স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
ষষ্ঠ খণ্ড
বীরবাণী (কবিতা)
=================
শ্রীরামকৃষ্ণস্তোত্রাণি
(১)
ওঁ হ্রীং ঋতং ত্বমচলো গুণজিৎ গুণেড্যঃ
ন-ক্তন্দিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম্।
মো-হঙ্কষং বহুকৃতং ন ভজে যতোঽহং
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ১
ওঁ হ্রীং তুমি সত্য, স্থির, ত্রিগুণজয়ী অথচ নানাপ্রকার গুণের দ্বারা স্তবের যোগ্য। যেহেতু তোমার মোহনিবারক পূজনীয় পাদপদ্ম আমি ব্যাকুলভাবে দিনরাত্রি ভজনা করি না, সেজন্য হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়। ১
ভ-ক্তির্ভগশ্চ ভজনং ভবভেদকারি
গ-চ্ছন্ত্যলং সুবিপুলং গমনায় তত্ত্বম্।
বক্ত্রোদ্ধৃতোঽপি হৃদয়ে ন মে ভাতি কিঞ্চিৎ১
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!২
সংসার-বন্ধন-নাশকারী ভজন, ভক্তি ও বৈরাগ্যাদি ষড়ৈশ্বর্য সেই অতি মহান্ ব্রহ্মতত্ত্বপ্রাপ্তির পক্ষে যথেষ্ট—এই কথা মুখে উচ্চারিত হইলেও আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র প্রতিভাত হইতেছে না। অতএব হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়।২
তে-জস্তরন্তি ত্বরিতং ত্বয়ি তৃপ্ততৃষ্ণাঃ২
রা-গং কৃতে ঋতপথে ত্বয়ি রামকৃষ্ণে।
৩ ম-র্ত্যামৃতং তব পদং মরণোর্মিনাশং
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ৩
হে রামকৃষ্ণ! সত্যের পথস্বরূপ তোমাতে যাহারা অনুরক্ত, তোমাকে পাইয়াই তাহাদের সমুদয় কামনা পূর্ণ হয়, সুতরাং তাহারা শীঘ্র রজোগুণকে অতিক্রম করে। মরণশীল নরলোকে অমৃতস্বরূপ তোমার পাদপদ্ম মৃত্যুরূপ তরঙ্গকে নাশ করে। অতএব হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়। ৩
কৃ-ত্যং করোতি কলুষং কুহকান্তকারি
ষ্ণা-ন্তং শিবং সুবিমলং তব নাম নাথ।
য-স্মাদহং ত্বশরণো জগদেকগম্য
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!৪
হে প্রভো! মায়াদূরকারী মঙ্গলময় অতি পবিত্র তোমার ‘ষ্ণান্ত’ (রামকৃষ্ণ) নাম পাপকেও পুণ্যে পরিণত করে। হে জগতের একমাত্র লভ্য, যেহেতু আমি নিরাশ্রয়, সেজন্য হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়।৪
(২)
আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো যস্য প্রেমপ্রবাহঃ
লোকাতীতোঽপ্যহহ ন জহৌ লোককল্যাণমার্গম্।
ত্রৈলোক্যেঽপ্যপ্রতিমমহিমা জানকীপ্রাণবন্ধঃ
ভক্ত্যা জ্ঞানং বৃতবরবপুঃ সীতায় যো হি রামঃ॥ ১
স্তব্ধীকৃত্য প্রলয়কলিতং বাহবোত্থং মহান্তং
হিত্বা রাত্রিং প্রকৃতিসহজামন্ধতামিস্রমিশ্রাম্।
গীতং শান্তং মধুরমপি যঃ সিংহনাদং জগর্জ
সোঽয়ং জাতঃ প্রথিতপুরুষো রামকৃষ্ণস্ত্বিদানীম্॥ ২
যাঁহার প্রেমস্রোত চণ্ডাল পর্যন্ত অপ্রতিহতবেগে প্রবাহিত অর্থাৎ চণ্ডালোকেও যিনি ভালবাসিতে কুণ্ঠিত হন নাই, আহা! যিনি অতিমানব-স্বভাব হইয়াও লোকের কল্যাণের পথ পরিত্যাগ করেন নাই, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল—এই তিনলোকেই যাঁহার মহিমার তুলনা নাই, যিনি সীতার প্রাণস্বরূপ, যিনি ভক্তির সহিত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের কল্যাণমূর্তি ধারণ করিয়াছিলেন;১
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের সময় যে ভয়ানক প্রলয়তুল্য হুহুঙ্কার উঠিয়াছিল, তাহাকে স্তব্ধ করিয়া এবং(অর্জুনের) ঘোরতর স্বাভাবিক অন্ধতম-স্বরূপ অজ্ঞান-রজনীকে দূর করিয়া দিয়া, শান্ত ও মধুর গীত (গীতাশাস্ত্র) যিনি সিংহনাদরূপে গর্জন করিয়া বলিয়াছিলেন—সেই বিখ্যাত পুরুষই এক্ষণে রামকৃষ্ণরূপে জন্মিয়াছেন। ২
(শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী-কৃত পদ্যানুবাদ)
প্রেমের প্রবাহ যাঁর আচণ্ডালে প্রবাহিত,
লোকহিতে রত সদা, হয়ে যিনি লোকাতীত,
জানকীর প্রাণবন্ধ, উপমা নাহিক যাঁর,
ভক্ত্যাবৃত জ্ঞানবপু—যিনি রাম অবতার;
স্তব্ধ করি কুরুক্ষেত্র-প্রলয়ের হুহুঙ্কার,
দূর করি সহজাত মহামোহ-অন্ধকার,
সুগভীর উঠেছিল গীতসিংহনাদ যাঁর,
সেই এবে রামকৃষ্ণ খ্যাতনামা ত্রিসংসার।
(৩)
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব
শক্তিসমুদ্রসমুত্থতরঙ্গং
দর্শিতপ্রেমবিজৃম্ভিতরঙ্গং
সংশয়রাক্ষসনাশমহাস্ত্রং
যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যং
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব॥ ১
অদ্বয়তত্ত্বসমাহিতচিত্তং
প্রোজ্জ্বলভক্তিপটাবৃতবৃত্তং
কর্মকলেবরমদ্ভুতচেষ্টং
যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যং
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব॥ ২
হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। যিনি শক্তিরূপ সমুদ্র হইতে উত্থিত তরঙ্গস্বরূপ, যিনি প্রেমের নানা লীলা দেখাইয়াছেন, যিনি সন্দেহরূপ রাক্ষস বিনাসের মহাস্ত্রস্বরূপ, সংসাররূপ রোগের চিকিৎসক সেই গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। ১
যাঁহার চিত্ত অদ্বয় ব্রহ্মে সমাহিত, যাঁহার চরিত্র অতি শ্রেষ্ঠ ভক্তিরূপ বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত—অর্থাৎ যাঁহার ভিতরে জ্ঞান এবং বাহিরে ভক্তি, যিনি দেহের দ্বারা ক্রমাগত লোকহিতার্থ কর্ম করিয়াছেন, যাঁহার কার্যকলাপ অদ্ভুত, সংসাররূপ রোগের চিকিৎসক সেই গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। ২
(৪)
সামাখ্যাদ্যৈর্গীতিসুমধুরৈর্মেঘগম্ভীরঘোষৈ-
র্যজ্ঞধ্বান-ধ্বনিতগগনৈর্ব্রাহ্মণৈর্জ্ঞাতবেদৈঃ।
বেদান্তাখৌঃ সুবিহিত-মখোদ্ভিন্ন-মোহান্ধকারৈঃ
স্তুতো গীতো য ইহ সততং তং ভজে রামকৃষ্ণম্॥
বেদতত্ত্বজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞস্থলে মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা আকাশ বাতাস মুখরিত করিতেন, বিধিপূর্বক যজ্ঞ সম্পাদন করার ফলে তাঁহাদের শুদ্ধ হৃদয় হইতে বেদান্তবাক্যদ্বারা ভ্রম ও অজ্ঞানের অন্ধকার দূরীভূত হইয়াছিল; তাঁহারা মেঘের মত গম্ভীর সুমধুর সুরে সামবেদ প্রভৃতি দ্বারা যাঁহার স্তব করিয়াছেন, যাঁহার মহিমা কীর্তন করিয়াছেন—আমি সর্বদা সেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভজনা করি।*
শ্রীরামকৃষ্ণপ্র ণামঃ
স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।
অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ॥
ধর্মের সংস্থাপক, সকলধর্মস্বরূপ, অবতারগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে রামকৃষ্ণ, তোমাকে প্রণাম করি।
শিবস্তোত্রম্
নিখিলভুবনজন্মস্থেমভঙ্গপ্ররোহাঃ
অকলিতমহিমানঃ কল্পিতা যত্র তস্মিন্।
সুবিমলগগনাভে ত্বীশসংস্থেঽপ্যনীশে
মম ভবতু ভবেঽস্মিন্ ভাসুরো ভাববদ্ধঃ॥ ১
যাঁহাতে সমুদয় জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের অঙ্কুরসমূহ অসংখ্য বিভূতিরূপে কল্পিত, যিনি সুনির্মল আকাশের তুল্য, যিনি জগতের ঈশ্বররূপে অবস্থিত, যাঁহার কোন নিয়ন্তা নাই—সেই মহাদেব আমার প্রেমবন্ধন দৃঢ় ও উজ্জ্বল হউক। ১
নিহতনিখিলমোহে ঽধীশতা যত্র রূঢ়া
প্রকটিতপরপ্রেম্না যো মহাদেবসংজ্ঞঃ।
অশিথিলপরিরম্ভঃ প্রেমরূপস্য যস্য
হৃদি প্রণয়তি বিশ্বং ব্যাজমাত্রং বিভুত্বম্॥ ২
যিনি সমুদয় মোহ নাশ করিয়াছেন, যাঁহাতে ঈশ্বরত্ব স্বাভাবিক ভাবে অবস্থিত, যিনি (হলাহল পান করিয়া জগতের জীবগণের প্রতি) পরম প্রেম প্রকাশ করায় ‘মহাদেব’ নামে অভিহিত হইয়াছেন, প্রেমস্বরূপ যাঁহার গাঢ় আলিঙ্গনে সমুদয় ঐশ্বর্যই আমাদের হৃদয়ে শুধু মায়া বলিয়া প্রতিভাত হয়, সেই মহাদেবে আমার প্রেমবন্ধন দৃঢ় হউক। ২
বহতি বিপুলবাতঃ পূর্বসংস্কাররূপঃ
বিদলতি৪ বলবৃন্দং ঘূর্ণিতেবোর্মিমালা।
প্রচলিত খলু যুগ্মং যুষ্মদস্মৎপ্রতীতম্
অতিবিকলিতরূপং নৌমি চিত্তং শিবস্থম্॥ ৩
পূর্বসংস্কাররূপ প্রবল বায়ু প্রবাহিত হইতেছে, উহা ঘূর্ণায়মান তরঙ্গসমূহের মত বলবান্ ব্যক্তিদিগকেও দলিত করিতেছে। ‘তুমি-আমি’-রূপে প্রতিভাত দ্বন্দ্ব চলিতেছে। সেই শিবে সংস্থাপিত অতি বিকারশীল অস্থির চিত্তকে আমি বন্দনা করি।৩
জনকজনিতভাবো বৃত্তয়ঃ সংস্কৃতাশ্চ
অবগণনবহুরূপা যত্র চৈকো যথার্থঃ।
শমিতবিকৃতিবাতে যত্র নান্তর্বহিশ্চ
তমহহ হরমীড়ে চিত্তবৃত্তের্নিরোধম্॥ ৪
কার্যকারণভাব এবং নির্মল বৃত্তিসমূহ অসংখ্য নানারূপ হইলেও যেখানে একবস্তুই সত্য, বিকাররূপ বায়ু শান্ত হইলে যেখানে ভিতর ও বাহির থাকে না, আহা! সেই চিত্তবৃত্তির নিরোধস্বরূপ মহাদেবকে আমি বন্দনা করি। ৪
গলিততিমিরমালঃ শুভ্রতেজঃপ্রকাশঃ
ধবলকমলশোভঃ জ্ঞানপুঞ্জাট্টহাসঃ।
যমিজনহৃদিগম্যো নিষ্কলো ধ্যায়মানঃ
প্রণতমবতু মাং সঃ মানসো রাজহংসঃ॥ ৫
যাঁহা হইতে অজ্ঞানরূপ অন্ধকারসমূহ নষ্ট হইয়াছে, শুভ্র জ্যোতির মত যাঁহার প্রকাশ, যিনি শ্বেতবর্ণ পদ্মের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছেন, জ্ঞানরাশি যাঁহার অট্টহাস্যস্বরূপ (যাঁহার অট্টহাসিতে জ্ঞানরাশি ছড়াইয়া পড়িতেছে), যিনি সংযমী ব্যক্তির হৃদয়ে লভ্য, যিনি অখণ্ডস্বরূপ, মনোরূপ সরোবরে অবস্থিত সেই রাজহংসরূপী শিব, আমার দ্বারা ধ্যাত হইয়া প্রণত আমাকে রক্ষা করুন। ৫
দুরিতদলনদক্ষং দক্ষজাদত্তদোষং
কলিতকলিকলঙ্কং কম্রকহ্লারকান্তম্।
পরহিতকরণায় প্রাণপ্রচ্ছেদপ্রীতং৫
নতনয়ননিযুক্তং নীলকণ্ঠং নমামঃ॥৬
যিনি পাপনাশ করিতে সমর্থ, দক্ষকন্যা সতী—যাঁহাকে করকমল দান করিয়াছেন, যিনি কলির দোষসমূহ নাশ করেন, যিনি সুন্দর কহ্লারপুষ্পের মত মনোহর, পরের কল্যাণের জন্য প্রাণত্যাগ করিতে যাঁহার সদাই প্রীতি, প্রণত ব্যক্তিগণের মঙ্গলের জন্য সর্বদা যাঁহার দৃষ্টি রহিয়াছে—সেই নীলকণ্ঠ মহাদেবকে আমরা প্রণাম করি। ৬
অম্বা-স্তোত্রম্
আঘূর্ণিতং ভবজলং প্রবলোর্মিভঙ্গৈঃ।
শান্তিং বিধাতুমিহ কিং বহুধা বিভগ্নাং
মাতঃ প্রযত্নপরমাসি সদৈব বিশ্বে॥ ১
হে কল্যাণকারিণী মাতঃ, তোমার দুই হাতে সুখ ও দুঃখ। কে তুমি? সংসাররূপ জল প্রবল তরঙ্গসমূহ দ্বারা ঘূর্ণায়মান হইতেছে। তুমি কি সর্বদাই নানাপ্রকারে ভগ্ন শান্তিতে জগতে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যত্নপর হইতেছ? ১
সম্পাদয়ন্ত্যবিরতং ত্ববিরামবৃত্তা
যা বৈ স্থিতা কৃতফলং ত্বকৃতস্য নেত্রী।
সা মে ভবত্বনুদিনং বরদা ভবানী
জানাম্যহং ধ্রুবমিয়ং ধৃতকর্মপাশা॥ ২
যে নিয়তক্রিয়াশীলা দেবী সর্বদা কৃতকর্মের ফল সংযোজনা করিয়া অবস্থিতা, যাঁহাদের কর্মক্ষয় হইয়া গিয়াছে, তাঁহাদিগকে যিনি মোক্ষপদে লইয়া যান, সেই ভবানী আমাকে সর্বদা বর প্রদান করুন। আমি নিশ্চয়ই জানি, তিনি কর্মরূপ রজ্জু ধারণ করিয়া আছেন। ২
কিং বা কৃতং কিমকৃতং৬ ক্ব কপাললেখঃ
কিং কর্ম বা ফলমিহাস্তি হি যাং বিনা ভোঃ৭।
ইচ্ছাগুণৈর্নিয়মিতা৮ নিয়মাঃ স্বতন্ত্রৈঃ
যস্যাঃ সদা৯ ভবতু সা শরণং মমাদ্যা॥ ৩
এ জগতে যাঁহা ব্যতীত ধর্ম বা অধর্ম অথবা কপালের লেখা বা কর্ম বা (তাহার) ফল, এ সকল কিছুই হইতে পারে না, যাঁহার স্বাধীন ইচ্ছারূপ রজ্জু দ্বারা নিয়মসমূহ পরিচালিত, সেই আদিকারণস্বরূপা দেবী সর্বদা আমার আশ্রয়স্বরূপা হউন। ৩
সন্তানয়ন্তি জলধিং জনিমৃত্যুজালং
সম্ভাবয়ন্ত্যবিকৃতং বিকৃতং বিভগ্নম্।
যস্যা বিভূতয় ইহামিতশক্তিপালাঃ
নাশ্রিত্য তাং বদ কুতঃ শরণং ব্রজামঃ॥ ৪
এই সংসারে যাঁহার অপরিমিতশক্তিশালী বিভূতিসমূহ জন্মমৃত্যু-জালরূপ সমুদ্র বিস্তার করিতেছে এবং অবিকারী বস্তুকে বিকৃত ও ভগ্ন করিতেছে, বল, তাঁহার আশ্রয় না লইয়া কাহার শরণাপন্ন হইব? ৪
মিত্রে রিপৌ ত্ববিষমং তব পদ্মনেত্রং
স্বস্থেঽসুখে ত্ববিতথস্তব১০ হস্তপাতঃ।
ছায়া মৃতেস্তব দয়া ত্বমৃতঞ্চ মাতঃ১১
মুঞ্চন্তু মাং ন১২ পরমে শুভদৃষ্টয়স্তে॥ ৫
তোমার পদ্মনেত্রের দৃষ্টি—শত্রু-মিত্র উভয়ের প্রতিই সমভাবে পতিত হইতেছে, সুখী দুঃখী উভয়কে তুমি একই ভাবে স্পর্শ করিতেছ। হে মাতঃ, মৃত্যুচ্ছায়া ও জীবন—উভয়ই তোমার দয়া। হে মহাদেবী, তোমার শুভদৃষ্টিসমূহ আমাকে যেন পরিত্যাগ না করে। ৫
ক্বাম্বা শিবা ক্ব গৃণনং মম হীনবুদ্ধেঃ
দোর্ভ্যাং বিধর্তুমিব যামি জগদ্বিধাত্রীম্১৩।
চিন্ত্যং শ্রিয়া১৪ সুচরণং ত্বভয়প্রতিষ্ঠং
সেবাপরৈরভিনুতং১৫ শরণং প্রপদ্যে॥ ৬
সেই মঙ্গলময়ী মাতাই বা কোথায় এবং হীনবুদ্ধি আমার এই স্তববাক্যই বা কোথায়? আমি আমার এই ক্ষুদ্র দুই হস্ত দ্বারা জগতের বিধাত্রীকে যেন ধরিতে উদ্যত হইয়াছি। লক্ষ্মী যাঁহার চিন্তা করেন, যাঁহার সুন্দর পাদপদ্মে মুক্তি প্রতিষ্ঠিত, সেবাপরায়ণ জনগণ যাঁহার বন্দনা করেন, আমি সেই জগন্মাতার আশ্রয় লইলাম। ৬
যা মাং চিরায়১৬ বিনয়ত্যতিদুঃখমার্গৈঃ
আসংসিদ্ধেঃ স্বকলিতৈর্ললিতৈর্বিলাসৈঃ।
যা মে মতিং১৭ সুবিদধে সততং ধরণ্যাং
সাম্বা শিবা১৮ মম গতিঃ সফলেঽফলে বা॥ ৭
সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত চিরদিন যিনি আমাকে নিজকৃত মনোহর লীলাদ্বারা অতি দুঃখময় পথ দিয়া লইয়া যাইতেছেন, যিনি সর্বদা পৃথিবীতে আমার বুদ্ধিকে উত্তমরূপে পরিচালিত করিতেছেন, আমি সফলই হই আর বিফলই হই, সেই কল্যাণময়ী জননীই আমার গতি। ৭
(স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ-কৃত পদ্যানুবাদ)
তুলি ঘোর ঊর্মিভঙ্গে, মহাবর্ত তার সঙ্গে
এ ভবসাগরে কে মা, খেলিতেছ বল না?
শিবময়ী মূর্তি তোর শুভঙ্করি, একি ঘোর,
সুখ দুঃখ ধরি করে কর সবে ছলনা।
এতই কি তোর কাজ, সদা ব্যস্ত বিশ্বমাঝ,
অশান্ত ধরায় কি গো শান্তিদান বাসনা? ১
যে ছিঁড়েছে কর্মপাশ, তারে করি চিরদাস
নিত্যশান্তি সুধারাশি পিয়াতেছ, জননী,
কার্য করি ফল চায়, কৃত ফল দিতে তায়
সদাই আকুল তুমি, ওগো হরঘরণী,
জানি মা, তোমায় আমি, কর্মপাশে বাঁধো তুমি
বেঁধো না বরদে, মোরে, নাশো দুঃখরজনী! ২
কি কারণে কার্যচয়, জগতে প্রকট হয়,
সুকৃত দুষ্কৃত কিম্বা ললাট-লিখিত রে,
কেহ না দেখিয়া কূল, কহয়ে অদৃষ্ট-মূল,
ধর্মাধর্মে সুখ-দুঃখ এ নহে নিশ্চিত রে,
স্বতন্ত্র বিধান যাঁর, বদ্ধ আছে এ সংসার,
সে মূল শক্তির আমি সদাই আশ্রিত রে। ৩
যাঁহার বিভূতিচয়, লোকপাল সমুদয়,
যাঁদের অমিত শক্তি কোন বাধা মানে না,
জন্ম মৃত্যু জরা ব্যাধি, যে সাগরে নিরবধি
সে অনন্ত জলনিধি যাঁহাদের রচনা,
প্রকৃতি-বিকৃতিকারী এই সব কর্মচারী,
যাঁর বলে বলীয়ান্, কর তাঁরি অর্চনা। ৪
মা তোমার কৃপাদৃষ্টি সমভাবে সুধাবৃষ্টি,
শত্রু মিত্র সকলের উপরেই কর গো,
সমভাবে ধনী দীনে, রক্ষা কর নিশিদিনে,
মৃত্যু বা অমৃত, দুয়ে তব কৃপা ঝরে গো,
যাচি পদে, নিরুপমে, ভুল না মা, এ অধমে,
শুভদৃষ্টি তব যেন সর্বতাপ হরে গো। ৫
বিশ্বপ্রসবিনী তুমি, ক্ষুদ্রবুদ্ধি জীব আমি,
করিব তোমার স্তুতি বৃথা এই কল্পনা।
সীমাহীন দেশকালে, ধরে আছ বিশ্বজালে,
তোমায় ধরিতে হাতে উন্মাদের বাসনা,
অকিঞ্চন ভক্তিধন, রমাভাব্য যে চরণ,
সে পদে শরণ পাই, এই মাত্র কামনা।৬
স্বচরিত লীলাগার, মনোহর এ সংসার,
সুখ দুঃখ লয়ে সদা নানা খেলা খেলিছ,
পূর্ণ জ্ঞান দিবে তাই, জন্ম হতে সুখ নাই,
দুঃখপথ দিয়া মোর করে ধরি চলিছ,
সফল নিষ্ফল হই, কভু বুদ্ধিহারা নই,
তোমারি প্রসাদে তুমি সদা মোরে রাখিছ,
তুমি গতি মোর, তাই স্নেহে মাগো পালিছ। ৭
শ্রীরামকৃষ্ণ -আরাত্রিক ভজন
খণ্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়॥
মোচন-অঘদূষণ ১৯ জগভূষণ, চিদ্ঘনকায়।
জ্ঞানাঞ্জন-বিমল-নয়ন বীক্ষণে মোহ যায়॥
ভাস্বর ভাব-সাগর চির-উন্মাদ প্রেম-পাথার।
ভক্তার্জন-যুগলচরণ, তারণ-ভব-পার॥
জৃম্ভিত-যুগ-ঈশ্বর ২০, জগদীশ্বর, যোগসহায়।
নিরোধন, সমাহিত মন, নিরখি তব কৃপায়॥
ভঞ্জন-দুঃখগঞ্জন ২১ করুণাঘন, কর্মকঠোর২২।
প্রাণার্পণ-জগত-তারণ, কৃন্তন-কলিডোর২৩॥
বঞ্চন-কামকাঞ্চন, অতিনিন্দিত-ইন্দ্রিয়-রাগ।
ত্যাগীশ্বর, হে নরবর, দেহ পদে অনুরাগ॥
নির্ভয়, গতসংশয়, দৃঢ়নিশ্চয়মানসবান্ ।
নিষ্কারণ-ভকত-শরণ, ত্যজি জাতিকুলমান২৪॥
সম্পদ তব শ্রীপদ, ভব গোষ্পদ-বারি যথায়।
প্রেমার্পণ, সমদরশন, জগজন-দুঃখ যায়॥
[পূর্বে এই ভজনটি নিম্নলিখিতভাবে রচিত হইয়াছিল; পরে স্বামীজী উহার পূর্বোক্তরূপে পরিবর্তন করেন।]
খণ্ডন্-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন, বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়॥
নমো নমো প্রভু বাক্যমনাতীত
মনোবচনৈকাধার,
জ্যোতির জ্যোতি উজল হৃদিকন্দর
তুমি তমভঞ্জনহার২৫।
ধে ধে ধে, লঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গ, বাজে অঙ্গ সঙ্গ মৃদঙ্গ,
গাইছে ছন্দ ভকতবৃন্দ, আরতি তোমার॥
শিব-সঙ্গীত
(১)
কর্ণাটি—একতালা
তাথেইয়া তাথেইয়া নাচে ভোলা,বম্ বব বাজে গাল।
ডিমি ডিমি ডিমি ডমরু বাজে, দুলিছে কপাল মাল।
গরজে গঙ্গা জটামাঝে, উগরে অনল ত্রিশূল রাজে,
ধক্ ধক্ ধক্ মৌলিবন্ধ জ্বলে শশাঙ্ক-ভাল।
(২)
তাল—সুর ফাঁকতাল
হর হর হর ভূতনাথ পশুপতি।
যোগেশ্বর মহাদেব শিব পিনাকপাণি॥
ঊর্ধ্ব জ্বলত জটাজাল, নাচত ব্যোমকেশ ভাল,
সপ্ত ভুবন ধরত তাল, টলমল অবনী॥
শ্রীকৃষ্ণ-সঙ্গীত
মুলতান—ঢিমা ত্রিতালী
মুঝে বারি বনোয়ারী সেঁইয়া, যানেকো দে।
যানেকো দে রে সেঁইয়া, যানেকো দে (আজু ভালা)।
মেরা বনোয়ারী, বাঁদি তুহারি
ছোড়ে চতুরাই সেঁইয়া, যানেকো দে (আজু ভালা)
(মোরে সেঁইয়া)
যমুনাকি নীরে, ভরোঁ গাগরিয়া
জোরে২৬ কহত সেঁইয়া, যানেকো দে॥
সৃষ্টি
একরূপ, অ-রূপ-নাম-বরণ, অতীত-আগামী-কাল-হীন,
দেশহীন, সর্বহীন, ‘নেতি নেতি’ বিরাম যথায়॥২৭
সেথা হতে বহে কারণ-ধারা
ধরিয়ে বাসনা বেশ উজালা,
গরজি গরজি উঠে তার বারি,
‘অহমহমিতি’ সর্বক্ষণ॥
সে অপার ইচ্ছা-সাগরমাঝে,
অযুত অনন্ত তরঙ্গ রাজে,
কতই রূপ, কতই শকতি,
কত গতি স্থিতি, কে করে গণন॥
কোটি চন্দ্র—কোটি তপন
লভিয়ে সেই সাগরে জনম,
মহাঘোর রোলে ছাইল গগন,
করি দশ দিক জ্যোতিমগন॥
তাহে বসে২৮ কত জড় জীব প্রাণী,
সুখ দুঃখ জরা জনম মরণ,
সেই সূর্য, তারি কিরণ; সেই সূর্য, সেই কিরণ॥২৯
***************
প্রলয় বা গভীর সমাধি
বাগেশ্রী—আড়া
নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর,
ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব চরাচর॥
অস্ফুট মন-আকাশে, জগতসংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
ধীরে ধীরে ছায়াদল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি’ ‘আমি’—এই ধারা অনুক্ষণ॥
সে ধারাও বদ্ধ হল, শুন্যে মিলাইল,
‘অবাঙ্মনসোগোচরম্’, বোঝে—প্রাণ বোঝে যার॥
সখার প্রতি
প্রাণ-সাক্ষী শিশুর ক্রন্দন, হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান্?
দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;
‘স্বার্থ’ ‘স্বার্থ’ সদা এই রব, হেথা কোথা শান্তির আকার?
সাক্ষাৎ নরক স্বর্গময়—কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?
কর্ম-পাশ গলে বাঁধা যার—ক্রীতদাস বল কোথা যায়?
যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।
হৃদিবান্ নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;
লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর-মূরতি তা কি সয়?
হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল—
সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।
বিদ্যাহেতু করি প্রাণপণ, অর্ধেক করেছি আয়ুক্ষয়—
প্রেমহেতু উন্মাদের মত, প্রাণহীন ধরেছি ছায়ায়;
ধর্ম তরে করি কত মত, গঙ্গাতীর শ্মশানে আলয়,
নদীতীর পর্বতগহ্বর, ভিক্ষাশনে কত কাল যায়।
অসহায়-ছিন্নবাস ধরে দ্বারে দ্বারে উদরপূরণ—
ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে, কি ধন করিনু উপার্জন?
শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ—বুদ্ধির বিভ্রম; ‘প্রেম’ ‘প্রেম’—এই মাত্র ধন।
জীব ব্রহ্ম, মানব ঈশ্বর, ভূত-প্রেত-আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী কীট-অণুকীট—এই প্রেম হৃদয়ে সবার।
‘দেব’ ‘দেব’—বল আর কেবা? কেবা বল সবারে চালায়?
পুত্র তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হরে—প্রেমের প্রেরণ!!
হয়ে বাক্য-মন-অগোচর, সুখ-দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ-শোক, দারিদ্র্য-যাতনা, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বল কেবা কিবা করে?
ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?
দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
নাচুক তাহাতে শ্যামা
শুভ্র শশী যেন হাসিরাশি, যত স্বর্গবাসী বিতরিছে ধরাবাসে॥
মৃদুমন্দ মলয়পবন, যার পরশন, স্মৃতিপট দেয় খুলে।
নদী, নদ, সরসী-হিল্লোল, ভ্রমর চঞ্চল, কত বা কমল দোলে॥
ফেনময়ী ঝরে নির্ঝরিণী—তানতরঙ্গিণী—গুহা দেয় প্রতিধ্বনি।
স্বরময় পতত্রিনিচয়, লুকায়ে পাতায়, শুনায় সোহাগবাণী॥
চিত্রকর, তরুণ ভাস্কর, স্বর্ণতুলিকর, ছোঁয় মাত্র ধরাপটে।
বর্ণখেলা ধরাতল ছায়, রাগপরিচয় ভাবরাশি জেগে ওঠে॥
মেঘমন্দ্র কুলিশ-নিস্বন, মহারণ, ভুলোক-দ্যুলোক-ব্যাপী।
অন্ধকার উগরে আঁধার, হুহুঙ্কার শ্বসিছে প্রলয়বায়ু॥
ঝলকি ঝলকি তাহে ভায়, রক্তকায় করাল বিজলীজ্বালা।
ফেনময় গর্জি মহাকায়, ঊর্মি ধায় লঙ্ঘিতে পর্বতচূড়া॥
ঘোষে ভীম গম্ভীর ভূতল, টলমল রসাতল যায় ধরা।
পৃথ্বীচ্ছেদি উঠিছে অনল, মহাচল চূর্ণ হয়ে যায় বেগে॥
শোভাময় মন্দির-আলয়, হ্রদে নীল পয়, তাহে কুবলয়শ্রেণী।
দ্রাক্ষাফল-হৃদয়-রুধির, ফেনশুভ্রশির, বলে মৃদু মৃদু বাণী॥
শ্রুতিপথে বীণার ঝঙ্কার, বাসনা বিস্তার, রাগ তাল মান লয়ে।
কতমত ব্রজের উচ্ছ্বাস, গোপী-তপ্তশ্বাস, অশ্রুরাশি পড়ে বয়ে॥
বিম্বফল যুবতী-অধর, ভাবের সাগর—নীলোৎপল দুটি আঁখি।
দুটি কর—বাঞ্ছাঅগ্রসর, প্রেমের পিঞ্জর, তাহে বাঁধা প্রাণপাখী॥
ডাকে ভেরী, বাজে ঝর্র্ ঝর্র্ দামামা নক্কাড়, বীর দাপে কাঁপে ধরা।
ঘোষে তোপ বব-বব-বম্, বব-বব-বম্ বন্দুকের কড়কড়া॥
ধূমে ধূমে ভীম রণস্থল, গরজি অনল বমে শত জ্বালামুখী।
ফাটে গোলা লাগে বুকে গায়, কোথা উড়ে যায় আসোয়ার ঘোড়া হাতী॥
পৃথ্বীতল কাঁপে থরথর, লক্ষ অশ্ববরপৃষ্ঠে বীর ঝাঁকে রণে।
ভেদি ধূম গোলাবরিষণ গুলি স্বন্ স্বন্, শত্রুতোপ আনে ছিনে॥
আগে যায় বীর্য-পরিচয় পতাকা-নিচয়, দণ্ডে ঝরে রক্তধারা।
সঙ্গে সঙ্গে পদাতিকদল, বন্দুক প্রবল, বীরমদে মাতোয়ারা॥
ঐ পড়ে বীর ধ্বজাধারী, অন্য বীর তারি ধ্বজা লয়ে আগে চলে।
তলে তার ঢের হয়ে যায় মৃত বীরকায়, তবু পিছে নাহি টলে॥
দেহ চায় সুখের সঙ্গম, চিত্ত-বিহঙ্গম সঙ্গীত-সুধার ধার।
মন চায় হাসির হিন্দোল, প্রাণ সদা লোল যাইতে দুঃখের পার॥
ছাড়ি হিম শশাঙ্কচ্ছটায়, কেবা বল চায়, মধ্যাহ্নপতন-জ্বালা।
প্রাণ যার চণ্ড দিবাকর, স্নিগ্ধ শশধর, সেও তবু লাগে ভাল॥
সুখতরে সবাই কাতর, কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?
সুখে দুঃখ, অমৃতে গরল, কণ্ঠে হলাহল, তবু নাহি ছাড়ে আশা॥
রুদ্রমুখে সবাই ডরায়, কেহ নাহি চায় মৃত্যুরূপা এলোকেশী।
উষ্ণধার, রুধির-উদ্গার, ভীম তরবার খসাইয়ে দেয় বাঁশী॥
সত্য তুমি মৃত্যরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।
করালিনি, কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখস্বপ্ন দেহে দয়া॥
মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী।
প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিক্বাস, বলে মা দানবজয়ী॥
মুখে বলে দেখিবে তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে।
মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে॥
হে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে বলে, ভক্তিপূজাছলে স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা॥
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার, দেখে তোর হিয়া কাঁপে।
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার! মর্মকথা বলি কাকে?
ভাঙ্গ বীণা—প্রেমসুধাপান, মহা আকর্ষণ—দূর কর নারীমায়া।
আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজলপান, প্রাণপণ, যাক্ কায়া॥
জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে॥
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥
গাই গীত শুনাতে তোমায়
ভাল মন্দ নাহি গণি,
নাহি গণি লোকনিন্দা যশকথা।
দাস তোমা দোঁহাকার,
সশক্তিক নমি তব পদে।
আছ তুমি পিছে দাঁড়াইয়ে,
তাই ফিরে দেখি তব হাসিমুখ।
ফিরে ফিরে গাই, কারে না ডরাই,
জন্মমৃত্যু মোর পদতলে।
দাস তব জনমে জনমে দয়ানিধে!
তব গতি নাহি জানি,
মম গতি—তাহাও না জানি।
কেবা চায় জানিবারে?
ভুক্তি মুক্তি ভক্তি আদি যত,
জপ-তপ সাধন-ভজন,
আজ্ঞা তব, দিয়েছি তাড়ায়ে;
আছে মাত্র জানাজানি-আশ,
তাও প্রভু কর পার।
চক্ষু দেখে অখিল জগৎ,
না চাহে দেখিতে আপনায়,
কেন বা দেখিবে?
দেখে নিজরূপ দেখিলে পরের মুখ।
তুমি আঁখি মম, তব রূপ সর্ব ঘটে।
ছেলেখেলা করি তব সনে,
কভু ক্রোধ করি তোমা ’পরে,
যেতে চাই দূরে পলাইয়ে;
শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে,
নির্বাক আনন, ছল ছল আঁখি,
চাহ মম মুখপানে।
অমনি যে ফিরি, তব পায়ে ধরি,
কিন্তু ক্ষমা নাহি মাগি।
তুমি নাহি কর রোষ।
পুত্র তব, অন্য কে সহিবে প্রগল্ভতা?
প্রভু তুমি, প্রাণসখা তুমি মোর।
কভু দেখি আমি তুমি, তুমি আমি।
বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর,
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী।
সিন্ধুরোলে তব হুহুঙ্কার,
চন্দ্রসূর্যে তোমারি বচন,
মৃদুমন্দ পবন—আলাপ,
এ সকল সত্য কথা।
কিন্তু মানি—অতি স্থূল ভাব,
তত্ত্বজ্ঞের এ নহে বারতা।
সূর্যচন্দ্র চলগ্রহতারা,
কোটি কোটি মণ্ডলীনিবাস
ধূমকেতু বিজলি আভাস,
সুবিস্তৃত অনন্ত আকাশ—মন দেখে।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ আদি
ভঙ্গ যথা তরঙ্গ-লীলার
বিদ্যা-অবিদ্যার ঘর,
জন্ম জরা জীবন মরণ,
সুখ-দুঃখ-দ্বন্দ্বভরা,
কেন্দ্র যার ‘অহমহমিতি’,
ভূজদ্বয়—বাহির অন্তর,
আসমুদ্র আসূর্যচন্দ্রমা,
আতারক অনন্ত আকাশ,
মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার,
দেব যক্ষ মানব দানব,
পশু পক্ষী কৃমি কীটগণ,
অণুক দ্ব্যণুক জড়জীব—
সেই সমক্ষেত্রে অবস্থিত।
স্থূল অতি এ বাহ্য বিকাশ,
কেশ যথা শিরঃপরে।
মেরুতটে হিমানীপর্বত,
যোজন যোজন সে বিস্তার;
অভ্রভেদী নিরভ্র আকাশে
শত উঠে চূড়া তার।
ঝকমকি জ্বলে হিমশিলা
শত শত বিজলি-প্রকাশ!
উত্তর অয়নে বিবস্বান্,
একীভূত সহস্রকিরণ,
কোটি বজ্রসম করধারা
ঢালে যবে তাহার উপর,
শৃঙ্গে শৃঙ্গে মূর্ছিত ভাস্কর,
গলে চূড়া শিখর গহ্বর,
বিকট নিনাদে খসে পড়ে গিরিবর,
স্বপ্নসম জলে জল যায় মিলে।
সর্ব বৃত্তি মনের যখন
একীভূত তোমার কৃপায়
কোটি সূর্য অতীত প্রকাশ,
চিৎসূর্য হয় হে বিকাশ,
গলে যায় রবি শশী তারা,
আকাশ পাতাল তলাতল,
এ ব্রহ্মাণ্ড গোষ্পদ-সমান।
বাহ্যভূমি অতীত গমন,
শান্ত ধাতু, মন আস্ফালন নাহি করে,
শ্লথ হৃদয়ের তন্ত্রী যত,
খুলে যায় সকল বন্ধন,
মায়ামোহ হয় দূর,
বাজে তথা অনাহত ধ্বনি—তব বাণীঃ
—শুনি সসম্ভ্রমে, দাস তব প্রস্তুত সতত
সাধিতে তোমার কাজ।—
‘আমি বর্তমান।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
প্রলয়ের কালে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
সে মহানির্বাণ, নাহি কর্ম করণ কারণ,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকার-বুকে,
আমি বর্তমান।
‘আমি বর্তমান।
প্রলয়ের কালে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকার-বুকে,
ত্রিশূন্য জগৎ শান্ত সর্বগুণভেদ,
একাকার সূক্ষ্মরূপ শুদ্ধ পরমাণুকায়,
আমি বর্তমান।
‘আমি হই বিকাশ আবার।
মম শক্তি প্রথম বিকার,
আদি বাণী প্রণব ওঙ্কার
বাজে মহাশূন্যপথে,
অনন্ত আকাশ শোনে মহানাদ-ধ্বনি,
ত্যজে নিদ্রা কারণমণ্ডলী,
পায় নব প্রাণ অনন্ত অনন্ত পরমাণু;
লম্ফঝম্প আবর্ত উচ্ছ্বাস
চলে কেন্দ্র প্রতি—দূর অতি দূর হতে;
চেতন-পবন তোলে ঊর্মিমালা
মহাভূত-সিন্ধু ’পরে;
পরমাণু আবর্ত বিকাশ,
আস্ফালন পতন উচ্ছ্বাস,
মহাবেগে ধায় সে তরঙ্গরাজি।
অনন্ত অনন্ত খণ্ড তার
উৎসারিত প্রতিঘাত-বলে,
ছোটে শূন্যপথে খগোলমণ্ডলরূপে
ধায় গ্রহ-তারা,
ফেরে পৃথ্বী মনুষ্য-আবাস।
‘আমি আদি কবি,
মম শক্তি বিকাশ-রচনা
জড় জীব আদি যত
আমি করি খেলা শক্তিরূপা মম মায়া সনে
একা আমি হই বহু দেখিতে আপন রূপ।
‘আমি আদি কবি,
মম শক্তি বিকাশ-রচনা
জড় জীব আদি যত।
মম আজ্ঞাবলে
বহে ঝঞ্ঝা পৃথিবী উপর,
গর্জে মেঘ অশনি-নিনাদ;
মৃদুমন্দ মলয়-পবন
আসে যায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসরূপে;
ঢালে শশী হিম করধারা,
তরুলতা করে আচ্ছাদন ধরাবপু;
তোলে মুখ শিশিরমার্জিত
ফুল্ল ফুল রবি-পানে।’
সাগর-বক্ষে
শ্বেত কৃষ্ণ বিবিধ বরণ—
তাহে তারতম্য তারল্যের
পীত ভানু মাঙ্গিছে বিদায়।
রাগচ্ছটা জলদ দেখায়।
বহে বায়ু আপনার মনে,
প্রভঞ্জন করিছে গঠন—
ক্ষণে গড়ে, ভাঙ্গে আর ক্ষণে—
কতমত সত্য অসম্ভব—
জড়, জীব, বর্ণ, রূপ, ভাব।
ঐ আসে তূলারাশি সম,
পরক্ষণে হের মহানাগ,
দেখ সিংহ বিকাশে বিক্রম,
আর দেখ প্রণয়িযুগল;
শেষে সব আকাশে মিলায়।
নীচে সিন্ধু গায় নানা তান;
মহীয়ান্ সে নহে, ভারত!
অম্বুরাশি বিখ্যাত তোমার;
রূপরাগ হয়ে জলময়
গায় হেথা, না করে গর্জন।
0 Comments