদ্যে আমি চাই না।
 ‘তবে তুই কী চাস? 
‘আমি চাই জ্ঞান।
 “সে আবার কী?
‘এক জানার নাম জ্ঞান, আর অনেক জানার নামও জ্ঞান।' বললে গদাধর, ‘যদি জানতে হয় আমি সেই একপরমেশ্বরকেই জানবাে।’
রাসমণির কালীমন্দিরে, দক্ষিণেশ্বরে, ঠাঁই পেলো গদাধর।

মাতৃভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ 


মাকে ঠাকুর নিয়ে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুরের দুই মা। ঘরের মা চন্দ্রমণি আর বিশ্বের মা ভবতারিণী। ঘরের মা থাকেন ঘরে, আর বিশ্বের মা মন্দিরে।
ঘরই মন্দির, মন্দিরই ঘর। 
ঘরের মাকে তিনি মহিমান্বিত করেন জগজ্জননীতে, আবার জগজ্জননীকে রূপান্তরিত করেন ঘরের মায়ে। যিনি প্রতাপ ও ঐশ্বর্যের মুকুট পরে রাজেন্দ্রাণী সেজেছেন তিনিই আবার রুগ্ন সন্তানের শিয়রে দীনবাস ম্লানমুখী বিনিদ্র জননী।।
ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে চন্দ্রমণিকে প্রণাম করেন। তারপরে ভবতারিণীর দুয়ারে। আগে ধারিণী, তারপরে তারিণী।
‘কোথায় তােরা ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস কোন্ গহন কাননে, কোন পথে-পর্বতে? ঠাকুর ডেকে বললেন বিশ্বজনকে : ‘ঈশ্বর তাের ঘরে তাের সংসারেই বিরাজ করছেন। শুধু ভাবের ঈশ্বর নয়, জীবন্ত ঈশ্বর ! অজানা ঈশ্বর নয়, অন্তরঙ্গ ঈশ্বর। নির্বাক বধির ঈশ্বর নয়, দয়াময় দ্রব্যময় ঈশ্বর ! সে ঈশ্বর তাের বাপ-মা।
তাের সীতা-রাম। তাের হর-গৌরী। তোর লক্ষ্মী-নারায়ণ। তাের আদিত্য আর চন্দ্রমা।
‘বাপ-মা কত বড়াে বস্তু।' বললেন ঠাকুর, বাপ-মাকে ফাকি দিয়ে যে ধর্ম করবে তার ছাই হবে।’
যখন তােতাপুরী এলাে দক্ষিণেশ্বরে, ঠাকুরকে দেখে লাফিয়ে উঠলাে। বেদান্ত-সাধনের এই তাে যােগ্য লােক। বেদান্ত সাধন মানে ভাবাতীত অরূপের সাধন। নির্বিকল্প সমাধি।
‘সাধন-ভজন কিছু করবে ?’ জিগ্যেস করলাে তােতাপুরী। 
‘তার আমি কি জানি!' সরল চোখে তাকিয়ে রইলেন রামকৃষ্ণ। 
‘তুমি কী জানাে মানে ! তবে কে জানে?
 ‘আমার মা জানে।
এ আবার কি রকম কথা ! কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলাে। তােতাপুরী, ‘কে তােমার মা ? কোথায় ?
‘ঐ যে, মন্দিরে পাষাণময়ী আছে, ঐ আমার মা। ভবতারিণীর প্রতি ইঙ্গিত করলেন রামকৃষ্ণ। 
‘তবে যাও, তাঁর মত নিয়ে এসাে।
ভবতারিণী আদেশ দিলেন। কিন্তু আরেক মা আছেন। তাঁরও মুখের দিকে চাইতে হবে। তার কথাও ভুলতে পারছেন না রামকৃষ্ণ।
শিখা-সুত্র ত্যাগ করে সন্যাস নিতে হবে, এই হচ্ছে তােতাপুরীর সাধনা। পরতে হবে গেরুয়া। নাম বদলাতে হবে, পদবী বদলাতে হবে। ছিন্ন করতে হবে জাগতিক সম্পর্ক। ত্যাগ করতে হবে সাংসারিক পরিচয়।
‘সব করবো, কিন্তু গােপনে। 
‘গােপনে কেন ? আশ্চর্য হলাে তােতাপুরী।
‘সব ত্যাগ করতে পারবাে কিন্তু মাকে ছাড়া। আমার দুই মা। মন্দিরে যে পাষাণময়ী ঘরে সেই করুণাময়ী’—ভাবের লাবণ্যে রামকৃষ্ণের চোখ ছলছল করে উঠলাে।
যেন সবটা বুঝতে পারলাে না তােতাপুরী।
রামকৃষ্ণ বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, আমার মা, আমার ঘরের মা, বছরখানেক হলাে আছেন আমার সঙ্গে। যদি দেখেন সন্যাস নিয়েছি, দুঃখে তার বুক ফেটে যাবে।
এক মা বলেন, সন্যাস নে। আরেক মা বলেন, তাের সােনার অঙ্গে ভস্ম দেখলে সইতে পারব না।
নিষ্কাম ছেলের নির্লোভ মা এই চন্দ্রমণি।
রামকৃষ্ণকে বিষয় দিতে চেয়েছিলেন মথুরবাবু, রামকৃষ্ণ অবহেলায় ছুড়ে দিয়েছেন। শাল দিয়েছিলেন গায়ে, গায়ের শাল ধুলােয় ফেলে দিয়েছেন। তার মা চন্দ্রমণিকে ভজাতে এলেন এবার। বললেন, “আচ্ছা ঠাকুমা, তুমি তাে কোনাে সেবা নিলে না আমার থেকে?’
‘আমার অভাব কিসের ?’ খুশি মুখে বললেন চন্দ্রমণি।।
‘তবু কিছু তুমি আমার কাছ থেকে নাও—এই বড়াে ইচ্ছে। কিছু নাও না চেয়ে।’
‘কী চাইব? খাবার-পরবার এতটুকু কষ্টও তাে রাখােনি।’
তবু পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন মথুরবাবু। তােমার তাে নেবার প্রার্থনা নয়, আমার শুধু দেবার ব্যাকুলতা।
‘যা মন চায় একটা কিছু নাও না।
 ‘যদি নেহাৎই কিছু দেবে, আমাকে চার পয়সার দোক্তা কিনে দাও। 
চার টাকা নয়, চার আনা নয়, চার পয়সার দোক্তা,
মা এমন লােভশূন্য বলেই তাে ছেলে এমন সর্বজয়ী। অমন বৃহদব্রত ব্রহ্মচারী। নির্বাসনাই তাে সন্তোষ। সর্বদুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি।
কথা রাখলে তােতাপুরী। চন্দ্রমণির চোখের আড়ালে সন্যাস দিলো রামকৃষ্ণকে। সাঙ্গ করলাে বিরজা হােম।
কিন্তু বেশীদিন কাষায়-কৌপীন পরেননি রামকৃষ্ণ। পাছে মার চোখে পড়ে। পাছে মা আঁচলে মুখ লুকিয়ে দেন অনুপায়ের মতাে। 
শুধু তাই ? খালি গায়ের ওপরে কোঁচার খুঁটটি কেন তুলে দিয়েছেন রামকৃষ্ণ ? যে মুক্তসমস্তসঙ্গ তাঁর গায়ের ওপরে ভদ্রতার ঢাকা কেন ? 
ওটি মার জন্যে। গলার পৈতে ফেলে দিয়েছেন এ বুঝতে পেলে মা ধুলিশয্যা নেবেন। তাই মার চোখে যাতে ধরা না পড়েন তারই জন্যে এই একটু ছদ্মধারণ। যাই বলল, সব সইতে পারবাে, মার চোখের জল সইতে পারবাে না।
প্রতাপ হাজরা দক্ষিণেশ্বরে এসেছে ঠাকুরের সংস্পর্শে থেকে সাধন করতে। কিন্তু তার বুড়াে মা দেশের বাড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছে—তার মরণাপন্ন অসুখ, প্রতাপ যেন একবার দেখে যায়।
বুড়াে মা, একবার দেখা দিয়ে এসাে।’ অনুনয় করলেন ঠাকুর।
প্রতাপ পাথর হয়ে রইলাে। বললাে, “ঈশ্বরসাধন করতে এসে পিছটান ভালাে নয়।’
‘পিছটান কিরে? মার সর্ব-টান। দশদিক থেকেই মা। দশদিকে দশ বিদ্যা।
তবু নড়লাে না প্রতাপ। তার মা কেঁদে কেঁদে মরে গেলাে। 
“এবারে হাজরা দেশে যাবে।’ নরেন এসে বললাে ঠাকুরকে।
‘এখন দেশে যাবে! দূর-দূর' ছি ছি করে উঠলেন ঠাকুর। 
‘বাপ-মা কতােবড়াে গুরু! রাখাল আমায় জিগ্যেস করে, বাবার পাতে কি খাবাে? আমি বলি, সে কি রে ? তাের কি হয়েছে যে, তাের বাবার পাতে খাবি না?
একজন রামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করলাে, বাপ-মা যদি কোনাে অপরাধ করে থাকেন
‘তা হােক। তবুও ত্যাগ করা চলবে না। অমুক গুরু খারাপ বলে কথা হলাে তার ছেলেকে গুরু করা যাক। আমি বললুম, সে কি গাে? ওলকে ছেড়ে ওলের মুলি নেবে? নষ্ট হলে তাে কি? নষ্টকেই ইষ্ট বলে জেনাে। যদ্যপি আমার গুরু শুড়ি-বাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
মা-বাপ কি কম জিনিস? তাঁরা প্রসন্ন না হলে ধর্মটর্ম কিছুই হয় । চৈতন্যদেব তাে প্রেমে উন্মত্ত, তবুও সন্যাসের আগে কতোদিন মাকে বােঝন, বলেন, মা, আমি মাঝে মাঝে এসে তােমাকে দেখা দিয়ে যাবাে।
বৃন্দাবনে এসেছেন রামকৃষ্ণ। এইখানে গঙ্গাময়ীর সঙ্গে দেখা।
নিধুবনের কাছে কুটির বেঁধে একলাটি থাকে গঙ্গাময়ী। ষাট বছর বয়স, তা হােক, ললিতাসখী হয়ে রাধিকাভজন করে।
পরস্পরকে দেখে চিনে ফেললো দু’জনে। রামকৃষ্ণ বললেন, “তুমি ললিতা। গঙ্গাময়ী বললাে, ‘আর তুমি রাধিকা ভাবভক্তিবিনােদিনী।’
রামকৃষ্ণ ঠিক করলেন দক্ষিণেশ্বরে আর ফিরবেন না। বাকী জীবন এই ব্রজধামেই কাটিয়ে দেবেন। কাটিয়ে দেবেন গঙ্গাময়ীর স্নেহাশ্রমে।
মথুরবাবু প্রমাদ গুণলেন। দক্ষিণেশ্বর কি অন্ধকার হয়ে যাবে ? যিনি নিজে সুদক্ষিণ তিনি কি পরাম্মুখ হয়ে থাকবেন? হৃদয়কে বললেন, ‘এখন ব্যবস্থা করাে।
হৃদয় অনেক সাধ্যসাধনা করলাে, কিন্তু কিছুতেই নরম হলেন না রামকৃষ্ণ। এখানে এমন মধুচারিণী যমুনা, এমন পরম পবিত্র লীলাধাম, এ ছেড়ে আমি পাদমেকং ন গচ্ছামি ।
হৃদয় ধমকে উঠলাে, “তােমার এতে পেটের অসুখ, তােমাকে এখানে দেখবে কে ?
‘কেন, আমি দেখবাে সেবা করব।' বলে উঠলাে গঙ্গাময়ী।
কিছুতেই কিছু হবার নয়। বাইরের যুক্তিতর্কের কোনাে ধার ধারবেন না রামকৃষ্ণ। অন্তরে যে ভাবটি এসেছে সেইটির পূরণ চাই।
গায়ের জোর ছাড়া আর পথ নেই। মহাবীর হনুমানের মতােই দুর্ধর্ষ সেবক এই হৃদয়রাম, তেমনি দুর্দান্ত আর শক্তি। সে ঠাকুরের হাত চেপে ধরলাে। বললে, “ওসব চলবেনা চালাকি। ওঠো, চলো।
গঙ্গাময়ীও চেপে ধরলাে আরেক হাত। বললাে, “কখনাে না। কিছুতেই যেতে দেবাে না। তুমি পারবে গায়ের জোরে ?
ঠাকুরের সমস্ত জোর গঙ্গাময়ীর দিকে। তাই তাঁকে টলায় হৃদয়ের সাধ্য কি। দু’জনের টানাটানিতে ঠাকুরের হয়রানি। যেন সাতেও নেই পাঁচেও নেই এমনি ভাব। দু’জনের হাতে দু’হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যে পারাে রাখাে, যে পারাে টেনে নাও।
হৃদয়ের গর্ব চূর্ণ হলাে। ঠাকুর সুমেরুর মত অটল। 
এখন উপায় কি ? 
উপায় মা। উপায় চন্দ্রমণি।
মার মুখখানি হঠাৎ মনে পড়ে গেলাে রামকৃষ্ণের। স্নেহলাবণ্যময় কোমল করুণ মুখখানি। ব্যস্ত হয়ে ঘর-বার করছেন। উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুয়ার ধরে। দিনান্ত হয়ে গেলাে, ছেলে এখনাে ফিরলাে না। জল ছলছল চোখে জিগ্যেস করছেন পথচলা পথিককে, আমার গদাইকে দেখেছাে কোথাও ? নিশীথ রাতে উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে। আতঙ্কিত অন্ধকারকে শুধােচ্ছেন শূন্য স্বরে, আমার গদাই কোথায় গেলাে?
মার সেই উদ্বেগচঞ্চল চক্ষু দু’টি। সেই মার ভীত চমকিত ব্যাকুলতা।
মনস্থির করতে আর দেরী হলাে না রামকৃষ্ণের। উড়ে গেলাে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। পড়ে রইলাে বৃন্দাবন। পড়ে রইলাে গঙ্গাময়ী। পড়ে রইলাে নীল যমুনা। নিমেষে গঙ্গাময়ীর হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘চল, মার কাছে ফিরে যাই।
মার মত কেউ নয়। মার বড়াে কেউ নেই।
সকল তীর্থের সার, সকল তীর্থের উর্ধ্বে মা। মা স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী। ‘টানাটানিতে মার কথা মনে পড়ে গেলাে। বললেন ঠাকুর ‘অমনি বদলে গেলাে সমস্ত। ভাবলুম মা বুড়াে হয়েছেন, মার চিন্তা থাকলে ঈশ্বর-ফিশ্বর সব ঘুরে যাবে। তার চেয়ে তার কাছেই যাই। গিয়ে সেখানেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঈশ্বরচিন্তা করি।'
মার মাঝেই ত্রিভুবন। মাকে প্রদক্ষিণ করলেই হলাে।
অহেতুক কৃপা চাই ঈশ্বরের। কিন্তু শুধুই চাই, বিনিময়ে কিছু দেব না ঈশ্বরকে ? দেব বৈ কি। কিন্তু কি দিতে পারি ? দেবার মতাে আমার কী আছে? আছে, এক অমূল্য সম্পদ আছে। শুধু আমার নয়, সকলের আছে। পৃথিবীতে যে দীনতম হীনতম তারও আছে। অহেতুক কৃপার বদলে দেবাে অহেতুক ভালােবাসা। ভালােবাসা কার নেই ? কে এমন আছে সংসারে যে ভালােবাসতে পারে না? আর কাউকে না হােক, অন্তত নিজেকে ভালােবাসে? ঈশ্বরকে দেবে সেই ভালােবাসা। কিছু চাই না তবু ভালােবাসি। কিছু পাই না তবু ভালােবাসি। দেবাে সেই অকারণ ভালােবাসা। সেই অকারণ ভালােবাসার বদলে পাবাে তােমার অবারণ করুণা।
ঈশ্বরের উপর যাতে এই নিঃস্বার্থ ভালােবাসা আসে তারই জন্য ঠাকুরের মাতৃসাধনা। মাকে ভাবতেই মন ভরে ওঠে, চোখে জল আসে, প্রাণ আনচান করে। সন্তান ভালােবাসবার আগে মাকে জিগ্যেস করে না, মা তুমি কি রূপসী, বা, তুমি কি বিদুষী, বা, তােমার ক্যাশবাক্সে কত টাকা আছে, বা, তােমার স্বামী কি চাকরি করে। তার মা আছে এই তার ঐশ্বর্য। তার মা আছে এই তার ভুবনজোড়া শান্তি।
মার অনন্ত ক্ষমা, অনন্ত দয়া, অনন্ত সহিষ্ণুতা।
মা কখনােও পুরােনাে হয় না। মা নামের জরা-মৃত্যু নেই। মা-নামের আকার দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত। মা-নামের বাণী নির্মল মুক্তির নির্ঝরিণী।
দুঃখেও মা-নাম, আনন্দেও মা-নাম। মা সর্বসম্পৎস্বরূপা। 
মা সর্বংসহা ধরিত্রী। ধান্যদা, ধনদায়িণী।।
‘কী হবি ? ধ্রুব হবি না প্রহলাদ হবি? জিগ্যেস করলেন ঠাকুর। ‘ধ্রুব বড়ো না প্রহলাদ বড়?
হৃতরাজ্য উদ্ধারের জন্য ধ্রুব তপস্যা করেছিলাে। কাঁচ কুড়ােতে এসে মণি পেয়ে গেলাে। কিন্তু প্রাহলাদের কোনাে আকাঙ্ক্ষা নেই। ঈশ্বরকে কেন ডাকছে তাও জানে না। ডাকতে ভালাে লাগছে বলেই ডেকে যাচ্ছে। হাতীর পায়ের তলায় ফেলছে, তাতেও ঈশ্বর। তপ্ত তেলের কটাহে ফেলছে তাতেও ঈশ্বর। মুক্তি চাই না, সিদ্ধি চাই না, শুধু তােমাকে ভালােবাসতে চাই।
কি চায় ছেলে তা ছেলে জানে না, তার মা জানে। ছেলের শুধু মা-মা বলে কেঁদে যাবার কথা। মা এসে বিচার করবেন কোথায় ছেলের উপশম। আর কিছু না দিন যদি তার উত্তপ্ত উৎসঙ্গটুকু পাই সেই আমার জগজ্জয়।
“মা একটা পয়সা দে।' ছেলে কাঁদছে মার কাছে। ‘ঘুড়ি কিনবাে। 
মা বললে, “না, উনি বারণ করে গেছেন— 
 তবু ছেলের কান্নার বিরাম নেই। শত বারণ ধুয়ে যাচ্ছে সে কান্নার ব্যাকুলতায়। অন্য মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছে মা। ছেলের কান্না কানে তুলছে না। ততোই ছেলে টানছে আঁচল ধরে। বলছে, শুধু একটা পয়সা। ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াবাে।
‘এক্ষুনি একটা কাণ্ড বাধাবি আর কি। মা ধমক দিয়ে উঠলেন। 
কিছুতেই নিরস্ত হবার নয়। আবার কান্না। আবার আঁচল টানা।
‘বােসো গাে, ছেলেটাকে শান্ত করে আসি। পাড়ার মেয়েদের বসতে বলে ঘরের মধ্যে চলে আসে মা। বাক্স খুলে একটা পয়সা ফেলে দেয় ছেলেকে।
তেমনি ছাড়ানছােড়ান নেই। কৃপার পয়সাটি ফেলে দাও বাক্স থেকে। প্রাণের সুতােয় সচ্চিদানন্দের ঘুড়ি ওড়াবাে।
‘বাপ-মা পরমগুরু।' বললেন রামকৃষ্ণ : কেবল ঈশ্বরের জন্যে বাপ-মার আদেশ লঙ্ঘন করা চলে—আর কিছুতে নয়। বাপের কথায় প্রহলাদ ছাড়েনি কৃষ্ণনাম। মা বারণ করলেও ধ্রুব তপস্যা করতে বনে গিয়েছিলাে। কৈকেয়ীর কথায় ভরত ছাড়েনি রামসেবা। রামের জন্যে রাবণের কথা শােনেনি বিভীষণ। ভগানের জন্যে বলি তার গুরু শুক্ৰচার্যকে অমান্য করেছে-’
নইলে বাপ-মা যা বলবেন তাই বেদবাক্য। তাই শিরােধার্য। 
চন্দ্রমণি মাঝে মাঝে বেঁধে দেন রামকৃষ্ণকে।
‘তুমি মা দেশের মতন করে বেশ ফোড়ন-টোড়ন দিয়ে দুটো একটা তরকারি করােনা। খেতে বড়াে মন চায়।'
বেঁধে দেন চন্দ্রমণি। তরকারিতে এমন একটি ফোড়ন দেন, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। সেটির নাম মাতৃস্নেহ।
মার কাছটিতে বসে খান রামকৃষ্ণ। এমন একটি আস্বাদ পান যা রান্নার মধ্যে নেই। আছে তাঁর অন্তরের মধ্যে। সেটির নাম মাতৃভক্তি।
শেষের দিকে কেমন জবুথবু হয়ে পড়লেন চন্দ্রমণি। জরায় আচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগলেন। তবু তাঁকে আঁকড়ে রইলেন ঠাকুর।
বাইরে জরা কিন্তু অন্তরে সেই ঋদ্ধিশালিনী মহালক্ষ্মী।
আলমবাজারের চটকলের বাঁশি না বাজলে চন্দ্রমণি খেতে বসেন না। সেই বাঁশি বাজলে বলে ওঠেন, ‘ঐ বৈকুণ্ঠের বাঁশি বাজলাে। লক্ষ্মীনারায়ণের ভােগ হলো এতােক্ষণে।’
রবিবার তাঁকে নিয়ে বড় বিপদ। সেদিন কলের ছুটি, বাঁশি নেই। সেদিন কিছুতেই খাবেন না চন্দ্রমণি। বৈকুণ্ঠ লক্ষ্মী-নারায়ণ উপােস করে থাকলাে আর আমি ভাত খাবাে? এ কখনো হতে পারে ?
মাকে নিয়ে ঠাকুরের মহা ভাবনা।
এখন উদ্ধারের পথ কি ? আহা, বুড়ােমানুষ, শরীর বেজায় কাহিল হয়ে পড়বে যে। 
 ‘মা এইবেলা খেয়ে নাও, রাধাকান্তের পেসাদ। মার কাছে গিয়ে অনুনয় করেন ঠাকুর।
সরলা বালিকার মতাে বলেন চন্দ্রমণি : ‘কি করে খাই বলল? লক্ষ্মী-নারায়ণের যে এখনো ভােগ হয়নি।
হৃদয় বললাে, “তুমি মামা, অতো ভেবােনি। বুড়ির খিদে পেলে আপনিই খাবে।’ 
‘না রে দেখতে হয়। খাওয়াতে হয় ভুলিয়ে-ভালিয়ে।’
তখন হৃদয় জলের জালার মধ্যে চোঙা ঢুকিয়ে বাঁশির আওয়াজ করলাে। বললাে, “এই নাও তােমার বাঁশি বাজলাে। এবারে খাও।
এদিকে জরা, কিন্তু বুদ্ধি টনটনে। বললেন চন্দ্রমণি, ‘না রে। ও তাে শুধু চোঙে শব্দ করছিস।’
তখন সকলের হাসি।
ঠাকুর তখন মার গায়ে হাত বুলােত লাগলেন। বললেন, “দেখাে মা, আজকাল গঙ্গায় বড়াে বড়াে সব জাহাজ চলে। তার অনবরত শব্দ হচ্ছে। আর যা জোর হাওয়া! তাই বাঁশির আওয়াজ হয়তাে তুমি শুনতে পাওনি আজ।’
‘তাই হবে হয়তাে। তখন ঠাকুরের কথায় খেলেন। 
এমনি করে মাকে ঠাকুর রেখেছেন চোখে চোখে। সেবা ও শুশ্রুষার। অজস্রতায় যত্ন ও জিজ্ঞাসার আবেষ্টনে।
সেই চন্দ্রমণি মারা গেলেন একদিন। আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন ঠাকুর। নিঃস্বের মত লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
এ কি সন্যাসী পুত্রের ব্যবহার ? সন্যাসী পুত্রের কি মার খোঁজ রাখে, মার খবর করে, মার মৃত্যুর সংবাদ পায়, পেলেও বা কি কাঁদে মাটিতে লুটিয়ে ?
ঠাকুর সন্যাসীর শিরােমণি হয়ে গৃহীর মধ্যমণি। তাঁর ঘর-বন সবই সমান।
অন্তর্জলি করতে চন্দ্রমণিকে নিয়ে এলেন গঙ্গায়। যাবার আগে ফুল আর চন্দন দিয়ে মার পায়ে অঞ্জলি দিলেন ঠাকুর।
পুত্রকে শিয়রে রেখে মা চোখ বুজলেন।
মার পা দু'খানি গঙ্গা স্কুলে ধুয়ে তাতে ঘন করে চন্দন মাখালেন ঠাকুর। এ জল চোখের জল, এ চন্দন ভক্তির চন্দন, ভালােবাসার চন্দন।
সন্যাসী, তাই শ্রাদ্ধ করা নিষিদ্ধ ঠাকুরের। রামলাল শ্রাদ্ধ করলে। অশৌচ পর্যন্ত পালন করলেন না ঠাকুর। তারও বিধি নেই।
‘ছেলের মতাে কোনাে কাজই করতে পেলুম না। কিছুতেই তৃপ্তি দিতে পারলুম না মাকে। আমার মতাে দুঃখী আর কে আছে সংসারে।’
একটু অন্তত তৰ্পণ করি মাকে। একটু অন্ততঃ জলাঞ্জলি দিই।
গঙ্গায় নেমে জলে হাত ডােবালেন ঠাকুর। অঙ্গুলিবদ্ধ হাত যেই তুললেন উপরে, সব জল পড়ে গেলাে আঙুল গলিয়ে। শিথিল অসাড় হয়ে গেলাে আঙুল, এক বিন্দু জলও ধরে রাখা গেলাে না।
তেমনি ধরে রাখা গেলাে না চোখের জল।
সঞ্চয় বা সংগ্রহ করা চলে না ঠাকুরের। এক বিন্দু জল পর্যন্ত নয়। কিন্তু দুই নয়নে এতাে জল কি করে সঞ্চিত হলাে? দুই হাতে এতাে সুধাস্পর্শ? অন্তরে এতাে দয়া-ক্ষমা !
নিরঞ্জন চাকরি করছে জেনে ঠাকুর বিরক্ত হলেন। পরে যখন শুনলেন মার ভরণ-পােষণের জন্যে চাকরি নিয়েছে তখন ঠাকুর সমর্থন করলেন। বললেন, ‘তুই মার জন্যে চাকরি স্বীকার করেছিস, বেশ করেছিস। মা ব্ৰহ্মময়ী স্বরূপা।
বিদ্যাসাগরকে বললেন, “তুমি তাে সিদ্ধ গাে।”
বিদ্যাসাগর হাসলেন। বললেন, “আমি সিদ্ধ? কই আমি তাে সাধন-ভজন করি না কিছু।’
‘নাই বা করলে! আলু পটল সিদ্ধ হলে কি হয়? গভীর চোখে তাকালেন ঠাকুর : ‘নরম হয়। তুমিও তেমনি নরম হয়েছে। পরের দুঃখে তােমার হৃদয় দ্রবীভূত হয়েছে। তােমার ব্ৰত দয়া। যে পরের জন্যে কাঁদে সে তো ভগবানের জন্যেই কাঁদে।
এ কান্নাটুকুই তাে ভালােবাসা। নিঃস্বার্থ পরােপকার। এই তাে অহেতুক ভক্তি।
‘আরেক অর্থেও তুমি সিদ্ধ। তুমি মাতৃভক্ত। আয় তােমার মার নামও ভগবতী সর্বসিদ্ধিপ্ৰদা ভুবনেশ্বরী।’
‘আর সব ডাক ফুরােয়। মা ডাক ফুরােয় না।' 
এই ‘মা’-ই ঠাকুরের একমাত্র মন্ত্র। একাক্ষর মন্ত্র।

বালকস্বভাব শ্রীরামকৃষ্ণ 


ঘাসবনে কি কামড়েছে রামকৃষ্ণকে।
সাপ বােধহয় ! 
কি হবে !
কে একজন বলেছিলাে রামকৃষ্ণকে, দ্বিতীয়বার যদি কামড়ায় তবে বিষ ঠিক তুলে নেয় সাপ। এখন সেই সাপ পাই কোথায়!
সেই সাপ না হােক, আরেকটা হলেই তাে চলে। সাপের গর্ত খুজতে লাগলেন রামকৃষ্ণ। এ গর্ত না ও গর্ত।
‘কি করছেন? কৌতুহলী হয়ে কে একজন জিগ্যেস করলাে। 
‘সাপ খুঁজছি।' 
“সে কি কথা!
তখন তাকে সব কথা বললেন রামকৃষ্ণ। দ্বিতীয় দংশনে বিষে বিষক্ষয় দরকার। নইলে এ যাত্ৰাই শেষ যাত্রা। 
সব শুনে লােকটি চিন্তিত হবার ভান করলাে। বললে শুধু আরেকবার কামড়ালেই তাে চলবে না। ঠিক প্রথম জায়গাটিতেই কামড়ানাে চাই।
সত্যি? এ তো বড় ঝামেলার কথা। দ্বিতীয় সাপ প্রথম দংশনের জায়গা যদি ঠিক না ঠাহর করতে পারে।
উঠে পড়লেন রামকৃষ্ণ। দরকার নেই সাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। 
কৈ, কিছু হলাে না তাে! বিছে-টিছে কামড়েছিলাে হয়তাে।

**********

‘শরতের হিম খুব ভালাে। একদিন বললাে এসে রামলাল।
‘ভালাে? 
‘হ্যা, মাথা ঠাণ্ডা থাকে। সংস্কৃত একটা শ্লোক ছাড়লে রামলাল।
হবেও বা! শ্লোকের আমি কি জানি! যখন বলছে, তখন গুরুগম্ভীর হয়ে, বিশ্বাস না করে উপায় কি ?
কলকাতা থেকে ঘােড়ার গাড়িতে করে ফিরছেন দক্ষিণেশ্বর। আশ্বিন মাসের রাত। হাওয়াতে ঠাণ্ডার একটু আমেজ লেগেছে। মনে পড়ে গেলাে, যাতে হিমটুকু বেশ লাগে, তাই গাড়ি থেকে মাথা বাড়িয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ।
তারপরেই পড়লেন অসুখে। 
বালকস্বভাব রামকৃষ্ণ। সরল, অলজ্জ, নিরাসক্ত।
লজ্জা ঘৃণা ভয়—তিন থাকতে নয়। একমাত্র বালকেরই লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই, ভয় নেই। একমাত্র বালকই অবন্ধন।
ঈশ্বরও বালকস্বভাব।
যেমন কোনাে ছেলে কোঁচড়ে রত্ব নিয়ে বসে আছে। বসে আছে রাস্তার ধারে। যে রাস্তা দিয়ে দিন-রাত্রি হেঁটে চলেছে যাত্রীদল। আমায় দাও না, আমায় দাও না, বলে রত্নের জন্য কতো লােক সাধাসাধি করছে। কিন্তু রত্নের মালিক সেই ছেলে কাপড়ে হাত চেপে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলছে, না—দেবব না, কখনাে না। কিন্তু এমন কেউ হয়তাে চলে যাচ্ছে সুমুখ দিয়ে, রত্নের জন্য একবিন্দু যার প্রার্থনা নেই, চলে যাচ্ছে উপেক্ষা করে, তারই পিছে পিছে ছুটে যাচ্ছে। সেই রত্নেশ্বর। বলছে, সকাতরে বলছে, ওগাে, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও এই স্পর্শমণি। তােমাকে আমি অমনি দিয়ে দিচ্ছি।
এমনি ঈশ্বরের কৃপা। ঠিক বালকের যেমন খামখেয়াল। 
কার উপর কখন তাঁর কৃপা হবে কেউ বলতে পারে না।
হনুমানকে দড়িদড়া দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে লবকুশ। মাকে গিয়ে বলছে, মা, মহাবীরকে বন্দী করেছি।'
‘মহাবীরকে ? সীতা তাে অবাক। 
‘হ্যাঁ মা, এই যে বেঁধে এনেছি তােমার সামনে।’
মহাকায় হনুমান তখন ছােট্টটি হয়ে গিয়েছে। কুঁকড়ে-সুকড়ে এতােটুকু ! কে বলবে এই সেই সমুদ্র-লাফানাে গন্ধমাদন-বয়ে-আনা বীর-বলী হনুমান!
দুই ভাইয়ের মহাফুর্তি। অসাধ্য সাধন করেছি। ধরে-বেঁধে টেনে এনেছি ঘরের দুয়ারে। তখন হনুমান বললল হাসিমুখে ?
‘ওরে কুশীলব, করিস কি গৌরব,
ধরা না দিলে কি পারিস ধরিতে ? 
রাম তনয়দের কাছে হনুমান ইচ্ছে করেই ধরা দিয়েছে। নইলে সাধ্য কি বাঁধে তারা পবন তনয়কে!
তেমনি, ভগবান যদি কৃপা করে ধরা দেন তবেই তাঁকে ধরা সম্ভব। নচেৎ কিছুতে নয়, কিছুতে নয়। কিন্তু কেমন করে তাঁর কৃপা পাবে?
বালকের মতাে সরল হও, অকপট হও; সেয়ানা বুদ্ধি ছাড়ো। 
ছেলেকে মা বলছেন, “ও তাের দাদা’।
ছেলের অমনি বিশ্বাস যে, ও আমার দাদা। তা সে হয়তাে বামুনের ছেলে, আর দাদা হয়তাে ছুতাের কি কামার।
মা বলেছেন, ‘ও-ঘরে জুজু আছে।'
যােলােআনা বিশ্বাসও-ঘরে জুজুর আস্তানা।
জটিল বালকের গল্প বললেন রামকৃষ্ণ ‘জটিল বালক বনের পথ দিয়ে পাঠশালায় যেতে বড়াে ভয় পায়। মাকে বলতে মা বললেন, ভয় কি, মধুসূদনকে ডাকবি।
‘কে মধুসুদন? জিগ্যেস করলাে জটিল। 
‘মা বললেন, তাের দাদা।
‘পরদিন নির্জন পথ দিয়ে যেতে যেতে যেমনি ভয় পেলে অমনি মার কথা মনে পড়লাে । দাদা মধুসূদন, দাদা মধুসূদন, বলে ডাকতে লাগলাে জটিল। কারাে সাড়া-শব্দ নেই, সব নিশ্চুপ। তখন গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলাে জটিল : কোথায় দাদা মধুসূদন, দেখা দাও, আমার হাত ধরাে, আমার যে ভয় পেয়েছে !
‘মধুসূদন আর থাকতে পারলেন না লুকিয়ে। কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, এই যে আমি, ভয় কি ? হাত ধরে পাঠশালার রাস্তার পৌঁছিয়ে দিলেন জটিলকে।’

**************

আরাে একটি গল্প বললেন রামকৃষ্ণ : ‘এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ঠাকুরসেবা ছিলাে। সেদিন ব্রাহ্মণের আর কোথাও কাজ পড়েছে। ছােটো ছেলেটিকে বললাে, তুই আজ ঠাকুরের ভােগ দিস, বুঝলি? ফিরতে আমার রাত হবে।
“কি করতে হবে জানতে চাইলে ছেলে। বাপ বললাে, আর কিছু নয়, খাওয়াবি শুধু ঠাকুরকে। ঠাকুরকে ভােগ দেওয়া মানে ঠাকুরকে খাওয়ানাে।
‘বাপ চলে গেলো। পূজোর ঘরে গিয়ে ঠাকুরকে ভােগ দিলে। ছেলে। কিন্তু ও কি, ঠাকুর যে চুপ করে বসে আছেন! কথাও কন না, খানও না। অনেকক্ষণ বসে বসে দেখলাে ছেলে, কিন্তু ঠাকুরের আর গা তােলবার নাম নেই। তখন সে বারবার বলতে লাগলাে, ঠাকুর খাও, অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি আর বসতে পাচ্ছি না।
‘ঠাকুর তবুও অনড়, অচল। তখন ছেলেটি কান্না শুরু করলাে। বলতে লাগলাে, ঠাকুর, বাবা তােমাকে খাওয়াতে বলে গেছেন, তুমি কেন আমার কাছে খাবে না? বাবা এলে তবে কি বলব?
‘ব্যাকুল হয়ে যেই অনেকক্ষণ কেঁদেছে, ঠাকুর অমনি হাসতে হাসতে আসনে এসে বসে খেতে লাগলেন। ঠাকুরকে খাইয়ে সবে ঘর থেকে যখন ছেলেটি বেরিয়ে এলাে, বাড়ির লােকেরা বললাে, ভােগ হয়ে গেছে। এখন সে সব নামিয়ে আন্। ‘ছেলেটি বললে, নামিয়ে আনবাে কি, ঠাকুর সব খেয়েছেন। 
‘বাড়ির লােকেরা বললাে, সে কি রে ? কি বলছিস তুই!
‘সরল, তরল চোখ তুলে ছেলেটি বললাে, কেন, ডাকলুম, কাঁদলুম, ঠাকুর তাে এসে খেয়ে গেলেন!
‘তখন ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখে সকলে অবাক।’
ছােটা ছােটো ছেলের সঙ্গে খেলা করেন রামকৃষ্ণ। ছােটো ছেলেদের কাছাকাছিই ভগবানের বাসা। ধুলাে-বালিমাখা ছন্নছাড়া শিশু ভােলানাথ। যতােক্ষণ শিশুর সঙ্গে আছে—ততক্ষণই আছাে ঈশ্বরের প্রতিবেশী হয়ে। শিশুই হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতীক। ঈশ্বরের প্রতিভূ। শিশুর প্রধান গুণটিই হচ্ছে সরলতা। পেটে মুখে এক হওয়া ! আর সরল হলেই ঈশ্বর-লাভ!
‘ছােকরাদের অতাে ভালােবাসি কেন?’ বললেন রামকৃষ্ণ : ‘ওরা যে খাঁটি দুধ—একটু ফুটিয়ে নিলেই হয়-ঠাকুর সেবায় চলে। জোলাে দুধ অনেক জ্বাল দিতে হয়, অনেক কাঠ পুড়ে যায়। ঈশ্বর বিষয়বুদ্ধি থেকে অনেক দূর। তা না হলে একেবারে হাতের ভেতর।'
যদি ঈশ্বরের কৃপা পেতে চাও, সরল হয়ে যাও। অন্তরে যতক্ষণ গরল আছে ততােক্ষণ সরল হওয়া যায় না। অন্তরের গরল ধুয়ে ফেলতে হলে চাই শুধু তরল অশ্রুজল। আর সরলতার সঙ্গে চাই একটু ব্যাকুলতা।
হৃদয়রামের ছেলের চার-পাঁচ বছর মােটে বয়স। সারাদিন থাকে । রামকৃষ্ণের সঙ্গে। খেলা করে। কিন্তু যেই সন্ধ্যা হয়, অমনি কেঁদে ওঠে। মা যাব! কত তাকে ভােলাবার চেষ্টা করেন রামকৃষ্ণ, কিছুতেই শোনে না। পয়সা দেদাে, খাবার দেবো, কোনাে কিছুতেই রুচি নেই। খেলা-টেলা সব তেতাে লাগে। শুধু অবিরাম কান্না, মা যাবে!
তখন তার অবস্থা দেখে রামকৃষ্ণ কাঁদতে বসেন। তাঁরও মুখে সেই কথা : মা যাবে।
চাই এই বালকের ব্যাকুলতা। এই বালকের মতাে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে হবে ঈশ্বরের জন্য।

************

মেঝেতে বসে আছেন রামকৃষ্ণ। এক ভক্ত এক চাঙাড়ি জিলিপি নিয়ে এসেছে তাঁর জন্য। জিলিপি দেখে তাে রামকৃষ্ণ ভারী খুশি । ‘দেখছে, আমি মায়ের নাম করি বলে এ-সব জিনিস খেতে পাচ্ছি-’
একটি ছ-সাত বছরের ছেলে এসে ঘরে ঢুকলাে। রামকৃষ্ণের তখন বালকের অবস্থা। এক ছেলে যেমন আরেক ছেলের কাছ থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে—ঠাকুরেরও এখন সেই ভাব। জিলিপির চ্যাঙাড়ি হাত ঢেকে লুকোবার চেষ্টা করছেন। তাই নয়, একেবারে সরিয়ে ফেললেন। পাছে আরেক বালকের চোখে পড়ে। পাছে সে ভাগ বসায়।
এই বালক-ভাবে থাকতে থাকতে, হাত দিয়ে জিলিপি ঢাকতে ঢাকতে সমাধিস্থ হলেন রামকৃষ্ণ।
“মা, পরমহংস তো বালক। বালকের মা চাই না। তাই তুমি মা, আমি ছেলে। মার ছেলে মাকে ছেড়ে কেমন করে থাকে ?
বালকের সব নির্ভর যেমন মার ওপর, রামকৃষ্ণেরও তেমনি সমস্ত সমর্পণ ঈশ্বরে।
দাসীর যে ছেলে, সেও বাবুর ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে বলে, মাকে বলে দেব।
ছােটো ছেলে মা ছাড়া আর কিছুই জানে না। রামকৃষ্ণও তেমনি। রঙিন চুষি-কাঠি ফেলে দিয়ে ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদছে মার জন্য। বালিশ চাপা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে গিয়েছিলাে মা। বালিশ ছুড়ে ফেলে শুরু করেছে চেঁচাতে। সাধ্যি কি-মা থাকবে কর্মান্তরে ? ছুটে এসে কোলে নেবে। মার ঐ উত্তপ্ত উৎসঙ্গকুটুই সমস্ত জীবনের উপশম।
মাকে পাবার জন্যই ঐ বালক-ভাব।
চিৎ হয়ে শুয়ে শিশুর মতাে নিজের পায়ের বুড়াে আঙুল চুষছেন রামকৃষ্ণ। হাসছেন নির্গলিত শুভ্রতায়। কখনাে বা বাৎসল্যে বিভাের হয়ে বালিশকে সন্তান ভেবে দুধ খাওয়াচ্ছেন। কখনাে বা কাপড় বগলে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন উদাসীনের মতাে।
বালকই তাে সন্যাসী। বালকই তাে ঈশ্বর। এই খেলা ঘর তৈরী করছে, এই আবার ভেঙে দিচ্ছে অবলীলায়। এই ঝগড়া করছে, পরের মুহুর্তেই আবার গলায় গলায় ভাব।
অহঙ্কার খারাপ। কিন্তু ‘আমি বালক’ এই আমিত্বটুকুই মধুর।
‘হিঞ্চে শাক শাকের মধ্যে নয়। মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয়।' বললেন রামকৃষ্ণ : ‘তেমনি, আমি বালক, আমি সন্তান, এটুকু অহঙ্কারের মধ্যে নয়। এ আমিত্বে বরং উপকার আছে। যেমন হিঞ্চে শাকে পেট ঠাণ্ডা হয়। মিছরিতে অম্ল যায়। অন্য শাকে, অন্য মিষ্টিতে অসুখ করে।
কিন্তু এ বালক ভাবটি আনি কি করে ?
দিনে রাতে যখন যত পারাে মেশাে এই বালকদের সঙ্গে। মিশতে মিশতেই রসিয়ে উঠবে। ভিতরে রস না এলে বাইরে কি রং ধরে ?
ভক্তেরা ফুল দিয়ে গিয়েছে রামকৃষ্ণকে। বালকের মতাে ফুল নিয়ে খেলা করছেন রামকৃষ্ণ। কখনাে ফুল নিজের মাথায় দিচ্ছেন, কখনাে গলায়, কখনাে বুকে, কখনাে নাভিতে। বলছেন, এখন আমার বালকস্বভাব। তাই ফুল নিয়ে এরকম করছি। কি দেখছি জানাে? শরীরটা যেন বাঁকারি-সাজানাে কাপড় মােড়া, সেইটে নড়ছে। ভেতরে একজন আছে বলেই নড়ছে। তাই নয় ?
শিবুর সঙ্গে ভাব খুব, শিবু রামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ। বয়স চার-পাঁচ বছর।
মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ দেখে শিবুর খুব আনন্দ। চোখ বড়াে বড়াে করে বলছে রামকৃষ্ণকে, ‘খুড়াে, ঐ চকমকি ছাড়ছে।’
যেমনটি শুনেছে তেমনিটি বিশ্বাস করেছে। অন্য কথা বলল, কিছুতেই স্বীকার করবে না। যেমন গ্রামােফোন শুনে বললাে, খােলের মধ্যে বসে গান গাইছে কেউ।
ফড়িং ধরতে যাচ্ছে শিবু। অন্যমনে, প্রায় রুদ্ধ নিঃশ্বাসে। পাতা নড়ছে গাছে। তাই দেখে ভারী বিরক্ত। বলছে পাতাকে, চুপ চুপ, নড়িসনে, আমি ফড়িং ধরবাে।
সব চৈতন্যময় দেখছে বালক। চাই সেই বালকের দৃষ্টি।
বাপের সঙ্গে নেমন্তন্নে যাচ্ছে ছােটো ছেলে। কতোদূর গিয়ে ছেলে বলছে, বাবা আমার প্যান্টের বােতাম নেই। বাবা বললেন, তাের বােতাম লাগবে না। বাপের কথা অকাতরে মেনে নেয় ছেলে। বাবা যখন বলছেন তখন আর ভাবনা কি।
তেমনিধারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন রামকৃষ্ণ। পরনে ধুতি, পায়ে চটি, গায়ে ফতুয়া। সঙ্গে মহেন্দ্র গুপ্ত মাষ্টারমশাই। গেট দিয়ে ঢুকবেন, বলে উঠলেন রামকৃষ্ণ, “ওহে মাষ্টার, ফতুয়াতে বােতাম নেই যে।'
মাষ্টারমশাই বললেন, আপনার বােতাম লাগে না। 
‘লাগে না নাকি?” 
‘না’—অভয় দিলেন মাষ্টারমশাই।
তাই মেনে নিলেন রামকৃষ্ণ। মাষ্টারমশাই জ্ঞানী-গুণী লােক। তিনি যখন বলছেন তখন আর সন্দেহ কি।
থিয়েটারে পার্ট নিয়েছে বাপ, সেনাপতির। মার কোলে বসে প্লে দেখছে ছেলে। সেনাপতিকে সেনাপতি বলে ভাবতে পারছে না, বাপ বলেই দেখছে। থিয়েটারে শত্রুপক্ষের লােক সেনাপতিকে তলােয়ারের ঘা মারলাে। তাই দেখে ছেলের নিদারুণ কান্না। আমার বাবাকে মারলে বাবাকে মারলে! মা তাকে কিছুতেই বােঝাতে পারছে না, ওটা অভিনয়, ওটা ছলনা, যাকে মেরেছে সে নাটকের সেনাপতি, বাস্তবের পিতা নয়। কিন্তু কিছুতেই বুঝ মানছে না ছেলে।
তেমনিধারা ষ্টার থিয়েটারে ‘দক্ষ-যজ্ঞ' প্লে দেখছেন রামকৃষ্ণ।
গিরীশ ঘােষ দক্ষের পার্ট নিয়েছেন। ষ্টেজে নেমে বলছেন ক্রুদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে : ‘শিবনাম ঘুচাইব ধরাতল হতে।’
উপরে, বক্সে আছেন রামকৃষ্ণ। গিরীশের হুঙ্কার শুনে তিনি তো স্তম্ভিত। তিনি গিরিশকে দক্ষরূপে দেখতে পাচ্ছেন না, গিরীশরূপেই দেখছেন। গিরীশের দম্ভোক্তি শুনে তিনি হতবাক। আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন : “শিবনাম ঘােচাবি কি রে ! বলতে বলতে নেমে এলেন নীচেয় ষ্টেজের ধারে। গিরীশকে লক্ষ্য করে ভৎসনা করে উঠলেন ? ‘তােকে এতােদিনে তবে শেখালাম কি! তুই শিবনাম ঘােচাবি ?’
গিরীশ করজোড়ে বললেন, ‘প্রভু, এ-কথা তাে আমি বলছি না, দক্ষ বলছে।’
“তুই বলছিস না!' কিঞ্চিৎ যেন আশ্বস্ত হলেন রামকৃষ্ণ। ‘না। ও দক্ষের কথা। আর দক্ষও শেষকালে ধরবে শিবনাম 
 ‘ধরবি তাে? দেখিস ! ভুলিসনে।’
 বালকস্বভাব রামকৃষ্ণ। অষ্টপাশ আর তিন গুণের বাইরে।
ছােটো ছেলে শুধু তার মাকে ডাকে। রামকৃষ্ণেরও তাই। ঈশ্বরকে ডাকাই তাঁর পূজা। শুধু ঈশ্বরের নাম করাই তাঁর সাধন-ভজন।

*********

এবার বালগােপাল হয়েছেন রামকৃষ্ণ।
কামারহাটীর অঘােরমণি, বাষট্টি বছরের বুড়ি। গােপাল-মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে। বিশ্বের যিনি অধীশ্বর তাকে ছােট্ট শিশুরূপে, সন্তানরূপে বুকের মধ্যে আকর্ষণ করেছে। মাতৃস্নেহাতুর নিষ্কিঞ্চন শিশু।
রাত তিনটের সময় জপে বসে অঘােরমণি।
সেদিন জপে বসেছে, হঠাৎ কে এসে বসলাে তার পাশটিতে। গা কাঁটা দিয়ে উঠলাে। কে, কে তুমি? চমকে চোখ চেয়ে দেখলাে—এ কি, এ যে সেই দক্ষিণেশ্বরের সাধু! রামকৃষ্ণ ! মুখে সেই আনন্দ ভরা শিশুর হাসি, এত রাতে এখানে কি করে ?
পাছে আবার চলে যান, সহসা নিজের হাত বাড়িয়ে ধরলে রামকৃষ্ণের বাঁ হাত। অঘটন ঘটে গেলাে তক্ষুণি। প্রৌঢ় রামকৃষ্ণ চকিতে একটি দশমাসের শিশু হয়ে গেলাে। শিশু হয়েই হামা দিয়ে একেবারে অঘােরমণির বুকের কাছে চলে এলাে। হাত তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাে, “মা গাে, ননী দে।’
অঘােরমণি দিশাহারা হয়ে গেলাে। কেঁদে উঠলাে অঝােরে। বললাে, “বাবা, আমি কাঙালিনী। চির দুঃখিনী। ননী কোথা পাব ? আমি খুদ খাই, পাতা কুড়ােই। আজ আনি তাে কাল খাই। ক্ষীরসর-ননী আমি কোথায় পাবাে, বাবা!’
ওসব শােনবার মতাে ছেলে নয় গােপাল। অঘােরমণির হাত থেকে জপের মালা কেড়ে নিলাে, আঁচল টানতে লাগলাে সজোরে। বায়না ধরা অবুঝ ছেলের মতাে বললাে, “ওসব আমি জানি না। খেতে দিতে না পারিস তো মা হয়েছিস কেন, খেতে দিতে হবে। মা হয়ে সন্তানকে তুই অনাহারী রাখবি ?
তখন কি করে, শিকে থেকে নারকেল নাড়ু, পেড়ে আনলাে অঘােরমণি। গােপালের ছােটো হাতখানি ভরে দিলাে। বললাে, “বাবা গােপাল, এ বাসি নাড়ু। তােমাকে দিতে বুক ফেটে যাচ্ছে।’
কিসের বাসি নাড়ু। তৃপ্তি করে তাই খেতে লাগলাে গােপাল। গােপালবেশী রামকৃষ্ণ।
সকাল হতেই অঘােরমণি ছুটলাে দক্ষিণেশ্বরে। 
গােপাল! গােপাল ! মুখে শুধু এই স্নেহার্দ্র আকুলতা।
ঘরে ঢুকে পড়লাে, কোনাে ক্ৰক্ষেপ নেই, বসলাে রামকৃষ্ণের পাশ ঘেঁষে। মুখে শুধু সেই বিগলিত কান্না : গােপাল ! গােপাল।
ভাবাবেশে রামকৃষ্ণ অঘােরমণির কোলে চড়ে বসলেন। বাষট্টি বছরের বুড়ির কোলে আটচল্লিশ বছরের প্রৌঢ়।
আসলে যশােদার কোলে গােপাল। 
ঈশ্বর সন্তানরূপে অবতীর্ণ। শিশুরূপে অবতীর্ণ।
হে ঈশ্বর, শিশুর মত সরল করাে, সহজ করাে, স্বচ্ছ করে। নির্মল করাে, নিরাময় করে। তােমার খেলার সঙ্গী করে নাও। রিক্ত করাে, যাতে মুক্তির আনন্দে খেলতে পারি তােমার সঙ্গে।
ছােটো ছেলেটি হলেই তাে তুমি আমাকে ধরবে। আমার ভার নেবে। আর তুমি যদি আমাকে ধরাে, আমার ভার নাও, তবে আর আমার ভাবনা কি! আমাকে তখন পায় কে?

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর


‘তুমি ঈশ্বর দেখতে চাও? আমি তােমাকে এখনি দেখিয়ে দিতে পারি। বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ : ‘গুণদর্শনই ঈশ্বরদর্শন।’
শুধু গুণ দেখাে। যে পরিমাণে গুণ বিকশিত, সেই পরিমাণে ঈশ্বর প্রকাশিত। জল কোথাও ধানের শিষে শিশির বিন্দু, কোথাও গেড়েডােবা, কোথাও সরােবর-দীঘি, কোথাও হ্রদ, কোথাও নদী, কোথাও সমুদ্র। জল দেখাে। কোনােখানে প্রদীপ, কোনােখানে মশাল, কোনােখানে বা আবার দাবানল। আগুন দেখাে।
যেখানেই গুণ দেখেন, সেখানেই মাথা নােয়ান ঠাকুর । সে বীণকার মহেশ সরকারই হােক বা বিদ্যার সাগর বিদ্যাসাগরই হােক।
কাশীতে এসেছেন। মথুরবাবুকে বললেন, 'মহেশের বীণা শুনবাে।’
কোনাে একটা এঁদো বিশ্রী গলিতে মহেশের বাসা। সেখানে মথুরবাবুর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ গেলে মথুরবাবুর থাকে না। তাই মথুরবাবু বললেন, “বেশ তাে, খবর পাঠাই মহেশকে, আমার বৈঠক খানায়ই সে আসর জমাক।'
মথুরবাবুর নিমন্ত্রণ পেলে মহেশ কৃতার্থ হয়ে যাবে।
কিন্তু ঠাকুর থ বনে গেলেন। বললেন, “সে কী কথা? মহেশ কেন আসতে যাবে? আমি যাব তার বাড়ি। তার বাড়ি তাে এখন তীর্থ, সেখানে স্বয়ং সরস্বতীর আবির্ভাব। আমি সেখানে গিয়ে আমার প্রণাম রেখে আসবে। সেখানে তার বাজনাই তাে শুনব না, দেখবাে বীণাপাণিকে। সে আসবে না। আমি যাবাে। আমিই পিপাসু। আমিই তীর্থঙ্কর।”
তাই সেদিন বললেন মাষ্টারমশাইকে, ‘আমার বিদ্যাসাগরকে দেখতে বড় সাধ হয়। একদিন নিয়ে যাবে তার কাছে ?
কত গুণ! কতাে দয়া !
একটা ঝাঁকামুটে কলেরা হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়, তাকে কোলে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। বাছুরেরা মায়ের দুধ পায় না দেখে বন্ধ করেছে দুধ খাওয়া। ঘােড়ার কষ্ট দেখে চড়ে না আর ঘােড়ার গাড়ি। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে সাঁতরে পার হলাে দামােদর। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের অনৈক্য হতেই এক কথায় ছেড়ে দিলাে চাকরি, কলেজের প্রধান অধ্যক্ষের কাজ। আর কতােবড়াে পণ্ডিত, বিদ্যায় কি অগাধ অনুরাগ!
বিদ্যাই তাে সব ! বিদ্যা থেকেই ভক্তি, দয়া, শ্রদ্ধা, প্রেম। বিদ্যা থেকেই বিনয়, অহঙ্কার, শরণাগতি । বিদ্যাই ঈশ্বর মন্দিরে শেষ তােরণ।
বিদ্যাসাগরের কাছে এলেন মাষ্টারমশাই। বললেন, ‘দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতে চান।
‘পরমহংস? বিদ্যাসাগর অবাক মানলেন। ‘কেমনতরাে পরমহংস ? গেরুয়া-টেরুয়া পরে নাকি ?’
মাষ্টারমশাই বললেন, “আজ্ঞে না। সে এক আশ্চর্য পুরুষ। সন্যাসী হয়েও সংসারী, আবার সংসারী হয়েও সন্যাসীর শিরােমণি। লালপেড়ে কাপড় পরেন, গায়ে জামা রাখেন, পায়ে বার্নিস করা চটি জুতো। গাছতলায় ধুলােমাটিতে পড়ে থাকেন না, রাসমণির কালীবাড়িতে একটি ঘরের মধ্যে বাস করেন, তক্তপােশে বিছানা পেতে দিব্যি মশারী খাটিয়ে শােন-’’
‘তাহলে বৈশিষ্ট্য কি ?’
‘একেবারে বালকের মতাে। ঈশ্বর বই আর কিছু জানেন না, সর্বক্ষণ মা নামে মাতােয়ারা।’
‘নিয়ে এসে একদিন।’

********

খালের পােল পেরিয়ে শ্যামবাজার হয়ে আমহাষ্ট ষ্ট্ৰীটে পড়েছে। ঘােড়ার গাড়ি। এবার পড়বে বাদুড়বাগান। এর পরেই বিদ্যার সমুদ্র।
ভাবাবেশ হলাে ঠাকুরের। এখন আর অন্যকথা বলাে না, শুধু বিদ্যার কথা বলো। যে জ্ঞান ঈশ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যায়, অক্ষয় পুরুষকে জানতে শেখায়, সেই বিদ্যা।
ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘জামার বােতাম খােলা রয়েছে, এতে কোনাে দোষ হবে না?’
‘না, দোষ হবে না।' বললেন মাষ্টারমশাই, আপনার কিছুতে দোষ নেই। আপনার দরকার নেই বােতামে। 
 ‘নেই। নিশ্চিন্ত হলেন ঠাকুর।
এই বিদ্যাসাগর। পরনে থান কাপড়, পায়ে চটি জুতাে, গায়ে হাতকাটা ফ্লানেলের জামা। প্রসন্ন প্রশস্ত মুখ, উন্নত ললাট, শুভ্র দাঁত। খর্বদেহ সংহত তেজঃপুঞ্চ।
বিদ্যাসাগরকে দেখেই ঠাকুর বলে উঠলেন, “তুমি তাে সিদ্ধ গাে।' 
‘অমি সিদ্ধ? থমকে গেলেন বিদ্যাসাগর। কৈ, আমি তাে সাধন-ভজন করি না, মঠে-মন্দিরে যাই না, ঘুরি না তীর্থে ঘাটে, আমি —আমি সিদ্ধ হলাম কি করে ?’
ঠাকুর বললেন, ‘সিদ্ধ হতে হলে সাধন-ভজন করতে হয় না, যেতে হয় না মঠে মন্দিরে।’
“তবে?’
‘সিদ্ধ হলে কি হয় ? আলু-পটল যখন সিদ্ধ হয় তখন কি হয় ? সহাস্য বয়ানে জিগ্যেস করলেন ঠাকুর, ‘বলো কি হয় ? নরম হয়। তােমার হৃদয়ও পর-দুঃখে দ্রবীভূত হয়েছে। তুমি নরম হয়েছে। সুতরাং তুমি সিদ্ধ।’
পরও যা পরমও তাই। তুমি পরের দুঃখে কাঁদছো, তার মানে তুমি ঈশ্বরের দুঃখে কাঁদছো। নইলে যে সত্যি পর তার মধ্যে তুমি তােমার আপনজনকে দেখছাে কি করে? যে আর্ত সেই তােমার পরমাত্মীয়, তােমার ঈশ্বর। পরােপকারই ঈশ্বর সাধনা।
‘কিন্তু জানেন’, বললেন বিদ্যাসাগর, ‘কলাই বাটা সিদ্ধ হলে শক্ত হয়ে যায়।’
 ঠাকুর হাসলেন। বললেন, “তুমি কি বাটা ডাল? তুমি আস্ত ভাল। তুমি একটা গােটা মানুষ। যারা শুধু পণ্ডিত তারাই দরকচাপড়া। যেমন খুব উঁচুতে উঠেও শকুনের ভাগাড়ের দিকে নজর তেমনি শুধু-পণ্ডিতগুলাে উঁচুতে উঠেও বিষয়েই আবদ্ধ। কিন্তু তুমি তাে শুকনাে ডাঙা নও, তুমি সাগর। শুষ্ক পণ্ডিত নও, তুমি বিদ্যার অম্বুনিধি। বিদ্যা থেকেই দয়া, বিদ্যা থেকেই ভক্তি, বিদ্যা থেকেই বৈরাগ্য।
একঘর লােক শুনছে মুগ্ধ হয়ে।
‘তাই’, বললেন ঠাকুর, ‘আজ বড়াে 'আনন্দের দিন। আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন শুধু খাল-বিল, নদ-নদীই দেখেছি, আজ আমার সমুদ্র দর্শন।’
‘সাগরে যখন এসে মিললেন, বললেন বিদ্যাসাগর, তখন কিন্তু লােনা জল নিয়ে যান। ‘লােনা জল কেন ? তুমি ক্ষীর-সমুদ্র।’
আর তুমি? তুমি অমৃতের পারাবার। গুণী না হলে কি গুণ দেখে ? ভালাে না হলে কি ভালাে বলে ?
‘তােমার মধ্যে দেখছি আমি ঈশ্বরের শ্রী, সমস্ত রূপিণী বিদ্যামূর্তি।’
আসলে মানুষের শুধু দুটো দুঃখ। এক দুঃখের নাম অহঙ্কার, আরেক দুঃখের নাম পরশ্রীকাতরতা।
ঠাকুর বললেন, ‘অহঙ্কার যখনই মনে এই জিজ্ঞাসা আনবে তখনই জাগবে দীনতা। অহঙ্কারের উৎখাত হবে।'
যদু মল্লিক বললাে, “তুমি হরি হরি করতে পারাে, আমি কেন টাকা-টাকা করতে পারবাে না? টাকার মধ্যে কি ঈশ্বর নেই?’
ঠাকুর বললেন, ‘বল ঈশ্বরের টাকা তাের টাকা নয়। তােকে অবলম্বন করে ঈশ্বর বিত্তরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তাই এ তাের কৃতিত্ব নয়, এ ঈশ্বরের কৃপা। যখন নিজের সাফল্যে ঔজ্জ্বল্যে তাঁর কৃপা দেখবি, তখন আর কিসের অহঙ্কার ?’
তেমনি পরশ্রী মানে পরমের শ্রী। পরমের শ্রীকে দেখে কি কেউ কাতর হয়? এক আকাশ তারা বা এক মাঠ ফুল কি মানুষকে দুঃখিত করে ? কখনাে না-উল্লসিত করে। গহন পার্বত্য অরণ্যে একটি কলস্বরা নিঝর্রিণী, আবিষ্কার করলে মানুষ করতালি দিয়ে ওঠে। ভােরে-জাগা এক গাছ পাখির কাকলি শুনে কূল-ভাঙা গান জাগে হৃদয়ে। কোথাও তিনি বিত্তের স্ত্রী, বিদ্যার , শক্তির স্ত্রী, দীপ্তির স্ত্রী হয়ে বিরাজ করছেন। তাই পরশ্রীতে কাতর না হয়ে আনন্দিত হও। পরশ্রীকাতর নয় পরশ্রী-আনন্দিত।
“তাই যদু মল্লিকের মধ্যে আমি টাকা দেখি না, বৈভবরূপী বিভুকে দেখি। শ্ৰী দৰ্শনই ব্ৰহ্মদর্শন। 
‘কী ব্ৰহ্ম ?' জিগ্যেস করলেন বিদ্যাসাগর।
ঐটিই মজা।' বললেন ঠাকুর, ‘আর সব বস্তু মুখে আনা যায় কিন্তু ব্ৰহ্ম অনুচ্ছিষ্ট।'
‘আর সব বস্তু মুখে বর্ণনা করা যায় কিন্তু ব্ৰহ্ম অবর্ণনীয়। কোনাে রসনার সাধ্য নেই তার স্বাদের ব্যাখ্যা করে। তার সংজ্ঞা দেয় বা তার রূপরীতি জানায়-বােঝায়। সব তন্ত্র-মন্ত্র, শাস্ত্র-দর্শন এঁটো হয়ে গিয়েছে, তার মানে মুখে পড়া হয়েছে, বলা হয়েছে, নির্ণয়-নিরূপণ হয়েছে। কিন্তু ব্ৰহ্ম অনুচ্চারিত, অকথিত, অনিরূপিত। ব্ৰহ্ম অনুচ্ছিষ্ট।'
যে বােঝবার নয় তাকে বােঝান। যাকে রসনায় আনবার নয় তাকে বসানাে হলাে হৃদয়ে।
‘কিছু খাবার দিলে কি ইনি খাবেন? অনুচ্চ স্বরে মাষ্টারমশাইকে জিগ্যেস করলেন বিদ্যাসাগর।
শুনতে পেয়েছেন ঠাকুর। সরল খুশিতে বলে উঠলেন : ‘দাও না।
ব্যস্ত হয়ে বিদ্যাসাগর অন্তঃপুরে ঢুকলেন। নিয়ে এলেন একথালা মিষ্টি। বললেন, ‘এ খাবার বর্ধমান থেকে এসেছে।'
‘যেখান থেকেই আসুক, মধুর সব সময়েই মধুর।’ ঠাকুর হাত বাড়িয়ে নিলেন সেই থালা। 
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘তাহলে আপনি বলছেন ঈশ্বর কাউকে বেশী শক্তি কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?’
“নিশ্চয়ই। খেতে খেতে বলছেন ঠাকুর : ‘তাঁর যেখানে যেমন খুশি। পিঁপড়েতেও শক্তি আবার হাতিতেও শক্তি। একজন পালিয়ে যায়, আরেকজন হারিয়ে দেয়। নইলে তােমার কাছে আসি কেন ? অন্যের তুলনায় তােমার দয়া বেশী, বিদ্যা বেশী, হৃদয় বেশী—তাই। নইলে তােমার তাে আর শিং বেরােয়নি বা লেজ গজায়নি। আকাশের দিকে তাকাই কেন ? না, সেই তাে বৃহতের শেষ সীমা।’
ঠাকুর থামলেন। একটু হেসে বললেন, ‘এ-সব যা বলছি, কিছুই অজানা নয়। তবে কি জানাে? তােমার খবর নেই। বরুণের ভাণ্ডারে কতো কি রত্ন আছে তা বরুণ রাজাই জানে না।
‘অনেক বাবু আছেন যারা বাড়ির চাকর-বাকরেরই নাম জানেন না, বলতে পারেন না বাড়িতে কোথায় কি জিনিস আছে। আজে বাজে জিনিস নয়, এমন কি দামী দামী জিনিস। যার জিনিস নেই সে গরীব নয়, যার জিনিস থেকেও জিনিসের জ্ঞান নেই সে-ই যথার্থ গরীব।'
ঠাকুরের খাওয়া হলাে। 
ঠাকুর বললেন, ‘একবার যাবে রাসমণির বাগান দেখতে?
‘যাবো বৈ কি। বিদ্যাসাগর কৃতজ্ঞ-কণ্ঠে বললেন, আপনি এলেন আর আমি যাবাে না?’
ঠাকুর ছি ছি করে উঠলেন। বললেন, “আমার কাছে নয়, আমি অণুর অণু, রেণুর রেণু। যাবে গঙ্গাতীরে রাসমণির বাগান দেখতে।’
‘সেকি কথা? 
‘ওহে আমি হচ্ছি জেলে ডিঙি। খাল-বিলেও যেতে পারি, বড়াে নদীতেও যেতে পারি।' বললেন ঠাকুর, আর তুমি হচ্ছাে জাহাজ। কি জানি, যদি যেতে গিয়ে চড়ায় ঠেকে যাও।'
‘না, ঠেকবাে কেন? এখন তো ভরা বর্ষা।’
‘হ্যাঁ, যদি নবানুরাগের বর্ষা নামে তাহলে আর ভয় নেই। তখন সর্বত্র উত্তাল-জলের উজ্জ্বলতা। তখন সব চড়া সব অহং-ঢিপি জলে ডােবা। তখন নেই আর মান-অপমান, নেই আর আমি-তুমি। তখন সব একাকার।
ঠাকুর উঠলেন। বিদ্যাসাগর এগিয়ে দিলেন তাঁকে। প্রণাম করলেন।
ঠাকুর বললেন, “যদি জানলে ভালােবাসা এসেছে তখনই জানবে ঈশ্বর এসেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ


‘শুনেছি দেবেন ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তা করে। মথুরবাবুকে বলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, ‘তাকে ভারী দেখতে সাধ হয়। তার বাড়িতে নিয়ে যাবে একদিন ?
 ‘নিয়ে যাবাে। এক কথায় রাজি হলেন মথুরবাবু।
 ‘তােমার সঙ্গে তার আলাপ আছে ? 
“বাঃ, আমরা যে একসঙ্গে পড়েছি হিন্দু কলেজে। একসঙ্গে মানে এক ক্লাসে। মথুরবাবু বলেন, ‘তার সঙ্গে আমার খুব জানাশােনা।’
‘তবে একদিন নিয়ে চলাে সঙ্গে করে।' শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে ঝরে পড়লো ব্যাকুলতা।
‘ঢাল নেই তলােয়ার নেই নিধিরাম সর্দার—তুমি সেখানে যাবে কি। কতােবড়াে রাজপ্রাসাদের মতাে বাড়ি। তার বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের রাজতুল্য বিত্ত। বলতেই বলে প্রিন্স দ্বারকানাথ। কতাে তাদের জাঁকজমক, কতো তাঁদের বােলবােলা। তােমাকে সেখানে কে পুঁছবে ? দ্বারকানাথ নেই কিন্তু তাঁর বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁরই মতাে হাঁকডেকে লােক। জানাে, ব্যবসা করে অনেক টাকা লােকসান দেন দ্বারকানাথ, পাহাড়প্রমাণ ঋণ রেখে যান ছেলের ঘাড়ে। দেবেন্দ্রনাথ শেষ ক্রান্তি পর্যন্ত সেই ঋণ শােধ করে দিয়েছে।
‘কলেজে পড়া কৃতবিদ্য ব্যক্তি। কতবড়াে কর্মী, কতাে মহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত। হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি স্বদেশের উন্নতির পথে অন্তরায়—এই আন্দোলন চালাচ্ছে ইংরেজ শিক্ষক আর তারই অন্ধস্রোতে গা ভাসিয়েছে উগ্রপন্থী ছাত্রের দল। তারই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাে। অগ্রণী এই দেবেন্দ্রনাথ। নিজের ধর্মে অনাস্থা, নিজের সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা ও পশ্চিমকে অনুকরণ করবার লালসার বিরুদ্ধে তার অভিযান। তারই জন্যে রামমােহন রায় ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তন করলেন আর তার প্রধান ব্যাখ্যাতা দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মধর্ম তো হিন্দুধর্মের বিরােধী বা বিসম্বাদী নয়, আসলে তা হিন্দুধর্মেরই সার, নির্যাস।
“এ নিয়ে দেবেন্দ্রনাথের কতাে লেখা কতাে বক্তৃতা।
‘আমি অতশত জানতে চাই না।' বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, সে ঈশ্বরভক্ত তাে?
‘সে ঈশ্বরে শরণাগত। ঈশ্বর বই সে আর কিছু জানে না জীবনে। সে একটি অনির্বাণ ভক্তির প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। সে প্রদীপে শুধু আলােই নয় দাহও আছে। দুঃখ-দুর্দিনের দাহ কিন্তু সত্যের আলাে। |
 ‘যে এই দীপ জ্বালায় সে আর ঘুমুতে পারে না। সেই দীপই তাকে জাগিয়ে রাখে। জাগিয়ে রাখে সতর্ক প্রহরায়। দুর্যোগের ঝােড়াে হাওয়ায় তা না নিবে যায় অকস্মাৎ, আলস্যে ঔদাসীন্যে না স্তিমিত হয়। আর কোনাে ভার ভার নয় যেমন এই দীপক্ষার ভার। তাতে যােগাও নিষ্ঠার তেল, উস্কে দাও উৎসাহের কাঠি দিয়ে, আর তাকে ঘিরে রাখাে তােমার বিশ্বাসের দেয়াল দিয়ে। তাই ঘাের কষ্টের দিনে আত্মীয় গেলাে, সমাজ গেলাে, বিত্ত গেলাে, প্রভুত্ব গেলে, নিন্দায় ছেয়ে গেলে দশদিক, ধনী-মানী বন্ধু-স্বজন, সহায়-সম্বল, সব তাকে ত্যাগ করলে, তবু দীপের অকম্প শিখা নিবতে দিলাে না কিছুতেই। সেই শিখাকে বুকে করে লােকালয় ছেড়ে ঘুরতে লাগলাে অরণ্যে-পর্বতে। সেই আলােকে দেখতে লাগলাে রুদ্রের প্রসন্ন মুখ। যিনি ভয়ের ভয় ভীষণের ভীষণ, তাঁর বজ্রমুষ্টির অন্তরালে খুঁজে নিয়েছে বরাভয়ের অমৃত।
‘রাজার ছেলে ঋষি—এমন মহাপুরুষকে দেখবে না স্বচক্ষে ?’
‘কিন্তু তােমাকে পাত্তা দিলে তাে!’
—সংসারাসক্ত বিষয়-মত্ত লােক বিষয় পেয়েও কেন মনে যথার্থ সুখ পায় না? যে জিনিসের উপর আমাদের সবচেয়ে বেশী মমতা, বেশী আকর্ষণ, যার বিনাশ বিচ্ছেদের কল্পনাতেও আমাদের দুঃসহ কষ্ট তা থেকেই কেন আমরা সর্বাগ্রেই বঞ্চিত হই ? কেনই বা পার্থিব সুখ অনর্থক ও অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়? কেন মনে হয় একটা উৎকৃষ্টতর সুখ কোথাও আছে। নইলে, কেন--কেন তবু আমাদের ভােগস্পৃহা ? এই সব সিদ্ধান্ত করতে গেলে মনে হয় ঈশ্বর এমন বিধান করেছেন যে, শুধু তাতেই আমাদের আসল সুখ। শুধু তিনিই সমস্ত তৃপ্তির হেতু। যতােক্ষণ আমরা তাকে চোখের সামনে রাখি, তার ইচ্ছার অনুগত হয়ে কাজ করি ততােক্ষণই আমাদের যথার্থ আনন্দ।
আরাে কী বলছেন শােননা।
—আমরা ক্ষুদ্র জীব হয়ে যে ঈশ্বরকে জানবার অধিকারী হয়েছি এই আমাদের সর্বোত্তম সৌভাগ্য। কিন্তু এই মহত্তম অধিকারের উপযুক্ত হতে হলে আমাদের সর্বভাবে পবিত্র হতে হবে। যেমন ভদ্র সমাজের উপযুক্ত হবার জন্য ভদ্র হতে হয়, সাধুর সঙ্গে বসবাসের জন্য সাধু হতে হয় তেমনি সেই পবিত্র-স্বরূপের সান্নিধ্য পেতে হলে পবিত্র হওয়া চাই। বাহ্যিক সাধুভাব প্রকাশ করতে পারলে সাধুর সঙ্গে কখনাে-কখনাে বিনয় রক্ষা করা যায় বটে কিন্তু পরমেশ্বরের সকাশে সেরূপ হবার নয়। সর্বান্তর্যামী পরমেশ্বরের কাছে বিনয় রক্ষা করতে গেলে মন, বাক্য ও কার্য যুগপৎ পবিত্র রাখা দরকার।
“তবে? এমন সুন্দর যার কথা, এমন গভীর যার ঈশ্বর অনুভব, চলাে, তাকে দেখে আসি দু’চোখ ভরে। তাকে দেখে আসাও পুণ্য।’
 ‘যদি তােমাকে ঢুকতে না দেয় বাড়িতে ? তুমি কোথাকার কে এক হেঁজিপেঁজি লােক-' মথুরবাবু নিরস্ত করতে চাইলেন।
হাসলেন শ্রীরামকৃষ্ণ : ‘যদি ঢুকতে না দেয় ফিরে আসবাে। অন্তত দেখে আসবাে তো বাড়িটা। তার বাড়িটাই তাে তীর্থ।’ তারপর বললেন আশ্বাসের সুরে, ‘তা হয় না। পারবে না আমাকে ফিরিয়ে দিতে। যদি শােনে আমিও ঈশ্বর-ঈশ্বর করি—কাছে ডেকে নেবে হাত বাড়িয়ে, আনন্দের কথা শােনাবে।’
নিয়ে গেলেন মথুরবাবু। একেবারে দেবেন্দ্রনাথের কামরায়। 
‘চিনতে পারাে?’
“আরে, মথুর না? চেহারাটা একটু বদলেছে দেখছি। ভুঁড়ি হয়েছে।’ হাসির রেখাটুকু মিলিয়ে যেতেই উৎসুক চোখে জিগ্যেস করলেন দেবেন্দ্রনাথ : ‘ইনি কে?
“ইনি ঈশ্বর-ঈশ্বর করে পাগল।’ তােমাকে দেখতে এসেছেন। 
কে কাকে দেখে! 
তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলেন দেবেন্দ্রনাথ। 
‘দেখি তােমার গা। মুখভাবে প্রসন্ন বন্ধুতা, সহজ সুরে বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আশ্চর্য, পারলেন বলতে। এতােটুকু কুণ্ঠা হলাে না। আরাে আশ্চর্য দেবেন্দ্রনাথের ব্যবহার। অনায়াসে তিনি গায়ের জামা তুলে ধরলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ দেখলেন দেবেন্দ্রনাথের গায়ের রং গৌর, তার উপর একরাশ সিঁদুর ছড়ানাে।
তার মানেই দেবেন্দ্রনাথের দিব্যভাব উপস্থিত। তিনি এসেছেন ঈশ্বর-সান্নিধ্যে। আগুনের সামনে এসেছেন বলেই তাঁর গায়ে এই সতেজ রক্তিমা।
ঠিক লােকের কাছেই এসেছি। পাশে বসে পড়লেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বললেন, “আমাকে কিছু বলো।”
‘আমি কী বলব!’
‘না, বলো। তুমি কতবড়ো পণ্ডিত। সমস্ত বেদ-উপনিষদ তােমার নখদর্পণে। এ পাণ্ডিত্যও তােমার প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহ। বলাে কিছু, শুনি। ঈশ্বরীয় কথার কি কিছু শেষ আছে ? যতাে বলবে ততাে নতুন। 
বলতে লাগলেন দেবেন্দ্রনাথ : ‘এই জগৎ যেন একটা বিরাট ঝাড় লণ্ঠন, আর জীব হচ্ছে এক-একটি ঝাড়ের দীপ। এ জগৎ কে জানতাে? ঈশ্বর মানুষ করেছেন তাঁর মহিমা প্রকাশ করবার জন্যে। ঝাড়ের দীপ থাকলে সব অন্ধকার, ঝাড় পর্যন্ত দেখা যায় না।’
 ‘আরাে একটু বলাে।’
‘ঈশ্বরের মহিমা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। প্রভাতে আমাদের নিমীলিত নয়ন মুক্ত হওয়া মাত্রই তার চক্ষু আমাদের ওপরে স্থাপিত দেখি। আমরা যদি তাঁর জন্যে ব্যাকুল হই, যদি সরল হৃদয়ে তাঁকে প্রার্থনা করি, যদি ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুতেই আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার নিবারণ না হয়, তবে অন্তরে-বাইরে দূরে-কাছে সকল স্থানেই তাঁর প্রকাশ দেখতে পাই। যখন নিজেকে পবিত্র করি, ঈশ্বরের কাছে মুক্ত করি হৃদয় দ্বার, সতৃষ্ণ হয়ে অন্বেষণ করি তাঁকে, তখন গিরিগুহা, উদ্যান-কানন, নির্জন সজন সকল কিছুই তাতে ভরে ওঠে।
‘এবার আপনি কিছু বলুন।’ অনুরােধ করলেন দেবেন্দ্রনাথ। 
‘তুমি কলির জনক, তােমাকে দেখে আমার খুব আনন্দ।’ ভাবময় উজ্জ্বল মুখে বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ, ‘জনক এদিক-ওদিক দু’দিক রেখে খেয়েছিলাে দুধের বাটি। তুমি সংসারে থেকেও ঈশ্বরে মন রেখেছে, তুমিই তত বাহাদুর, তুমিই তাে বীরপুরুষ! তাই তাে তােমাকে আমার দেখতে আসা।
‘জনক একদিকে নিজের হাতে লাঙল নিয়ে চাষ করছে, আরেক দিকে দেশদেশান্তর থেকে আসা জ্ঞানপিপাসুদের ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দিচ্ছে।’
‘আরাে একটু বলুন।’
‘এক হাতে কাজ করে আর এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাকো। কাজ শেষ হলে দু’হাতে ঈশ্বরকে ধরবে।
‘যুদ্ধ যখন করতেই হবে, সংসারীদের বলি, কেল্লায় মানে সংসারে থেকেই যুদ্ধ করা সহজ। মাঠে দাঁড়িয়ে, মানে সংসার ছেড়ে এসে যুদ্ধ করার অনেক বিপদ। যদি খেতে না পাও ঈশ্বর-টিশ্বর সব ঘুরে যাবে।
‘যা চাও তাও তাই কাছে রয়েছে। অথচ লােকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ব্যস্তবাগীশ লােক কাছের জিনিসও দেখতে পায় না। একজন গামছা খুঁজে খুঁজে তারপর দেখে কাঁধেই রয়েছে। আরেকজন, শােনোনি বুঝি, তামাক খাবে বলে অনেক রাত্রে এক প্রতিবেশীর বাড়ি টিকে ধরাতে গেছে। কিন্তু তারা তখন সব ঘুমিয়ে। অনেকক্ষণ ধরে দরজা ঠেলাঠেলি করায় একজন বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলাে—কি গাে, এতাে রাত্রে কি মনে করে ? তখন সেই লােক বললাে, আরে ভাই, জানাে তাে তামাকের নেশা আছে, তাই এই টিকেখানা ধরাবাে বলে এসেছি। দেশলাই আছে ? তখন প্রতিবেশী বললাে-বাঃ, তুমি তাে বেশ লােক। এতাে রাত্রে দোর ঠেলাঠেলি করে আমাদের ঘুম ভাঙালে। তােমার হাতেই তো লণ্ঠন।'
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মোৎসবে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ করলেন, ‘আপনাকে আসতে হবে আমাদের উৎসবে।’
“সে ঈশ্বরের ইচ্ছা। দেখছে তত আমার অবস্থা। বেশবাসের দিকে ইঙ্গিত করলেন : ‘কখন কীভাবে তিনি রাখেন কিছু ঠিক নেই।’ 
‘বেশ তো, ধুতি আর উড়নি পরে আসবেন। জামা-টামা নাই পরলেন। আপনাকে কেউ কিছু বললে আমার কষ্ট হবে।’
‘তা পারবাে না। আমি পারবাে না বাবু হতে।’
 মথুরবাবু আর দেবেন্দ্রনাথ হাসতে লাগলেন।

*********

দেবেন্দ্রনাথ তখন আছেন গঙ্গার উপর নৌকা, উত্তেজিত ঝড়ের মতাে তাঁর নিভৃতকক্ষে ঢুকে পড়লাে নরেন। জিগ্যেস করলাে, আপনি দেখেছেন ঈশ্বরকে ?
‘আমি ? অভিভূতের মতাে তাকালেন দেবেন্দ্রনাথ।
‘দেখলে আপনিই তাে দেখবেন। আপনি বর্তমান বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু। প্রগাঢ়স্বরে বললো নরেন, ‘আপনি মহর্ষি।
‘কিন্তু আমি দেখলে তােমার লাভ কি? বললেন মহর্ষি, ‘তােমাকে নিজে দেখতে হবে।’
‘কোথেকে দেখবে? বিশাল চোখে তাকিয়ে রইলাে নরেন ।
 ‘দেখবে, দেখবে—তােমার এমন যােগীচক্ষু, তুমি দেখবে না?’
যােগীচক্ষু দিয়ে আমি কী করব? আমি চর্মচক্ষে দেখতে চাই ঈশ্বরকে। আর, এক্ষুণি—এক্ষুণি। দেরী করবার আমার সময় নেই। তােমরা কেউ যদি ঈশ্বকে দেখে থাকো, আমাকে দেখিয়ে দাও। একজন পারলে কেন আরেকজন পারবে না?
পারাে, কেউ পারাে দেখাতে ? 
আমি পারি। 
তুমি পারাে, কে তুমি?
আমি কেউ না, কিছু না। আমি মুখখু পেঁয়াে পুজুরী বামুন। আমি দক্ষিণেশ্বরে থাকি। তুই আয় আমার কাছে। আমি কততদিন ধরে তাের জন্যে পথ চেয়ে বসে আছি। তােক আমি দেখাবাে ঈশ্বর।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও শিবনাথ শাস্ত্রী


বিদ্যাসাগরের স্কুলে ভর্তি হয়েছে শিবনাথ। ন-দশ বছর বয়স, নাদুস নুদুস চেহারা। বাপ-মা ডাকে ভোঁদড় বলে। 
স্কুলে কী-একটা দুষ্টুমি করেছে শিবনাথ। ধরা পড়ে গিয়েছে। স্বয়ং বিদ্যাসাগরই ধরেছেন, ‘এসাে আমার ঘরে।’ 
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শিবনাথ বিদ্যাসাগরের ঘরে এসে ঢুকলাে।
কোণে দাঁড় করালেন। একটা পাতলা পেপার কাটার দিয়ে পেটের উপর মারলেন দু’ঘা।
এই শাস্তি ?
না। আরও আছে। শিবনাথের ভুঁড়ি দেখে বিদ্যাসাগরের লােভ হলাে। তিনি তাঁর ডান হাতের আঙুল দুটো চিমটের মত করে শিবনাথের ভুঁড়ির মাংস টেনে ধরলেন। আসলে এটা আদর।
মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের বাড়িতে থেকে পড়ে শিবনাথ। দ্বারকানাথ বিদ্যাসাগরের বন্ধু। সেই সুবাদে বিদ্যাসাগর প্রায়ই আসেন দ্বারকানাথের বাড়ি। এসেই শিবনাথের খোঁজ করেন। শিবনাথ কাছে এসে দাঁড়ালেই তার ভুঁড়িতে চিমটি কাটেন।
‘পালা! পালা! বিদ্যেসাগর এসেছে।’
 শিবনাথের কানে এ খবর পৌঁছােলই সে হাওয়া হয়ে যেতাে।
পিসতুতাে ভাই রামযাদব চক্রবর্তীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে শিবনাথ। 
মা গােলকমণি ছুটে এসে মাঝখানে পড়ে দু’জনের কান ধরে দু’থাবড়া মেরে ঝগড়া ভাঙিয়ে দিলেন। রামযাদব কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করলাে : ‘মামীমা-মায়ে-পােয়ে পড়ে ওরা আমায় মেরেছে।'
আর যায় কোথা! কী ব্যাপার কিছু সন্ধান না করেই রামযাদবের মা গালাগালি শুরু করলেন। সন্ধ্যার দিকে শিবনাথের বাবা হরানন্দ ভটচাজ, বাড়ি ফিরছেন, গালাগালি শুনে বােনের বাড়ি ঢুকে ব্যাপার কী জেনে নিলেন।
তাড়াতাড়ি শিবনাথকে ভাত বেড়ে দিলাে মা। বললাে, ‘শীগগির খেয়ে চলে যা। ভট্টচাজি পাড়ায় যে যাত্রা হবে তাই গিয়ে শােন্। সকালবেলায় ফিরিস। ততােক্ষণে কর্তার রাগ পড়ে যাবে।
‘পাজীটা কোথায়? বাড়ি পৌঁছেই হাঁক দিলেন হরানন্দ।
রান্নাঘরের দরজার দু’কাঠ ধরে পথ আগলে দাঁড়ালেন গােলকমণি। বললেন, ‘ঘরে নেই’।
হরানন্দ রান্নাঘরের দিকে এগােলেন না, উঠোনে দাড়িয়েইষললেন, ‘দা-খানা দাও।’
‘কেন, দা কেন ? 
“সে কথায় কাজ কী? দাও বলছি।' 
গােলকমণি দা বার করে দিলেন। দা নিয়ে চলে গেলেন হরানন্দ।
এ সুযােগে তাড়াতাড়ি আঁচিয়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পালালাে শিবনাথ। একেবারে সেই যাত্রার আসরে।
‘সব সময় ভীড়ের মধ্যে থাকবি।' বলে দিলেন গােলকমণি, ‘মুখে-মাথায় কাপড় বেঁধে।’
আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত কাটলাে নির্বিবাদে। শিবনাথের মনে আর ভয় ভাবনা রইলাে না। আসরের বাইরে এসে বেড়াতে লাগলাে।
কে যেন হঠাৎ পিছন থেকে ঘাড় চেপে ধরলাে।
‘কে রে? চমকে ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে পিছন ফিরে তাকালে শিবনাথ। সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেলাে। যমের চেয়েও নিকট, বাবা ধরেছেন।
পিঠে দু'ঘা বসিয়ে দিলেন হরানন্দ। বললেন, “খবরদার, কাঁদতে পারবিনে।'
অসম্ভব, সেই মার খেয়ে না কাঁদা, কান্না গিলে খাওয়া। তবু প্রাণপণ শক্তিতে চুপ করে রইলাে শিবনাথ।
বাড়ি নিয়ে গিয়ে শিবনাথকে দাঁড় করালেন উঠোনে। বললেন, ‘দাঁড়িয়ে থাক, নড়িসনে, আমি আসছি।’
দা দিয়ে বাঁশের ছড়ি কেটে রেখেছিলেন তাই খুঁজতে লাগলেন হরানন্দ। গােলকমণি যে সে ছড়ি পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছেন তা আর তাঁর জানা নেই।
‘ওরে পালা, মার খাবার জন্যে কেন দাঁড়িয়ে আছিস বােকার মতাে?' আতঙ্কিত আত্মীয়ের দল সমস্বরে বললাে শিবনাথকে।
শিবনাথও অটল। বললো, “না, বাবা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন, আমি দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়বাে না একচুল।’
আধঘণ্টা কেটে গেলাে, ছড়ি না পেয়ে অন্য অস্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন হরানন্দ, শিবনাথ ঠায় দাড়িয়ে। মারবার সঙ্কল্পে হরানন্দ অটল আর পিতৃআজ্ঞা পালন করবে এই বাধ্যতায় শিবনাথও সমাধিনিষ্ঠ।
অবশেষে একটা চেলাকাঠ নিয়ে উদ্যত হলেন হরানন্দ। 
রামযাদবের মা - হরানন্দের দিদি, সেই এলাে হন্তদন্ত হয়ে। “ওরে কী সর্বনাশ, এই কাঠের বাড়ি মারলে ছেলে কি আর বাঁচবে?
কার কথা কে শোনে ? 
রামযাদবের মা কাড়তে গেলে কাঠ, হুটোপুটি শুরু হয়ে গেলাে। দিদিকে ধাক্কা মারলেন হরানন্দ, তিন-চার হাত দূরে ছিটকে পড়লাে।
গােলকমণি দাড়িয়ে আছেন চিত্রার্পিতের মত।
“কী দেখছাে এদিকে? ছেলে মেরে ফেলতে হয়, মেরে ফেললাে। আমার চোখের সামনেই মেরে ফেলাে।'
‘হ্যা, ফেলবােই তাে। হরানন্দের মাথায় খুন চেপেছে। যারা এগিয়ে এসেছিলাে নিরস্ত করতে, মার খেয়ে পিছু হঠলাে।
আর শিবনাথ ? শিবনাথ মার খেয়ে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়লাে।
যখন জ্ঞান হলাে, দেখলে তার বাবা ও আরও দু’জন লােক তার গায়ে তার্পিন তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন। মা বাড়ির কাছের জঙ্গলে পড়ে আছেন। 
 ‘বাবারে, তুই কি আছিস? পাগলের মতাে পড়ি-কি-মরি করে ছুটে এলেন গােলকমণি।
একটু সুস্থ হবার পর শিবনাথ বললাে আপন মনে, ‘ঝগড়া করেছিলাম, আমার দোষ হয়েছিলাে। তাই বলে লঘু পাপে এই গুরুদণ্ড দেওয়া কি ঠিক হয়েছে ?’
দেখলে, হরানন্দ মাটিতে নাক ঘষে নাকে খত দিচ্ছেন। 
যেমন প্রতিজ্ঞায় তেমনি অনুতাপেও ঐকান্তিক।
গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়ে পাঠাতে নিষেধ করে জমিদাররা হুকুমনামা জারি করেছেন। যে পাঠাবে তাকে একঘরে করে ছাড়বে।
‘কি, এতাে বড়াে স্পর্ধা! হরানন্দ রুখে দাঁড়ালেনঃ “আমার ছেলে মেয়ে পড়বে কি পড়বে না তা অন্য লােকে ঠিক করে দেবে? অসম্ভব।'
“ওটা তাে ব্রাহ্মদের স্কুল। জমিদার তরফ পিঠে হাত বুলুতে চাইলে: “আর আপনি একজন সনাতনপন্থী হিন্দু, সদাচারী ব্রাহ্মণ।’
‘তাতে কী। নিজের প্রতিজ্ঞায় নিশ্চল হরানন্দ, বললেন : “তাতে মেয়ে পড়ানাে না পড়ানােয় কী এসে যায় ?
সব মেয়ে চলে গিয়েছে স্কুল ছেড়ে। শুধু দু’জন আছে খুঁটি ধরে। শিবনাথের দুই বােন। আর তৃতীয়জন—বিদ্যালয়ের পণ্ডিত।
শিবনাথ বড়াে হয়েছে, ভবানীপুরে চৌধুরীদের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ছে। বাবা একখানা সরকারী কাগজ পাঠিয়েছেন, আদেশ করেছেন নিজে গিয়ে স্কুল ইনস্পেক্টর উড্রো সাহেবের হাতে দিয়ে এসাে।
দরিদ্র অবস্থা, বুট জুতা কেনার সঙ্গতি নেই শিবনাথের, চটি পায়েই উড্রো সাহেবের আপিসে এসে উপস্থিত হলে শিবনাথ। কাগজখানা উড্রো সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলাে। উড্রো তা নিলে না। রুঢ় কণ্ঠে জিগ্যেস করলাে, ‘তুমি আপিস ঘরের বাইরে জুতাে ছেড়ে আসনি কেন?’
“কৈ, এ নিয়ম তাে জানতাম না।’ 
শিবনাথ সােজা হয়ে দাঁড়ালাে।
‘তুমি জুতাে পায়ে ঘরে ঢুকে আমাকে অপমান করেছে।’ গম্ভীর হলাে উড্রোঃ ‘জুতো ছেড়ে এসে বলছি।’
‘খালি পায়ে ঢুকবে? 
‘হ্যাঁ, খালি পায়ে।'
‘এমন অদ্ভুত কথা তাে শুনিনি’ ! বললাে শিবনাথ : ‘ঘরের মধ্যে আপনার পায়ে জুতাে, আপনার কেরাণীবাবুর পায়ে জুতাে, আর আমিই জুতাে ছাড়া হয়ে থাকবাে ? বেশ, আপনারা খালি-পা হােন, আমিও খালি-পা হবো।’
‘আমাদের যে বুট জুতাে, আর তােমার—' 
‘আমারটা চটি। বুট হলে আপনার মান থাকতাে আর চটি বলেই আপনার মান গেছে, এ আমি মানতে প্রস্তুত নই। বললাে শিবনাথ, ‘জুতাে জুতোই, বুটে-চটিতে কোনও তফাৎ নেই। 
‘তুমি জুতাে ছাড়বে কিনা বলল।’ সাহেব হুমকে উঠলাে।
 ‘মাপ করবেন। পারবােনা ছাড়তে।’
 ‘তবে যাও, তােমার চিঠিও নেবে না।’
‘এই আপনাদের টেবিলের ওপর রইলাে ! নেন নেবেন, না নেন ফেলে দেবেন। আমার কাজ আমি করে গেলাম।’ বলে টেবিলের উপর চিঠি রেখে শিবনাথ বেরিয়ে গেলাে।
সেই শিবনাথ পৈতে ফেলে দিয়ে ব্রাহ্ম হলো। কেশব সেনের কাছে দীক্ষা নিলাে।
হরানন্দ ছেলেকে গড়িয়ে দিলেন, ভাড়াটে গুণ্ডা রাখলেন এ-মুখাে হলে যেন লাঠি-পেটা করে গ্রামের বার করে দেওয়া হয়।
তবু লুকিয়ে মাঝে মাঝে এসে মায়ের পায়ের ধুলাে নিয়ে যায়। 
সেদিন মার কাছে বসে মুড়ি খাচ্ছে শিবনাথ।
তাই দেখে একজন স্ত্রীলােক বললাে, “ওমা, সে কী গাে? মুড়ি খায়? কথা কয় ? তবে কে বলে ও আমাদের মধ্যে নেই ?
পাড়ার ছােটো একটা মেয়ে ছুটে এসে খবর দিলাে, লাঠিয়াল আসছে। তাড়াতাড়ি মাকে প্রণাম করে খিড়কির দোর দিয়ে পালিয়ে গেলে শিবনাথ।
দরিদ্র ব্রাহ্মণ তার ছেলেকে ঠেঙাবার জন্য মাইনে দিয়ে লাঠিয়াল রাখছে — কতােবড়াে স্বধর্মনিষ্ঠ হলে এ সম্ভব, ভাবতে অভিভূত হলে শিবনাথ। ভাবতাে, বাবার এই প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা যদি আরও একটু বেশী হয়ে থাকতাে তার মধ্যে।
বাবার ছেলে বলেই শিবনাথও বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হলাে না তার আদর্শ থেকে। দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা নির্যাতন-কিছুতে না। আঠারাে উনিশ বছর বাবা তার মুখদর্শন করেননি, বাক্যালাপ করেননি, তবুও না। শিবনাথও তার নিজের বিশ্বাসে নির্বিচল।
হরানন্দ বিদ্যাসাগরকে বললেন : “মানুষ যেমন ছেলে যমকে দেয় তেমনি ছেলে কেশবকে দিয়েছি।'
শুনে বিদ্যাসাগর কেঁদে ফেললেন।
পথে একদিন শিবনাথের সঙ্গে দেখা। ‘হ্যাঁরে, তাের কেমন করে চলে?' জিগ্যেস করলেন বিদ্যাসাগর।
‘খুব কষ্টে চলে, শুধু ক’টা স্কলারশিপের টাকা।’
তখন আবার একবার চোখ ভিজে উঠলাে বিদ্যাসাগরের। একবার বাপের দুঃখে দুঃখ। আবার ছেলের কষ্টে ক্লেশ।
কিন্তু শিবনাথকে দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের মহা আনন্দ।
‘এই যে, শিবনাথ।’ সহাস্যমুখে বললেন ঠাকুর, “তুমি ভক্ত, তােমাকে দেখে ভারী আনন্দ হয়। গাঁজাখােরের স্বভাব—আরেকজন গাঁজাখােরকে দেখলে ভারী খুশি হয়।’
নিরাকারবাদী ব্রাহ্ম হলে কী হয়, শিবনাথের খুব ভালাে লাগে রামকৃষ্ণকে। ধর্ম সাধনার জন্য চূড়ান্ত ক্লেশ করছেন—এতে ক্লেশ আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই। তাছাড়া ধর্ম মানেন, সমস্ত মতবাদকেই শ্রদ্ধা করেন, সমস্ত মানুষকেই ভালােবাসেন, বুকে ধরেন। এমন লােক আর দু’টি হয় না।
একজন ব্রাহ্মভক্ত জিগ্যেস করলেন, ‘মশায়, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার ?
‘তাঁর ইতি করা যায় না।' বললেন রামকৃষ্ণ, ‘তিনি নিরাকার, আবার সকার । ভক্তের জন্য সাকার। যারা জ্ঞানী, যারা জগৎকে স্বপ্ন বলে দেখছে, তাদের পক্ষে নিরাকার। ভক্ত জানে আমি একটি জিনিস। তাই ভক্তের কাছে ঈশ্বর ব্যক্তি হয়ে দেখা দেন। এই ধরো না শিবনাথ, শিবনাথের দিকে প্রীতিপূর্ণ চোখে তাকালেন ঠাকুর : ‘যতক্ষণ ও সভায় আসেনি ততােক্ষণ ও নিরাকার—কতো তার নাম আর গুণের কথা রয়েছে। আর যেই সে এসে পড়লাে, সাকার হয়ে উঠলাে, অমনি সব কথা বন্ধ। তখন তার দর্শনেই সুখ।’
সবাইকে প্রণাম করছেন ঠাকুর। প্রণাম করতে করতে বলছেন, ‘জ্ঞানীর চরণে প্রণাম, ভক্তের চরণে প্রণাম, সাকারবাদীর বিকারবাদীর চরণে প্রণাম, আগেকার ব্রাহ্মজ্ঞানীদের, ব্রাহ্মসমাজের ইদানীং ব্ৰহ্মজ্ঞানীদের চরণে প্রণাম।’
এক খৃষ্টান পাদ্রী বন্ধুকে নিয়ে এসেছে শিবনাথ। বললাে, ‘আমার এই খৃষ্টান বন্ধু আপনাকে দেখতে এসেছেন।'
ঠাকুর অমনি প্রণত হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বললেন, “যীশু খৃষ্টের চরণে আমার শত শত প্রণাম।’
‘যীশুকে যে আপনি প্রণাম করছেন তাঁকে আপনি কী মনে করেন?’ পাদ্রী প্রশ্ন করলাে।
‘ঈশ্বরের অবতার মনে করি।' 
‘যেমন আপনাদের কৃষ্ণ, রাম, তেমনি ? 
‘হ্যা, তেমনি। ভগবানের অবতার অসংখ্য। যীশুও এক অবতার।’ 
‘অবতার বলতে আপনি কী বােঝেন?’
‘কী বুঝি? শুনেছি কোনাে কোনাে জায়গায় সমুদ্রের জল জমে বরফ হয়, ধরবার ছোঁবার মতাে হয়। তেমনি অনন্ত সমুদ্রের মতাে অনন্ত শক্তি জগতে ব্যাপ্ত হয়ে আছে, কোনােও বিশেষ কারণে কোনােও এক বিশেষ স্থানে ঐশী শক্তি জমাট বেঁধে মূর্তি ধারণ করলাে, ধরবার ছোঁবার মতাে হলাে, সেইটেই ভগবানের অবতার।'
ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে গেলাে পাদ্রী। ধর্মের সার্বভৌমিকতা শিবনাথ ও উপলব্ধি করলাে।
‘শিবনাথকে দেখলে আমার আনন্দ হয়।’ বলছিলেন ঠাকুর, ‘যেন ভক্তিরসে ডুবে আছে। আর যাকে অনেকে গােণে মানে তাতে নিশ্চয়ই ঈশ্বর শক্তি প্রকাশিত। 
শিবনাথকে দেখবার জন্য অস্থির হয়েছেন ঠাকুর। ব্রাহ্ম পাড়ার মধ্যে বাড়ি, চলাে, দেখে আসি ভক্তকে। দ্বারপ্রান্তে এসে শুনলেন শিবনাথ বাড়িতে নেই।
‘কী হবে কেমন করে থাকবে তাকে না দেখে?’ 
‘কেন, শিবনাথকে চান কেন?’
“কেন চাই? যে ঈশ্বর চিন্তা করে তাকে দেখাও যে কতকটা ঈশ্বরকে দেখা।’
সরকারী চাকরী ছেড়ে দিয়েছে শিবনাথ। বিদ্যাসাগরকে একজন এসে জানালাে : মশাই, পাজীটা সুখের চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে।’
বিদ্যাসাগরও তে চাকরী ছাড়া। তিনি হেসে বললেন, ‘কেন বলছাে? সে তাে আমার মনের মতােই কাজ করছে।' 
কতো না জানি কষ্টে আছে শিবনাথ, কষ্টে থেকেও ভগবানে শুধু লগ্ন নয়, মগ্ন হয়ে আছে—ব্যাকুল হয়ে রামকৃষ্ণ চলে এসেছেন।
কিন্তু হরানন্দ, পিতৃদেব কি আসবেন না? 
 রােগশয্যায় পড়ে বাবাকে চিঠি লিখলাে শিবনাথ। আগে আগে চিঠি গেলে ছিড়ে ফেলতেন, এবার কেন কে জানে, খুলে ফেললেন চিঠিটা। জীবন সংশয় অসুখ। পায়ের ধুলাে চেয়েছে।
দেখা না হােক, চিকিৎসার বন্দোবস্তটা করে দিয়ে আসি। স্ত্রীর গয়না বাঁধা দিয়ে টাকা যােগাড় করে বেরুলেন।
‘বাবা এলেন না কেন?’ মাকে কাছে পেয়ে আকুল হয়ে জিগ্যেস করলাে শিবনাথ।
‘কোবরেজ ডাকতে গিয়েছিলেন।’
যথাসময়ে কোবরেজ এলাে। কিন্তু বাবা কৈ ? 
কবিরাজ বললাে, “উনি রাস্তার একটা দোকানে বসে আছেন।’
শিবনাথ ভাবতে লাগলাে, বিষয়-সম্পত্তি না থাক, বাবার এই তেজস্বিত, এই সত্যানুরাগ, এই দৃঢ়চিত্ততা—এই উদার সহৃদয়তার যেন উত্তরাধিকারী হই।
‘ঈশ্বরের জন্যে ভক্ত সব ছাড়তে পারে। দেখাে বিশ্বনাথকে।’ বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, ভক্তিতে দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে আছে। আর জানবে ভক্তই সার কথা, শেষ কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও মাইকেল


মাইকেল মধুসূদন ব্যারিষ্টার হয়ে এসেছে। উগ্র সাহেব। খ্রীষ্টান। তারপর, আবার নাকি মদ খায়। 
সে এসেছে দক্ষিণেশ্বরে। 
শ্রীরামকৃষ্ণের ডাকে নয়, মথুরবাবুর ছেলে ঘারিকের ডাকে। 
মথুরবাবু তখন নেই, বড়াে ছেলে দ্বারিকই বিষয়-সম্পত্তি দেখাশােনা করছে। যা বিষ হয়, তাই বিষয়। মামলা বেধেছে পাশে বারুদ ঘরের সাহেবদের সঙ্গে।
সে মামলায় নতুন ব্যারিষ্টার মধুসূদনকে ডাকো। তাকেই কাগজপত্ৰ বুঝিয়ে দাও। যা ফি চায় তাই দেবাে। 
দপ্তরখানার পাশে বড় ঘরে বসিয়েছে মধুসূদনকে। দ্বারিক নিজেই উদ্যোগী হয়ে দেখাচ্ছে কাগজপত্র। কিন্তু মধুসূদন যেন কেমন উন্মনা। দৃষ্টি যেন দেশান্তরী। মামলার নথিতে মন না দিলে ব্যারিষ্টারি করবে কি ? দ্বারিক বিশ্বাস চঞ্চল হয়ে উঠলাে।
হঠাৎ কাগজ থেকে চোখ তুলে মধুসূদন বললাে, “শ্রীরামকৃষ্ণকে একবার দেখতে চাই? 
‘ও! এই কথা ? এখুনি ডাকছি ঠাকুরকে।
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে খবর গেলাে। নিজের ঘরটিতে চুপ করে বসে আছেন, দপ্তরের আমলা এসে বললাে, ‘বাবু তলব করেছেন।'
‘কেন হে, ব্যাপার কি ? 
‘মাইকেল মধুসূদনের নাম শুনেছেন?’ 
‘তা আর শুনিনি।’
‘সে এসেছে, বাবুদের বড়াে ঘরটায় বসে আছে। আপনাকে একবারটি দেখতে পায়।’
‘ওরে বাবা ! ভয়ে আঁতকে উঠলেন রামকৃষ্ণ : ‘দুর্দান্ত সাহেব, সর্বক্ষণ হাটু ম্যাট্‌-ক্যাট বলছে, তার সামনে আমি গিয়ে দাঁড়াবো কি! আমি মুখখু সুখখু মানুষ, এ-বি-সি-ডির ধার ধারি না। কি কথা বলতে কি কথা বলব তার ঠিক নেই।
‘তা জানি না। বাবুর হুকুম, আমার জানাবার কথা, আমি তাই জানিয়ে দিলাম।’
 ‘ওরে হৃদে, তুই যা’। ভাগনে হৃদয়রামের উদ্দেশ্যে সজোরে হাঁক পাড়লেন ঠাকুর।
হৃদয়রাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাে। বললাে, ‘সেকি কথা। দেখতে চায় আপনাকে, আর আমি গিয়ে সামনে দাঁড়াবাে ?
বালকস্বভাব ঠাকুর সহাস্য মুখে বললেন, “ও একই কথা। তুইও এখানকার লােক, আমিও এখানকার লােক। একজন গেলেই হলাে। মামার কথা শুনে গুটি গুটি গেলাে হৃদয়রাম।
দ্বারিক বিশ্বাস তেড়ে এলাে : ‘তুমি এসেছো কি করতে? তােমাকে কে চায়? তােমাকে দিয়ে কি হবে?’
মামা যে বললেন—
‘মামাকে পাঠিয়ে দাও।' দ্বারিক গর্জে উঠলাে।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলে হৃদয়রাম। বললাে, ‘আমাকে দিয়ে হবে। না। আপনাকে যেতে হবে।’
‘কি বিপদ ! আমি যাবাে কি!’ ঠাকুর চারিদিকে তাকাতে লাগলেন। ‘আমি কি একটা সাহেবের সঙ্গে কথা কইবার যােগ্য।' আমার কি সেরকম পােশাক-আশাক কিছু আছে, না, কি আমি ইংরিজি জানি?’
সামনে দেখতে পেলেন নারায়ণ শাস্ত্রীকে। রাজপুত পণ্ডিত, নবদ্বীপে এসেছিলাে ন্যায় পড়তে। সাত বছর ন্যায় পড়ে দেশে ফিরে যাবার মুখে এসেছে দক্ষিণেশ্বরে। এসে দেখছে, এতদিন করেছে কি, পড়েছে কি, মূর্তিমান সিদ্ধান্ত যে এইখানে! সমস্ত তর্কের নিষ্পত্তি সমস্ত জিজ্ঞাসার মীমাংসা ! ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নিলাে নারায়ণ। 
নারায়ণকে ডাকলেন ঠাকুর। বললেন, ‘একা যেতে ভয় করছে। তুমি সঙ্গে চলো।’
‘আমি গিয়ে কি করব?’ নারায়ণ আপত্তি তুললাে।
‘তবু তুমি পণ্ডিত মানুষ, দুটো কথা কইতে পারবে। তর্ক তুললে পারবে সামাল দিতে। আমি আকাট, হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারবাে । তুমি সঙ্গে থাকলে তবু খানিকটা বল হবে।’
নারায়ণ শাস্ত্রীকে আগে রেখে এগুতে লাগলেন ঠাকুর।
কিন্তু মধুসূদনের কাছ পৌঁছেই বেসুর ধরলাে নারায়ণ। সরাসরি জিগ্যেস করে বসলাে, ‘তুমি ধর্ম ছেড়েছ কেন?’
প্রথমেই এমন একটা প্রশ্ন করতে হয়? তাও এমন রুষ্ট স্বরে ? ঠাকুর যেন ফাঁপরে পড়লেন। 
 কি বলবে ঠিক যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না মধুসূদন। কাতর চোখে শূন্যে তাকিয়ে রইলাে।
নারায়ণ কি তবু নিরস্ত হয়। একই প্রশ্নবান আবার ছুঁড়ে মারলােঃ “কেন ছাড়লে নিজের ধর্ম ? হিন্দু ধর্ম ?”
মধুসূদন নিজের পেটে হাত রাখলাে। বললাে, ‘পেটের জন্যে’। 
‘পেটের জন্যে বাপ-ঠাকুর্দার ধর্ম ছাড়লে তুমি?’ নারায়ণ শাস্ত্রী বােমার মত ফেটে পড়লােঃ ‘এই দু'দিনের সংসারে পেটের দায়ে ধর্ম ছাড়া? কি হত ধর্মচ্যুত না হলে? কি হত?’
‘মরে যেতাম।' বললে মধুসূদন।
‘না হয় মরেই যেতে। ধর্মের চেয়ে তুচ্ছ দেহটা বড়াে হলাে ?’ নারায়ণ হুঙ্কার করে উঠলাে : ‘যে পেটের জন্যে ধর্ম ছাড়ে তার সঙ্গে কথা কইবাে কি, তার মুখদর্শন করাও পাপ। বলে নারায়ণ চলে গেলাে ঘর ছেড়ে।
ঠাকুর একা পড়লেন। অবরােধের যে প্রাচীর সঙ্গে নিয়ে এসে ছিলেন তা সরে যেতেই পড়লেন একেবারে ফাঁকা মাঠে।
পরিপূর্ণ চোখে মধুসূদন তাকালাে ঠাকুরের দিকে। এমন সুন্দর মানুষ তাে কই আর দেখিনি। চোখ ভরা করুণা আর ক্ষমা, সুখ ভরা আর্তিহরণ প্রসন্নতা।
বললাে, “আপনিও কি আমাকে ত্যাগ করবেন?
ঠাকুর সহাস্যে তাকিয়ে রইলেন। সে হাসির অর্থ—আমি কি কাউকে ত্যাগ করতে পারি? বললেন, ‘অশ্রদ্ধেয় বলে অপাংক্তেয় বলে কেউ কি আছে আমার কাছে?
‘তাহলে আমাকে কিছু বলুন। কিছু উপদেশ দিন। মিনতিময় চোখ তুলে মধুসূদন তাকালাে ঠাকুরের দিকে।
ঠাকুর কি বলতে যাচ্ছেন, সহসা কে তাঁর মুখ চেপে ধরলাে।
একি, তিনি কথা কইতে পারছেন না কেন, কে তার মুখ চেপে ধরলাে হঠাৎ?
আর কে! স্বয়ং কালী সনাতনী। 
‘একি, আমাকে দুটো কথা কইতে দিবিনে?
না, যে ধর্মদ্রোহী, তার সঙ্গে আবার কি কথা! তাকে আবার কিসের সান্ত্বনা, কিসের উপদেশ! প্রত্যাখ্যান করে দাও।
‘কিছু বলুন আমাকে।' সম্পৃহ চোখে তাকিয়ে রইলাে মধুসূন।
‘আশ্চর্য, আমি তাে বলতে চাই, কিন্তু কে যেন আমার মুখ চেপে ধরেছে’। ব্যথায় যেন ছটফট করে উঠলেন ঠাকুর।
মনের মধ্যে ম্লান হয়ে গেলাে। আমি এতােই অকিঞ্চন? শুধু আমারই কি স্থান নেই পদাশ্রয়ে ?
মা, কৃপা কর। তুই তাে সকলের মা। পাপী-তাপী অক্ষম-অধম সকলের অঙ্কদায়িনী। তবে কেন তুই বিমুখ হয়ে থাকবি? কেন তুই ব্যথার স্থানে উপশমের হাত বুলিয়ে দিবিনে?
ঠাকুরের মুখ থেকে হাতের বাধা সরে গেলাে বুঝি।
ঠাকুর উল্লসিত হয়ে উঠলেন। সাহ্লাদ-সুন্দর মুখে বললেন, ‘আমাকে কথা কইতে দিচ্ছে না বটে, কিন্তু, দাঁড়াও, তােমাকে গান শােনাই তুমি শান্তি পাবে।'
হৃদয়ের ভালােবাসা বৈরীরীতির ধার ধারে না। ঈশ্বরকে কী পূজা করাে যদি মানুষকে ভালােবাসতে পারি? ধর্মদ্রোহীর মন্দিরে জায়গা হােক, জায়গা হবে হৃদয়ে, যখন সে দ্রোহের মধ্যে দুঃখের প্রদাহ।
মাইকেলের রক্তাক্ত ক্ষতে আরামের প্রলেপ পড়লাে। অশ্রুতে ভরে উঠলাে দু'নয়ন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও কেশবচন্দ্র


প্রশান্তদীপ্ত সুন্দর সুপুরুষ, মুখশ্রীতে ঈশ্বর বিশ্বাসের কান্তি। কণ্ঠস্বরে যেমন ভক্তির মাধুর্য তেমনি প্রতিভার তেজ। বাংলা ইংরিজি দু’ভাষাতেই চমৎকার বক্তৃতা দেয়। যেমন তার বর্ণচ্ছটা তেমনি বিন্যাসচাতুর্য। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডানহাত হচ্ছে এই কেশবচন্দ্র। বাকপতি বিবুধেশ্বর। ঈশ্বর-মাতােয়ারা।
রাজপুত পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রীকে রামকৃষ্ণ বললেন, ‘লােকটার খুব নাম ডাক শুনছি। তুমি গিয়ে একবার দেখে আসবে?
নারায়ণ শাস্ত্রী জ্যোতিষ জানতো, দেখে এলাে কেশবকে। ‘কেমন দেখলে? 
 ‘খাঁটি লােক। জ্ঞানসিদ্ধ।’
দেবেন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ধর্মসভায় রামকৃষ্ণ গিয়ে দেখলেন বেদীর উপর অনেক লােক বসেছে, মধ্যিখানে কেশব। একমাত্র কেশবই কাষ্ঠবৎ। রামকৃষ্ণ দেখলেন, যতোজন ধ্যান করছে তার মধ্যে কেশবই গভীরগামী। মথুরবাবুকে বললেন, ‘শুধুই কেশব ছকরারই ফাতনা ডুবেছে।’
তখন ভাগ্নে হৃদয়কে নিয়ে গেলেন বেলঘরে, কেশবের সঙ্গে দেখা করতে। কেশব আমার সঙ্গে দেখা করতে আসুক এই ভাব নয়। আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যাই কেশবের কাছে। কেশব ঈশ্বরের কথা নয়, বহু লোক তাকে মানে-গােনে, সেই তাে তীর্থস্তৃত।
কেশব সশিষ্য পুকুরের বাঁধাঘাটে বসে আছে, হৃদয় কাছে এসে বললাে, আমার মামা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। 
‘কে আপনার মামা?
‘দক্ষিণেশ্বরে থাকেন। আপনি এখানে হরিনাম করতে এসেছেন জেনে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।’
‘নাম কী?’ 
নাম বললাে হৃদয়। 
‘কোথায় তিনি?’ ব্যস্ত হয়ে উঠলাে কেশব।
 ‘গাড়িতে বসে আছেন।’
 ‘নিয়ে আসুন নামিয়ে।’
হৃদয় তখন নিয়ে এলাে রামকৃষ্ণকে। সবাই উদগ্র উৎসুক হয়ে তাকালাে। এই রামকৃষ্ণ ? সাধারণ পাঁচজনেরই একজন। কিংবা হয়তাে তারও চেয়ে নগণ্য।
কেশব কোনজন, ঠিক বুঝতে পেরেছেন রামকৃষ্ণ। কাছে কালীর বললেন, ‘বাবু, তােমাদের কাছে ঈশ্বরের কথা শুনতে এসেছি ! তাে এরা নাকি দেখেছাে ঈশ্বরকে? সে কেমনতরাে দর্শন আমাকে একটু বলবে?’
কে বলে সাধারণ-সামান্য ! তন্ময়ের মতাে তাকিয়ে বললাে কেশব, ‘আপনি বলুন। যদি কেউ বলবার থাকে তাে আপনিই বলবেন।’
‘আমি বলব?' গান ধরলে নরামকৃষ্ণ : ‘কে জানে কালী কেমন ? ষড়দর্শনে না পায় দরশন’
গাইতে গাইতে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।
আর-সকলে মনে করলে মস্তিষ্কের বিকার, কিংবা মৃগী রােগ আছে হয়তাে লােকটার। কিন্তু কেশব বুঝলাে রামকৃষ্ণের মুখের এ পবিত্র দিব্য বিভা অলৌকিক দর্শন আর স্পর্শনের সংমিশ্রণ।
হৃদয় প্রণব-মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলাে, হরি ওঁ, হরি ওঁ। 
বাহ্যজ্ঞান ফিরে পেলেন রামকৃষ্ণ।
বলতে লাগলেন ঈশ্বরকথা। গিরগিটি কখনাে লাল কখনাে নীল কখনাে সবুজ কখনাে হলদে। আবার কখনাে কখনাে দেখা যাবে একদম রং নেই। ঈশ্বরও তেমনি। কখনাে সগুণ কখনাে নিগুন। ভক্ত যে রূপটি ভালােবাসে ভগবান সেই রূপটি ধরে দেখা দেন। পরে আবার রূপের বাইরে চলে যান, প্রত্যক্ষের বাইরে। তখন শুধু জ্যোতি, অনুভূতির সমুদ্র।
দুই-ই সত্য। নিরাকারও সত্য। কবীর বলতে, নিরাকার আমার বাপ, সাকার আমার মা। তুমি কাকে ছেড়ে কাকে রাখবে।
উপাসনার ঘণ্টা পড়লাে। এবার সকলের উঠতে হয়। 
কিন্তু উঠতে কারু মন চাইলাে না। উপাসনার অর্থই হচ্ছে ভগবানের কাছটিতে বস, আসন নেওয়া। এ কী সবাই এক ভাগ্যবতী উপস্থিতির কাছে বসে নেই ?
‘সাকারই বলল নিরাকারই বললাে, তিনি রয়েছেন এই দেহের মধ্যে।’ বললেন রামকৃষ্ণ, ‘হরিণের নাভিতে কস্তুরী, তার গন্ধে সারা বন আমােদ হয়ে আছে। কিন্তু হরিণ জানে না কোথায় এই সুগন্ধের উৎস, দিকে দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্তের মতাে। তেমনি ভগবান এই মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছেন, মানুষ তাকে জানতে না পেরে ঘুরে-ঘুরে মরছে।’
কেশবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তােমার ভাবনা নেই। তােমার লেজ খসেছে।'
ব্যাখ্যা করে দিলেন। ব্যাঙাচির যদ্দিন লেজ থাকে তদ্দিন সে জলেই থাকে, ডাঙায় উঠতে পারে না। কিন্তু লেজ যখন খসে পড়ে তখন সে জলেও থাকতে পারে ডাঙায়ও উঠতে পারে। তেমনি মানুষের যদ্দিন অবিদ্যার লেজ থাকে তদ্দিন সে সংসার জলেই থাকতে পারে, ব্ৰহ্মভূমিতে উঠতে পারে না। অবিদ্যা খসে পড়লে মানুষ সংসারেও থাকতে পারে, ঈশ্বরেও থাকতে পারে। তুমি তেমনি সংসারেও আছে ঈশ্বরেও আছে।
তবু বুঝি সংশয় যায় না কেশবের। রামকৃষ্ণকে বাজিয়ে দেখবার জন্য চর পাঠিয়েছে দক্ষিণেশ্বরে। দিন-রাত পাহারা দেবে, দেখবে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। দেখবে, সত্যি খাঁটি কিনা, না আছে কিছু বুজরুকি। 
 রামকৃষ্ণ খুশি। হ্যাঁ, বাজিয়ে নাও যাচাই করে নাও। শানের উপর মহাজন যেমন শক্ত হাতে টাকা বাজায়, বেপারী যেমন তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নেয় টুটফুটা।
ব্রাহ্ম ভক্তরা রামকৃষ্ণকে বললাে, তুমি কেশববাবুকে ধরাে, তাহলে তােমার ভালাে হবে। 
‘কিন্তু আমি যে সাকার মানি। আমি যে মা বলে ডাকি। মাকে যদি নিরাকার করি তবে অমন কোলটুকু পাবাে কি করে ? কি করে দেখব তবে মায়ের স্নেহভরা নয়ন?
সেই কেশবের যখন অসুখ করলাে রামকৃষ্ণ মায়ের কাছে ডাব-চিনি মানলাে। শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায়, আর মার কাছে বসে কাঁদেন রামকৃষ্ণ। বলেন, 'আমার কেশবের অসুখ ভালাে করে দাও। কেশব না থাকলে আমি কলকাতায় গেলে কার সঙ্গে কথা কইব।'
কেশবের বাড়ি এসেছেন রামকৃষ্ণ। সেখানে ধ্যানে হঠাৎ কালীর আবির্ভাব। রামকৃষ্ণ বলছেন, মাগাে, এখানে তুই আসিস না। এরা তাের রূপ-টুপ মানে না। কেবল নিরাকার করে।'
কিন্তু এমনি আর কতদিন যাবে।
কলুটোলার বাড়িতে রামকৃষ্ণ যখন প্রথম গিয়েছিলেন, হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে, কেশব তখন টেবিলে কী লিখছিলাে, ওঁদের দেখেও দেখলাে না। একটা নমস্কার পর্যন্ত করলাে না। সহৃদয় রামকৃষ্ণ মেঝের উপর ফরাশে বসলেন। প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ পরে কলম ছেড়ে চেয়ার থেকে নেমে বসলাে কেশব। 
কেশলকে আসতে দেখেই নমস্কার করলেন ঠাকুর। 
আর যায় কোথা! কেশবও নমস্কার করলাে। ভূমিষ্ঠ নমস্কার।
গিরীশ ঘােষ বলে, ‘রাম অবতারে ধনুর্বাণ নিয়ে জগজ্জয় হয়েছিলাে, কৃষ্ণ অবতারে জগজ্জয় হয়েছিলাে বংশীধ্বনিতে আর রামকৃষ্ণ অবতারে জগজ্জয় হবে প্রণাম মন্ত্র !’
নাম আর প্রণাম এই-ই তো পূজার ফুল-জল। সাধন-ভজন।
‘দেখাে, কেশব কত পণ্ডিত!’ বলছেন ঠাকুর, ‘ইংরিজিতে লেকচার দেয়, কতাে লোক তাকে মানে। স্বয়ং কুইন ভিক্টোরিয়া তাঁর সঙ্গে বসে কথা কয়েছে। কিন্তু এখানে যখন আসে, শুধু-গায়ে। সাধুদর্শন করতে হলে হাতে কিছু আনতে হয়, তাই ফল হাতে করে আসে। কতবড়াে ভক্ত। একেবারে অভিমানশূন্য।’
বিদ্যায় কী হবে যদি ভক্তি না থাকে। ভক্তিই পরা বিদ্যা।
“কেশববাবুর পিতামহ রামকমল সেন ভক্ত ছিলেন। বললাে মাষ্টার, ‘তুলসীকাননের মধ্যে বসে নাম করতেন। কেশবের বাবা প্যারীমােহনও ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন।’
ঠাকুর বললেন, ‘বাপ ওরকম না হলে ছেলে অমন হয় না।'
‘কেশবের বৈরাগ্য বাল্যকাল থেকেই।’ বললে প্রতাপ, ‘বাল্যকাল থেকেই তার আমােদ-আহ্লাদে অরুচি।’
শিষ্যদের সঙ্গে এসেছে দক্ষিণেশ্বর। 
ঠাকুর বললেন, “তােমার লেকচার শুনব।' 
চাঁদনিতে বসে লেকচার দিলাে কেশব।
তারপর ঘাটে বসে আলাপ শুরু করলাে ঠাকুরের সঙ্গে। ঠাকুর বললেন, ‘যিনি ভগবান তিনিই একরূপে ভক্ত। আবার আরেকরূপে ভাগবত। বলো, ভাগবত-ভক্ত-ভগবান-’
কেশব বললাে, ভাগবত-ভক্ত-ভগবান। সঙ্গে-সঙ্গে তার শিষ্যরাও বললে সমস্বরে।
‘বলো—গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব' বলে উঠলেন ঠাকুর।
কেশব হাসলাে। বললাে, “মশায়, এখুনি এতদূর নয়। লােকে গোঁড়া বলবে।’
ঠাকুর আবার বললেন, ‘‘আমি’ ত্যাগ না করলে হবে না।’
 ‘তাহলে মশায়, দলটল থাকে না।' হাসলাে কেশব।
‘কাঁচা আমি, বজ্জাত আমি ত্যাগ করতে বলছি, কিন্তু পাকা আমি, বালক আমি, দাস আমি, সন্তান আমি ত্যাগ করতে বলছি না।'
‘তুমি মা, আমি সন্তান—এর মতাে সুন্দর, এর মতাে সহজ আর কিছু আছে ? 
‘তােমরা যাকে ব্ৰহ্ম বলাে তাকেই আমি শক্তি বলি, আদ্যাশক্তি বলি ! যখন বাক্য-মনের অতীত, নিগুণ নিষ্ক্রিয় তখন তিনি ব্রহ্ম। বলছেন ঠাকুর, ‘কিন্তু যখন দেখি তিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন তখন তিনি শক্তি।
শক্তিকে মেনেছে কেশব। মেনেছে কালীকে, চিন্ময়ী কালীকে। আগে খােল-করতাল নিয়ে ব্রহ্মনাম করতাে, এখন মা নাম ধরেছে। কেশব এখন মা-মা বলে ঈশ্বরের নামকীর্তন করে।
যে দেশে যে রকম মাটি, যে রকম ভাব। কীর্তন-ক্রন্দন না হলে মন সহজে সাড়া দেবে না। আর ঈশ্বরের কাছে আসতে চাওয়া মানেই সরল হয়ে যাওয়া। কেশব সরলতার প্রতিমূর্তি।
“কেশব সেন কী সরল ছিলাে’। বলছেন ঠাকুর, ‘একদিন কালীবাড়ি গিয়েছিলো। অতিথিশালা দেখে বেলা চারটের সময় বললাে, ‘হ্যাঁ গা, অতিথি কাঙালদের কখন খাওয়া হবে ?’
সেই কেশবের বাড়াবাড়ি অসুখ।
‘তােমার অসুখ হয়েছে কেন তার মানে আছে। শরীরের ভেতর দিয়ে অনেক ভাব চলে গিয়েছে কিনা তাই।' বললেন ঠাকুরঃ ‘কুঁড়ে ঘরে হাতি ঢুকলে এমনটি হয়। ঘর তােলপাড় করে ভেঙেচুরে দেয়। তেমনি ভাবহস্তী তােমার দেহ বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে।’
কেশবের মা বললাে, আমার কেশবের অসুখ যাতে সারে তাই করে দিন
ঠাকুর বললেন, ‘সুবচনী আনন্দময়ীকে ডাকো।’
 ‘আপনি আশীর্বাদ করুন কেশবকে।’
‘আমার কী সাধ্য! তিনি আশীর্বাদ করবেন। তােমার কর্ম তুমি করাে মা লােকে বলে করি আমি—'
কেশবের অবস্থা ভালাে নয় জেনে তার ‘কমল কুটিরে’ তাকে দেখতে এসেছেন ঠাকুর। কিন্তু সবাই তাকে বসিয়ে রেখেছে বাইরে, কেশবের কাছে যেতে দিচ্ছে না। কেশব এখন বিশ্রাম করছে।
“ওগাে আমাকে তার কাছে নিয়ে চলাে।’
‘তার অবস্থা এখন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে’। প্রসন্ন এসে বললাে, ‘আপনারাই মতাে মার সঙ্গে কথা কন! মা কী বলেন তাই শুনে হাসেন, কাঁদেন—
বলো কী! এতােদূর ! শুধু মাকে মানা নয়, মায়ের সঙ্গে কথা বলা !
ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন। বাহজ্ঞান ফিরে এলে ঘরের চারিদিকে তাকালেন। ঘরভর্তি চেয়ার কোচ আলনা টেবিল। বললেন, এখন এসবে আর কী দরকার। আবার ভাবাবেশ এলাে? ‘এই যে মা এসেছে। এসো আবার, বেনারসী শাড়ি পরে সেজেগুজে দেখাও। হাঙ্গামা করাে না। বসাে গাে, বসাে।’
‘তােমার মাকে বলো, আমার কেশব ভালাে হক।
‘অসুখ ভালো হােক, ওসব কথা আমি বলতে পারি না। বললেন ঠাকুর, ও ক্ষমতা আমি মার কাছে চাইও না। মাকে শুধু বলি, মা আমাকে শ্রদ্ধা ভক্তি দাও!’
এরপর ঠাকুর তখন দক্ষিণেশ্বরে, কেশবের তিরােভাবের কথা জানানাে হলাে। ঠাকুরের মনে হলাে, একটা অঙ্গ যেন গেলাে। এমন কম্প এলাে যে, লেপ চাপা দিয়ে পড়ে রইলেন, তিনদিন বেহুঁশ।
মাষ্টারকে একদিন বললেন ঠাকুর, কেশবের মা এসেছিলো। বাড়ির ছােকরারা হরিনাম করলাে। কেশবের মা তাদের প্রদক্ষিণ করে হাততালি দিতে লাগলাে। দেখলাম, শােকে কাতর হয়নি। এখানে এসে একাদশী করলাে। মালাটি নিয়ে জপ করে। বেশ ভক্তি!’
“ওরে, আমি উলুবনে মুক্তো ছড়াই না!’ নব্য বাংলার মাতব্বর ছেলেদের বলছেন ঠাকুর : ‘কালে সব বুঝতে পারবি। ওই হে কথায় আছে না—যারে ধ্যানে না পায় মুনি, তাকে ঝাঁটায় নন্দরানী।’
তাে শালারা আমাকে লাট করে ফেললি। আমাকে সেই এক বুঝেছিলাে কেশব সেন। বলরামকে বলেছিলেন, তােমরা বুঝতে পারছো না, উনি কে। তাই অত ঘাঁটাঘাঁটি করছো। ওঁকে মখমলে মুড়ে একটি গেলাসকেসের মধ্যে রাখবে, দু'চারটি ফুল দেবে আর দূর থেকে প্রণাম করবে।
‘আমরা তাে আর কেশব সেন নই যে, তাঁর মতাে আপনাকে দেখবো’, কে একজন রাগ করে বললাে, “বেশ, না হয় কাল থেকে আর আসব না।
ঠাকুর হেসে বললেন, ‘বা গাে সখি, ঠোঁটের আগায় দেখছি বেশ রাগটুকু আছে।’

শ্রীরামকৃষ্ণ ও লাটু


বাপ-মা নেই, রাখতুরাম খুড়োর সংসারে মানুষ হচ্ছে। খুড়ােও নিঃসন্তান, তাই সমস্ত স্নেহ এই রাখতুরামের উপর। 
রাখতুরাম রাখালি করে। 
গরু চরায়। গােঠে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুপুরে গাছের ছায়ায় বসে কখনাে-কখনাে গান ধরে--মনুয়া রে, সীতারাম ভজন কর লিজিয়ে।
গরীব মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করলাে রাখতুরামের খুড়।
সেই ঋণ বাড়তে বাড়তে খুডাের সমস্ত জমি-জমা গ্রাস করলাে। রাখতুরামের হাত ধরে খুড়ো পথে এসে দাঁড়ালাে।
‘চাচাজী!’
‘চল, কলকাতা চল। দেখি কাজ-টাজ যােগাড় করতে পারি কিনা সেখানে কিছু।’
কোথায় ছাপরা জেলার এক মেঠো পাড়া গাঁ আর কোথায় ইটের পর ইট কঠিন কলকাতা।
*******
দেশের লােক কাউকে পাওয়া যায় কিনা এখানে-ওখানে খুঁজতে লাগলাে চাচাজী। অনেক ঘােরাঘুরি করে পাওয়া গেলাে ফুলচাঁদকে। ফুলচাঁদ রাম দত্তের আরদালি। রাম দত্ত মেডিকেল কলেজের রাসায়নিক পরীক্ষক। সিমলে স্ট্রীটে থাকে।
ফুলচাঁদ বললাে, “ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে যা। দেখি, বাবুকে বলে-কয়ে রাজি করাতে পারি কিনা।’
‘আমার রাখতুরাম খুব ভালাে ছেলে।’ চাচা অনুনয় করলে ফুলচাঁদকেঃ ‘যা করতে বলবে তাই করবে’।
রাম দত্তকে তাই বললাে গিয়ে ফুলাচাঁদ।
 ‘কোথায় ছেলেটা?’
আশ্চর্য, ছেলেটাকে দেখেই রামদত্তের পছন্দ হয়ে গেলাে। চেহারায় কেমন একটা তাজা তেজী ভাব। চোখ দুটো যেমন উজ্জ্বল তেমনি সরলতায় ভরা। সমস্ত শরীরে স্বাস্থ্য যেন শ্ৰী হয়ে ফুটে আছে।
“কী রে, কাজ করতে পারবি?
 ‘পারব।'
কাজ আর কী। বাজার করা, বাড়ির মেয়েদের ফুটফরমাস খাটা আর অফিসে আমার টিফিন নিয়ে যাওয়া। পারবি ?’
বললে যেন গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসতে পারে এমনি ভাব করলাে রাখতুরাম : ‘খুব পারবাে’।
‘কিন্তু শােন, তাের অতােবড়াে নাম আমি বলতে পারব না। গম্ভীর থেকে একটু তরল হলাে রাম দত্ত : ‘তােকে আমি ছােট্ট করে লালটু বলবাে। কী, রাজি ?
হেসে ঘাড় নােয়ালে রাখতুরাম। খুব রাজি। 
লালটু থেকে আরাে ছােটো হলে লাটুতে।
********

‘জানেন, আপনার চাকর আখড়ায় গিয়ে কুস্তি করে ?’ পাড়ার লােকেরা রাম দত্তের কাছে এসে নালিশ করলো।
‘বাঃ, কুস্তি করা তত ভালাে।’
“ভালাে? কুস্তি করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাে ও একদিন পাড়ায় ডাকাতি করবে।’
‘যখন করবে তখন দেখা যাবে। রাম দত্ত নালিশ উড়িয়ে দিলাে। 
ডাকাতি না করুক, ছোঁড়াটা জলজ্যান্ত চুরি তত করছে এখন।
‘আপনার চাকর লাটু, বাজারের পয়সা চুরি করছে। পাড়ার লােকেরা জানালাে আরেক নালিশ : ‘ফর্দ ধরুন। হিসেব মেলান।’
‘হ্যাঁ রে, ছোঁড়া, রামদত্ত হাঁক দিলাে : ‘বাজার থেকে আজ ক’ পয়সা চুরি করেছিস?’
লাটু দাঁড়ালাে স্থির হয়ে। সত্যের তেজ ফুটে উঠলে মুখে-চোখে। বললাে, “জানবেন বাবু, হামি নােকর আছে, চোর না আছে।’
রাম দত্ত তাকালে। প্রতিবেশীদের দিকে। প্রতিবেশীরা চলে গেলাে।
তখনকার মত সব মিটে গেলাে। কিন্তু তারপর দুপুরবেলা কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে লাটু কাঁদছে।
 “কী হলো? কে কী বললাে? মারধাের করেছে নাকি কেউ।”
‘ না তাে।’
‘তবে কাঁদছিস কেন? চাচাজীর জন্যে মন কেমন করছে? 
‘না, তাও না।’
লাটু তাকালাে ফ্যালফ্যাল করে। কেন যে কাঁদছে, কেন যে কান্না পাচ্ছে তা কে বলবে !
রবিবারে রাম দত্ত দক্ষিণেশ্বরে চলেছে, লাটু এসে বললাে, ‘হামাকে নিয়ে চলুন।’
“সে কী, তুই কোথা যাবি’। 
‘যার কথা আপুনি বলেন সেই রামকৃষ্ণকে হামি দেখবে।'
এতে যখন আগ্রহ ছেলেটার, কাজেই তখন রাম দত্ত লাটুকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাে।
*********
গােলগাল বেঁটেখেটে জোয়ান চেহারার হিন্দুস্থানী চাকর। চাকর বলে ঘরে ঢােকবার সাহস নেই। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাে জোড়হাতে।
‘ও ছেলেটাকে কোথায় পেলে’! জিগ্যেস করলেন রামকৃষ্ণ, ‘ওর যে সাধুর লক্ষণ।’
লাটু আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাে। সাধুর লক্ষণ তাে কাঁদবার কী হয়েছে! ‘কী রে, কী হলাে? কাঁদছিস কেন?’
লাটু বললাে, “আমি ইখানকে থাকবো।’
‘এখানে থাকবি---তােকে মাইনে দেবে কে?’ ঘরের বাইরে চলে এলেন রামকৃষ্ণ।
হামি মাইনে লেবে না। আপুনার কাজ করবে।' 
‘আমার কাজ করবি, আমার আবার কী কাজ ! যা, বাড়ি যা। রামকৃষ্ণ বুঝি একটু কঠিন হলেন : “তুই এখানে থাকলে আমার রামের সংসার দেখবে কে? শােন, রাম তােকে আশ্রয় দিয়েছে, তার কাজ যদি না করবি তো নেমকহারামি হবে। খবরদার, নেমকহারাম হবিনে।’
ফিরে গেলে বটে কিন্তু মন পড়ে রইলাে দক্ষিণেশ্বরে।
কিন্তু থেকে-থেকে চলে আসে। কখনাে বলে-কয়ে রাম দত্তের দেওয়া ফল-মিষ্টি নিয়ে, কখনাে খালি হাতে কাউকে না জানিয়ে। এক রাজ্যের পথ, আসে উধাও-ধাওয়া হাওরার মতােন ছুটতে ছুটতে। আর, এলে শীগগির উঠতে চায় না কাছ ছেড়ে।
রাম দত্তকে ডাকলেন রামকৃষ্ণ। বললেন, ‘কী মধু পেয়ে ছোঁড়াটা এখানে পড়ে থাকতে চায় বলে তাে? আমি তাে কিছু বুঝি না।’
রাম দও বােঝে না।
‘তােকে ওখানে খেতে দেবে কে ? কাপড়চোপড় দেবে কে? দেশে টাকা পাঠাবি কোত্থেকে?’ রাম দত্তের স্ত্রী মুখিয়ে এলাে।
‘হামার কুছু দরকার নেই।’ বললাে লাটু, ‘হামি বিনা তলবে নােকরি করবে ওইখানে।’
রাম দত্ত তখন ওকে ছেড়ে দিলাে। বললাে, 'যা, যেখানে তাের মন চায়, তুই সেখানেই থাক।’
*****
রামকৃষ্ণের কাছে এসে লাটু বললাে, 'হামাকে লেখা-পড়া শিখিয়ে দিন।’
‘ভালাে লােকের কাছেই এসেছিস।' রামকৃষ্ণ হাসলেন। বললেন, ‘যা, বর্ণপরিচয় নিয়ে আয়।’
লাটু বর্ণপরিচয় নিয়ে এলাে।
রামকৃষ্ণ বললেন, “বল, ক’ 
লাটু বললাে, ‘কা’
‘ওরে কা নয়, ক। বল-ক।’ 
লাটু আবার বললাে, ‘কা—’
কিছুতেই তার খােট্টাই জিভ সজুত করতে পারছে না। রামকৃষ্ণ যতাে বলছেন, ‘ক’, লাটু ততাে বলছে ‘কা।’
রামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘শালা, ক-কেই যদি কা বলবি তবে ক-ও আকারকে কী বলবি ? যা শালা, তাের আর পড়ে কাজ নেই।’
যাক, ছুটি মিলে গেলে লাটুর। রামকৃষ্ণও হাঁপ ছাড়লেন।
লাটুকে শিবমন্দিরে ধ্যান করতে পাঠিয়েছেন রামকৃষ্ণ। ঢুকেছে সেই দুপুরবেলা, বিকেল হয়ে এলাে লাটুর এখনাে বেরােবার নাম নেই। ওরে, কী করছে দেখে আয় তো।
রামলাল গেলে খোঁজ নিতে। ফিরে এসে বললাে, ‘এক গা ঘেমে আছে। নিথর পাথর।’
‘একটা পাখা দে’, বললেন, “তুই এক গেলাস জল নিয়ে আয়। পাখা নিয়ে শিবমন্দিরে চললেন রামকৃষ্ণ !
জল নিয়ে গিয়ে রামলাল দেখলাে রামকৃষ্ণ লাটুকে হাওয়া করছেন। আর তুলো যেমন হাওয়ায় কেঁপে তেমনি লাটুর শরীর কাঁপছে।
‘ওরে, বেলা যে আর নেই। সন্ধে-টন্ধে কখন সাজাবি ?’ লাটুর উদ্দেশে স্নিগ্ধস্বরে জিগ্যেস করলেন রামকৃষ্ণ।
রামকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর শুনে লাটুর ধ্যান ভাঙলাে। এ কী, যেন এতোক্ষণ ধ্যানে ছিলেন, তিনিই এখন বসেছেন পাশটিতে। মার মতন বাতাস করছেন সস্নেহে।
লাটু ব্যস্ত হয়ে উঠতে চাইলে আসন ছেড়ে। রামকৃষ্ণ বললেন, 'আগে একটু সুস্থ হ, তারপরে উঠিস। দেখছিস না, গরমে কেমন ঘেমে গেছিণা’
‘কিন্তু আপুনি এ কী করছেন?’ পাখার দিকে লক্ষ্য করলাে লাটু। ‘এতে হামার অকল্যাণ হবে।’
রামকৃষ্ণ হাসলেন। বললেন, “তাের কে সেবা করছে ? তাের মধ্যে যে শিব এসেছিলেন তাঁর সেবা করছিলাম। গরমে যে তাঁর কষ্ট হচ্ছিলাে। নে, এখন এই এক গেলাস জল খা দিকিনি’
এই চাকর লাটুই শ্রীমৎ স্বামী অদ্ভুতানন্দ।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও ডাক্তার সরকার


মহেন্দ্র সরকার বিরাট ডাক্তার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডি। বিজ্ঞানের দিকপাল। সবাই চেনে একবাক্যে। ডাক্তার সরকার না ধন্বন্তরি! সেই লােক কিনা হঠাৎ আবার হােমিওপ্যাথি শুরু করলাে। এ কী পাগলামি! না, তা নয়। তা হবে কেন। এ পাগলামি নয়, এ হচ্ছে সত্যসন্ধান। দেখবাে এর মধ্যে সত্য আছে কি নেই।আর যদি একবার বুঝি, যে সত্যই সত্য আছে, তাহলে ফিরবো না।”
মেডিকেল এসােসিয়েশনের সভা হচ্ছে। ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার বক্তৃতা দিচ্ছেন। বক্তৃতার বিষয় কী? বক্তৃতার বিষয় হােমিওপ্যাথি । হ্যানিম্যানের গুণকীর্তন। সহকর্মী অ্যালােপ্যাথের দল তীব্র আপত্তি করলো। ওসব বাজে অবৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া চলবে না।
‘বিষয় যে অবৈজ্ঞানিক নয় তাই তাে প্রমাণ করবে। ডাক্তার সরকারও দৃঢ়সঙ্কল্প।
‘চুপ করো’ গর্জে উঠলল আলােপাথের দল।
‘বক্তব্য শুনবে না, এ কোন্ ধরনের বিজ্ঞান ?’ ডাক্তার সরকার বিদ্রুপ করে উঠলেন।
‘মুখ চেপে ধরে। ঘাড় ধরে বার করে দাও।'
ডাক্তার সরকার শান্ত স্বরে বললেন, ‘গায়ের জোর বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান সত্যের জোর। ঘাড় ধরে আমাকে বার করে দিলেও আমার সত্যকে হটানাে যাবে না। আমি আমার সত্যকে প্রকাশ করে যাব। যা বুঝেছি, যা জেনেছি—তা বলতে পেছপা হব না। শুধু বলে যাবাে , করে যাবাে। দেখিয়ে যাবে। অর্থাৎ নিজেও প্রকাশিত হব। 
কিন্তু এ কোন প্রকাশিত সত্য ? এই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ?
গলায় ক্যান্সার হয়েছে, ডাক্তার সরকারের চিকিৎসাধীন আছেন। গঙ্গাপ্রসাদ কবিরাজের চিকিৎসায় কোনো ফল হয়নি, ইংরেজ ডাক্তাররাও মাথা নেড়ে ফিরে গিয়েছেন। রােগ অসাধ্য, তাতে সন্দেহ কী। কিন্তু রুগীটি ভারী মধুর।
গলায় সহনাতীত যন্ত্রণা, তবু সারাক্ষণ কথা কইছেন। কথার সেরা কথা—ঈশ্বরকথা। আর আশ্চর্য, তাই কিনা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একমনে বসে শুনছে ডাক্তার ! শুনতে ভালাে লাগছে ?
একেক সময় এমনও মনে হচ্ছে তিনি নিজেই বুঝি রুগী আর যাঁর অসুখ তিনি ভালাে করতে এসেছেন তিনিই ডাক্তার !
কি মধুময় কথা!
ভক্তিলাভের পর সংসার করা যায়। যেমন হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আঠা লাগে না। সংসার জল, আর মানুষের মনটি যেন দুধ। জলে যদি দুধ রাখতে যাও, দুধে জলে এক হয়ে যাবে। তাই নির্জন স্থানে দই পাততে হয়। দই পেতে মাখন তুলতে হয়। মাখন তুলে যদি জলে রাখে, তাহলে জলে মিশবে না, নির্লিপ্ত হয়ে ভাসতে থাকবে।
গিরিশ ঘােষ ধমকে উঠলো ‘আপনি যে এখানে তিন-চার ঘণ্টা ধরে রয়েছেন এ কেমন কথা? আর রুগী নেই আপনার? তাদের চিকিৎসা করতে হবে না?’
‘আর ডাক্তারি আর রুগী !’ ডাক্তার সরকার গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন : “যে পরমহংস হয়েছে তার জন্যে আমার সব গেলো।'
মাষ্টারমশাইকে বলছে, “তােমরা জানাে না আমার কী ভীষণ লােকসান হচ্ছে ! রােজ রােজ দু-তিনটে কল মারা যাচ্ছে। পরদিন নিজেই রুগীদের বাড়ি যাই, ফি নিই না। নিজের থেকে গেলে ফি নেবাে কেমন করে ?
‘ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিলে?’ রামকৃষ্ণ মাষ্টারমশাইকে জিগ্যেস করলেন।
‘গিয়েছিলাম।’ 
‘অসুখের কথা কী বলে?’
“তাই জানতেই তাে গিয়েছিলাম। জিগ্যেস করলাম, আজ ব্যারামের কী ব্যবস্থা হবে? ডাক্তার বললাে, ব্যবস্থা আমার মাথা আর মুণ্ডু। আমাকে আবার যেতে হবে—শুধু এই ব্যবস্থা। 
রােজ লােকসান হচ্ছে তবু ডাক্তারের যাওয়া চাই।
তবে কি ডাক্তারের ঈশ্বরে বিশ্বাস হচ্ছে ? বৈজ্ঞানিক, যুক্তিবাদী, বাস্তবপন্থী ডাক্তার—তার কিনা আজগুবিতে বিশ্বাস ! যাকে দেখা যায়
না, ধরা যায় না, জানা যায় না, সে থাকে কী করে?
না না, ঈশ্বর বলি না, বিজ্ঞান বলি, বিজ্ঞানই বলি। কিন্তু যতদূর আমার বুদ্ধি ততোদূরই তাে বিজ্ঞান। আমার বুদ্ধির বাইরে কি কিছু নেই। তবে বিজ্ঞান সেখানে কোথায় ? কারণের পর কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু সমস্ত কারণের কর্তা কে, এ কে বলবে ?
*******
শিবনাথের বন্ধুর স্ত্রীর খুব অসুখ। অবস্থা এমন নয় যে, ভালাে ডাক্তার দেখায়। শিবনাথ বিদ্যাসাগরকে ধরলো। বিদ্যাসাগর ধরলো ডাক্তার সরকারকে—যদি বিনা ফিতে গরিবকে দেখে।
ডাক্তার সরকার তখনি দেখতে ছুটলেন। বারে বারে ছুটলেন। কিন্তু শত চেষ্টায়ও বাউটিকে সুস্থ করতে পারলেন না।
বউটি মারা যাবার একদিন আগে, রাত প্রায় দশটা, শিবনাথ হন্তদন্ত হয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে : ‘শীগগির নতুন একটা কিছু ওষুধ চাই, বড় ছটফট করছে।
‘দিচ্ছি। কিন্তু ঔষুধের জন্যে শিশি এনেছাে ? ডাক্তার সরকার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কিন্তু আশ্চর্য, শিবনাথ শিশি আনতে ভুলে গিয়েছে। কোনােদিন তার এমন ভুল হয় না, আজ এই সঙ্গিন মুহূর্তেই এমন বিস্মরণ !
ডাক্তার নিজের বাড়িতে খোঁজ করলেন। কিন্তু যেমনটি দরকার পাওয়া গেলাে না। শিবনাথ ছুটে বেরিয়ে গেলাে। কোনাে ডাক্তারখানা থেকে যদি কিনতে পারে। রাত অনেক হলাে। তা হােক। শিশি একটা যােগাড় হবে না?
শিবনাথ যখন শিশি নিয়ে ফিরলাে তখন অমেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ডাক্তার ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘এরি জন্যে মনে হচ্ছে বউটি বাঁচবার নয়। যদি বাঁচবার হত, তােমার শিশি আনতে ভুল হবে কেন, আর আমার ঘরেই বা একটা শিশিও পাওয়া যায় না কেন?’
‘বাঃ, এই তাে এনেছি, যােগাড় করে।’
‘যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত দামী সেখানে এতােটা সময় অনর্থক নষ্টই বা হয় কেন? কোন্ ওজরে? শিবনাথ, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বাঁচাতে পারলাম না।’
শিবনাথ ম্লান হয়ে গেলাে। বললাে, “আপনিও যদি এই কথা বলেন, আমরা যাই কোথায় ?’
ডাক্তার চমকে উঠলেন : ‘কেন, কী বললাম আমি ?’
‘আপনি ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক।’ শিবনাথ ঋজু কণ্ঠে বললাে, ‘আপনিও যদি ভাগ্য বা নিয়তির ওপর নির্ভর করে থাকেন তাহলে আমাদের উপায় কী?’
“অনেকদিন ধরে ডাক্তারি করছি, হাড়ে ঘুণ ধরে গেলাে। কিন্তু সর্বদা এই সত্যই উপলব্ধি করছি, আরেকটা শক্তি সমস্ত প্রাণী-জীবনকে চালনা করছে। যতােই ওষুধ দিই, ছুরি-কাঁচি চালাই, আমরা কিছু নয়, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছি মাত্র। যার মৃত্যু নিশ্চিত, কোন্ ডাক্তার তাকে রক্ষা করে।’
“তাহলে ডাক্তারি ছেড়ে দিন।’ শিবনাথ ঝলসে উঠলােঃ ‘সবাইকে বলুন, ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পণ করে চুপচাপ বসে থাকো।’
‘তা কেন ?’ ডাক্তার শান্তমুখে বললেন, “অন্ধকারে আছি বলেই তাে বেশী করে হাতড়াতে হবে, বেশী করে আঁকড়াতে হবে। ফলাফল আমাদের হাতে না থাক, তবু আমরা বীর, আমরা লড়াই করে যাবাে। সত্য খুঁজতে খুঁজতে ধরে ফেলবাে সেই সত্যস্বরূপকে।’
কিন্তু এ নতুন রুগী, রামকৃষ্ণ কী বলেন? বলেন, ‘ডাক্তার, আমার এই অসুখটা ভালাে করে দাও। তাঁর নাম গুণগান করতে পাই না। 
শােনাে, কী অদ্ভুত কথা। আমাকে ভালাে করে দাও--যেন ঈশ্বরকথা বলতে পারি। যদি একটা দিনেরও আয়ু পাই, তবে সেদিনেও শুধু ঈশ্বরকথা কইবাে।
‘যতোক্ষণ আমি আমি করছো ততক্ষণ যন্ত্রণা,' বলছেন রামকৃষ্ণ, ‘যেই তুমি তুমি করলে, সমস্ত যন্ত্রণা সঙ্গীত হয়ে যাবে। এই দেখাে না, গরু যতোক্ষণ হাম্বা হাম্বা বা হামহাম করে ততােক্ষণ তার দুঃখ। গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই, সমস্তদিন তাকে লাঙল দিতে হয়। পিটুনি সইতে হয় রাখালের হাতে। তারপর তাকে কসাইরা কাটে। চামারে চামড়া নিয়ে জুতাে তৈরী করে। অবশেষে নাড়িভুড়ি থেকে তাঁত হয়। ধুনুরির হাতে পড়ে যখন সে তাঁত তুহুঁ তুহুঁ'-তুমি তুমি করে তখনই নিস্তার। অর্থাৎ যখন মানুষ বলে আমি নই, আমি কেউ নই, হে ঈশ্বর তুমিই কর্তা তুমিই সমস্ত তখনই তার যন্ত্রণার অবসান।’
ডাক্তার বললেন, ‘কিন্তু ধুনুরির হাতে পড়া চাই।’
 আশ্চর্য, ডাক্তারও তবে ধুনুরির হাতে ধরা পড়বার কথা ভাবে !
বর্ষার রাত, তিনটের সময় ঘুম ভেঙে গিয়েছে ডাক্তারের ! ভাবনা ধরেছে, রামকৃষ্ণের ঘরের জানলা বন্ধ আছে কিনা। নাকি খােলা জানলায় নতুন করে ঠাণ্ডা লাগলো?
ভাের হতেই খোঁজ নিতে চলে এসেছেন ডাক্তার। 
নরেনও এসেছে। রামকৃষ্ণ বললেন ডাক্তারকে, ‘গান শুনবেন?'
 ‘না। সেটা তােমার পক্ষে ভালাে নয়। তবে যদি ভাব চেপে- -'
“না না, আমার আবার ভাব কী !
নরেন গান ধরলাে। কিছুক্ষণ শুনেই ঠাকুর অতল ভাব-সমাধিতে ডুবে গেলেন। শরীর নিস্পন্দ, নাকে নিঃশ্বাস নেই, চোখ পাথরের মত স্থির, নিস্পলক। যেন একটা জড় কাঠের পুতুল। একবারে বাহশূন্য। 
ডাক্তার ঠাকুরের বুকে ষ্টেথিস্কোপ রাখলেন। হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ। নিশ্চল। ষ্টেথিস্কোপ ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ডাক্তার।
নরেনের গান চললাে : ‘এ কি এ সুন্দর শােভা, কি মুখ হেরি এ! 
সত্যি, এ যেন কোনাে মানুষেরই মুখ নয়। ঈশ্বরেরই মুখ।
ষ্টেথিস্কোপ গুটিয়ে নিলেন ডাক্তার। মনে স্থির জানলেন ঈশ্বরই মহত্তম বিজ্ঞান।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও দুর্গাচরণ নাগ


চলেছে পায়ে হেঁটে। চলেছে তাে চলেইছে! কতােদূর থেকে আসছে না-জানি। সমস্ত শরীরে ধুলল। দক্ষিণেশ্বর কোথায় বলতে পারেন? শেষে একজনকে জিগ্যেস করলাে। 
‘সে কি মশাই? দক্ষিণেশ্বর যে আপনি ছাড়িয়ে এসেছেন।’
 দুপুর দুটোর সময় মন্দিরে এসে পৌঁছােলাে দুর্গাচরণ। সে যখন আট বছরের ছেলে তখন মা মারা যায়। পিসীমা মানুষ করে। রাতে যখন পিসীমা রূপকথার গল্প বলতে তখন জানলা দিয়ে তারা-জ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দুর্গাচরণ বলতে আমি ওই দেশে যাবাে পিসীমা, আমাকে ওখানে নিয়ে চলো।
যদিও তখন ভর-দুপুর, দুর্গাচরণের মনে হলাে, এটাই বুঝি তারাজ্বলা আকাশের ওপারে সেই রূপকথার রাজ্য !
‘হ্যাঁ মশাই, এখানে একজন সাধু থাবেন?’ একজন দাড়িওয়ালা লােককে জিগ্যেস করলাে দুর্গাচরণ।
দাড়িওয়ালা লােক আর কেউ নয়, প্রতাপ হাজরা। তার শুধু পাটোয়ারী বুদ্ধি।
বললাে, “হ্যা, একজন আছেন বটে, কিন্তু আজ তাে এখানে নেই।’
 ‘নেই ? বসে পড়লাে দুর্গাচরণ : ‘কোথায় গিয়েছেন?’
 ‘চন্দননগরে। কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তুমি আরেকদিন এসাে।’
অবসন্ন পায়ে হৃতসর্বম্বের মতাে আবার কলকাতা ফিরে চলা ! তারা-জ্বলা আকাশ বুঝি এক ফুঁয়ে অন্ধকার হয়ে গেলাে।
ও মা, ওই দেখাে ঘরের ভিতর থেকে হাতছানি দিয়ে কে ডাকছে। আর কে! ওই বুঝি তার মনের মানুষ !
প্রতাপ হাজরাকে উপেক্ষা করে সটান ঘরে ঢুকে পড়লাে দুর্গাচরণ। দেখলাে, ছােটো তক্তপােশটির উপর পা ছড়িয়ে বসে আছেন রামকৃষ্ণ। 
প্রতাপ হাজরা লােককে বেশী ঘেঁষতে দিতে চায় না। পাছে আর কেউ তার বরাদ্দে ভাগ বসায়। কিন্তু ঠাকুর যাকে ডাকেন তাকে আটকায় প্রতাপের সাধ্য কী!
দুর্গাচরণ ঠাকুরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলাে। 
রামকৃষ্ণ পা সরিয়ে নিলেন। 
‘তুমি তাে ডাক্তার।
হ্যাঁ, ক্যাম্বেলে ক’দিন পড়েছিলাে দুর্গাচরণ। কলেজ ছেড়ে দিয়ে হােমিওপ্যাথি করছে। বিস্তর নাম ডাক।
‘ডাক্তারের ধর্মলাভ হওয়া কঠিন।' বললেন রামকৃষ্ণ, এক ফোঁটা ওষুধেই যদি মন পড়ে থাকে, তাহলে কী করে এই বিরাট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা হবে!’
দরকার নেই আমার ধর্মলাভে। দুর্গাচরণ মনে মনে বললাে। যে তােমার চরণস্পর্শ লাভ করতে পারলাে না কী হবে তার বিরাটের ধারণা নিয়ে ! | ‘শােনাে, তুমি সংসারেই থাকবে, গৃহই তােমার পীঠস্থান। কিন্তু কী রকম থাকবে বলে তাে? রামকৃষ্ণ স্মিতমুখে বললেন, ‘থাকবে পাঁকাল মাছের মতাে। পাঁকাল মাছ পাকের মধ্যে ডুবে আছে কিন্তু গায়ে পাঁকের স্পর্শলেশ নেই। তেমনি সংসারে থাকো কিন্তু তার ময়লা যেন না লাগে।’
তােমার পায়ের স্পর্শটুকুই পেলাম না, কী করে আমার ময়লা কাটবে? অন্তরের নির্জনে বসে নীরবে কাঁদতে লাগলাে দুর্গাচরণ।
“আচ্ছা, তুমি তাে ডাক্তার, তবে দেখাে তাে আমার পায়ে কী হয়েছে। রামকৃষ্ণ পা দুখানি বাড়িয়ে ধরলেন।
কাছে সরে এলে দুর্গাচরণ। স্পর্শ করা বারণ, তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাে। কুষ্টিতের মতাে বললাে, “কই, কোথাও তাে কিছু দেখতে পাচ্ছি না!'
রামকৃষ্ণ হাসলেন : “আহা, ভালাে করে দেখােনা, কী হয়েছে ?’
এতোক্ষণে তবে বুঝলাে দুর্গাচরণ। পা দু'খানি চেপে ধরলে মাথা লুটিয়ে দিলে পায়ে। অন্তর্যামী মনের কান্না শুনতে পেয়েছেন। অহঙ্কার অশ্রুতে দ্রবীভূত হলেই পরমপদ লাভের যােগ্যতা আসে।
*******
দুর্গাচরণ ওষুধের বাক্স আর চিকিৎসা-প্রণালী বই ফেলে দিলাে গঙ্গায়।
কী করে চলবে তবে? ভগবান চালাবেন। তাঁর রাজ্যে কিছুই অচল নেই।
বাড়ির লাউগাছটার কাছে গরু বাঁধা। দড়িটা ছােটো, তাই আকণ্ঠ চেষ্টা করেও গাছের নাগাল পাচ্ছে না। গরুটার ক্ষুধার্ত দুই চোখে লােপ কাতরতা। ও মা, খাবি, খেতে সাধ গিয়েছে ? নে খা, মনের সাধ মিটিয়ে খা। দড়িটা খুলে দিলাে দুর্গাচরণ। মুহূর্তে গাছটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলাে।
জেলে মাছ বেচতে এসেছে, কই মাগুর সিঙ্গি। কাছেই এই পুকুরের মাছ মশাই, জ্যান্ত, দেখুন লাফাচ্ছে চুপড়িতে"। আনন্দে লাফাচ্ছে, না, যন্ত্রণায় ছটফট করছে ? সমস্ত মাছ কিনলে দুর্গাচরণ। মুহূর্তমাত্র দেরী না করে মাছগুলি পুকুরে ছেড়ে দিয়ে এলাে। জেলে তাে থ! দাম আর চুপড়ি যেই ফিরে পেলাে অমনি ছুট দিলাে উর্বশ্বাসে। 
একটা গােখরাে সাপ বেরিয়েছে উঠোনে। মারাে-মারাে, সবাই স্ত-ব্যস্ত হয়ে উঠলাে। শুধু দুর্গাচরণ নির্বিচল। বললাে, বনের সাপে খায় না, মনের সাপে খায়। যদি ওর অনিষ্ট ইচ্ছা না করাে, ও-ও করবে কিছু অনিষ্ট। যেমন দেবে তেমনি পাবে।’
 নাগরাজ! নাগরাজ ! সাপকে ডাকতে লাগলাে দুর্গাচরণ।
‘আসুন আমার সঙ্গে। জঙ্গলে থাকেন, কেন এই ক্ষুদ্র মানুষের ঘরে পদার্পণ করেছেন। এখানে আপনার মর্যাদা কে বােঝে ?’
********
ঠাকুর গৃহে থাকতে বলেছেন, কী মনােরম গৃহই দিয়েছেন! চারখানা ঘর, তার মধ্যে তিনখানারই ছাদ ফুটো। অঢেল বর্মা নেমেছে, যে ঘরখানা নিটুট সে ঘরেই সস্ত্রীক থাকে দুর্গাচরণ। হঠাৎ দু’জন অতিথি এসে উপস্থিত। খাওয়ানাে না হয় হলাে কিন্তু রাত্রে শুতে দিই কোথায় ?
স্ত্রী একবার তাকালাে স্বামীর দিকে।
দুর্গাচরণ বললাে, “যে ঘরখানা আমাদের তাই ওদেরকে ছেড়ে দেবাে। আজ তাে আমাদের মহাভাগ্য। অতিথি-নারায়ণের সেবায় আমাদের ঘুম আর আরাম উৎসর্গ করতে পারছি।’
পেটে শূলব্যথা উঠেছে, ঘরে পড়ে আছে দুর্গাচরণ, আট-দশজন অতিথি এসে হাজির। বাজারে বেরােতে হয়, নইলে অতিথি-সৎকার হয় কি করে ? এদিকে ব্যথার যে কমতি নেই। ব্যথা নিয়েই বেরিয়ে পড়লে দুর্গাচরণ।
আট-দশজনের বাজার, প্রকাণ্ড বােঝা হয়ে দাঁড়ালাে। একটা মুটে ডাকলেই তাে হয়। সর্বনাশ ? নিজের বােঝা অন্যকে দিয়ে বয়াবাে? কখনাে না। মুটে না ডেকে নিজেই সে মােট মাথায় তুললে দুর্গাচরণ ! কিন্তু কতোদূর যাবে ? পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। ঠাকুরকে উদ্দেশ করে বললাে, “খুব তো সংসারাশ্রম করতে বলেছে। অতিথি-নারায়ণের সেবা করতে দিচ্ছে কই ?”
ব্যথার উপশম হলে মােট মাথায় নিয়ে ফের চলতে লাগলাে দুর্গাচরণ। বাড়ি পৌঁছে তার আবার কান্না : ‘আপনাদের কাছে আমি অপরাধী হয়ে রইলাম। আপনাদের সেবার কতে দেরী হয়ে গেলাে।’
রামকৃষ্ণ বললেন, “যে সংসারে থেকে ঈশ্বরকে ডাকে, ঈশ্বরের সেবা করে, সেই বীরভক্ত। যে সংসার ত্যাগ করেছে সে ঈশ্বরকে ডাকবে, ঈশ্বরের জন্যে করবে তাতে বাহাদুরি কী! যে সংসারে থেকে ঈশ্বরকে ডাকে ঈশ্বরকে ধরে সেই বাহাদুর সেই বীরপুরুষ।’
দুর্গাচরণ সেই বীর।
পাটের কলের দুটো সাহেব গ্রামে পাখি মারতে এসেছে। দুর্গাচরণ ছুটে গিয়ে তাদের বললাে, “পাখি আপনাদের কী করেছে? ওদের মারবেন না বলছি।’
রুক্ষসূক্ষ্ম পাগলের মতাে দেখতে। এর কথা কে গ্রাহ্য করে ! একটা সাহেব পাখির দিকে তাক করলাে বন্দুক।’
খপ করে বন্দুক ধরে ফেললল দুর্গাচরণ। কী স্পর্ধা, সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাে বন্দুকের গুলী পাখিকে নয়, তােমাকেই বিদ্ধ করবে, দেখাে। কিন্তু সাধ্য কি, দুর্গাচরণের মুঠোর থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেয়। রোগা লিকলিকে শরীরে এখন শত সিংহের শক্তি। ধস্তাধস্তিতে সাহেব তাকে কিছুতেই টলাতে পারছে না। দ্বিতীয় সাহেবটা এলাে প্রথমের সাহায্যে। তবুও নয়। দুর্গাচরণ বন্দুক কেড়ে নিয়ে চললো বাড়ির দিকে। বাড়ি এসে জলে হাত ধুয়ে ফেললাে। কী ভাষণ প্রাণঘাতী অস্ত্র স্পর্শ করেছি!
নিজের উপরেও তার নিষ্ঠুরতা কম নয়।
জিহ্বার সুখেচ্ছা হবে বলে নিজে মিষ্টি বা নুন খায় না। দুর্গাচরণ কিন্তু পরকে খাওয়ায় সাধ্যমতাে। তার বাসায় অর্ধেকটায় এক চালের আড়তদার থাকে। তার আড়তে কুঁড়াে জমে থাকে। তাই দুর্গাচরণ কুড়িয়ে নিয়ে এসে গঙ্গাজল মাখিয়ে খায়। শুধু আহার আর আস্বাদ নিয়েই যদি থাকবে, তবে কখন ডাকবে ভগবানকে? কুঁড়াে খেয়ে দিব্যি হালকা আছি।
আর যাই করাে পরনিন্দা করাে না। শুনােও না পরনিন্দা। আর গুরুনিন্দা শােনা তাে মহাপাতক।
অসতর্কে কাউকে হঠাৎ নিন্দা করে ফেলেছে, অমনি আত্মপীড়ন শুরু হয়ে গেলাে। আর নিন্দে করবি ? রাস্তা থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে এনে ঘা মারতে লাগলাে কপালে। বল, আর অবাধ্য হবি? কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগসাে। সে যেমন পাজী তার তেমনি শাস্তি হওয়া দরকার।
কে একজন রামকৃষ্ণের নিন্দে শুরু করেছে। 
‘থামুন বলছি, ও-সব মিথ্যে কথা। দুর্গাচরণ প্রমথটা তীব্রম্বরে প্রতিবাদ করলাে। নিন্দুকের রসনা আরাে লেলিহান হয়ে উঠলাে।
‘এ বাড়িতে বসে এসব নিন্দাবাদ করতে পারবেন না বলছি। দুর্গাচরণ হুমকে উঠলাে : ‘এই কানে শুনতে পারবাে না গুরুনিন্দা।’
গালাগালেরও একটা নেশা আছে। নিন্দুক তাই নিরস্ত হলাে না।
‘বেরােও, বেরােও তুমি এখান থেকে। নইলে মহা বিভ্রট হবে বলে দিচ্ছি।'
কে কার কথা শােনে। লােকটার মাথায় ভূত চেপেছে। নিন্দার গলা সে আরাে উঁচু করলাে।
‘তবে রে' নিজের পায়ে তােত জুতাে নেই, ওই লােকটারই পায়ের জুতাে কেড়ে নিয়ে লােকটাকে পিটতে লাগলাে দুর্গাচরণ। ‘বেরােও, বেরােও আমার সুমুখ থেকে।’
চলে যেতে যেতে লােকটা শাসিয়ে গেলাে, আচ্ছা, দেখে নেবে তুমি কেমনতরাে সাধু। পাবে এর প্রতিফল’। 
দুর্গাচরণ ঘন ঘন ঠাকুরেয় উদ্দেশে প্রণাম করতে লাগলাে। ঠাকুর, কেন, কেন তুমি আমাকে গৃহস্থ হতে বললে? সন্যাসী হলে তাে আমি নিষ্ক্রিয় ও নির্বিচল হতে পারতাম। গৃহস্থ হওয়ার জন্যই তাে আমার এই যন্ত্রণা। প্রতিবেশীর নিন্দা শুনতে হয়, করতে হয় ক্রুদ্ধ প্রতিকার। তারপর আবার প্রতীক্ষা করতে হয় দোর্দণ্ড প্রতিফলের।
মুহূর্তে কী ভােজবাজি হয়ে গেলাে কে জানে, লোকটা দেখি একাই ফিরে আসছে। লাঠিসােটা নিয়ে নয়, দুটি হাত জোড় করে। দুর্গাচরণের কাছে বসে দীনবচনে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করুন।’
জয় শ্রীরামকৃষ্ণ! আনন্দে দুর্গাচরণ লাফিয়ে উঠলাে।
“আরে বসুন বসুন, উঠছেন কেন? এতােবড়ো একজন গণ্যমান্য লােক আপনি অমনি কি ফিরে যেতে আছে ? তামাক খেয়ে যান।’ দুর্গাচরণ তামাক সাজতে বসলাে।
*******

ঠাকুরের কাছে গিয়ে বললাে, ‘আমাকে তােমার সেবার কাজে লাগাও।’
রামকৃষ্ণ তাকে নানা ফরমাশ খাটাতে লাগলেন। ওরে, হাওয়া কর, পা টিপে দে, তামাক সাজ, গামছা আর বটুয়া নিয়ে আয়, গাড়ুতে জল ভর, নিয়ে চল ঝাউতলায়।
দুর্গাচরণ এক পায়ে খাড়া। 
আমাকে আরও বড়াে কাজে লাগাও। একটা কঠিন কিছু করি।
রামকৃষ্ণের তখন অসুখ, তারই শয্যায় দুর্গাচরণ তাঁর গা ঘেঁষে বসেছে। মতলব, ঠাকুরের ব্যাধি নিজের শরীরে আকর্ষণ করে নেবে।
ঠাকুর জানেন, সে ক্ষমতা আছে দুর্গাচরণের ! তাই তাকে তিনি বারেবারে নানা কাজের ছুতােয় দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অসুখ ভালাে করবার জন্য যিনি কালীর কাছে, তাঁর মার কাছে পর্যন্ত প্রার্থনা করতে চান না, তিনি সেই ব্যাধি ভক্তদেহে সঞ্চারিত করবেন, এ অসম্ভব।
তবু দুর্গাচরণের আপ্রাণ চেষ্টা।
দেওয়া কাজ পলকে শেষ করে আবার ঠাকুরের গা ঘেঁষে বসেছে। সান্নিধ্যে ঘণতর হচ্ছে।
রামকৃষ্ণ তখন বললেন, ‘দুর্গাচরণ, আমার জন্যে আমলকী আনতে পারাে—টাটকা আমলকী ?’
সেটা শ্রাবণ মাস, আমলকীর সময় নয়। কিন্তু ঠাকুর যখন চেয়েছেন তখন সন্দেহ কী, অকাল ফলােদয় হবে। দুর্গাচরণ বেরিয়ে পড়লাে আমলকীর খোঁজে। বিশল্যকরণীর খোঁজে। বিশল্যকরণীর খোঁজে মহাবলী মহাবীর।
স্নান নেই, আহার নেই, নিদ্রা নেই, বিশ্রাম নেই; তিনদিন পরে, কোথেকে কে জানে, আমলকী নিয়ে এলাে দুর্গাচরণ।।
আমলকী পেয়ে ঠাকুরের সে কী আনন্দ!
ঈশ্বরের কৃপাশক্তিতেই জীবনে ফলবে এ আমলকী। ঘটবে অকাল ফলােদয়।
তাই ঈশ্বরকে ধরে থাকো। নিরন্তর ঈশ্বরকথা বলে। আর সব কথার ইতি আছে। ঈশ্বরকথার ইতি নেই।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ


নদীতীরে বসে এক সাধু সাধন করছে। হঠাৎ চোখ পড়ল জলের দিকে। দেখলাে একটা বৃশ্চিক জলে পড়েছে। পারে আসবার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু স্রোত ঠেলে এগুতে পারছে না। আশ্রয়চ্যুত অসহায়ের মতাে হাবুডুবু খাচ্ছে। স্থলের জীব পড়েছে জলের অগাধে। সাধুর মায়া হলাে। ভাবলাে, আহা, ওকে বাঁচাই, আশ্রয় দিই ওকে।
হাতে করে জল থেকে তুললাে তাকে! তােলা মাত্রই বৃশ্চিক তাকে দংশন করলাে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলাে না।
চক্ষের নিমিষে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সাধু বিছেটাকে ছুড়ে দিলাে। জলে। কি অকৃতজ্ঞ ! দয়াপরবশ হয়ে আশ্রয় দেবার জন্য তুললাম জল থেকে, আর আমাকেই কিনা কামড়ালাে! দীনমনা আর কাকে বলে!
আবার দৃষ্টি পড়লে জলের দিকে। দেখলাে, জল থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য বৃশ্চিক প্রাণপণে চেষ্টা করতে। কিন্তু তরঙ্গসঙ্কুল নদীর সঙ্গে পেরে ওঠে তার সাধ্য কি।
সাধুর আবার দয়া হলাে। আবার হাত বাড়িয়ে তুললাে বিছেটাকে।
জুরাত্মা বৃশ্চিক আবার দংশন করলে সাধুকে। অসহ্য! যেন একটা তপ্ত লােহার শলা হাতের মধ্যে কে গুজে দিলো। চক্ষের পলকে বিছেকে আবার জলের মধ্যে ছুড়ে দিলাে সাধু। বিছের আবার জলে পড়ে প্রাণসংশয় হলাে।
তখন সাধু ভাবলো, এ আমি কি করছি? বৃশ্চিক আমার চেয়ে বড় সাধু। সে-ই স্থিরব্রত, স্বধর্মনিষ্ঠ। সে বারে বারে তার ধর্ম পালন করছে। উপকারীর করতলকেও সে রেহাই দিচ্ছে না। আর আমি কি করছি? আমি বারে বারে আমার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। আমি সাধু, সর্বজীবে দয়া করাই আমার সাধুতা। উপকৃতই হই বা অপকৃতই হই-সর্বাবস্থায় দয়াতে প্রতিষ্ঠিত থাকাই আমার কর্তব্য। কেন আমি বৃশ্চিককে বারে বারে জলে ছুঁড়ে দিচ্ছি। আগুন কি তার উত্তাপ বা ঔজ্জ্বল্য ত্যাগ করে ? জল কি ত্যাগ করে শৈত্য বা তারল্য ? আমি যদি দয়া বিসর্জন দিই তবে আমি কিসের সাধু ? 
জল থেকে সাধু আবার তুললাে বৃশ্চিককে। যেমন-কে-তেমন বৃশ্চিক আবার দংশন করলাে। এবার আর সাধু তাকে ফেললাে না ছুড়ে। যন্ত্রণায় হাত ছিন্ন হয়ে গেলেও নির্বিচল রইলাে। ধীরে ধীরে তাকে নামিয়ে দিল মাটিতে। নিরাশ্রয়কে দিলাে তার নিরাপদ বসতি। বিপদ-বদ্ধকে অবাধগমন।
দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণের সহজাত কবচকুণ্ডল হরণ করবেন ঠিক করেছেন। হরণ করতে কি আর পারবেন? তাই ভেবেছেন ভিক্ষা চেয়ে নেবেন।
পাণ্ডবদের প্রিয়সাধন করতে তৎপর হয়েছেন ইন্দ্ৰ। অৰ্জুন যে তার প্রিয়তম।
ইন্দ্রের সঙ্কল্প জানতে পেরেছেন সূর্যদেব। ইন্দ্রের নাম যদি সহস্র লােচন, সূর্যের নাম সহস্ররশ্মি।
সত্যপরায়ণ মহাবীর কর্ণের কাছে উপস্থিত হলেন দিবাকর।
‘আমার হিতকথা শােনো। বিভাবসু বলতে লাগলেন স্নিগ্ধস্বরে, “তােমার স্বভাবের কথা জানতে পেরেছে সুররাজ।’
‘আমার স্বভাবের কথা?’ কর্ণ চমকে উঠলাে। 
‘হ্যাঁ, তুমি কারু কাছে কিছু প্রার্থনা করাে না অথচ তােমার কাছে যে যা চায় তাই বিলিয়ে দাও অকাতরে।'
প্রীতিপ্রফুল্ল মুখে হাসতে লাগলাে কর্ণ। “তােমার এই স্বভাবের কথা জানতে পেরে ইন্দ্ৰ তােমার থেকে তােমার কবচকুঙ্গল চেয়ে নিতে আসবে। খবরদার, তুমি কিছুতেই দেবে না। তােমার পরাভব ও অর্জুনের জয়ই তার কাম্য। শুধু পরাভব কেন, কবচকুণ্ডল থেকে বিচ্যুত হলে তােমার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং ধনরত্ন ও অন্যান্য পার্থিব সম্পদ দিয়ে পুরন্দরকে নিবারিত করবে।’
‘ব্রাহ্মণবেশে আপনি কে?’ কর্ণ প্রশ্ন করলাে।
‘আমি মরীচিমালী সূর্য। তােমার পরম সুহৃদ। আমার কথা শােনো। আমার কথা রাখলে তােমার শ্রেয়ােলাভ হবে।’
কর্ণ প্ৰণত হলাে। বললাে, “আমি যদি আপনার প্রীতিভাজন তবে কেন আপনি আমাকে আমার ব্রত থেকে পরায়ুখ করতে চান ? কেন আমি আমার স্বধর্ম থেকে ঋলিত হবে? দেবরাজ ইন্দ্র যদি পাণ্ডবদের হিতকামনায় কবচকুণ্ডল ভিক্ষে করেন আমি তাঁকে তা দিয়ে দেবা’।
মুর্খ, না উন্মত্ত! সূর্য ধিক্কার দিয়ে উঠলেন : ‘কবচকুণ্ডল আছে বলেই তুমি যুদ্ধে অবধ্য। ও দিয়ে ফেললে তােমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।’
‘হােক মৃত্যু। কর্ণ বললাে গম্ভীর স্বরে, ‘অকীর্তিকর জীবনের চেয়ে যশস্কর মৃত্যুই শ্রেয়। মৃত্যুর ভয়ে আমার ত্রিভুবনসঞ্চারিণী কীর্তিকে ম্লান হতে দেবে না।'
সূর্য বিদ্রুপ করে উঠলেন, ‘মৃত ব্যক্তি আবার কীর্তি কি ! সে কি করে জানতে আসছে তার কীর্তির কথা। একমাত্র জীবিতাবস্থায়ই কীতি উপভােগ্যা। সুতরাং যাতে বেঁচে থেকে কীর্তি আস্বাদ করতে পারে তার উপায় দেখাে। নিপাত করে যুদ্ধবিজয়ই পরম কীর্তি। শােনো, সন্নিহিত হলেন দিবাকর, হয় অকর্ণ নয় অনর্জুন, এই তাে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ কথা। কেন অকারণে প্রাণ দান করবে। তুমি যদি কবচকুণ্ডলসম্পন্ন থাকে। দেবরাজ ইন্দ্রের শত সাহায্য পেলেও স্পর্ধিত অর্জুন তােমাকে পরাস্ত করতে পারবে না। আমার উপদেশ শােনো। রমণীয় মধুর বাক্যে ইন্দ্রকে তৃপ্ত করে বিদায় দিয়ে দিও। কদাচ কুণ্ডলকবচ খুলাে না গা থেকে। খুললেই মৃত্যু।’
বিচলিত হলাে না কর্ণ। বললাে, “মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয় করি মিথ্যাকে। যখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যাচক কখনাে প্রত্যাখ্যাত হবেন। আমার কাছে, তখন সে সত্য আমি জীবনপণে পালন করবো। অর্জুনের কথা ভেবে কেন আপনি এমন উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। আমি দ্রোণাচার্য ও জামদগ্ন্যর থেকে যে অস্ত্র পেয়েছি অর্জুনকে পরাস্ত করতে তাই যথেষ্ট।’
মােটেই নিরুদ্বেগ হতে পারলেন না ভাস্কর। বললেন, ‘কিন্তু কবচকুণ্ডল থাকলেই সে-সব অস্ত্র কার্যকরী হবে। একমাত্র কবচকুণ্ডলেই শত্রুঘাতিনী অমােঘ শক্তি নিহিত। তাই তাে তা হরণ করতে উদ্যোগী হয়েছেন দেবরাজ।’
তবু কর্ণের এতােটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। বললাে, “ভগবন, শরীর অচিরস্থায়ী। শরীরের সঙ্গে সহজাত যে কবচকুণ্ডল তাও ক্ষণভঙ্গুর। আমি যদি ক্ষণভঙ্গুর দ্রব্যের বিনিময়ে চিরস্থায়িনী কীর্তি লাভ করতে পারি সে সুযােগ আমি ছাড়ি কেন? আমার ব্রত ভঙ্গ করতে আদেশ করবেন না। ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্র যদি আমার জীবন প্রার্থনা করেন, তাও আমি তাঁকে দিয়ে দেবাে অকাতরে। আমার সত্য থেকে আমার সঙ্কল্প থেকে আমি ভ্রষ্ট হবে না কিছুতেই।’
এই হচ্ছে স্বধর্মে নিয়ত স্থিত থাকা। সূর্য চন্দ্র টলুক, আমি টলছিনে। এই বসলাম আমার আসনে, শরীর শুষে যাক, কঙ্কালীকৃত হােক, তবু আমার সাধনফল উদ্ধার না করে উঠব না। এই বেরুলাম যাত্রায়, মৃত্যুদুঃখবন্ধুর দুর্গম পথে, অমৃতকে আবিষ্কার না করে থামবে না।
সেই দুর্বার যাত্রীই বিবেকানন্দ।
প্রথমে চলে এলাে কাশী। এখানেই এসেছিলেন বুদ্ধদেব, এখানেই এসেছিলেন শঙ্করাচার্য। কতাে ধর্মপ্রচার করে গিয়েছেন। এখানকার স্পর্শ না নিয়ে গেলে যাত্রা শুদ্ধ হবে না। 
একদিন ফিরছে দুর্গাবাড়ি থেকে, কতকগুলি বাঁদর জোট বেঁধে বিবেকানন্দকে তাড়া করলাে। ভয় পেয়ে ছুটতে লাগলাে স্বামীজী। ভাবলাে—পলায়নেই বুঝি মুক্তি।
কে সহসা হুঙ্কার করে উঠলাে : ‘থামাে, পালিয়াে না। রুখে দাঁড়াও ওদের সামনে।’
বিবেকানন্দ তাকিয়ে দেখলাে কে একজন সন্যাসী তাকে উপদেশ দিচ্ছে। সাহসে ভর করে রুখে দাঁড়ালাে বিবেকানন্দ। বানর দলের মুখােমুখি হলাে। আর যায় কোথা! উদ্ধত-উদ্যত ভঙ্গি দেখে বানরের দল চম্পট দিলাে। 
পরবর্তীকালে ইয়র্কে এক সভায় বক্তৃতা দিতে উঠে স্বামীজী বলেছিলাে : ‘দাঁড়াও জীবনের মুখখামুখি। অজ্ঞানের সম্মুখীন হও। অবিদ্যার সম্মুখীন হও। দাঁড়াও বুক ফুলিয়ে পালিয়ে, যেও না। যেও না পাশ কাটিয়ে।’
কাশী থেকে অযােধ্যা হয়ে আগ্রায় এসেছে বিবেকানন্দ। আগ্রা থেকে বৃন্দাবন। সমস্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে এসেছে। পকেটে একাটা কানাকড়ি পর্যন্ত নেই। পথে যা ভিক্ষে জুটেছে তাই খেয়েছে। সব দিন জোটেনি। ঘুমিয়েছে এখানে-সেখানে, কখনাে বা খােলা মাঠে, উদার-উদঘাটিত তারকা-আকীর্ণ আকাশের নীচে।
কোথায় চলেছি কে জানে! শুধু এইটুকু জানি ফিরে যাওয়া নেই। নেই থেমে পড়া।
গাছতলায় বসে কে একটা লােক তামাক খাচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। লােকটার মুখে প্রগাঢ় তৃপ্তির শান্তি। শ্রমবিমােচনের আরাম। 
 খানিকক্ষণ তার দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাে স্বামীজী। আহা, এক ছিলিম যদি তামাক পেতাম এ সময়। কতাে দীর্ঘ পথ হেঁটে এসেছি, পায়ের দড়ি ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যাচ্ছে। কলকেতে যদি দিতে পারতাম একটা সুখটান, পথশ্রম ধুয়ে মুছে যেত। ঢাঙ্গা হয়ে উঠতাম মুহূর্তে। 
‘ভাই, তােমার কলকেটা একটু দেবে? একটা টান দিই।'
ত্রস্ত-লজ্জিত হলাে লােকটা। কুষ্ঠিত হয়ে বললাে, “মহারাজ, আমি ভাঙ্গি, আমি মেথর-’
প্রসারিত হাত গুটিয়ে নিলাে স্বামীজীর। মেথরের উচ্ছিষ্ট কলকে কি করে মুখে দেয় ! আরামের মুখে ছাই দিয়ে ফিরে চললাে। এগিয়ে চললো। শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে আরাে কতাে পথ চলতে হবে তার ঠিক কি। 
 খানিকটা এগিয়ে এসে থেমে পড়লাে বিবেকানন্দ। একি, আমি সন্যাসী ? আমি না সমস্ত সংসারশৃঙ্খল ছিন্ন করেছি। আমার না সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শনের কথা। তবে কেন মেথর জেনে ওর কলকেতে আমি মুখ দিতে পারলাম না। আজও আমার জাতের গর্বআভিজাত্যের মােহ ! ওই মেথর কি ব্রহ্মের প্রতিভাস নয়? ও কি নয় আমার প্রভুর প্রতিভূ। ওকে অবজ্ঞা করে এ আমি কোথায় চলেছি, কোন্ মানবপ্রেমের তীর্থসত্রে?
ফিরলাে বিবেকানন্দ। দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এলাে সেই মেথরের কাছে ! বললাে, “শীগগির আমাকে এক ছিলিম তামাক সেজে দাও।’
‘মহারাজ, আমি যে মেথর-’ 
“কে বললাে? তুলি নারায়ণ। দাও, শীগগির দাও। ধোয়ার জন্যে আমার আকণ্ঠ শুকিয়ে গেছে।
কোনাে আপত্তিতেই ঠেকানাে গেলাে না। অগত্যা ভরাট করে তামাক সেজে দিলাে। পূর্ণ তৃপ্তিতে তাই টানতে লাগলাে স্বামীজী।
রসকে মেথর ছিলাে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির ঝাড়ুদার। তার সঙ্গে পঞ্চবটীর কাছে একদিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা। কোমরের গামছাখানা খুলে গলায় জড়িয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করলাে।
ঠাকুর জিগ্যেস করলেন, “কিরে রসিক, ভালাে আছিস তাে?
করজোড়ে রসিক বললো, “আমাদের আবার ভালাে থাকা ! আমরা মেথর, হীন জাত, হীন কর্ম করি' ।
ঠাকুর ফেস করে উঠলেন ; হীন কর্ম? কর্ম কি কখনাে হীন হয়? স্বয়ং নারায়ণ ঝড়ুদার সেজে তাের দুই হাত দিয়ে দক্ষিণেশ্বরে মায়ের দরবার ঝাঁট দিচ্ছেন—বল, নারায়ণ কি হীন জাত ?’
সে-সব কথা কি বিবেকানন্দ ভুলে গিয়েছে?
ঠাকুর পরীক্ষা করে দেখছেন। পরীক্ষা করে দেখছেন পূর্ব সংস্কার দূরীভূত হয়েছে কিনা, জাতিবর্ণের পরপারে চলে গিয়েছে কিনা।
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বিবেকানন্দ।
********
আলেয়ারে পণ্ডিত শম্ভুনাথের বাড়িতে আছে বিবেকানন্দ। এক ভক্ত মুসলমান এসে হাজির। স্বামীজীর দর্শন চাই।।
আমিও জ্ঞানী, তুমিও জ্ঞানী-লেগে যাবে তর্ক, লেগে যাবে ঠোকাঠুকি, যেন ইটে-ইটে সঙ্ঘর্ষ। কিন্তু আমিও ভক্ত, তুমিও ভক্ত, কোনাে বিবাদ নেই, বিরােধ নেই। আমিও একতাল কাদা, তুমিও একতাল কাদা। কাদায়-কাদায় সমন্বয়।
মৌলভীসাহেবের শুধু দর্শনে সুখ নেই, তার ইচ্ছে স্বামীজীকে সে, খাওয়ায় নিজের হাতে।
প্রস্তাব করতেও ভয় করে। পণ্ডিতজী অন্তত তেড়েফুঁড়ে উঠবেন। বাড়ির বার করে দেন কিনা তারই বা ঠিক কি।
তবু উপায় নেই, অন্তরের ব্যাকুলতার কথা বলতেই হবে খুলে। যার আশ্রয়ে স্বামীজী আছেন তাকেই বলতে হয়।
‘আমার বড়াে সাধ,’ হাতজোড় করে আতঙ্কজড়িত কণ্ঠে বললাে মৌলভী, ‘স্বামীজীকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষে দিই।'
জিজ্ঞাসু চোমে তার দিকে তাকালে একবার শম্ভুনাথ। সেই চাহনিতে করাল কটাক্ষ ঝলসে উঠলে কিনা কে জানে।
‘নতুন হাঁড়ি-বাসন কিনে আনবে বাজার থেকে। বামুন দিয়ে রান্না করাবাে।’
প্রতিপক্ষের তবু যেন কোনাে চাঞ্চল্য নেই। মৌলভীর মনে হলাে আরাে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে হয়তাে। বিনয় বিগলিত স্বরে বললাে, ‘আমার রসুই ঘরে রান্না করাব না। বৈঠকখানা ঘরের সব জিনিসপত্র সরিয়ে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নেব। সেইখানে বামুন দিয়ে নতুন উনুন পাতিয়ে রান্নার আয়ােজন হবে। আহা, স্বামীজী খাবেন, আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে—অনেক দূরে দাঁড়িয়ে—তাই দেখবো।
‘কোনাে কিছুর প্রয়ােজন হবে না।' বিবেকানন্দ বললাে প্রসন্ন মুখে : ‘খাবাে আপনার বাড়ি। কিন্তু কবে? দেখবেন যেন দেরি করে ফেলবেন না'
‘না না, কাল-কালই সব আয়ােজন করবে।’ আনন্দসাগরে ভাসতে ভাসতে বললাে মৌলভীসাহেব।
‘আপনি যা সব ব্যবস্থা করছেন, শম্ভুনাথ পণ্ডিত বললাে, “আমার নিজেরই খেতে সাধ হচ্ছে।’
ঠাকুর বলেন, ভক্ত হচ্ছে এক খেয়ার জল। যতােক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানবিচার ততোক্ষণ পর্যন্ত আলের বাঁক, আর ঘুরপথ। কিন্তু বন্যায় যখন মাঠ ভেসে যায় তখন কে আর আলের সন্ধান করে! তখন জল কেটে সােজা বেরিয়ে পড়াে। ভক্তি-ভালােবাসা চলে এলে তখন আবার ভেদবুদ্ধি কি, ভাগ-বণ্টন কি, জাত-বেজাত কি, সব জলে, জলময়, সব একজোট, একাকৃতি।
কিন্তু কে কাকে খাওয়ায় ? খাদ্যই বা কি, খাদকই বা কে!
ঠাকুর যখন নরেনকে ছুঁয়ে দিয়েছিলেন আর যখন তার চোখের সমুখ থেকে জড়জঞ্জালের পর্দা উঠে গেলাে তখন সে দেখেছিলাে মর্তের ধূলিকণা থেকে আকাশের নক্ষত্ৰকণা পর্যন্ত সমস্তই ঈশ্বর। রাত্রে বাড়িতে ফিরে এসে খেতে বসেছে, তন্ময় হয়ে দেখছে ঈশ্বর থালা-বাটি ভাত-ডালের মধ্যে বসে আছেন। নিস্পন্দ হয়ে আছে দেখে মা বললেন, ও কি-হাত গুটিয়ে কেন ?
যন্ত্রচালিতের মতাে খেতে শুরু করলো নরেন। কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করলাে, যে খাচ্ছে যাকে খাচ্ছে আর যিনি খাওয়াচ্ছেন সবই সেই ঈশ্বর।
কারু কাছ থেকে ভিক্ষা চাইবে না—বৃন্দাবনে এসে সঙ্কল্প করলাে। বিবেকানন্দ। বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি—নিজের গোয়ে চলে যাব পথ কেটে। থামবে না, দাঁড়াবো না কারু দুয়ার ধরে ।
একে নিদারুণ ক্ষুধা, তার উপর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খরশরধার বৃষ্টি। তবু পথ কেটে চলেছে স্বামীজী। হাতে দণ্ড আর কমণ্ডলু। আর বুকের মধ্যে রামকৃষ্ণের অমিয়মূর্তি। হে পরমরমণীয় রাম, হে ত্রৈলােক্যাকর্ষী কৃষ্ণ, ক্ষুধারূপেও যে তুমি, শ্রান্তিরূপেও যে তুমি, অপ্রাপ্তি-অলব্ধিও যে তুমি, দেহপাত হবার আগে তাই আস্বাদন করতে দাও।
‘মহারাজ, শুনছেন-' পিছন থেকে কে একজন ডাকলাে। 
ফিরেও তাকালাে না বিবেকানন্দ। সামনে চললে সমানে।
 ‘শুনছেন’
পিছন ফিরে তাকাবার সময় নেই। পিছনেই মায়া, অবিদ্যা, সংসারবল্লী। সর্ববন্ধন উপেক্ষা করে এগিয়ে চালাই বীরত্ব। কিন্তু পা চলছে না যে। ক্ষুধায় সমস্ত শরীর ঝিমিয়ে আসছে! শুধু ক্ষুধায় নয়, পর্যটনে। শুনিনা, লােকটা কি বলে ! কোনাে বিপদে পড়েছে বােধহয়। বিপন্ন প্রার্থীর মতােই কাতর কাকুতি। হয়ত সেবা চায়, ।
প্রভু, রক্ষা করে। যখন পিছন ফিরে তাকাবে না বলেছি তখন সন্তানের প্রতিজ্ঞার মান রাখাে। প্রার্থনার প্রলুব্ধ করাে না। কে বলে পা চলছে না? করুণ মিনতির স্বর যে ক্রমশই এগিয়ে আসছে। বিবেকানন্দ ছুটতে লাগলাে। ‘শুনছেন--' পশ্চাদ্বর্তী যে মিনতির স্বর, সেও ছুটতে লাগলাে।
কি সর্বনাশ, স্বামীজী যতাে ছােটে তার চয়েও জোরে ছােটে সেই পশ্চাদগামী কাকুতি।
প্রায় এক মাইল ছােটবার পর পিছনের লােকটি ধরে ফেললাে স্বামীজীকে। পরাস্ত করলাে, এগিয়ে এসে দাঁড়ালাে সামনে। হাঁপাতেহাঁপাতে বললাে, “মহারাজ আপনার জন্যে খাবার এনেছি।'
স্বামীজীর তাে চক্ষুস্থির !
গামছা দিয়ে বাঁধা প্রকাণ্ড খাবারের চ্যাঙাড়ি। নানারকম ভােজ্যদ্রব্যে বােঝাই।
এ খাবার কে পাঠালাে এ আর জিগ্যেস করলাে না বিবেকানন্দ। তার জানতে বাকি নেই। সে কেঁদে ফেললাে।
*********
গাজীপুরে আছে। কলকাতা থেকে খবর এল বলরাম বােস আর নেই। খবর শুনে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাে স্বামীজী।
‘সেকি, আপনি না সন্যাসী? কে একজন জিগ্যেস করলাে।
শােকাবেগ প্রশমিত করে বিবেকানন্দ বললাে, ‘সন্যাসী বলে কাঁদতে পাব না?
“উচিত নয়। হৃদয়কে কঠিন করতে না পারলে সন্যাসী কিসের!
‘যে সন্যাস হৃদয়কে পাষাণে পরিণত করে সে সন্যাসে ধিক। জ্বলে উঠলাে স্বামীজী : ‘বলরাম আমার গুরুভাই। আমরা এক গুরুর চরণতলে বসে পাঠ নিয়েছি। এক বৃক্ষ আমাদের ফল দিয়েছে ছায়া দিয়েছে একটু স্তব্ধ হলাে বিবেকানন্দ, পরে ফের বললাে, ‘শুধু বলরামের জন্যে কেন, জগজ্জনের জন্যে আমাকে কাঁদতে হবে। অগণিত জনগণকে যদি আমার আত্মজন বলে অনুভব না করতে পারি, তাদের ব্যথায় ব্যথিত হতে না পারি তবে কিসের ছাই আমার সন্যাসী হওয়া ! তুমি কি মনে করাে সন্যাসী হয়েছি বলে আমি বিমুখবিরস হয়ে থাকব? নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত ? অসম্ভব। অবিশ্যি অভিভূত হব না সংকল্পভ্রষ্ট হবে না কিন্তু পরের দুঃখে থাকব উদাসীন হয়ে, দ্রবীভূত হবে না, আমার এ ব্ৰত নয়। যেখানে পারি তুলে দিয়ে যাবাে কটা, যেখামে পারি মুছে দিয়ে যাব অশ্রু'। 
এর ক’দিন পরে আবার খবর এলাে, স্বামীজী তখন আলমােড়ায়, বােন মারা গিয়েছে। শােকে আবার ভেঙে পড়লাে স্বামীজী।
কিন্তু তার তােল আত্মবিস্মৃত হবার কথা নয়। সুতরাং পুনরায় রওনা হও। শােক থেকে অশােকে, মৃত্যু থেকে অমৃতে, দুর্গম থেকে দুঃসাধ্যে সেই দুর্লভ অথচ দুস্পরিহরের সন্ধানে।
বাড়ির লােক কি করে আলমােড়ার ঠিকানা পেলো? সুতরাং পদক্ষেপ দ্রুত করাে, চলে যাও আরাে নির্জনে, গহনে গভীরে, হিমালয়ের প্রস্তর-অরণ্য আশ্রয় করে, সেখানে গিয়ে জাগাও প্ৰসুপ্তকে, গুহাহিতকে, তােমার অন্তর্নিহিতকে।
কিন্তু বােনের কথাটাও একেবারে ভুলে থাকলে চলবে না! সে আত্মহত্যা করেছে। সমাজের অনুশাসনে নিগৃহীত নারীত্বের সে একটি মৌন প্রতীক। তারই মধ্য দিয়ে দুর্গত নারীসমাজ প্রতীকার চাইছে তার কাছে। জগজ্জনের যদি দুঃখ বিমােচন করতে না পারি তবে কিসের আমার সন্যাস, আমার সর্বত্যাগ, আমার প্রব্রজ্যা ? সেই সঙ্কল্প আবার মনে পড়লাে বিবেকানন্দের। কিন্তু দাঁড়াও, আগে উদ্ধার করে আনি সঞ্জীবনা, সেই আরােগ্য-আয়ুয়ের মহৌষধ।
গাড়ােয়ালের দিকে যাত্রা করলাে বিবেকানন্দ। সঙ্গে সারদানন্দ, অখণ্ডানন্দ আর বৈকুণ্ঠ। কর্ণপ্রয়াগে এসে অখণ্ডনন্দ অসুখে পড়লো। স্বামীজীও তার সঙ্গ নিলাে। শােক গেলাে, এবার বাধা এলাে রােগের মূর্তি ধরে। আসুক! বাধাকে উল্লঙ্ঘন করতে না পারবে তাে বুকের মধ্যে রামকৃষ্ণ কেন?
চটীতে বিশ্রাম করি আর ক’দিন। রােগ আপনিই অদৃশ্য হবে। 
তাই হলাে। সাতদিন পরে আবার যাত্রা রুদ্রপ্রয়াগের দিকে।
এবার রুদ্র দেখা দিলে প্রলয়ঙ্কর জ্বর হয়ে। বিবেকানন্দ আব অখণ্ডানন্দ দু’জনেই ঘায়েল হলাে। শয্যা বলতে তো ভূমি, সেই মাটি ধেকে ওঠে তাদের সাধ্য কি !
ঠাকুর, আর কি তুমি এগুতে দেবে না? স্পর্শ করতে দেবে না কি সে মহামৌনকে ?
কোথা থেকে কে জানে, গাড়ােয়াল জেলার সদর আমিন এসে হাজির ! একি, সাধুরা যে মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে ? এদের কেউ কি দেখবার নেই। তােলবার নেই?
না, নিশ্চয়ই আছে। তােমাকে তাে ঠাকুর পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আমিনের কাছে কি কবিরাজি ওধষু ছিলো তাই খেতে দিলাে সাধুদের। মন্ত্রবৎ কাজ করলাে। উঠে বসলাে দু’জনে।
কিন্তু শরীরের এ অবস্থায় পর্বতপর্যটন অসম্ভব। সুতরাং ডাণ্ডি যােগাড় করে দিচ্ছি, শ্রীনগর চলে যাও। সেখানে গিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা ও বিশ্রামে শরীরকে শক্তসমর্থ করাে।
যাবাে তাে, কিন্তু খাবাে কি ! অসুস্থ দেহ নিয়েই ভিক্ষা করতে হলাে পথে-পথে। শুধু চিকিৎসা বিশ্রামেই তাে চলবে না, পথ্য চাই। যিনি পথ দিয়েছেন তিনিই কি পথ্য জোগাবেন না?
********
শ্রীনগরে মাসখানেক থেকে আবার তারা চললাে টিহিরির দিকে।
‘গঙ্গাতীরে আমাকে একটি সাধনার স্থান তৈরী করে দিতে পারেন? টিহিরিরাজের দেওয়ান রঘুনাথ ভটচাজ্যিকে একদিন জিগ্যেস করলে বিবেকানন্দ।
‘পারি। দেওয়ান রঘুনাথ বললাে, “গণেশ প্রয়াগে চলে যান। গঙ্গা আর ভিলাঙ্গন নদীর সঙ্গমে। সেখানে আপনার জন্যে, নির্জনে, একটি কুটির নির্মাণ করে রেখেছি।'
আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো স্বামীজী। মহামৌন এবার বুঝি খুলে দেবে রুদ্ধ দ্বার।
গণেশ প্রয়াগ যাবার সব ঠিকঠাক, অখণ্ডানন্দের আবার অসুখ হয়ে পড়লাে। এবার শুধু জ্বর নয়, জ্বরের সঙ্গে ব্রঙ্কাইটিস।
উপায় ? ডাক্তার বললাে, শীগগির পাহাড় থেকে নেমে যাও নীচে। অন্তত দেরাদুনে।
সমস্ত সংকল্প ভেস্তে গেলাে। ঠাকুর, এ তােমার কী বিধান-বাসনা ! যখন মনে করি যাব এবার নীরব গভীরের অতল রাজ্যে, তখনই একটা না-একটা বাধা এসে উপস্থিত হয়। গুরুভাইদের তুমিই তাে আমার হাতে জিম্মা করে দিয়েছে। তাদের অসুখের সময় তাদেরই বা ফেলি কেমন করে ?
‘আমার গুরুভাই অসুস্থ। তাকে কেউ কি তােমরা একটু থাকবার মতাে জায়গা দেবে ? খাবার মতাে একটু পথ্য ? দ্বারে দ্বারে প্রার্থনা করতে লাগলাে স্বামীজী।
কেউ প্রতিধ্বনিও করে না।
অনেক ঘােরাঘুরির পর পণ্ডিত আনন্দনারায়ণ নামে এক কাশ্মীরী ব্রাহ্মণের দরজা খোলা পেলে ! ব্রাহ্মণ ভার নিলাে সেবাশুশ্রুষার।
‘ভালাে হয়ে এলাহাবাদ চলে যাস। অখণ্ডানন্দকে এই পরামর্শ দিয়ে অন্যান্য গুরুভাইদের সঙ্গে বিবেকানন্দ চলে গেলে হৃষীকেশ।
এবার বসে পড়তে হয় সাধনায়। দুর্জয় তপশ্চর্যায়। আয়, কোনাে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ি, নয়তাে দুপ্রবেশ অরণ্যে।
কিন্তু মনােরথ তোমার, রথের রশ্মি ঈশ্বরের হাতে। নির্বাচিত মুহূর্তে স্বামীজীর অসুখ করে গেলাে। প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে ঘােরতর প্রলাপ শুরু হলাে।
দেখতে-দেখতে সঙিন হয়ে দাঁড়ালাে অবস্থা। সংজ্ঞা লােপ পেয়ে গেলাে, নাড়ীও প্রায় ছাড়াে-ছাড়াে। গুরুভাইয়েরা দশদিকে অন্ধকার দেখলাে। কি করবে, কোথায় যাবে, কোথায় পাবে রােগের উপশম ! মাটির উপরে একটা কম্বল, তাতেই শুয়ে স্বামীজী ছটফট করছে। একটু নরম বিছানা পর্যন্ত যােগাড় করতে পারছে না! কোন্ ডাক্তারই বা আসবে বিনা পয়সায় রুগী দেখতে। ডাক্তার এলেও ওষুধ কেনবার পয়সা আসবে কোত্থেকে? চরম অসহায়ের মতাে গুরুভাইয়েরা কাঁদতে বসলো। ঠাকুর, তুমিই অগতির গতি, তুমিই অনাথের নাথ। তুমি নির্বান্ধবের বন্ধু, তুমি নিষ্কিঞ্চনের সর্বস্ব।
কে একটা পাহাড়ী লােক চলে এলাে কুটিরে। আমি ওষুধ দিচ্ছি। কি একটা পাহাড়ী গাছের শিকড় বেটে তার সঙ্গে খানিকটা মধু মিশিয়ে খেতে দিলাে স্বামীজীকে। জয় জগৎগুরু জগন্নাথ ! স্বামীজী চোখ মেললাে। জ্বর নেমে গেলাে আস্তে-আস্তে।
সুস্থ হয়ে উঠে বিবেকানন্দ বললাে গুরুভাইদের, তােমাদের অসুখ হলে আমি দেখবাে আর আমার অসুখ হলে তােমরা দেখবে এ এক রকম মায়া। এ মায়াবন্ধন কাটতে হবে নিষ্ঠুর হাতে, এ মায়াই আমার তপশ্চরণের বাধা। আমাকে এবার তােমরা ছেড়ে দাও, আমি এবার সম্পূর্ণ একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে চাই। যাতে ঘােরতম দুর্দিনেও ভাবতে পারি—আমার পাশে গুরুভাইরাও কেউ নেই। কেবল আমি আছি আর তিনি আছেন।
গুরুভাইয়েরা কোলাহল শুরু করলাে। আমরা যাবো সঙ্গে।
 ‘আমাকে পিছু ডেকো না। মায়াপাশ ছিন্ন করাই আমার স্বধর্ম । স্বধর্ম থেকে আর ভ্রষ্ট হবো না। সন্যাসীর প্রতি অনুরাগও মায়া।’
একা-একা চলে গেলাে বিবেকানন্দ।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও ক’টি ছােটো ছেলে


ছােটা নরেনের আসল নাম নরেন মিত্তির। ইস্কুল থেকে সটান চলে আসে দক্ষিণেশ্বরে । ঈশ্বরের জন্য কাঁদে। কান্না একবার শুরু হলে কি আর থামতে চায় ! ঠাকুর বলেন, ‘কান্না কি আর কমেতে হয়!’ সব আগুনই নেভে। সব কান্নাই থামে এক সময়। শুধু, ঈশ্বরের জন্য যে আগুন, তা নেভে না। ঈশ্বরের জন্যে যে কান্না তার আর বিরতি নেই।
 দক্ষিণেশ্বরে আসে লুকিয়ে লুকিয়ে। আসে বলে অভিভাবকরা শাসন করে, পীড়ন করে। তবু কি যে নেশা কে বলবে, এক নাগাড়ে দু-তিনদিন এসে থেকে যায়। স্কুলের কথা মনেও থাকে না। জীবনের আসল যে জ্ঞান তাই যেন ছড়িয়ে আছে ঠাকুরের চারপাশে। গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে ছড়িয়ে আছে পায়ের ধূলােয়। পরা-বিদ্যার পাঠশালা এই দক্ষিণেশ্বর।
যদি আবার না আসে, তার জন্য ছটফট করেন ঠাকুর। এলে গায়ে মাথায় হাত বুলােন। মিনতি করেন ‘আসিস এক-একবার। বড় শুদ্ধ আত্মা তাের। তাের মধ্যে মন্দের গন্ধ নেই এতােটুকু।’
সেদিন বললেন, ‘অচ্ছাে, তাের শরীর দেখি। খােল দেখি জামা। জামা খুলে ফেললাে ছােটো নরেন।
খুশি হলেন ঠাকুর। বললেন, ‘বা, বেশ বুকের আয়তন। তবে হবে। তবে মাঝে মাঝে আসিস। একেবারে ভুলে যাসনে।’
 যেন ঠাকুরেরই যত দায়!
দায় না দয়া, কে বলবে! মমতার স্পর্শে চোখ ছলছল করে ওঠে ছােটো নরেনের। একদিন ঠাকুর তাকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুই কী ভালােবাসিস?’
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাে ছােটো নরেন। তােমাকে ছাড়া আর কী আছে ভালােবাসার ?
‘কী ভালােবাসিস? জ্ঞান না ভক্তি?’ 
ছােট নরেন তার কি জানে? তবু বললাে, ‘শুধু ভক্তি।'
‘কিন্তু না জানলে কাকে ভক্তি করবি ? মাষ্টারকে যদি না জানিস, ভক্তি করবি কাকে ?.. মাষ্টার মশায়ের দিকে তাকালেন, ‘তবে ছােটো নরেন যেহেতু শুদ্ধাত্মা, আর যেকালে ও বলেছে শুদ্ধা ভক্তি চাই, তাহলে নিশ্চয়ই এর একটা মানে আছে।’
তুমি কে, জানি না! সাধ্যিও নেই। তবু তােমার দিকেই মন ছুটে চলেছে। না জেনে না চিনেই তােমাকে ভালােবেসে ফেলেছি। 
তােমার এমনি মজা! জানার আগেই টানা। দেখিনি, শুনিনি, তবু মন বলে এমন আর দু’টি নেই। কেউ শিখিয়ে দিলাে না! তবু নিজেকে বিকিয়ে দিলাম।
কপালে ছােটো একটি আব আছে নরেনের। পঞ্চবটীতে বেড়াতে বেড়াতে ঠাকুর বলছেন, ‘তুই আবটা কাটা না। ও তো গলায় নয় মাথায়—ওতে আর কি হবে !’
সমাধির পর উঠে দাড়িয়ে ঠাকুর যখন টলতে থাকেন তখন ছটো নরেন এসে তাকে ধরে। ছােটো নরেনর শুদ্ধ-শীতল দেহ, ঠাকুর সে স্পর্শ সইতে পারেন সহজে। কিন্তু সেদিন হলাে কি, সমাধির পর ছােটো নরেন ধরতে যেতেই ঠাকুর যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
কি হলাে? বিমর্ষ হয়ে গেলাে ছােটো নরেন। তবে কি কোনাে দোষ করেছি ? মনে কি আমার মলিনের স্পর্শ লেগেছে? নইলে আর্তনাদ করলেন কেন ঠাকুর ?
ঠাকুর বললেন, ‘তাের শরীরে ঘা।’
বাঁচা গেলাে। ক'দিন আগে শরীরে একটা অস্ত্রপচার হয়েছে তারই ঘা, শুকোয়নি। সেই কলুষসংসর্গ দুর্বিষহ ঠাকুরের কাছে।
তবু যাক। মনের ঘা নয়। মনের ঘা কিছুতেই শুকোতে চায় না। শুকোলেও দাগ যায় না কিছুতেই।
**********
দক্ষিণেশ্বরে আসে বলে নারানকেও তার বাড়ির লােকেরা প্রহার করে। বামুনেদের ছেলে। স্কুলে পড়ে, কিন্তু পালিয়ে-পালিয়ে চলে আসে দক্ষিণেশ্বর। ঠাকুর তাকে গাড়ি ভাড়ার পয়সা দিয়ে দেন।
ছােটো খাটটির উপর পাশে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়ান, জল খাওয়ান। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন।
সেদিন কানের কাছে মুখ এনে স্নেহ ঢেলে জিগ্যেস করলেন, ‘কালও খুব মেরেছে ?’ 
নারান মাথা হেঁট করে রইলাে।
‘এক কাজ কর। একটা চামড়ার জামা তৈরী কর। মারলে আর বেশী লাগবে না।
সেদিন কীর্তন শুনছেন ঠাকুর, কোথেকে নারান এসে কাছে দাঁড়ালাে। তাকে দেখে চটে উঠলেন ঠাকুর। বললেন, ‘তুই আবার কেন এসেছিস? অতাে মেরেছে তােকে সেদিন তাের বাড়ির লোক, আবার এসেছিস? তাের শিক্ষে হবে না?
চরম শিক্ষা নেব তােমার পদচ্ছায়ে। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে ? কোথায় তবে আর যাব ? যার তুমি আছাে তার আবার ভয় কি। প্রহারই তো তােমার উপহার।
ঠাকুরের ঘরের দিকে গেলাে নারান। নিজের বাড়ির দিকে নয় কিন্তু মােটেই সে গেলো না।
মমতায় প্রাণ গলে গেলে ঠাকুরের। বাবুরামকে বললেন, “যা তো, ওকে কিছু খেতে দে।'
কততক্ষণ পরে নিজেই চললেন খাওয়াতে। আশ্চর্য, কীর্তনে মন বসলাে না। কোথায় হরিসরােবরে ডুবে যাবেন, তা নয়, চললেন কোথাকার একটা ছেলেকে খাওয়াতে।
মাষ্টারকে বলছেন, ‘আহা, ওকে দেখলে যেন বাৎসল্য হয়। এখানে আসে বলে বাড়িতে মারে। 'ওর হয়ে বলে এমন বুঝি কেউ নেই।'
‘আপনিই বােঝাবেন !’
‘দেখাে, ওর কতাে বড়ােসত্তা। কীর্তন ফেলে উঠে গেলাম ওর কাছে। কীর্তনের চেয়েও ওর টানের জোর বেশী। কীর্তন ফেলে উঠে গেছি কোনােদিন এমনটি আর হয়নি।'
‘ক্রন্দনই তাে শ্রেষ্ঠ কীর্তন।' বললেন মাষ্টারমশাই : ‘ও মনে মনে কাঁদছে আপনার জন্যে, সেই টানেই তাে উঠে পড়লে।’
‘কিন্তু জানো, ওকে যখন জিগ্যেস করলাম, কেমন আছিস? তখন ও বললাে, আনন্দে আছি। দুঃখ-কষ্টের কথা মনেও রাখে না।’
অনেকদিন আবার আসছে না নারান। বাবুরামকে বলছেন ঠাকুর, ‘ওরে, একবার নারানের বাড়ি যা না। তাকে দেখে আয়। পারিস তত ডেকে আন।’
 কিন্তু ওর বাড়িতে যেতে বড়াে ভয়, পাছে ওর বাবা ক্ষেপে ওঠেন, তেড়ে আসেন লাঠি নিয়ে।
‘তবে এক কাজ কর। হাতে করে একখানি ইংরেজি বই নিয়ে যা। দেখে-শুনে ওর বাবা খুশি হবেন। কিচ্ছু বলবেন না।’
হঠাৎ একদিন নারানের মা এসেছে দক্ষিণেশ্বরে। কার টানে ছেলে এমন ঘরছাড়া তাকে নিজের চোখে দেখে আসতে। কে সে হাত বুলিয়ে সমস্ত মান ভুলিয়ে দেয় ! কিসের টানে টলিয়ে দেয় বাধার পাহাড়!
দেখে তাে তার চক্ষুস্থির ! শুধু স্থির নয় বিমােহিত! ছেলের দোষ কি ! তার নিজেরই তাে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না! 
কণ্ঠভরা কাকুতি নিয়ে ঠাকুর বললেন, ‘মা, আমার নারানকে বেশী পীড়ন করো না—
সত্যিই তাে, তারই তাে নারান! মনে হলাে ঈশ্বরের ছেলেকে কি বলে তিনি পীড়ন করেন ! ছলছল করে উঠলাে মায়ের চোখ। 
 ‘শােনাে', আবার বললেন ঠাকুর, ‘ভগবানের দিকে যদি ওর মন যায়, দুমড়ে দিওনা ওর মনটিকে। 
যেন ভিক্ষে করছেন ঠাকুর। যদি ঈশ্বরের দিকে কারু মন যায়, সে মনটি যেন তাঁর প্রাপ্য।
**********
বরানগরের এক তেলির ছেলে গােবিন্দ পাল। ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরে ষােলােআনা মন। তাই ঠাকুরের কাছে এসে চুপটি করে বসে থাকে। যখন চারিদিক স্তব্ধ তখন হরিকথা শােনে।
বিষয়ীদের দেখলে বড়াে ভয় পায়। যেমন বেড়াল দেখলে ইঁদুর ভয় পেয়ে থাকে। ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা এসেছে বাগানে বেড়াতে, তাড়াতাড়ি কুঠির ঘরের দরজা বন্ধ করলাে। পাছে আবার তাদের সঙ্গে কথা কইতে হয়—এই কুণ্ঠা।
একদিন বললাে, আমার একটি বন্ধু আছে। নাম গােপাল। গােপাল সেন। তাকে আনবাে এখানে? আপনাকে দেখতে চায়।
‘নিয়ে আয় না। গােবিন্দ এসেছে, গােপাল আসবে, আমার তাে মহাভাগ্য।'
আশ্চর্য, এ ছেলের যে ভাবসমাধি হয় ! পঞ্চবটী তলায় ভাব হলাে একদিন। ভাবে একদিন ঠাকুরের গায়ে হাত দিয়ে গােপাল বললাে, ‘আমি তবে যাই। আমি আর এ সংসারে থাকতে পারছি না। আপনার তাে এখনাে অনেক দেরি। সুতরাং আমি একলাই যাই।'
তখন ঠাকুরেরও ভাবস্থা। বললেন, ‘বলাে--আবার আসবে?’ 
“আচ্ছা, আবার আসব।’
কদিন পর গােবিন্দ এসেছে একলাটি। মনমরা। মুখখানি যেন একেবারে ছায়া-ঢাকা।
“কিরে, গােপাল কই ? 
‘গােপাল আর নেই। গােপাল চলে গেছে।’
*******
দশ-এগারাে বছরের দু’টি ছেলে, পতু আর মণীন্দ্র। কাশীপুরে ঠাকুরের অসুখের সময় দেখা করতে এসেছে। কেউ ডাকেনি, কেউ বলেনি, নিজের থেকে চলে এসেছে প্রাণের টানে। সেবার তারা কি জানি, কাউকে প্রশ্ন তুলতেও দেয়না, বলে, “আর কিছু না দাও চৌকাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবাে দিন-রাত।
পাখা পেয়েছে একদিন। একবার এ হাওয়া করে, আরেকবার ও। ঠাকুরের মাথায় তখন যন্ত্রণা, দিন-রাত হাওয়ার দরকার। কিন্তু ছােটছােট হাত, ঠিকমতাে নাগাল পায়না। তবু ক্লান্তি নেই, সাধ্যের অতীত করে পাখা চালাচ্ছে।
‘আমি যতক্ষণ পাখা করছি, তুই ততক্ষণ পা টেপ। মণীন্দ্রকে বলছে পতু। আর পতুকে বলছে মণীন্দ্র, তারপর তুই পা, আমি পাঁখা।
দোলের দিন। বাগানে সবাই খুব হল্লা করছে, রং আর আবীরে হুলুস্থুল ! বাড়ির সবাই নেমে গেছে নীচে। রুগীর কাছে শুধু পতু আর মণীন্দ্র।
ঠাকুর চোখ চাইলেন। বললেন, ‘সেকি রে, তােরা রং খেলতে যাসনি? যা যা, নিচে যা, সব্বাই গেছে—তােরাও যা, আবীর খেল গিয়ে প্রাণ ভরে
পতু বললাে গম্ভীর হয়ে, না মশাই, আমরা যাবো না। আপনি রয়েছেন, আমরা কি আপনাকে ফেলে যেতে পারি ! 
ঠাকুর কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘ওরে, এরাই আমার সেই রামলালা, আমাকে সেবা করতে এসেছে। ছেলেমানুষ, তবু আমাকে ফেলে অন্যদিকে ফিরেও তাকালো না!’
বড়াে গরিব দু’টি ছেলে। কিন্তু ভক্তিধনে বিরাট ধনী।
‘একজন আমার বড়াে নিন্দে করে। বলেছেন ঠাকুর, ‘কেবল বলে ছােকরাদের ভালােবাসে। কেন বাসবাে না শুনি ? ছােকরারা খাঁটি দুধ, একটু ফুটিয়ে নিলেই হয়। দুই-পাতা হাঁড়িতে দুধ রাখতে ভয় হয়, কিন্তু ছােকরারা নতুন হাঁড়ি, দুধ নিশ্চিন্ত হয়ে রাখা যায়।’
ধোঁয়া দেয়াল ময়লা করে কিন্তু আকাশের কিছু করতে পারে না। বালক হচ্ছে সেই নীল-আকাশের টুকরাে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও কল্পতরু


ঠাকুরের অসুখ করেছে। গলায় ব্যথা। 
কেন হবে না? ছেলেমানুষের মতাে বরফ খেতে ভালােবাসেন-- কাঁচা বরফ। দক্ষিণেশ্বরে যে যায় সেই বরফ নিয়ে যায়। মহা খুশি ঠাকুর। সরবৎ করে দাও তো ভালাে, নয়তাে সাদা জলের মধ্যেই বরফ ফেলে খাবেন চুক চুক করে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও কল্পতরু
তারপর কুলপি যদি পান তাে কথা নেই।
শুধু তাই ?
তার উপর আবার হিম লাগানাে আছে তাে। গিয়েছিলেন পেনেটির উৎসবে,' বৃষ্টিতে ভিজে এসেছেন। গলার ব্যথা তাই দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।
‘বৃষ্টিতে এভাবে আপনি ভিজলেন কেন বলুন তাে?’ ভক্তদের একজন শাসন করে উঠলাে।
‘তা আমি কি জানি !’ বালকের মতাে বললেন ঠাকুর : ‘সব রামের দোষ।’
রামের মানে, রাম দওের। তার দোষ, যেহেতু সে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাে। যেহেতু সে বারণ করেনি। 
 ‘ও তাে ক্যাম্বেলের পাশ করা ডাক্তার। ও তো আমাকে জোর করে নিষেধ করতে পারতাে ! ঠাকুর উলটো তখন নালিশ করলেন, ‘ও তাে আমাকে বলতে পারতো, বৃষ্টি হতে পারে এখন, মােটই যাবেন না মশাই।’
গলায় ব্যথার জয়াগায় ডাক্তারি প্রলেপ লাগিয়েছেন। মুখখানা ভরে করে আছেন—অপরাধী বালকের মতাে।
‘সত্যিই তাে, রামেরই অন্যায়।’
‘নইলে দেখাে না, নীচে জল ওপরে জল, রাম আমাকে সমস্তদিন সেখানে নাচিয়ে নিয়ে এলাে !’
‘যাক গে, এখন থাকুন সাবধান হয়ে। কথা কওয়া বন্ধ করে দিন। লােকে বলে, সমস্তক্ষণ কথা কয়েই আপনার ব্যথা।’
‘কথা কইবাে না তাে বাঁচব কি নিয়ে ! কথাই তাে আমার আনন্দ। কথাই তাে আমার অমৃত।'
ঈশ্বর ভ্রমর হয়ে গুঞ্জন করছেন। বিহঙ্গ হয়ে কূজন করছেন। বাতাস হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছেন বেণুবনে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কূজন-গুঞ্জন। সেই শ্রবণলােভন বংশীধ্বনি।
ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার বললেন, ‘শুধু আমার সঙ্গে কথা কইবেন, আর কারু সঙ্গে নয়।' 
‘কিন্তু বড় কাশি হয়েছে যে।' কাতরমুখে বললেন ঠাকুর।
‘কাশি হয়েছে ? ডাক্তার রসিকতা করলেন : “তা কাশীতে যাওয়া তাে ভালাে কাজ।’
সবাই হাসলো। ঠাকুরও হাসলেন। বললেন, তাতে তাে মুক্তি গাে। আমি মুক্তি চাই না, আমি ভক্তি চাই।'
মুক্তি তাে সােজা, কোনাে দায়িত্ব নেই, কোনাে ভার বহন নেই। ভক্তিই কঠিন। কণ্টককে কুসুম মনে করাই ভক্তি। আঘাতকে মনে করা ঈশ্বরের আলিঙ্গন।
ভক্তি মানে, ঈশ্বরকে ভালােবাসা। অহেতুক ভালােবাসা। কোনাে কারণ নেই তবু খুশিতে ভরে ওঠা। মধুরের শেষ না পাওয়া।
ডাক্তারের সঙ্গেই কথা কন ঠাকুর।
সমস্ত কিছুর মধ্যেই ভগবান জেগে রয়েছেন, ফুটে রয়েছেন, ফলে রয়েছেন সেই কথাটিই বােঝাচ্ছেন সেদিন।
কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, বলছেন ঠাকুর : “তুমি আমাকে ঈশ্বর বলছো-তােমাকে একটা জিনিস দেখাই, দেখবে এসাে।'
‘অর্জুন গেলেন সঙ্গে-সঙ্গে। খানিকদূরে গিয়ে বললেন শ্রীকৃষ্ণ, কি দেখতে পাচ্ছাে?
‘অর্জুন বললেন, মস্ত একটা গাছ।
 ‘কী ফলে আছে ? প্রশ্ন করলেন শ্রীকৃষ্ণ!
‘অর্জুন বললেন, দেখছি তত বহু কালাে জাম থােলাে-থােলাে হয়ে ঝুলে আছে।
‘শ্রীকৃষ্ণ বললেন, কালাে জাম নয়। দেখে ভালাে করে। আর একটু এগিয়ে এসে দেখাে।
‘তখন অর্জুন দেখলেন, থোলা-থােলাে কৃষ্ণ ফলে আছে। কৃষ্ণ বললেন, এখন দেখলে আমার মতাে কতাে কৃষ্ণ ফলে রয়েছে ? 
ডাক্তার বললেন, ‘এ-সব বেশ কথা।' 
ঠাকুর খুশি হয়ে বললেন, ‘হা! কেমন কথা? 
‘বেশ।’
 “তবে একটা থ্যাঙ্কউই দাও!' হাসতে লাগলেন ঠাকুর।
পরিহাসের স্বচ্ছ জলের উপর ফুটিয়েছেন বর্ণাঢ্য ভাব-পদ্ম। ঈশ্বরকথার চন্দনে স্নিগ্ধ করেছেন রােগ-যন্ত্রণা।
সকালে একটু ভাতের মণ্ড, ঝােল আর দুধ, সন্ধ্যায় আবার একটু দুধ আর যবের মণ্ড—এই পথ্য করছেন ঠাকুর। তবু এত নিয়মে থেকেও রােগের কমতি নেই একটুও। বরং বৃদ্ধির মুখে।
“নিশ্চয়ই কুপথ্য করেছেন!’ ডাক্তার শাসিয়ে উঠলাে।
ডাক্তারের সঙ্গে ঠাকুরের ভাব তখন জমে গিয়েছে—তাই আর ‘আপনি’ নেই।
ঠাকুর মাথা চুলকে বললেন, “কই, না তাে!
“আচ্ছা আজ কোন্ কোন্ আনাজ দিয়ে ঝােল রাঁধা হয়েছিলাে?’ কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন ডাক্তার !
‘আলু, কাঁচকলা, বেগুন-’ ঠাকুর আবার মাথা চুলকোলেন : ‘দু-এক টুকরাে ফুলকপিও ছিলাে ।
‘এ্যাঁ"! ফুলকপি ? ফুলকপি খেয়েছেন? এই তাে আবার অত্যাচার হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। কটুকরাে খেয়েছেন? ডাক্তার তড়পাতে লাগলাে।
‘না গাে, এক টুকরােও খাইনি।' ঠাকুর বললেন অপরাধীর মতো : ‘তবে ঝােলে ছিলাে দেখেছি। 
‘দেখেছেন? তবেই হয়েছে ! না খেলে কী হয়?’
 না খেলে কী হয় ! ঠাকুর অবাক হবার মুখ করলেন।
‘কপি না খান, ঝােল তাে খেয়েছেন? ঝােলে তাে কপির গুণ ছিলাে। তারই জন্যে তাে আপনার মার হজমের ব্যাঘাত হয়ে ব্যায়ামের বৃদ্ধি হয়েছেন।’
সে কি গাে ! ঠাকুর প্রায় আকাশ থেকে পড়লেনঃ ‘কপি খেলাম না, পেটের অসুখও হয়নি, ঝােলে একটু-কি কপির রস ছিলো তাইতেই অসুখ বাড়লাে? এ কিছুতেই মানতে পারব না।' 
‘মানতে পারবেন না কেন ?’ ডাক্তার বসলেন গ্যাঁট হয়ে ? ‘আমার বেলায় কী হয়েছিলাে শুনুন ! হােমিওপ্যাথি করি, ছােটো-একটুকুর শক্তিকে উপেক্ষা করতে পারি না। আপনিই তাে বলেছেন, ছােটো একটুকু বীজে বিরাট বনস্পতি ছােট একটুকু নামে বিরাট বিশ্বঝঙ্কার। সেবার আমার দারুণ সর্দি হলাে। সর্দি থেকে ব্রঙ্কাইটিস! কিছুতেই সারে না ! কেন যে অসুখটা লেগে থাকছে বুঝে উঠতে পারছি না কিছুতেই। শেষে একদিন দেখি কি---
ঠাকুর তাকালেন কৌতূহলী হয়ে।
‘দেখি, চাকর গরুকে মাষকড়াই খাওয়াচ্ছে। যে গরুটার আমি দুধ খাই সেই গরুটাকে। কি ব্যাপার? চাকর বললাে কোথেকে কতগুলাে মাষকড়াই জুটেছে, সর্দির ভয়ে কেউ খেতে চাচ্ছে না, তাই ঠেসে ঠেসে খাওয়াচ্ছে গরুকে। হিসেব করে দেখলাম, যেদিন থেকে মাষকড়াই খাচ্ছে গরু, সেদিন থেকেই আমার সর্দি।
‘তারপর কী করলেন?’
‘গরুর মাষকড়াই খাওয়া বন্ধ করে দিলাম, আর আমার সর্দিও তাই সেরে গেলাে!’
সবাই হেসে উঠলে হাে-হহ করে।
“কিসে কি হয় কিছু বলা যায় না। আবার গল্প জুড়লেন ডাক্তার : ‘পাকপাড়ায় বাবুদের বাড়িতে সাত মাসের মেয়ের অসুখ করেছিলাে— ঘুঙরি কাশি, হুপিংকাফ। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। কিছুতেই অসুখের কারণ ঠিক করতে পারি না। শেষে জানতে পারলাম, গাধা ভিজেছিলাে।’
‘গাধা ভিজেছিলো কি গাে!’
 ‘যে গাধার দুধ মেয়েটি খেতাে সেই গাধা ভিজেছিলাে বৃষ্টিতে।’
‘সেই যে কি বলে গাে? ঠাকুরও রঙ্গ করলেন ‘সেই-যে বলে, তেঁতুলতলা দিয়ে আমার গাড়ি গিয়েছিলাে কিনা, সেজন্যেই তাে আমার অম্বল হয়েছে!’
পড়লাে আবার হাসির রােল।
ডাক্তার বললেন, ‘জানেন, একবার এক জাহাজের কাপ্তেনের বড়ো মাথা ধরেছিলাে। তখন ডাক্তাররা পরামর্শ করে জাহাজের গায়ে বেলেস্তারা লাগিয়ে দিলাে।
শত চিকিৎসায়ও সারছে না ঠাকুরের অসুখ। শত যন্ত্রণায়ও ঠাকুর ছাড়ছেন না ঈশ্বরকে।
আরামেও রাম, ব্যারামেও রাম। যার ব্যাধি, তারই আরােগ্য। যার তিমিররাত্রি, তারই সুপ্রভাত। যে ঘাতক সেই বলি, সেই খড়্গ, সেই হাড়িকাঠ।
‘দুঃখ জানে, শরীর জানে, মন তুমি আনন্দে থাকো' ছন্দের মতাে সুর করে বলে ওঠেন ঠাকুর।
যতোই দুঃখ আসুক, শরীর ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাক, তবু হে আমার মন, তুমি আনন্দে থাকো, ঈশ্বরকে ধরে থাকো। যতোই মেষ আসুক, বিদ্যুৎ জ্বলুক, ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিক, তবু হে আকাশ, তুমি তােমার নীল কান্তিটি অম্লান রেখাে। তােমার বজ্রে যেন তােমার বাঁশিটি শুনতে পাই। তােমার দাবদাহে অনুভব করি যেন তােমার শীতল প্রসাদ। 
সিন্ধুদেশী ভক্তের নাম হীরানন্দ। বলছেন মাষ্টারমশাইকে : ‘ওর কষ্ট আর দেখতে পাচ্ছি না। কেন উনি অতাে কষ্ট সইছেন?'
মাষ্টারমশাই বললেন, ‘লােকশিক্ষার জন্যে।’
 ‘কিসের লােকশিক্ষা?'
‘শুধু শেখাতে, দুর্বিষহ দৈহিক কষ্টের মধ্যেও কি করে ঈশ্বরে ডুবে থাকতে হয়। সকল কাঁটা ধন্য করে ফোটাতে হয় গােলাপ ! আসলে যাকে আমরা ভােগ বলি তাই হয়তাে রােগ। আর যাকে আমরা রােগ বলি তাই হয়তাে যােগ !’
‘সত্যি, দেখছি সেই ক্রুশবিদ্ধ যীশুখ্রীষ্টকে। কাঁটার মুকুট-পরা ভুবনেশ্বরকে।’ ঠাকুরকে এমন করে ভুগতে দিতে রাজি নয় দুর্গাচরণ।
একদিন তাকে কাছে ডেকে বসালেন ঠাকুর। ভাবাবেশে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, ‘শুনেছো—শােনো, আমার অসুখ আর সারবে না কোনােদিন।’
‘কে বললাে?’ দুর্গাচরণ রুখে উঠলাে।
‘আমিই বলছি ! শােনন, ডাক্তারেরা হদ্দ হয়ে গেলাে। কিছুতেই পারলাে না সারাতে। তুমি পারাে?’
‘পারি। লাফিয়ে উঠলাে দুর্গাচরণ।
 ‘পারাে?’ 
‘পারি।
ঠাকুর বুঝতে পারলেন তার মনের কথা। ঠাকুরের ব্যাধি নিজের দেহে টেনে নিতে চায় দুর্গাচরণ।
তাকে পাশ থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন ঠাকুর? বললেন, ‘জানি, তুমি পারাে। কিন্তু থাক, সারিয়ে কাজ নেই।'
পরে বললেন একটু থেমে : ‘আমার জন্যে কটা আমলকী আনতে পারাে?’
তাও পারে দুর্গাচরণ। লাফিয়ে উঠলাে। তখুনি পড়ি-মরি ছুটলাে আমলকী আনতে।
‘কোথায় পাবে এখন আমলকী ? কে একজন তাকে বাধা দিলাে : ‘এখন আমলকীর সময় নয়।
দুর্গাচরণ তা গ্রাহ্য করে না। সময় হয়তাে নয়, তাতে আমলকী পেতে বাধা কি। প্রভু যখন চেয়েছেন তখন মাটি ফুড়ে পাষাণ ফুড়ে আমলকী আসবে। যিনি মুককে বাচাল করেন, পঙ্গুকে করেন গিরিলঙ্ঘী, তিনি অকালফলােদয় ঘটাবেন আশ্চর্য কি? আমার ব্যাকুলতাই নিয়ে আসবে আমার আকাক্ষিতকে। অনাবৃষ্টির আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব আমার দৃষ্টির প্রাখর্যই ডেকে নিয়ে আসৰে, সেই শ্যামল-শােভন জলধরকে।
তিনদিনের মধ্যেই দুর্গাচরণ নিয়ে এলো আমলকী। 
কিন্তু আমলকী খেয়ে তাে গলার ঘা সারবে না।
 তবে কিসে সারবে ? 
সারবে, ভবতারিণীর কাছে স্পষ্টাস্পষ্টি প্রার্থনা করে।
নরেন তাই ঠাকুরকে পেড়ে ধরলাে। বললাে, “এতাে মা-মা করাে, তােমার মার কাছে থেকে বর চেয়ে নিয়ে এসাে, আমার গলার ঘা সারিয়ে দাও।’
‘ওরে, শরীরের জন্যে কিছু চাইতে পারি না। শরীর তাে নয়, কাপড়-মােড়া বাঁখারি। শুধু একটা বালিশের খােল।'
‘ওসব কথা চাই না শুনতে। তােমার কষ্ট আর আমি যে দেখতে পারি না।' 
‘ওরে, যে মন একবার মাকে দিয়েছি সেই মন মার পাদপদ্ম থেকে তুলে এনে নিজের দেহের ওপর রাখতে পারি না।' 
‘রাখাে। ওসব ঢের শুনছি।' নরেন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাে : ‘তুমি কিছু খেতে পাচ্ছো না। এই নিদারুণ দৃশ্য দেখা অসহ্য হয়ে উঠেছে। তুমি যাও, মার কাছ থেকে রােগমুক্তির বর চেয়ে নাও গে। মার কাছে এতাে সঙ্কোচ কি ? সন্তানের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এ মা-ই বা কি করে সহ্য করছেন? 
প্রায় ঠেলেঠুলে জোর জবরদস্তি করে ঠাকুরকে পাঠালে নরেন। পাঠালাে ভবতারিণীর মন্দিরে। বাইরে অপেক্ষা করে রইলাে মাতাপুত্রে কি কথা হয় তা জানবার জন্য।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন ঠাকুর। 
‘কি, বলেছিলে মাকে?’ নরেন ছুটে এলে উৎসুক হয়ে। 
‘বলেছিলাম!' 
“কি বলেছিলে ?’
“বলেছিলাম, খেতে পাচ্ছি না—মুখ বন্ধ’ 
‘বলেছিলে ? তাতে মা কী বললেন ?’
 ‘বললেন, তাের এক মুখ বন্ধ হয়েছে তাতে কি হলাে। তুই তো শতমুখে খাচ্ছিস।'
মাথা হেঁট করে রইলাে নরেন। নরেন যে খাচ্ছে-তাও তাে ঠাকুরই খাচ্ছেন।
শুধু তাই কেন ? যেখানে যে প্রাণী আহার করছে আস্বাদ করছে, সব 'আমি। ধরিত্রীর বুক থেকে রস টেনে নিচ্ছে গাছ, সে তাে আমি। মা’র চঞ্চু থেকে খাদ্য সংগ্রহ করছে পক্ষীশাবক, সে তাে আমি। আর আমিই তাে সেই গহন কাননের মধুসন্ধানী মধুকর।’
‘আমি অতাে শতটত চাই না।' বলেছিলাে বাবুরাম : ‘আমি শুধু তােমার এই একখানি মুখ চাই। আমি চাই তুমি এই মুখটিতে খাবে আর আমি তােমার এই মুখটিই দেখবে।'
তােমার অভয়ময় আনন্দময় মুখ। এতে তােমার কষ্ট তবু এতাে তােমার করুণা! এতাে তােমার ক্লেশ তবু এতে তােমার আশ্বাস।
সমস্ত রােগের মালিন্যের ঊর্ধ্বে একটি আরােগ্যের কনককান্তি। সমস্ত যন্ত্রণার অবশেষে একটি উল্লাস উজ্জল জয়ধ্বনি।
আমাদের চারিদিক আলােকময় করে আছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তােমার তৃপ্তিভরা চক্ষু দু'টি দেখি- দেখি তােমার রুচির মুখের পবিএতা। গাছের ডালে নতুন জাগা পাতা ক’টি নাচছে, সে যেন তােমার আনন্দ ! বাসা-না-ছাড়া পাখির কাকলী করছে, সে যেন তােমার সংবাদ । জলটি বয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে, সে যেন তুমি ডেকে যাচ্ছে। মেঘ ছেড়া-রােদটি এসে গায়ে পড়েছে, সে যেন তুমি এসে ছুয়েছে বন্ধুর মতাে।
এতাে কষ্ট পাচ্ছেন তবু জীবের দুঃখে কাতর। সর্বক্ষণ জীবের মঙ্গল চিন্তা করছেন। তাকে নিমন্ত্রণ করছেন জগতের আনন্দযজ্ঞে।
‘আহা, কি চিনিমাখা কথা!' বলছেন শ্যাম বস্তু।
‘যে চিনিটুকু নিতে পারে সেই চতুর।' বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ : ‘সংসারে বলিতে চিনিতে মিশেল হয়ে আছে। পিঁপড়ের মতাে থাকো। বালি ত্যাগ করে চিনিটুকু নাও। বালির মধ্যে থেকে যে চিনিটুকু নিতে পারে সেই বাহাদুর।’
তেমনি সংসারে থেকে, সং-টুকু ছেড়ে দিয়ে সারটুকু নাও।
আমার ঘর ভরা। কত জিনিস, কত আসবাব। কতাে বই খাতা, কতাে পােশাক-আসাক। কত লােকজন, গান-বাজনা। কত হৈ-চৈ, হাসি-হুল্লোড়। কিন্তু ভরা ঘরে তােমাকে ছাড়া আমি ব্যর্থ। আমি হৃতসর্বস্ব।
ঠাকুর তখন কাশীপুরে গােপাল ঘােষের বাগান বাড়িতে। রােগ ক্রমশ বেড়ে চলেছে আগুনের মত। যা বিক্ষত তাই বিশুদ্ধ—ক্ষত মুখে ঝরছে শুধু সুধাধারা। ক্ষুব্ধ স্তব্ধতা থেকে ঝরছে শুধু শান্তি। আর্তনাদ থেকে গীতকলকূজন।
শ্রীশ্রীমা সারদামণি এসেছেন ঠাকুরের সেবা করতে। দেবতার পূজার বেদীতে জাগ-প্রদীপটি হয়ে জেগে থাকতে। দুর্যোগের অমানিশাকে মঙ্গল দীপ্তিতে স্নিগ্ধ করতে । 
একদিন দুধের বাটি নিয়ে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন শ্ৰীমা। দুধ তো গেলােই, মায়ের পায়ের গােড়ালির হাড় সরে গেলাে। , তাই তাে বাবুরাম, এখন কি হবে ! ঠাকুর চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘যা হয় একটু কিছু খাইয়ে যেতেন, এখন কী উপায় আমার খাওয়ার !’
একেবারে সর্বাৰ্পিতনির্ভর শিশুর মতাে। একেবারে সরল শরণাগতি।
মা তখন নথ পরতেন। এরই মধ্যে মাকে নিয়ে ঠাকুরের রসিকতা, নাকের কাছে গােল করে হাত ঘুরিয়ে ঠারেঠোরে বলছেন ঠাকুর : ‘ও বাবুরাম, ঐ যে--ওকে তুই ঝুড়ি করে মাথায় তুলে এখানে নিয়ে আসতে পারিস?’
ঠাকুরের কথা শুনে বাবুরাম আর নরেন তাে হেসে খুন।
কিছুতেই কিছু হবার নয়। শ্রীমা তখন চললেন তারকেশ্বরে হত্যে দিতে।
একদিন যায়, দু’দিন যায়, পড়েই আছেন। তিনদিনের দিন রাতে একটা শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন শ্রীমা। যেন অনেকগুলাে সাজানাে হাঁড়ির উপর লাঠির ঘা পড়লাে। সঙ্গে-সঙ্গে একটা ভাব এলাে মার মনে। এ সংসারে কে কার ? কার জন্য আমি এখানে হত্যে দিতে বসেছি? কাকে আমি বাঁচাবো? কার সাধ্য তাকে মারে?
মায়া কাটিয়ে মহান বৈরাগ্য এনে দিলাে। অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে মন্দিরের পিছনের কুণ্ড থেকে স্নানঞ্জল নিয়ে চোখে-মুখে দিলেন শ্ৰীমা। পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে গিয়েছিলাে। জল খেয়ে প্রাণ কিছু সুস্থ হলাে। পরদিনই চলে এলেন।
“কি গাে, কিছু হলাে? জিগ্যেস করলেন ঠাকুর। মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন শ্রীমা।
ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ‘কিছুই না। কিছুই না! ও আমি জানতাম। আমিও এদিকে স্বপ্ন দেখছিলাম, যেন ওষুধ আনতে হাতী গেলাে। হাতী মাটি খুঁড়ছে ওযুধের জন্যে, এমন সময় গােপাল এসে স্বপ্ন ভেঙে দিলাে! 
মা কালীর কাছে এসে দাঁড়ালেন শ্রীমা। দেখলেন মা-কালী ঘাড় কাত করে রয়েছেন।
‘মা, তুমি কেন অমন করে আছাে? শুধােলেন সারদামণি।
ঠাকুরের গলায় ঘা দেখিয়ে মা-কালী বললেন, ‘ওর ঐটের জন্যে আমারও হয়েছে।'
ঠাকুর বললেন ভক্তদের, ‘যা ভােগ আমার ওপর দিয়েই হলাে। তােমাদের আর কাউকে কষ্ট ভােগ করতে হবে না। জগতের সকলের জন্যে আমি ভােগ করে গেলাম।’
আমাদের সকল তাপ তুমি হরণ করেছে, সকল পাপ, সকল গ্লানি।সকল অহঙ্কার, সকল অগৌরব। ক্ষমা দিয়ে মুছে দিয়েছে সকল অক্ষমতা। দয়া দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে সকল দারিদ্র্য। তােমার পাবনমন্ত্রে জীবিত করেছে ভগ্ন আর রুগ্নকে জীর্ণ, আর জ্বরক্লান্তকে, পীড়িত আর অধােগতকে! তােমার স্পর্শে আমাদের তাে শুধু উদ্ধার নয়, আমাদের উত্থান।
নরেন আর রাখাল পদসেবা করছে। মাষ্টারমশাইও কাছে বসে। নিরঞ্জন, শরৎশশী, বাবুরাম, যােগীন, কালী, লাটু, গােপাল সব আশেপাশে, নীচে-উপরে। রাত দুটো। কারুর চোখে ঘুম নেই। নবমীর চাঁদ উঠেছে, কারুর মনে সুখ নেই। ঠাকুরের অসুখ আরাে বেড়েছে। অসহায়ের মতাে স্তব্ধ হয়ে আছে সকলে। যেন শত্রুসৈন্য অবরােধ করেছে নগরী--কিন্তু সবাই নিরস্ত্র বলহীন।
‘তােমরা কাঁদবে বলে এতাে ভােগ করছি।' বলছেন ঠাকুর, ‘সবাই যদি বলো, এত কষ্ট, দেহ যাক, তাহলেই দেহ যায়।'
কেউ কিছু বলছে না। 
কিন্তু কেন, কেন এতাে ভােগ ? কেন এই দেহ-বিকার ?
‘জ্যোতির্ময় দেহ থাকলে লােকের ভিড় আরাে বেড়ে যেতাে।' বলছেন ঠাকুর, এখন বাইরে প্রকাশ নেই। তাই এখন আগাছারা পালাবে। আর যারা শুদ্ধ ভক্ত তারাই থাকবে এখন আমাকে ঘিরে এই ব্যারাম হয়েছে কেন? এর মানে ওই। যাদের সকাম ভক্তি তারা ব্যারাম অবস্থা দেখলে চলে যাবে।
শুধু কি তাই?
ভক্তকুলকে বাঁধতে চাইলেন সেবার পুণ্যব্রতে! সেবার মধ্য দিয়ে সমপ্রাণতায় উদ্বুদ্ধ হতে।
আমরা সবাই তােমার সেবক। হে পরম সেব্য, তােমাকে সেবা করতে-করতে পরস্পরের প্রতি প্রীতিমান হবে। তােমার যখন শরণ নিয়েছি, হে মহাজীবন, হে মহামরণ, তােমার সঙ্ঘেরও শরণ নিয়েছি।
শুধু কি তাই? 
আরাে একটি অর্থ আছে।
তুমি যে আমাদেরই একজন, আমাদের যে তুমি ভােলােনি, আমাদের যে তুমি ত্যাগ করতে পারো না, এইটুকু বােঝাবার জন্যই তােমার এই রােগজ্বালা। তুমি এই ভুবন বিস্তীর্ণ সমস্ত পথ হেঁটে এসে উঠলে এ সংসারে ? আমাদের পাশটিতে, আমাদের উত্তপ্ত নৈকট্যে। অন্তরবাসী হয়ে কি করে আবার প্রতিবেশী হতে হয় তারই সহজরূপে। বললে, আমি তােমাদেরই একজন, তোমাদেরই আপনার। চেয়ে দেখাে আমার দিকে, রােগে বল নাও, শশাকে সাহস নাও, আর মনে নাও ঈশ্বরানন্দমদিরা।
‘দুঃখ জানে, শরীর জানে, মন তুমি আনন্দে থাকো।’
আর, তােমার যদি এই রােগ হতাে, তবে, জগজ্জনকে কি করে দিতে তুমি আরােগ্যফল ? কি করে তুমি কল্পতরু হতে ?
ঈশ্বর অন্তরীক্ষ জুড়ে বৃক্ষের মতাে বিরাজ করছেন--এ কথা শাস্ত্রে বলে। তুমি সে বৃক্ষের চেয়ে নিকটতর, নিবিড়তর! তুমি আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে ! দিঙ্মণ্ডল ঢেকে মেলেছাে তােমার শীতল ছায়া, তােমার আতপচ্ছদ। তুমি কল্পনার নও, তুমি মৃত্তিকার কল্পতরু।
১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি ! ঘােরতর অসুখের মধ্যে ঠাকুর হঠাৎ উঠে বসলেন। বললেন, “আমার কাপড়-জামা দাও, আমি পরবাে সাজবে, যাবাে আমি বাগানে বেড়াতে।’
বেলা প্রায় তিনটে। ছুটির দিন বলে গৃহী-ভক্ত জড়াে হয়েছে । বাগানে। যদি কোনাে সুযােগে ঠাকুরের একবার দর্শন পায়।
গৃহীর টানে চললেন সেই মহাগৃহস্থ। সন্যাসীর শিরােমণি হয়ে গৃহস্থের মধ্যমণি। সন্যাসী সেবকেরা পড়ে রইলাে ঘরের মধ্যে, আশেপাশে, ঠাকুর চললেন মুক্ত মাঠে-গৃহস্থদের মাঝখানে।
আমি তােমাদের একজন। আমি তােমাদের ঘরের মানুষ। তােমাদের আত্মার আত্মীয়।
ঠাকুরের লালপেড়ে ধুতি পরনে, গায়ে সবুজ বনাতের জামা।’
কাপড়ের টুপি দিয়ে কর্ণমূল ঢাকা। লতাপাতা-আঁকা মােজা পায়ে, চটিজুতাে পরা। 
সন্যাসী সেবকরা সঙ্গ নিলাে না। তারা ঘর-দোর বিছানা-বালিশ পরিষ্কার করতে বসলাে ! ঠাকুর চলে এলেন একা-একা।
চলে এলেন সংসারীদের এলাকায়। একেবারে পাপী-তাপী দুঃস্থ-দুর্গতদের দুয়ারে।
বসতবাড়ি আর ফটক, তারই মাঝখানে পশ্চিমদিকে সমাগত অতিথিরা ভিড় করেছে—গিরিশ ঘােষ, তার ভাই অতুল, রাম দত্ত, অক্ষয় সেন। আরাে অনেকে।
ভাবানন্দে বিহবল হয়ে তাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন ঠাকুর। মৃত্তিকার ঘরে আকাশের দিনমণি।
সবাই হাতজোড় করে রইলাে।
গিরিশকে সম্বােধন করে বললেন ঠাকুর, ‘তুমি যে এত সব বলে বেড়াচ্ছাে, কি দেখেছাে তুমি ?’
‘আমি আর কী বলতে পারি, প্রভু ! হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়লাে গিরিশ। করজোড়ে উর্ধ্বমুখে বললাে, “ব্যাস-বাল্মীকি যার ইয়ত্তা করতে পারেনি, সেখানে আমি কি, আমি কতটুকু?’
বরাভয়ে প্রসারিত হলেন ঠাকুর। উত্তোলিত হাতে সবাইকে আশীর্বাদ করলেন, “তােমাদের চৈতন্য হােক।'
চৈতন্যের ঢেউ পড়ে গেলাে। দেশ-কাল মুছে গেলে নিমেষে! ঠাকুরের আর ব্যাধি নেই, পঞ্চভূতের ফাঁদ থেকে যেন এসেছেন বেরিয়ে। প্রণামের হরির লুঠ পড়ে গেছে। স্পর্শাঞ্জলির অতৃপ্য তর্পণ। সবাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাে ঠাকুরের অসুখ নাসারা পর্যন্ত কেউ ছোঁবে না তাঁকে-কেননা, সকলের স্পর্শ কলুষেই তাে ঠাকুরের এই রােগ--ভুলে গেলে সে-প্রতিজ্ঞা। কেশব সেন বলেছিলেন, ঠাকুরকে রেখে দিতে ‘গ্লাস-কেসে'—ভেঙে গেলে সেই ‘গ্লাস-কেস'। ঠাকুরও মহানন্দে ডুব দিলেন সেই স্পর্শ-সমুদ্রে। মৃত্যুঞ্জয়ী অভয় দিতে লাগলেন।
রাম দত্ত অঞ্জলি-অঞ্জলি ফুল দিতে লাগলাে !
অক্ষয় সেনের হাতে দু’টি জহুরী চাপা। চাঁপা দুটা তাঁর পায়ে দিতেই ঠাকুর তার বুক ছুঁয়ে দিলেন।
অক্ষয় একটা বিপুলতর চেতনার মধ্যে প্রাণ পেলাে! সানন্দে চীৎকার করে ডাকতে লাগলাে সবাইকে ‘ওরে, কে কোথা আছিস, এইবেলা চলে আয়। মুঠো-মুঠো অভয় কুড়িয়ে নে, আশ্বাস কুড়িয়ে নে। চৈতন্যের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কুড়িয়ে নে ভারে-ভারে। জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি বিবেক—এমন দিন আর পাবি না রে! কৃপার পাত্র উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন প্রভু! আয়, নিয়ে যা, দেখে যা অর্জুন যেমন দেখেছিলাে বিশ্বরূপ।’
ছুঁলেন নবগােপালকে, অতুলকে, হরমােহনকে। বৈকুণ্ঠ কিশােরী আর রামলালকে। হারাণের মহা-ভাগ্য, যেই প্রণাম করতে গিয়েছে, ভাবাবেশে ঠাকুর তার মাথায় পাদপদ্ম স্থাপন করেছেন।
কেউ স্তোত্র পড়ছে, কেউ বা ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে, কেউ আবার ভাসছে চোখের জলে।
ওরে, আর লােক কই, বেলা যে বয়ে গেলাে! কোথার কে আছিস আর্ত-বঞ্চিত অন্ধ-বিভ্রান্ত, আয় ছুটে আয়, কল্পতরুকে দেখে যা, বস এসে তাঁর ছায়ার আশ্রয়ে, তাঁর করুণার নিকেতনে। চতুর্বগ ফল নিয়ে যা। জীবনে যা তাের অভীষ্টতম সে পরম-ধন স্পর্শ কর্। লােহার কালাে তনু কাঞ্চন করিয়ে নিয়ে যা।
রুটি বেলবার আয়ােজন করছে রাঁধুনি বামুন, তাকে হিড়হিড় করে টেনে আনলাে গিরিশ।
‘ওরে, কাতর প্রভু অকাতর হয়েছেন কৃপাবিন্দু নিয়ে যা পাত্র ভরে।’
রাঁধুনি-বামুনও কৃপা পেলাে। আর কোথায়! আর কোথায়! হরিশ আছে। উপেন্দ্র আছে। তারাও এসে পড়েছে ঠিক সময়। 
গুপ্ৰবেশে মহালীলা করে গেলাম। যারা সেদিন কাছে ছিলিনে, ভয় নেই, আমি আছি তােদের কাছটিতে। যারা সেদিন ছুতে পারিসনি নে, আমার এই অন্তর-স্পর্শ। যারা সেদিন দেখিসনি আমাকে, দেখ আজ তােদর মানস-দর্পণে।
আমি কল্পতরু। আমি ক্ষয়হীন করুণার উৎস।
বল কি তাের আকাক্ষনীয় ? নিজেকে কৃপণ মনে করে ক্ষুদ্র দরিদ্র মন নিয়ে কেন কোণে পড়ে আছিস ? চা না, তাের যা ইচ্ছে। অন্তত আকাঙ্ক্ষায় উদার হ, অবারিত হ। নির্ভয়ে বল, কী তাের কামনা ? যা চাইবি তাই পাবি। হিসাব করে চাইতে হবে না, প্রাণ ঢেলে, প্রাণ ভরে চা। চা-মুখ ফুটে।। 
‘আমি কিছু চাই না। তােমার ফুল চাই না, ফল চাই না, শাখা চাই না। হে বৃক্ষ; আমি শুধু তােমাকে চাই।'
*************

Read PDF Online

Post a Comment

0 Comments