পত্রাবলী (পত্র সংখ্যাঃ ১-১২৮) - স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
ষষ্ঠ খণ্ড

পত্রাবলী (পত্র সংখ্যাঃ ১-১২৮)

১২ই অগস্ট, ১৮৮৮ হইতে ১৫ই নভেম্বর, ১৮৯৪
*******************

পত্র সংখ্যা (১-১০)

পত্র সংখ্যা (১-১০)


পত্র সংখ্যা- ১

[শ্রীযুক্ত প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিত]

বৃন্দাবন
১২ অগষ্ট, ১৮৮৮

মান্যবরেষু,
শ্রীঅযোধ্যা হইয়া শ্রীবৃন্দাবনধামে পৌঁছিয়াছি। কালাবাবুর কুঞ্জে আছি—শহরে মন কুঞ্চিত হইয়া আছে। শুনিয়াছি রাধাকুণ্ডাদি স্থান মনোরম। তাহা শহর হইতে কিঞ্চিৎ দূরে। শীঘ্রই হরিদ্বার যাইব, বাসনা আছে। হরিদ্বারে আপনার আলাপী কেহ যদি থাকেন, কৃপা করিয়া তাঁহার উপর এক পত্র দেন, তাহা হইলে বিশেষ অনুগ্রহ করা হয়। আপনার এস্থানে আসিবার কি হইল? শীঘ্র উত্তর দিয়া কৃতার্থ করিবেন। অলমধিকেনেতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ২
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

শ্রীশ্রীদুর্গা শরণম্
বৃন্দাবন
২০ অগষ্ট, ১৮৮৮

ঈশ্বরজ্যোতি মহাশয়েষু,
আমার এক বৃদ্ধ গুরুভ্রাতা সম্প্রতি কেদার ও বদরিকাশ্রম দেখিয়া ফিরিয়া বৃন্দাবনে আসিয়াছেন, তাঁহার সহিত গঙ্গাধরের সাক্ষাৎ হয়। গঙ্গাধর দুইবার তিব্বত ও ভূটান পর্যন্ত গিয়াছিল। অতি আনন্দে আছে। তাঁহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া আকুল হয়। শীতকালে কনখলে ছিল। আপনার প্রদত্ত করোয়া তাহার হস্তে আজিও আছে। সে ফিরিয়া আসিতেছে—এই মাসেই বৃন্দাবন আসিবে। আমি তাহাকে দেখিবার প্রত্যাশায় হরিদ্বার গমন কিছুদিন স্থগিত রাখিলাম। আপনার সমীপচারী সেই শিবভক্ত ব্রাহ্মণটিকে আমার কোটি সাষ্টাঙ্গ প্রণাম দিবেন ও আপনি জানিবেন। অলমিতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

**********

পত্র সংখ্যা- ৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
বরাহনগর মঠ
৫ অগ্রহায়ণ, সোমবার, ১২৯৫
(১৯ নভেম্বর, ১৮৮৬)

পূজ্যপাদ মহাশয়,
আপনার প্রেরিত পুস্তকদ্বয় প্রাপ্ত হইয়াছি এবং আপনার অত্যুদার হৃদয়ের উপযুক্ত পরিচায়ক অদ্ভুত স্নেহরসাপ্লুত লিপি পাঠ করিয়া আনন্দে পূর্ণ হইয়াছি। মহাশয় আমার ন্যায় একজন ভিক্ষাজীবী উদাসীনের উপর এত অধিক স্নেহ প্রকাশ করেন, ইহা আমার প্রাক্তনের সুকৃতিবশতঃ সন্দেহ নাই। ‘বেদান্ত’ প্রেরণ দ্বারা মহাশয় কেবল আমাকে নয়, পরন্তু ভগবান্ রামকৃষ্ণের সমুদায় সন্ন্যাসিশিষ্যমণ্ডলীকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহারা অবনতমস্তকে আপনাকে প্রণিপাত জানাইয়াছেন। পাণিনির ব্যাকরণ কেবল আমার নিমিত্ত প্রার্থনা করি নাই, প্রত্যুত এ মঠে সংস্কৃত শাস্ত্রের বহুল চর্চা হইয়া থাকে। বঙ্গদেশে বেদশাস্ত্রের একেবারে অপ্রচার বলিলেই হয়। এই মঠের অনেকেই সংস্কৃতজ্ঞ এবং তাঁহাদের বেদের সংহিতাদি ভাগ সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করিবার একান্ত অভিলাষ। তাঁহাদিগের মত, যাহা করিতে হইবে বৈদিক ভাষায় সম্পূর্ণ করিব। অতএব, পাণিনিকৃত সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাকরণ আয়ত্ত না হইলে বৈদিক ভাষায় সম্পূর্ণ জ্ঞান হওয়া অসম্ভব, এই বিবেচনায় উক্ত ব্যাকরণের আবশ্যক। ‘লঘু’ অপেক্ষা আমাদের বাল্যাধীত ‘মুগ্ধবোধ’ অনেকাংশে উৎকৃষ্ট। যাহা হউক, মহাশয় অতি পণ্ডিত ব্যক্তি এবং এ বিষয়ে আমাদের সদুপদেষ্টা, আপনি বিবেচনা করিয়া যদি এ বিষয়ে ‘অষ্টাধ্যায়ী’ সর্বোৎকৃষ্ট হয়, তাহাই (যদি আপনার সুবিধা এবং ইচ্ছা হয়) দান করিয়া আমাদিগকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিবেন। এ মঠে অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি, মেধাবী এবং অধ্যবসায়শীল ব্যক্তির অভাব নাই। গুরুর কৃপায় তাঁহারা অল্পদিনেই ‘অষ্টাধ্যায়ী’ অভ্যাস করিয়া বেদশাস্ত্র বঙ্গদেশে পুনরুজ্জীবিত করিতে পারিবেন—ভরসা করি। মহাশয়কে আমার গুরুমহারাজের দুইখানি ফটোগ্রাফ এবং তাঁহার গ্রাম্য ভাষায় উপদেশের কিয়দংশ—কোন ব্যক্তি সঙ্কলিত করিয়া [যাহা] মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহা দুই খণ্ড প্রেরণ করিলাম। আশা করি গ্রহণ করিয়া আমাদিগকে আনন্দিত করিবেন। আমার শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে—ভরসা দুই-তিন মাসের মধ্যে মহাশয়ের চরণ দর্শন করিয়া সার্থক হইব। কিমধিকমিতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

**********
পত্র সংখ্যা- ৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা

বরাহনগর, কলিকাতা
২৮ অগষ্ট, ১৮৮৮

প্রণাম নিবেদনমিদং—
মহাশয়ের প্রেরিত ‘পাণিনি’ পুস্তক প্রাপ্ত হইয়াছি, আমাদিগের বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিবেন। আমি পুনরায় জ্বরে পড়িয়াছিলাম—তজ্জন্য শীঘ্র উত্তর দিতে পারি নাই। ক্ষমা করিবেন। শরীর অত্যন্ত অসুস্থ। মহাশয়ের শারীরিক এবং মানসিক কুশল মহামায়ীর১ নিকট প্রার্থনা করি। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
২৩ মাঘ
৪ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯

নমস্য মহাশয়,
কতকগুলি কারণবশতঃ অদ্য আমার মন অতি সঙ্কুচিত ও ক্ষুব্ধ হইয়াছিল, এমন সময়ে আপনার (আমাকে) অপার্থিব বারাণসীপুরীতে আবাহনপত্র আসিয়া উপস্থিত। ইহা আমি বিশ্বেশ্বরের বাণী বলিয়া গ্রহণ করিলাম। সম্প্রতি আমার গুরুদেবের জন্মভূমিদর্শনার্থ গমন করিতেছি, তথায় কয়েক দিবসমাত্র অবস্থিতি করিয়া ভবৎসমীপে উপস্থিত হইব। কাশীপুরী ও কাশীনাথদর্শনে যাহার মন বিগলিত না হয়, সে নিশ্চিত পাষাণে নির্মিত। আমার শরীর এক্ষণে অনেক সুস্থ। জ্ঞানানন্দকে আমার প্রণাম। যত শীঘ্র পারি মহাশয়ের সান্নিধ্যে উপস্থিত হইব। পরে বিশ্বেশ্বরের ইচ্ছা। কিমধিকমিতি। সাক্ষাতে সমুদয় জানিবেন ।

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ৬
[শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে (মাষ্টার মহাশয়) লিখিত]

আঁটপুর,২ হুগলী জেলা
২৬ মাঘ, ১২৯৫
(৭ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯

প্রিয় ম—,
মাষ্টার মহাশয়, আমি আপনাকে লক্ষ লক্ষ বার ধন্যবাদ দিতেছি। আপনি রামকৃষ্ণকে ঠিক ঠিক ধরিয়াছেন। হায়, অতি অল্পলোকেই তাঁহাকে বুঝিতে পারিয়াছে!

আপনার
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—যে উপদেশামৃত ভবিষ্যতে জগতে শান্তি বর্ষণ করিবে, কোন ব্যক্তিকে যখন তাহার ভিতর সম্পূর্ণ ডুবিয়া থাকিতে দেখি, তখন আমার হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতে থাকে এবং আমি যে আনন্দে একেবারে উন্মত্ত হইয়া যাই না কেন—তাহাই আশ্চর্য!
**********
পত্র সংখ্যা- ৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
১১ ফাল্গুন
(২১ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯)

মহাশয়,
৺কাশীধামে যাইবার সংকল্প ছিল এবং আমার গুরুদেবের জন্মভূমি পরিদর্শনানন্তর কাশীধামে পৌঁছিব—এইরূপ কল্পনা ছিল; কিন্তু আমার দুরদৃষ্টবশতঃ উক্ত গ্রামে যাইবার পথে অত্যন্ত জ্বর হইল এবং তৎপরে কলেরার ন্যায় ভেদবমি হইয়াছিল। তিন-চারি দিনের পর পুনরায় জ্বর হইয়াছে; এক্ষণে শরীর এ প্রকার দুর্বল যে, দুই কদম চলিবার সামর্থ্যও নাই। অতএব বাধ্য হইয়া এক্ষণে পূর্বোক্ত সংকল্প পরিত্যাগ করিতে হইল। ভগবানের কি ইচ্ছা জানি না, কিন্তু আমার শরীর এ পথের নিতান্ত অনুপযুক্ত। যাহা হউক, শরীর বিশেষ বড় কথা নহে। কিছুদিন এস্থানে থাকিয়া কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলেই মহাশয়ের চরণ দর্শন করিবার অভিলাষ আছে। বিশ্বেশ্বরের ইচ্ছা যাহা, তাহাই হইবে, আপনিও আশীর্বাদ করুন। জ্ঞানানন্দ ভায়াকে আমার প্রণাম, মহাশয়ও জানিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
২১ মার্চ, ১৮৮৯

পূজনীয় মহাশয়,
কয়েক দিবস হইল আপনার পত্র পাইয়াছি—কোন বিশেষ কারণবশতঃ উত্তর প্রদান করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। শরীর এক্ষণে অত্যন্ত অসুস্থ, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়, কিন্তু প্লীহাদি কোন উপসর্গ নাই—হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাইতেছি। অধুনা কাশী যাইবার সংকল্প একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে, পরে শরীর-গতিক দেখিয়া ঈশ্বর যাহা করিবেন, হইবে। জ্ঞানানন্দ ভায়ার সহিত যদি সাক্ষাৎ হয়, অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন—যেন তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া না থাকেন। আমার যাওয়া বড়ই অনিশ্চিত। আপনি আমার প্রণাম জানিবেন ও জ্ঞানানন্দকে দিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ৯
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা শরণম্
বরাহনগর
২৬ জুন, ১৮৮৯

পূজ্যপাদ মহাশয়,
বহুদিন আপনাকে নানা কারণে কোন পত্রাদি লিখিতে পারি নাই, তজ্জন্য ক্ষমা করিবেন। অধুনা গঙ্গাধরজীর সংবাদ পাইয়াছি এবং আমার কোন গুরুভ্রাতার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁহারা দুইজনে উত্তরাখণ্ডে রহিয়াছেন। আমাদের এ স্থান হইতে চারি জন উত্তরাখণ্ডে রহিয়াছেন, গঙ্গাধরকে লইয়া পাঁচ জন। শিবানন্দ নামক আমার একজন গুরুভ্রাতার সহিত ৺কেদারনাথের পথে শ্রীনগর নামক স্থানে গঙ্গাধরের সাক্ষাৎ হয়। গঙ্গাধর এই স্থানে দুইখানি পত্র লিখিয়াছেন। তিনি প্রথম বৎসর তিব্বত প্রবেশের অনুমতি পান নাই, পরের বৎসর পাইয়াছিলেন। লামারা তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসে। তিনি তিব্বতী ভাষা শিক্ষা করিয়াছেন। তিনি বলেন, তিব্বতের শতকরা ৯০ জন লামা, কিন্তু তাহারা এক্ষণে তান্ত্রিক মতের উপাসনাই অধিক করে। অত্যন্ত শীতল দেশ; আহারীয় অন্য কিছু নাই—কেবল শুষ্ক মাংস। গঙ্গাধর তাহাই খাইতে খাইতে গিয়াছিল! আমার শরীর মন্দ নাই, কিন্তু মনের অবস্থা অতি ভয়ঙ্কর!

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৪ জুলাই, ১৮৮৯

পূজ্যপাদ মহাশয়,
কল্য আপনার পত্রে সবিশেষ অবগত হইয়া পরম আনন্দিত হইলাম। আপনাকে পত্র লিখিতে—গঙ্গাধরকে অনুরোধ করিতে যে আপনি লিখিয়াছেন, তাহার কোন সম্ভাবনা দেখি না, কারণ তাঁহারা আমাদের পত্র দিতেছেন, কিন্তু তাঁহারা ২।৩ দিবস কোথাও রহিতেছেন না, অতএব আমাদের কোন পত্রাদি পাইতেছেন না। আমার পূর্ব অবস্থার কোন আত্মীয় সিমুলতলায় (বৈদ্যনাথের নিকট) একটি বাংলো (bungalow) ক্রয় করিয়াছেন। ঐ স্থানের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর বিধায় আমি সেস্থানে কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু গ্রীষ্মের আতিশয্যে অত্যন্ত উদরাময় হওয়ায় পলাইয়া আসিলাম।
৺কাশীধামে গমন করিয়া মহাশয়ের চরণ দর্শন করিয়া এবং সদালাপে অবস্থানপূর্বক আত্মাকে চরিতার্থ করিব—এই ইচ্ছা যে অন্তরে কত বলবতী, তাহা বাক্য বর্ণনা করিতে পারে না, কিন্তু সকলই তাঁহার হাত। কে জানে মহাশয়ের সহিত জন্মান্তরীণ কি হৃদয়ের যোগ, নহিলে এই কলিকাতায় বহু ধনী মানী লোক আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, তাহাদের সঙ্গ আমার সাতিশয় বিরক্তিকর বোধ হয়, আর মহাশয়ের সহিত এক দিবসের আলাপেই প্রাণ এবম্প্রকার মুগ্ধ হইয়াছে যে, আপনাকে হৃদয় পরমাত্মীয় এবং ধর্মবন্ধুভাবে গ্রহণ করিয়াছে। মহাশয় ভগবানের প্রিয় সেবক, এই একটি কারণ। আর একটি বোধ হয়—‘তচ্চেতসা স্মরতি নূনমবোধপূর্বং ভাবস্থিরাণি জননান্তর-সৌহৃদানি।’৩
ভূয়োদর্শন এবং সাধনের ফলস্বরূপ মহাশয়ের যে উপদেশ, তজ্জন্য আমি আপনার নিকট ঋণী রহিলাম। নানা প্রকার অভিনব মত মস্তিষ্কে ধারণ জন্য যে সময়ে সময়ে ভুগিতে হয়, ইহা অতি যথার্থ এবং অনেক সময়ে দেখিয়াছি।
কিন্তু এবার অন্যপ্রকার রোগ। ঈশ্বরের মঙ্গলহস্তে বিশ্বাস আমার যায় নাই এবং যাইবারও নহে—শাস্ত্রে বিশ্বাসও টলে নাই। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় গত ৫।৭ বৎসর আমার জীবন ক্রমাগত নানাপ্রকার বিঘ্নবাধার সহিত সংগ্রামে পরিপূর্ণ। আমি আদর্শ শাস্ত্র পাইয়াছি, আদর্শ মনুষ্য চক্ষে দেখিয়াছি, অথচ পূর্ণভাবে নিজে কিছু করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, ইহাই অত্যন্ত কষ্ট। বিশেষ, কলিকাতার নিকটে থাকিলে হইবারও কোন উপায় দেখি না। আমার মাতা এবং দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্ষ্ট আর্টস পড়িতেছে, আর একটি ছোট।
ইঁহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমন কি কখনও কখনও উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা—দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন—যে প্রকার মকদ্দমার দস্তুর।
কখনও কখনও কলিকাতার নিকট থাকিলে তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া রজোগুণের প্রাবল্যে অহঙ্কারের বিকার-স্বরূপ কার্যকরী বাসনার উদয় হয়, সেই সময়ে মনের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ বাধে, তাহাতেই লিখিয়াছিলাম, মনের অবস্থা বড়ই ভয়ঙ্কর। এবার তাঁহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া, তাঁহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।—‘আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ &c.’৪
আশীর্বাদ করুন যেন আমার হৃদয় মহা ঐশবলে বলীয়ান হয় এবং সকলপ্রকার মায়া আমা হইতে দূরপরাহত হইয়া হয়—For ‘we have taken up the cross, Thou hast laid it upon us, and grant us strength that we bear it unto death, Amen.’৫—Imitation of Christ.
আমি এক্ষণে কলিকাতায় আছি। আমার ঠিকানা—বলরাম বসুর বাটী, ৫৭ নং রামকান্ত বসুর ষ্ট্রীট, বাগবাজার, কলিকাতা।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পত্র সংখ্যা (১১-২০)

পত্র সংখ্যা (১-১০)

পত্র সংখ্যা- ১১
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
সিমলা, কলিকাতা
১৪ জুলাই, ১৮৮৯

পূজ্যপাদ মহাশয়,
মহাশয়ের পত্র পাইয়া পরম প্রীত হইলাম। এরূপস্থলে অনেকেই সংসারের দিকে টলিতে উপদেশ দেন। মহাশয় সত্যগ্রাহী এবং বজ্রসারসদৃশ হৃদয়বান্—আপনার উৎসাহবাক্যে পরম আশ্বাসিত হইলাম। আমার এ স্থানের গোলযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে ৺কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।
আপনি ২০৲ টাকার এক কেতা নোট পাঠাইয়াছিলেন। আপনি অতি মহৎ; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য—মহাশয়ের প্রথমোদ্দেশ্য পালনে আমার মাতা ভ্রাতাদির সাংসারিক অহঙ্কার প্রতিবন্ধক হইল; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অর্থাৎ আমার কাশী যাইবার জন্য ব্যবহার করিয়া চরিতার্থ হইব। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১২
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর, কলিকাতা
৭ অগষ্ট, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
প্রায় এক সপ্তাহের অধিক হইল আপনার পত্র পাইয়াছি, সেই সময়ে পুনরায় জ্বর হওয়ায় উত্তরদানে অসমর্থ ছিলাম, ক্ষমা করিবেন। মধ্যে মাস দেড়েক ভাল ছিলাম, কিন্তু পুনরায় ১০|১২ দিন হইল জ্বর হইয়াছিল, এক্ষণে ভাল আছি। গুটিকতক প্রশ্ন আছে, মহাশয়ের বিস্তৃত সংস্কৃতশাস্ত্রজ্ঞান—উত্তর দিয়া বাধিত করিবেন।—

১। সত্যকাম জাবালি এবং জনশ্রুতির কোন উপাখ্যান ছান্দোগ্য উপনিষদ্ সওয়ায়৬ বেদের অন্য কোন অংশে আছে কি না?

২। শঙ্করাচার্য বেদান্তভাষ্যে অধিকাংশ স্থলেই স্মৃতি উদ্ধৃত করিতে গেলেই মহাভারতের প্রমাণ প্রয়োগ করেন। কিন্তু বনপর্বে অজগরোপাখ্যানে এবং উমামহেশ্বর-সংবাদে, তথা ভীষ্মপর্বে, যে গুণগত জাতিত্ব অতি স্পষ্টই প্রমাণিত, তৎসম্বন্ধে তাঁহার কোন পুস্তকে কোন কথা বলিয়াছেন কি না?

৩। পুরুষসূক্তের জাতি পুরুষানুগত নহে—বেদের কোন্ কোন্ অংশে ইহাকে ধারাবাহিক পুরুষানুগত করা হইয়াছে?

৪। আচার্য, ‘শূদ্র যে বেদ পড়িবে না’—এ প্রকার কোন প্রমাণ বেদ হইতে দিতে পারেন নাই। কেবল ‘যজ্ঞেঽনবকঌপ্তঃ’ ইহাই উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন যে, যখন যজ্ঞে অধিকার নাই, তখন উপনিষদাদি পাঠেও অধিকার নাই। কিন্তু ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’—এস্থলে ঐ আচার্যই বলিতেছেন যে, অথ শব্দ ‘বেদাধ্যয়নাদনন্তরম্’—এ প্রকার অর্থ নহে, কারণ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ না পড়িলে যে উপনিষদ্ পড়া যায় না, ইহা অপ্রামাণ্য; এবং কর্মকাণ্ডের শ্রুতি এবং জ্ঞানকাণ্ডের শ্রুতিতে কোন পূর্বাপর ভাব নাই। অতএব যজ্ঞাত্মক বেদ না পড়িয়াই উপনিষদ‍্‍পাঠে ব্রহ্মজ্ঞান হইতে পারে। যদি যজ্ঞে ও জ্ঞানে পৌর্বাপর্য না থাকিল, তবে শূদ্রের বেলা কেন ‘ন্যায়পূর্বকম্’ ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা আচার্য আপনার বাক্যকে ব্যাহত করিতেছেন? কেন শূদ্র উপনিষদ্ পড়িবে না?

মহাশয়কে একখানি—কোন খ্রীষ্টিয়ান সন্ন্যাসীর লিখিত—’Imitation of Christ’ নামক পুস্তক পাঠাইলাম। পুস্তকখানি অতি আশ্চর্য। খ্রীষ্টিয়ানদিগের মধ্যেও এ প্রকার ত্যাগ বৈরাগ্য ও দাস্যভক্তি ছিল দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বোধ হয় আপনি এ পুস্তক পড়িয়া থাকিবেন, না পড়িয়া থাকেন তো পড়িয়া আমাকে চিরকৃতার্থ করিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
১৭ অগষ্ট, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের শেষ পত্রে—আপনাকে উক্ত অভিধান দেওয়ায় কিছু কুণ্ঠিত হইয়াছেন! কিন্তু তাহা আমার দোষ নহে, মহাশয়ের গুণের। পূর্বে এক পত্রে আপনাকে লিখিয়াছিলাম যে, মহাশয়ের গুণে আমি এত আকৃষ্ট যে, বোধ হয় আপনার সহিত জন্মান্তরীণ কোন সম্বন্ধ ছিল। আমি গৃহস্থও বুঝি না, সন্ন্যাসীও বুঝি না; যথার্থ সাধুতা এবং উদারতা এবং মহত্ত্ব যথায়, সেই স্থানেই আমার মস্তক চিরকালই অবনত হউক—শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। প্রার্থনা করি, আজিকালিকার মানভিখারী, পেটবৈরাগী এবং উভয়ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীশ্রমীদের মধ্যে লক্ষের মধ্যেও যেন আপনার ন্যায় মহাত্মা একজন হউন। আপনার গুণের কথা শুনিয়া আমার সকল ব্রাহ্মণজাতীয় গুরুভ্রাতাও আপনাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত জানাইতেছেন।
মহাশয় আমার প্রশ্ন-কয়েকটির যে উত্তর দিয়াছেন, তাহার মধ্যে একটি সম্বন্ধে আমার ভ্রম সংশোধিত হইল। মহাশয়ের নিকট তজ্জন্য আমি চিরঋণবদ্ধ রহিলাম। আর একটি প্রশ্ন ছিল যে, ভারতাদি পুরাণোক্ত গুণগত জাতি সম্বন্ধে আচার্য কোন মীমাংসাদি করিয়াছেন কি না? যদি করিয়া থাকেন, কোন্ পুস্তকে? এতদ্দেশীয় প্রাচীন মত যে বংশগত, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই, এবং স্পার্টানরা যে প্রকার হেলট্ [দের উপর ব্যবহার করিত] অথবা মার্কিনদেশে কাফ্রীদের উপর যে প্রকার ব্যবহার হইত, সময়ে সময়ে শূদ্রেরা যে তদপেক্ষাও নিগৃহীত হইত, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আর জাত্যাদি সম্বন্ধে আমার কোন পক্ষে পক্ষপাতিত্ব নাই। কারণ আমি জানি, উহা সামাজিক নিয়ম—গুণ এবং কর্ম-প্রসূত। যিনি নৈষ্কর্ম ও নিগুর্ণত্বকে প্রাপ্ত হইতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার জাত্যাদি ভাব মনে আনিলেও সমূহ ক্ষতি। এই সকল বিষয়ে গুরুকৃপায় আমার এক প্রকার বুদ্ধি আছে, কিন্তু মহাশয়ের মতামত জানিলে কোন স্থানে সেই সকলকে দৃঢ় এবং কোন স্থানে সংশোধিত করিয়া লইব। চাকে খোঁচা না মারিলে মধু পড়ে না—অতএব আপনাকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব; আমাকে বালক এবং অজ্ঞ জানিয়া যথাযথ উত্তর দিবেন, রুষ্ট হইবেন না।

১। বেদান্তসূত্রে যে মুক্তির কথা কহে, তাহা এবং অবধূত-গীতাদিতে যে নির্বাণ আছে, তাহা এক কি না?

২। ‘সৃষ্টিবর্জ’—সূত্রে এই ভাবের পুরো ভগবান্‌ কেহই হয় না, তবে নির্বাণ কি?

৩। চৈতন্যদেব পুরীতে সার্বভৌমকে বলিয়াছিলেন যে ব্যাসসূত্র আমি বুঝি, তাহা দ্বৈতবাদ; কিন্তু ভাষ্যকার অদ্বৈত করিতেছেন, তাহা বুঝি না—ইহা সত্য নাকি? প্রবাদ আছে যে, চৈতন্যদেবের সহিত প্রকাশানন্দ সরস্বতীর এ বিষয়ে অনেক বিচার হয়, তাহাতে চৈতন্যদেব জয়ী হন। চৈতন্যের কৃত এক ভাষ্য নাকি উক্ত প্রকাশানন্দের মঠে ছিল।

৪। আচার্যকে তন্ত্রে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলিয়াছে। ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ নামক বৌদ্ধদের (মহাযান) গ্রন্থের মতের সহিত আচার্য-প্রচারিত বেদান্তমতের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য আছে। ‘পঞ্চদশী’কারও বলিতেছেন যে, বৌদ্ধ [দের] শূন্য ও আমাদিগের ব্রহ্ম একই ব্যাপার—ইহার অর্থ কি?

৫। বেদান্তসূত্রে বেদের কোন প্রমাণ কেন দেওয়া হয় নাই? প্রথমেই বলা হইয়াছে, ঈশ্বরের প্রমাণ বেদ এবং বেদ প্রামাণ্য ‘পুরুষ-নিঃশ্বসিতম্’ বলিয়া; ইহা কি পাশ্চাত্য ন্যায়ে যাহাকে argument in a circle৭ বলে, সেই দোষদুষ্ট নহে?

৬। বেদান্ত বলিলেন—বিশ্বাস করিতে হইবে, তর্কে নিষ্পত্তি হয় না। তবে যেখানে ন্যায় অথবা সংখ্যাদির অণুমাত্র ছিদ্র পাইয়াছেন, তখনই তর্কজালে তাহাদিগকে সমাচ্ছন্ন করা হইয়াছে কেন? আর বিশ্বাসই বা করি কাকে? যে যার আপনার মতস্থাপনেই পাগল; এত বড় ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ’, তিনিই যদি ব্যাসের মতে অতি ভ্রান্ত, তখন ব্যাস যে আরও ভ্রান্ত নহেন, কে বলিল? কপিল কি বেদাদি বুঝিতেন না?

৭। ন্যায়-মতে ‘আপ্তোপদেশবাক্যঃ শব্দঃ’; ঋষিরা আপ্ত এবং সর্বজ্ঞ। তাঁহারা তবে সূর্যসিদ্ধান্তের দ্বারা সামান্য সামান্য জ্যোতিষিক তত্ত্বে অজ্ঞ বলিয়া আক্ষিপ্ত কেন হইতেছেন? যাঁহারা বলেন—পৃথিবী ত্রিকোণ, বাসুকি পৃথিবীর ধারয়িতা ইত্যাদি, তাঁহাদের বুদ্ধিকে ভবসাগরপারের একমাত্র আশ্রয় কি প্রকারে বলি?

৮। ঈশ্বর সৃষ্টিকার্যে যদি শুভাশুভ কর্মকে অপেক্ষা করেন, তবে তাঁহার উপাসনায় আমার লাভ কি? নরেশচন্দ্রের একটি সুন্দর গীত আছে—

‘কপালে যা আছে কালী, তাই যদি হবে, (মা)
জয় দুর্গা শ্রীদুর্গা বলে কেন ডাকা তবে॥’

৯। সত্য বটে, বহু বাক্য এক-আধটির দ্বারা নিহত হওয়া অন্যায্য। তাহা হইলে চিরপ্রচলিত মধুপর্কাদি প্রথা৮ ‘অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্’ ইত্যাদি৯ দুই-একটি বাক্যের দ্বারা কেন নিহত হইল? বেদ যদি নিত্য হয়, তবে ইহা দ্বাপরের, ইহা কলির ধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ এবং সাফল্য কি?

১০। যে ঈশ্বর বেদ-বক্তা, তিনিই বুদ্ধ হইয়া বেদ নিষেধ করিতেছেন। কোন্ কথা শুনা উচিত? পরের বিধি প্রবল, না, আগের বিধি প্রবল?

১১। তন্ত্র বলেন—কলিতে বেদমন্ত্র নিষ্ফল; মহেশ্বরেরই বা কোন্ কথা মানিব?

১২। বেদান্তসূত্রে ব্যাস বলেন যে, বাসুদেব সঙ্কর্ষণাদি চতুর্ব্যূহ উপাসনা ঠিক নহে—আবার সেই ব্যাসই ভাগবতাদিতে উক্ত উপাসনার মাহাত্ম্য বিস্তার করিতেছেন; ব্যাস কি পাগল?

আরও এই প্রকার অনেক সন্দেহ আছে, মহাশয়ের প্রসাদে ছিন্নদ্বৈধ হইব আশা করিয়া পরে সেগুলি লিখিব। এ সকল কথা সাক্ষাৎ না হইলে সমস্ত বলা যায় না এবং আশানুরূপ তৃপ্তিও হয় না। গুরুর কৃপায় শীঘ্রই ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইয়া সমস্ত নিবেদন করিবার বাসনা রহিল। ইতি
শুনিয়াছি, বিনা সাধনায় শুদ্ধ যুক্ত্যাদি-বলে এ সকল বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না, কিন্তু কতক পরিমাণে আশ্বস্ত হওয়া প্রথমেই বোধ হয় আবশ্যক। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
বাগবাজার, কলিকাতা
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের দুইখানি পত্র কয়েক দিবস হইল পাইয়াছি। মহাশয়ের অন্তরে জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সম্মিলন দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছি। আপনি যে তর্কযুক্তি পরিত্যাগ করিতে উপদেশ দেন, তাহা অতি যথার্থ বটে এবং প্রত্যেক জীবনেরই উদ্দেশ্য তাহাই—‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ’ ইত্যাদি ১০। তবে কি না আমার গুরুমহারাজ যে প্রকার বলিতেন যে, কলসী পুরিবার সময় ভকভক ধ্বনি করে, পূর্ণ হইলে নিস্তব্ধ হইয়া যায়, আমার পক্ষে সেইরূপ জানিবেন। বোধ হয়, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব—ঈশ্বর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
অনেকদিন আপনার কোন পত্রাদি পাই নাই; ভরসা করি, শারীরিক ও মানসিক কুশলে আছেন। সম্প্রতি আমার দুইটি গুরুভ্রাতা ৺কাশীধামে যাইতেছেন। একটির নাম রাখাল ও অপরটির নাম সুবোধ। প্রথমোক্ত মহাশয় আমার গুরুদেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং সর্বদা তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। যদি সুবিধা হয়, ইঁহারা যে কয়েকদিন উক্ত ধামে অবস্থান করেন, কোন সত্রে বলিয়া দিয়া অনুগৃহীত করিবেন। আমার সকল সংবাদ ইঁহাদের নিকট পাইবেন। আমার অসংখ্য প্রণামের সহিত।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—গঙ্গাধর এক্ষণে কৈলাসাভিমুখে যাইতেছেন। পথে তিব্বতীরা তাঁহাকে ফিরিঙ্গীর চর মনে করিয়া কাটিতে আসে, পরে কোন কোন লামা অনুগ্রহ করিয়া ছাড়িয়া দেয়—এ সংবাদ তিব্বতযাত্রী কোন ব্যবসায়ী হইতে পাইয়াছি। লাসা না দেখিলে আমাদের গঙ্গাধরের রক্ত শীতল হইবে না। লাভের মধ্যে শারীরিক কষ্টসহিষ্ণুতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে—একরাত্রি তিনি অনাচ্ছাদনে বরফের উপর শয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতেও বিশেষ কষ্ট হয় নাই ।

ইতি
নরেন্দ্র
**********
পত্র সংখ্যা- ১৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর, কলিকাতা
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইয়া সবিশেষ অবগত হইলাম—পরে রাখালের পত্রে তাঁহার আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাহাও জানিলাম। আপনার রচিতpamphlet (পুস্তিকা) পাইয়াছি। Theory of Conservation of Energy (শক্তির নিত্যতা—এই মতবাদ) আবিষ্কারের পর হইতে ইওরোপে এক প্রকার Scientific (বৈজ্ঞানিক) অদ্বৈতবাদ প্রচারিত হইতেছে, কিন্তু তাহা পরিণামবাদ। আপনি ইহার সহিত শঙ্করের বিবর্তবাদের যে পার্থক্য দেখাইয়াছেন, তাহা অতি উত্তম। জার্মান Transcendentalist-দের১১ উপর স্পেন্সারের যে বিদ্রূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা বুঝিলাম না; তিনি স্বয়ং উহাদের প্রসাদভোজী। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী গাফ্ (Gough) সম্যক‍্‍রূপে হেগেল বুঝেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যাহা হউক, আপনার উত্তর অতি pointed (তীক্ষ্ণ) এবং thrashing (সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষযুক্তি-খণ্ডনকারী)।

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৭
[শ্রীযুক্ত বলরাম বসুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
বৈদ্যনাথ
২৪ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

নমস্কারপূর্বকম্—
বৈদ্যনাথে পূর্ণবাবুর বাসায় কয়েকদিন আছি। শীত বড় নাই, শরীরও বড় ভাল নহে—হজম হয় না, বোধ হয় জলে লৌহাধিক্যের জন্য। কিছুই ভাল লাগিল না—স্থান, কাল ও সঙ্গ। কাল কাশী চলিলাম। দেওঘরে অচ্যুতানন্দ ‘—’র বাসায় ছিল। সে আমাদের সংবাদ পাইয়াই বিশেষ আগ্রহ করিয়া রাখিবার জন্য বড় জিদ করে। শেষে আর একদিন দেখা হইয়াছিল—ছাড়ে নাই। সে বড় কর্মী, কিন্তু সঙ্গে ৭।৮ টা স্ত্রীলোক বুড়ী, ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ই অধিক—রুচি ভাল, শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গের মহিমা! তাহার কর্মচারীরাও আমাদের অত্যন্ত ভক্তি করে। তাহারা কেহ কেহ উহার উপর বড় চটা, তাহারা তাহার নানাস্থানের দুষ্কর্মের কথা কহিতে লাগিল।

প্রসঙ্গক্রমে আমি ‘—’র কথা পাড়িলাম। তোমাদের তাঁহার সম্বন্ধে অনেক ভ্রম বা সন্দেহ আছে, তজ্জন্যই বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া লিখিতেছি। তাঁহাকে এখানকার বৃদ্ধ কর্মচারীরাও বড় মান্য ও ভক্তি করে। তিনি অতি বালিকা-অবস্থায় ‘—’র কাছে আসিয়াছিলেন, বরাবর স্ত্রীর ন্যায় ছিলেন। এমন কি, ‘—’র মন্ত্রগুরু ভগবানদাস বাবাজীও জানিতেন যে, তিনি উহার স্ত্রী। তাহারা বলে, উঁহার মা তাঁহাকে ‘—’র কাছে দিয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, তাঁহার এক পুত্র হয় ও মরিয়া যায় এবং সেই সময়ে ‘—’কোথা হইতে একটা ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ বামনী আনিয়া ঘরে ঢোকায়, এই সকল কারণে তিনি তাহাকে ফেলিয়া পলান। যাহা হউক, সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তাঁহার চরিত্রে কখনও কোন দোষ ছিল না, তিনি অতি সতী বরাবর ছিলেন এবং কখনও স্ত্রী-স্বামী ভিন্ন ‘—’র সহিত অন্য কোন ব্যবহার বা অন্য কাহারও প্রতি কু-ভাব ছিল না। এত অল্প বয়সে আসিয়াছিলেন যে, সে সময়ে অন্য পুরুষ-সংসর্গ সম্ভবে না। তিনি ‘—’র নিকট হইতে পলাইয়া যাইবার পর তাহাকে লেখেন যে, আমি কখনও তোমাকে স্বামী ভিন্ন অন্য ব্যবহার করি নাই, কিন্তু বেশ্যাসক্ত ব্যক্তির সহিত আমার বাস করা অসম্ভব। ইহার পুরাতন কর্মচারীরাও ইহাকে শয়তান ও তাঁহাকে দেবী বলিয়া বিশ্বাস করে ও বলে, ‘তিনি যাবার পর হইতেই ইহার মতিচ্ছন্ন হইয়াছে।’

এ সকল লিখিবার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহার বাল্যকালসম্বন্ধী গল্পে আমি পূর্বে বিশ্বাস করিতাম না। এ সকল ভাব, সমাজে যাহাকে বিবাহ বলে না, তাহার মধ্যে এত পবিত্রতা—আমি romance (কাল্পনিক) মনে করিতাম, কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানিয়াছি, সকল ঠিক। তিনি অতি পবিত্র, আবাল্য পবিত্র, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ঐ সকল সন্দেহের জন্য আমরা সকলেই তাঁহার নিকট অপরাধী। আমি তাঁহাকে অসংখ্য প্রণাম করিতেছি ও অপরাধের জন্য ক্ষমা চাহিতেছি। তিনি মিথ্যাবাদিনী নহেন। তাঁহার ধর্মে ঐকান্তিকী আস্থাও চিরকাল ছিল, এ কথাও শুনিলাম। এক্ষণে ইহাই শিখিলাম, ঐ প্রকার তেজ মিথ্যাবাদিনী ব্যাভিচারিণীতে সম্ভবে না।

আপনার পীড়া এখনও আরাম হইতেছে না। এখানে খুব পয়সা খরচ না করিতে পারিলে রোগীর বিশেষ সুবিধা বুঝি না। যাহা হয় বিবেচনা করিবেন। সকল দ্রব্যই অন্যত্র হইতে আনাইয়া লইতে হইবে।

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বৈদ্যনাথ
২৬ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
বহু দিবস চেষ্টার পর বোধ হয় এতদিনে ভবৎসমীপে উপস্থিত হইতে সমর্থ হইলাম। দুই-এক দিনেই ৺কাশীধামে ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইব।

এ স্থানে কলিকাতার একজন বাবুর বাসায় কয়েক দিবস আছি, কিন্তু কাশীর জন্য মন অত্যন্ত ব্যাকুল।

ইচ্ছা আছে, তথায় কিছুদিন থাকিব এবং আমার মন্দ ভাগ্যে বিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা কি করেন, দেখিব। এবার ‘শরীরং বা পাতয়ামি, মন্ত্রং বা সাধয়ামি’ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি—কাশীনাথ সহায় হউন।

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ১৯
[বলরামবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
এলাহাবাদ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
শ্রীচরণেষু,
গুপ্ত১২ আসিবার সময় একটা শ্লিপ ফেলিয়া আসিয়াছিল এবং পরদিবসে একখানি যোগেনের পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইয়া তৎক্ষণাৎ এলাহাবাদে যাত্রা করি। পরদিবস পৌঁছিয়া দেখিলাম, যোগেন ১৩ সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়াছে। পানিবসন্ত (দুই-একটা ‘ইচ্ছা’ ও ছিল) হইয়াছিল। ডাক্তারবাবু অতি সাধু ব্যক্তি এবং তাঁহাদের একটি সম্প্রদায় আছে। ইঁহারা অতি ভক্ত ও সাধুসেবাপরায়ণ। ইঁহাদের বড় জিদ—আমি এ স্থানে মাঘ মাস থাকি, আমি কিন্তু কাশী চলিলাম। গোলাপ-মা, যোগীন-মা এখানে কল্পবাস করিবেন, নিরঞ্জনও১৪ বোধ হয় থাকিবে, যোগেন কি করিবে জানি না। আপনি কেমন আছেন?

ঈশ্বরের নিকট সপরিবার আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করি। তুলসীরাম, চুনীবাবু প্রভৃতিকে আমার নমস্কারাদি দিবেন। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ২০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
৺প্রয়াগধাম
১৭ পৌষ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
দুই-এক দিনের মধ্যে কাশী যাইতেছি বলিয়া আপনাকে এক পত্র লিখিয়াছিলাম, কিন্তু বিধাতার নির্বন্ধ কে খণ্ডাইবে? যোগেন্দ্র নামক আমার একটি গুরুভ্রাতা চিত্রকূট ওঙ্কারনাথাদি দর্শন করিয়া এস্থানে আসিয়া বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়াছেন সংবাদ পাই, তাহাতে তাঁহার সেবা করিবার জন্য এস্থানে আসিয়া উপস্থিত হই। আমার গুরুভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছেন। এখানের কয়েকটি বাঙালী বাবু অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও অনুরাগী, তাঁহারা আমাকে অত্যন্ত যত্ন করিতেছেন এবং তাঁহাদিগের বিশেষ আগ্রহ যে, আমি এই স্থানে মাঘ মাসে ‘কল্পবাস’ করি। আমার মন কিন্তু ‘কাশী কাশী’ করিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছে এবং আপনাকে দেখিবার জন্য মন অতি চঞ্চল। দুই-চারি দিবসের মধ্যে ইঁহাদের নির্বন্ধাতিশয় এড়াইয়া যাহাতে বারাণসীপুরপতির পবিত্র রাজ্যে উপস্থিত হইতে পারি—তাহার বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। অচ্যুতানন্দ সরস্বতী নামক আমার কোন গুরুভ্রাতা সন্ন্যাসী যদি আপনার নিকটে আমার তত্ত্ব লইতে যান, বলিবেন যে শীঘ্রই আমি কাশী যাইতেছি। তিনি অতি সজ্জন এবং পণ্ডিত লোক, তাঁহাকে বাধ্য হইয়া বাঁকীপুরে ফেলিয়া আসিয়াছি। রাখাল ও সুবোধ কি এখনও কাশীতে আছেন? এ বৎসর কুম্ভের মেলা হরিদ্বারে হইবে কি না, ইহার তথ্য লিখিয়া অনুগৃহীত করিবেন। কিমধিকমিতি।

অনেক স্থানে অনেক জ্ঞানী, ভক্ত, সাধু ও পণ্ডিত দেখিলাম, অনেকেই অত্যন্ত যত্ন করেন, কিন্তু ‘ভিন্নরুচির্হি লোকঃ’, আপনার সঙ্গে কেমন প্রাণের টান আছে—অত ভাল আর কোথাও লাগে না। দেখি কাশীনাথ কি করেন।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

ঠিকানা—ডাক্তার গোবিন্দচন্দ্র বসুর বাটী, চক, এলাহাবাদ।

**********

পত্র সংখ্যা (২১-৩০)


পত্র সংখ্যা (২১-৩০)

পত্র সংখ্যা- ২১
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণো জয়তি
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০

নমস্কার নিবেদনঞ্চ—
মহাশয়ের পত্রে আপনার পীড়ার সমাচার জ্ঞাত হইয়া বিশেষ দুঃখিত হইলাম। বৈদ্যনাথ change (বায়ুপরিবর্তন) সম্বন্ধে আপনাকে যে পত্র লিখি তাহার সার কথা এই যে, আপনার ন্যায় দুর্বল অথচ অত্যন্ত নরম-শরীর লোকের অধিক অর্থব্যয় না করিলে উক্ত স্থানে চলা অসম্ভব। যদি পরিবর্তনই আপনার পক্ষে বিধি হয় এবং যদি কেবল সস্তা খুঁজিতে এবং গয়ংগচ্ছ করিতে করিতে এতদিন বিলম্ব করিয়া থাকেন, তাহা হইলে দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই। …

বৈদ্যনাথ—হাওয়া সম্বন্ধে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট, কিন্তু জল ভাল নহে, পেট বড় খারাপ করে, আমার প্রত্যহ অম্বল হইত। ইতঃপূর্বে আপনাকে এক পত্র লিখি—তাহা কি আপনি পাইয়াছেন, না bearing (বিনা মাশুলে প্রেরিত) দেখিয়া the devil take it করিয়াছেন?১৫ আমি বলি change (বায়পরিবর্তন) করিতে হয় তো শুভস্য শীঘ্রং। রাগ করিবেন না—আপনার একটি স্বভাব এই যে ক্রমাগত ’বামুনের গরু’ খুঁজিতে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ জগতে সকল সময়ে তাহা পাওয়া যায় না—আত্মানং সততং রক্ষেৎ। Lord have mercy (ঈশ্বর করুণা করুন) ঠিক বটে, কিন্তু He helps him who helps himself (যে উদ্যমী, ভগবান্ তাহারই সহায় হন)। আপনি খালি টাকা বাঁচাতে যদি চান, Lord (ভগবান্) কি বাবার ঘর হইতে টাকা আনিয়া আপনাকে change (বায়ুপরিবর্তন) করাইবেন? যদি এতই Lord-এর উপর নির্ভর করেন, ডাক্তার ডাকিবেন না। … যদি আপনার suit না করে (সহ্য না হয়) কাশী যাইবেন—আমিও এতদিন যাইতাম, এখানকার বাবুরা ছাড়িতে চাহে না, দেখি কি হয়।…

কিন্তু পুনর্বার বলি, change-এ (বায়ুপরিবর্তনে) যদি যাওয়া হয়, কৃপণতার জন্য ইতস্ততঃ করিবেন না। তাহা হইলে তাহার নাম আত্মঘাত। আত্মঘাতীর গতি ভগবান্‌ও করিতে পারেন না। তুলসী বাবু প্রভৃতি সকলকে আমার নমস্কারাদি দিবেন। ইতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********
পত্র সংখ্যা- ২২
[শ্রীযজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্যকে লিখিত]
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০

প্রিয় ফকির,
একটি কথা তোমাকে বলি, উহা সর্বদা স্মরণ রাখিবে, আমার সহিত তোমাদের আর দেখা না হইতে পারে—নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও, হৃদয় যেন সম্পূর্ণ শুদ্ধ থাকে। সম্পূর্ণ নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও—প্রাণের ভয় পর্যন্ত রাখিও না। ধর্মের মতামত লইয়া মাথা বকাইও না। কাপুরুষেরাই পাপ করিয়া থাকে, বীর কখনও পাপ করে না—মনে পর্যন্ত পাপচিন্তা আসিতে দেয় না। সকলকেই ভালবাসিবার চেষ্টা করিবে। নিজে মানুষ হও, আর রাম প্রভৃতি যাহার সাক্ষাৎ তোমার তত্ত্বাবধানে আছে, তাহাদিগকেও সাহসী, নীতিপরায়ণ ও সহানুভূতিসম্পন্ন করিবার চেষ্টা করিবে। হে বৎসগণ, তোমাদের জন্য নীতিপরায়ণতা ও সাহস ব্যতীত আর কোন ধর্ম নাই, ইহা ব্যতীত ধর্মের আর কোন মতামত তোমাদের জন্য নহে। যেন কাপুরুষতা, পাপ, অসদাচরণ বা দুর্বলতা একদম না থাকে, বাকী আপনা-আপনি আসিবে। রামকে কখনও থিয়েটার বা কোনরূপ চিত্তদৌর্বল্যকারক আমোদ-প্রমোদে লইয়া যাইও না বা যাইতে দিও না।

তোমার
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ২৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
প্রিয় রাম, কৃষ্ণময়ী ও ইন্দু, বৎসগণ, মনে রাখিও কাপুরুষ ও দুর্বলগণই পাপাচরণ করে ও মিথ্যা কথা বলে। সাহসী ও সবলচিত্ত ব্যক্তিগণ সদাই নীতিপরায়ণ। নীতিপরায়ণ, সাহসী ও সহানুভূতিসম্পন্ন হইবার চেষ্টা কর। ইতি

তোমাদের
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ২৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি

শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাটী
গোরাবাজার, গাজীপুর
শুক্রবার, ২৪ জানুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
অদ্য তিন দিন যাবৎ গাজীপুরে পৌঁছিয়াছি। এস্থানে আমার বাল্যসখা শ্রীযুক্ত বাবু সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাসাতে আছি; স্থানটি অতি মনোরম। অদূরে গঙ্গা আছেন, কিন্তু স্নানের বড় কষ্ট—পথ নাই, এবং বালির চড়া ভাঙ্গিতে বড় কষ্ট হয়। আমার বন্ধুর পিতা শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়—যে মহানুভবের কথা আমি আপনাকে বলিয়াছিলাম—এ স্থানে আছেন। অদ্য ইনি ৺কাশীধামে যাইতেছেন, কাশী হইয়া কলিকাতা যাইবেন। আমার বড় ইচ্ছা ছিল, ইঁহার সঙ্গে পুনর্বার কাশী যাই। কিন্তু যে জন্য আসিয়াছি—অর্থাৎ বাবাজীকে১৬ দেখা—তাহা এখনও হয় নাই। অতএব দুই-চারি দিন বিলম্ব হইবে। এস্থানের সকলই ভাল, বাবুরা অতি ভদ্র, কিন্তু বড় westernized (পাশ্চাত্যভাবাপন্ন); আর দুঃখের বিষয় যে, আমি western idea (পাশ্চাত্যভাব) মাত্রেরই উপর খড়্গহস্ত। কেবল আমার বন্ধুর ও-সকল idea (ভাব) বড়ই কম। কি কাপুড়ে সভ্যতাই ফিরিঙ্গী আনিয়াছে! কি materialistic (জড়ভাবের) ধাঁধাই লাগাইয়াছে! বিশ্বনাথ এই সকল দুর্বলহৃদয়কে রক্ষা করুন। পরে বাবাজীকে দেখিয়া বিশেষ বৃত্তান্ত লিখিব। ইতি

দাস
বিবেকানন্দ

পুঃ—ভগবান্ শুকের জন্মভূমিতে আজি বৈরাগ্যকে লোকে পাগলামি ও পাপ মনে করে! অহো ভাগ্য!
**********

পত্র সংখ্যা- ২৫
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
শ্রীরামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
৩০ জানুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আমি এক্ষণে গাজীপুরে সতীশবাবুর নিকট রহিয়াছি। যে কয়েকটি স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তন্মধ্যে এইটি স্বাস্থ্যকর। বৈদ্যনাথের জল বড় খারাপ, হজম হয় না। এলাহাবাদ অত্যন্ত ঘিঞ্জি—কাশীতে যে কয়েকদিন ছিলাম দিনরাত জ্বর হইয়া থাকিত—এত ম্যালেরিয়া! গাজীপুরের বিশেষতঃ আমি যে স্থানে থাকি, জলবায়ু অতি স্বাস্থ্যকর। পওহারী বাবার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি। চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর, ইংরেজী বাঙলার মতন, ভিতরে বাগান আছে, বড় বড় ঘর, chimney &c. (চিমনি ইত্যাদি)। কাহাকেও ঢুকিতে দেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারদেশে আসিয়া ভিতর থেকে কথা কন মাত্র। একদিন যাইয়া বসিয়া বসিয়া হিম খাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। রবিবারে কাশী যাইব। ইতোমধ্যে বাবাজীর সহিত দেখা হইল তো হইল—নহিলে এই পর্যন্ত। প্রমদাবাবুর বাগান সম্বন্ধে কাশী হইতে স্থির করিয়া লিখিব। কালী ভট্টাচার্য যদি একান্ত চাহে তো আমি কাশীতে রবিবার যাইলে যেন আসে—না আসিলেই ভাল। কাশীতে দুই-চারিদিন থাকিয়া শীঘ্রই হৃষীকেশ চলিতেছি—প্রমদাবাবুর সঙ্গে যাইলেও যাইতে পারে। আপনারা এবং তুলসীরাম সকলে আমার যথাযোগ্য নমস্কারাদি জানিবেন ও ফকির, রাম, কৃষ্ণময়ী প্রভৃতিকে আমার আশীর্বাদ।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

আমার মতে আপনি কিছুদিন গাজীপুরে আসিয়া থাকিলে বড় ভাল, এখানে সতীশ বাঙলা ঠিক করিয়া দিতে পারিবে ও গগনচন্দ্র রায় নামক একটি বাবু—আফিম আফিসের Head (বড়বাবু), তিনি যৎপরোনাস্তি ভদ্র, পরোপকারী ও social (মিশুক)। ইঁহারা সব ঠিক করিয়া দিবেন। বাড়ী ভাড়া ১৫৲।২০৲ টাকা; চাউল মহার্ঘ, দুগ্ধ ১৬।২০ সের, আর সকল অত্যন্ত সস্তা। আর ইঁহাদের তত্ত্বাবধানে কোন ক্লেশ হইবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু কিছু expensive (বেশী খরচ)। ৪০৲।৫০৲ টাকার উপর পড়িবে। কাশী বড় damned malarious (অত্যন্ত ম্যালেরিয়াপূর্ণ)।

প্রমদাবাবুর বাগানে কখনও থাকি নাই—তিনি কাছ-ছাড়া করিতে চান না। বাগান অতি সুন্দর বটে, খুব furnished (সাজান গোজান) এবং বড় ও ফাঁকা। এবার যাইয়া থাকিয়া দেখিয়া মহাশয়কে লিখিব। ইতি

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ২৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
৩১ জানুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
বাবাজীর সহিত দেখা হওয়া বড় মুশকিল, তিনি বাড়ীর বাহিরে আসেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারে আসিয়া ভিতর হইতে কথা কন। অতি উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যান-সমন্বিত এবং চিমনীদ্বয়-শোভিত তাঁহার বাটী দেখিয়া আসিয়াছি, ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছা নাই। লোকে বলে, ভিতরে গুফা অর্থাৎ তয়খানা গোছের ঘর আছে, তিনি তন্মধ্যে থাকেন; কি করেন তিনিই জানেন, কেহ কখনও দেখে নাই। একদিন যাইয়া অনেক হিম খাইয়া বসিয়া বসিয়া চলিয়া আসিয়াছি, আরও চেষ্টা দেখিব। রবিবার ৺কাশীধামে যাত্রা করিব—এখানকার বাবুরা ছাড়িতেছেন না, নহিলে বাবাজী দেখিবার সখ আমার গুটাইয়াছে। অদ্যই চলিয়া যাইতাম; যাহা হউক, রবিবার যাইতেছি। আপনার হৃষীকেশ যাইবার কি হইল?

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—গুণের মধ্যে স্থানটি বড় স্বাস্থ্যকর।

**********

পত্র সংখ্যা- ২৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ওঁ বিশ্বেশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্রও পাইয়াছি এবং বহু ভাগ্যফলে বাবাজীর সাক্ষাৎ হইয়াছে। ইনি অতি মহাপুরুষ—বিচিত্র ব্যাপার, এবং এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার অদ্ভুত নিদর্শন। আমি ইঁহার শরণাগত হইয়াছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়াছেন, সকলের ভাগ্যে ঘটে না। বাবাজীর ইচ্ছা—কয়েক দিবস এই স্থানে থাকি, তিনি উপকার করিবেন। অতএব এই মহাপুরুষের আজ্ঞানুসারে দিন কয়েক এ স্থানে থাকিব। ইহাতে আপনিও আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। পত্রে লিখিলাম না, কথা অতি বিচিত্র, সাক্ষাতে জানিবেন। ইঁহাদের লীলা না দেখিলে শাস্ত্রে বিশ্বাস পুরা হয় না।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—এ পত্রের বিষয় গোপন রাখিবেন। ইতি

**********
পত্র সংখ্যা- ২৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
বিশ্বেশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
বএইমাত্র আপনার পত্র পাইয়া সাতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইলাম। বাবাজী আচারী বৈষ্ণব; যোগ, ভক্তি এবং বিনয়ের মূর্তি বলিলেই হয়। তাঁহার কুটীর চতুর্দিকে প্রাচীর দেওয়া, তাহার মধ্যে কয়েকটি দরজা আছে। এই প্রাচীরের মধ্যে এক অতি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ আছে, তন্মধ্যে ইনি সমাধিস্থ হইয়া পড়িয়া থাকেন; যখন উপরে আসেন, তখনই লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কহেন। কি খান, কেহই জানে না, এইজন্যই ‘পওহারী বাবা’ বলে। মধ্যে একবার ৫ বৎসর—একবারও গর্ত হইতে উঠেন নাই, লোকে জানিয়াছিল যে, শরীর ছাড়িয়াছেন; কিন্তু আবার উঠিয়াছেন। এবার কিন্তু দেখা দেন না, তবে দ্বারের আড়াল হইতে কথা কহেন। এমন মিষ্ট কথা আমি কখনও শুনি নাই। কোন direct (সোজাসুজি) প্রশ্নের উত্তর দেন না, বলেন ‘দাস ক্যা জানে?’ তবে কথা কহিতে কহিতে আগুন বাহির হয়। আমি খুব জিদাজিদি করাতে বলিলেন যে, ‘আপনি কিছুদিন এ স্থানে থাকিয়া আমাকে কৃতার্থ করুন।’ এ প্রকার কখনও কহেন না; ইহাতেই বুঝিলাম, আমাকে আশ্বাস দিলেন এবং যখনই পীড়াপীড়ি করি, তখনই বলেন, ‘কিছুদিন থাকুন।’ এই আশায় আছি। ইনি অতি পণ্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু কিছুই প্রকাশ পায় না, আবার কর্মকাণ্ডও করেন—পূর্ণিমা হইতে সংক্রান্তি পর্যন্ত হোম হয়। অতএব ইহার মধ্যে গর্তে যাইবেন না নিশ্চিত। অনুমতি কি লইব, direct (স্পষ্ট) উত্তর দিবেন না। ‘দাসকে ভাগ্য’ ইত্যাদি ঢের বলিবেন। আপনার ইচ্ছা থাকে, পত্রপাঠ চলিয়া আসুন। ইঁহার শরীর যাইলে বড় আপসোস থাকিবে—দুদিনে দেখা অর্থাৎ আড়াল হইতে কথা কহিয়া যাইতে পারিবেন। আমার বন্ধু সতীশবাবু অতি সমাদরে আপনাকে গ্রহণ করিবেন। আপনি পত্রপাঠ চলিয়া আসুন, ইতোমধ্যে আমি বাবাজীকে বলিব।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—ইঁহার সঙ্গ না হইলেও এ প্রকার মহাপুরুষের জন্য কোন কষ্টই বৃথা হইবে না নিশ্চিত। অলমতিবিস্তরেণ।
**********

পত্র সংখ্যা- ২৯
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
১৩ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার শারীরিক অসুস্থতা শুনিয়া চিন্তিত রহিলাম। আমারও কোমরে একপ্রকার বেদনা হইয়া রহিয়াছে, সম্প্রতি অত্যন্ত বাড়িয়াছে এবং যাতনা দিতেছে। বাবাজীকে দুই দিন দেখিতে যাইতে পারি নাই, তজ্জন্য তাঁহার নিকট হইতে আমার খবর লইতে এক ব্যক্তি আসিয়াছিল—অতএব আজ যাইব। আপনার অসংখ্য প্রণাম দিব। আগুন বাহির হয়, অর্থাৎ অতি অদ্ভুত গূঢ় ভক্তির কথা এবং নির্ভরের কথা বাহির হয়—এমন অদ্ভুত তিতিক্ষা এবং বিনয় কখনও দেখি নাই। কোন মাল যদি পাই, আপনার তাহাতে ভাগ আছে নিশ্চিত জানিবেন। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ৩০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
গতকল্য আপনাকে যে পত্র লিখিয়াছি, তাহাতে শরৎ-ভায়ার পত্রখানি পাঠাইতে—বলিতে ভুলিয়াছি বোধ হয়; অনুগ্রহ করিয়া পাঠাইয়া দিবেন। গঙ্গাধর ভায়ার একখানি পত্র পাইয়াছি। তিনি এক্ষণে কাশ্মীর, রামবাগ সমাধি, শ্রীনগরে আছেন। আমি lumbagoতে (কোমরের বাতে) বড় ভুগিতেছি। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—রাখাল ও সুবোধ ওঁকার, গির্নার, আবু, বোম্বে, দ্বারকা দেখিয়া এক্ষণে বৃন্দাবনে আছে।

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা (৩১-৪০)

পত্র সংখ্যা (৩১-৪০)


পত্র সংখ্যা- ৩১
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

C/o সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
গোরাবাজার, গাজীপুর
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার আপসোস-পত্র পাইয়াছি। আমি শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ করিতেছি না, বাবাজীর অনুরোধ এড়াইবার যো নাই।

সাধুদের সেবা করিয়া কি হইল বলিয়া আপসোস করিয়াছেন। কথা ঠিক বটে, অথচ নহে বটে। Ideal bliss-এর (আদর্শ আনন্দ) দিকে চাহিতে গেলে এ কথা সত্য বটে, কিন্তু যে স্থান ছাড়িয়া আসিয়াছেন সে দিকে তাকাইলেই দেখিতে পাইবেন—ছিলেন গরু, হইয়াছেন মানুষ, হইবেন দেবতা এবং ঈশ্বর। পরন্তু ঐ প্রকার ‘কি হইল’, ‘কি হইল’ অতি ভাল—উন্নতির আশাস্বরূপ, নহিলে কেহ উঠিতে পারে না। ‘পাগড়ি বেঁধেই ভগবান্’ যে দেখে, তাহার ঐখানেই খতম। আপনার সর্বদাই যে মনে পড়ে ‘কি হইল’, আপনি ধন্য নিশ্চিত জানিবেন—আপনার মার নাই।

গিরিশবাবুর সহিত মাতাঠাকুরাণীকে আনিবার জন্য আপনার কি মতান্তর হইয়াছে, গিরিশবাবু লিখিয়াছেন—সে বিষয়ে আমার বলিবার কিছুই নাই। তবে আপনি অতি বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি, কার্যসিদ্ধির প্রধান উপায় যে ধৈর্য—এ আপনি ঠিক বুঝেন, সে বিষয়ে চপলমতি আমরা আপনার নিকট বহু শিক্ষার উপযুক্ত, সন্দেহ নাই। কাশীতে আমি—যোগীন-মাতার ঘাড় না ভাঙা যায় এবিষয়ে একদিন বাদানুবাদচ্ছলে কহিয়াছিলাম। তৎসওয়ায় আর আমি কোন খবর জানি না এবং জানিতে ইচ্ছাও রাখি না। মাতাঠাকুরাণীর যে প্রকার ইচ্ছা হইবে, সেই প্রকারই করিবেন। আমি কোন্ নরাধম, তাঁহার সম্বন্ধে কোন বিষয়ে কথা কহি? যোগীন-মাতাকে যে বারণ করিয়াছিলাম, তাহা যদি দোষের হইয়া থাকে, তজ্জন্য লক্ষ লক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আপনি সদ্বিবেচক—আপনাকে কি বলিব? কান দুটো, কিন্তু মুখ একটা; বিশেষতঃ আপনার মুখ বড় কড়া এবং ফস ফস করিয়া large promises (বেশী বেশী অঙ্গীকার-বাক্য) বাহির হয় না বলিয়া আপনার উপর অনেক সময় বিরক্ত হই, কিন্তু বিচার করিয়া দেখি যে, আপনিই সদ্বিবেচনার কার্য করেন।—’Slow but sure’ (ধীর, কিন্তু নিশ্চিত)।

What is lost in power, is gained in speed (শক্তি যে পরিমাণ ব্যয়িত হয়, গতিবৃদ্ধিতে তাহা পোষাইয়া যায়), যাহাই হউক, সংসারে কথা লইয়াই কাজ। কথার ছাল ছাড়াইয়া (তাতে আপনার কৃপণতার আবরণ—এত ছাড়াইয়া) অন্তর্দৃষ্টি সকলের হয় না এবং বহু সঙ্গ না করিলে কোন ব্যক্তিকে বুঝা যায় না। ইহা মনে করিয়া এবং শ্রীশ্রীগুরুদেব এবং মাতাঠাকুরাণীকে স্মরণ করিয়া—নিরঞ্জন যদি আপনাকে কিছু কটুকাটব্য বলিয়া থাকে ক্ষমা করিবেন। ‘ধর্ম—দলে নহে, হুজুগে নহে’, ৺গুরুদেবের এই সকল উপদেশ ভুলিয়া যান কেন? আপনার যা করিবার সাধ্য করুন, কিন্তু তাহার কি ব্যবহার হইল, কি না হইল, ভাল মন্দ বিচার করার অধিকার আমাদের বোধ হয় নাই। … গিরিশবাবু যে আঘাত পাইয়াছেন, তাহাতে এ সময়ে মাতাঠাকুরাণীর সেবায় তাঁহার বিশেষ শান্তিলাভ হইবে। তিনি অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাঁহার সম্বন্ধে আমি কি বিচার করিব! আর ৺গুরুদেব আপনার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন। আপনার বাটী ভিন্ন কোথাও অন্নাদি গ্রহণ করিতেন না এবং শুনিয়াছি, মাতাঠাকুরাণীও আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন—এই সকল মনে করিয়া আমাদের ন্যায় চপলমতি বালকদিগের (নিজ পুত্রের কৃত অপরাধের ন্যায়) সকল অপরাধ সহ্য ও ক্ষমা করিবেন—অধিক কি লিখিব।

জন্মোৎসব কবে হইবে পত্রপাঠ লিখিবেন। আমার কোমরে একটা বেদনায় বড় অসুস্থ করিয়াছে। আর দিনকয়েক বাদে এ স্থানে বড় শোভা হইবে—ক্রোশ-ক্রোশব্যাপী গোলাপফুলের মাঠে ফুল ফুটিবে। সেই সময়ে সতীশ কতকগুলো তাজাফুল ও ডাল মহোৎসব উপলক্ষে পাঠাইবে বলিতেছে। যোগেন কোথায়, কেমন আছে? বাবুরাম কেমন আছে? সারদা কি এখন তেমনি চঞ্চলচিত্ত? গুপ্ত কি করিতেছে? তারক-দাদা, গোপাল-দাদা প্রভৃতিকে আমার প্রণাম। মাষ্টারের ভাইপো কতদূর পড়িল? রাম ও ফকির ও কৃষ্ণময়ীকে আমার আশীর্বাদাদি দিবেন। তাহারা পড়াশুনা কেমন করিতেছে? ভগবান্ করুন, আপনার ছেলে যেন ‘মানুষ’ হয়—না-মরদ না হয়। তুলসীবাবুকে আমার লক্ষ লক্ষ সাদর সম্ভাষণ দিবেন এবং এবারে একলা সাণ্ডেলও নিজের খাটনি খাটিতে পারিবে কিনা? চুনীবাবু কেমন আছেন?

বলরামবাবু, মাতাঠাকুরাণী যদি আসিয়া থাকেন, আমার কোটি কোটি প্রণাম দিবেন ও আশীর্বাদ করিতে বলিবেন—যেন আমার অটল অধ্যবসায় হয়, কিম্বা এ শরীরে যদি তাহা অসম্ভব, যেন শীঘ্রই ইহার পতন হয়।

(পরের পত্রখানি) গুপ্তকে দেখাইবেন।

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ৩২
[স্বামী সদানন্দকে লিখিত]
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

কল্যাণবরেষু,
বোধ করি শারীরিক কুশলে আছ। আপনার জপতপ সাধন ভজন করিবে ও আপনাকে দাসানুদাস জানিয়া সকলের সেবা করিবে। তুমি যাঁহাদের কাছে আছ, আমিও তাঁহাদের দাসানুদাস ও চরণরেণুর যোগ্য নহি—এই জানিয়া তাঁহাদের সেবা ও ভক্তি করিবে। ইঁহারা গালি দিলে বা খুন করিলেও ক্রুদ্ধ হইও না। কোন স্ত্রীসঙ্গে যাইও না—hardy (কষ্টসহিষ্ণু) হইবার অল্প অল্প চেষ্টা করিবে এবং সইয়ে সইয়ে ক্রমে ভিক্ষা দ্বারা শরীর ধারণ করিবার চেষ্টা করিবে। যে কেহ রামকৃষ্ণের দোহাই দেয়, সেই তোমার গুরু জানিবে। কর্তাত্ব সকলেই পারে—দাস হওয়া বড় শক্ত। বিশেষতঃ তুমি শশীর কথা শুনিবে। গুরুনিষ্ঠা, অটল ধৈর্য ও অধ্যবসায় ব্যতিরিক্ত কিছুই হইবে না—নিশ্চিত, নিশ্চিত জানিবে। Strict morality (কঠোর নীতিপরায়ণতা) চাহি—একটুকু এদিক ওদিক হইলে সর্বনাশ। ইতি

নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
গঙ্গাধর ভায়াকে আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে নিষেধ করিয়া ও কোন স্থানে বসিয়া যাইতে পরামর্শ দিয়া এবং তিব্বতে কি কি সাধু দেখিয়াছেন এবং তাঁহাদের আচার-ব্যবহার কি প্রকার, সবিশেষ লিখিতে এক পত্র লিখিয়াছিলাম। তদুত্তরে তিনি যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহা অত্র পত্রের সহিত আপনার নিকট পাঠাইতেছি। কালী (অভেদানন্দ) ভায়ার হৃষীকেশে পুনঃপুনঃ জ্বর হইতেছে, তাঁহাকে এ স্থান হইতে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি; উত্তরে যদি আমার যাওয়ার আবশ্যক তিনি বিবেচনা করেন, এ স্থান হইতে একেবারেই হৃষীকেশে যাইতে বাধ্য হইব, নতুবা দুই-এক দিনের মধ্যেই ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। মহাশয় হয়তো এই মায়ার প্রপঞ্চ দেখিয়া হাসিবেন—কথাও তাই বটে। তবে কি না লোহার শিকল ও সোনার শিকল—সোনার শিকলের অনেক উপকার আছে, তাহা [সেই উপকার] হইয়া গেলে আপনা-আপনি খসিয়া যাইবে। আমার গুরুদেবের পুত্রগণ আমার অতি সেবার পাত্র—এই স্থানেই একটু duty (কর্তব্য)-বোধ আছে। সম্ভবতঃ কালীভায়াকে এলাহাবাদে অথবা যে স্থানে সুবিধা হয়, পাঠাইয়া দিব। আপনার চরণে আমার শত শত অপরাধ রহিল, পুত্রস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ (আমি আপনার পুত্র, শরণাগত, আমায় শাসন করুন, শিক্ষা দিন)। কিমধিকমিতি

দাস
নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৪
[স্বামী অখণ্ডানন্দ বা ‘গঙ্গাধর’কে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

গাজীপুর
ফেব্রুআরী, ১৮৯০

প্রাণাধিকেষু,
তোমার পত্র পাইয়া অতি প্রীত হইলাম। তিব্বত সম্বন্ধে যে কথা লিখিয়াছ, তাহা অতি আশাজনক, আমি সে স্থানে যাইবার একবার চেষ্টা করিব, সংস্কৃতে তিব্বতকে ‘উত্তরকুরুবর্ষ’ কহে—উহা ম্লেচ্ছভূমি নহে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চ ভূমি—এজন্য শীত অত্যন্ত, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সহিয়া যাইতে পারে। তিব্বতী লোকদিগের আচার-ব্যবহার তুমি তো কিছুই লিখ নাই; যদি এত আতিথেয়, তবে কেন তোমাকে যাইতে দিল না? সবিশেষ লিখিবে—সকল কথা খুলিয়া একখান বৃহৎ পত্রে। তুমি আসিতে পারিবে না জানিয়া দুঃখিত হইলাম। তোমাকে দেখিবার বড় ইচ্ছা ছিল। তোমাকে সমধিক ভালবাসি বলিয়া বোধ হয়। যাহাই হউক, এ মায়াও আমি কাটাইবার চেষ্টা করিব।

তিব্বতীদের যে তন্ত্রাচারের কথা কহিয়াছ, তাহা বৌদ্ধধর্মের শেষ দশায় ভারতবর্ষেই হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস যে, আমাদিগের যে সকল তন্ত্র প্রচলিত আছে, বৌদ্ধেরাই তাহার আদিম স্রষ্টা। ঐ সকল তন্ত্র আমাদিগের বামাচারবাদ হইতে আরও ভয়ঙ্কর (উহাতে ব্যভিচার অতি মাত্রায় প্রশ্রয় পাইয়াছিল), এবং ঐ প্রকার immorality (চরিত্রহীনতা) দ্বারা যখন (বৌদ্ধগণ) নির্বীর্য হইল, তখনই [তাহারা] কুমারিল ভট্ট দ্বারা দূরীকৃত হইয়াছিল। যে প্রকার সন্ন্যাসীরা শঙ্করকে ও বাউলরা মহাপ্রভুকে secret (গোপনে) স্ত্রীসম্ভোগী, সুরাপায়ী ও নানাপ্রকার জঘন্য আচরণকারী বলে, সেই প্রকার modern (আধুনিক) তান্ত্রিক বৌদ্ধেরা বুদ্ধদেবকে ঘোর বামাচারী বলে এবং ‘প্রজ্ঞাপারমিতো’ক্ত তত্ত্বগাথা প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর বাক্যকে কুৎসিত ব্যাখ্যা করে; ফল এই হইয়াছে যে, এক্ষণে বৌদ্ধদের দুই সম্প্রদায়; বর্মা ও সিংহলের লোক প্রায় তন্ত্র মানে না ও সেই সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুর দেবদেবীও দূর করিয়াছে, এবং উত্তরাঞ্চলের বৌদ্ধেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ মানে, তাঁহাকেও ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন দিয়াছে। ফল কথা এই, উত্তরের লোকেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ ইত্যাদি মানে, তাহা ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’দিতে নাই, কিন্তু দেবদেবী অনেক মানা আছে। আর দক্ষিণীরা জোর করিয়া শাস্ত্র লঙ্ঘন করিয়া দেবদেবী বিসর্জন করিয়াছে। যে everything for others (‘যাহা কিছু সব পরের জন্য’—এই মত) তিব্বতে বিস্তৃত দেখিতেছ, ঐ phase of Buddhism (বৌদ্ধর্মের ঐ ভাব) আজকাল ইওরোপকে বড় strike করিয়াছে (ইওরোপের বড় মনে লাগিয়াছে)। যাহা হউক, ঐ phase (ভাব) সম্বন্ধে আমার বলিবার অনেক আছে, এ পত্রে তাহা হইবার নহে। যে ধর্ম উপনিষদে জাতিবিশেষে বদ্ধ হইয়াছিল, বুদ্ধদেব তাহারই দ্বার ভাঙিয়া সরল কথায় চলিত ভাষায় খুব ছড়াইয়াছিলেন। নির্বাণে তাঁহার মহত্ত্ব বিশেষ কি? তাঁহার মহত্ত্ব in this unrivalled sympathy (তাঁহার অতুলনীয় সহানুভূতিতে)। তাঁহার ধর্মে যে সকল উচ্চ অঙ্গের সমাধি প্রভৃতির গুরুত্ব, তাহা প্রায় সমস্তই বেদে আছে; নাই তাঁহার intellect (বুদ্ধি) এবং heart (হৃদয়), যাহা জগতে আর হইল না।

বেদের যে কর্মবাদ, তাহা jew (য়াহুদী) প্রভৃতি সকল ধর্মের কর্মবাদ, অর্থাৎ যজ্ঞ ইত্যাদি বাহ্যোপকরণ দ্বারা অন্তর শুদ্ধি করা—এ পৃথিবীতে বুদ্ধদেব the first man (প্রথম ব্যক্তি), যিনি ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়েন। কিন্তু ভাব ঢঙ সব পুরাতনের মত রহিল, সেই তাঁহার অন্তঃকর্মবাদ—সেই তাঁহার বেদের পরিবর্তে সূত্রে বিশ্বাস করিতে হুকুম। সেই জাতিও ছিল, তবে গুণগত হইল (বুদ্ধের সময় জাতিভেদ যায় নাই), সেই যাহারা তাঁহার ধর্ম মানে না, তাহাদিগকে ‘পাষণ্ড’ বলা। ‘পাষণ্ড’টা বৌদ্ধদের বড় পুরানো বোল, তবে কখনও বেচারীরা তলওয়ার চালায় নাই, এবং বড় toleration (উদারভাব) ছিল। তর্কের দ্বারা বেদ উড়িল, কিন্তু তোমার ধর্মের প্রমাণ?—বিশ্বাস কর!!—যেমন সকল ধর্মের আছে, তাহাই। তবে সেই কালের জন্য বড় আবশ্যক ছিল এবং সেই জন্যই তিনি অবতার হন। তাঁহার মায়াবাদ কপিলের মত। কিন্তু শঙ্করের how far more grand and rational (কত মহত্তর এবং অধিকতর যুক্তিপূর্ণ)! বুদ্ধ ও কপিল কেবল বলেন—জগতে দুঃখ দুঃখ, পালাও পালাও। সুখ কি একেবারেই নাই? যেমন ব্রাহ্মরা বলেন, সব সুখ—এও সেই প্রকার কথা। দুঃখ, তা কি করিব? কেহ যদি বলে যে সহিতে সহিতে অভ্যাস হইলে দুঃখকেই সুখ বোধ হইবে? শঙ্কর এ দিক্‌ দিয়ে যান না—তিনি বলেন, ‘সন্নাপি অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি’—আছে অথচ নেই, ভিন্ন অথচ অভিন্ন এই যে জগৎ, এর তথ্য আমি জানিব—দুঃখ আছে কি কী আছে; জুজুর ভয়ে আমি পালাই না। আমি জানিব, জানিতে গেলে যে অনন্ত দুঃখ তা তো প্রাণভরে গ্রহণ করিতেছি; আমি কি পশু যে ইন্দ্রিয়জনিত সুখদুঃখ-জরামরণ-ভয় দেখাও? আমি জানিব—জানিবার জন্য জান দিব। এ জগতে জানিবার কিছুই নাই, অতএব যদি এই relative-এর (মায়িক জগতের) পার কিছু থাকে—যাকে শ্রীবুদ্ধ ‘প্রজ্ঞাপারম্’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন—যদি থাকে, তাহাই চাই। তাহাতে দুঃখ আসে বা সুখ আসে I do not care (আমি গ্রাহ্য করি না)। কি উচ্চভাব! কি মহান্ ভাব! উপনিষদের উপর বুদ্ধের ধর্ম উঠেছে, তার উপর শঙ্করবাদ। কেবল শঙ্কর বুদ্ধের আশ্চর্য heart (হৃদয়) অণুমাত্র পান নাই; কেবল dry intellect (শুষ্ক জ্ঞানবিচার)—তন্ত্রের ভয়ে, mob-এর (ইতরলোকের) ভয়ে ফোড়া সারাতে গিয়ে হাতসুদ্ধ কেটে ফেললেন, এ সকল সম্বন্ধে গেলে পুঁথি লিখতে হয়; আমার তত বিদ্যা ও আবশ্যক—দুইয়েরই অভাব।

বুদ্ধদেব আমার ইষ্ট, আমার ঈশ্বর। তাঁহার ঈশ্বরবাদ নাই—তিনি নিজে ঈশ্বর, আমি খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু ‘ইতি’ করিবার শক্তি কাহারও নাই। ঈশ্বরেরও আপনাকে limited (সীমাবদ্ধ) করিবার শক্তি নাই। তুমি যে ‘সূত্তনিপাত’ হইতে গণ্ডারসূত্ত তর্জমা লিখিয়াছ, তাহা অতি উত্তম। ঐ গ্রন্থে ঐ প্রকার আর একটি ধনীর সূত্ত আছে, তাহাতেও প্রায় ঐ ভাব। ‘ধম্মপদ’-মতেও ঐ প্রকার অনেক কথা আছে। কিন্তু সেও শেষে যখন ‘জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ’১৭—যাহার শরীরের উপর অণুমাত্র শারীর বোধ নাই, তিনি মদমত্ত হস্তীর ন্যায় ইতস্ততঃ বিচরণ করিবেন। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র প্রাণী এক জায়গায় বসিয়া সাধন করিয়া সিদ্ধ হইলে তখন ঐ প্রকার আচরণ করিবে—সে দূর—বড় দূর।

চিন্তাশূন্যমদৈন্যভৈক্ষ্যমশনং পানং সরিদ্বারিষু
স্বাতন্ত্র্যেণ নিরঙ্কুশা স্থিতিরভীর্নিদ্রা শ্মশানে বনে।
বস্ত্রং ক্ষালনশোষণাদিরহিতং দিগ্বাস্তু শয্যা মহী
সঞ্চারো নিগমান্তবীথিষু বিদাং ক্রীড়া পরে ব্রহ্মণি॥
বিমানমালম্ব্য শরীরমেতদ্
ভুনক্ত্যশেষান্ বিষয়ানুপস্থিতান্।
পরেচ্ছয়া বালবদাত্মবেত্তা
যোঽব্যক্তলিঙ্গোঽননুষক্তবাহ্যঃ॥
দিগম্বরো বাপি চ সাম্বরো বা
ত্বগম্বরো বাপি চিদম্বরস্থঃ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবদ্বা
পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্॥১৮

ব্রহ্মজ্ঞের ভোজন, চেষ্টা বিনা উপস্থিত হয়—যেথায় জল, তাহাই পান। আপন ইচ্ছায় ইতস্ততঃ তিনি পরিভ্রমণ করিতেছেন—তিনি ভয়শূন্য, কখনও বনে, কখনও শ্মশানে নিদ্রা যাইতেছেন; যেখানে বেদ শেষ হইয়াছে, সেই বেদান্তের পথে সঞ্চরণ করিতেছেন। আকাশের ন্যায় তাঁহার শরীর, বালকের ন্যায় পরের ইচ্ছাতে পরিচালিত; তিনি কখনও উলঙ্গ, কখনও উত্তমবস্ত্রধারী, কখনও জ্ঞানমাত্রই আচ্ছাদন, কখনও বালকবৎ, কখনও উন্মত্তবৎ, কখনও পিশাচবৎ ব্যবহার করিতেছেন।

গুরুচরণে প্রার্থানা করি যে তোমার তাহাই হউক এবং তুমি গণ্ডারবৎ ভ্রমণ কর। ইতি

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৫ 
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
Lumbago (কোমরের বাতে) বড় ভোগাইতেছে, নহিলে ইতিপূর্বেই যাইবার চেষ্টা দেখিতাম। এস্থানে আর মন তিষ্ঠিতেছে না। তিন দিন বাবাজীর স্থান হইতে আসিয়াছি, কিন্তু তিনি দয়া করিয়া প্রায় প্রত্যহই আমার খবর লয়েন। কোমর একটু সারিলেই বাবাজীর নিকট বিদায় লইয়া যাইতেছি। আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
মার্চ, ১৮৯০

প্রাণাধিকেষু,
কল্য তোমার পত্র পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। এখানে পওহারীজী নামক যে অদ্ভুত যোগী ও ভক্ত আছেন, এক্ষণে তাঁহারই কাছে রহিয়াছি। ইনি ঘরের বাহির হন না—দ্বারের আড়াল হইতে কথাবার্তা কহেন। ঘরের মধ্যে এক গর্ত আছে, তন্মধ্যে বাস করেন। শুনিতে পাই, ইনি মাস মাস সমাধিস্থ হইয়া থাকেন। ইঁহার তিতিক্ষা বড়ই অদ্ভুত। আমাদের বাঙলা ভক্তির দেশ ও জ্ঞানের দেশ, যোগের বার্তা একেবারে নাই বলিলেই হয়। যাহা কিছু আছে, তাহা কেবল বদখত দমটানা ইত্যাদি হঠযোগ—তা তো gymnastics (কসরত)। এইজন্য এই অদ্ভুত রাজযোগীর নিকট রহিয়াছি—ইনি কতক আশাও দিয়াছেন। এখানে একটি বাবুর একটি ছোট্ট বাগানে একটি সুন্দর বাংলা-ঘর আছে; ঐ ঘরে থাকিব এবং উক্ত বাগান বাবাজীর কুটীরের অতি নিকট। বাবাজীর একজন দাদা ঐখানে সাধুদের সৎকারের জন্য থাকে, সেই স্থানেই ভিক্ষা করিব। অতএব এ রঙ্গ কতদূর গড়ায়, দেখিবার জন্য এক্ষণে পর্বতারোহণ-সংকল্প ত্যাগ করিলাম। এবং কোমরে দুমাস ধরিয়া একটা বেদনা—বাত (lumbago)—হইয়াছে, তাহাতেও পাহাড়ে উঠা এক্ষণে অসম্ভব। অতএব বাবাজী কি দেন, পড়িয়া পড়িয়া দেখা যাউক।

আমার motto (মূলমন্ত্র) এই যে, যেখানে যাহা কিছু উত্তম পাই, তাহাই শিক্ষা করিব। ইহাতে বরাহনগরের অনেকে মনে করে যে, গুরুভক্তির লাঘব হইবে। আমি ঐ কথা পাগল এবং গোঁড়ার কথা বলিয়া মনে করি। কারণ, সকল গুরুই এক এবং জগদ‍্গুরুর অংশ ও আভাসস্বরূপ।

তুমি যদি গাজীপুরে আইস, গোরাবাজারের সতীশবাবু অথবা গগনবাবুর নিকট আসিলেই আমার সন্ধান পাইবে। অথবা পওহারী বাবা এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি যে, ইঁহার নামমাত্রেই সকলে বলিবে, এবং তাঁহার আশ্রমে যাইয়া পরমহংসজীর খোঁজ করিলেই সকলে বলিয়া দিবে। মোগলসরাই ছাড়াইয়া দিলদারনগর ষ্টেশনে নামিয়া Branch Railway (শাখা রেল) একটু আছে; তাহাতে তারিঘাট—গাজীপুরের আড়পারে নামিয়া গঙ্গা পার হইয়া আসিতে হয়।

এক্ষণে আমি গাজীপুরে কিছুদিন রহিলাম; দেখি বাবাজী কি করেন। তুমি যদি আইস, দুইজনে উক্ত কুটীরে কিছুদিন থাকিয়া পরে পাহাড়ে বা যেথায় হয়, যাওয়া যাইবে। আমি গাজীপুরে আছি, একথা বরাহনগরে কাহাকেও লিখিও না। আমার আশীর্বাদ জানিবে।

সতত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী
নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৩ মার্চ, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র এইমাত্র পাইলাম। আপনি জানেন না—কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই, কত চেষ্টা করি যে, খালি আপনার ভাবনা ভাবি। কিন্তু বারংবার পরের ভাবনা ভাবিয়া ফেলি। এবার বড় কঠোর হইয়া নিজের চেষ্টার জন্য বাহির হইয়াছিলাম—এলাহাবাদে এক ভ্রাতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া অমনি ছুটিতে হইল। আবার এই হৃষীকেশের খবর—মন ছুটিয়াছে। শরৎকে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি, আজিও উত্তর আইসে নাই—এমন স্থান, টেলিগ্রাম আসিতেও এত দেরী! কোমরের বেদনা কিছুতেই ছাড়িতে চায় না, বড় যন্ত্রণা হইতেছে। পওহারীজীর সঙ্গে আর দেখা করিতে কয়েক দিন যাইতে পারি নাই, কিন্তু তাঁহার বড় দয়া, প্রত্যহ লোক পাঠাইয়া খবর নেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি ‘উল্টা সমঝ‍্‍লি রাম!’—কোথায় আমি তাঁহার দ্বারে ভিখারী, তিনি আমার কাছে শিখিতে চাহেন! বোধ হয়—ইনি এখনও পূর্ণ হয়েন নাই, কর্ম এবং ব্রত এবং আচার অত্যন্ত, এবং বড় গুপ্তভাব। সমুদ্র পূর্ণ হইলে কখনও বেলাবদ্ধ থাকিতে পারে না, নিশ্চিত। অতএব অনর্থক ইঁহাকে উদ্বেজিত করা ঠিক নহে স্থির করিয়াছি; এবং বিদায় লইয়া শীঘ্রই প্রস্থান করিব। কি করি, বিধাতা নরম করিয়া যে কাল করিয়াছেন! বাবাজী ছাড়েন না, আবার গগনবাবু (ইঁহাকে আপনি বোধ হয় জানেন, অতি ধার্মিক, সাধু এবং সহৃদয় ব্যক্তি) ছাড়েন না। টেলিগ্রামে যদ্যপি আমার যাইবার আবশ্যক হয়, যাইব; যদ্যপি না হয়, দুই-চারি দিনে কাশীধামে ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। আপনাকে ছাড়িতেছি না—হৃষীকেশে লইয়া যাইবই, কোন ওজর আপত্তি চলিবে না। শৌচের কথা কি বলিতেছেন? পাহাড়ে জলের অভাব—স্থানের অভাব? তীর্থ এবং সন্ন্যাসী—কলিকালের? টাকা খরচ করিলে সত্রওয়ালারা ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া ঘর ছাড়িয়া দেয়, স্থানের কা কথা!! কোন গোল নাই, এতদিনে গরম আরম্ভ হইয়াছে, তবে কাশীর গরম হইবে না—সে তো ভালই। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা চিরকাল, তাহাতে নিদ্রা উত্তমরূপ হইবারই কথা।

আপনি অত ভয় পান কেন? আমি guarantee (দায়ী), আপনি নিরাপদে ঘরে ফিরিবেন এবং কোন কষ্ট হইবে না। ব্রিটিশ রাজ্যে কষ্ট ফকিরের, গৃহস্থের কোন কষ্ট নাই, ইহা আমার experience (অভিজ্ঞতা)।

সাধ করে বলি—আপনার সঙ্গে পূর্বের সম্বন্ধ? এক চিঠিতে আমার সকল resolution (সংকল্প) ভেসে গেল, আবার সব ফেলে গুটি গুটি কাশী চলিলাম। ইতি

গঙ্গাধর ভায়াকে ফের এক চিঠি লিখিয়াছি, এবার তাঁহাকে মঠে যাইতে বলিয়াছি। যদি যান, অবশ্যই কাশী হইয়া যাইবেন ও আপনার সহিত দেখা হইবে। আজকাল কাশীর স্বাস্থ্য কেমন? এ স্থানে থাকিয়া আমার ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে সকল (উপসর্গ) সারিয়াছে, কেবল কোমরের বেদনায় অস্থির, দিন রাত কনকন করে এবং জ্বালাতন করিতেছে—কেমন করিয়া বা পাহাড়ে উঠিব, ভাবিতেছি। বাবাজীর তিতিক্ষা অদ্ভুত, তাই কিছু ভিক্ষা করিতেছি, কিন্তু উপুড় হস্তের নামটি নাই, খালি গ্রহণ! খালি গ্রহণ! অতএব আমিও প্রস্থান।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—আর কোন মিঞার কাছে যাইব না—

‘আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে,
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
পরম ধন এই পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে,
এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাচদুয়ারে।’

এখন সিদ্ধান্ত এই যে—রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy (প্রগাঢ় সহানুভূতি) বদ্ধ-জীবনের জন্য—এ জগতে আর নাই। হয়, তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ ‘লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে, নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ, এবং তাঁহার উপাসনাই পাতঞ্জলোক্ত ‘মহাপুরুষ-প্রণিধানাদ্বা।’১৯

তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনও আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই—আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন—এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনও বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, ইহা কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে। বিপদে, প্রলোভনে ‘ভগবান্ রক্ষা কর’ বলিয়া কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই—কিন্তু এই অদ্ভুত মহাপুরুষ বা অবতার বা যাই হউন, নিজ অন্তর্যামিত্বগুণে আমার সকল বেদনা জানিয়া নিজে ডাকিয়া জোর করিয়া সকল অপহৃত করিয়াছেন। যদি আত্মা অবিনাশী হয়—যদি এখনও তিনি থাকেন, আমি বারংবার প্রার্থনা করি—হে অপারদয়ানিধে, হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান্, কৃপা করিয়া আমার এই নরশ্রেষ্ঠ বন্ধুবরের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর। আপনার সকল মঙ্গল—এ জগতে কেবল যাঁহাকে অহেতুকদয়াসিন্ধু দেখিয়াছি—তিনিই করুন। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

দাস নরেন্দ্র

পুনঃ—পত্রপাঠ উত্তর দিবেন। নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৮ মার্চ, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইলাম, অতএব আমিও প্রয়াগ যাইতেছি। আপনি প্রয়াগে কোথায় থাকিবেন, অনুগ্রহ করিয়া লিখিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্র

পুঃ—দুই-এক দিনের মধ্যে অভেদানন্দ যদ্যপি আইসেন, তাঁহাকে কলিকাতায় রওনা করিয়া দিলে অত্যন্ত অনুগৃহীত হইব।

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৩৯
নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
১১ মার্চ, ১৮৯০

বলরামবাবু,
Receipt (রসিদ) পাইবামাত্র লোক পাঠাইয়া Fairlie Place (ফেয়ার্লি প্লেস) রেলওয়ে গুদাম হইতে গোলাপ ফুল আনাইয়া শশীকে পাঠাইয়া দিবেন। আনাইতে বা পাঠাইতে বিলম্ব না হয়।

বাবুরাম Allahabad (এলাহাবাদ) যাইতেছে শীঘ্র—আমি আর এক জায়গায় চলিলাম।

নরেন্দ্র

P.S. দেরী হলে সব খারাপ হইয়া যাইবে—নিশ্চিত জানিবেন।

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৪০
[বলরামবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
১৫ মার্চ, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র কল্য পাইয়াছি। সুরেশবাবুর পীড়া অত্যন্ত কঠিন শুনিয়া অতি দুঃখিত হইলাম। অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই হইবে। আপনারও পীড়া হইয়াছে, দুঃখের বিষয়। ‘অহং’-বুদ্ধি যতদিন থাকে, ততদিন চেষ্টার ত্রুটি হইলে তাহাকে আলস্য এবং দোষ এবং অপরাধ বলা যায়। যাঁহার উক্ত বুদ্ধি নাই, তাঁহার সম্বন্ধে তিতিক্ষাই ভাল। জীবাত্মার বাসভূমি এই শরীর কর্মের সাধনস্বরূপ—ইহাকে যিনি নরককুণ্ড করেন, তিনি অপরাধী এবং যিনি অযত্ন করেন, তিনিও দোষী। যেমন সামনে আসিবে, খুঁত খুঁত কিছু মাত্র না করিয়া তেমনই করিয়া যাউন।

‘নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্।
কালমেব প্রতীক্ষেত নিদেশং ভূতকো যথা॥’

যেটুকু সাধ্য সেটুকু করা, মরণও ইচ্ছা না করিয়া এবং জীবনও ইচ্ছা না করিয়া—ভৃত্যের ন্যায় আজ্ঞা প্রতীক্ষা করিয়া থাকাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

কাশীতে অত্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা হইতেছে—প্রমদাবাবু প্রয়োগে গিয়াছেন। বাবুরাম হঠাৎ এ স্থানে আসিয়াছে, তাহার জ্বর হইয়াছে—এমন অবস্থায় বাহির হওয়া ভাল হয় নাই। কালীকে২০ ১০৲ টাকা পাঠানো গিয়াছে—সে বোধ হয় গাজীপুর হইয়া কলিকাতাভিমুখে যাইবে। আমি কল্য এস্থান হইতে চলিলাম। কালী আসিয়া আপনাদের পত্র লিখিলে যাহা হয় করিবেন। আমি লম্বা। আর পত্র লিখিবেন না, কারণ আমি এস্থান হইতে চলিলাম। বাবুরাম ভাল হইয়া যাহা ইচ্ছা করিবেন।

ফুল—বোধ হয় রিসিট (রসিদ) প্রাপ্তিমাত্রই আনাইয়া লইয়াছেন। মাতাঠাকুরাণীকে আমার অসংখ্য প্রণাম।

আপনারা আশীর্বাদ করুন যেন আমার সমদৃষ্টি হয়—সহজাত বন্ধন ছাড়াইয়া পাতানো বাঁধনে আবার যেন না ফাঁসি। যদি কেহ মঙ্গলকর্তা থাকেন এবং যদি তাঁহার সাধ্য এবং সুবিধা হয়, আপনাদের পরম মঙ্গল হউক—ইহাই আমার দিবারাত্র প্রার্থনা। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা (৪১-৫০)

পত্র সংখ্যা (৪১-৫০)

পত্র সংখ্যা- ৪১

গাজীপুর
১৫ মার্চ, ১৮৯০

অতুলবাবু,২১
আপনার মনের অবস্থা খারাপ জানিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম—যাহাতে আনন্দে থাকেন তাহাই করুন।

যাবজ্জননং তাবন্মরণং
তাবজ্জননীজঠরে শয়নং
ইতি সংসারে স্ফুটতরদোষঃ
কথমিহ মানব তব সন্তোষঃ।২২

দাস
নরেন্দ্র

পুঃ—আমি কল্য এস্থান হইতে চলিলাম—দেখি অদৃষ্ট কোথায় লইয়া যায়।

**********

পত্র সংখ্যা- ৪২
( স্বামী অখন্ডানন্দকে লিখিত)
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
মার্চ, ১৮৯০

প্রাণাধিকেষু,
এইমাত্র তোমার আর একখানি পত্র পাইলাম—হিজিবিজি বহু কষ্টে বুঝিলাম। পূর্বের পত্রে সমস্ত লিখিয়াছি। তুমি পত্রপাঠ চলিয়া আসিবে। তুমি যে নেপাল হইয়া তিব্বতের পথ বলিয়াছ, তাহা আমি জানি। যে প্রকার তিব্বতে সহজে কাহাকেও যাইতে দেয় না, ঐপ্রকার নেপালেও কাটামুণ্ড রাজধানী ও দুই-এক তীর্থ ছাড়া কাহাকেও কোথাও যাইতে দেয় না। কিন্তু আমার একজন বন্ধু এক্ষণে নেপালের রাজার ও রাজার স্কুলের শিক্ষক—তাঁহার কাছে শুনিয়াছি যে, বৎসর বৎসর যখন নেপাল হইতে চীন দেশে রাজকর যায়, সে সময় লাসা হইয়া যায়। একজন সাধু—যোগাড় করিয়া ঐ রকমে লাসা, চীন এবং মাঞ্চুরিয়ায় (উত্তর চীন)—তারাদেবীর পীঠ পর্যন্ত গিয়াছিল। উক্ত বন্ধু চেষ্টা করিলে আমরাও মান্য ও খাতিরের সহিত তিব্বত, লাসা, চীন সব দেখিতে পারিব। অতএব তুমি অবিলম্বে গাজীপুরে চলিয়া আইস। এথায় আমি বাবাজীর কাছে কিছুদিন থাকিয়া, উক্ত বন্ধুকে চিঠি পত্র লিখিয়া নেপাল হইয়া নিশ্চিত তিব্বতাদি যাইব। কিমধিকমিতি। দিলদারনগর ষ্টেশনে নামিয়া গাজীপুরে আসিতে হয়। দিলদারনগর মোগলসরাই ষ্টেশনের তিন-চার ষ্টেশনের পর। এথায় ভাড়া যোগাড় করিতে পারিলে পাঠাইতাম; অতএব তুমি যোগাড় করিয়া আইস। গগনবাবু—যাঁহার আশ্রয়ে আমি আছি—এত ভদ্র, উদার এবং হৃদয়বান্ ব্যক্তি যে কি লিখিব! তিনি কালীর জ্বর শুনিয়া হৃষীকেশে তৎক্ষণাৎ ভাড়া পাঠাইলেন এবং আমার জন্য আরও অনেক ব্যয় করিয়াছেন। এ অবস্থায় আবার তাঁহাকে কাশ্মীরের ভাড়ার জন্য ভারগ্রস্ত করা সন্ন্যাসীর ধর্ম নহে জানিয়া নিরস্ত হইলাম। তুমি যোগাড় করিয়া পত্রপাঠ চলিয়া আইস। অমরনাথ দেখিবার বাতিক এখন থাক। ইতি

নরেন্দ্র

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৩১ মার্চ, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আমি কয়েক দিবস এস্থানে ছিলাম না এবং অদ্যই পুনর্বার চলিয়া যাইব। গঙ্গাধর ভায়াকে এস্থানে আসিতে লিখিয়াছি। যদি আইসেন, তাহা হইলে তৎসহ আপনার সন্নিধানে যাইতেছি। কতকগুলি বিশেষ কারণবশতঃ এস্থানের কিয়দ্দুরে এক গ্রামে গুপ্তভাবে কিছুদিন থাকিব, সে স্থান হইতে পত্র লিখিবার কোন সুবিধা নাই। এইজন্যই আপনার পত্রের উত্তর দিতে পারি নাই। গঙ্গাধর-ভায়া বোধ করি আসিতেছেন, না হইলে আমার পত্রের উত্তর আসিত। অভেদানন্দ-ভায়া কাশীতে প্রিয় ডাক্তারের নিকট আছেন। আর একটি গুরুভাই আমার নিকটে ছিলেন, তিনি অভেদানন্দের নিকট গিয়াছেন। তাঁহার পৌঁছানো সংবাদ পাই নাই। তাঁহারও শরীর ভাল নহে, তজ্জন্য অত্যন্ত চিন্তিত আছি। তাঁহার সহিত আমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছি, অর্থাৎ আমার সঙ্গ ত্যাগ করিবার জন্য তাঁহাকে অত্যন্ত বিরক্ত করিয়াছি। কি করি, আমি বড়ই দুর্বল, বড়ই মায়াসমাচ্ছন্ন—আশীর্বাদ করুন, যেন কঠিন হইতে পারি। আমার মানসিক অবস্থা আপনাকে কি বলিব, মনের মধ্যে নরক দিবারাত্রি জ্বলিতেছে—কিছুই হইল না, এ জন্ম বুঝি বিফলে গোলমাল করিয়া গেল; কি করি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বাবাজী মিষ্ট মিষ্ট বুলি বলেন, আর আটকাইয়া রাখেন। আপনাকে কি বলিব, আমি আপনার চরণে শত শত অপরাধ করিতেছি—অন্তর্যাতনায় ক্ষিপ্ত ব্যক্তির কৃত বলিয়া সে সকল মার্জনা করিবেন। অভেদানন্দের রক্তামাশয় হইয়াছে। কৃপা করিয়া যদি তাঁহার তত্ত্ব লন এবং যিনি এস্থান হইতে গিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে যদি মঠে ফিরিয়া যাইতে চান, পাঠাইয়া দিলে বিশেষ অনুগৃহীত হইব। আমার গুরু ভ্রাতারা আমাকে অতি নির্দয় ও স্বার্থপর বোধ করিতেছেন। কি করি, মনের মধ্যে কে দেখিবে? আমি দিবারাত্রি কি যাতনা ভুগিতেছি, কে জানিবে? আশীর্বাদ করুন, যেন অটল ধৈর্য ও অধ্যবসায় আমার হয়। আমার শতকোটি প্রণাম জানিবেন।

দাস
নরেন্দ্র

পুঃ—প্রিয়বাবু ডাক্তারের বাটী সোনারপুরাতে অভেদানন্দ আছেন। আমার কোমরের বেদনা সেই প্রকারই আছে।

দাস নরেন্দ্র

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৪
[স্বামী অভেদানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
২ এপ্রিল, ১৮৯০

ভাই কালী,
তোমার, প্রমদাবাবুর ও বাবুরামের হস্তাক্ষর পাইয়াছি। আমি এ স্থানে একরকম মন্দ নাই। তোমার আমাকে দেখিবার ইচ্ছা হইয়াছে, আমারও বড় ঐরূপ হয়, সেই ভয়েই যাইতে পারিতেছি না—তার উপর বাবাজী বারণ করেন। দুই-চারি দিনের বিদায় লইয়া যাইতে চেষ্টা করিব। কিন্তু ভয় এই তাহা হইলে একেবারে, হৃষীকেশী টানে পাহাড়ে টেনে তুলবে—আবার ছাড়ানো বড় কঠিন হইবে, বিশেষ আমার মত দুর্বলের পক্ষে। কোমরের বেদনাটাও কিছুতেই সারে না—cadaverous (জঘন্য)। তবে অভ্যাস পড়ে আসছে। প্রমদাবাবুকে আমার কোটি কোটি প্রণাম দিবে, তিনি আমার শরীর ও মনের বড় উপকারী বন্ধু ও তাঁহার নিকট আমি বিশেষ ঋণী। যাহা হয় হইবে। ইতি

শুভাকাঙ্ক্ষী
নরেন্দ্র

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
গাজীপুর
২ এপ্রিল, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়, বৈরাগ্যাদি সম্বন্ধে আমাকে যে আজ্ঞা করিয়াছেন, আমি তাহা কোথায় পাইব? তাহারই চেষ্টায় ভবঘুরেগিরি করিতেছি। যদি কখনও যথার্থ বৈরাগ্য হয়, মহাশয়কে বলিব; আপনিও যদি কিছু পান, আমি ভাগীদার আছি—মনে রাখিবেন। কিমধিকমিতি—

দাস নরেন্দ্র

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
১০ মে, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
বহুবিধ গোলমালে এবং পুনরায় জ্বর হওয়ায় আপনাকে পত্র লিখিতে পারি নাই। অভেদানন্দের পত্রে আপনার কুশল অবগত হইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। গঙ্গাধর ভায়া বোধ হয় এতদিনে ৺কাশীধামে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। এ স্থানে এ সময়ে যমরাজ বহু বন্ধু এবং আত্মীয়কে গ্রাস করিতেছেন, তজ্জন্য বিশেষ ব্যস্ত আছি। নেপাল হইতে আমার কোন পত্রাদি বোধ হয় আইসে নাই। বিশ্বনাথ কখন এবং কিরূপে আমাকে rest (বিশ্রাম) দিবেন, জানি না। একটু গরম কমিলেই এ স্থান হইতে পলাইতেছি, কোথা যাই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি আমার জন্য ৺বিশ্বনাথ-সকাশে প্রার্থনা করিবেন, শূলী যেন আমাকে বল দেন। আপনি ভক্ত, এবং ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’ ইতি ভগবদ্বাক্য স্মরণ করিয়া আপনাকে বিনয় করিতেছি। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্র

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
৫৭, রামকান্ত বসু ষ্ট্রীট
বাগবাজার, কলিকাতা
২৬ মে, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
বহু বিপদ‍্‍‍ঘটনার আবর্ত এবং মনের আন্দোলনের মধ্যে পড়িয়া আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি; বিশ্বনাথের নিকট প্রার্থনা করিয়া ইহার যুক্তিযুক্ততা এবং সম্ভবাসম্ভবতা বিবেচনা করিয়া উত্তর দিয়া কৃতার্থ করিবেন।

১। প্রথমেই আপনাকে বলিয়াছি যে, আমি রামকৃষ্ণের গোলাম—তাঁহাকে ‘দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিনুঁ’ করিয়াছি। তাঁহার নির্দেশ লঙ্ঘন করিতে পারি না। সেই মহাপুরুষ যদ্যপি ৪০ বৎসর যাবৎ এই কঠোর ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং পবিত্রতা এবং কঠোরতম সাধন করিয়া ও অলৌকিক জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও বিভূতিমান্ হইয়াও অকৃতকার্য হইয়া শরীর ত্যাগ করিয়া থাকেন, তবে আমাদের আর কি ভরসা? অতএব তাঁহার বাক্য আপ্তবাক্যের ন্যায় আমি বিশ্বাস করিতে বাধ্য।

২। আমার উপর তাঁহার নির্দেশ এই যে, তাঁহার দ্বারা স্থাপিত এই ত্যাগিমণ্ডলীর দাসত্ব আমি করিব, ইহাতে যাহা হইবার হইবে, এবং স্বর্গ বা নরক বা মুক্তি যাহাই আসুক, লইতে রাজী আছি।

৩। তাঁহার আদেশ এই যে, তাঁহার ত্যাগী সেবকমণ্ডলী যেন একত্রিত থাকে এবং তজ্জন্য আমি ভারপ্রাপ্ত। অবশ্য কেহ কেহ এদিক ওদিক বেড়াইতে গেল, সে আলাদা কথা—কিন্তু সে বেড়ানো মাত্র, তাঁহার মত এই ছিল যে এক পূর্ণ সিদ্ধ—তাঁহার ইতস্ততঃ বিচরণ সাজে। তা যতক্ষণ না হয়, এক জায়গায় বসিয়া সাধনে নিমগ্ন হওয়া উচিত। আপনা-আপনি যখন সকল দেহাদি ভাব চলিয়া যাইবে, তখন যাহার যে প্রকার অবস্থা হইবার হইবে, নতুবা প্রবৃত্ত সাধকের পক্ষে ক্রমাগত বিচরণ অনিষ্টজনক।

৪। অতএব উক্ত নির্দেশক্রমে তাঁহার সন্ন্যাসিমণ্ডলী বরাহনগরে একটি পুরাতন জীর্ণ বাটীতে একত্রিত আছেন, এবং সুরেশচন্দ্র মিত্র এবং বলরাম বসু নামক তাঁহার দুইটি গৃহস্থ শিষ্য তাঁহাদের আহারাদি নির্বাহ এবং বাটী ভাড়া দিতেন।

৫। ভগবান্ রামকৃষ্ণের শরীর নানা কারণে (অর্থাৎ খ্রীষ্টিয়ান রাজার অদ্ভুত আইনের জ্বালায়) অগ্নিসমর্পণ করা হইয়াছিল। এই কার্য যে অতি গর্হিত তাহার আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে তাঁহার ভস্মাবশেষ অস্থি সঞ্চিত আছে, উহা গঙ্গাতীরে কোন স্থানে সমাহিত করিয়া দিতে পারিলে উক্ত মহাপাপ হইতে কথঞ্চিৎ বোধ হয় মুক্ত হইব। উক্ত অবশেষ এবং তাঁহার গদির এবং প্রতিকৃতি যথানিয়মে আমাদিগের মঠে প্রত্যহ পূজা হইয়া থাকে এবং আমার এক ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব গুরুভ্রাতা উক্ত কার্যে দিবারাত্র লাগিয়া আছেন, ইহা আপনার অজ্ঞাত নহে। উক্ত পূজাদির ব্যয়ও উক্ত দুই মহাত্মা করিতেন।

৬। যাঁহার জন্মে আমাদিগের বাঙালীকুল পবিত্র ও বঙ্গভূমি পবিত্র হইয়াছে—যিনি এই পাশ্চাত্য বাক‍্ছটায় মোহিত ভারতবাসীর পুনরুদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন—যিনি সেই জন্যই অধিকাংশ ত্যাগী শিষ্যমণ্ডলী University men (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ) হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলেন, এই বঙ্গদেশে তাঁহার সাধনভূমির সন্নিকটে তাঁহার কোন স্মরণচিহ্ন হইল না, ইহার পর আর আক্ষেপের কথা কি আছে?

৭। পূর্বোক্ত দুই মহাত্মার নিতান্ত ইচ্ছা ছিল যে, গঙ্গাতীরে একটি জমি ক্রয় করিয়া তাঁহার অস্থি সমাহিত করা হয় এবং তাঁহার শিস্যবৃন্দও তথায় বাস করেন এবং সুরেশবাবু তজ্জন্য ১০০০৲ টাকা দিয়াছিলেন; এবং আরও অর্থ দিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরের গূঢ় অভিপ্রায়ে তিনি কল্য রাত্রে ইহলোকে ত্যাগ করিয়াছেন। বলরামবাবু মৃত্যুসংবাদ আপনি পূর্ব হইতেই জানেন।

৮। এক্ষণে তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহার এই গদি ও অস্থি লইয়া কোথায় যায়, কিছুই স্থিরতা নাই। (বঙ্গদেশের লোকের কথা অনেক, কাজে এগোয় না, আপনি জানেন।) তাঁহারা সন্ন্যাসী; তাঁহারা এইক্ষণেই যথা ইচ্ছা যাইতে প্রস্তুত; কিন্তু তাঁহাদিগের এই দাস মর্মান্তিক বেদনা পাইতেছে, এবং ভগবান্ রামকৃষ্ণের অস্থি সমাহিত করিবার জন্য গঙ্গাতীরে একটু স্থান হইল না, ইহা মনে করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে।

৯। ১০০০৲ টাকায় কলিকাতার সন্নিকটে গঙ্গাতীরে জমি এবং মন্দির হওয়া অসম্ভব, অন্যূন ৫।৭ হাজার টাকার কমে জমি হয় না।

১০। আপনি এক্ষণে রামকৃষ্ণের শিষ্যদিগের একমাত্র বন্ধু এবং আশ্রয় আছেন। পশ্চিম দেশে আপনার মান এবং সম্ভ্রম এবং আলাপও যথেষ্ট; আমি প্রার্থনা করিতেছি যে যদি আপনার অভিরুচি হয়, উক্ত প্রদেশের আপনার আলাপী ধার্মিক ধনবানদিগের নিকট চাঁদা করিয়া এই কার্যনির্বাহ হওয়ানো আপনার উচিত কি না, বিবেচনা করিবেন। যদি ভগবান্ রামকৃষ্ণের সমাধি এবং তাঁহার শিষ্যদিগের বঙ্গদেশে গঙ্গাতটে আশ্রয়স্থান হওয়া উচিত বিবেচনা করেন, আমি আপনার অনুমতি পাইলেই ভবৎসকাশে উপস্থিত হইব এবং এই কার্যের জন্য, আমার প্রভুর জন্য এবং প্রভুর সন্তানদিগের জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহি। বিশেষ বিবেচনা করিয়া এবং বিশ্বনাথের নিকট প্রার্থনা করিয়া এই কথা অনুধাবন করিবেন। আমার বিবেচনায় যদি এই অতি অকপট, বিদ্বান্‌, সৎকুলোদ্ভুত যুবা সন্ন্যাসিগণ স্থানাভাবে এবং সাহায্যাভাবে রামকৃষ্ণের ideal (আদর্শ) ভাব লাভ করিতে না পারেন, তাহা হইলে আমাদের দেশের ‘অহো দুর্দৈবম্’।

১১। যদি বলেন, ‘আপনি সন্ন্যাসী, আপনার এ সকল বাসনা কেন?’—আমি বলি, আমি রামকৃষ্ণের দাস—তাঁহার নাম তাঁহার জন্ম ও সাধন-ভূমিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিতে ও তাঁহার শিষ্যগণের সাধনের অণুমাত্র সহায়তা করিতে যদি আমাকে চুরি ডাকাতি করিতে হয়, আমি তাহাতেও রাজী। আপনাকে পরমাত্মীয় বলিয়া জানি, আপনাকে সকল বলিলাম। এইজন্যই কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম। আপনাকে বলিয়া আসিয়াছি, আপনার বিচারে যাহা হয় করিবেন।

১২। যদি বলেন যে ৺কাশী-আদি স্থানে আসিয়া করিলে সুবিধা হয়, আপনাকে বলিয়াছি যে, তাঁহার জন্মভূমে এবং সাধনভূমে তাঁহার সমাধি হইবে না, কি পরিতাপ! এবং বঙ্গভূমির অবস্থা বড়ই শোচনীয়। ‘ত্যাগ’ কাহাকে বলে এদেশের লোকে স্বপ্নেও ভাবে না, কেবল বিলাস, ইন্দ্রিয়পরতা ও স্বার্থপরতা এদেশের অস্থিমজ্জা ভক্ষণ করিতেছে। ভগবান্ এদেশে বৈরাগ্য ও অসংসারিত্ব প্রেরণ করুন। এদেশের লোকের কিছুই নাই, পশ্চিম দেশের লোকের, বিশেষ ধনীদিগের, এ সকল কার্যে অনেক উৎসাহ—আমার বিশ্বাস। যাহা বিবেচনায় হয়, উত্তর দিবেন। গঙ্গাধর আজিও পৌঁছান নাই, কালি হয়তো আসিতে পারেন। তাঁহাকে দেখিতে বড় উৎকণ্ঠা।ইতি—দাস

নরেন্দ্র

পুনঃ—উল্লিখিত ঠিকানায় পত্র দিবেন।

**********

পত্র সংখ্যা- ৪৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৪ জুন, ১৮৯০

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইয়াছি। আপনার পরামর্শ অতি বুদ্ধিমানের পরামর্শ, তদ্বিষয়ে সন্দেহ কি; তাঁহার যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে—বড় ঠিক কথা। আমরাও এ স্থানে ও স্থানে দুই চারিজন করিয়া ছড়াইতেছি। গঙ্গাধর-ভায়ার পত্র দুইখানি আমিও পাইয়াছি—ইনফ্লুয়েঞ্জা হইয়া গগনবাবুর বাটীতে আছেন এবং গগনবাবু তাঁহার বিশেষ সেবা ও যত্ন করিতেছেন। আরোগ্য হইয়াই আসিবেন। আপনি আমাদের সংখ্যাতীত দণ্ডবৎ জানিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্র

অভেদানন্দ প্রভৃতি সকলে ভাল আছেন। ইতি

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ৪৯
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
বাগবাজার, কলিকাতা
৬ জুলাই,১৮৯০

প্রিয় শরৎ ও কৃপানন্দ,
তোমাদের পত্র যথাসময়ে পাইয়াছি। শুনিতে পাই, আলমোড়া এই সময়েই সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর, তথাপি তোমার জ্বর হইয়াছে; আশা করি, ম্যালেরিয়া নহে। গঙ্গাধরের নামে যাহা লিখিয়াছ, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে যে তিব্বতে যাহা তাহা খাইয়াছিল, তাহা সর্বৈব মিথ্যা কথা। … আর টাকা তোলার কথা লিখিয়াছ—সে ব্যাপারটা এইঃ তাহাকে মাঝে মাঝে ‘উদাসী বাবা’ নামে এক ব্যক্তির জন্য ভিক্ষা করিতে এবং তাহার রোজ বার আনা, এক টাকা করিয়া ফলাহার যোগাইতে হইত। গঙ্গাধর বুঝিতে পারিয়াছে যে, সে ব্যক্তি একজন পাকা মিথ্যাবাদী, কারণ সে যখন ঐ ব্যক্তির সহিত প্রথম যায়, তখনই সে তাহাকে বলিয়াছিল যে, হিমালয়ে কত আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিষ দেখিতে পাওয়া যায়। আর গঙ্গাধর এই সকল আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিষ এবং স্থান না দেখিতে পাইয়া তাহাকে পুরাদস্তুর মিথ্যাবাদী বলিয়া জানিয়াছিল, কিন্তু তথাপি তাহার যথেষ্ট সেবা করিয়াছিল ‘তা—’ইহার সাক্ষী। বাবাজীর চরিত্র সম্বন্ধেও সে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ পাইয়াছিল। এই সকল ব্যাপার এবং তার সহিত শেষ সাক্ষাৎ হইতেই সে উদাসীর উপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিল এবং এই জন্যই উদাসী প্রভুর এত রাগ। আর পাণ্ডারা—সে পাজীগুলো একেবারে পশু; তুমি তাহাদের এতটুকুও বিশ্বাস করিও না।

আমি দেখিতেছি যে, গঙ্গাধর এখনও সেই আগেকার মত কোমলপ্রকৃতির শিশুটিই আছে, এই সব ভ্রমণের ফলে তাহার ছটফটে ভাবটা একটু কমিয়াছে; কিন্তু আমাদের এবং আমাদের প্রভুর প্রতি তাহার ভালবাসা বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। সে নির্ভীক, সাহসী, অকপট এবং দৃঢ়নিষ্ঠ। শুধু এমন একজন লোক চাই, যাহাকে সে আপনা হইতে ভক্তিভাবে মানিয়া চলিবে, তাহা হইলেই সে একজন অতি চমৎকার লোক হইয়া দাঁড়াইবে।

এবারে আমার গাজীপুর পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা ছিল না, অথবা কলিকাতা আসিবার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কালীর পীড়ার সংবাদে আমাকে কাশী আসিতে হইল এবং বলরামবাবুর আকস্মিক মৃত্যু আমায় কলিকাতায় টানিয়া আনিল। সুরেশবাবু ও বলরাম বাবু দুই জনেই ইহলোক হইতে চলিয়া গেলেন! গিরিশচন্দ্র ঘোষ মঠের খরচ চালাইতেছেন এবং আপাততঃ ভালয় ভালয় দিন গুজরান হইয়া যাইতেছে। আমি শীঘ্রই (অর্থাৎ ভাড়ার টাকাটা যোগাড় হইলেই) আলমোড়া যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছি। সেখান হইতে গঙ্গাতীরে গাড়োয়ালের কোন এক স্থানে গিয়া দীর্ঘকাল ধ্যানে মগ্ন হইবার ইচ্ছা; গঙ্গাধর আমার সঙ্গে যাইতেছে। বলিতে কি, আমি শুধু এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই তাহাকে কাশ্মীর হইতে নামাইয়া আনিয়াছি।

আমার মনে হয়, তোমাদের কলিকাতা আসিবার জন্য অত ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই। ঘোরা যথেষ্ট হইয়াছে। উহা ভাল বটে; কিন্তু দেখিতেছি, তোমরা এ পর্যন্ত একমাত্র যে জিনিষটি তোমাদের করা উচিত ছিল, সেইটিই কর নাই, অর্থাৎ কোমর বাঁধো এবং বৈঠ্ যাও। আমার মতে জ্ঞান জিনিষটা এমন কিছু সহজ জিনিষ নয় যে, তাকে ‘ওঠ ছুঁড়ী, তোর বে’ বলে জাগিয়ে দিলেই হল। আমার দৃঢ় ধারণা যে, কোন যুগেই মুষ্টিমেয় লোকের অধিক কেহ জ্ঞান লাভ করে না; এবং সেই হেতু আমাদের ক্রমাগত এ বিষয়ে লাগিয়া পড়িয়া থাকা এবং অগ্রসর হইয়া যাওয়া উচিত; তাহাতে মৃত্যু হয়, সেও স্বীকার। এই আমার পুরানো চাল, জানই তো। আর আজকালকার সন্ন্যাসীদের মধ্যে জ্ঞানের নামে যে ঠকবাজী চলিতেছে, তাহা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। সুতরাং তোমরা নিশ্চিন্ত থাক এবং বীর্যবান্ হও। রাখাল লিখিতেছে যে, দক্ষ২৩ তাহার সঙ্গে বৃন্দাবনে আছে এবং সে সোনা প্রভৃতি তৈয়ার করিতে শিখিয়াছে, আর একজন পাকা ‘জ্ঞানী’ হইয়া উঠিয়াছে! ভগবান্ তাহাকে আশীর্বাদ করুন এবং তোমরাও বল, শান্তিঃ! শান্তিঃ!

আমার স্বাস্থ্য এখন খুব ভাল, আর গাজীপুর থাকার ফলে যে উন্নতি হইয়াছে, তাহা কিছুকাল থাকিবে বলিয়াই আমার বিশ্বাস। গাজীপুর হইতে যে সকল কাজ করিব বলিয়া এখানে আসিয়াছি, তাহা শেষ করিতে কিছুকাল লাগিবে। সেই আগেও যেরূপ বোধ হইত, আমি এখানে যেন কতকটা ভীমরুলের চাকের মধ্যে রহিয়াছি। এক দৌড়ে আমি হিমালয়ে যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। এবার আর পওহারী বাবা ইত্যাদি কাহারও কাছে নহে, তাহারা কেবল লোককে নিজ উদ্দেশ্য হইতে ভ্রষ্ট করিয়া দেয়। একেবারে উপরে যাইতেছি।

আলমোড়ার জল-হাওয়া কিরূপ লাগিতেছে? শীঘ্র লিখিও। সারদানন্দ, বিশেষ করিয়া তোমার আসিয়া কাজ নাই। একটা জায়গায় সকলে মিলিয়া গুলতোন করায় আর আত্মোন্নতির মাথা খাওয়ায় কি ফল? মূর্খ ভবঘুরে হইও না, কিন্তু বীরের মত অগ্রসর হও। ‘নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষাঃ’২৪ ইত্যাদি। ভাল কথা, তোমার আগুনে ঝাঁপ দিবার ইচ্ছা হইল কেন? যদি দেখ যে, হিমালয়ে সাধনা হইতেছে না, আর কোথাও যাও না।

এই যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়াছ, ইহাতে—তুমি যে নামিয়া আসিবার জন্য উতলা হইয়াছ, শুধু মনের এই দুর্বলতাই প্রকাশ পাইতেছে। শক্তিমান্, ওঠ এবং বীর্যবান্ হও। ক্রমাগত কাজ করিয়া যাও, বাধা-বিপত্তির সহিত যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হও। অলমিতি।

এখানকার সমস্ত মঙ্গল, শুধু বাবুরামের একটু জ্বর হইয়াছে।

তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫০
[লালা গোবিন্দ সহায়কে লিখিত]
আজমীঢ়
১৪ এপ্রিল, ১৮৯১

প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
… পবিত্র এবং নিঃস্বার্থ হইতে চেষ্টা করিও—উহাতেই সমগ্র ধর্ম নিহিত। …

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (৫১-৬০)

পত্র সংখ্যা (৫১-৬০)

পত্র সংখ্যা- ৫১
আবু পাহাড়
৩০ এপ্রিল, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
তুমি কি সেই ব্রাহ্মণ বালকটির উপনয়ন সম্পন্ন করিয়াছ? তুমি সংস্কৃত পড়িতেছ কি? কতদূর অগ্রসর হইলে? আশা করি প্রথমভাগ নিশ্চয়ই শেষ করিয়া থাকিবে। … তুমি শিবপূজা সযত্নে করিতেছ তো? যদি না করিয়া থাক তো করিতে চেষ্টা করিও। ‘তোমরা প্রথমে ভগবানের রাজ্য অন্বেষণ কর, তাহা হইলেই সব পাইবে।’ ভগবানকে অনুসরণ করিলেই তুমি যাহা কিছু চাও পাইবে। … কম্যাণ্ডার সাহেবদ্বয়কে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাইবে; তাঁহারা উচ্চপদস্থ হইয়াও আমার ন্যায় একজন দরিদ্র ফকিরের প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। বৎসগণ, ধর্মের রহস্য শুধু মতবাদে নহে, পরন্তু সাধনার মধ্যে নিহিত। সৎ হওয়া এবং সৎ কর্ম করাতেই সমগ্র ধর্ম পর্যবসিত। “যে শুধু ‘প্রভু প্রভু’ বলিয়া চীৎকার করে সে নহে, কিন্তু যে সেই পরমপিতার ইচ্ছানুসারে কার্য করে, সেই ধার্মিক।” তোমরা আলোয়ারবাসী যে কয়জন যুবক আছ, তোমরা সকলেই চমৎকার লোক, এবং আশা করি যে অচিরেই তোমাদের অনেকেই সমাজের অলঙ্কারস্বরূপ এবং জন্মভূমির কল্যাণের হেতুভূত হইয়া উঠিবে। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

পুঃ—যদিই বা মাঝে মাঝে সংসারে এক-আধটু ধাক্কা খাও, তথাপি বিচলিত হইও না; নিমিষেই উহা চলিয়া যাইবে এবং পুনরায় সব ঠিকঠাক হইয়া যাইবে।

**********
পত্র সংখ্যা- ৫২
আবু পাহাড়, ১৮৯১

প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
মন যে দিকেই যাউক না কেন, নিয়মিত জপ করিতে থাকিবে। হরবক্সকে বলিও যে, সে যেন প্রথমে বাম নাসায়, পরে দক্ষিণ নাসায়, এবং পুনরায় বাম নাসায়, এইক্রমে প্রাণায়াম করে। বিশেষ পরিশ্রমের সহিত সংস্কৃত শিখিবে। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৩
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]

১৮৯১

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
আমার স্বাস্থ্য ও সুখ-সুবিধার সংবাদ লইতে আপনি যে একজন লোক পাঠাইয়াছেন, ইহা আপনার অপূর্ব সহৃদয়তা ও পিতৃসুলভ চরিত্রের একটুখানি পরিচয় মাত্র। আমি এখানে বেশ আছি। আপনার সহৃদয়তায় এখানে আর আমার কিছুরই অভাব নাই। আমি দু-চার দিনের মধ্যে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব বলিয়া আশা করি। এখান হইতে নামিবার সময় আমার কোন যানবাহনের প্রয়োজন নাই। অবরোহণ কষ্টসাধ্য; কিন্তু অধিরোহণ আরও কষ্টসাধ্য এবং এ কথা জগতের সব কিছু সম্বন্ধেই সমভাবে সত্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করিবেন। ইতি

চির বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৪ 
বরোদা
২৬ এপ্রিল, ১৮৯২

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি এখানেই পেয়ে ভারী আনন্দ হল। নাড়িয়াদ ষ্টেশন থেকে আপনার বাড়ী যেতে আমার মোটেই অসুবিধা হয়নি। আপনার ভাইদের কথা কি আর বলব? আপনার ভাইদের যেমনটি হওয়া উচিত, তাঁরা ঠিক তাই! ভগবান্ আপনার পরিবারের উপর তাঁর অশেষ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন। আমার সমস্ত পরিব্রাজক জীবনে এমন পরিবার তো আর দেখলাম না। আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মণিভাই আমার সব রকম সুবিধা করে দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর সঙ্গে মেলামেশার এইটুকু সুযোগ হয়েছে যে, আমি তাঁকে মাত্র দুবার দেখেছি—একবার এক মিনিটের জন্য, আর একবার খুব বেশী হয়তো দশ মিনিটের জন্য। দ্বিতীয়বারে তিনি এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রণালীর আলোচনা করেছিলেন। তবে আমি পুস্তকালয় ও রবিবর্মার ছবি দেখেছি; আর এখানে দেখবার মত এই তো আছে! সুতরাং আজ বিকালে বোম্বে চলে যাচ্ছি। এখানকার দেওয়ানজীকে (বা আপনাকেই) তাঁর সদয় ব্যবহারের জন্য আমার ধন্যবাদ জানাবেন। বোম্বে হতে সবিশেষ লিখিব। ইতি

আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—নাড়িয়াদে শ্রীযুক্ত মণিলাল নাভুভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি অতি বিদ্বান্ ও সাধুপ্রকৃতির ভদ্রলোক। তাঁর সাহচর্যে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।

**********

পত্র সংখ্যা- ৫৫
পুনা
১৫ জুন, ১৮৯২

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার শেষ চিঠি পাবার পর দীর্ঘকাল কেটে গেল; আশা করি, আমি আপনার কোনরূপ বিরাগ ঘটাইনি। আমি ঠাকুরসাহেবের সহিত মহাবালেশ্বর হতে এখানে এসেছি এবং তাঁরই বাড়ীতে আছি। এখানে আরও দু-এক সপ্তাহ থাকবার ইচ্ছা আছে; তারপর হায়দরাবাদ হয়ে রামেশ্বর যাব।

ইতোমধ্যে জুনাগড়ে আপনার পথের সমস্ত বাধা হয়তো দূর হয়ে গেছে—অন্ততঃ আমার আশা তাই। আপনার স্বাস্থ্যের সংবাদ পেতে বিশেষ আগ্রহ হয়—বিশেষতঃ সেই মচকানোটার।

ভবনগরের রাজকুমারের শিক্ষক ও আপনার বন্ধু সেই সুরতি [সুরাটি?] ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে—তিনি অতি সজ্জন। তাঁর পরিচয়লাভে আমি নিজেকে ভাগ্যবান্ মনে করি; তিনি বড়ই অমায়িক ও উদারপ্রকৃতির লোক।

আপনার মহামনা সহোদরগণকে এবং আমাদের ওখানকার বন্ধুবর্গকে আমার অকৃত্রিম অভিনন্দন জানাবেন। বাড়ীতে পত্র লেখার সময় দয়া করে শ্রীযুক্ত নাভুভাইকে আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবেন। আশা করি, সত্বর উত্তর দিয়ে কৃতার্থ করবেন।

আপনাকে ও পরিবারস্থ সকলকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং সকলের মঙ্গল কামনা করছি। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৬
বোম্বে
১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
এই পত্রের বাহক বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষ আমার বিশেষ বন্ধু। সে কলিকাতার একটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তার পরিবারকে আমি যদিও পূর্ব হতেই জানি, তবু তাকে দেখতে পাই খাণ্ডোয়াতে এবং সেখানেই আলাপ-পরিচয় হয়।

সে খুব সৎ ও বুদ্ধিমান্ ছেলে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডারগ্রাজুয়েট। আপনি জানেন যে, আজকাল বাঙলাদেশের অবস্থা কি কঠিন; তাই এই যুবকটি চাকরির অন্বেষণে বেরিয়েছে। আমি আপনার স্বভাবসুলভ সহৃদয়তার সহিত পরিচিত আছি; তাই মনে হয় যে, এ যুবকটির জন্য কিছু করতে অনুরোধ করে আমি নিশ্চয়ই আপনাকে উত্ত্যক্ত করছি না। অধিক লেখা নিষ্প্রয়োজন। আপনি দেখতে পাবেন যে, সে সৎ ও পরিশ্রমী। কোন মানুষের প্রতি একটু দয়া দেখালে তার জীবন সুখময় হয়ে উঠতে পারে, এ বালক সেই দয়ার উপযুক্ত পাত্র; আপনি মহৎ ও দয়ালু, আপনাকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বোধ করি না।

আশা করি, আমার এই অনুরোধে আপনি বিব্রত বা উত্ত্যক্ত হচ্ছেন না। এই আমার প্রথম ও শেষ অনুরোধ এবং বিশেষ ঘটনাচক্রে এটা করতে হল। এখন আপনার দয়ালু প্রাণই আমার আশা ও ভরসা। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৭
বোম্বে
২২ অগষ্ট, ১৮৯২

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার পত্র পেয়ে খুবই কৃতার্থ হলাম—বিশেষতঃ তাহাতে আমার প্রতি আপনার পূর্বের মত স্নেহের প্রমাণ পেয়ে।

আপনার ইন্দোরের বন্ধুর … সহৃদয়তা ও সৌজন্য সম্বন্ধে বেশী কিছু না বলাই ভাল। তবে অবশ্য সব দক্ষিণীই কিছু সমান নয়। আমি শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গকে যখন পত্রে জানিয়েছিলাম যে, আমি লিমডির ঠাকুরসাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছি, তখন তিনি তার উত্তরে মহাবালেশ্বরে আমায় যা লিখেছিলেন, তা উদ্ধৃত করলেই আপনি বিষয়টা বুঝতে পারবেনঃ

‘আপনি লিমডির ঠাকুরকে ওখানে পেয়েছেন জেনে বড়ই খুশী হলাম; নতুবা আপনাকে বড়ই মুশকিলে পড়তে হত; কারণ আমরা—মারাঠারা গুজরাতীদের মত তেমন অতিথিপরায়ণ নই।’ …

আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।

এখানে পনর-কুড়ি দিন, থেকে রামেশ্বর যাবার বাসনা আছে। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব নিশ্চিত।

আপনার ন্যায় উচ্চমনা, মহাপ্রাণ ও দয়ালু ব্যক্তিদের দ্বারাই জগতের প্রকৃত উন্নতি হয়। অন্যেরা সংস্কৃত কবির ভাষায় ‘জননীযৌবন-বনকুঠারাঃ।’

আমার প্রতি আপনার পিতৃসুলভ স্নেহ ও যত্ন আমি মোটেই ভুলতে পারি না; আবার আমার মত একজন ফকির আপনার ন্যায় একজন মহাশক্তিমান্ মন্ত্রীর উপকারের কী প্রতিদান দিতে পারে? আমি শুধু এইটুকু প্রার্থনা করতে পারি যে, সর্বমঙ্গলবিধাতা ভগবান্‌ আপনাকে ইহলোকে বাঞ্ছিত সমস্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ করুন; আর আপনাকে অতি দীর্ঘায়ু দান করে অবশেষে তাঁর অনন্ত মঙ্গল ও শান্তিময় পবিত্র কোলে টেনে নিন। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—একটি বিষয় অতি দুঃখের সহিত উল্লেখ করছি—এ অঞ্চলে সংস্কৃত ও অন্যান্য শিক্ষার সম্পূর্ণ অভাব। এতদঞ্চলের লোকদের মধ্যে ধর্মের নামে পানাহার ও শৌচাদি বিষয়ে একরাশ কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচার আছে—আর এগুলিই যেন তাদের কাছে ধর্মের শেষ কথা!

হায় বেচারারা! দুষ্ট ও চতুর পুরুতরা যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামিগুলোকেই বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে তাদের শেখায় (কিন্তু মনে রাখবেন যে, এসব দুষ্ট পুরুতগুলো বা তাদের পিতৃ-পিতামহগণ গত চারশ-পুরুষ ধরে একখণ্ড বেদও দেখেনি); সাধারণ লোকেরা সেগুলি মেনে চলে আর নিজেদের হীন করে ফেলে। কলির ব্রাহ্মণরূপী রাক্ষসদের কাছ থেকে ভগবান্‌ তাঁদের বাঁচান!

আমি আপনার কাছে একটি বাঙালী ছেলেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, তার প্রতি একটু সদয় ব্যবহার করবেন। ইতি

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৮ 
ঈশ্বরো জয়তি
বোম্বাই
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২
প্রিয় পণ্ডিতজী মহারাজ,
আমি যথাসময়ে আপনার পত্র পাইয়াছি। আমি প্রশংসার উপযুক্ত না হইলেও, আমাকে কেন যে প্রশংসা করা হয়, তাহা বুঝিতে পারি না। প্রভু যীশুর কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, ‘ভাল একজন মাত্রই আছেন—স্বয়ং প্রভু ভগবানই একমাত্র ভাল।’ অপর সকলে তাঁহারই হস্তের যন্ত্রমাত্র। ‘মহতো মহীয়ান্’ পরমধামে অধিষ্ঠিত ঈশ্বর এবং উপযুক্ত ব্যক্তিগণই মহিমামণ্ডিত হউন, আমার ন্যায় অনুপযুক্ত ব্যক্তি নয়। বর্তমান ক্ষেত্রে ‘ভৃত্যটি মজুরিলাভের উপযুক্তই নহে’; বিশেষতঃ ফকিরের কোনরূপ প্রশংসালাভের অধিকার নাই। আপনার ভৃত্য যদি শুধু তাহার নির্দিষ্ট কর্তব্য করে, তবে কি সেজন্য আপনি তাহাকে প্রশংসা করেন?

আশা করি, আপনি সপরিবারে সর্বাঙ্গীন কুশলে আছেন। পণ্ডিত সুন্দরলালজী ও মদীয় অধ্যাপক২৬ যে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, সেজন্য তাঁহাদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ।

এখন আপনাকে আমি অন্য এক বিষয় বলিতে চাইঃ হিন্দুগণ চিরকালই সাধারণ সত্য হইতে বিশেষ সত্যে উপনীত হইতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু কখনই বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও সত্যের বিচার দ্বারা সাধারণ সত্যে উপনীত হইবার চেষ্টা করেন নাই। আমাদের সকল দর্শনেই দেখিতে পাই—প্রথমে একটি সাধারণ ‘প্রতিজ্ঞা’ ধরিয়া লইয়া, তারপর চুলচেরা বিচার চলিতেছে; কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞাটিই হয়তো সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক ও বালকোচিত। কেহই এই সকল সাধারণ প্রতিজ্ঞার সত্যাসত্য জিজ্ঞাসা অথবা অনুসন্ধান করে নাই। সুতরাং আমাদের স্বাধীন চিন্তা একরূপ নাই বলিলেই হয়। সেইজন্যই আমাদের দেশে পর্যবেক্ষণ ও সামান্যীকরণ২৭ প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানসমূহের অত্যন্ত অভাব দেখিতে পাই। ইহার কারণ কি? ইহার দুইটি কারণঃ প্রথমতঃ এখানে গ্রীষ্মের অত্যন্ত আধিক্য আমাদিগকে কর্মপ্রিয় না করিয়া শান্তি ও চিন্তা-প্রিয় করিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা কখনই দূরদেশে ভ্রমণ অথবা সমুদ্রযাত্রা করিতেন না। সমুদ্রযাত্রা বা দূরভ্রমণ করিবার লোক ছিল বটে, তবে তাহারা প্রায় সবই ছিল বণিক; পৌরোহিত্যের অত্যাচার ও তাহাদের নিজেদের ব্যবসায়ে লাভের আকাঙ্ক্ষা, তাহাদের মানসিক উন্নতির সম্ভাবনা একেবারে রুদ্ধ করিয়াছিল। সুতরাং তাহাদের পর্যবেক্ষণের ফলে মনুষ্যজাতির জ্ঞানভাণ্ডার বর্ধিত না হইয়া উহার অবনতিই হইয়াছিল। কারণ, তাহাদের পর্যবেক্ষণ দোষযুক্ত ছিল, এবং তাহাদের প্রদত্ত বিবরণ এতই অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক হইত যে, বাস্তবের সঙ্গে তাহার মোটেই মিল থাকিত না।

সুতরাং আপনি বুঝিতেছেন, আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশে যাইতেই হইবে। আমাদিগকে দেখিতে হইবে, অন্যান্য দেশে সমাজ-যন্ত্র কিরূপে পরিচালিত হইতেছে। আর যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতে হইবে। সর্বোপরি আমাদিগকে দরিদ্রের উপর অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। আমরা এখন কি হাস্যকর অবস্থাতেই না উপনীত হইয়াছি! ভাঙ্গীরূপে যদি কোন ভাঙ্গী কাহারও নিকট উপস্থিত হয়, সংক্রামক রোগের ন্যায় সকলে তাহার সঙ্গ ত্যাগ করে; কিন্তু যখনই পাদ্রী সাহেব আসিয়া মন্ত্র আওড়াইয়া তাহার মাথায় খানিকটা জল ছিটাইয়া দেয়, আর সে একটা জামা (যতই ছিন্ন ও জর্জরিত হউক) পরিতে পায়, তখনই সে খুব গোঁড়া হিন্দুর বাড়ীতেই প্রবেশাধিকার পায়! আমি তো এমন লোক দেখি না, যে তখন তাহাকে একখানা চেয়ার আগাইয়া না দিতে ও তাহার সহিত সপ্রেম করমর্দন না করিতে সাহস করে! ইহার চেয়ে আর অদৃষ্টের পরিহাস কতদূর হইতে পারে? এখন এই পাদ্রীরা দক্ষিণে কি করিতেছে, দেখিবেন—আসুন দেখি। উহারা লাখ লাখ নীচ জাতকে খ্রীষ্টান করিয়া ফেলিতেছে—আর পৌরোহিত্যের অত্যাচার ভারতের সর্বাপেক্ষা যেখানে বেশী, সেই ত্রিবাঙ্কুরে, যেখানে ব্রাহ্মণগণ সমুদয় ভূমির স্বামী, এবং স্ত্রীলোকেরা—এমন কি রাজবংশীয়া মহিলাগণ পর্যন্ত—ব্রাহ্মণগণের উপপত্নীরূপে বাস করা খুব সম্মানের বিষয় জ্ঞান করিয়া থাকে, তথাকার সিকি ভাগ খ্রীষ্টান হইয়া গিয়াছে। আর আমি তাহাদের দোষও দিতে পারি না। তাহাদের আর কোন্ বিষয়ে কি অধিকার আছে বলুন? হে প্রভু, কবে মানুষ অপর মানুষকে ভাইয়ের ন্যায় দেখিবে?

আপনারই
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৫৯
[হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
মাড়গাঁও, ১৮৯৩

কল্যাণবরেষু,
আপনার এক পত্র এইমাত্র পাইলাম। আমি এ স্থানে নিরাপদে পৌঁছিয়া ও তদনন্তর পঞ্জেম প্রভৃতি কয়েকটি গ্রাম ও দেবালয় দর্শন করিতে যাই—অদ্য ফিরিয়া আসিয়াছি। গোকর্ণ, মহাবালেশ্বর প্রভৃতি দর্শন করিবার ইচ্ছা এক্ষণে পরিত্যাগ করিলাম। কল্য প্রাতঃকালের ট্রেনে ধারবাড় যাত্রা করিব। ষষ্টি আমি লইয়া আসিয়াছি। ডাক্তার যুগড়েকরের মিত্র আমার অতিশয় যত্ন করিয়াছেন। ভাটেসাহেব ও অন্যান্য সকল মহাশয়কে আমার যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানাইবেন। ঈশ্বর আপনার ও আপনার পত্নীর সকল কল্যাণ করুন। পঞ্জেম শহর বড় পরিষ্কার। এখানকার খ্রীষ্টিয়ানেরা অনেকেই কিছু কিছু লেখাপড়া জানে। হিন্দুরা প্রায় সকলেই মূর্খ। ইতি

সচ্চিদানন্দ২৮
**********

পত্র সংখ্যা- ৬০
C/o বাবু মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়
সুপারিণ্টেণ্ডিং ইঞ্জিনিয়র
খার্তাবাদ, হায়দরাবাদ
২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার বন্ধু সেই গ্রাজুয়েট যুবকটি ষ্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিলেন—একটি বাঙালী ভদ্রলোকও এসেছিলেন। এখন আমি ঐ বাঙালী ভদ্রলোকটির কাছেই রয়েছি—কাল তোমার যুবক বন্ধুটির কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব; তারপর এখানকার দ্রষ্টব্য জিনিষগুলি দেখা হয়ে গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই মান্দ্রাজে ফিরছি। কারণ আমি অত্যন্ত দুঃখের সহিত তোমায় জানাচ্ছি যে, আমি এখন আর রাজপুতানায় ফিরে যেতে পারব না—এখানে এখন থেকেই ভয়ঙ্কর গরম পড়েছে; জানি না রাজপুতানায় আরও কি ভয়ানক গরম হবে, আর গরম আমি আদপে সহ্য করতে পারি না। সুতরাং এরপর আমাকে বাঙ্গালোরে যেতে হবে, তারপর উতকামণ্ডে গ্রীষ্মটা কাটাতে যাব। গরমে আমার মাথার ঘিটা যেন ফুটতে থাকে।

তাই আমার সব মতলব ফেঁসে চুরমার হয়ে গেল; আর এই জন্যই আমি গোড়াতেই মান্দ্রাজ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে আমায় আমেরিকা পাঠাবার জন্য আর্যাবর্তের কোন রাজাকে ধরবার যথেষ্ট সময় হাতে পেতাম। কিন্তু হায়, এখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। প্রথমতঃ এই গরমে আমি ঘুরে বেড়াতে পারব না—তা করতে গেলে মারা যাব, দ্বিতীয়তঃ আমার রাজপুতানার ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণ আমাকে পেলে তাঁদের কাছেই ধরে রেখে দেবেন, পাশ্চাত্য দেশে যেতে দেবেন না। সুতরাং আমার মতলব ছিল, আমার বন্ধুদের অজ্ঞাতসারে কোন নূতন লোককে ধরা। কিন্তু মান্দ্রাজে এই বিলম্ব হওয়ার দরুন আমার সব আশাভরসা চুরমার হয়ে গেছে; এখন আমি অতি দুঃখের সহিত ঐ চেষ্টা ছেড়ে দিলাম—ঈশ্বরের যা ইচ্ছা, তাই পূর্ণ হোক। এ আমারই প্রাক্তন—অপর কারও দোষ নেই। তবে তুমি এক রকম নিশ্চিতই জেনো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই দু-এক দিনের জন্য মান্দ্রাজে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে বাঙ্গালোরে যাব, আর সেখান থেকে উতকামণ্ডে গিয়ে দেখব, যদি ম—মহারাজ আমায় পাঠায়। ‘যদি’ বলছি তার কারণ, আমি ‘—’রাজার অঙ্গীকারবাক্যে বড় নিশ্চিত ভরসা রাখি না। তারা তো আর রাজপুত নয়, রাজপুত বরং প্রাণ দেবে, কিন্তু কখনও কথার খেলাপ করবে না। যাই হোক, ‘যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি’—অভিজ্ঞতাই জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

‘স্বর্গে যেরূপ মর্ত্যেও তদ্রূপ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, কারণ অনন্তকালের জন্য তোমারই মহিমা জগতে ঘোষিত হচ্ছে এবং সবই তোমারই রাজত্ব।’২৯

তোমরা সকলে আমার শুভেচ্ছা জানবে। ইতি

তোমাদের
সচ্চিদানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (৬১-৭০)

পত্র সংখ্যা (৬১-৭০)

পত্র সংখ্যা- ৬১
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
খেতড়ি, রাজপুতানা
২৭ এপ্রিল, ১৮৯৩

প্রিয় ডাক্তার,
এইমাত্র আপনার পত্র পাইলাম। অযোগ্য হইলেও আমার প্রতি আপনার প্রীতির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিবেন। বালাজী বেচারার পুত্রের মৃত্যু-সংবাদে বড়ই দুঃখিত হইলাম। ‘প্রভুই দিয়া থাকেন, আবার প্রভুই গ্রহণ করেন—প্রভুর নাম ধন্য হউক।’ আমরা কেবল জানি, কিছুই নষ্ট হয় না বা হইতে পারে না। আমাদিগকে সম্পূর্ণ শান্তভাবে তাঁহার নিকট হইতে যাহাই আসুক না কেন, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। সেনাপতি যদি তাঁহার অধীন সৈন্যকে কামানের মুখে যাইতে বলেন, তাহাতে তাহার অভিযোগ করিবার বা ঐ আদেশ পালন করিতে এতটুকু ইতস্ততঃ করিবার অধিকার নাই। বালাজীকে প্রভু এই শোকে সান্ত্বনা দান করুন, আর এই শোক যেন তাহাকে সেই পরম করুণাময়ী জননীর বক্ষের নিকট হইতে নিকটে লইয়া যায়।

মান্দ্রাজ হইতে জাহাজে উঠিবার প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, উহা এক্ষণে আর হইবার যো নাই, কারণ আমি পূর্বেই বোম্বাই হইতে উঠিবার বন্দোবস্ত করিয়াছি। ভট্টাচার্য মহাশয়কে বলিবেন, রাজা৩০ অথবা আমার গুরুভাইগণ আমার সংকল্পে বাধা দিবেন, তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। রাজাজীর তো আমার প্রতি অগাধ ভালবাসা।

একটা কথা—চেটির উত্তরটি মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আমি বেশ ভাল আছি। দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বোম্বাই রওনা হইতেছি।

সেই সর্বশুভবিধাতা আপনাদের সকলের ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল বিধান করুন, ইহাই সচ্চিদানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা।

পুঃ—আমি জগমোহনকে আপনার নমস্কার জানাইয়াছি। তিনিও আমাকে বলিতেছেন, আপনাকে তাঁহার প্রতিনমস্কার জানাইতে।

**********

পত্র সংখ্যা- ৬২
[শ্রীযুক্ত বালাজী রাওকে লিখিত]
১৮৯৩

প্রিয় বালাজী,
‘আমরা মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হই উলঙ্গ অবস্থায়, ইহলোক হইতে বিদায় হইবার সময় যাইও উলঙ্গ অবস্থায়; প্রভু দিয়াছিলেন, তিনিই আবার গ্রহণ করিলেন; প্রভুর নাম ধন্য হউক!’ যখন সেই প্রাচীন য়াহুদী-বংশসম্ভূত মহাত্মা—মনুষ্যের অদৃষ্টচক্রে যতদূর দুঃখ-কষ্ট আসিতে পারে, তাহার চূড়ান্ত ভোগ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার মুখ দিয়া ঐ বাণী নির্গত হইয়াছিল, আর তিনি মিথ্যা বলেন নাই। তাঁহার এই বাণীর মধ্যেই জীবনের গূঢ় রহস্য নিহিত। সমুদ্রের উপরিভাগে উত্তালতরঙ্গমালা নৃত্য করিতে পারে, প্রবল ঝটিকা গর্জন করিতে পারে, কিন্তু উহার গভীরতম প্রদেশে অনন্ত স্থিরতা, অনন্ত শান্তি, অনন্ত আনন্দ বিরাজমান। ‘শোকার্তেরা ধন্য, কারণ তাহারা সান্ত্বনা পাইবে’; কারণ ঐ মহাবিপদের দিনে, যখন পিতামাতার কাতর ক্রন্দনে উদাসীন করাল কালের পেষণে হৃদয় বিদীর্ণ হইতে থাকে, যখন গভীর দুঃখ ও নিরাশায় পৃথিবী অন্ধকার বোধ হয়, তখনই আমাদের অন্তরের চক্ষু উন্মীলিত হয়। যখন দুঃখ বিপদ নৈরাশ্যের ঘনান্ধকারে চারিদিক একেবারে আচ্ছন্ন বোধ হয়, তখনই যেন সেই নিবিড় অন্ধকারের মধ্য হইতে হঠাৎ জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠে, স্বপ্ন যেন ভাঙিয়া যায়, আর তখন আমরা প্রকৃতির মহান্ রহস্য সেই অনন্ত সত্তাকে দিব্যচক্ষে দেখিতে থাকি।

যখন জীবনভার এত দুর্বহ হয় যে, তাহাতে অনেক ক্ষুদ্রকায় তরী ডুবাইয়া দিতে পারে, তখনই প্রতিভাবান্ বীরহৃদয় ব্যক্তি সেই অনন্ত পূর্ণ নিত্যানন্দময় সত্তামাত্রস্বরূপকে দেখে, যে অনন্ত পুরুষ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অভিহিত ও পূজিত; তখনই যে শৃঙ্খল তাহাকে এই দুঃখময় কারায় আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা যেন ক্ষণকালের জন্য ভাঙিয়া যায়। তখন সেই বন্ধনমুক্ত আত্মা ক্রমাগত উচ্চ হইতে উচ্চতর ভূমিতে আরোহণ করিয়া শেষে সেই প্রভুর সিংহাসনে সমীপবর্তী হয়, ‘যেখানে অত্যাচারীর উৎপীড়ন সহ্য করিতে হয় না, যেখানে পরিশ্রান্ত ব্যক্তি বিশ্রাম লাভ করে।’

ভ্রাতঃ! দিবারাত্র তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে ভুলিও না; দিবারাত্র বলিতে ভুলিও না, ‘তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক।’

‘কেন’ প্রশ্নে আমাদের নাই অধিকার।
কাজ কর, করে মর—এই হয় সার॥

হে প্রভো! তোমার নাম—তোমার পবিত্র নাম ধন্য হউক এবং তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক। হে প্রভো! আমরা জানি যে, আমাদিগকে তোমার ইচ্ছার অধীনে চলিতে হইবে—জানি প্রভো, মায়ের হাতেই মার খাইতেছি; কিন্তু মন বুঝিলেও প্রাণ যে বুঝে না! হে প্রেমময় পিতঃ! তুমি যে একান্ত আত্মসমর্পণ শিক্ষা দিতেছ, হৃদয়ের জ্বালা তো তাহা করিতে দিতেছে না।

হে প্রভো! তুমি তোমার চক্ষের সমক্ষে তোমার সব আত্মীয়স্বজনকে মরিতে দেখিয়াছিলে এবং শান্তচিত্তে বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া নিশ্চিন্তভাবে বসিয়াছিলে; তুমি আমাদিগকে বল দাও। এস প্রভো, এস হে আচার্যচূড়ামণি! তুমি আমাদিগকে শিখাইয়াছ; সৈনিককে কেবল আজ্ঞা পালন করিতে হইবে, তাহার কথা কহিবার অধিকার নাই। এস প্রভো, এস হে পার্থসারথি! অর্জুনকে তুমি যেমন একসময় শিখাইয়াছিলে যে, তোমার শরণ লওয়াই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য, তেমনি, আমাকেও শিখাও—যেন প্রাচীনকালের মহাপুরুষগণের সহিত আমিও দৃঢ়তা ও শরণাগতির সহিত বলিতে পারি ‘ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু’। প্রভু আপনার হৃদয়ে শান্তি দিন, ইহাই দিবারাত্র সচ্চিদানন্দের প্রার্থনা ।

**********

পত্র সংখ্যা- ৬৩
খেতড়ি
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৩

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
ইচ্ছা ছিল যে, এখানে আসার পথে নাড়িয়াদে আপনার ওখানে যাব, এবং আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করব। কিন্তু কয়েকটি ঘটনাতে বাধা পড়ল, তার মধ্যে প্রধান এই যে, আপনি ওখানে ছিলেন না—হ্যামলেটের ভূমিকা বাদ দিয়ে ‘হ্যামলেট’ অভিনয় করা হাস্যকর ব্যাপার মাত্র! আর আমার নিশ্চিত জানা আছে যে, আপনি দিন-কয়েকের মধ্যেই নাড়িয়াদে ফিরবেন। অধিকন্তু আমি দিন-বিশেকের মধ্যেই যখন বোম্বে যাচ্ছি, তখন আপনার ওখানে যাওয়াটা পেছিয়া দেওয়াই উচিত মনে করলাম।

খেতড়ির রাজাজী আমায় দেখবার জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; সুতরাং আমাকে খেতড়ি আসতেই হল। কিন্তু গরম অসহ্য; অতএব আমি শীঘ্রই পালাচ্ছি।

ভাল কথা, আমার প্রায় সকল দক্ষিণী রাজার সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, আর বহু জায়গায় বহু অদ্ভুত দৃশ্যও দেখেছি। আবার দেখা হলে সে-সব সবিশেষ বলব। আমি জানি আপনি আমায় খুবই ভালবাসেন এবং আপনার ওখানে না যাওয়ার অপরাধ নেবেন না। যা হোক, কিছুদিনের মধ্যেই আসছি।

আর এক কথা। এখন কি জুনাগড়ে আপনার কাছে সিংহের বাচ্চা আছে? রাজার জন্য একটি কি আমায় ধার দিতে পারেন? এর বদলে আপনার পছন্দ হলে তিনি রাজপুতানার কোন জানোয়ার আপনাকে দিতে পারেন।

ট্রেনে রতিলাল ভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ঠিক সেই সুন্দর অমায়িক মানুষটিই আছেন। আর দেওয়ানজী সাহেব, আপনার জন্য কি আর প্রার্থনা করব? করুণাময় জগৎপিতার এতগুলি পুত্রকন্যার সেবায় নিরত থেকে আপনার যে পবিত্র জীবন সকলের প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছে, তার শেষভাগে ভগবান্ আপনার সর্বস্ব হোন। ওম্

আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৪ 
বোম্বে
২২ মে, ১৮৯৩

দেওয়ানজী সাহেব,
কয়েকদিন হয় বোম্বে পৌঁছিয়াছি। আবার দুই-চার দিনের মধ্যে এখান হইতে বাহির হইব। আপনার যে বেনিয়া বন্ধুটির নিকট আমার থাকিবার স্থানের জন্য লিখিয়াছিলেন, পত্রযোগে তিনি জানাইয়াছেন যে, পূর্ব হইতেই তাঁহার বাটী অতিথি-অভ্যাগতে ভর্তি এবং তন্মধ্যে অনেকে আবার অসুস্থ; সুতরাং আমার জন্য স্থানসঙ্কুলান হওয়া সেখানে সম্ভব নয়—সেজন্য তিনি দুঃখিত। তবে আমরা বেশ একটি সুন্দর ও খোলা জায়গা পাইয়াছি। … খেতড়ির মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী ও আমি বর্তমানে একত্র আছি। আমার প্রতি তাঁহার ভালবাসা ও সহৃদয়তার জন্য আমি যে কত কৃতজ্ঞ, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি না। রাজপুতানার জনসাধারণ যে শ্রেণীর লোককে ‘তাজিমি সর্দার’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে এবং যাঁহাদের অভ্যর্থনার জন্য স্বয়ং রাজাকেও আসন ত্যাগ করিয়া উঠিতে হয়, ইনি সেই সর্দারশ্রেণীর লোক। অথচ ইনি এত অনাড়ম্বর এবং এমনভাবে আমার সেবা করেন যে, আমি সময় সময় অত্যন্ত লজ্জা বোধ করি। …

এই ব্যাবহারিক জগতে এরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিতে দেখা যায় যে, যাঁহারা খুব সৎলোক তাঁহারাও নানাপ্রকার দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে পতিত হন। ইহার রহস্য দুর্জ্ঞেয় হইতে পারে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, এ জগতের সব কিছুই মূলতঃ সৎ—উপরের তরঙ্গমালা যে-রূপই হউক, তাহার অন্তরালে, গভীরতম প্রদেশে প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অনন্ত বিস্তৃত স্তর বিরাজিত। যতক্ষণ সেই স্তরে আমরা পৌঁছিতে না পারি, ততক্ষণই অশান্তি; কিন্তু যদি একবার শান্তিমণ্ডলে পৌঁছানো যায়, তবে ঝঞ্ঝার গর্জন ও বায়ুর তর্জন যতই হউক—পাষাণ-ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত গৃহ তাহাতে কিছুমাত্র কম্পিত হয় না।

আর আমি এ কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, আপনার ন্যায় পবিত্র ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তি, যাঁহার সমগ্র জীবন অপরের কল্যাণসাধনেই নিযুক্ত হইয়াছে, তিনি—গীতামুখে শ্রীভগবান্ যাহাকে ‘ব্রাহ্মী স্থিতি’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন—সেই দৃঢ় ভূমিতে অবশ্যই স্থিতি লাভ করিয়াছেন।

যে আঘাত আপনি পাইয়াছেন, তাহা আপনাকে তাঁহার সমীপবর্তী করুক—যিনি ইহলোকে এবং পরলোকে একমাত্র প্রেমের আস্পদ। আর তাহা হইলেই তিনি যে সর্বকালে সব কিছুর ভিতর অধিষ্ঠিত এবং যাহা কিছু আছে, যাহা কিছু হারাইয়া গিয়াছে, সব কিছু আপনি তাঁহাতেই উপলব্ধি করুন।

আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৫ 
খেতড়ি
মে, ১৮৯৩

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনি পত্র লেখার পূর্বে আমার পত্র নিশ্চয়ই পৌঁছায়নি। আপনার পত্র পড়ে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ হল। হর্ষ এ জন্য যে, আপনার ন্যায় হৃদয়বান্ শক্তিমান্ ও পদমর্যাদাশালী একজনের স্নেহলাভের সৌভাগ্য আমার ঘটেছে; আর বিষাদ এ জন্য যে, আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার আগাগোড়াই ভুল ধারণা হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করুন যে, আমি আপনাকে পিতার ন্যায় ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি এবং আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অসীম। সত্য কথা এইঃ আপনার হয়তো স্মরণ আছে যে, আগে থেকেই আমার চিকাগো যাবার অভিলাষ ছিল; এমন সময় মান্দ্রাজের লোকেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবং মহীশূর ও রামনাদের মহারাজার সাহায্যে আমাকে পাঠাবার সব রকম আয়োজন করে ফেলল। আপনার আরও স্মরণ থাকতে পারে যে, খেতড়ির রাজা ও আমার মধ্যে প্রগাঢ় প্রেম বিদ্যমান। তাই কথাচ্ছলে তাঁকে লিখেছিলাম যে, আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। এখন খেতড়ির রাজা মনে করলেন যে, যাবার পূর্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাবই; আরও বিশেষ কারণ এই যে, ভগবান্ তাঁকে সিংহাসনের একটি উত্তরাধিকারী দিয়াছেন এবং সেজন্য এখানে খুব আমোদ আহ্লাদ চলেছে। অধিকন্তু আমার আসা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার জন্য তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে অত দূর মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আসতে আমাকে হতই। ইতোমধ্যে নাড়িয়াদে আপনার ভাইকে টেলিগ্রাম করে জানতে চাইলাম যে, আপনি সেখানে আছেন কি না; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উত্তর পেলাম না। এদিকে বেচারা প্রাইভেট সেক্রেটারীর মান্দ্রাজ যাতায়াতে খুবই কষ্ট হয়েছিল, আর তার নজর ছিল শুধু একটা জিনিষের দিকে—জলসার আগে আমরা খেতড়ি না পৌঁছালে রাজা খুব দুঃখিত হবেন; তাই সে তখনি জয়পুরের টিকেট কিনে ফেলে। পথে রতিলালের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় এবং তিনি আমাকে জানালেন যে, আমার টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল, যথাকালে উত্তরও দেওয়া হয়েছিল, আর শ্রীযুক্ত বিহারীদাস আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এখন আপনিই বিচার করুন; কারণ এ যাবৎ আপনি সর্বদা সুবিচার করাকেই নিজের কর্তব্যরূপে গ্রহণ করেছেন। আমি এ বিষয়ে কী করতে পারতাম, আর কী করা উচিত ছিল? আমি পথে নেমে পড়লে খেতড়ির উৎসবে যথাসময়ে যোগ দিতে পারতাম না এবং আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভুল ধারণার সৃষ্টি হত। কিন্তু আমি আপনার ও আপনার ভায়ের ভালবাসা জানি; তা-ছাড়া আমার এও জানা ছিল যে, চিকাগো যাবার পথে আমাকে দিন কয়েকের মধ্যেই বোম্বে যেতে হবে। ভেবেছিলাম যে, আপনার ওখানে যাওয়াটা আমার ফেরার পথের জন্য মুলতবী রেখে দেওয়াই উত্তম হবে। আপনি যে মনে করছেন আপনার ভাইরা আমার দেখাশোনা না করায় আমি অপমানিত হয়েছি—এটা আপনার একটা অভিনব আবিষ্কার বটে! আমি তো এ কথা স্বপ্নেও ভাবিনি; অথবা আপনি হয়তো মানুষের মনের কথা জানার বিদ্যা শিখে ফেলেছেন—ভগবান্ জানেন! ঠাট্টা ছেড়ে দিলেও দেওয়ানজী সাহেব, আমার কৌতুকপরায়ণতা ও দুষ্টামি আগের মতই আছে; কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক বলছি যে, জুনাগড়ে আমায় যেরূপ দেখেছিলেন আমি এখনও সেই সরল বালকই আছি এবং আপনার প্রতি আমার ভালবাসাও পূর্ববৎই আছে—বরং শতগুণ বর্ধিত হয়েছে; কারণ আপনার ও দক্ষিণদেশের প্রায় সকল দেওয়ানের মধ্যে মনে মনে তুলনা করার সুযোগ আমি পেয়েছি এবং ভগবান্ জানেন, আমি দক্ষিণদেশের প্রত্যেক রাজদরবারে শতমুখে আপনার কিরূপ প্রশংসা করেছি। অবশ্য আমি জানি যে, আপনার সদ‍্গুণরাশি ধারণা করতে আমি অতি অযোগ্য। এতেও যদি ব্যাপারটার যথেষ্ট ব্যাখ্যা না হয়ে থাকে, তবে আপনাকে অনুনয় করছি যে, আপনি আমাকে পিতার ন্যায় ক্ষমা করুন; আমি আপনার ন্যায় উপকারীর প্রতি কখনও অকৃতজ্ঞ হয়েছি—এই ধারণার কবলে পড়ে আমি যেন উৎপীড়িত না হই। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ

পুঃ—আপনার ভায়ের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে, তা দূর করবার ভার আপনার ওপর দিচ্ছি। আমি যদি স্বয়ং শয়তানও হই, তবু তাঁদের দয়া ও আমার প্রতি বহু প্রকার উপকারের কথা আমি ভুলতে পারি না।

অপর যে দুজন স্বামীজী গতবারে জুনাগড়ে আপনার নিকট গিয়েছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, তাঁরা আমার গুরুভাই এবং তাঁদের একজন আমাদের নেতা। তাঁদের সঙ্গে তিন বৎসর পরে দেখা হয় এবং আমরা সকলে আবু পর্যন্ত একসঙ্গে এসে ওখানেই ওঁদের ছেড়ে এসেছি। আপনার অভিলাষ হলে বোম্বে যাবার পথে আমি তাঁদের নাড়িয়াদে নিয়ে যেতে পারি। ভগবান্ আপনার ও আপনার পরিবারের সকলের মঙ্গল করুন।

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৬
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]
বোম্বে
২৪ মে, ১৮৯৩

কল্যাণীয়াসু,
মা, তোমার ও হরিপদ বাবাজীর পত্র পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলাম। সর্বদা পত্র লিখিতে পারি নাই বলিয়া দুঃখিত হইও না। সর্বদা শ্রীহরির নিকট তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। বেলগাঁওয়ে এক্ষণে যাইতে পারি না, কারণ ৩১ তারিখে এখান হইতে আমেরিকায় রওনা হইবার সকল বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। আমেরিকা ও ইওরোপ পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়া প্রভুর ইচ্ছায় পুনরায় তোমাদের দর্শন করিব। সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করিবে। সর্বদা মনে রাখিবে যে, প্রভুর হস্তে আমরা পুত্তলিকামাত্র। সর্বদা পবিত্র থাকিবে। কায়মনোবাক্যেও যেন অপবিত্র না হও এবং সদা যথাসাধ্য পরোপকার করিতে চেষ্টা করিবে। মনে রাখিও, কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করা স্ত্রীলোকের প্রধান ধর্ম। নিত্য যথাশক্তি গীতাপাঠ করিও। তুমি ইন্দুমতী ‘দাসী’ কেন লিখিয়াছ? ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ‘দেব’ ও ‘দেবী’ লিখিবে, বৈশ্য ও শূদ্রেরা ‘দাস’ ও ‘দাসী’ লিখিবে। অপিচ জাতি ইত্যাদি আধুনিক ব্রাহ্মণ-মহাত্মারা করিয়াছেন। কে কাহার দাস? সকলেই হরির দাস, অতএব আপনাপন গোত্রনাম অর্থাৎ পতির নামের শেষভাগ বলা উচিত, এই প্রাচীন বৈদিক প্রথা, যথা—ইন্দুমতী মিত্র ইত্যাদি। আর কি লিখিব মা, সর্বদা জানিবে যে, আমি নিরন্তর তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি, তুমি শীঘ্রই পুত্রবতী হও। আমেরিকা হইতে সেখানকার আশ্চর্যবিবরণপূর্ণ পত্র আমি মধ্যে মধ্যে তোমায় লিখিব। এক্ষণে আমি বোম্বেতে আছি। ৩১ তারিখ পর্যন্ত থাকিব। খেতড়ি মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী আমায় জাহাজে তুলিয়া দিতে আসিয়াছেন। কিমধিকমিতি—

আশীর্বাদক
সচ্চিদানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৭
ওরিয়েণ্টাল হোটেল
ইয়োকোহামা
১০ জুলাই, ১৮৯৩

প্রিয় আলাসিঙ্গা, বালাজী, জি. জি. ও অন্যান্য মান্দ্রাজী বন্ধুগণ,
আমার গতিবিধি সম্বন্ধে তোমাদের সর্বদা খবর দেওয়া আমার উচিত ছিল, আমি তা করিনি, সেজন্য আমায় ক্ষমা করবে। এরূপ দীর্ঘ ভ্রমণে প্রত্যহই বিশেষ ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। বিশেষতঃ আমার তো কখনও নানা জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে ঘোরা অভ্যাস ছিল না। এখন এই সব যা সঙ্গে নিতে হয়েছে, তার তত্ত্বাবধানেই আমার সব শক্তি খরচ হচ্ছে। বাস্তবিক, এ এক বিষম ঝঞ্ঝাট!

বম্বাই ছেড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে কলম্বো পৌঁছলাম। জাহাজ প্রায় সারাদিন বন্দরে ছিল। এই সুযোগ আমি নেমে শহর দেখতে গেলাম। গাড়ী করে কলম্বোর রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম। সেখানকার কেবল বুদ্ধ-ভগবানের মন্দিরটির কথা আমার স্মরণ আছে; তথায় বুদ্ধদেবের এক বৃহৎ পরিনির্বাণ-মূর্তি শয়ান অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতগণের সহিত আলাপ করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাঁরা সিংহলী ভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা জানেন না বলে আমাকে আলাপের চেষ্টা ত্যাগ করতে হল। ওখান থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে সিংহলের মধ্যদেশে অবস্থিত কাণ্ডি শহর সিংহলী বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র, কিন্তু আমার সেখানে যাবার সময় ছিল না। এখানকার গৃহস্থ বৌদ্ধগণ—কি পুরুষ কি স্ত্রী—সকলেই মৎস্যমাংস-ভোজী, কেবল পুরোহিতগণ নিরামিষাশী। সিংহলীদের পরিচ্ছদ ও চেহারা তোমাদের মান্দ্রাজীদেরই মত। তাদের ভাষা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না; তবে উচ্চারণ শুনে বোধ হয়, উহা তোমাদের তামিলের অনুরূপ।

পরে জাহাজ পিনাঙে লাগল; উহা মালয় উপদ্বীপে সমুদ্রের উপরে একটি ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড মাত্র। উহা খুব ক্ষুদ্র শহর বটে, কিন্তু অন্যান্য সুনির্মিত নগরীর ন্যায় খুব পরিষ্কার-ঝরিষ্কার। মালয়বাসিগণ সবই মুসলমান। প্রাচীনকালে এরা ছিল সওদাগরি জাহাজসমূহের বিশেষ ভীতির কারণ—বিখ্যাত জলদস্যু। কিন্তু এখনকার বুরুজওয়ালা যুদ্ধজাহাজের প্রকাণ্ড কামানের চোটে মালয়বাসিগণ অপেক্ষাকৃত কম হাঙ্গামার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।

পিনাং থেকে সিঙ্গাপুর চললাম। পথে দূর হতে উচ্চশৈল-সমন্বিত সুমাত্রা দেখতে পেলাম; আর কাপ্তেন আমাকে প্রাচীনকালে জলদস্যুগণের কয়েকটি আড্ডা অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাতে লাগলেন। সিঙ্গাপুর প্রণালী-উপনিবেশের (Straits Settlement) রাজধানী। এখানে একটি সুন্দর উদ্ভিদ্-উদ্যান আছে, তথায় অনেক জাতীয় ভাল ভাল ‘পাম’ সংগৃহীত। ‘ভ্রমণকারীর পাম’ (Traveller’s Palm) নামক সুন্দর তালবৃন্তবৎ পাম এখানে অপর্যাপ্ত জন্মায়, আর ‘রুটিফল’ (bread fruits) বৃক্ষ তো এখানে সর্বত্র। মান্দ্রাজে যেমন আম অপর্যাপ্ত, এখানে তেমন বিখ্যাত ম্যাঙ্গোষ্টিন অপর্যাপ্ত, তবে আমের সঙ্গে আর কিসের তুলনা হতে পারে? এখানকার লোকে মান্দ্রাজীদের অর্ধেক কালোও হবে না, যদিও এ স্থান মান্দ্রাজ অপেক্ষা বিষুবরেখার নিকটবর্তী। এখানে একটি সুন্দর যাদুঘরও (Museum) আছে। এখানে পানদোষ ও লাম্পট্য বেশী মাত্রায় বিরাজমান, এটাই এখানকার ইওরোপীয় ঔপনিবেশিকগণের যেন প্রথম কর্তব্য। আর প্রত্যেক বন্দরেই জাহাজের প্রায় অর্ধেক নাবিক নেমে এরূপ স্থানের অন্বেষণ করে, যেখানে সুরা ও সঙ্গীতের প্রভাবে নরক রাজত্ব করে। থাক সে কথা।

তারপর হংকং। সিঙ্গাপুর মালয় উপদ্বীপের অন্তর্গত হলেও সেখান থেকেই মনে হয় যেন চীনে এসেছি—চীনের ভাব সেখানে এতই প্রবল। সকল মজুরের কাজ, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বোধ হয় তাদেরই হাতে। আর হংকং তো খাঁটি চীন; যাই জাহাজ কিনারায় নোঙর করে, অমনি শত শত চীনে নৌকা এসে ডাঙায় নিয়ে যাবার জন্য তোমায় ঘিরে ফেলবে। এই নৌকাগুলো একটু নূতন রকমের—প্রত্যেকটিতে দুটি করে হাল। মাঝিরা সপরিবারে নৌকাতেই বাস করে। প্রায়ই দেখা যায়, মাঝিরা স্ত্রীই হালে বসে থাকে, একটি হাল দু হাত দিয়ে ও অপর হাল এক পা দিয়ে চালায়। আর দেখা যায় যে, শতকরা নব্বই জনের পিঠে একটি কচি ছেলে এরূপভাবে একটি থলির মত জিনিষ দিয়ে বাঁধা থাকে, যাতে সে হাত-পা অনায়াসে খেলাতে পারে। চীনে-খোকা কেমন মায়ের পিঠে সম্পূর্ণ শান্তভাবে ঝুলে আছে, আর ওদিকে মা—কখনও তাঁর সব শক্তি প্রয়োগ করে নৌকা চালাচ্ছেন, কখনও ভারী ভারী বোঝা ঠেলছেন, অথবা অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় লাফিয়ে যাচ্ছেন—এ এক বড় মজার দৃশ্য! আর এত নৌকা ও ষ্টীম-লঞ্চ ভীড় করে ক্রমাগত আসছে যাচ্ছে যে, প্রতিমুহূর্তে চীনে-খোকার টিকি-সমেত ছোট মাথাটি একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে; খোকার কিন্তু সে দিকে খেয়ালই নেই। তার পক্ষে এই মহাব্যস্ত কর্মজীবনের কোন আকর্ষণ নাই। তার পাগলের মত ব্যস্ত মা মাঝে মাঝে তাকে দু-এক খানা চালের পিঠে দিচ্ছেন, সে ততক্ষণ তার গঠনতন্ত্র (anatomy) জেনেই সন্তুষ্ট।

চীনে-খোকা একটি রীতিমত দার্শনিক। যখন ভারতীয় শিশু হামাগুড়ি দিতেও অক্ষম, এমন বয়সে সে স্থিরভাবে কাজ করতে যায়। সে বিশেষরূপেই প্রয়োজনীয়তার দর্শন শিখেছে। চীন ও ভারতবাসী যে ‘মমিতে’ পরিণতপ্রায় এক প্রাণহীন সভ্যতার স্তরে আটকে পড়েছে, অতি দারিদ্র্যই তার অন্যতম কারণ। সাধারণ হিন্দু বা চীনবাসীর পক্ষে তার প্রাত্যহিক অভাব এতই ভয়ানক যে, তাকে আর কিছু ভাববার অবসর দেয় না।

হংকং অতি সুন্দর শহর—পাহাড়ের ঢালুর উপর নির্মিত; পাহাড়ের উপরেও অনেক বড়লোক বাস করে; ইহা শহর অপেক্ষা অনেক ঠাণ্ডা। পাহাড়ের উপরে প্রায় খাড়াভাবে ট্রাম-লাইন গিয়েছে; তারের দড়ির সংযোগে এবং বাষ্পীয় বলে ট্রামগুলি উপরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমরা হংকঙে তিন দিন ছিলাম। সেখানে থেকে ক্যাণ্টন দেখতে গিয়েছিলাম, হংকং থেকে একটি নদী ধরে ৮০ মাইল উজিয়ে ক্যাণ্টনে যেতে হয়। নদীটি এত চওড়া যে, খুব বড় বড় জাহাজ পর্যন্ত যেতে পারে। অনেকগুলো চীনে জাহাজ হংকং ও ক্যাণ্টনের মধ্যে যাতায়াত করে। আমরা বিকেলে একখানি জাহাজে চড়ে পরদিন প্রাতে ক্যাণ্টনে পৌঁছলাম। প্রাণের স্ফূর্তি ও কর্মব্যস্ততা মিলে এখানে কি হইচই! নৌকার ভীড়ই বা কি! জল যেন ছেয়ে ফেলেছে! এ শুধু মাল ও যাত্রী নিয়ে যাবার নৌকা নয়, হাজার হাজার নৌকা রয়েছে গৃহের মত বাসোপযোগী। তাদের মধ্যে অনেকগুলো অতি সুন্দর, অতি বৃহৎ। বাস্তবিক সেগুলো দুতলা তেতলা বাড়ীর মত, চারিদিকে বারাণ্ডা রয়েছে, মধ্যে দিয়ে রাস্তা গেছে; কিন্তু সব জলে ভাসছে!!

আমরা যেখানে নামলাম, সেই জায়গাটুকু চীন গভর্ণমেণ্ট বৈদেশিকদের বাস করবার জন্য দিয়েছেন; এর চতুর্দিকে, নদীর উভয় পার্শ্বে অনেক মাইল জুড়ে এই বৃহৎ শহর অবস্থিত—এখানে অগণিত মানুষ বাস করছে, জীবন-সংগ্রামে একজন আর একজনকে ঠেলে ফেলে চলেছে—প্রাণপণে জীবন-সংগ্রামে জয়ী হবার চেষ্টা করছে। মহা কলরব—মহা ব্যস্ততা! কিন্তু এখানকার অধিবাসিসংখ্যা যতই হোক, এখানকার কর্মপ্রবণতা যতই হোক, এর মত ময়লা শহর আমি দেখিনি। তবে ভারতবর্ষের কোন শহরকে যে হিসেবে আবর্জনাপূর্ণ বলে, সে হিসেবে বলছি না, চীনেরা তো এতটুকু ময়লা পর্যন্ত বৃথা নষ্ট হতে দেয় না; চীনেদের গা থেকে যে বিষম দুর্গন্ধ বেরোয়, তার কথাই বলছি, তারা যেন ব্রত নিয়েছে, কখনও স্নান করবে না।

প্রত্যেক বাড়ীখানি এক একখানি দোকান—লোকেরা উপরাতলায় বাস করে। রাস্তাগুলো এত সরু যে, চলতে গেলেই দুধারের দোকান যেন গায়ে লাগে। দশ পা চলতে না চলতে মাংসের দোকান দেখতে পাবে; এমন দোকানও আছে, যেখানে কুকুর-বেড়ালের মাংস বিক্রয় হয়। অবশ্য খুব গরীবেরাই কুকুর-বেড়াল খায়।

আর্যাবর্তনিবাসিনী হিন্দু মহিলাদের যেমন পর্দা আছে, তাদের যেমন কেউ কখনও দেখতে পায় না, চীনা মহিলাদেরও তদ্রূপ। অবশ্য শ্রমজীবী স্ত্রীলোকেরা লোকের সামনে বেরোয়। এদের মধ্যেও দেখা যায়, এক একটি স্ত্রীলোকের পা তোমাদের ছোট খোকার পায়ের চেয়ে ছোট; তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে ঠিক বলা যায় না. খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে থপ থপ করে চলছে।

আমি কতকগুলি চীনে মন্দির দেখতে গেলাম। ক্যাণ্টনে যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ মন্দিরটি আছে, তা প্রথম বৌদ্ধ সম্রাট্ এবং সর্বপ্রথম ৫০০ জন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর স্মরণার্থে উৎসর্গীকৃত। অবশ্য স্বয়ং বুদ্ধদেব প্রধান মূর্তি; তাঁর নীচেই সম্রাট্ বসেছেন, আর দুধারে শিষ্যগণের মূর্তি—সব মূর্তিগুলিই কাঠে সুন্দররূপে খোদিত।

ক্যাণ্টন হতে আমি হংকঙে ফিরলাম। সেখান থেকে জাপানে গেলাম। নাগাসাকি বন্দরে প্রথমেই কিছুক্ষণের জন্য আমাদের জাহাজ লাগল। আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্য জাহাজ থেকে নেমে শহরের মধ্যে গাড়ী করে বেড়ালাম। চীনের সহিত কি প্রভেদ! পৃথিবীর মধ্যে যত পরিষ্কার জাত আছে, জাপানীরা তাদের অন্যতম। এদের সবই কেমন পরিষ্কার! রাস্তাগুলো প্রায় সবই চওড়া সিধে ও বরাবর সমানভাবে বাঁধানো। খাঁচার মত এদের ছোট ছোট দিব্যি বাড়ীগুলো, প্রায় প্রতি শহর ও পল্লীর পশ্চাতে অবস্থিত চিড়গাছে ঢাকা চিরহরিৎ ছোট ছোট পাহাড়গুলো, বেঁটে সুন্দরকায় অদ্ভুত-বেশধারী জাপ, তাদের প্রত্যেক চালচলন অঙ্গভঙ্গী হাবভাব—সবই ছবির মত। জাপান ‘সৌন্দর্যভূমি’। প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর পেছনে এক-একখানি বাগান আছে—তা জাপানী ফ্যাশনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুল্মতৃণাচ্ছাদিত ভূমিখণ্ড, ছোট ছোট কৃত্রিম জলপ্রণালী এবং পাথরের সাঁকো দিয়ে ভালরূপে সাজান।

নাগাসাকি থেকে কোবি গেলাম। কোবি গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিলাম, স্থলপথে ইয়োকোহামায় এলাম—জাপানের মধ্যবর্তী প্রদেশসমূহ দেখবার জন্য। আমি জাপানের মধ্যপ্রদেশে তিনটি বড় বড় শহর দেখেছি। ওসাকা—এখানে নানা শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হয়; কিয়োটা—প্রাচীন রাজধানী; টোকিও—বর্তমান রাজধানী; টোকিও কলিকাতার প্রায় দ্বিগুণ হবে। লোকসংখ্যাও প্রায় কলিকাতার দ্বিগুণ।

ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশীকে জাপানের ভিতরে ভ্রমণ করতে দেয় না।

দেখে বোধ হয়—জাপানীরা বর্তমানকালে কি প্রয়োজন, তা বুঝেছে; তারা সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হয়েছে। ওদের সম্পূর্ণরূপে শিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত স্থল-সৈন্য আছে। ওদের যে কামান আছে, তা ওদেরই একজন কর্মচারী আবিষ্কার করেছেন। সকলেই বলে, উহা কোন জাতির কামানের চেয়ে কম নয়। আর তারা তাদের নৌবলও ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। আমি একজন জাপানী স্থপতি-নির্মিত প্রায় এক মাইল লম্বা সকটি সুড়ঙ্গ (tunnel) দেখেছি।

এদের দেশলাই-এর কারখানা একটা দেখবার জিনিষ। এদের যে-কোন জিনিষের অভাব, তাই নিজের দেশে করবার চেষ্টা করছে। জাপানীদের নিজেদের একটি ষ্টীমার লাইনের জাহাজ চীন ও জাপানের মধ্যে যাতায়াত করে; আর এরা শীঘ্রই বোম্বাই ও ইয়োকোহামার মধ্যে জাহাজ চালাবে, মতলব করছে।

আমি এদের অনেকগুলি মন্দির দেখলাম। প্রত্যেক মন্দির কতকগুলি সংস্কৃত মন্ত্র প্রাচীন বাঙলা অক্ষরে লেখা আছে। মন্দিরে পুরোহিতদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সংস্কৃত বোঝে। কিন্তু এরা বেশ বুদ্ধিমান্। বর্তমানকালে সর্বত্রই যে একটা উন্নতির জন্য প্রবল তৃষ্ণা দেখা যায়, তা পুরোহিতদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে। জাপানীদের সম্বন্ধে আমার মনে কত কথা উদিত হচ্ছে, তা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে প্রকাশ করে বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের দেশের যুবকেরা দলে দলে প্রতি বৎসর চীন ও জাপানে যাক। জাপানে যাওয়া আবার বিশেষ দরকার; জাপানীদের কাছে ভারত এখনও সর্বপ্রকার উচ্চ ও মহৎ পদার্থের স্বপ্নরাজ্যস্বরূপ।

আর তোমরা কি করছ? সারা জীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের দেখে যাও, তারপর যাও—গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকাও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরছে! তোমরা—দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!! এই হাজার বছরের ক্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ, হাজার বছর ধরে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতা বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ! পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ! শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তোমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে—তোমরা কী বল দেখি? আর তোমরা এখন করছই বা কি? আহাম্মক, তোমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ! ইওরোপীয় মস্তিস্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিষ নয়—সেই চিন্তার বদহজম খানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছ, আর তোমাদের প্রাণমন সেই ৩০৲ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; না হয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ। ইহাই ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা। আবার প্রত্যেক ছাত্রের আশেপাশে একপাল ছেলে—তাঁর বংশধরগণ—‘বাবা, খাবার দাও, খাবার দাও’ করে উচ্চ চীৎকার তুলেছে!! বলি, সমুদ্রে কি জলের অভাব হয়েছে যে, তোমাদের বই, গাউন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রভৃতি সমেত তোমাদের ডুবিয়ে ফেলতে পারে না?

এস, মানুষ হও। প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। তাদের হৃদয়ের কখনও প্রসার হবে না। শত শত শতাব্দীর কুসংস্কার ও অত্যাচারের ফলে তাদের উদ্ভব; আগে তাদের নির্মূল কর। এস, মানুষ হও। নিজেদের সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালবাসো? তা হলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য—উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। পেছনে চেও না—অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন কাঁদুক; পেছনে চেও না, সামনে এগিয়ে যাও।

ভারতমাতা অন্ততঃ সহস্র যুবক বলি চান। মনে রেখো—মানুষ চাই, পশু নয়। প্রভু তোমাদের এই বাঁধাধরা সভ্যতা ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্ণমেণ্টকে প্রেরণ করেছেন, আর মান্দ্রাজের লোকই ইংরেজদের ভারতে বসবার প্রধান সহায় হয়। এখন জিজ্ঞাসা করি, সমাজের এই নূতন অবস্থা আনবার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রাণপণ যত্ন করবে, মান্দ্রাজ এমন কতকগুলি নিঃস্বার্থ যুবক দিতে কি প্রস্তুত—যারা দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে, তাদের ক্ষুধার্তমুখে অন্ন দান করবে, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে, আর তোমাদের পূর্বপুরুষগণের অত্যাচার যারা পশুপদবীতে উপনীত হয়েছে, তাদের মানুষ করবার জন্য আমরণ চেষ্টা করবে?

… কুক কোম্পানী, চিকাগো—এই ঠিকানায় আমাকে পত্র লিখবে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—ধীর, নিস্তব্ধ অথচ দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। খবরের কাগজে হুজুক করা নয়। সর্বদা মনে রাখবে, নামযশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৮ 
ব্রিজি মেডোজ
মেটকাফ, মাসাচুসেটস
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কাল তোমার পত্র পাইলাম। তুমি বোধ হয় এত দিনে জাপান হইতে [লেখা] আমার পত্র পাইয়াছ। জাপান হইতে আমি বঙ্কুবরে৩১ (Vancouver) পৌঁছিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশ দিয়া আমাকে যাইতে হইয়াছিল। খুব শীত ছিল। গরম কাপড়ের অভাবে বড় কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। যাহা হউক, কোনরূপে বঙ্কুবরে পৌঁছিয়া তথা হইতে কানাডা দিয়া চিকাগোয় পৌঁছিলাম। তথায় আন্দাজ বার দিন রহিলাম। এখানে প্রায় প্রতিদিনই মেলা দেখিতে যাইতাম। সে এক বিরাট ব্যাপার। অন্ততঃ দশ দিন না ঘুরিলে সমুদয় দেখা অসম্ভব। বরদা রাও যে মহিলাটির সঙ্গে আমার আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি ও তাঁহার স্বামী চিকাগো সমাজের মহা গণামান্য ব্যক্তি। তাঁহারা আমার প্রতি খুব সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু এখানকার লোকে বিদেশীকে খুব যত্ন করিয়া থাকে, কেবল অপরকে তামাসা দেখাইবার জন্য; অর্থসাহায্য করিবার সময় প্রায় সকলেই হাত গুটাইয়া লয়। এবার এখানে বড় দুর্বৎসর, ব্যবসায়ে সকলেরই ক্ষতি হইতেছে, সুতরাং আমি চিকাগোয় অধিক দিন রহিলাম না। চিকাগো হইতে আমি বষ্টনে আসিলাম। লালুভাই বষ্টন পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনিও আমার প্রতি খুব সহৃদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। …

এখানে আমার খরচ ভয়ানক হইতেছে। তোমার স্মরণ আছে তুমি আমায় ১৭০ পাউণ্ড নোট ও নগদ ৯ পাউণ্ড দিয়াছিলেন। এখন দাঁড়াইয়াছে ১৩০ পাউণ্ড। গড়ে আমার এক পাউণ্ড করিয়া প্রত্যহ খরচ পড়িতেছে। এখানে একটা চুরুটের দামই আমাদের দেশের আট আনা। আমেরিকানরা এত ধনী যে, তাহারা জলের মত টাকা খরচ করে, আর তাহারা আইন করিয়া সব জিনিষের মূল্য এত বেশী রাখিয়াছে যে, জগতের অপর কোন জাতি যেন কোনমতে এ দেশে ঘেঁষিতে না পারে। সাধারণ কুলি গড়ে প্রতিদিন ৯৲।১০৲ টাকা করিয়া রোজগার করে ও উহা খরচ করিয়া থাকে। এখানে আসিবার পূর্বে যে-সব সোনার স্বপন দেখিতাম, তাহা ভাঙিয়াছে। এক্ষণে অসম্ভবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইতেছে। শত শত বার মনে হইয়াছে, এ দেশ হইতে চলিয়া যাই; কিন্তু আবার মনে হয়, আমি একগুঁয়ে দানা, আর আমি ভগবানের নিকট আদেশ পাইয়াছি। আমি কোন পথ দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু তাঁহার চক্ষু তো সব দেখিতেছে। মরি বাঁচি, উদ্দেশ্য ছাড়িতেছি না।

তুমি অনুগ্রহপূর্বক থিওজফিষ্টদের সম্বন্ধে আমাকে যে সাবধান করিয়াছ, তাহা ছেলেমানুষি বলিয়া বোধ হয়। এ গোঁড়া খ্রীষ্টানের দেশ—এখানে কেহ উহাদের খোঁজ খবর রাখে না বলিলেই হয়। এখনও পর্যন্ত কোন থিওজফিষ্টের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই, আর দু-এক বার অপরকে—কথাপ্রসঙ্গে উহাদের বিষয় অতিশয় ঘৃণার সহিত উল্লেখ করিতে শুনিয়াছি। আমেরিকানরা উহাদিগকে জুয়াচোর বলিয়া মনে করে।

আমি এক্ষণে বষ্টনের এক গ্রামে এক বৃদ্ধা মহিলার অতিথিরূপে বাস করিতেছি। ইঁহার সহিত রেলগাড়ীতে হঠাৎ আলাপ হয়। তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার নিকট রাখিয়াছেন। এখানে থাকায় আমার এই সুবিধা হইয়াছে যে, প্রত্যহ এক পাউণ্ড করিয়া যে খরচ হইতেছিল, তাহা বাঁচিয়া যাইতেছে; আর তাঁহার লাভ এই যে, তিনি তাঁহার বন্ধুগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া ভারতাগত এক অদ্ভুত জীব দেখাইতেছেন!!! এ সব যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবেই। আমাকে এখন অনাহার, শীত, অদ্ভুত পোষাকের দরুন রাস্তার লোকের বিদ্রূপ—এইগুলির সহিত যুদ্ধ করিয়া চলিতে হইতেছে। প্রিয় বৎস! জানিবে, কোন বড় কাজই গুরুতর পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার ব্যতীত হয় নাই। আমার মহিলাবন্ধুর এক জ্ঞাতিভাই আজ আমাকে দেখিতে আসিবেন। তিনি তাঁহার ভগিনীকে লিখিতেছেন, ‘প্রকৃত হিন্দু সাধককে দেখিয়া বিশেষ আনন্দ ও শিক্ষা হইতে পারে সন্দেহ নাই, তবে আমি এখন বুড়া হইয়াছি। এসোটেরিক বৌদ্ধগণ আমাকে আর ঠকাইতে পারিতেছে না।’ এই তো এখানে থিয়োজফির প্রভাব এবং উহার প্রতি ইহাদের শ্রদ্ধা! ‘মো—’র এক সময় বষ্টনের একটি খুব ধনী মহিলার কাছে বিশেষ খাতির ছিল, কিন্তু ‘মো-’র দরুনই বিশেষ উহাদের সব পসার মাটি হইয়াছে। এখন উক্ত মহিলা ‘এসোটেরিক বৌদ্ধধর্ম’ ও ঐরূপ সমুদয় ব্যাপারের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।

জানিয়া রাখো, এই দেশ খ্রীষ্টানের দেশ। এখানে আর কোন ধর্ম বা মতের প্রতিষ্ঠা কিছুমাত্র নাই বলিলেই হয়। আমি জগতে কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার ভয় করি না। আমি এখানে মেরী-তনয়ের সন্তানগণের মধ্যে বাস করিতেছি; প্রভু ঈশাই আমাকে সাহায্য করিবেন। একটি জিনিষ দেখিতে পাইতেছি; ইঁহারা আমার হিন্দুধর্মসম্বন্ধীয় উদার মত ও নাজারেথের অবতারের প্রতি ভালবাসা দেখিয়া খুব আকৃষ্ট হইতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে বলিয়া থাকি যে, আমি সেই গালিলীয় মহাপুরুষের বিরুদ্ধে কিছুমাত্র বলি না, কেবল তাঁহারা যেমন যীশুকে মানেন, সেই সঙ্গে ভারতীয় মহাপুরুষগণকেও মানা উচিত। এ কথা ইঁহারা আদরপূর্বক গ্রহণ করিতেছেন। এখন আমার কার্য এইটুকু হইয়াছে যে, লোকে আমার সম্বন্ধে কতকটা জানিতে পারিয়াছে ও বলাবলি করিতেছে। এখানে এইরূপেই কার্য আরম্ভ করিতে হইবে। ইহাতে দীর্ঘ সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এখন শীত আসিতেছে। আমাকে সকল রকম গরম কাপড় যোগাড় করিতে হইবে, আবার এখানকার অধিবাসী অপেক্ষা আমাদের অধিক কাপড়ের আবশ্যক হয়। … বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ভগবানের ইচ্ছায় ভারতে আমাদের দ্বারা বড় বড় কার্য সম্পন্ন হইবে। বিশ্বাস কর, আমরাই মহৎ কর্ম করিব, এই গরীব আমরা—যাহাদের লোকে ঘৃণা করে, কিন্তু যাহারা লোকের দুঃখ যথার্থ প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছে। রাজারাজড়াদের দ্বারা মহৎ কার্য হইবার আশা অতি অল্প।

চিকাগোয় সম্প্রতি একটা বড় মজা হইয়া গিয়াছে। কপুরতলার রাজা এখানে আসিয়াছিলেন, আর চিকাগো সমাজের কতকাংশ তাঁহাকে কেষ্ট-বিষ্টু করিয়া তুলিয়াছিল। মেলার জায়গায় এই রাজার সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি বড় লোক, আমার মত ফকিরের সঙ্গে কথা কহিবেন কেন? এখানে একটি পাগলাটে, ধুতিপরা মারাঠী ব্রাহ্মণ মেলায় কাগজের উপর নখের সাহায্যে প্রস্তুত ছবি বিক্রয় করিতেছিল। এ লোকটা খবরের কাগজের রিপোর্টারদের নিকট রাজার বিরুদ্ধে নানা কথা বলিয়াছিল; সে বলিয়াছিল—এ ব্যক্তি খুব নীচ জাতি, এই রাজারা ক্রীতদাসস্বরূপ, ইহারা দুর্নীতিপরায়ণ ইত্যাদি; আর এই সত্যবাদী (?) সম্পাদকেরা—যাহার জন্য আমেরিকা বিখ্যাত—এই লোকটার কথায় কিছু গুরুত্ব-আরোপের ইচ্ছায় তার পরদিন সংবাদপত্রে বড় বড় স্তম্ভ বাহির করিল, তাহারা ভারতাগত একজন জ্ঞানী পুরুষের বর্ণনা করিল—অবশ্য আমাকেই লক্ষ্য করিয়াছিল। আমাকে স্বর্গে তুলিয়া দিয়া আমার মুখ দিয়া তাহারা এমন সকল কথা বাহির করিল, যাহা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই; তারপর এই রাজার সম্বন্ধে মারাঠী ব্রাহ্মণটি যাহা যাহা বলিয়াছিল, সব আমার মুখে বসাইল। আর তাহাতেই চিকাগো সমাজ একটা ধাক্কা খাইয়া তাড়াতাড়ি রাজাকে পরিত্যাগ করিল। এই মিথ্যাবাদী সম্পাদকেরা আমাকে দিয়া আমার দেশের লোককে বেশ ধাক্কা দিলেন। যাহা হউক—ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, এই দেশে টাকা অথবা উপাধির জাঁকজমক অপেক্ষা বুদ্ধির আদর বেশী।

কাল নারী-কারাগারের অধ্যক্ষা মিসেস্ জন‍্সন্ মহোদয়া এখানে আসিয়াছিলেন; এখানে কারাগার বলে না, বলে—সংশোধনাগার। আমেরিকায় যাহা যাহা দেখিলাম, তাহার মধ্যে ইহা এক অতি অদ্ভুত জিনিষ। কারাবাসিগণের সহিত কেমন সহৃদয় ব্যবহার করা হয়, কেমন তাহাদের চরিত্র সংশোধিত হয়, আবার তাহারা ফিরিয়া গিয়া সমাজের আবশ্যকীয় অঙ্গরূপে পরিণত হয়! কি অদ্ভুত, কি সুন্দর! না দেখিলে তোমাদের বিশ্বাস হইবে না। ইহা দেখিয়া তারপর যখন দেশের কথা ভাবিলাম, তখন আমার প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল। ভারতবর্ষে আমরা গরীবদের, সামান্য লোকদের, পতিতদের কি ভাবিয়া থাকি! তাহাদের কোন উপায় নাই, পালাইবার কোন রাস্তা নাই, উঠিবার কোন উপায় নাই। ভারতের দরিদ্র, ভারতের পতিত, ভারতের পাপিগণের সাহায্যকারী কোন বন্ধু নাই। সে যতই চেষ্টা করুক, তাহার উঠিবার উপায় নাই। তাহারা দিন দিন ডুবিয়া যাইতেছে। রাক্ষসবৎ নৃশংস সমাজ তাহাদের উপর ক্রমাগত যে আঘাত করিতেছে, তাহার বেদনা তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছে, কিন্তু তাহারা জানে না—কোথা হইতে ঐ আঘাত আসিতেছে। তাহারাও যে মানুষ, ইহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহার ফল দাসত্ব ও পশুত্ব। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ কিছুদিন হইতে সমাজের এই দুরবস্থা বুঝিয়াছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহারা হিন্দুধর্মের ঘাড়ে এই দোষ চাপাইয়াছেন। তাঁহারা মনে করেন, জগতের মধ্যে এই মহত্তর ধর্মের নাশই সমাজের উন্নতির একমাত্র উপায়। শোন বন্ধু, প্রভুর কৃপায় আমি ইহার রহস্য আবিষ্কার করিয়াছি। হিন্দুধর্মের কোন দোষ নাই। হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন—জগতে যত প্রাণী আছে, সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থার কারণ, কেবল এই তত্ত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব, হৃদয়ের অভাব। প্রভু তোমাদের নিকট বুদ্ধরূপে আসিয়া শিখাইলেন তোমাদিগকে গরীবের জন্য, দুঃখীর জন্য, পাপীর জন্য প্রাণ কাঁদাইতে, তাহাদের সহিত সহানুভূতি করিতে; কিন্তু তোমরা তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলে না। তোমাদের পুরোহিতগণ—ভগবান্ ভ্রান্তমত-প্রচার দ্বারা অসুরদিগকে মোহিত করিতে আসিয়াছিলেন, এই ভয়ানক গল্প বানাইলেন। সত্য বটে, কিন্তু অসুর আমরা; যাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহারা নহে। আর যেমন য়াহুদীরা প্রভু যীশুকে অস্বীকার করিয়া আজ সমগ্র জগতে গৃহশূন্য ভিক্ষুক হইয়া সকলের দ্বারা অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হইয়া বেড়াইতেছে, সেইরূপ তোমরাও যে-কোন জাতি ইচ্ছা করিতেছে, তাহাদেরই ক্রীতদাস হইতেছ। অত্যাচারিগণ! তোমরা জান না যে, অত্যাচার ও দাসত্ব এক জিনিষেরই এপিঠ ওপিঠ। দুই-ই এক কথা।

বালাজী ও জি.জি-র স্মরণ থাকিতে পারে, একদিন সায়ংকালে পণ্ডিচেরীতে এক পণ্ডিতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক হইতেছিল। তাহার সেই বিকট ভঙ্গী ও তাহার ‘কদাপি ন’ (কখনও না)—এই কথা চিরকাল আমার স্মরণ থাকিবে। ইহাদের অজ্ঞতার গভীরতা দেখিয়া অবাক হইতে হয়। তাহারা জানে না, ভারত জগতের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ, আর সমুদয় জগৎ এই ত্রিশ কোটি লোককে অতি ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে। তাহারা দেখে, এরা কীটতুল্য, ভারতের মনোরম ক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছে, এবং এ উহার উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করিতেছে। সমাজের এই অবস্থাকে দূর করিতে হইবে ধর্মকে বিনষ্ট করিয়া নহে, পরন্তু হিন্দুধর্মের মহান্ উপদেশসমূহ অনুসরণ করিয়া এবং তাহার সহিত হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক পরিণতিস্বরূপ বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত হৃদয়বত্তা লইয়া। লক্ষ লক্ষ নরনারী পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, ভগবানে দৃঢ় বিশ্বাসরূপ বর্মে সজ্জিত হইয়া দরিদ্র পতিত ও পদদলিতদের প্রতি সহানুভূতিজনিত সিংহবিক্রমে বুক বাঁধুক এবং মুক্তি, সেবা, সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যের মঙ্গলময়ী বার্তা দ্বারে দ্বারে বহন করিয়া সমগ্র ভারতে ভ্রমণ করুক।

হিন্দুধর্মের ন্যায় আর কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম এরূপ করে না। ভগবান্ আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, ইহাতে ধর্মের কোন দোষ নাই। তবে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত আত্মাভিমানী কতকগুলি ভণ্ড ‘পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক’৩২ নামক মত দ্বারা সর্বপ্রকার অত্যাচারের আসুরিক যন্ত্র ক্রমাগত আবিষ্কার করিতেছে।

নিরাশ হইও না। স্মরণ রাখিও, ভগবান্ গীতায় বলিতেছেন, ‘কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়।’ কোমর বাঁধো, বৎস, প্রভু আমাকে এই কাজের জন্য ডাকিয়াছেন। সারা জীবন আমার নানা দুঃখযন্ত্রণার মধ্যেই কাটিয়াছে। আমি প্রাণপ্রিয় আত্মীয়গণকে একরূপ অনাহারে মরিতে দেখিয়াছি। লোকে আমাকে উপহাস ও অবজ্ঞা করিয়াছে, জুয়াচোরে বদমাশ বলিয়াছে (মান্দ্রাজের অনেকে এখনও আমাকে এইরূপ ভাবিয়া থাকে)। আমি এ সমস্তই সহ্য করিয়াছি তাহাদেরই জন্য, যাহারা আমাকে উপহাস ও ঘৃণা করিয়াছে। বৎস! এই জগৎ দুঃখের আগার বটে, কিন্তু ইহা মহাপুরুষগণের শিক্ষালয়স্বরূপ। এই দুঃখ হইতেই সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা, সর্বোপরি অদম্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়, যে শক্তিবলে মানুষ সমগ্র জগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেলেও একটু কম্পিত হয় না। যাহারা আমাকে ভণ্ড বিবেচনা করে, তাহাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তাহাদের কিছু দোষ নাই। তাহারা শিশু, অতি শিশু, যদিও সমাজে তাহারা মহাগণ্যমান্য বলিয়া বিবেচিত। তাহাদের চক্ষু নিজেদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিসীমার বাহিরে আর কিছু দেখিতে পায় না। তাহাদের নিয়মিত কার্য—আহার, পান, অর্থোপার্জন ও বংশবৃদ্ধি—যেন গণিতের নিয়মে অতি সুশৃঙ্খলভাবে পর পর সম্পাদিত হইয়া চলিয়াছে। ইহার অতিরিক্ত আর কিছু তাহারা জানে না। বেশ সুখী তাহারা! তাহাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয় না। শত শত শতাব্দীর পাশব অত্যাচারের ফলে সমুত্থিত শোক, তাপ, দৈন্য ও পাপের যে কাতরধ্বনিতে ভারতাকাশ সমাকুল হইয়াছে, তাহাতেও তাহাদের জীবন সম্বন্ধে দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না! সেই শত শত যুগব্যাপী মানসিক, নৈতিক ও দৈহিক অত্যাচারের কথা যাহাতে ভগবানের প্রতিমাস্বরূপ মানুষকে ভারবাহী গর্দভে এবং ভগবতীর প্রতিমারূপা নারীকে সন্তান ধারণ করিবার দাসীস্বরূপা করিয়া ফেলিয়াছে এবং জীবন বিষময় করিয়া তুলিয়াছে, এ কথা তাহাদের স্বপ্নেও মনে উদিত হয় না। কিন্তু অন্যান্য অনেকে আছেন, যাঁহারা দেখিতেছেন, প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছেন, হৃদয়ের রক্তময় অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন; যাঁহারা মনে করেন, ইহার প্রতিকার আছে, আর প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যাঁহারা ইহার প্রতিকারে প্রস্তুত আছেন। ‘ইহাদিগকে লইয়াই স্বর্গরাজ্য বিরচিত।’ ইহা কি স্বাভাবিক নহে যে, উচ্চস্তরে অবস্থিত এই সকল মহাপুরুষের—ঐ বিষোদ্গিরণকারী ঘৃণ্য কীটগণের প্রলাপবাক্য শুনিবার মোটেই অবকাশ নাই?

গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নাই—তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর—পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী—তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখো। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর—সাহায্য আসিবেই আসিবে। আমি দ্বাদশ বৎসর হৃদয়ে এই ভার লইয়া ও মাথায় এই চিন্তা লইয়া বেড়াইয়াছি। আমি তথাকথিত অনেক ধনী ও বড়লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াছি, তাহারা আমাকে কেবল জুয়াচোর ভাবিয়াছে। হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করিতে করিতে আমি অর্ধেক পৃথিবী অতিক্রম করিয়া এই বিদেশে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছি। আর আমার স্বদেশের লোকেরাই যখন আমায় জুয়াচোর ভাবে, তখন আমেরিকানরা এক অপরিচিত বিদেশী ভিক্ষুককে অর্থ ভিক্ষা করিতে দেখিলে কত কী-ই না ভাবিবে? কিন্তু ভগবান্ অনন্তশক্তিমান্; আমি জানি, তিনি আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি এই দেশে অনাহারে বা শীতে মরিতে পারি; কিন্তু হে মান্দ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরীব, অজ্ঞ, অত্যাচার-পীড়িতদের জন্য সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা—দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি। যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে—যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহা বলি প্রদান কর; বলি—জীবন-বলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীন দরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য। তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।

এ এক দিনের কাজ নয়। পথ ভীষণ কণ্টকপূর্ণ। কিন্তু পার্থসারথি আমাদের সারথি হইতেই প্রস্তুত, তাহা আমরা জানি। তাঁহার নামে, তাঁহার প্রতি অনন্ত বিশ্বাস রাখিয়া ভারতের শতশতযুগসঞ্চিত পর্বতপ্রমাণ অনন্ত দুঃখরাশিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দাও, উহা ভস্মসাৎ হইবেই হইবে।

তবে এস, ভ্রাতৃগণ! সমস্যাটির অন্তস্তলে প্রবেশ করিয়া ভাল করিয়া দেখ! এ ব্রত গুরুতর, আমরাও ক্ষুদ্রশক্তি। কিন্তু আমরা জ্যোতির তনয়, ভগবানের তনয়। ভগবানের জয় হউক—আমরা সিদ্ধিলাভ করিবই করিব। শত শত লোক এই চেষ্টায় প্রাণ ত্যাগ করিবে, আবার শত শত লোক উহাতে ব্রতী হইতে প্রস্তুত থাকিবে। প্রভুর জয়! আমি এখানে অকৃতকার্য হইয়া মরিতে পারি, আর একজন এই ভার গ্রহণ করিবে! রোগ কি বুঝিলে, ঔষধ কি তাহাও জানিলে, কেবল বিশ্বাসী হও। আমরা ধনী বা বড়লোককে গ্রাহ্য করি না। আমরা হৃদয়শূন্য মস্তিষ্কসার ব্যক্তিগণকে ও তাহাদের নিস্তেজ সংবাদপত্রের প্রবন্ধসমূহও গ্রাহ্য করি না। বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি। জয় প্রভু, জয় প্রভু। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। জয় প্রভু! অগ্রসর হও, প্রভু আমাদের নেতা। পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও, সম্মুখে, সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে।

এই গ্রাম হইতে কাল আমি বষ্টনে যাইতেছি। সেখানে একটি বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা করিতে হইবে। ইহারা (খ্রীষ্টান) রমাবাইকে সাহায্য করিতেছে। বষ্টনে গিয়া আমাকে প্রথমে কাপড় কিনিতে হইবে। সেখানে যদি বেশী দিন থাকিতে হয়, তবে আমার এ অপূর্ব পোষাক চলিবে না। রাস্তায় আমায় দেখিবার জন্য শত শত লোক দাঁড়াইয়া যায়। সুতরাং আমাকে কালো রঙের লম্বা জামা পড়িতে হইবে। কেবল, বক্তৃতার সময় গেরুয়া আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিব। কি করিব? এখানকার মহিলাগণ এই পরামর্শ দিতেছেন। তাঁহারাই এখানকার সর্বময় কর্ত্রী; তাঁহাদের সহানুভূতি না পাইলে চলিবে না। এই পত্র তোমার নিকট পৌঁছিবার পূর্বে আমার সম্বল দাঁড়াইবে ৬০।৭০ পাউণ্ড। অতএব কিছু টাকা পাঠাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে কিছুদিন এখানে থাকা দরকার। আমি ভট্টাচার্য মহাশয়ের জন্য ফনোগ্রাফ দেখিতে যাইতে পারি নাই; কারণ, তাঁহার পত্র এখানে আসিয়া পাইলাম। যদি আবার চিকাগোয় যাই, তবে উহার জন্য চেষ্টা করিব। আমি চিকাগোয় আর যাইব কি না, জানি না। আমার তথাকার বন্ধুগণ আমাকে ভারতের প্রতিনিধি হইতে বলিয়াছিলেন, আর বরদা রাও যে ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি চিকাগো মেলার একজন কর্তা। কিন্তু আমি প্রতিনিধি হইতে অস্বীকার করি, কারণ চিকাগোয় এক মাসের অধিক থাকিতে গেলে আমার সামান্য সম্বল ফুরাইয়া যাইত।

কানাডা ব্যতীত সমগ্র আমেরিকায় রেলগাড়ীতে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস নাই। সুতরাং আমাকে ফার্ষ্ট ক্লাসে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে, কারণ উহা ছাড়া আর ক্লাস নাই। আমি কিন্তু উহার পুলমান গাড়ীতে (Pullmans) চড়িতে ভরসা করি না। এগুলি খুব আরামপ্রদ; এখানে আহার, পান. নিদ্রা, এমন কি স্নানের পর্যন্ত সুবন্দোবস্ত আছে। তুমি যেন হোটেলে রহিয়াছ, বোধ করিবে। কিন্তু ইহাতে বেজায় খরচ।

এখানে সমাজের মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া মহা কঠিন ব্যাপার। বিশেষতঃ এখন কেহ শহরে নাই, সকলেই গ্রীষ্মাবাসে গিয়াছে। শীতে আবার সব শহরে আসিবে, তখন তাহাদিগকে পাইব। সুতরাং আমাকে এখানে কিছুদিন থাকিতে হইবে। এত চেষ্টার পর আমি সহজে ছাড়িতেছি না। তোমরা কেবল যতটা পার, আমায় সাহায্য কর। আর যদি তোমরা নাই পার, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করিয়া দেখিব। আর যদিই আমি এখানে রোগে, শীতে বা অনাহারে মরিয়া যাই, তোমরা এই ব্রত লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে। পবিত্রতা, সরলতা ও বিশ্বাস! আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমার নামে যে-কোন চিঠি বা টাকা আসিবে, কুক কোম্পানীকে তাহা আমার নিকট পাঠাইতে বলিয়া দিয়াছি। ‘রোম এক দিনে নির্মিত হয় নাই।’ যদি তোমরা টাকা পাঠাইয়া আমাকে অন্ততঃ ছয় মাস এখানে রাখিতে পার, আশা করি—সব সুবিধা হইয়া যাইবে। ইতোমধ্যে আমিও যে-কোন কাষ্ঠখণ্ড সম্মুখে পাই, তাহাই ধরিয়া ভাসিতে চেষ্টা করিতেছি। যদি আমার ভরণপোষণের কোন উপায় করিতে পারি, তৎক্ষণাৎ তোমায় তার করিব।

প্রথমে আমেরিকায় চেষ্টা করিব; এখানে অকৃতকার্য হইলে ইংলণ্ডে চেষ্টা করিব। তাহাতেও কৃতকার্য না হইলে ভারতে ফিরিব ও ভগবানের পুনরাদেশের প্রতীক্ষা করিব। ‘রা—’র পিতা ইংলণ্ডে গিয়াছেন। তিনি বাড়ী যাইবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত। তাঁহার অন্তরটা খুব ভাল, উপরটায় কেবল বেনিয়াসুলভ কর্কশতা। চিঠি পৌঁছিতে বিশ দিনের অধিক সময় লাগিবে।

এই নিউ ইংলণ্ডে এখনই এত শীত যে, প্রত্যহ প্রাতে ও রাত্রে আগুন জ্বালাইয়া রাখিতে হয়। কানাডায় আরও শীত। কানাডায় যত নীচু পাহাড়ে বরফ পড়িতে দেখিয়াছি, আর কোথাও সেরূপ দেখি নাই।

আমি আবার এই সোমবারে সেলেমে এক বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা দিতে যাইতেছি। তাহাতে আরও অনেক সভাসমিতির সঙ্গে আমার পরিচয় হইবে। এইরূপে ক্রমশঃ পথ করিতে পারিব। কিন্তু এরূপ করিতে হইলে এই ভয়ানক মহার্ঘ দেশে অনেক দিন থাকিতে হয়। ভারতে টাকার (Rupee) দর চড়িয়া যাওয়ায় লোকের মনে মহা আশঙ্কার উদয় হইয়াছে। অনেক মিল বন্ধ হইয়াছে। সুতরাং এখন সাহায্যের চেষ্টা বৃথা। আমাকে এখন কিছুদিন অপেক্ষা করিতে হইবে।

এইমাত্র দরজীর কাছে গিয়াছিলাম, কিছু শীতবস্ত্রের অর্ডার দিয়া আসিলাম। তাহাতে ৩০০৲ টাকা বা তাহারও বেশী পড়িবে। ইহা যে খুব ভাল কাপড় হইবে, তাহা মনে করিও না, অমনি চলনসই গোছের হইবে। এখানকার স্ত্রীলোকেরা পুরুষের পোষাক সম্বন্ধে বড় খুঁতখুঁতে, আর এদেশে তাহাদেরই প্রভুত্ব। মিশনরীরা ইহাদের ঘাড় ভাঙিয়া যথেষ্ট অর্থ আদায় করে। ইহারা প্রতি বৎসর রমাবাইকে খুব সাহায্য করিতেছে। যদি তোমরা আমাকে এখানে রাখিবার জন্য টাকা পাঠাইতে না পার, এ দেশ হইতে চলিয়া যাইবার জন্য কিছু টাকা পাঠাইও। ইতোমধ্যে যদি অনুকূল কিছু ঘটে, লিখিব বা তার করিব। ‘কেব‍্ল্’ (তার) করিতে প্রতি শব্দে পড়ে ৪৲ টাকা।

তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৬৯
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
সেলেম
৩০ অগষ্ট, ’৯৩

প্রিয় অধ্যাপকজী,৩৩
আজ এখান থেকে আমি চলে যাচ্ছি। মনে হয় চিকাগো থেকে আপনি কিছু উত্তর পেয়েছেন। মিঃ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে পূর্ণ নির্দেশসহ আমন্ত্রণ পেয়েছি। সুতরাং সোমবার সারাটোগায় যাচ্ছি। আপনার গৃহিণীকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন। অষ্টিন ও অন্য শিশুদের ভালবাসা দেবেন। আপনি সত্যই মহাত্মা এবং শ্রীমতী রাইট অতুলনীয়া।

প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭০
সেলেম
শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩

প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার প্রদত্ত পরিচয়পত্র পেয়েই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। চিকাগোর মিঃ থেলিস্ এর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি, যাতে মহাসভার কয়েকজন প্রতিনিধির নাম এবং অন্যান্য সংবাদ আছে।

মিস্ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে প্রেরিত চিঠিতে আপনার সংস্কৃতের অধ্যাপক আমাকে পুরুষোত্তম যোশী বলে ভুল করেছেন, এবং ঐ চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন যে, বষ্টনে এমন একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার আছে, যার তুল্য কিছু ভারতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। গ্রন্থাগারটি দেখতে পেলে আমি কতই না খুশী হব!

‘মিঃ স্যানবর্ন আমাকে সোমবার সারাটোগায় আসতে বলেছেন এবং সেইমত আমি সেখানে যাচ্ছি। সেখানে আমি ‘স্যানাটোরিয়াম’ নামক বোর্ডিঙ হাউসে থাকব। যদি ইতোমধ্যে চিকাগো থেকে কোন সংবাদ আসে, আশা করি অনুগ্রহ করে তা সারাটোগা স্যানাটোরিয়ামে পাঠিয়ে দেবেন।

আপনি, আপনার মহীয়সী পত্নী এবং শিশুসন্তানগুলি আমার মনে এমন ছাপ রেখেছেন, যা কিছুতেই মুছে যাবার নয়। আমি যখন আপনাদের সঙ্গে থাকি, তখন সত্যি মনে হয়—স্বর্গের কাছাকাছি আছি। যিনি সব কিছুর দাতা, তিনি আপনার উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন।

কয়েক লাইন লিখে পাঠাচ্ছি—কবিতার মত করে। এই অত্যাচারটুকু আপনি ভালবেসে ক্ষমা করবেন, এই আশায়।

আপনার চিরবন্ধু
বিবেকানন্দ

পাহাড়ে পর্বতে উপত্যকায়
গীর্জায়, মন্দিরে, মসজিদে—
বেদ বাইবেল আর কোরানে
তোমাকে খুঁজেছি আমি ব্যর্থ ক্রন্দনে।

মহারণ্যে পথভ্রান্ত বালকের মত
কেঁদে কেঁদে ফিরেছি নিঃসঙ্গ,—
তুমি কোথায়—কোথায়—আমার প্রাণ, ওগো ভগবান্‌?
নাই, প্রতিধ্বনি শুধু বলে, নাই।

দিন, রাত্রি, মাস, বর্ষ কেটে যায়,
আগুন জ্বলতে থাকে শিরে,
কিভাবে দিন রাত্রি হয় জানি না,
হৃদয় ভেঙে যায় দুভাগ হয়ে।
গঙ্গার তীরে লুটিয়ে পড়ি বেদনায়,
রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি,
ধূলিকে সিক্ত করে তপ্ত অশ্রু,
হাহাকার মিশে যায় জনকলরবে;
সকল দেশের সকল মতের মহাজনদের
নাম নিয়ে ডেকে উঠি অধীর হয়ে,
বলি, আমাকে পথ দেখাও, দয়া কর,
ওগো, তোমরা যারা পৌঁছেছ পথের প্রান্তে।

কত বর্ষ কেটে গেল করুণ আর্তনাদে,
মুহূর্ত মনে হয় যুগ যেন,
তখন—একদিন আমার হাহাকারের মধ্যে
কে যেন ডাকল আমাকে আমারি নাম ধরে।

মৃদু মধু আস্বাদের মত এক স্বর—
‘পুত্র! আমার পুত্র! পুত্র মোর!’
সে কণ্ঠ বাজল হৃদয়ে একটি সুরে—
আত্মার প্রতিটি তন্ত্রী উঠল ঝঙ্কার দিয়ে।

উঠে দাঁড়াই। কোথায় সেই স্বর
যা ডাকছে আমায়—এমন ক’রে?

খুঁজে ফিরি এখানে, ওখানে—সেখানে,
বারে বারে—পথে ও প্রান্তে।
ঐ ঐ আবার সেই দৈবী স্বর!
ঐ তো শুনছি আমি, আমারি আহ্বান!
আবেগে আনন্দে নিরুদ্ধ হৃদয়
ডুবে গেল পরমা শান্তিতে।

জ্বলে উঠল আত্মা পরম জ্যোতিতে
খুলে গেল হৃদয়ের দ্বার,
আনন্দ! আনন্দ! একি অপরূপ!
প্রিয় মোর, প্রাণ মোর, সর্বস্ব আমার,
তুমি এখানে, এত কাছে,—আমারি হৃদয়ে?
আমারি হৃদয়ে তুমি নিত্যকাল রাজার গৌরবে!

সেইদিন থেকে যখনি যেখানে যাই
বুঝেছি হৃদয়ে, তুমি আছ পাশে পাশে
পর্বতে—উপত্যকায়—শিখরে—সানুতে
— দূরে বহু দূরে, ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে।

চাঁদের কোমল আলো, তারকার দ্যুতি,
দিবসের মহান্ উদ্ভাস—
সবার অন্তর-জ্যোতিরূপে প্রকাশিত;
তাঁর শক্তি সকল আলোর প্রাণ!
মহিমার ঊষা তিনি, সন্ধ্যা বিগলিত,
অনন্ত অশান্ত তিনি সমুদ্র,
প্রকৃতির সুষমায়, পাখীর সঙ্গীতে
শুধু তিনি, একমাত্র তিনি।

ঘোর দুর্বিপাকে যখন জড়িয়ে পড়ি,
অবসন্ন প্রাণ, ক্লান্ত ও কাতর,
যখন প্রকৃতি আমাকে চূর্ণ করে
ক্ষমাহীন তার নিয়মে—

শুনেছি তোমারি স্বর তখনি হে প্রিয়!
বলেছ গোপনে মৃদুভাষে ‘আমি এসেছি’,
জেগেছি সেই স্বরে; তোমার সঙ্গে
সহস্র মৃত্যুর মুখে আমি যে নির্ভয়।
তুমি আছ মায়ের গানে, যা শুনে
কোলের শিশু ঘুমিয়ে পড়ে মায়ের কোলে,
তুমি আছ শিশুর হাসিতে ও খেলায়,
দাঁড়িয়ে থাকো তাদের মাঝে আলো করে।

পবিত্রহৃদয় বন্ধুরা যখন মিলিত হয়
তাদেরও মাঝে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি।
সুধা ঢেলে দাও তুমি মায়ের চুমোয়,
তুমি সুর দাও শিশুর মা-মা ডাকে।
প্রাচীন ঋষির তুমি ভগবান্,
সকল মতের তুমি চিরন্তন উৎস,
বেদ, বাইবেল আর কোরান গাইছে
তোমারি নাম উচ্চকণ্ঠে—সমস্বরে।

আছ, আছ, তুমি আছ,
ধাবমান জীবনে তুমি আত্মার আত্মা,
ওঁ তৎ সৎ ওঁ,৩৪—আমার ঈশ্বর তুমি,
প্রিয় আমার, আমি তোমার, আমি তোমারি।

**********

পত্র সংখ্যা (৭১-৮০)

পত্র সংখ্যা (৭১-৮০)

পত্র সংখ্যা- ৭১
চিকাগো
২ অক্টোবর, ’৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আমার দীর্ঘ নীরবতার বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন জানি না। প্রথমতঃ মহাসভায় আমি শেষ মুহূর্তে একেবারে বিনা প্রস্তুতিতে হাজির হয়েছিলাম। কিছু সময় তার জন্য নিদারুণভাবে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ মহাসভায় প্রায় প্রতিদিন আমাকে বক্তৃতা করতে হয়েছে, ফলে লিখবার কোন সময়ই করে উঠতে পারিনি। শেষ কথা এবং সবচেয়ে বড় কথা এই যে, হে হৃদয়বান্ বন্ধু, আপনার কাছে আমি এমনই ঋণী যে, তাড়াহুড়ো করে—চিঠির উত্তর দেবার জন্যেই—কিছু একটা লিখে পাঠালে তা আপনার অহেতুক সৌহার্দ্যের অমর্যাদা হত। মহাসভার পাট এখন চুকেছে।

প্রিয় ভ্রাতা, সেই মহাসভায়, যেখানে সারা পৃথিবীর বিশিষ্ট বক্তা ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা উপস্থিত, সেখানে তাঁদের সামনে দাঁড়াতে এবং বক্তৃতা দিতে আমার যে কী ভয় হচ্ছিল! কিন্তু প্রভু আমাকে শক্তি দিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিন আমি বীরের মত (?) সভাকক্ষে শ্রোতাদের সম্মুখীন হয়েছি। যদি আমি সফল হয়ে থাকি, তিনিই শক্তিসঞ্চার করেছেন; যদি আমি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে থাকি—তা যে হব আমি আগে থেকেই জানতাম—তার কারণ আমি নিতান্ত অজ্ঞান।

আপনার বন্ধু অধ্যাপক ব্রাডলি আমার প্রতি খুবই দয়া প্রকাশ করেছেন এবং সব সময় আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আহা! সকলে আমার প্রতি—আমার মত নগণ্যের প্রতি কী না প্রীতিপরায়ণ, ভাষায় তা প্রাকাশ করা যায় না! প্রভু ধন্য, জয় হোক তাঁর, তাঁর কৃপাদৃষ্টিতে ভারতের দরিদ্র অজ্ঞ এক সন্ন্যাসী এই মহাশক্তির দেশে পণ্ডিত ধর্মযাজকদের সমতুল্য গণ্য হয়েছে। প্রিয় ভ্রাতা, জীবনের প্রতিটি দিনে আমি যেভাবে প্রভুর করুণা পাচ্ছি, আমার ইচ্ছা হয়, ছিন্নবস্ত্রে ও মুষ্টিভিক্ষায় যাপিত লক্ষ লক্ষ যুগব্যাপী জীবন দিয়ে তাঁর কাজ করে যাই—কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর সেবা করে যাই।

আহা, আমি কী ভাবেই না চেয়েছি, আপনি এখানে এসে ভারতের কয়েকজন মধুরচরিত্র ব্যক্তিকে দেখে যান—কোমলপ্রাণ বৌদ্ধ ধর্মপালকে, বাগ্মী মজুমদারকে; অনুভব করবেন, সেই সুদূর দরিদ্র ভারতেও এমন মানুষ আছেন, যাঁদের হৃদয় এই বিশাল শক্তিশালী দেশের মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সমতালে স্পন্দিত হয়।

আপনার পুণ্যবতী পত্নীকে আমার অসীম শ্রদ্ধা। আপনার মধুর সন্তানগুলিকে আমার অনন্ত ভালবাসা ও আশীর্বাদ।

যথার্থ উদারমনা কর্ণেল হিগিন‍্সন আমাকে বলেছেন যে, আপনার কন্যা তাঁর কন্যাকে আমার বিষয়ে কিছু লিখেছেন। কর্ণেল আমার প্রতি খুবই সহানুভূতিপরায়ণ। আমি আগামী কাল এভানষ্টনে যাচ্ছি। সেখানে অধ্যাপক ব্রাডলিকে দেখব, আশা করি।

প্রভু আমাদের সকলকে পবিত্র থেকে পবিত্রতর করুন, যাতে আমরা এই পার্থিব দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেবার আগেই পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতে পারি।

বিবেকানন্দ

(পৃথক্ একটি কাগজে লিখিত পত্রের পরের অংশ)

আমি এখন এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। সমস্ত জীবন সকল অবস্থাকে তাঁরই দান বলে গ্রহণ করেছি এবং শান্তভাবে চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। আমেরিকায় প্রথম দিকে আমার অবস্থা ছিল ডাঙায় তোলা মাছের মত। আমি প্রভুর দ্বারা চালিত হয়ে এসেছি—আমার আশঙ্কা হল, সেই এতদিনের অভ্যস্ত জীবনের ধারা এবার বোধহয় ত্যাগ করতে হবে, এবার বোধহয় নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে—এই ধারণাটা কী জঘন্য অন্যায় আর অকৃতজ্ঞতা! আমি এখন স্পষ্ট বুঝেছি যে, যিনি আমাকে হিমালয়ের তুষার-শৈলে কিম্বা ভারতের দগ্ধ প্রান্তরে পথ দেখিয়েছেন, তিনিই এখানে পথ দেখাবেন, সাহায্য করবেন। তাঁর জয় হোক, অশেষ জয় হোক। সুতরাং আমি আবার আমার পুরাতন রীতিতে শান্তভাবে গা ঢেলে দিয়েছি। কেউ এগিয়ে এসে আমাকে খেতে দেয়, হয়তো কেউ দেয় আশ্রয়, কেউ বলে—তাঁর কথা শোনাও আমাদের। আমি জানি তিনিই তাদের পাঠিয়েছেন—আমি শুধু নির্দেশ পালন করে যাব। তিনি আমাকে সব যোগাচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পযুর্পাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥ গীতা, ৯।২২

এমনি এশিয়াতে, এমনি ইওরোপে, এমনি আমেরিকায়, ভারতের মরুভূমির মধ্যেও একই জিনিষ। আমেরিকার বাণিজ্য-ব্যস্ততার মধ্যেও অন্য কিছু নয়। কারণ তিনি কি এখানেও নেই? আর যদি তিনি আমার পাশে সত্যি এখানে না থাকেন, তাহলে নিশ্চিত ধরে নেব, তিনি চান যে, এই তিন মিনিটের মাটির শরীর আমি যেন ছেড়ে দিই;—হ্যাঁ, তাহলে তাই তিনি চান, এবং আমি তা সানন্দে পালন করবার ভরসা রাখি।

ভ্রাতঃ, আমাদের সাক্ষাৎ আর হতেও পারে, নাও পারে, তিনিই জানেন। আপনি বিদ্বান্, মহান্ ও পুণ্যবান্। আপনাকে বা আপনার পত্নীকে কিছু শোনাবার স্পর্ধা আমি করি না। তবে আপনার সন্তানদের জন্যঃ

প্রিয় বাছারা, পিতামাতার চেয়েও তিনি তোমাদের নিকটতর। তোমরা ফুলের মত পবিত্র ও নির্মল। সেভাবেই থাকো। তাহলেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করবেন তোমাদের কাছে। বাছা অষ্টিন, যখন তুমি খেলা কর, তখন তোমার সঙ্গে খেলে যান আর এক খেলুড়ে, যাঁর থেকে আর কেউ তোমাকে বেশী ভালবাসেন না। আহা, কি যে মজায় ভরা তিনি। খেলা বৈ তিনি নেই। কখনও মস্ত মস্ত গোলা নিয়ে তিনি খেলা করেন, যেগুলোকে আমরা বলি পৃথিবী বা সূর্য। কখনও খেলেন তোমারি মত ছোট ছেলের সঙ্গে, হেসে হেসে খেলে যান কত রকমের খেলা। তাঁকে খুঁজে নিয়ে খেলতে পারলে কেমন মজা, একবার সেটি ভেবে দেখ।

প্রিয় অধ্যাপকজী, সম্প্রতি আমি ঘোরাফেরা করছি। চিকাগোয় এলেই আমি মিঃ ও মিসেস লায়নকে দেখতে যাই। আমার দেখা মহত্তম দম্পতিদের অন্যতম এঁরা। যদি অনুগ্রহ করে আমাকে কিছু লেখেন, দয়া করে তা ‘মিঃ জন্ বি. লায়ন, ২৬২ মিশিগান এভিনিউ, চিকাগো,’—এই ঠিকানায় পাঠাবেন।

যং শৈবাঃ সমুপাসতে শিব ইতি ব্রহ্মেতি বেদান্তিনো।
বৌদ্ধা বুদ্ধ ইতি প্রমাণপটবঃ কর্তেতি নৈয়ায়িকাঃ॥
অর্হন্নিত্যথ জৈনশাসনরতাঃ কর্মেতি মীমাংসকাঃ
সোঽয়ং বো বিদধাতু বাঞ্ছিতফলং ত্রৈলোক্যনাথো হরিঃ॥

নৈয়ায়িক বা দ্বৈতবাদী বিখ্যাত দার্শনিক উদয়নাচার্য এই শ্লোকটি রচনা করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘কুসুমাঞ্জলি’র প্রথমেই এই আশীর্বাণী উচ্চারিত হয়েছে। এই শ্লোকে তিনি চেষ্টা করেছেন সৃষ্টিকর্তা ও পরমপ্রেমিক নীতিনিয়ন্তার প্রকাশনিরপেক্ষ সত্তাকে প্রতিপাদন করতে।

আপনার সদাকৃতজ্ঞ বন্ধু
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭২
চিকাগো,
১০ অক্টোবর, ১৮৯৩

প্রিয় মিসেস উডস,
গতকাল আপনার চিঠি পেয়েছি। এখন আমি চিকাগোর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি—আমার বিবেচনায় তা বেশ ভালই হচ্ছে। ৩০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে প্রতি বক্তৃতায় পাওয়া যাচ্ছে; সম্প্রতি ধর্মমহাসভার দরুন চিকাগোয় আমার নাম এমনই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এই ক্ষেত্রটি ত্যাগ করা বর্তমানে যুক্তিযুক্ত হবে না। মনে হয়, এ ব্যাপারে আপনিও নিশ্চয় একমত হবেন। যাই হোক, আমি শীঘ্রই বষ্টনে যেতে পারি; ঠিক কবে, তা অবশ্য বলতে পারি না। গতকাল ষ্ট্রীটর থেকে ফিরেছি, সেখানে একটি বক্তৃতায় ৮৭ ডলার মিলেছে। এই সপ্তাহে প্রতিদিনই আমার বক্তৃতা আছে। সপ্তাহের শেষে আরও আমন্ত্রণ আসবে বলে আমার বিশ্বাস। মিঃ উডসকে আমার প্রীতি, এবং সকল বন্ধুকে শুভেচ্ছাদি।

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৩
C/o J. B. Lyon
২৬২ মিশিগান এভিনিউ, চিকাগো
২৬ অক্টোবর, ’৯৩

প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনি শুনে খুশী হবেন যে, এখানে আমার কাজ ভালই চলছে এবং এখানে প্রায় সকলেই আমার প্রতি খুব সহৃদয়, অবশ্য নিতান্ত গোঁড়াদের বাদ দিয়ে। নানা দূরদেশ থেকে বহু মানুষ এখানে বহু পরিকল্পনা, ভাব ও আদর্শ প্রচার করবার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছে, এবং আমেরিকাই একমাত্র স্থান, যেখানে সব কিছুর সাফল্যের সম্ভাবনা আছে। তবে আমার পরিকল্পনার বিষয়ে একদম আর কিছু না বলাই ঠিক করেছি। সেই ভাল। … পরিকল্পনার জন্য একাগ্রভাবে খেটে যাওয়াই আমার ইচ্ছা, পরিকল্পনাটা থাকবে আড়ালে, বাইরে কাজ করে যাব, অন্যান্য বক্তার মত।

আমাকে যিনি এখানে এনেছেন এবং এখনও পর্যন্ত যিনি আমাকে ত্যাগ করেননি, তিনি নিশ্চয় যে অবধি আমি এখানে থাকব, আমাকে ত্যাগ করবেন না। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, আমি ভালই করছি—এবং টাকাকড়ি পাওয়ার ব্যাপার যদি বলেন, খুবই ভাল করার আশা রাখি। অবশ্য আমি এ ব্যাপারে একেবারেই কাঁচা, কিন্তু শীঘ্রই এ ব্যবসার কৌশল শিখে নেব। চিকাগোয় আমি খুবই জনপ্রিয়, সুতরাং এখানে আরও কিছু সময় থাকতে ও টাকা সংগ্রহ করতে চাই।

আগামী কাল শহরের সবচেয়ে প্রভাবসম্পন্ন মহিলাদের ‘ফর্টনাইটলি ক্লাব’-এ বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করতে যাব। হৃদয়বান্ বন্ধু! আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাব জানি না; এবং জানি না কিভাবে তাঁকে ধন্যবাদ জানাব, যিনি আপনার সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখন যে আমার কাছে পরিকল্পনার সাফল্য সম্ভব বোধ হচ্ছে, সেটা আপনারই জন্য।

ইহজগতে অগ্রগতির প্রতি পদক্ষেপে আনন্দ ও শান্তি লাভ করুন। আপনার সন্তানদের জন্য আমার প্রীতি ও আশীর্বাদ।

সদা প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৪
চিকাগো
২ নভেম্বর, ১৮৯৩

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কাল তোমার পত্র পাইলাম। আমার এক মুহূর্তের অবিশ্বাস ও দুর্বলতার জন্য তোমরা সকলে এত কষ্ট পাইয়াছ, তাহার জন্য অতিশয় দুঃখিত। যখন ছবিলদাস আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল, তখন নিজেকে এত অসহায় ও নিঃসম্বল বোধ করিলাম যে, নিরাশ হইয়া তোমাদিগকে তার করিয়াছিলাম। তারপর হইতে ভগবান্ আমাকে অনেক বন্ধু ও সহায় দিয়াছেন। বষ্টনের নিকটবর্তী এক গ্রামে ডক্টর রাইটের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীকভাষার অধ্যাপক। তিনি আমার প্রতি অতিশয় সহানুভূতি দেখাইলেন, ধর্মমহাসভায় যাইবার বিশেষ আবশ্যকতা বুঝাইলেন—তিনি বলিলেন, উহাতে সমুদয় আমেরিকান জাতির সহিত আমার পরিচয় হইবে। আমার সহিত কাহারও আলাপ ছিল না, সুতরাং ঐ অধ্যাপক আমার জন্য সকল বন্দোবস্ত করিবার ভার স্বয়ং লইলেন। অবশেষে আমি পুনরায় চিকাগোয় আসিলাম। এখানে এক ভদ্রলোকের গৃহে—ধর্মমহাসভার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সকল প্রতিনিধির সহিত আমারও থাকিবার ব্যবস্থা হইল।

আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

‘মহাসভা’ খুলিবার দিন প্রাতে আমরা সকলে ‘শিল্পপ্রাসাদ’ (Art Place) নামক বাটীতে সমবেত হইলাম। সেখানে মহাসভার অধিবেশনের জন্য একটি বৃহৎ ও কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী হল নির্মিত হইয়াছিল। এখানে সর্বজাতীয় লোক সমবেত হইয়াছিলেন। ভারতবর্ষ হইতে আসিয়াছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও বোম্বাই-এর নগরকার; বীরচাঁদ গান্ধী জৈনসমাজের প্রতিনিধিরূপে এবং এনি বেসাণ্ট ও চক্রবর্তী থিওসফির প্রতিনিধি রূপে আসিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে মজুমদারের সহিত আমার পূর্বে পরিচয় ছিল, আর চক্রবর্তী আমার নাম জানিতেন। বাসা হইতে ‘শিল্পপ্রাসাদ’ পর্যন্ত খুব শোভাযাত্রা করিয়া যাওয়া হইল এবং আমাদের সকলকেই প্লাটফর্মের উপর শ্রেণীবদ্ধভাবে বসানো হইল। কল্পনা করিয়া দেখ, নীচে একটি হল, আর উপরে এক প্রকাণ্ড গ্যালারি; তাহাতে আমেরিকার সুশিক্ষিত সমাজের বাছা বাছা ৬।৭ হাজার নরনারী ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া উপবিষ্ট, আর প্লাটফর্মের উপর পৃথিবীর সর্বজাতীয় পণ্ডিতের সমাবেশ। আর আমি, যে জীবনে কখনও সাধারণের সমক্ষে বক্তৃতা করে নাই, সে এই মহাসভায় বক্তৃতা করিবে! সঙ্গীত, বক্তৃতা প্রভৃতি অনুষ্ঠান যথারীতি ধুমধামের সহিত সম্পন্ন হইবার পর সভা আরম্ভ হইল। তখন একজন একজন করিয়া প্রতিনিধিকে সভার সমক্ষে পরিচিত করিয়া দেওয়া হইল; তাঁহারাও অগ্রসর হইয়া কিছু কিছু বলিলেন। অবশ্য আমার বুক দুরদুর করিতেছিল ও জিহ্বা শুষ্কপ্রায় হইয়াছিল। আমি এতদূর ঘাবড়াইয়া গেলাম যে, পূর্বাহ্নে বক্তৃতা করিতে ভরসা করিলাম না। মজুমদার বেশ বলিলেন, চক্রবর্তী আরও সুন্দর বলিলেন। খুব করতালিধ্বনি হইতে লাগিল। তাঁহারা সকলেই বক্তৃতা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন। আমি নির্বোধ, কিছুই প্রস্তুত করি নাই। দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করিয়া অগ্রসর হইলাম। ডক্টর ব্যারোজ আমার পরিচয় দিলেন। আমার গৈরিক বসনে শ্রোতৃবৃন্দের চিত্ত কিছু আকৃষ্ট হইয়াছিল, আমেরিকাবাসীদিগকে ধন্যবাদ দিয়া এবং আরও দু-এক কথা বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিলাম। যখন আমি ‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ বলিয়া সভাকে সম্বোধন করিলাম, তখন দুই মিনিট ধরিয়া এমন করতালিধ্বনি হইতে লাগিল যে, কানে যেন তালা ধরিয়া যায়। তারপর আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম; যখন আমার বলা শেষ হইল, তখন হৃদয়ের আবেগে একেবারে যেন অবশ হইয়া বসিয়া পড়িলাম। পরদিন সব খবরের কাগজে বলিতে লাগিল, আমার বক্তৃতাই সেই দিন সকলের প্রাণে লাগিয়াছিল; সুতরাং তখন সমগ্র আমেরিকা আমাকে জানিতে পারিল। সেই শ্রেষ্ঠ টীকাকার শ্রীধর সত্যই বলিয়াছেন, ‘মূকং করোতি বাচালং’—ভগবান্‌ বোবাকেও মহাবক্তা করিয়া তোলেন। তাঁহার নাম জয়যুক্ত হউক! সেই দিন হইতে আমি একজন বিখ্যাত লোক হইয়া পড়িলাম, আর যে দিন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে আমার বক্তৃতা পাঠ করিলাম, সেই দিন ‘হল’-এ এত লোক হইয়াছিল যে, আর কখনও সেরূপ হয় নাই। একটি সংবাদপত্র হইতে আমি কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছিঃ

‘মহিলা—মহিলা—কেবল মহিলা—সমস্ত জায়গা জুড়িয়া, কোণ পর্যন্ত ফাঁক নাই, বিবেকানন্দের বক্তৃতা হইবার পূর্বে অন্য যে সকল প্রবন্ধ পঠিত হইতেছিল, তাহা ভাল না লাগিলেও কেবল বিবেকানন্দের বক্তৃতা শুনিবার জন্যই অতিশয় সহিষ্ণুতার সহিত বসিয়াছিল, ইত্যাদি।’ যদি সংবাদপত্রে আমার সম্বন্ধে যে-সকল কথা বাহির হইয়াছে, তাহা কাটিয়া পাঠাইয়া দিই, তুমি আশ্চর্য হইবে। কিন্তু তুমি তো জানই, নাম-যশকে আমি ঘৃণা করি। এইটুকু জানিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যখনই আমি প্লাটফর্মে দাঁড়াইতাম, তখনই আমার জন্য কর্ণবধিরকারী করতালি পড়িয়া যাইত। প্রায় সকল কাগজেই আমাকে খুব প্রশংসা করিয়াছে। খুব গোঁড়াদের পর্যন্ত স্বীকার করিতে হইয়াছে, ‘এই সুন্দরমুখ বৈদ্যুতিকশক্তিশালী অদ্ভুত বক্তাই মহাসভায় শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করিয়াছেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এইটুকু জানিলেই তোমাদের যথেষ্ট হইবে যে, ইহার পূর্বে প্রাচ্যদেশীয় কোন ব্যক্তিই আমেরিকান সমাজের উপর এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন নাই।

আমেরিকানদের দয়ার কথা কি বলিব। আমার এক্ষণে আর কোন অভাব নাই। আমি খুব সুখে আছি, আর ইওরোপ যাইতে আমার যে খরচ লাগিবে, তাহা আমি এখান হইতেই পাইব। অতএব তোমাদের আর আমাকে কষ্ট করিয়া টাকা পাঠাইবার আবশ্যক নাই। একটা কথা—তোমরা কি একসঙ্গে ৮০০৲ টাকা পাঠাইয়াছিলে? আমি কুক কোম্পানীর নিকট হইতে কেবল ৩০ পাউণ্ড পাইয়াছি। যদি তুমি ও মহারাজ পৃথক্ পৃথক্ টাকা পাঠাইয়া থাকো, তাহা হইলে বোধ হয় কতকটা টাকা এখনও আমার নিকট পৌঁছায় নাই। যদি একত্র পাঠাইয়া থাকো, তবে একবার অনুসন্ধান করিও।

নরসিংহাচার্য নামে একটি বালক আমাদের নিকট আসিয়া জুটিয়াছে। সে গত তিন বৎসর ধরিয়া চিকাগো শহরে অলসভাবে কাটাইতেছে। ঘুরিয়া বেড়াক বা যাহাই করুক, আমি তাহাকে ভালবাসি। কিন্তু যদি তাহার সম্বন্ধে তোমার কিছু জানা থাকে, তাহা লিখিবে। সে তোমাকে জানে। যে বৎসর পারি একজিবিশন হয়, সেই বৎসর সে ইওরোপে আসে। আমার পোষাক প্রভৃতির জন্য যে গুরুতর ব্যয় হইয়াছে, তাহা সব দিয়া আমার হাতে এখন ২০০ শত পাউণ্ড আছে। আর আমার বাড়ীভাড়া বা খাইখরচের জন্য এক পয়সাও লাগে না। কারণ ইচ্ছা করিলেই এই শহরের অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়ীতে আমি থাকিতে পারি। আর আমি বরাবরই কাহারও না কাহারও অতিথি হইয়া রহিয়াছি। এই জাতির এত অনুসন্ধিৎসা! তুমি আর কোথাও এরূপ দেখিবে না। ইহারা সব জিনিষ জানিতে ইচ্ছা করে, আর ইহাদের নারীগণ সকল দেশের নারী অপেক্ষা উন্নত; আবার সাধারণতঃ আমেরিকান নারী আমেরিকান পুরুষ অপেক্ষা অধিক শিক্ষিত ও উন্নত। পুরুষে অর্থের জন্য সারা জীবনটাকেই দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখে, আর স্ত্রীলোকেরা অবকাশ পাইয়া আপনাদের উন্নতির চেষ্টা করে; ইহারা খুব সহৃদয় ও অকপট। যে-কোন ব্যক্তির মাথায় কোনরূপ খেয়াল আছে, সেই এখানে তাহা প্রচার করিতে আসে; আর আমায় লজ্জার সহিত বলিতে হইতেছে, এখানে এইরূপে যে সমস্ত মত প্রচার করা হয়, তাহার অধিকাংশই যুক্তিসহ নয়। ইহাদের অনেক দোষও আছে। তা কোন্ জাতির নাই? আমি সংক্ষেপে জগতের সমুদয় জাতির কার্য ও লক্ষণ এইরূপে নির্দেশ করিতে চাইঃ এশিয়া সভ্যতার বীজ বপন করিয়াছিল, ইওরোপ পুরুষের উন্নতি বিধান করিয়াছে, আর আমেরিকা নারীগণের এবং সাধারণ লোকের উন্নতি বিধান করিতেছে। এ যেন নারীগণের ও শ্রমজীবিগণের স্বর্গস্বরূপ। আমেরিকার নারী ও সাধারণ লোকের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করিলে তৎক্ষণাৎ তোমার মনে এই ভাব উদিত হইবে। আর এই দেশ দিন দিন উদারভাবাপন্ন হইতেছে। ভারতে যে ‘দৃঢ়চর্ম খ্রীষ্টান’ (ইহা ইহাদেরই কথা৩৫) দেখিতে পাও, তাহাদের দেখিয়া ইহাদিগের বিচার করিও না। তাহারা এখানেও আছে বটে; কিন্তু তাহাদের সংখ্যা দ্রুত কমিয়া যাইতেছে। আর যে আধ্যাত্মিকতা হিন্দুদের প্রধান গৌরবের বস্তু, এই মহান্ জাতি দ্রুত তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে।

হিন্দু যেন কখনও তাহার ধর্ম ত্যাগ না করে। তবে ধর্মকে উহার নির্দিষ্ট সীমার ভিতর রাখিতে হইবে, আর সমাজকে উন্নতির স্বাধীনতা দিতে হইবে। ভারতের সকল সংস্কারই এই গুরুতর ভ্রমে পড়িয়াছেন যে, পৌরোহিত্যের সর্ববিধ অত্যাচার ও অবনতির জন্য তাঁহারা ধর্মকেই দায়ী করিয়াছেন; সুতরাং তাঁহারা হিন্দুর ধর্মরূপ এই অবিনশ্বর দুর্গকে ভাঙিতে উদ্যত হইলেন। ইহার ফল কি হইল?—নিষ্ফলতা! বুদ্ধ হইতে রামমোহন রায় পর্যন্ত সকলেই এই ভ্রম করিয়াছিলেন যে, জাতিভেদ একটি ধর্মবিধান; সুতরাং তাঁহারা ধর্ম ও জাতি উভয়কেই একসঙ্গে ভাঙিতে চেষ্টা করিয়া বিফল হইয়াছিলেন। এ বিষয়ে পুরোহিতগণ যতই আবোল-তাবোল বলুন না কেন, জাতি একটি অচলায়তনে পরিণত সামাজিক বিধান ছাড়া কিছুই নহে। উহা নিজের কার্য শেষ করিয়া এক্ষণে ভারতগগনকে দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন করিয়াছে। ইহা দূর হইতে পারে, কেবল যদি লোকের হারানো সামাজিক স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধি ফিরাইয়া আনা যায়। এখানে যে-কেহ জন্মিয়াছে, সেই জানে—সে একজন মানুষ। ভারতে যে-কেহ জন্মায়, সেই জানে—সে সমাজের একজন ক্রীতদাস মাত্র। স্বাধীনতাই উন্নতির একমাত্র সহায়ক। স্বাধীনতা হরণ করিয়া লও, তাহার ফল অবনতি। আধুনিক প্রতিযোগিতা প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কত দ্রুতবেগে জাতিভেদ উঠিয়া যাইতেছে। এখন উহাকে নাশ করিতে হইলে কোন ধর্মের আবশ্যকতা নাই। আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ দোকানদার, জুতাব্যবসায়ী ও শুঁড়ী খুব দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার কারণ কেবল প্রতিযোগিতা। বর্তমান গভর্ণমেণ্টের অধীনে কাহারও আর জীবিকার জন্য যে-কোন বৃত্তি আশ্রয় করিতে কোনরূপ বাধা নাই। ইহার ফল প্রবল প্রতিযোগিতা! এইরূপে সহস্র সহস্র ব্যক্তি—জড়ের মত নীচে পড়িয়া না থাকিয়া, যে উচ্চ সম্ভাবনা লইয়া তাহারা জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহা পাইবার চেষ্টা করিয়া সেই স্তরে উপনীত হইতেছে।

আমি এই দেশে অন্ততঃ শীতকালটা থাকিব, তারপর ইওরোপ যাইব। আমার যাহা কিছু আবশ্যক, ভগবানই সব যোগাইয়া দিবেন, আশা করি। সুতরাং এখন সে বিষয়ে তোমাদের কোন দুশ্চিন্তার কারণ নাই। আমার প্রতি ভালবাসার জন্য তোমাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমার অসাধ্য।

আমি দিন দিন বুঝিতেছি, প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে রহিয়াছেন, আর আমি তাঁহার আদেশ অনুসরণ করিবার চেষ্টা করিতেছি। তাঁহার ইচ্ছাই পূর্ণ হইবে। এই পত্রখানি খেতড়ির মহারাজাকে পাঠাইয়া দিও, আর ইহা প্রকাশ করিও না। আমরা জগতের জন্য অনেক মহৎ কার্য করিব, আর উহা নিঃস্বার্থভাবে করিব, নামযশের জন্য নহে।

“ ‘কেন’ প্রশ্নে আমাদের নাহি অধিকার। কাজ কর, করে মর—এই হয় সার॥’ সাহস অবলম্বন কর, আমাদ্বারা ও তোমাদের দ্বারা বড় বড় কাজ হইবে, এই বিশ্বাস রাখো। ভগবান্‌ বড় বড় কাজ করিবার জন্য আমাদিগকে নির্দিষ্ট করিয়াছেন, আর আমরা তাহা করিব। নিজদিগকে প্রস্তুত করিয়া রাখো; অর্থাৎ পবিত্র, বিশুদ্ধস্বভাব এবং নিঃস্বার্থপ্রেমসম্পন্ন হও। দরিদ্র, দুঃখী, পদদলিতদিগকে ভালবাস; ভগবান্ তোমাদিগকে আশীর্বাদ করিবেন। সময়ে সময়ে রামনাদের রাজা ও আর আর সকল বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিবে এবং যাহাতে তাঁহারা ভারতের সাধারণ লোকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হন, তাহার চেষ্টা করিবে। তাঁহাদিগকে বল, তাঁহারা তাহাদের উন্নতির প্রতিবন্ধকস্বরূপ হইয়া আছেন, আর যদি তাঁহারা উহাদের উন্নতির চেষ্টা না করেন, তবে তাঁহারা মনুষ্য-নামের যোগ্য নহেন। ভয় ত্যাগ কর, প্রভু তোমাদের সঙ্গেই রহিয়াছেন; তিনি নিশ্চয়ই ভারতের লক্ষ লক্ষ অনশনক্লিষ্ট ও অজ্ঞানান্ধ জনগণকে উন্নত করিবেন। এখানকার একজন রেলের কুলি তোমাদের অনেক যুবক এবং অধিকাংশ রাজা-রাজড়া হইতে অধিক শিক্ষিত। আমরাও কেন না উহাদের মত শিক্ষিত হইব? অবশ্যই হইব। অধিকাংশ ভারতীয় নারী যতদূর শিক্ষার উন্নতি কল্পনা করিতে পারে, প্রত্যেকটি মার্কিন নারী তদপেক্ষা অনেক অধিক শিক্ষিতা। আমাদের মহিলাগণকেও কেন না ঐরূপ শিক্ষিতা করিব? অবশ্যই করিতে হইবে।

মনে করিও না, তোমরা দরিদ্র। অর্থই বল নহে; সাধুতাই—পবিত্রতাই বল। আসিয়া দেখ, সমগ্র জগতে ইহাই প্রকৃত বল কি না। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

পুনঃ—ভাল কথা, তোমার কাকার প্রবন্ধের মত অদ্ভুত ব্যাপার আমি আর কখনও দেখি নাই। এ যেন ব্যবসাদারের জিনিষের ফর্দ; সুতরাং উহা ধর্ম মহাসভায় পাঠের যোগ্য বিবেচিত হয় নাই। তাই নরসিংহাচার্য একটা পাশের হলে উহা হইতে কতক কতক অংশ পাঠ করিল; কিন্তু কেহই উহার একটা কথাও বুঝিল না। তাঁহাকে এ বিষয়ে কিছু বলিও না। অনেকটা ভাব খুব অল্প কথার ভিতর প্রকাশ করা একটা বিশেষ শিল্পকলা বলিতে হইবে। এমনি কি, মণিলাল দ্বিবেদীর প্রবন্ধও অনেক কাটছাঁট করিতে হইয়াছিল। প্রায় এক হাজারের অধিক প্রবন্ধ পড়া হইয়াছিল, সুতরাং তাহাদের ওরূপ আবোল-তাবোল বক্তৃতা শুনিবার সময়ই ছিল না। অন্যান্য বক্তাদিগকে সাধারণতঃ যে আধ ঘণ্টা সময় দেওয়া হইয়াছিল, তাহা অপেক্ষা আমাকে অনেকটা অধিক সময় দেওয়া হইয়াছিল, কারণ শ্রোতৃবৃন্দকে ধরিয়া রাখিবার জন্য সর্বাপেক্ষা লোকপ্রিয় বক্তাদিগকে সর্বশেষে রাখা হইত। আর আমার প্রতি ইহাদের কি সহানুভূতি! এবং ইহাদের ধৈর্যই বা কত! ভগবান্ তাহাদিগকে আশীর্বাদ করুন। প্রাতে বেলা দশটা হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত তাহারা বসিয়া থাকিত, মধ্যে কেবল খাইবার জন্য আধ ঘণ্টা ছুটি—ইতোমধ্যে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ পাঠ হইত, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই বাজে ও অসার, কিন্তু তাহারা তাহাদের প্রিয় বক্তাদের বক্তৃতা শুনিবার অপেক্ষায় এতক্ষণ বসিয়াই থাকিত। সিংহলের ধর্মপালও তাহাদের অন্যতম প্রিয় বক্তা ছিলেন। তিনি বড়ই অমায়িক, আর এই মহাসভার অধিবেশনের সময় আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল।

পুনা হইতে আগত মিস সোপরাবজী নাম্নী জনৈকা খ্রীষ্টান মহিলা আর জৈনধর্মের প্রতিনিধি মিঃ গান্ধী এদেশে আরও কিছুদিন থাকিয়া বক্তৃতা দিয়া ঘুরিয়া অর্থোপাজনের চেষ্টা করিবেন। আশা করি, তাঁহাদের উদ্দেশ্য সফল হইবে। এ দেশে বক্তৃতা করা খুব লাভজনক ব্যবসা, অনেক সময় ইহাতে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। তুমি যে পরিমাণে লোক আকর্ষণ করিতে পারিবে, তাহার উপরই টাকা নির্ভর করিবে। মিঃ ইঙ্গারসোল প্রতি বক্তৃতায় ৫০০ হইতে ৬০০ ডলার পর্যন্ত পাইয়া থাকেন। তিনি এ দেশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ বক্তা। আমি খেতড়ির মহারাজাকে আমার আমেরিকার ফটোগ্রাফ পাঠাইয়াছি। ইতি

আশীর্বাদক
বি—
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৫

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৯ নভেম্বর, ১৮৯৩

প্রিয় মিসেস উড‍স,
চিঠির উত্তর দিতে আমার দেরীর জন্য মাফ করবেন। কবে আপনার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করতে পারব জানি না। আগামী কাল ম্যাডিসন এবং মিনিয়াপোলিস রওনা হচ্ছি। যে ইংরেজ ভদ্রলোকটির কথা আপনি বলেছিলেন, তিনি হলেন লণ্ডনের ডাঃ মমেরি, লণ্ডনের দরিদ্রদের মধ্যে কর্মী হিসাবে সুপরিচিত—অতি মধুর চরিত্রের লোক। আপনি বোধ হয় জানেন না, ইংলিশ চার্চই পৃথিবীতে এক মাত্র ধর্মীয় সংস্থা, যা এখানে প্রতিনিধি পাঠায়নি; এবং ক্যাণ্টারবেরীর আর্কবিশপ ধর্মমহাসভাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করা সত্ত্বেও ডাঃ মমেরি মহাসভায় এসেছিলেন।

হে সহৃদয় বন্ধু, আপনাকে ও আপনার কৃতী পুত্রকে ভালবাসা জানাচ্ছি—আমি সর্বদা আপনাদের চিঠি লিখি আর না লিখি, কিছু এসে যায় না।

আপনি কি আমার বইগুলি এবং ‘কভার-অল’টিকে মিঃ হেলের ঠিকানায় এক্সপ্রেস-যোগে পাঠাতে পারেন? ওগুলি আমার দরকার। এক্সপ্রেসের দাম এখানে মিটিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের সকলের উপর প্রভুর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক।

আপনার সদাবন্ধু
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—মিস স্যানবর্ন বা পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য বন্ধুদের যদি আপনি কখনও চিঠি লেখেন, তাহলে অনুগ্রহ করে তাঁদের আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাবেন।

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৬
(হরিপদ মিত্রকে লিখিত)
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৮ ডিসেম্বর, ১‍৮৯৩

কল্যাণবরেষু,
বাবাজী, তোমার পত্র কাল পাইয়াছি। তোমরা যে আমাকে মনে রাখিয়াছ, ইহাতে আমার পরমানন্দ। ভারতবর্ষের খবরের কাগজে চিকাগোবৃত্তান্ত হাজির—বড় আশ্চর্যের বিষয়, কারণ আমি যাহা করি, গোপন করিবার যথোচিত চেষ্টা করি। এ দেশে আশ্চর্যের বিষয় অনেক। বিশেষ এদেশে দরিদ্র ও স্ত্রী-দরিদ্র নাই বলিলেই হয় ও এ দেশের স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখি নাই! সৎপুরুষ আমাদের দেশেও অনেক, কিন্তু এদেশের মেয়েদের মত মেয়ে বড়ই কম। ‘যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষু’৩৬—যে দেবী সুকৃতী পুরুষের গৃহে স্বয়ং শ্রীরূপে বিরাজমানা। এ কথা বড়ই সত্য। এ দেশের তুষার যেমন ধবল, তেমনি হাজার হাজার মেয়ে দেখেছি। আর এরা কেমন স্বাধীন! সকল কাজ এরাই করে। স্কুল-কলেজ মেয়েতে ভরা। আমাদের পোড়া দেশে মেয়েছেলের পথ চলিবার যো নাই। আর এদের কত দয়া! যতদিন এখানে এসেছি, এদের মেয়েরা বাড়ীতে স্থান দিতেছে, খেতে দিচ্ছে—লেকচার দেবার সব বন্দোবস্ত করে, সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে যায়, কি না করে বলিতে পারি না। শত শত জন্ম এদের সেবা করলেও এদের ঋণমুক্ত হব না।

বাবাজী, শাক্ত শব্দের অর্থ জান? শাক্ত মানে মদ-ভাঙ্ নয়, শাক্ত মানে যিনি ঈশ্বরকে সমস্ত জগতে বিরাজিত মহাশক্তি বলে জানেন এবং সমগ্র স্ত্রী-জাতিতে সেই মহাশক্তির বিকাশ দেখেন। এরা তাই দেখে; এবং মনু মহারাজ বলিয়াছেন যে, ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ’৩৭—যেখানে স্ত্রীলোকেরা সুখী, সেই পরিবারের উপর ঈশ্বরের মহাকৃপা। এরা তাই করে। আর এরা তাই সুখী, বিদ্বান্‌, স্বাধীন, উদ্যোগী। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল—আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন, দরিদ্র।

এ দেশের ধনের কথা কি বলিব? পৃথিবীতে এদের মত ধনী জাতি আর নাই। ইংরেজরা ধনী বটে, কিন্তু অনেক দরিদ্র আছে। এ দেশে দরিদ্র নাই বলিলেই হয়। একটা চাকর রাখতে গেলে রোজ ৬ টাকা—খাওয়া-পরা বাদ—দিতে হয়। ইংলণ্ডে এক টাকা রোজ। একটা কুলি ৬ টাকা রোজের কম খাটে না। কিন্তু খরচও তেমনি। চার আনার কম একটা খারাপ চুরুট মেলে না। ২৪৲ টাকায় এক জোড়া মজবুত জুতো। যেমন রোজগার তেমনি খরচ। কিন্তু এরা যেমন রোজগার করিতে, তেমনি খরচ করিতে।

আর এদের মেয়েরা কি পবিত্র! ২৫ বৎসর ৩০ বৎসরের কমে কারুর বিবাহ হয় না। আর আকাশের পক্ষীর ন্যায় স্বাধীন। বাজার-হাট, রোজগার, দোকান, কলেজ, প্রোফেসর—সব কাজ করে, অথচ কি পবিত্র! যাদের পয়সা আছে, তারা দিনরাত গরীবদের উপকারে ব্যস্ত! আর আমরা কি করি? আমার মেয়ে ১১ বৎসরে বে না হলে খারাপ হয়ে যাবে! আমরা কি মানুষ, বাবাজী? মনু বলেছেন, ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিতিষত্নতঃ’—ছেলেদের যেমন ৩০ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য করে বিদ্যাশিক্ষা হবে, তেমনি মেয়েদেরও করিতে হইবে। কিন্তু আমরা কি করছি? তোমাদের মেয়েদের উন্নতি করিতে পার? তবে আশা আছে। নতুবা পশুজন্ম ঘুচিবে না।

দ্বিতীয় দরিদ্র লোক। যদি কারুর আমাদের দেশে নীচকুলে জন্ম হয়, তার আর আশা ভরসা নাই, সে গেল। কেন হে বাপু? কি অত্যাচার! এদেশের সকলের আশা আছে, ভরসা আছে, opportunities (সুবিধা) আছে। আজ গরীব, কাল সে ধনী হবে, বিদ্বান্‌ হবে, জগৎমান্য হবে। আর সকলে দরিদ্রের সহায়তা করিতে ব্যস্ত। গড়ে ভারতবাসীর মাসিক আয় ২৲ টাকা। সকলে চেঁচাচ্ছেন, আমরা বড় গরীব, কিন্তু ভারতের দরিদ্রের সহায়তা করিবার কয়টা সভা আছে? ক-জন লোকের লক্ষ লক্ষ অনাথের জন্য প্রাণ কাঁদে? হে ভগবান্, আমরা কি মানুষ! ঐ যে পশুবৎ হাড়ী-ডোম তোমার বাড়ীর চারিদিকে, তাদের উন্নতির জন্য তোমরা কি করেছ, তাদের মুখে এক-গ্রাস অন্ন দেবার জন্য কি করেছ, বলতে পার? তোমরা তাদের ছোঁও না, ‘দূর দূর’ কর। আমরা কি মানুষ? ঐ যে তোমাদের হাজার হাজার সাধু-ব্রাহ্মণ ফিরছেন, তাঁরা এই অধঃপতিত দরিদ্র পদদলিত গরীবদের জন্য কি করছেন? খালি বলছেন, ‘ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না।’ এমন সনাতন ধর্মকে কি করে ফেলেছে! এখন ধর্ম কোথায়? খালি ছুঁৎমার্গ—আমায় ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।

আমি এদেশে এসেছি, দেশ দেখতে নয়, তামাসা দেখতে নয়, নাম করতে নয়, এই দরিদ্রের জন্য উপায় দেখতে। সে উপায় কি, পরে জানতে পারবে, যদি ভগবান্ সহায় হন।

এদের অনেক দোষও আছে। ফল এই, ধর্মবিষয়ে এরা আমাদের চেয়ে অনেক নীচে, আর সামাজিক সম্বন্ধে এরা অনেক উচ্চে। এদের সামাজিক ভাব আমরা গ্রহণ করিব, আর এদের আমাদের অদ্ভুত ধর্ম শিক্ষা দিব।

কবে দেশে যাব জানি না, প্রভুর ইচ্ছা বলবান্। তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ জানিবে। ইতি

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৭
[মান্দ্রাজী ভক্তদিগকে লিখিত]
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৪ শে জানুয়ারী ১৮৯৪

প্রিয় বন্ধুগণ,
তোমাদের পত্র পাইয়াছি। আমি আশ্চর্য হইলাম যে, আমার সম্বন্ধে অনেক কথা ভারতে পৌঁছিয়াছে। ‘ইণ্টিরিয়র’ পত্রিকার যে সমালোচনার উল্লেখ করিয়াছ, তাহা সমুদয় আমেরিকাবাসীর ভাব বলিয়া বুঝিও না; এই পত্রিকা এখানে কেহ জানে না বলিলেই হয়, আর ইহাকে এখানকার লোক ‘নীলনাসিক প্রেসবিটেরিয়ান’দের কাগজ বলে। এ সম্প্রদায় খুব গোঁড়া। অবশ্য এই নীলনাসিকগণ সকলেই যে অভদ্র, তা নয়। সাধারণে যাহাকে আকাশে তুলিয়া দিতেছে, তাহাকে আক্রমণ করিয়া একটু বিখ্যাত হইবার ইচ্ছায় এই পত্রিকা ঐরূপ লিখিয়াছিল। আমেরিকাবাসী জনসাধারণ এবং পুরোহিতগণের অনেকেই আমাকে খুব যত্ন করিতেছেন। কোন বড় লোককে গালাগালি দিয়া পত্রিকাগুলির খ্যাতনামা হইবার ওই কৌশল এখানকার সকলেই জানে; সুতরাং এখানকার লোকে উহা কিছু গ্রাহ্য করে না। অবশ্য ভারতীয় মিশনরিগণ যে ইহা লইয়া একটা হুজুক করিবার চেষ্টা করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাদিগকে বলিও—‘হে য়াহুদী, লক্ষ্য কর, তোমার উপর এখন ঈশ্বরের দণ্ড নামিয়া আসিয়াছে।’ তাহাদের প্রাচীন গৃহের ভিত্তি পর্যন্ত এক্ষণে যায় যায় হইয়াছে, আর তাহারা পাগলের মত যতই চীৎকার করুক না কেন, উহা ভাঙিবেই ভাঙিবে। মিশনরীদের জন্য অবশ্য আমার দুঃখ হয়। প্রাচ্যদেশবাসিগণ এখানে দলে দলে অনেক আসাতে—তাহাদের ভারতে গিয়া বড়মানুষি করিবার উপায় অনেক কমিয়া আসিয়াছে। কিন্তু ইহাদের প্রধান প্রধান পুরোহিতগণের মধ্যে একজনও আমার বিরোধী নহেন। যাই হোক, যখন পুকুরে নামিয়াছি, তখন ভাল করিয়াই স্নান করিব।

তাহাদের সম্মুখে আমি আমাদের ধর্মের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাঠ করিয়াছিলাম, তৎসম্বন্ধে একটি সংবাদপত্র হইতে কাটিয়া পাঠাইয়া দিলাম। আমার অধিকাংশ বক্তৃতাই মুখে মুখে। আশা করি এদেশ হইতে চলিয়া যাইবার পূর্বে পুস্তকাকারে সেগুলিকে গ্রথিত করিতে পারিব। ভারত হইতে কোন সাহায্যের আর আবশ্যক নাই, এখানে আমার যথেষ্ট আছে। বরং তোমাদের নিকট যে টাকা আছে, তাহা দ্বারা এই ক্ষুদ্র বক্তৃতাটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত কর এবং বিভিন্ন দেশীয়-ভাষায় অনুবাদ করিয়া চারিদিকে উহার প্রচার কর। ইহা জাতির সম্মুখে আমাদের আদর্শ জাগরূক রাখিবে। আর সেই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের কথা এবং উহা হইতে ভারতের চতুর্দিকে শাখা-বিদ্যালয় সংস্থাপনের কথাও ভুলিও না। আমি এখানে প্রাণপণে সাহায্য-লাভের জন্য চেষ্টা করিতেছি, তোমরা ভারতেও চেষ্টা কর। খুব দৃঢ়ভাবে কার্য কর। ‘রামনাথ’ বা যে-কোন ‘নাথ’কে পাও, তাহাকেই ধরিয়া তাহার সাহায্যে এই কার্যের জন্য ধীরে ধীরে টাকা সঞ্চয় করিতে থাকো। যদিও এখানে এবার অর্থের বড়ই অনটন, তথাপি আমার যতদূর সাধ্য করিতেছি। এখানে এবং ইওরোপে ভ্রমণ করিবার সমুদয় খরচ আমার যথেষ্ট যোগাড় হইয়া যাইবে।

আমি কিডির পত্র পাইয়াছি। জাতিভেদ উঠিয়া যাইবে কি থাকিবে, এ সম্বন্ধে আমার কিছুই করিবার নাই। আমার উদ্দেশ্য এই যে, ভারতে বা ভারতের বাহিরে মনুষ্যজাতি যে মহৎ চিন্তারাশি উদ‍্ভাবন করিয়াছে, তাহা অতি হীন, অতি দরিদ্রের নিকট পর্যন্ত প্রচার করা। তারপর তারা নিজেরা ভাবুক। জাতিভেদ থাকা উচিত কি না, স্ত্রীলোকদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া উচিত কি না, এ বিষয়ে আমার মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। ‘চিন্তা ও কার্যের স্বাধীনতার উপরেই নির্ভর করে জীবন, উন্নতি এবং কল্যাণ।’ ইহার অভাবে মানুষ, বর্ণ ও জাতির পতন অবশ্যম্ভাবী।

জাতিভেদ থাকুক বা নাই থাকুক, কোন মতবাদ প্রচলিত থাকুক বা নাই থাকুক, যে-কোন ব্যক্তি, শ্রেণী, বর্ণ, জাতি বা সম্প্রদায় যদি অপর কোন ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার ও কার্যের শক্তিতে বাধা দেয় (অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ শক্তি কাহারও অনিষ্ট না করে) তাহা অতি অন্যায়, এবং যে ঐরূপ করে—তাহার পতন অবশ্যম্ভাবী।

আমার জীবনে এই একমাত্র আকাঙ্ক্ষা যে, আমি এমন একটি যন্ত্র চালাইয়া যাইব—যাহা প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট উচ্চ উচ্চ ভাবরাশি বহন করিয়া লইয়া যাইবে। তারপর পুরুষই হউক আর নারীই হউক—নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য রচনা করিবে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এবং অন্যান্য জাতি জীবনের গুরুতর সমস্যাসমূহ সম্বন্ধে কি চিন্তা করিয়াছেন, তাহা সকলে জানুক। বিশেষতঃ তাহারা দেখুক—অপরে এক্ষণে কি করিতেছে। তারপর তাহারা কি করিবে, স্থির করুক। রাসায়নিক দ্রব্যগুলি আমরা এক সঙ্গে রাখিয়া দিব মাত্র, উহারা প্রকৃতির নিয়মে দানা বাঁধিবে। আমেরিকার মহিলাগণ সম্বন্ধে বক্তব্য এই—তাঁহারা আমার খুব বন্ধু। শুধু চিকাগোয় নয়, সমগ্র আমেরিকায়। তাঁহাদের দয়ার জন্য আমি যে কতদূর কৃতজ্ঞ, তাহা প্রকাশ করা আমার সাধ্য নয়। প্রভু তাঁহাদিগকে আশীর্বাদ করুন। এই দেশে মহিলাগণ সমুদয় জাতীয় কৃষ্টির প্রতিনিধিস্বরূপ। পুরুষেরা কার্যে এত ব্যস্ত যে আত্মোন্নতির সময় পায় না। এখানকার মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় বড় আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ।

ভট্টাচার্য মহাশয়কে অনুগ্রহপূর্বক বলিবে, আমি তাঁহার ফনোগ্রাফের কথা বিস্মৃত হই নাই। তবে এডিসন ৩৮ সম্প্রতি ইহার উন্নতিসাধন করিয়াছেন; যতদিন না তাহা বাহির হইতেছে, ততদিন আমি উহা ক্রয় করা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।

দৃঢ়ভাবে কার্য করিয়া যাও, অবিচলিত অধ্যবসায়শীল হও এবং প্রভুর উপর বিশ্বাস রাখো; কাজে লাগো। দুইদিন আগেই হউক বা পরেই হউক, আমি আসিতেছি। আমাদের কার্যের এই মূল কথাটা সর্বদা মনে রাখিবে—‘ধর্মে একবিন্দুও আঘাত না করিয়া জনসাধারণের উন্নতিবিধান।’ মনে রাখিবে, দরিদ্রের কুটীরেই আমাদের জাতীয় জীবন স্পন্দিত হইতেছে। কিন্তু হায়, কেহই ইহাদের জন্য কিছুই করে নাই। আমাদের আধুনিক সংস্কারকগণ বিধবা-বিবাহ লইয়া বিশেষ ব্যস্ত। অবশ্য সকল সংস্কারকার্যেই আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপরে কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না; উহা নির্ভর করে—জনসাধারণের অবস্থার উপর। তাহাদিগকে উন্নত করিতে পার? তাহাদের স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক প্রকৃতি নষ্ট না করিয়া তাহাদিগকে আপনার পায়ে দাঁড়াইতে শিখাইতে পার? তোমরা কি সাম্য, স্বাধীনতা, কার্য ও উৎসাহে ঘোর পাশ্চাত্য এবং ধর্ম-বিশ্বাস ও সাধনায় ঘোর হিন্দু হইতে পার? ইহাই করিতে হইবে এবং আমরাই ইহা করিব। তোমরা সকলে ইহা করিবার জন্যই আসিয়াছ। আপনাতে বিশ্বাস রাখো। প্রবল বিশ্বাসই বড় বড় কার্যের জনক। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। মৃত্যু পর্যন্ত গরীব, পদদলিতদের উপর সহানুভূতি করিতে হইবে—ইহাই আমাদের মূলমন্ত্র। এগিয়ে যাও, বীরহৃদয় যুবকবৃন্দ!

তোমাদের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

পুঃ—একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া সাধারণ লোকের উন্নতি-বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে এবং এই বিদ্যালয়ে শিক্ষিত প্রচারকগণের দ্বারা গরীবের বাড়ীতে বাড়ীতে যাইয়া তাহাদের নিকট বিদ্যা ও ধর্মের বিস্তার—এই ভাবগুলি প্রচার করিতে থাকো। সকলেই যাহাতে এ বিষয়ে সহানুভূতি করে, তাহার চেষ্টা কর।

আমি তোমাদের নিকট সবচেয়ে উঁচুদরের কতকগুলি কাগজ হইতে স্থানে স্থানে কাটিয়া পাঠাইতেছি। ইহাদের মধ্যে ডাঃ টমাসের লেখাটি বিশেষ মূল্যবান্, কারণ তিনি সর্বাগ্রণী না হইলেও আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মযাজক বটে। ‘ইণ্টিরিয়র’ কাগজটার অতিরিক্ত গোঁড়ামি ও আমাকে গালাগালি দিয়া একটা নাম জাহির করিবার চেষ্টা সত্ত্বেও উহাদের স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে, আমি সর্বসাধারণের প্রিয় বক্তা ছিলাম। আমি উহা হইতেও কয়েক পঙক্তি কাটিয়া পাঠাইতেছি। ইতি

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৮
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
২৯ জানুআরী, ১৮৯৪

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
কয়েক দিন হয় আপনার শেষ চিঠিখানা পাইয়াছি। আপনি আমার দুঃখিনী মা ও ছোটভাইদের দেখিতে গিয়াছিলেন জানিয়া সুখী হইয়াছি। কিন্তু আপনি আমার অন্তরের একমাত্র কোমল স্থানটি স্পর্শ করিয়াছেন। আপনার জানা উচিত যে, আমি নিষ্ঠুর পশু নই। এই বিপুল সংসারে আমার ভালবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন, তবে তিনি আমার মা। তথাপি এ বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করিয়া আসিতেছি এবং এখনও করি যে, যদি আমি সংসার ত্যাগ না করিতাম, তবে আমার মহান্ গুরু পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে বিরাট সত্য প্রচার করিতে জগতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তাহা প্রকাশিত হইতে পারিত না। আর তাহা ছাড়া যে-সকল যুবক বর্তমান যুগের বিলাসিতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার তরঙ্গাভিঘাত প্রতিহত করিবার জন্য সুদৃঢ় পাষাণভিত্তির মত দাঁড়াইয়াছে—তাহাদেরই বা কী অবস্থা হইত? ইহারা ভারতের, বিশেষ করিয়া বাঙলার অশেষ কল্যাণসাধন করিয়াছে। আর এই তো সবে আরম্ভ। প্রভুর কৃপায় ইহারা এমন কাজ করিয়া যাইবে, যাহার জন্য সমস্ত জগৎ যুগের পর যুগ ইহাদিগকে আশীর্বাদ করিবে। সুতরাং একদিকে ভারতের ও বিশ্বের ভাবী ধর্মসম্বন্ধীয় আমার পরিকল্পনা, এবং যে উপেক্ষিত লক্ষ লক্ষ নরনারী দিন দিন দুঃখের তমোময় গহ্বরে ধীরে ধীরে ডুবিতেছে, যাহাদিগকে সাহায্য করিবার কিম্বা যাহাদের বিষয় চিন্তা করিবারও কেহ নাই, তাহাদের জন্য আমার সহানুভূতি ও ভালবাসা, আর অন্যদিকে আমার যত নিকট আত্মীয় স্বজন আছেন, তাঁহাদের দুঃখ ও দুর্গতির হেতু হওয়া—এই দুইটির মধ্যে প্রথমটিকেই আমি ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছি, বাকী যাহা কিছু তাহা প্রভুই সম্পন্ন করিবেন। তিনি যে আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আমি যতক্ষণ খাঁটি আছি, ততক্ষণ কেহই আমাকে প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইবে না; কারণ তিনিই আমার সহায়। ভারতের অসংখ্য নরনারী আমাকে বুঝিতে পারে নাই। আর কিরূপেই বা পারিবে? বেচারীদের চিন্তাধারা দৈনন্দিন খাওয়া-পরার ধরাবাঁধা নিয়মকানুনের গণ্ডিই যে কখনও অতিক্রম করিতে পারে না! কেবল আপনার ন্যায় মহৎ-অন্তঃকরণ-বিশিষ্ট মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র আমার গুণগ্রাহী। ভগবান্ আপনাকে আশীর্বাদ করুন! আমার সমাদর হউক আর নাই হউক—আমি এই যুবকদলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আর শুধু ইহারাই নহে, ভারতের নগরে নগরে আরও শত শত যুবক আমার সহিত যোগ দিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। ইহারা দুর্দমনীয় তরঙ্গাকারে ভারতভূমির উপর দিয়া প্রবাহিত হইবে, এবং যাহারা সর্বাপেক্ষা দীন হীন ও পদদলিত—তাহাদের দ্বারে দ্বারে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, ধর্ম ও শিক্ষা বহন করিয়া লইয়া যাইবে—ইহাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত, ইহা আমি সাধন করিব কিম্বা মৃত্যুকে বরণ করিব।

আমাদের দেশের লোকের না আছে ভাব, না আছে সমাদর করিবার ক্ষমতা। পরন্তু সহস্র বৎসরের পরাধীনতার ফলে উৎকট পরশ্রীকাতরতা ও সন্দিগ্ধ প্রকৃতির বশে ইহারা যে-কোন নূতন ভাবধারারই বিরোধী হইয়া উঠে। এতৎসত্ত্বেও প্রভু মহান্।

আরতি ও অন্যান্য বিষয়ে আপনি যাহা লিখিয়াছেন—ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রত্যেক মঠেই সে-সকল প্রথা প্রচলিত আছে দেখা যায় এবং ‘গুরুপূজা’ সাধনার প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়াই বেদে উক্ত হইয়াছে। ইহার ভালমন্দ উভয় দিকই আছে সত্য, কিন্তু এ কথাও স্মরণ রাখিবেন—আমাদের সম্প্রদায়ের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, নিজের মতামত বা বিশ্বাস অন্যের উপর চাপাইবার কোন অধিকার আমরা রাখি না। আমাদের মধ্যে অনেকে কোনপ্রকার মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নহে, কিন্তু তাই বলিয়া অপরের সেই বিশ্বাসে বাধা দিবারও কোন অধিকার তাহাদের নাই, কারণ তাহা হইলে আমাদের ধর্মের মূলতত্ত্বই লঙ্ঘন করা হইবে। অধিকন্তু শুধু মানুষের মধ্য দিয়াই ভগবানকে জানা সম্ভব। যেমন আলোক-স্পন্দন সর্বত্র, এমন কি অন্ধকার কোণেও বিদ্যমান, কেবলমাত্র প্রদীপের মধ্যেই উহা লোকচক্ষুর গোচর হইয়া থাকে, সেইরূপ যদিও ভগবান্‌ সর্বত্র বিরাজিত, তথাপি তাঁহাকে আমরা কেবল এক বিরাট মানুষরূপেই কল্পনা করিতে পারি। করুণাময়, রক্ষক, সহায়ক প্রভৃতি ভগবৎসম্বন্ধীয় ভাবগুলি—মানবীর ভাব; মানুষ স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়াই ভগবানকে দেখে বলিয়া ঐ সকল ভাবের উদ্ভব হইয়াছে। কোন মনুষ্যবিশেষকে আশ্রয় করিয়াই এই সকল গুণের বিকাশ হইতে বাধ্য—তাঁহাকে গুরুই বলুন, ঈশ্বর-প্রেরিত পুরুষই বলুন আর অবতারই বলুন। নিজদেহের সীমা আপনি যেমন উল্লম্ফনে অতিক্রম করিতে পারেন না, মানুষও তেমনি নিজ প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘন করিতে পারে না। যে গুরু আপনাদের ইতিহাসে বর্ণিত সমুদয় অবতারপ্রথিত পুরুষগণ অপেক্ষা শত শত গুণে অধিক পবিত্র—সেই প্রকার গুরুকে যদি কেহ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজাই করে, তবে তাহাতে কী ক্ষতি হইতে পারে? যদি খ্রীষ্ট, কৃষ্ণ কিম্বা বুদ্ধকে পূজা করিলে কোন ক্ষতি না হয়, তবে যে পুরুষপ্রবর জীবনে চিন্তায় বা কর্মে লেশমাত্র অপবিত্র কিছু করেন নাই, যাঁহার অন্তদৃষ্টিপ্রসূত তীক্ষ্ণবুদ্ধি অন্য সকল একদেশদর্শী ধর্মগুরু অপেক্ষা ঊর্ধ্বতর স্তরে বিদ্যমান—তাঁহাকে পূজা করিলে কী ক্ষতি হইতে পারে? দর্শন বিজ্ঞান অপর কোন বিদ্যার সহায়তা না লইয়া এই মহাপুরুষই জগতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব প্রচার করিলেন যে, ‘সকল ধর্মেই সত্য নিহিত আছে, শুধু ইহা বলিলেই চলিবে না, প্রত্যুত সকল ধর্মই সত্য। আর এই সত্যই জগতের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছে।

কিন্তু এ মতও আমরা জোর করিয়া কাহারও উপর চাপাই না; আমার গুরুভাইদের মধ্যে কেহই আপনাকে এমন কথা বলে নাই যে, সকলকে তাঁহার গুরুকেই পূজা করিতে হইবে—ইহা কখনই হইতে পারে না। পক্ষান্তরে—যদি কেহ ঐরূপ পূজা করে, তবে তাহাকে বাধা দিবার অধিকারও আমাদের নাই। কেনই বা থাকিবে? তাহা হইলে পৃথিবীতে অদৃষ্টপূর্ব অতুলনীয় এই সমাজটি—যেখানে দশজন মানুষ দশ প্রকার ভিন্ন মত ও ভাব অবলম্বন করিয়া পরিপূর্ণ সাম্যের মধ্যে বাস করিতেছে—বিনষ্ট হইয়া যাইবে। দেওয়ানজী, ঈশ্বর মহান্‌ ও করুণাময়—ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করুন, আরও বহু কিছু দেখিতে পাইবেন।

আমরা যে প্রত্যেকটি ধর্মমতকে শুধু সহ্য করি তাহা নহে, পরন্তু উহাদিগকে গ্রহণ করিয়া থাকি এবং সেই তত্ত্বই প্রভুর সহায়তায় জগতে প্রচার করিতে আমি চেষ্টা করিতেছি।

বড় হইতে গেলে কোন জাতির বা ব্যক্তির পক্ষে তিনটি বস্তুর প্রয়োজনঃ

(১) সাধুতার শক্তিতে প্রগাঢ় বিশ্বাস।

(২) হিংসা ও সন্দিগ্ধভাবের একান্ত অভাব।

(৩) যাহারা সৎ হইতে কিম্বা সৎ কাজ করিতে সচেষ্ট, তাহাদিগের সহায়তা।

কি কারণে হিন্দুজাতি তাহার অদ্ভুত বুদ্ধি এবং অন্যান্য গুণাবলী সত্ত্বেও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল? আমি বলি, হিংসা। এই দুর্ভাগা হিন্দুজাতি পরস্পরের প্রতি যেরূপ জঘন্যভাবে ঈর্ষান্বিত এবং পরস্পরের খ্যাতিতে যেভাবে হিংসাপরায়ণ, তাহা কোন কালে কোথাও দেখা যায় নাই। যদি আপনি কখনও পাশ্চাত্য দেশে আসেন, তবে এতদ্দেশবাসীর মধ্যে এই হিংসার অভাবই সর্বপ্রথম আপনার নজরে পড়িবে। ভারতবর্ষে তিন জন লোকও পাঁচ মিনিট কাল একসঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতে পারে না। প্রত্যেকেই ক্ষমতার জন্য কলহ করিতে শুরু করে—ফলে সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিই দুরবস্থায় পতিত হয়। হায় ভগবান্! কবে আমরা হিংসা না করিবার শিক্ষা লাভ করিব!

এইরূপ একটি জাতির মধ্যে, বিশেষ করিয়া বাঙলাদেশে এমন একদল লোক সৃষ্টি করা, যাহারা মতের বিভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পরের সহিত অবিচ্ছেদ্য স্নেহ-ভালবাসার সূত্রে আবদ্ধ থাকিবে—ইহা কি বিস্ময়কর নহে? এই দলের সংখ্যা ক্রমশঃ বর্ধিত হইবে, এই অদ্ভুত উদারভাব অপ্রতিহতবেগে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িবে, এবং এই দাসজাতির উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উৎকট অজ্ঞতা, ঘৃণা, প্রাচীন মূর্খতা, জাতিবিদ্বেষ ও হিংসা প্রভৃতি সত্ত্বেও সমগ্র দেশকে বিদ্যুৎশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিবে।

সর্বব্যাপী বদ্ধতার এই মহাসমুদ্রের মধ্যে যে কয়েকটি মহাপ্রাণ মনীষী শৈলের মত মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন—আপনি তাঁহাদের অন্যতম। ভগবান্ আপনাকে নিরন্তর আশীর্বাদ করুন। ইতি

চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৭৯

৫৪১ ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ মার্চ, ১৮৯৪

প্রিয় কিডি,
তোমার সব চিঠিই পেয়েছিলাম; কিন্তু কী জবাব দেব, ভেবে পাইনি। তোমার শেষ চিঠিখানিতে আশ্বস্ত হলাম। … বিশ্বাসে যে অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয় এবং একমাত্র বিশ্বাসই যে মানুষকে পরিত্রাণ করতে পারে, এই পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমি একমত; কিন্তু এতে আবার গোঁড়ামি আসবার ও ভবিষ্যৎ উন্নতির দ্বার রুদ্ধ হবার আশঙ্কা আছে।

জ্ঞানমার্গ খুব ঠিক, কিন্তু এতে আশঙ্কা এই—পাছে উহা শুষ্ক পাণ্ডিত্যে পর্যবসিত হয়। প্রেম ভক্তি খুব বড় ও ভাল জিনিষ, কিন্তু নিরর্থক ভাবপ্রবণতায় আসল জিনিষই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এগুলির সামঞ্জস্যই দরকার। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এরূপ সমন্বয়পূর্ণ ছিল। কিন্তু এরূপ মহাপুরুষ কালেভদ্রে জগতে এসে থাকেন। তবে তাঁর জীবন ও উপদেশ আদর্শ-স্বরূপ সামনে রেখে আমরা এগোতে পারি। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো একজনও সেই পূর্ণতা লাভ করতে পারবে না; তবু আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান, ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য বিধান এবং পরস্পরের অভাব পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে ঐ পূর্ণতা পেতে পারি। এতে প্রত্যেকের জীবনেই সমন্বয়ভাবের প্রকাশ হল না বটে, কিন্তু কতকগুলি লোকের মধ্যে একটা সমন্বয় হল, আর সেটা অন্যান্য প্রচলিত ধর্মমত হতে সুনিশ্চিত অগ্রগতি, তাতে সন্দেহ নেই।

কোন ধর্মকে ফলপ্রসূ করতে হলে তাই নিয়ে একেবারে মেতে যাওয়া দরকার; অথচ যাতে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ভাব না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এইজন্য আমরা একটি ‘অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়’ হতে চাই। সম্প্রদায়ের যে-সকল উপকারিতা তাও তাতে পাব, আবার তাতে সার্বভৌম ধর্মের উদারভাবও থাকবে।

ভগবান্ যদিও সর্বত্র আছে বটে, কিন্তু তাঁকে আমরা জানতে পারি কেবল মানবচরিত্রের মধ্য দিয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের মত এত উন্নত চরিত্র কোন কালে কোন মহাপুরুষের হয় নাই; সুতরাং তাঁকেই কেন্দ্র করে আমাদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে; অথচ প্রত্যেকের তাঁকে নিজের ভাবে গ্রহণ করার স্বাধীনতা থাকবে—কেউ আচার্য বলুক, কেউ পরিত্রাতা, কেউ ঈশ্বর, কেউ আদর্শ পুরুষ, কেউ বা মহাপুরুষ—যার যা খুশী।

আমরা সামাজিক সাম্যবাদ বা বৈষম্যবাদ কিছুই প্রচার করি না। তবে বলি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সকলেরই সমান অধিকার, আর তাঁর শিষ্যদের ভেতরে যাতে—কি মতে, কি কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, এইটির দিকেই আমাদের বিশেষ দৃষ্টি। সমাজ আপনার ভাবনা আপনি ভাবুক গে। আমরা কোন মতাবলম্বীকেই বাদ দিতে চাই না—তা সে নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী হোক বা ‘সর্বং ব্রহ্মময়ং জগৎ’ এই মতে বিশ্বাসবান্ হোক, অদ্বৈতবাদী হোক বা বহুদেবে বিশ্বাসী হোক, অজ্ঞেয়বাদী হোক বা নাস্তিক হোক। কিন্তু শিষ্য হতে গেলে তাকে কেবল এটুকু করতে হবে যে, তাকে এমন চরিত্র গঠন করতে হবে, তা যেমনি উদার তেমনি গভীর।

অপরের অনিষ্টকর না হলে আচার-ব্যবহার, চরিত্রগঠন বা পানাহার সম্বন্ধেও আমরা কোন বিশেষ নৈতিক মতের উপর জোর দিই না। এইটুকু বলে আমরা লোককে তার নিজের বিচারের উপর নির্ভর করতে বলি। ‘যা উন্নতির বিঘ্ন করে বা পতনের সহায়তা করে, তাই পাপ বা অধর্ম; আর যা উন্নত ও সমন্বয়-ভাবাপন্ন হবার সাহায্য করে, তাই ধর্ম।’

তারপর কোন্ পথ তার ঠিক উপযোগী, কোন‍্টাতে তার উপকার হবে, সে বিষয় প্রত্যেকে নিজে নিজে বেছে নিয়ে সেই পথে যাক; এ বিষয়ে আমরা সকলকে স্বাধীনতা দিই। যথা একজনের হয়তো মাংস খেলে সহজে উন্নতি হতে পারে, আর একজনের হয়তো ফলমূল খেয়ে হয়। যার যা নিজের ভাব, সে তা করুক। কিন্তু একজন যা করছে তা যদি অপরে করে, তার ক্ষতি হতে পারে, কারও কোন অধিকার নেই যে, সে অপরকে গাল দেবে, তাকে নিজের মতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করা তো দূরের কথা। কতকগুলি লোকের পক্ষে হয়তো দারপরিগ্রহ উন্নতির খুব সহায়ক হতে পারে, অপরের পক্ষে হয়তো তা বিশেষ ক্ষতিকর। তা বলে অবিবাহিত ব্যক্তির বিবাহিত শিষ্যকে বলবার কোন অধিকার নেই যে, সে ভুল পথে যাচ্ছে, জোর করে তাকে নিজের মতে আনবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা।

আমাদের বিশ্বাস—সব প্রাণীই ব্রহ্মস্বরূপ। প্রত্যেক আত্মাই যেন মেঘে ঢাকা সূর্যের মত; একজনের সঙ্গে আর একজনের তফাত কেবল এই—কোথাও সূর্যের উপর মেঘের আবরণ ঘন, কোথাও এই আবরণ একটু পাতলা; আমাদের বিশ্বাস—জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ইহা সকল ধর্মেরই ভিত্তিস্বরূপ; আর শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে মানবের উন্নতির সমগ্র ইতিহাসের সার কথাটাই এই—এক আত্মাই বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করছেন।

আমাদের বিশ্বাস—এই হল বেদের সার রহস্য।

আমাদের বিশ্বাস—প্রত্যেক ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে এইভাবে অর্থাৎ ঈশ্বর বলে চিন্তা করা উচিত ও তার সহিত তেমনভাবে ব্যবহারও করা উচিত, কাকেও ঘৃণা করা বা কোনরূপে কারও নিন্দা বা অনিষ্ট করা উচিত নয়। আর এ যে শুধু সন্ন্যাসীর কর্তব্য তা নয়, সকল নর-নারীরই কর্তব্য।

আমাদের বিশ্বাস—আত্মাতে লিঙ্গভেদ বা জাতিভেদ নাই বা তাঁতে অপূর্ণতা নেই।

আমাদের বিশ্বাস—সমুদয় বেদ, দর্শন, পুরাণ ও তন্ত্ররাশির ভিতর কোথাও এ কথা নাই যে, আত্মায় লিঙ্গ, ধর্ম বা জাতিভেদ আছে। এই হেতু যাঁরা বলেন, ‘ধর্ম আবার সমাজসংস্কার সম্বন্ধে কি বলবে?’ তাঁদের সহিত আমরা একমত; কিন্তু তাঁদের আবার আমাদের এ কথা মানতে হবে যে, ধর্মের কোনরূপ সামাজিক বিধান দেবার বা সকল জীবের মধ্যে বৈষম্যবাদ প্রচার করবার কোন অধিকার নেই, কারণ ধর্মের লক্ষ্যই হচ্ছে—এই কাল্পনিক ও ভয়ানক বৈষম্যকে একেবারে নাশ করে ফেলা।

যদি এ কথা বলা হয়, এই বৈষম্যের ভিতর দিয়ে গিয়েই আমরা চরমে সমত্ব ও একত্বভাব লাভ করব, তাতে আমাদের উত্তর এই—তাঁরা যে ধর্মের দোহাই দিয়ে পূর্বোক্ত কথাগুলো বলছেন, সেই ধর্মেই পুনঃপুনঃ বলেছে, ‘পাঁক দিয়ে পাঁক ধোয়া যায় না।’ বৈষম্যের ভিতর দিয়ে সমত্বে যাওয়া কি রকম?—না, যেন অসৎকার্য করে সৎ হওয়া।

সুতরাং সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সামাজিক বিধানগুলো সমাজের নানা প্রকার অবস্থা-সংঘাত হতে উৎপন্ন—ধর্মের অনুমোদনে। ধর্মের ভয়ানক ভ্রম হয়েছে যে, সামাজিক ব্যাপারে তিনি হাত দিলেন; কিন্তু এখন আবার ভণ্ডামি করে এবং নিজেই নিজের খণ্ডন করে বলছেন, ‘সমাজসংস্কার ধর্মের কাজ নয়।’ ঠিক কথা! এখন দরকার—ধর্ম যেন সমাজসংস্কার করতে না যান, আমরা সেজন্যই এ কথাও বলি, ধর্ম যেন সমাজের বিধানদাতা না হন। অপরের অধিকারে হাত দিতে যেও না, আপনার সীমার ভিতর আপনাকে রাখো, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

১। শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।

২। ধর্ম হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে ব্রহ্মত্ব প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।

সুতরাং উভয় স্থলেই শিক্ষকের কার্য কেবল পথ থেকে সব অন্তরায় সরিয়ে দেওয়া। আমি যেমন সর্বদা বলে থাকিঃ ‘অপরের অধিকারে হাত দিও না, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ আমাদের কর্তব্য, রাস্তা সাফ করে দেওয়া। বাকী সব ভগবান্ করেন।

সুতরাং তোমরা যখন বার বার ভাব যে, ধর্মের কাজ কেবল আত্মাকে নিয়ে, সামাজিক বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই, তখন তোমাদের এ কথাও মনে রাখা উচিত, যে-অনর্থ আগে থেকেই হয়ে গিয়েছে সে-সম্বন্ধেও এ কথা সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য। এ কি রকম জান? যেন কোন লোক জোর করে একজনের বিষয় কেড়ে নিয়েছে; এখন বঞ্চিত ব্যক্তি যখন তার বিষয় পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, তখন প্রথম ব্যক্তি নাকী সুরে চীৎকার শুরু করলে, আর ‘মানুষের অধিকার’রূপ মতবাদ যে কত পবিত্র, তা প্রচার করতে লাগল!

সমাজের প্রত্যেক খুঁটিনাটি বিষয়ে পুরুতগুলোর অত গায়ে পড়ে বিধান দেবার কি দরকার ছিল? তাতেই তো লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন কষ্ট পাচ্ছে!

তোমরা মাংসাহারী ক্ষত্রিয়দের কথা বলছ। ক্ষত্রিয়েরা মাংস খাক আর নাই খাক, তারাই হিন্দুধর্মের ভিতর যা কিছু মহৎ ও সুন্দর জিনিষ রয়েছে, তার জন্মদাতা। উপনিষদ্‌ লিখেছিলেন কারা? রাম কি ছিলেন? কৃষ্ণ কি ছিলেন? বুদ্ধ কি ছিলেন? জৈনদের তীর্থঙ্করেরা কি ছিলেন? যখনই ক্ষত্রিয়েরা ধর্ম উপদেশ দিয়েছেন, তাঁরা জাতিবর্ণনির্বিশেষে সবাইকে ধর্মের অধিকার দিয়েছেন; আর যখনই ব্রাহ্মণেরা কিছু লিখেছেন, তাঁরা অপরকে সকল রকম অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আহাম্মক, গীতা আর ব্যাসসূত্র পড় অথবা আর কারও কাছে শুনে নাও। গীতায় সকল নরনারী, সকল জাতি, সকল বর্ণের জন্য পথ উন্মুক্ত রয়েছে; আর ব্যাস গরীব শূদ্রদের বঞ্চিত করবার জন্য বেদের স্বকপোলকল্পিত মানে করছেন। ঈশ্বর কি তোমাদের মত ভীরু আহাম্মক যে, এক টুকরো মাংসে তাঁর দয়া-নদীতে চড়া পড়ে যাবে? যদি তাই হয়, তবে তাঁর মূল্য এক কানাকড়িও নয়। যাক, ঠাট্টা থাক। কি প্রণালীতে তোমাদের চিন্তাকে নিয়মিত করতে হবে, এ চিঠিতে তার গোটাকতক সঙ্কেত দিলাম।

আমার কাছ থেকে কিছু আশা কর না। তোমাকে পূর্বেই লিখেছি ও বলেছি, আমার স্থির বিশ্বাস—মান্দ্রাজীদের দ্বারাই ভারতের উদ্ধার হবে। তাই বলছি, হে মান্দ্রাজবাসী যুবকবৃন্দ, তোমাদের মধ্যে গোটাকতক লোক এই নূতন ভগবান্ রামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এই নূতনভাবে একেবারে মেতে উঠতে পার কি? ভেবে দেখো; উপাদান সংগ্রহ করে একখানা সংক্ষিপ্ত রামকৃষ্ণ-জীবনী লেখো দেখি। সাবধান, যেন তার মধ্যে কোন অলৌকিক ঘটনাসমাবেশ কর না—অর্থাৎ জীবনীটি লেখা হবে তাঁর উপদেশের উদাহরণস্বরূপ। তার মধ্যে কেবল তাঁর কথা থাকবে। খবরদার, এর মধ্যে আমাকে বা অন্য কোন জীবিত ব্যক্তিকে যেন এনো না। প্রধান লক্ষ্য থাকবে তাঁর শিক্ষা, তাঁর উপদেশ জগৎকে দেওয়া, আর জীবনীটি তাঁরই উদাহরণস্বরূপ হবে। তাঁর জীবনের অন্যান্য ঘটনা সাধারণের জন্য নয়। আমি অযোগ্য হলেও আমার উপর একটি কর্তব্য ন্যস্ত ছিল—যে রত্নের কৌটা আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা মান্দ্রাজে নিয়ে এসে তোমাদের হাতে দেওয়া।

কপট, হিংসুক, দাসভাবাপন্ন, কাপুরুষ, যারা কেবল জড়ে বিশ্বাসী, তারা কখনও কিছু করতে পারে না। ঈর্ষাই আমাদের দাসসুলভ জাতীয় চরিত্রের কলঙ্কস্বরূপ। ঈর্ষা থাকলে সর্বশক্তিমান্ ভগবানও কিছু করে উঠতে পারেন না।

আমার সম্বন্ধে মনে কর, যা কিছু করবার ছিল সব শেষ করেছি; এইটি ভাব যে, সব কাজের ভার তোমাদের ঘাড়ে। হে মান্দ্রাজবাসী যুবকবৃন্দ, ভাব যে তোমরা এই কাজ করবার জন্য বিধাতা কর্তৃক নির্দিষ্ট। তোমরা কাজে লাগো, ঈশ্বর তোমাদের আশীর্বাদ করুন। আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ভুলে যাও, কেবল রামকৃষ্ণকে প্রচার কর; তাঁর উপদেশ, তাঁর জীবনী প্রচার কর। কোন লোকের বিরুদ্ধে, কোন সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বল না। জাতিভেদের স্বপক্ষে বিপক্ষে কিছু বল না, অথবা সামাজিক কোন কুরীতির বিরুদ্ধেও কিছু বলবার দরকার নেই। কেবল লোককে বল, ‘গায়ে পড়ে কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে যেও না,’ তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আলাসিঙ্গা, জি. জি, বালাজী ও ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা কর, তারা এটা পারবে কি না। সাহসী, দৃঢ়নিষ্ঠ, প্রেমিক যুবকবৃন্দ, তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮০
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১২ মার্চ, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনীগণ,
আমি এখন মিঃ পামারের অতিথি। ইনি বড় চমৎকার লোক। পরশু রাত্রে ভোজ দিলেন এঁর একদল প্রাচীন বন্ধুকে; তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ষাটের উপর। দলটিকে ইনি বলেন—‘পুরানো বন্ধুদের আড্ডা।’ এক নাট্যশালায় বক্তৃতা দিলাম আড়াই ঘণ্টা; সকলেই খুব খুশী। এইবার বষ্টন আর নিউ ইয়র্কে যাচ্ছি। এখানকার আয় দিয়েই ওখানকার খরচ কুলিয়ে যাবে। ফ্ল্যাগ ও অধ্যাপক রাইটের ঠিকানা মনে নাই। মিশিগানে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি না। মিঃ হলডেন আজ প্রাতে খুব বোঝাচ্ছিলেন আমাকে—মিশিগানে বক্তৃতা দেবার জন্য। আমার কিন্তু এখন বষ্টন ও নিউ ইয়র্ক একটু ঘুরে দেখবার আগ্রহ। সত্য কথা বলতে কি, যতই আমি জনপ্রিয় হচ্ছি এবং আমার বাগ্মিতার উৎকর্ষ হচ্ছে, ততই আমার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এ-যাবৎ যতগুলি বক্তৃতা দিয়েছি, তার মধ্যে শেষেরটাই সবচেয়ে ভাল। শুনে মিঃ পামার তো আনন্দে আত্মহারা; আর শ্রোতারা এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান যে, বক্তৃতা শেষ হয়ে যাবার পর আমি জানতে পারলাম—এত দীর্ঘকাল ধরে বলেছি। শ্রোতার অমনোযোগ বা চাঞ্চল্য বক্তার অগোচর থাকে না। যাক, এ সব বাজে জিনিষ থেকে ভগবান্‌ আমাকে রক্ষা করুন—আমার আর এ সব ভাল লাগে না। ঈশ্বর করেন তো বষ্টন বা নিউ ইয়র্কে বিশ্রামের অভিপ্রায়। তোমরা সকলে আমার প্রীতি জেনো। চিরসুখী হও। ইতি।

তোমাদের স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (৮১-৯০)

পত্র সংখ্যা (৮১-৯০)

পত্র সংখ্যা- ৮১ 
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৫ মার্চ, ১৮৯৪

স্নেহের খুকীরা,
বুড়ো পামারের সঙ্গে আমার বেশ জমেছে। বৃদ্ধ সজ্জন ও সদানন্দ। আমার বক্তৃতার জন্য মাত্র একশো সাতাশ ডলার পেয়েছি। সোমবার আবার ডেট্রয়েটে বক্তৃতা দেব। তোমাদের মা আমাকে বলেছেন—লীনের (Lynn) এক মহিলাকে চিঠি দিতে। আমি তো তাঁকে কখনও দেখিওনি। বিনা পরিচয়ে লেখা ভদ্রতাসঙ্গত হবে কি? মহিলাটির নামে বরং ডাকে একটি ছোট পরিচয়পত্র আমাকে পাঠিয়ে দিও। আর লীনই বা কোথায়? হাঁ, আমার সম্বন্ধে সব চেয়ে মজার কথা লিখেছে এখানকার এক সংবাদপত্রঃ ঝঞ্ঝা-সদৃশ হিন্দুটি এখানে মিঃ পামারের অতিথি, মিঃ পামার হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন, ভারতবর্ষে যাচ্ছেন; তবে তাঁর জেদ, দুইটি বিষয়ে কিছু অদল-বদল চাই—জগন্নাথদেবের রথ টানবে তাঁর লগ্ হাউস ফার্মের ‘পারচেরন্’ জাতীয় অশ্ব, আর তাঁর জার্সি গাভীগুলিকে হিন্দুর গোদেবী-সম্প্রদায়ভুক্ত করে নিতে হবে। এই জাতীয় অশ্ব ও গাভী মিঃ পামারের লগ্ হাউস ফার্মে বহু আছে এবং এগুলি তাঁর খুব আদরের।

প্রথম বক্তৃতা সম্পর্কে বন্দোবস্ত ঠিক হয়নি। হলের ভাড়াই লেগেছিল একশো পঞ্চাশ ডলার। হলডেনকে ছেড়ে দিয়েছি। অন্য একজন জুটেছে, দেখি এর ব্যবস্থা ভাল হয় কি না। মিঃ পামার আমায় সারাদিন হাসান। আগামী কাল ফের এক নৈশভোজ হবে। এ পর্যন্ত সব ভালই চলেছে, কিন্তু জানি না কেন, এখানে আসা অবধি আমার মন বড় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।

বক্তৃতা প্রভৃতি বাজে কাজে একেবারে বিরক্ত হয়ে উঠেছি। শত বিচিত্র রকমের মনুষ্যনামধারী কতকগুলি জীবের সহিত মিশে মিশে উত্ত্যক্ত হয়ে পড়েছি। আমার বিশেষ পছন্দের বস্তুটি যে কি, তা বলছিঃ আমি লিখতেও পারি না, বক্তৃতা করতেও পারি না; কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি, আর তার ফলে যখন উদ্দীপ্ত হই, তখন বক্তৃতায় অগ্নি বর্ষণ করতে পারি; কিন্তু তা অল্প—অতি অল্পসংখ্যক বাছাই-করা লোকের মধ্যেই হওয়া উচিত। তাদের যদি ইচ্ছা হয়তো আমার ভাবগুলি জগতে প্রচার করুক—আমি কিছু করব না। কাজের এ একটা যুক্তিযুক্ত বিভাগ মাত্র। একই ব্যক্তি চিন্তা করে, তারপর সেই চিন্তালব্ধ ভাব প্রচার করে কখনও সফল হতে পারেনি। ঐরূপে প্রচারিত ভাবের মূল্য কিছুই নয়। চিন্তা করবার, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতার এই দাবী, এবং মানুষ যে যন্ত্রবিশেষ নয়—এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাই যেহেতু সব ধর্মচিন্তার সার কথা, অতএব বিধিবদ্ধ যান্ত্রিক ধারা অবলম্বন করে এই চিন্তা অগ্রসর হতে পারে না। যন্ত্রের স্তরে সব কিছুকে টেনে নামাবার এই প্রবৃত্তিই আজ পাশ্চাত্যকে অপূর্ব সম্পদ‍্শালী করেছে সত্য, কিন্তু এই প্রবৃত্তিই আবার তার সব রকম ধর্মকে বিতাড়িত করেছে। যৎসামান্য যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাকেও পাশ্চাত্য পদ্ধতিমত কসরতে পর্যবসিত করেছে।

আমি বাস্তবিকই ‘ঝঞ্ঝাসদৃশ’ নই, বরং ঠিক তার বিপরীত। আমার যা কাম্য, তা এখানে লভ্য নয় এবং এই ‘ঝঞ্ঝাবর্তময়’ আবহাওয়াও আমি আর সহ্য করতে পারছি না। পূর্ণত্বলাভের পথ এই যে, নিজে ঐরূপ চেষ্টা করতে হবে এবং অন্যান্য স্ত্রী-পুরুষ যারা সচেষ্ট, তাদের যথাশক্তি সাহায্য করতে হবে। বেনাবনে মুক্তা ছড়িয়ে সময়, স্বাস্থ্য ও শক্তির অপব্যয় করা আমার কর্ম নয়—মুষ্টিমেয় কয়েকটি মহামানব সৃষ্টি করাই আমার ব্রত।

এইমাত্র ফ্ল্যাগের এক পত্র পেলাম। বক্তৃতা-ব্যাপারে তিনি আমাকে সাহায্য করতে অক্ষম। তিনি বলেন, ‘আগে বষ্টনে যান।’ যাক, বক্তৃতা দেবার সাধ্য আর আমার নেই। এই যে আমাকে দিয়ে ব্যক্তি বা শ্রোতা বিশেষকে খুশী করবার চেষ্টা—এটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না। যা হোক, এ দেশ থেকে চলে যাবার আগে অন্ততঃ দু-এক দিনের জন্যও চিকাগোয় ফিরে যাব। ঈশ্বর তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।

আপনার সদাকৃতজ্ঞ বন্ধু
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮২
[মিস ইসাবেল ম্যাক‍্‍কিণ্ডলিকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৭ মার্চ, ’৯৪

প্রিয় ভগিনী,
তোমার প্যাকেটটি গতকাল পেয়েছি। সেই মোজাগুলি পাঠাতে হয়েছে বলে দুঃখিত—এখানে আমি নিজেই কিছু যোগাড় করে নিতে পারতাম। তবে ব্যাপারটি তোমার ভালবাসার পরিচায়ক বলে আমি খুশী। যা হোক আমার ঝুলি এখন ঠাসা ভর্তি। কিভাবে যে বয়ে বেড়াব জানি না!

মিঃ পামারের সঙ্গে বেশী সময় থাকার ব্যাপারে মিসেস ব্যাগলি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় আজ তাঁর বাড়ীতে ফিরেছি। পামারের বাড়ীতে বেশ ভালই কেটেছে। পামার সত্যি আমুদে দিলখোলা মজলিশী লোক, ‘ঝাঁঝালো স্কচ’-এর ভক্ত; নিতান্ত নির্মল আর শিশুর মত সরল।

আমি চলে আসাতে তিনি খুব দুঃখিত হলেন। কিন্তু আমার অন্য কিছু করবার ছিল না। এখানে এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে আমার দু-বার সাক্ষাৎ হয়েছে। তার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। যেমন তার বুদ্ধি, তেমনি রূপ, তেমনি ধর্মভাব; সংসারের ছোঁয়ার মধ্যে একেবারে নেই। প্রভু তাকে কৃপা করুন। সে আজ সকালে মিসেস ম্যাক‍্ডুভেলের সঙ্গে এসেছিল এবং এমন চমৎকারভাবে কথাবার্তা বলল, এমন গভীর ও আধ্যাত্মিকভাবে—আহা, আমি একেবারে মোহিত হয়ে গেলাম! যোগীদের বিষয়ে তার সব-কিছু জানা আছে, আর ইতোমধ্যে যোগাভ্যাসে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে!



বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৩
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৮ মার্চ, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনী মেরী,
কলিকাতার চিঠিখানা আমাকে পাঠানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবে। গুরুদেব সম্বন্ধে অনেক কথাই তুমি আমার কাছে শুনেছ। তাঁরই জন্মতিথি অনুষ্ঠানের একটি নিমন্ত্রণপত্র কলিকাতার গুরুভায়েরা আমাকে লিখেছেন। সুতরাং পত্রটি তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি। পত্রে আরও লিখেছেন, ‘ম—’ কলিকাতায় ফিরে গিয়ে রটাচ্ছে যে বিবেকানন্দ আমেরিকায় সব রকমের পাপ কাজ করছে। … এই তো তোমাদের আমেরিকার ‘অপূর্ব আধ্যাত্মিক পুরুষ!’ তাদেরই বা দোষ কি? যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী না হওয়া পর্যন্ত—অর্থাৎ আত্মার স্বরূপ প্রত্যক্ষ না করলে, আধ্যাত্মিক রাজ্যের সঠিক সন্ধান না পেলে মানুষ বস্তু ও অবস্তুর, বাগাড়ম্বর ও জ্ঞানগাম্ভীর্যের এবং এ জাতীয় অপরাপর বিষয়ের পার্থক্য ধরতে পারে না। ‘ম—’ বেচারীর এতদূর অধঃপতনে আমি বিশেষ দুঃখিত। ভগবান্‌ ভদ্রলোককে কৃপা করুন।

পত্রে সম্বোধনাংশ ইংরেজীতে। নামটি আমার বহু আগেকার; লেখক শৈশবের এক সাথী; এখন আমার মত সন্ন্যাসী। বেশ কবিত্বপূর্ণ নাম! নামের অংশমাত্র লিখেছে, সবটা হচ্ছে ‘নরেন্দ্র’, অর্থাৎ ‘মানুষের সেরা’ (‘নর’ মানে মানুষ, আর ‘ইন্দ্র’ মানে রাজা, অধিপতি)—হাস্যাস্পদ নয় কি? আমাদের দেশে নাম, সব এই রকমের। নাচার! আমি কিন্তু নামটি যে ছাড়তে পেরেছি, তাতে খুব খুশী।

বেশ ভাল আছি। আশা করি তোমাদের কুশল। ইতি তোমার ভ্রাতা

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o George W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
চিকাগো, ‍১৯ মার্চ, ১৮৯৪

কল্যাণবরেষু,
এদেশে আসিয়া অবধি তোমাদের পত্র লিখি নাই। কিন্তু হরিদাস ভাই-এর৩৯ পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। G. C. Ghose৪০ এবং তোমরা যে হরিদাস ভাই-এর যথোচিত খাতির করিয়াছ, তাহা বড়ই ভাল।

এদেশে আমার কোন অভাব নাই; তবে ভিক্ষা চলে না, পরিশ্রম অর্থাৎ উপদেশ করিতে হয় স্থানে স্থানে। এদেশে যেমন গরম তেমনি শীত। গরমি কলিকাতা অপেক্ষা কোন অংশে কম নহে। শীতের কথা কি বলিব, সমস্ত দেশ দু হাত তিন হাত কোথাও ৪।৫ হাত বরফে ঢাকা। দক্ষিণভাগে বরফ নাই! বরফ তো ছোট জিনিষ। যখন পারা জিরোর উপর ৩২ দাগ থাকে, তখন বরফ পড়ে। কলিকাতায় কদাচ ৬০ হয়—জিরোর উপর, ইংলণ্ডে কদাচ জিরোর কাছে যায়। এখানে পারার পো জিরোর নীচে ৪০।৫০ তক নেবে যান। উত্তরভাগে কানাডায় পারা জমে যায়। তখন আলকোহল থার্মোমিটার ব্যবহার করিতে হয়। যখন বড্ড ঠাণ্ডা, অর্থাৎ যখন পারা জিরোর উপর ২০ ডিগ্রীরও নীচে থাকে, তখন বরফ পড়ে না। আমার বোধ ছিল—বরফ পড়া একটা বড় ঠাণ্ডা। তা নয়, বরফ অপেক্ষাকৃত গরম দিনে পড়ে। বেজায় ঠাণ্ডায় এক রকম নেশা হয়। গাড়ী চলে না, শ্লেজ চক্রহীন—ঘসড়ে যায়! সব জমে কাঠ—নদী নালা লেকের (হ্রদের) উপর হাতী চলে যেতে পারে! নায়াগারার প্রচণ্ড প্রবাহশালী বিশাল নির্ঝর জমে পাথর!!! আমি কিন্তু বেশ আছি। প্রথমে একটু ভয় হয়েছিল তার পর গরজের দায়ে একদিন রেলে করে কানাডার কাছে, দ্বিতীয় দিন দক্ষিণ আমেরিকা [যুক্তরাষ্ট্র] লেকচার করে বেড়াচ্চি! গাড়ী ঘরের মত, steam pipe (নলবাহিত বাষ্প)-যোগে খুব গরম, আর চারিদিকে বরফের রাশি ধপধপে সাদা, সে অপূর্ব শোভা!

বড় ভয় ছিল যে, আমার নাক কান খসে যাবে, কিন্তু আজিও কিছু হয় নাই। তবে রাশীকৃত গরম কাপড়, তার উপর সলোম চামড়ার কোট, জুতো, জুতোর উপর পশমের জুতো ইত্যাদি আবৃত হয়ে বাইরে যেতে হয়। নিঃশ্বাস বেরুতে না বেরুতেই দাড়িতে জমে যাচ্চেন। তাতে তামাসা কি জান? বাড়ীর ভেতর জলে এক ডেলা বরফ না দিয়ে এরা পান করে না। বাড়ীর ভেতর গরম কিনা, তাই। প্রত্যেক ঘরে, সিঁড়িতে steam pipe গরম রাখছে। কলা-কৌশলে এরা অদ্বিতীয়, ভোগে বিলাসে এরা অদ্বিতীয়, পয়সা রোজগারে অদ্বিতীয়, খরচে অদ্বিতীয়। কুলীর রোজ ৬৲ টাকা, চাকরের তাই, ৩৲ টাকার কম ঠিকা গাড়ী পাওয়া যায় না। চারি আনার কম চুরুট নাই। ২৪৲ টাকায় মধ্যবিৎ জুতো একজোড়া। ৫০০৲ টাকায় একটা পোষাক। যেমন রোজগার, তেমনই খরচ। একটা লেকচার ২০০।৩০০।৫০০।২০০০।৩০০০৲ পর্যন্ত। আমি ৫০০৲ টাকা৪১ পর্যন্ত পাইয়াছি। অবশ্য—আমার এখানে এখন পোয়াবারো। এরা আমায় ভালবাসে, হাজার হাজর লোক আমার কথা শুনিতে আসে।

প্রভুর ইচ্ছায় মজুমদার মশায়ের সঙ্গে এখানে দেখা। প্রথমে বড়ই প্রীতি, পরে যখন চিকাগোসুদ্ধ নরনারী আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগল তখন মজুমদার ভায়ার মনে আগুন জ্বলল! … দাদা, আমি দেখেশুনে অবাক্! বল্ বাবা, আমি কি তোর অন্নে ব্যাঘাত করেছি? তোর খাতির তো যথেষ্ট এ দেশে। তবে আমার মত তোমাদের হল না, তা আমার কি দোষ? … আর মজুমদার পার্লামেণ্ট অব্ রিলিজিয়নের পাদ্রীদের কাছে আমার যথেষ্ট নিন্দা করে, ‘ও কেউ নয়, ঠক জোচ্চোর; ও তোমাদের দেশে এসে বলে—আমি ফকির’ ইত্যাদি বলে তাদের মন আমার উপর যথেষ্ট বিগড়ে দিলে। ব্যারোজ প্রেসিডেণ্টকে এমনি বিগড়ালে যে, সে আমার সঙ্গে ভাল করে কথাও কয় না। তাদের পুস্তকে প্যাম্ফলেটে যথাসাধ্য আমায় দাবাবার চেষ্টা; কিন্তু গুরু সহায় বাবা! মজুমদার কি বলে? সমস্ত আমেরিকান নেশন যে আমাকে ভালবাসে, ভক্তি করে, টাকা দেয়, গুরুর মত মানে—মজুমদার করবে কি? পাদ্রী-ফাদ্রীর কি কর্ম? আর এরা বিদ্বানের জাত। এখানে ‘আমরা বিধবার বে দিই, আর পুতুলপূজা করি না’—এ সব আর চলে না—পাদ্রীদের কাছে কেবল চলে। ভায়া, এরা চায় ফিলসফি, learning (বিদ্যা), ফাঁকা গপ্পি আর চলে না।

ধর্মপাল ছোকরা বেশ, … ভাল মানুষ। তার এদেশে যথেষ্ট আদর হয়েছিল। দাদা, মজুমদারকে দেখে আমার আক্কেল এসে গেল। বুঝতে পারলুম, ‘যে নিঘ্নন্তি পরহিতং নিরর্থকং তে কে ন জানীমহে’—ভর্তৃহরি।৪২

ভায়া, সব যায়, ওই পোড়া হিংসেটা যায় না। আমাদের ভিতরও খুব আছে। আমাদের জাতের ঐটে দোষ, খালি পরনিন্দা আর পরশ্রীকাতরতা। হাম‍্‍বড়া, আর কেউ বড় হবে না।

এ দেশের মেয়ের মত মেয়ে জগতে নাই। কি পবিত্র, স্বাধীন, স্বাপেক্ষ, আর দয়াবতী—মেয়েরাই এদেশের সব। বিদ্যে বুদ্ধি সব তাদের ভেতর। ‘যা শ্রীঃ সুকৃতিনাং স্বয়ং ভবনেষু’ (যিনি পুণ্যবানদের গৃহে স্বয়ং লক্ষ্মীস্বরূপিণী) এ দেশে, আর ‘পাপাত্মনাং হৃদয়েষ্বলক্ষ্মীঃ’ (পাপাত্মগণের হৃদয়ে অলক্ষ্মীস্বরূপিণী) আমাদের দেশে, এই বোঝ। হরে, হরে, এদের মেয়েদের দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। ‘ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীঃ’ ইত্যাদি—(তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমি লজ্জাস্বরূপিণী)। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ (যে দেবী সর্বভূতে শক্তিরূপে অবস্থিতা) ইত্যাদি। এদেশের বরফ যেমনি সাদা, তেমনি হাজার হাজার মেয়ে আছে, যাদের মন পবিত্র। আর আমাদের দশ বৎসরের বেটা-বিউনিরা!!! প্রভো, এখন বুঝতে পারছি। আরে দাদা, ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ’ (যেখানে স্ত্রীলোকেরা পূজিতা হন, সেখানে দেবতারাও আনন্দ করেন)—বুড়ো মনু বলেছে। আমরা মহাপাপী; স্ত্রীলোককে ঘৃণ্যকীট, নরকমার্গ ইত্যাদি বলে বলে অধোগতি হয়েছে। বাপ, আকাশপাতাল ভেদ!! ‘যাথাতথ্যতোঽর্থান্ ব্যদধাৎ’৪৩ (যথোপযুক্তভাবে কর্মফল বিধান করেন)। প্রভু কি গপ্পিবাজিতে ভোলেন? প্রভু বলেছেন, ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’ ইত্যাদি—(তুমিই স্ত্রী, তুমিই পুরুষ, তুমিই বালক ও তুমিই বালিকা)।৪৪ আর আমরা বলছি—‘দূরমপসর রে চণ্ডাল’ (ওরে চণ্ডাল, দূরে সরিয়া যা), ‘কেনৈষা নির্মিতা নারী মোহিনী’ ইত্যাদি (কে এই মোহিনী নারীকে নির্মাণ করিয়াছে?)। ওরে ভাই, দক্ষিণ দেশে যা দেখেছি, উচ্চজাতির নীচের উপর যে অত্যাচার! মন্দিরে যে দেবদাসীদের নাচার ধুম! যে ধর্ম গরীবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম? আমাদের কি আর ধর্ম? আমাদের ‘ছুঁৎমার্গ’, খালি ‘আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না’। হে হরি? যে দেশের বড় বড় মাথাগুলো আজ দু-হাজার বৎসর খালি বিচার করছে—ডান হাতে খাব, কি বাম হাতে; ডান দিক্‌ থেকে জল নেব, কি বাঁ দিক্‌ থেকে এবং ফট্ ফট্ স্বাহা, ক্রাং ক্রুং হুঁ হুঁ করে, তাদের অধোগতি হবে না তো কার হবে? ‘কালঃ সুপ্তেষু জাগর্তি কালো হি দুরতিক্রমঃ’ (সকলে নিদ্রিত হয়ে থাকলেও কাল জাগরিত থাকেন, কালকে অতিক্রম করা বড় কঠিন)। তিনি জানছেন, তাঁর চক্ষে কে ধুলো দেয় বাবা!

যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশবিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ঐ গরীবদের রক্ত চুষে খায়, আর তাদের উন্নতির কোন চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক! সে ধর্ম, না পৈশাচ নৃত্য! দাদা, এটি তলিয়ে বোঝ—ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেছি। এ দেশ দেখেছি। কারণ বিনা কার্য হয় কি? পাপ বিনা সাজা মিলে কি? ‘সর্বশাস্ত্রপুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্। পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্॥ (সমুদয় শাস্ত্র ও পুরাণে ব্যাসের দুইটি বাক্য—পরোপকার করিলে পুণ্য ও পরপীড়ন করিলে পাপ উৎপন্ন হয়)। সত্য নয় কি?

দাদা, এই সব দেখে—বিশেষ দারিদ্র্য আর অজ্ঞতা দেখে আমার ঘুম হয় না; একটা বুদ্ধি ঠাওরালুম Cape Comorin (কুমারিকা অন্তরীপে) মা কুমারীর মন্দিরে বসে, ভারতবর্ষের শেষ পাথর-টুকরার উপর বসে—এই যে আমরা এতজন সন্ন্যাসী আছি, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, লোককে metaphysics (দর্শন) শিক্ষা দিচ্ছি, এ সব পাগলামি। ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’—গুরুদেব বলতেন না? ঐ যে গরীবগুলো পশুর মত জীবন যাপন করছে, তার কারণ মূর্খতা; পাজি বেটারা চার যুগ ওদের চুষে খেয়েছে, আর দু পা দিয়ে দলেছে।

“ মনে কর, কতকগুলি সন্ন্যাসী যেমন গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—কোন্ কাজ করে?—তেমনি কতকগুলি নিঃস্বার্থ পরহিতচিকীর্ষু সন্ন্যাসী—গ্রামে গ্রামে বিদ্যা বিতরণ করে বেড়ায়, নানা উপায়ে নানা কথা, map, camera, globe (মানচিত্র, ক্যামেরা, গোলক) ইত্যাদির সহায়ে আচণ্ডালের উন্নতিকল্পে বেড়ায়, তাহলে কালে মঙ্গল হতে পারে কি না। এ সমস্ত প্ল্যান আমি এইটুকু চিঠিতে লিখতে পারি না। ফলকথা—If the mountain does not come to Mahomet, Mahomet must come to the mountain৪৫. গরীবেরা এত গরীব, তারা স্কুল- পাঠশালে আসতে পারে না, আর কবিতা-ফবিতা পড়ে তাদের কোন উপকার নাই। We as a nation have lost our individuality and that is the cause of all mischief in India. We have to give back to the nation its lost individuality and raise the masses. The Hindu, the Mahommedan, the Christian, all have trampled them under foot. Again the force to raise them must come from inside, i.e., from the orthodox Hindus. In every country the evils exist not with but against religion. Religion, therefore, is not to blame, but men.৪৬

এই করতে গেলে প্রথম চাই লোক, দ্বিতীয় চাই পয়সা। গুরুর কৃপায় প্রতি শহরে আমি ১০।১৫ জন লোক পাব। পয়সার চেষ্টায় তার পর ঘুরলাম। ভারতবর্ষের লোক পয়সা দেবে!!! Fools and dotards and Selfishness personified৪৭—তারা দেবে! তাই আমেরিকায় এসেছি, নিজে রোজগার করব, করে দেশে যাব and devote the rest of my life to the realization of this one aim of my life.৪৮

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

যেমন আমাদের দেশে social virtue-র (সমাজ-হিতকর গুণের) অভাব, তেমনি এ দেশে spirituality (আধ্যাত্মিকতা) নাই, এদের sprituality দিচ্ছি, এরা আমায় পয়সা দিচ্ছে। কত দিনে সিদ্ধকাম হব জানি না, আমাদের মত এরা hypocrite (কপট) নয়, আর jealousy (ঈর্ষা) একেবারে নাই। হিন্দুস্তানের কারও উপর depend (নির্ভর) করি না। নিজে প্রাণপণ করে রোজগার করে নিজের plans carry out (উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত) করব or die in the attempt (কিম্বা ঐ চেষ্টায় মরব)। ‘সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি’—(যখন মৃত্যু নিশ্চিত, তখন সৎ উদ্দেশ্যে দেহত্যাগ করাই ভাল)।

তোমরা হয়তো মনে করতে পার, কি Utopian nonsense (অসম্ভব বাজে কথা)। You little know what is in me (আমার ভিতর কি আছে, তোমরা মোটেই জান না)। আমাদের ভেতর যদি কেউ আমার সহায়তা করে in my plan (আমার পরিকল্পনা সফল করতে)—all right (খুব উত্তম); নইলে কিন্তু গুরুদেবwill show me the way out (আমাকে পথ দেখাইবেন)। ইতি।

মাকে আমার কোটি কোটি সাষ্টাঙ্গ দিবে। তাঁর আশীর্বাদে আমার সর্বত্র মঙ্গল। এই পত্র বাহিরের লোকের নিকট পড়বার আবশ্যক নাই। এটি সকলকে বলিও, সকলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করিও—সকলে jealousy ত্যাগ করে এককাট্টা হয়ে থাকতে পারবে কি না। যদি না পারে, যারা হিংসুটেপনা না করে থাকতে পারে না, তাদের ঘরে যাওয়াই ভাল, আর সকলের কল্যাণের জন্য। ঐটে আমাদের জাতের দোষ, national sin (জাতিগত পাপ)!!! এদেশে ঐটে নাই, তাই এরা এত বড়।

আমাদের মত কূপমণ্ডুক তো দুনিয়ায় নাই। কোন একটা নূতন জিনিষ কোন দেশ থেকে আসুক দিকি, আমেরিকা সকলের আগে নেবে। আর আমরা? আমাদের মত দুনিয়ায় কেউ নেই, ‘আর্যবংশ’!!! কোথায় বংশ তা জানি না! … এক লাখ লোকের দাবানিতে ৩০০ মিলিয়ান (ত্রিশ কোটি) কুকুরের মত ঘোরে, আর তারা ‘আর্যবংশ’!!!

কিমধিকমিতি—বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৫
[রেভারেণ্ড হিউমকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
২৯ মার্চ, ১৮৯৪

প্রিয় ভ্রাতা,
আপনার পত্র সদ্য এখানে আমার কাছে পৌঁছেছে। আমি ব্যস্ত আছি, সুতরাং আপনার পত্রের মাত্র কয়েকটি বিষয় সংশোধনের সুযোগ নিচ্ছি বলে ক্ষমা করবেন।

প্রথমতঃ পৃথিবীর কোন ধর্ম অথবা ধর্মসংস্থাপকের বিরুদ্ধে আমার কোন কিছুই বলবার নেই, থাকতে পারে না; আমাদের ধর্ম সম্পর্কে আপনারা যা খুশী ভাবুন না কেন। সব ধর্মই আমার কাছে অতি পবিত্র। দ্বিতীয়তঃ মিশনরীরা আমাদের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষা করে না, এমন কথা আমি বলিনি; কিন্তু আমার এই অভিমতে আমি এখনও সুদৃঢ় যে, তাঁদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যকই (সত্যি যদি কেউ থাকেন) সংস্কৃতের প্রতি কোনপ্রকার মনোযোগ দেন। তাছাড়া একথাও সত্য নয় যে, আমি কোন ধর্মসংস্থার বিরুদ্ধে কিছু বলেছি, যদিও এখনও আমি আমার অভিমতের উপর জোর দিচ্ছি যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে কখনও খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা সম্ভব হবে না; খ্রীষ্টধর্মের দ্বারা নিম্নশ্রেণীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে—এ কথাও আমি অস্বীকার করছি; এবং সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করে দিচ্ছি—দক্ষিণ ভারতে ভারতীয় খ্রীষ্টানেরা কেবল যে ক্যাথলিক তাই নয়, তাদের নিজেদের উক্তি অনুযায়ী তারা হল ‘জাতিমানা খ্রীষ্টান’, অর্থাৎ তারা ঘনিষ্ঠভাবে তাদের জাতিকে আঁকড়ে থাকে, এবং আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি—যদি হিন্দুসমাজ তার বর্জননীতি পরিহার করে, তাহলে ওদের শতকরা নব্বুই ভাগ বহু ত্রুটিপূর্ণ এই হিন্দুধর্মেই অবিলম্বে ফিরে আসবে।

পরিশেষে আমাকে ‘স্বদেশবাসী’ বলে সম্বোধন করার জন্য আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই সর্বপ্রথম কোন বিদেশী ইওরোপীয় একজন ঘৃণ্য নেটিভকে ঐ ভাষায় সম্বোধন করতে সাহসী হলেন—তিনি ভারতে জাত বা মিশনরী, যাই হোন না কেন। বন্ধুবর, ঐ একইভাবে ভারতবর্ষেও কি আমাকে সম্বোধন করতে আপনি সাহস করবেন? ভারতে জাত মিশনরীদের অনুগ্রহ করে বলুন, তাঁরা ঐভাবেই যেন আমাদের সম্বোধন করেন, এবং যাঁরা ভারতে জন্মাননি, তাঁদের বলুন তাঁরা যেন ভারতবাসীকে সমপর্যায়ের মানুষ বলে গণ্য করেন। আর বাকী সব বিষয়ে—আপনি নিজেই আমাকে আহাম্মক মনে করবেন, যদি আমি কতকগুলো পৃথিবী-পর্যটক বা অলীক কাহিনীকারের বিবরণ অনুযায়ী আমাদের ধর্ম বা সমাজের বিচার হতে পারে বলে স্বীকার করে নিই। ভ্রাতঃ, ক্ষমা করবেন, ভারতে জন্মালেও আমাদের সমাজ বা ধর্মের বিষয়ে আপনি জানেনই বা কি? কেননা সমাজের দ্বার যেভাবে বন্ধ, কিছু জানা অসম্ভব। সর্বোপরি, সকলেই তার পূর্ব ধারণার মাপকাঠিতে কোন জাতি বা ধর্মের বিচার করে থাকে—করে না কি? প্রভু আপনাকে আশীর্বাদ করুন, আপনি আমাকে ‘স্বদেশবাসী’ বলেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রেম ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক এখনও সম্ভব।

ভ্রাতৃপ্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৬
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
৩০ মার্চ, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনী,
তুমি ও মাদার চার্চ টাকা পেয়েছ জানিয়ে যে চিঠি দুখানি লিখেছ, তা এইমাত্র একসঙ্গে পেলাম। খেতড়ির পত্রটি পেয়ে সুখী হলাম; তোমাকে ওটি ফেরত পাঠাচ্ছি। পড়ে দেখো—লেখক চাইছেন খবরের কাগজের কিছু কাটিং! ডেট্রয়েটের কাগজগুলি ছাড়া আর কিছু আমার কাছে নেই, তাই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমিও কিছু সংগ্রহ করতে পারলে পাঠিয়ে দিও—যদি অবশ্য সুবিধা হয়। ঠিকানা জান তো?—

H. H. The Maharaja of Khetri, Rajputana, India.

চিঠিখানা কিন্তু তোমাদের ধার্মিক পরিবারের মধ্যেই যেন থাকে। মিসেস ব্রীড প্রথমে আমায় এক কড়া ঝাঁঝালো চিঠি দেন। আজ টেলিগ্রামে এক সপ্তাহের জন্য তাঁর আতিথ্যগ্রহণের নিমন্ত্রণ পেলাম। এর আগে নিউ ইয়র্ক থেকে মিসেস স্মিথের এক পত্র পেয়েছি—তিনি, মিস হেলেন গোল্ড ও ডাক্তার—আমাকে নিউ ইয়র্কে আহ্বান করেছেন। আবার আগামী মাসে ১৭ তারিখে লীন ক্লাবের (Lynn Club) নিমন্ত্রণ আছে। প্রথমে নিউ ইয়র্কে যাব, তারপর লীনে তাদের সভায় যথাসময়ে উপস্থিত হব।

ইতোমধ্যে যদি আমি চলে না যাই—মিসেস ব্যাগলির আগ্রহও তাই, তাহলে আগামী গ্রীষ্মে সম্ভবতঃ এনিস্কোয়ামে (Annisquam) যাব। মিসেস ব্যাগলি সেখানে এক সুন্দর বাড়ী বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। মহিলাটি বেশ ধর্মপ্রাণা (spiritual), মিঃ পামার কিন্তু বেশ একটু পানাসক্ত (spirituous)—তাহলেও সজ্জন। অধিক আর কি? আমি শারীরিক ও মানসিক বেশ ভাল আছি। স্নেহের ভগিনীগণ! তোমরা সুখী—চিরসুখী হও। ভাল কথা, মিসেস শার্মান নানা রকমের উপহার দিয়েছেন—নখ কাটবার ও চিঠি রাখবার সরঞ্জাম, একটি ছোট ব্যাগ, ইত্যাদি ইত্যাদি—যদিও ওগুলি নিতে আমার আপত্তি ছিল, বিশেষ করে ঝিনুকের হাতলওয়ালা শৌখীন নখকাটা সরঞ্জামটার বিষয়ে, তবুও তাঁর আগ্রহের জন্য নিতে হল। ঐ ব্রাশ নিয়ে কি যে করব, তা জনি না। ভগবান্ ওদের রক্ষা করুন। তিনি এক উপদেশও দিয়েছেন—আমি যেন এই আফ্রিকী পরিচ্ছদে ভদ্রসমাজে না যাই। তবে আর কি! আমিও একজন ভদ্রসমাজের সভ্য! হা ভগবান্, আরও কি দেখতে হবে! বেশী দিন বেঁচে থাকলে কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই না হয়!

তোমাদের ধার্মিক পরিবারের সকলকে অগাধ স্নেহ জানাচ্ছি। ইতি

তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৭

নিউ ইয়র্ক
৯ এপ্রিল, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার শেষ পত্রখানি কয়েকদিন আগে পেয়েছি। দেখ, আমাকে এখানে এত বেশী ব্যস্ত থাকতে হয় আর প্রত্যহ এতগুলো চিঠি লিখতে হয় যে, তুমি আমার কাছ থেকে ঘন ঘন পত্র পাবার আশা করতে পার না। যা হোক, এখানে যা কিছু হচ্ছে, তা যাতে তুমি মোটামুটি জানতে পার, তার জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করে থাকি। আমি ধর্মমহাসভা-সম্বন্ধীয় একখানি বই তোমায় পাঠাবার জন্য চিকাগোয় লিখব। ইতোমধ্যে তুমি নিশ্চয় আমার দুটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা পেয়েছ।

সেক্রেটারী সাহেব আমায় লিখেছেন, আমার ভারতে ফিরে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য—কারণ ভারতই আমার কর্মক্ষেত্র। এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু হে ভ্রাতৃগণ, আমাদিগকে এমন একটি প্রকাণ্ড মশাল জ্বালতে হবে, যা সমগ্র ভারতে আলো দেবে। অতএব ব্যস্ত হয়ো না, ঈশ্বরেচ্ছায় সময়ে সবই হবে। আমি আমেরিকায় অনেক বড় বড় শহরে বক্তৃতা দিয়েছি এবং ওতে যে টাকা পেয়েছি, তাতে এখানকার অত্যধিক খরচ বহন করেও ফেরবার ভাড়া যথেষ্ট থাকবে। আমার এখানে অনেক ভাল ভাল বন্ধু হয়েছে—তার মধ্যে কয়েকজনের সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি। অবশ্য গোঁড়া পাদ্রীরা আমার বিপক্ষে, আর তাঁরা আমার সঙ্গে সোজা রাস্তায় সহজে পেরে উঠবেন না দেখে আমাকে গালমন্দ নিন্দাবাদ করতে আরম্ভ করেছেন, আর ‘ম—’বাবু তাঁদের সাহায্য করছেন। তিনি নিশ্চয় হিংসায় পাগল হয়ে গেছেন। তিনি তাঁদের বলেছেন, আমি একটা ভয়ানক জোচ্চোর ও বদমাশ, আবার কলিকাতায় গিয়ে সেখানকার লোকদের বলেছেন, আমি ঘোর পাপে মগ্ন, বিশেষতঃ আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছি!!! প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন। ভ্রাতৃগণ, কোন ভাল কাজই বিনা বাধায় সম্পন্ন হয় না। কেবল যারা শেষ পর্যন্ত অধ্যবসায়ের সহিত লেগে থাকে, তারাই কৃতকার্য হয়। আমি তোমার ভগিনীপতির৪৯ লিখিত পুস্তিকাগুলি এবং তোমার পাগলা বন্ধুর আর একখানি পত্র পেয়েছি। ‘যুগ’ সম্বন্ধে প্রবন্ধটি বড় সুন্দর—তাতে যুগের যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাই তো ঠিক ব্যাখ্যা; তবে আমি বিশ্বাস করি, সত্যযুগ এসে পড়েছে—এই সত্যযুগে এক বর্ণ, এক বেদ হবে এবং সমগ্র জগতে শান্তি ও সমন্বয় স্থাপিত হবে। এই সত্যযুগের ধারণা অবলম্বন করেই ভারত আবার নবজীবন পাবে। এতে বিশ্বাস স্থাপন কর।

একটা জিনিষ করা আবশ্যক—যদি পার। মান্দ্রাজে একটা প্রকাণ্ড সভা আহ্বান করতে পার? রামনাদের রাজা বা ঐরূপ একজন বড় লোক কাকেও সভাপতি করে ঐ সভায় একটা প্রস্তাব করিয়ে নিতে পার যে, আমি আমেরিকায় হিন্দুধর্ম যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছি, তাতে তোমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়েছ (—অবশ্য যদি তোমরা সত্যই ঐরূপ হয়ে থাক)। তারপর সেই প্রস্তাবটি ‘চিকাগো হেরাল্ড’, ‘ইণ্টার-ওশ্যান’ (Inter-Ocean), ‘নিউ ইয়র্ক সান’ এবং ডেট্রয়েট (মিশিগান) থেকে প্রকাশিত ‘কমার্শিয়াল এডভাটাইজার’ কাগজে পাঠিয়ে দিতে হবে। চিকাগো ইলিনয় রাষ্ট্রে। ‘নিউ ইয়র্ক সান’-এর আর বিশেষ ঠিকানার কোন আবশ্যক নাই। প্রস্তাবের কয়েকটি কপি ধর্ম-মহাসভার সভাপতি ডাঃ ব্যারোজকে চিকাগোয় পাঠাবে—আমি তাঁর বাড়ীর নম্বরটা ভুলে গেছি, রাস্তাটার নাম ইণ্ডিয়ানা এভিনিউ। এক কপি ডেট্রয়েটের মিসেস জে. জে. ব্যাগলির নামে পাঠাবে—তাঁর ঠিকানা ওয়াশিংটন এভিনিউ। এই সভাটা যত বড় হয়, তার চেষ্টা করবে। যত বড় বড় লোককে পার, ধরে নিয়ে এসে এই সভায় যোগ দেওয়াবার চেষ্টা করবে; তাঁদের ধর্মের জন্য, দেশের জন্য তাঁদের এতে যোগ দেওয়া উচিত। মহীশূরের মহারাজ ও তাঁর দেওয়ানের নিকট হতে সভা ও তার উদ্দেশ্যের সমর্থন করে চিঠি নেবার চেষ্টা কর—খেতড়ির মহারাজের নিকট থেকেও ঐরূপ চিঠি নেবার চেষ্টা কর—মোটের উপর সভাটা যত প্রকাণ্ড হয় ও তাতে যত বেশী লোক হয়, তার চেষ্টা কর।

উঠ বৎসগণ—এই কাজে লেগে যাও। যদি তোমরা এটা করতে পার, তবে ভবিষ্যতে আমরা অনেক কাজ করতে পারব নিশ্চয়।

প্রস্তাবটি এমন ধরনের হবে যে, মান্দ্রাজের হিন্দুসমাজ, যাঁরা আমাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা আমার এখানকার কাজে সম্পূর্ণ সন্তোষ প্রকাশ করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

যদি সম্ভব হয়, এইটির জন্য চেষ্টা কর—এ তো আর বেশী কাজ নয়। সব জায়গা থেকে যতদূর পার আমাদের কাজে সহানুভূতি-প্রকাশক পত্রও যোগাড় কর, ঐগুলি ছাপাও, আর যত শীঘ্র পার মার্কিন সংবাদপত্রসমূহে পাঠাও। বৎসগণ, এতে অনেক কাজ হবে। ‘ব্রা—’ সমাজের লোকেরা এখানে যা তা বলছে। যত শীঘ্র হয়, তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। সনাতন হিন্দুধর্মের জয় হোক। মিথ্যাবাদী ও পাষণ্ডেরা পরাভূত হোক। উঠ, উঠ বৎসগণ, আমরা নিশ্চিত জয়লাভ করব। আমার পত্রগুলির প্রকাশ সম্বন্ধে বক্তব্য এই—যতদিন না আমি ভারতে ফিরছি, ততদিন এইগুলির যতটা অংশ প্রকাশ করা উচিত, ততটা আমাদের বন্ধুগণের নিকট প্রকাশ করা যেতে পারে। একবার কাজ করতে আরম্ভ করলে খুব হুজুকে মেতে যাবে, কিন্তু আমি কাজ না করে বাঙালীর মত কেবল লম্বা লম্বা কথা কইতে চাই না।

ঠিক বলতে পারি না, তবে বোধ হয়, কলিকাতার গিরিশ ঘোষ আর মিত্র মহাশয় আমার গুরুদেবের ভক্তদের দিয়ে কলিকাতায় ঐরূপ সভা আহ্বান করাতে পারেন। যদি পারেন তো খুব ভালই হয়। সম্ভব হলে কলিকাতার সভায় ঐ একই রকম প্রস্তাব পাস করিয়ে নিতে বলবে। কলিকাতায় হাজার হাজার লোক আছে, যারা আমাদের কাজের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। …

আর বিশেষ কিছু লিখিবার নেই। আমাদের সকল বন্ধুকে আমার সাদর সম্ভাষণাদি জানাবে—আমি সতত তাঁদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। ইতি

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

পুনঃ—সাবধান, পত্র লিখিবার সময় আমার নামের আগে ‘His Holiness’ লিখো না। এখানে উহা অত্যন্ত কিম্ভূতকিমাকার শুনায়। ইতি

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৮
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৫ এপ্রিল, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার আমন্ত্রণের জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ৭ই মে যাচ্ছি। বিছানা?—বন্ধু, আপনার ভালবাসা এবং মহৎ প্রাণ পাথরকেও পাখীর পালকের মত কোমল করতে পারে।

সেলেমে লেখকদের প্রাতরাশে যোগ দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।

৭ই ফিরছি।

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৮৯
[মিস ইসাবেল ম্যাক্‌কিণ্ডলিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৬ এপ্রিল

প্রিয় ভগিনী,
গতকাল তোমার চিঠি পেয়েছি। তুমি ঠিকই বলেছ, আমি ‘ইণ্টিরিয়র’-৫০ এর পাগলামিতে খুব মজা বোধ করছি। কিন্তু তুমি ভারতের কাগজপত্রের যে ডাক গতকাল পাঠিয়েছ, তা মাদার চার্চ যেমন বলেছেন—দীর্ঘ বিরতির পর সত্যি সুসংবাদ। ওর মধ্যে দেওয়ানজীর একটি চমৎকার পত্র আছে। বৃদ্ধ লোকটি—প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন, যথারীতি সাহায্যের প্রস্তাব করেছেন। ওর মধ্যে কলিকাতায় প্রকাশিত আমার সম্বন্ধে একটি ছোট্ট পুস্তিকা আছে, যাতে দেখা গেল—‘প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি’ তাঁর নিজ দেশে মর্যাদা পেলেন; আমার জীবনে অন্তত একবারের জন্য এটা দেখতে পেলাম। আমেরিকান ও ভারতীয় পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত আমার বিষয়ক অংশগুলি তার মধ্যে রয়েছে। কলিকাতার পত্রাদির অংশগুলি বিশেষভাবে তৃপ্তিকর, কিন্তু প্রশংসাবাহুল্যের জন্য সেগুলি তোমাকে পাঠাব না। তারা আমার সম্বন্ধে ‘অপূর্ব’, ‘অদ্ভুত’, ‘সুবিখ্যাত’ এইসব নানা আজে-বাজে কথা বলেছে, কিন্তু তারা বহন করে এনেছে সমগ্র জাতির হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা। এখন আমি লোকের কথা আর গ্রাহ্য করি না, আমার নিজের দেশের লোক বললেও না—কেবল একটি কথা। আমার বুড়ী মা এখনও বেঁচে আছেন, সারা জীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সে-সব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করবার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ আশার, তাঁর সবচেয়ে ভালবাসার যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছেন, সে দূরদেশে গিয়ে—কলিকাতায় মজুমদার যেমন রটাচ্ছে তেমনিভাবে—জঘন্য নোংরা জীবন যাপন করছে, এ সংবাদ তাঁকে একেবারে শেষ করে দেবে। কিন্তু প্রভু মহান্, তাঁর সন্তানের ক্ষতি কেউ করতে পারে না।

ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে—আমি না চাইতেই। ঐ সম্পাদকটি কে জান?—আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক, যিনি আমার অত প্রশংসা করেছেন এবং আমেরিকায় আমি হিন্দুধর্মের পক্ষ-সমর্থনে এসেছি বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তিনি মজুমদারের সম্পর্কিত ভাই!! হতভাগ্য মজুমদার! ঈর্ষায় জ্বলে মিথ্যা কথা বলে নিজের উদ্দেশ্যেরই ক্ষতি করলে। প্রভু জানেন, আমি আত্মসমর্থনের কিছুমাত্র চেষ্টা করিনি।

‘ফোরাম’-এ মিঃ গান্ধীর রচনা এর পূর্বেই আমি পড়েছি। যদি গতমাসের ‘রিভিউ অফ রিভিউজ’টা পাও, তাহলে সেটা মায়ের কাছে পাঠ কর। তাতে আফিং-সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতীয় চরিত্র সম্পর্কে বৃটিশ ভারতের জনৈক সর্বোচ্চ রাজকর্মচারীর অভিমত পাবে। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে হিন্দুদের তুলনা করে হিন্দুদের আকাশে তুলেছেন। আমাদের জাতির একজন চরমতম শত্রু ঐ স্যার লেপেল্ গ্রিফিন্! তাঁর এই মত-পরিবর্তনের কারণ কি?

বষ্টনে মিসেস ব্রীড-এর বাড়ীতে আমার সময় কেটেছে চমৎকার। অধ্যাপক রাইটের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি আবার বষ্টনে যাচ্ছি। দরজীরা আমার নূতন গাউন তৈরী করছে। কেম্ব্রিজ (হার্ভার্ড) ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দিতে যাব। সেখানে অধ্যাপক রাইটের অতিথি হব। বষ্টনের কাগজপত্রে আমাকে বিরাট করে স্বাগত জানিয়েছে।

এই সব আজে-বাজে ব্যাপারে আমি পরিশ্রান্ত। মে মাসের শেষের দিকে চিকাগোয় যাব। সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে আবার ফিরব পূর্বদিকে।

গত রাত্রে ওয়ালডর্ফ হোটেলে বক্তৃতা দিয়েছি। মিসেস স্মিথ প্রতি টিকিট দু-ডলার করে বেচেছেন। ঘর-ভর্তি শ্রোতা পেয়েছিলাম, যদিও ঘরটি বেশী বড় ছিল না। টাকাকড়ির দর্শন এখনও পাইনি। আজকের মধ্যে পাবার আশা রাখি।

লীন-এ যে এক-শ ডলার পেয়েছি, তা পাঠালাম না, কারণ নূতন গাউন তৈরী ইত্যাদি বাজে ব্যাপারে খরচ করতে হবে।

বষ্টনে টাকার ভরসা নেই। তবু আমেরিকার মস্তিষ্কটিকে স্পর্শ করতেই হবে, তাতে নাড়া দিতেই হবে, দেখি যদি পারি।

তোমার প্রিয় ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯০
[মিস ইসাবেল ম্যাক্‌কিণ্ডলিকে লিখিত]

নিউ ইয়র্ক

প্রিয় ভগিনী,
পুস্তিকাটি তোমাকে এখনই পাঠাতে পারব বলে মনে হয় না, তবে গতকাল ভারত থেকে সংবাদপত্রের যে-সব অংশ এসেছে, তা তোমায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেগুলো পড়ে অনুগ্রহ করে মিসেস ব্যাগলির কাছে পাঠিয়ে দিও। ঐ সংবাদপত্রটির সম্পাদক হচ্ছেন মিঃ মজুমদারের আত্মীয়। বেচারা মজুমদারের জন্য এখন আমার দুঃখ হয়!!

আমার কোটের ঠিক কমলা রঙটি এখানে খুঁজে বার করতে পারলাম না। সুতরাং তার কাছাকাছি ভাল রঙ যা মিলল—পীতাভ রক্তিম—তাতেই খুশী থাকতে হল। কয়েকদিনের মধ্যেই কোটটি তৈরী হয়ে যাবে।

সেদিন ওয়ালডর্ফের বক্তৃতা থেকে ৭০ ডলার পেয়েছি। আগামীকালের বক্তৃতা থেকে আরও কিছু পাবার আশা রাখি। ৭ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত বষ্টনে বক্তৃতাদি আছে, তবে সেখানে তারা খুব কমই পয়সা দেয়।

গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা পাইপ কিনেছি—দোহাই, ফাদার পোপকে কথাটি বল না যেন। কোটের খরচ পড়বে ৩০ ডলার। খাবার-দাবার ঠিকই মিলছে … এবং যথেষ্ট টাকা। আশা হয়, আগামী বক্তৃতার পরেই অবিলম্বে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব।

… সন্ধ্যায় এক নিরামিষ নৈশভোজে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি!

ঠিক, আমি নিরামিষাশী … কারণ যখন নিরামিষ জোটে, তখন তাই আমার পছন্দ। লাইম্যান অ্যাবট-এর কাছে আগামী পরশু মধ্যাহ্ন-ভোজের আর একটি নিমন্ত্রণ আছে। সময় মোটের উপর চমৎকার কাটছে। বষ্টনেও তেমনি সুন্দর কাটবে আশা হয়—কেবল ঐ জঘন্য, অতি জঘন্য বিরক্তিকর বক্তৃতা বাদে। যা হোক, ১৯ তারিখ পার হলেই এক লাফে বষ্টন থেকে … চিকাগোয়, … তারপরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেব, আর টানা বিশ্রাম—দু-তিন সপ্তাহের। তখন গ্যাঁট হয়ে বসে শুধু গল্প করব—আর পাইপ টানব।

ভাল কথা, তোমার নিউ ইয়র্কীরা লোক খুবই ভাল, কেবল তাদের মগজের চেয়ে টাকা বেশী।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিতে যাব। বষ্টনে তিনটি বক্তৃতা এবং হার্ভার্ডে তিনটি—সকলেরই ব্যবস্থা করেছেন মিসেস ব্রীড। এখানেও ওরা কিছু ব্যবস্থা করছে। সুতরাং চিকাগোর পথে আমি আর একবার নিউ ইয়র্কে আসব—কিছু কড়া বাণী শুনিয়ে টাকাকড়ি পকেটস্থ করে সাঁ করে চিকাগোয় চলে যাব।

চিকাগোয় পাওয়া যায় না এমন কিছু যদি নিউ ইয়র্ক বা বষ্টন থেকে তোমার দরকার থাকে, সত্বর লিখবে। আমার এখন পকেট-ভর্তি ডলার। যা তুমি চাইবে এক মুহূর্তে পাঠিয়ে দেব। এতে অশোভন কিছু হবে—কখনও মনে কর না। আমার কাছে বুজরুকি নেই। আমি যদি তোমার ভাই হই তো ভাই-ই! পৃথিবীতে একটি জিনিষই আমি ঘৃণা করি—বুজরুকি।

তোমার স্নেহময় ভাই
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (৯১-১০০)

পত্র সংখ্যা (৯১-১০০)

পত্র সংখ্যা- ৯১
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৪ মে, ১৮৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার সহৃদয় লিপি এখনই পেলাম। আপনার কথামত কাজ করে আমি যে খুবই সুখী হব, তা বলাই বাহুল্য।

কর্ণেল হিগিন‍্সনের চিঠিও পেয়েছি। তাকে উত্তর পাঠাচ্ছি। আমি রবিবার (৬ই মে) বষ্টনে যাব। মিসেস হাউ-এর উইমেন‍্স্ ক্লাবে সোমবার বক্তৃতা দেবার কথা।

আপনার সদা বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯২ 
১৭ বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
মে, ১৮৯৪

প্রিয় অধ্যাপকজী,
ইতোমধ্যে আপনি পুস্তিকা এবং চিঠিগুলি পেয়ে গেছেন। যদি আপনি চান, তাহলে চিকাগো থেকে ভারতীয় রাজা ও রাজমন্ত্রীদের কয়েকখানি চিঠি পাঠাতে পারি। ঐ মন্ত্রীদের একজন ভারতের রাজকীয় কমিশনের অধীন বিগত ‘আফিং কমিশন’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। আমি যে প্রতারক নই, তা আপনাকে বিশ্বাস করবার জন্য তাদের আপনার কাছে লিখতে বলব, আপনি যদি এটা পছন্দ করেন। কিন্তু ভ্রাতঃ, এ সব বিষয়ে গোপনতা ও অপ্রতিকারই আমাদের জীবনের আদর্শ।

আমাদের কর্তব্য শুধু ত্যাগ—গ্রহণ নয়। যদি আমার মাথায় খেয়াল না চাপত, তাহলে আমি কখনই এখানে আসতাম না। এতে আমার কাজের সহায়তা হবে, এই আশায় আমি ধর্মমহাসভায় যোগদান করেছি, যদিও আমার দেশবাসী যখন আমাকে পাঠাতে চেয়েছিল, তখন আমি সর্বদা আপত্তি করেছি। আমি তাদের বলে এসেছি, ‘আমি মহাসভায় যোগদান করতে পারি বা নাও পারি, তোমাদের যদি খুশী হয়, আমাকে পাঠাতে পার।’ তাঁরা আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। বাদ-বাকী আপনি করেছেন।

হে সহৃদয় বন্ধু, সর্বপ্রকারে আপনার সন্তোষ বিধান করতে ন্যায়তঃ আমি বাধ্য। আর বাকী পৃথিবীকে—তাদের বাতচিতকে আমি গ্রাহ্য করি না। আত্মসমর্থন সন্ন্যাসীর কাজ নয়। আপনার কাছে তাই আমার প্রার্থনা, আপনি ঐ পুস্তিকা ও চিঠিপত্রাদি কাউকে দেখাবেন না বা ছাপাবেন না। বুড়ো মিশনরীগুলোর আক্রমণকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। কিন্তু আমি দারুণ আঘাত পেয়েছি মজুমদারের ঈর্ষার জ্বালা দেখে। প্রার্থনা করি, তাঁর যেন চৈতন্য হয়। তিনি উত্তম ও মহান্ ব্যক্তি, সারা জীবন অপরের মঙ্গল করতে চেয়েছেন। অবশ্য এর দ্বারা আমার গুরুদেবের একটি কথাই আবার প্রমাণিত হল—‘কাজলের ঘরে থাকলে তুমি যত সেয়ানাই হও না কেন, গায়ে ছিটেফোঁটা কালি লাগবেই।’ সাধু পবিত্র হবার যত চেষ্টাই কেউ করুক না কেন, মানুষ যতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছে তার স্বভাব কিছু পরিমাণে নিম্নগামী হবেই।

ভগবানের দিকে যাবার পথ সাংসারিক পথের ঠিক বিপরীত। ঈশ্বর ও ধনৈশ্বর্য একই সঙ্গে কেউ কখনও পেয়েছে?

আমি কোনদিন ‘মিশনরী’ ছিলাম না, কোনদিন হবও না—আমার স্বস্থান হিমালয়ে। পূর্ণ বিবেকের সঙ্গে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে অন্ততঃ এই কথা আজ আমি বলতে পারি, ‘হে প্রভু, আমার ভ্রাতৃগণের ভয়ঙ্কর যাতনা আমি দেখেছি, যন্ত্রণামুক্তির পথ আমি খুঁজেছি এবং পেয়েছি—প্রতিকারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, প্রভু।’

তাঁর আশীর্বাদ অনন্তকাল ধরে আপনাদের উপর বর্ষিত হোক।

আপনার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগোঃ

আমি আগামীকাল কিম্বা পরশু চিকাগো যাচ্ছি।

আপনাদের বি.
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৩
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২০ মে, ১৮৯৪

প্রিয় শরৎ,
আমি তোমার পত্র পাইলাম ও শশী আরোগ্যলাভ করিয়াছে জানিয়া সুখী হইলাম। আমি তোমাকে একটি আশ্চর্য ব্যাপার বলিতেছি, শুন। যখনই তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ হইয়া পড়িবে, তখন সে নিজে অথবা তোমাদের মধ্যে অপর কেহ তাহাকে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করিবে। ঐরূপে দেখিতে দেখিতে মনে মনে বলিবে ও দৃঢ়ভাবে কল্পনা করিবে যে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে। ইহাতে সে শীঘ্র আরোগ্যলাভ করিবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে না জানাইয়াও তুমি এরূপ করিতে পার। সহস্র মাইলের ব্যবধানেও এই কার্য চলিতে পারে। এইটি সর্বদা মনে রাখিয়া আর কখনও অসুস্থ হইও না।

*       *       *

সান্যাল তাহার কন্যাগণের বিবাহের জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া এত অস্থির হইয়াছে কেন, বুঝিতে পারি না। মোদ্দা কথা তো এই যে, সে নিজে যে সংসার হইতে পলায়নে ইচ্ছুক, তাহার কন্যাগণকে সেই পঙ্কিল সংসারে নিমগ্ন করিতে চাহে!!! এ বিষয়ে আমার একটি মাত্র সিদ্ধান্ত থাকিতে পারে—নিন্দা! বালক বালিকা—যাহারই হউক না কেন, আমি বিবাহের নাম পর্যন্ত ঘৃণা করি। তুমি কি বলিতে চাও, আমি একজনের বন্ধনের সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন আজ বিবাহ করে, আমি তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখিব না। এ বিষয়ে আমি স্থিরসংকল্প। এখন বিদায়—

তোমাদের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৪
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৪ মে, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
এই সঙ্গে আমি আপনাকে রাজপুতানার অন্যতম শাসক মহামান্য খেতড়ির মহারাজের পত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহৎ দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের প্রাক্তন মন্ত্রীর পত্রও পাঠালাম। ইনি আফিং কমিশনের একজন সদস্য এবং ‘ভারতের গ্লাডষ্টোন’ নামে খ্যাত। মনে হয় এগুলি পড়লে আপনার বিশ্বাস হবে যে—আমি প্রতারক নই।

একটা জিনিষ আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কখনই মিঃ মজুমদারের ‘নেতা’র৫১ মতাবলম্বী হইনি। যদি মজুমদার তেমন কথা বলে থাকেন, তিনি সত্য বলেননি।

চিঠিগুলো পাঠের পর আশা করি অনুগ্রহ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। পুস্তিকাটির কোন দরকার নেই, ওটার কোন মূল্য দিই না।

প্রিয় বন্ধু, আমি যে যথার্থই সন্ন্যাসী, এ বিষয়ে সর্বপ্রকারে আপনাকে আশ্বস্ত করতে আমি দায়বদ্ধ। কিন্তু সে কেবল ‘আপনাকেই’। বাকী নিকৃষ্ট লোকেরা কি বলে না বলে, আমি তার পরোয়া করি না।

‘কেউ তোমাকে বলবে সাধু, কেউ বলবে চণ্ডাল, কেউ বলবে উন্মাদ, কেউ বলবে দানব, কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের পথে চলে যাও’—এই কথা বলেছিলেন বার্ধক্যে সন্ন্যাসগ্রহণকারী রাজা ভর্তৃহরি—ভারতের একজন প্রাচীন সম্রাট্ ও মহান্ সন্ন্যাসী।

ঈশ্বরের চিরন্তন আশীর্বাদ আপনার উপর বর্ষিত হোক। আপনার সকল সন্তানের জন্য আমার ভালবাসা, এবং আপনার মহীয়সী পত্নীর উদ্দেশ্যে আমার শ্রদ্ধা।

আপনার সদাবান্ধব
বিবেকানন্দ

পুনশ্চঃ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সে কেবল সমাজসংস্কারের ব্যাপারে।—কে আমি সব সময় আন্তরিকতাহীন বলে মনে করেছি, এবং এখনও সে-মত পরিবর্তনের কোন কারণ ঘটেনি। ধর্মীয় ব্যাপারে অবশ্য আমার বন্ধু পণ্ডিতজীর সঙ্গেও আমার বিশেষ মতপার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল—আমার কাছে সন্ন্যাস সর্বোচ্চ আদর্শ, তাঁর কাছে পাপ। সুতরাং ব্রাহ্মসমাজীরা সন্ন্যাসী হওয়াকে পাপ বলে মনে তো করবেই!!

আপনার বি.

ব্রাহ্মসমাজ আপনাদের দেশের ‘ক্রিশ্চান সায়েন্স’ দলের মত কিছু সময়ের জন্য কলিকাতায় বিস্তৃতিলাভ করেছিল, তারপর গুটিয়ে গেছে। এতে আমি সুখীও নই, দুঃখিতও নই। তার কাজ সে করেছে, যেমন সমাজসংস্কার। তার ধর্মের দান এক কানাকড়িও নয়। সুতরাং এ জিনিষ লোপ পেয়ে যাবে। যদি ম— মনে করেন আমি সেই মৃত্যুর অন্যতম কারণ, তিনি ভুল করেছেন। আমি এখনও ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারকার্যের প্রতি প্রভূত সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু ঐ ‘অসার’ ধর্ম প্রাচীন ‘বেদান্ত’-এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। আমি কি করব? সেটা কি আমার দোষ? ম—কে বুড়ো বয়সে ছেলেমিতে পেয়েছে, এবং তিনি যে ফন্দি নিয়েছেন, তা আপনার খ্রীষ্টান মিশনরীদের ফন্দিবাজির চেয়ে একচুল কম নয়। প্রভু তাঁকে কৃপা করুন এবং শুভপথ দেখান।

আপনাদের
বিবেকানন্দ

আপনি কবে এনিষ্কোয়ামে যাচ্ছেন? অষ্টিন এবং বাইমকে আমার ভালবাসা, আপনার পত্নীকে আমার শ্রদ্ধা। আপনার জন্য গভীর প্রেম ও কৃতজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশে আমি অসমর্থ।

সদাপ্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৫
চিকাগো
২৮ মে, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার পত্রের উত্তর পূর্বে দিতে পারি নাই, কারণ আমি নিউ ইয়র্ক ও বষ্টনের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম আর আমি ন—র পত্রের অপেক্ষা করিতেছিলাম। আমার সম্বন্ধে কিছু লিখিবার পূর্বে তোমাকে ন—র কথা কিছু বলিব। সে সকলকে নিরাশ করেছে। কতকগুলো বিটকেল দুষ্ট পুরুষ ও মেয়ের সঙ্গে মিশিয়া যে একেবারে গোল্লায় গিয়াছে—এখন কেউ তাহাকে কাছে ঘেঁষিতে দেয় না। যাহা হউক, অধোগতির চরম সীমায় পৌঁছিয়া সে আমাকে সাহায্যের জন্য লেখে। আমিও তাহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিব। যাহা হউক, তুমি তাহার আত্মীয়স্বজনকে বলিবে, তাহারা যেন শীঘ্র তাহাকে দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য ভাড়া পাঠায়। তাহারা কুক কোম্পানীর নামে টাকা পাঠাইতে পারে—তাহারা ওকে নগদ টাকা না দিয়া ভারতের একখানা টিকিট দিবে। আমার বোধ হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের পথে যাওয়াই তাহার পক্ষে ভাল—ঐ পথে কোথাও নামিয়া পড়িবার প্রলোভন কিছু নেই। বেচারা বিশেষ কষ্টে পড়িয়াছে—অবশ্য যাহাতে সে অনশনক্লেশ না পায়, সেই দিকে আমি দৃষ্টি রাখিব। ফটোগ্রাফ-সম্বন্ধে বক্তব্য এই, এখন আমার নিকট একখানাও নাই—খানকতক পাঠাইবার জন্য অর্ডার দিব। খেতড়ির মহারাজকে আমি কয়েকখানি পাঠাইয়াছিলাম এবং তিনি তাহা হইতে কতকগুলি ছাপাইয়াছিলেন—ইতোমধ্যে তুমি তাহা হইতে কতকগুলি পাঠাইবার জন্য লিখিতে পার।

জানি না, কবে ভারতে যাইব। সমুদয় ভার তাঁহার উপর ফেলিয়া দেওয়া ভাল, তিনি আমার পশ্চাতে থাকিয়া আমাকে চালাইতেছেন।

আমাকে ছাড়িয়া কাজ করিবার চেষ্টা কর, মনে কর, যেন আমি কখনও ছিলাম না। কোন ব্যক্তির বা কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করিও না। যাহা পার করিয়া যাও, কাহারও উপর কোন আশা রাখিও না। ধর্মপাল যে তোমাদের বলিয়াছিল, আমি এ দেশ হইতে যত ইচ্ছা টাকা পাইতে পারি, সে কথা ঠিক নয়। এ বছরটা এ দেশে বড়ই দুর্বৎসর—ইহারা নিজেদের দরিদ্রদেরই সব অভাব দূর করিতে পারিতেছে না। যাহা হউক, এরূপ সময়েও আমি যে উহাদের নিজেদের বক্তাদের অপেক্ষা অনেক সুবিধা করিতে পারিয়াছি, তাহার জন্য উহাদিগকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

কিন্তু এখানে ভয়ানক খরচ হয়। যদিও প্রায় সর্বদাই ও সর্বত্রই আমি ভাল ভাল ও বড় বড় পরিবারের মধ্যে আশ্রয় পাইয়াছি, তথাপি টাকা যেন উড়িয়া যায়।

আমি বলিতে পারি না, আগামী গ্রীষ্মকালে এদেশ হইতে চলিয়া যাইব কিনা; খুব সম্ভবতঃ না। ইতোমধ্যে তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে এবং আমাদের কাজ যাহাতে অগ্রসর হয়, তাহার চেষ্টা কর। বিশ্বাস কর যে তোমরা সব করিতে পার। জানিয়া রাখো যে, প্রভু আমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, আর অগ্রসর হও, হে বীরহৃদয় বালকগণ!

আমার দেশ আমাকে যথেষ্ট আদর করিয়াছে। আদর করুক আর নাই করুক, তোমরা ঘুমাইয়া থাকিও না, তোমরা শিথিল-প্রযত্ন হইও না। মনে রাখিবে যে, আমাদের উদ্দেশ্যের এক বিন্দুও এখনও কার্যে পরিণত হয় নাই। শিক্ষিত যুবকগণের মধ্যে কার্য কর, তাহাদিগকে একত্র করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ কর। বড় বড় কাজ কেবল খুব স্বার্থত্যাগ দ্বারাই হইতে পারে। স্বার্থের আবশ্যকতা নাই, নামেরও নয়, যশেরও নয়—তা তোমারও নয়, আমারও নয় বা আমার গুরুর পর্যন্ত নয়। ভাব ও সঙ্কল্প যাহাতে কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর; হে বীরহৃদয় মহান্ বালকগণ! উঠে পড়ে লাগো! নাম, যশ বা অন্য কিছু তুচ্ছ জিনিষের জন্য পশ্চাতে চাহিও না। স্বার্থকে একেবারে বিসর্জন দাও ও কার্য কর। মনে রাখিও—‘তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নৈর্বধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ’—অনেকগুলি তৃণগুচ্ছ একত্র করিয়া রজ্জু প্রস্তুত হইলে তাহাতে মত্ত হস্তীকেও বাঁধা যায়। তোমাদের সকলের উপর ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক! তাঁহার শক্তি তোমাদের সকলের ভিতর আসুক—আমি বিশ্বাস করি, তাঁহার শক্তি তোমাদের মধ্যেই রহিয়াছে। বেদ বলিতেছেন, ‘ওঠ, জাগো, যত দিন না লক্ষ্যস্থলে পঁহুছিতেছ, থামিও না। জাগো, জাগো, দীর্ঘ রজনী প্রভাতপ্রায়। দিনের আলো দেখা যাইতেছে। মহাতরঙ্গ উঠিয়াছে। কিছুতেই উহার বেগ রোধ করিতে পারিবে না। আমি পত্রের উত্তর দিতে দেরী করিলে বিষণ্ণ হইও না বা নিরাশ হইও না। লেখায়—আঁচড় কাটায় কি ফল? উৎসাহ, বৎস, উৎসাহ—প্রেম, বৎস, প্রেম। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। আর ভয় করিও না, সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ভয়!

সকলকে আমার আশীর্বাদ। মান্দ্রাজের যে সকল মহানুভব ব্যক্তি আমাদের কার্যে সহায়তা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা জানাইতেছি। কিন্তু আমি তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তাঁহারা কার্যে শৈথিল্য না করেন। চারিদিকে ভাব ছড়াইতে থাকো। গর্বিত হইও না। গোঁড়াদের মত জোর করিয়া কাহাকেও কিছু বিশ্বাস করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিও না, কোন কিছুর বিরুদ্ধেও বলিও না। আমাদের কাজ কেবল ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য একত্র রাখিয়া দেওয়া। প্রভু জানেন, কিরূপে ও কখন তাহারা নির্দিষ্ট আকার ধারণ করিবে। সর্বোপরি আমার বা তোমাদের কৃতকার্যতায় গর্বিত হইও না, বড় বড় কাজ এখনও করিতে বাকী। যাহা ভবিষ্যতে হইবে, তাহার সহিত তুলনায় এই সামান্য সিদ্ধি অতি তুচ্ছ। বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর, প্রভুর আজ্ঞা—ভারতের উন্নতি হইবেই হইবে, জনসাধারণকে এবং দরিদ্রদিগকে সুখী করিতে হইবে; আর আনন্দিত হও যে, তোমরাই তাঁহার কার্য করিবার নির্বাচিত যন্ত্র। ধর্মের বন্যা আসিয়াছে। আমি দেখিতেছি, উহা পৃথিবীকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে—অদম্য, অনন্ত, সর্বগ্রাসী। সকলেই সম্মুখে যাও, সকলের শুভেচ্ছা উহার সহিত যোগ দাও। সকল হস্ত উহার পথের বাধা সরাইয়া দিক্‌! জয়! প্রভুর জয়!!

শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্য আয়ার, কৃষ্ণস্বামী আয়ার, ভট্টাচার্য এবং আমার অন্যান্য বন্ধুগণকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাইবে। তাঁহাদিগকে বলিবে, যদিও সময়াভাবে কিছু লিখিতে পারি না, কিন্তু হৃদয় তাঁহাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট আছে। আমি তাঁহাদিগের ঋণ কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না। প্রভু তাঁহাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।

আমার কোন সাহায্যের আবশ্যকতা নাই। তোমরা কিছু অর্থ সংগ্রহ করিয়া একটি ফণ্ড খুলিবার চেষ্টা কর। শহরের সর্বাপেক্ষা দরিদ্রগণের যেখানে বাস, সেখানে একটি মৃত্তিকানির্মিত কুটীর ও হল প্রস্তুত কর। গোটাকতক ম্যাজিক লণ্ঠন, কতকগুলি ম্যাপ, গ্লোব এবং কতকগুলি রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি যোগাড় কর। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সেখানে গরীব অনুন্নত, এমন কি, চণ্ডালগণকে পর্যন্ত জড়ো কর; তাহাদিগকে প্রথমে ধর্ম উপদেশ দাও, তারপর ঐ ম্যাজিক লণ্ঠন ও অন্যান্য দ্রব্যের সাহায্যে জ্যোতিষ, ভূগোল প্রভৃতি চলিত ভাষায় শিক্ষা দাও। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একদল যুবক গঠন কর। তোমাদের উৎসাহাগ্নি তাহাদের ভিতর জ্বালিয়া দাও। আর ক্রমশঃ এই সঙ্ঘ বাড়াইতে থাকো—উহার পরিধি বাড়িতে থাকুক। তোমরা যতটুকু পার, কর। যখন নদীতে জল কিছুই থাকিবে না, তখন পার হইব বলিয়া বসিয়া থাকিবে না। পত্রিকা, সংবাদপত্র প্রভৃতির পরিচালন ভাল, সন্দেহ নাই; কিন্তু চিরকাল চীৎকার ও কলমপেশা অপেক্ষা প্রকৃত কার্য—যতই সামান্য হউক, অনেক ভাল। ভট্টাচার্যের গৃহে একটি সভা আহ্বান কর। কিছু টাকা সংগ্রহ করিয়া পূর্বে আমি যাহা বলিয়াছি, সেইগুলি ক্রয় কর। একটি কুটীর ভাড়া লও এবং কাজে লাগিয়া যাও। পত্রিকাদি গৌণ, ইহাই মুখ্য। যে কোনরূপেই হউক, সাধারণ দরিদ্রলোকের মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তার করিতেই হইবে। কার্যের সামান্য আরম্ভ দেখিয়া ভয় পাইও না, কাজ সামান্য হইতেই বড় হইয়া থাকে। সাহস অবলম্বন কর। নেতা হইতে যাইও না, সেবা কর। নেতৃত্বের এই পাশব প্রবৃত্তি জীবনসমুদ্রে অনেক বড় বড় জাহাজ ডুবাইয়াছে। এই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হও অর্থাৎ মৃত্যুকে পর্যন্ত তুচ্ছ করিয়া নিঃস্বার্থ হও এবং কাজ কর। আমার যাহা বলিবার ছিল, তোমাদিগকে সব লিখিতে পারিলাম না। হে বীরহৃদয় বালকগণ! প্রভু তোমাদিগকে সব বুঝাইয়া দিবেন। লাগো, লাগো, বৎসগণ! প্রভুর জয়! কিডিকে আমার ভালবাসা জানাইবে। আমি সেক্রেটারী সাহেবের পত্র পাইয়াছি।

তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৬
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
১৮ জুন, ’৯৪

প্রিয় অধ্যাপকজী,
অন্য চিঠিগুলো পাঠাতে দেরী হল বলে ক্ষমা করবেন। আমি সেগুলো আগে খুঁজে পাইনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছি।

এনিষ্কোয়ামে যেতে পারব কিনা, ঠিক জানি না। আমি পুনরায় না লিখিলে চিঠিগুলো আমার কাছে পাঠাবার দরকার নেই। বষ্টনের কাগজে আমার বিরুদ্ধে লেখা সেই রচনাটি দেখে মিসেস ব্যাগলি খুবই বিচলিত হয়েছেন। তিনি ডেট্রয়েট থেকে আমার কাছে তার একটা কপি পাঠিয়েছেন এবং চিঠিপত্র লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন, তিনি আমার প্রতি সব সময়ই খুব সদয় ছিলেন।

ভ্রাতঃ, আপনার মত বলিষ্ঠ হৃদয় সহজে মেলে না। এটা একটা আজব জায়গা—আমাদের এই দুনিয়াটা। তবে এই দেশে যেখানে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, সামান্য ‘পরিচয়পত্র’ও যেখানে আমার নেই, সেখানে এখানকার মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণে সহৃদয়তা পেয়েছি, তার জন্য সব জড়িয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মঙ্গলমুখী।

সদাকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—ছেলেদের জন্য ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষ্ট্যাম্প পাঠালাম, যদি তাদের কাজে লাগে।
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৭
[শ্রীযুত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]

C/o. G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
চিকাগো
২০ জুন, ১৮৯৪

প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহলিপি আজ পাইলাম। আপনার মত মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বিবেচনাহীন কঠোর মন্তব্য দ্বারা দুঃখ দিয়াছি বলিয়া আমি অত্যন্ত বেদনা বোধ করিতেছি। আপনার অল্প স্বল্প সংশোধন আমি নতমস্তকে মানিয়া লইলাম। ‘শিষ্যস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।’ কিন্তু দেওয়ানজী সাহেব, এ কথা আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আপনাকে ভালবাসি বলিয়াই ঐরূপ কথা বলিয়াছিলাম। অসাক্ষাতে যাহারা আমার দুর্নাম রটাইয়াছে, তাহারা পরোক্ষভাবে আমার উপকার তো করেই নাই, পরন্তু আমাদের হিন্দু সমাজের পক্ষ হইতে আমেরিকার জনসাধারণের নিকট আমার প্রতিনিধিত্ব-বিষয়ে একটি কথাও উক্ত না হওয়াতে ঐ সকল দুর্নাম যথেষ্ট ক্ষতির কারণই হইয়াছে। আমার দেশবাসী কেহ—আমি যে তাহাদের প্রতিনিধি—এ বিষয়ে কি একটি কথাও লিখিয়াছিল? কিম্বা আমার প্রতি আমেরিকাবাসীদের সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপক একটি বাক্যও কি তাহারা প্রেরণ করিয়াছে? পক্ষান্তরে—আমেরিকাবাসীর নিকট তারস্বরে এই কথাই ঘোষণা করিয়াছে যে, আমি একটি পাকা ভণ্ড এবং আমেরিকায় পদার্পণ করিয়াই আমি প্রথম গেরুয়া ধারণ করিয়াছি। অভ্যর্থনার ব্যাপারে অবশ্য এই সকল প্রচারের ফলে আমেরিকায় কোন ক্ষতি হয় নাই; কিন্তু অর্থসাহায্যের ব্যাপারে এই ভয়াবহ ফল ঘটিয়াছে যে, আমেরিকাবাসিগণ আমার কাছে একেবারে হাত গুটাইয়া ফেলিয়াছে। এই যে এক বৎসর যাবৎ আমি এখানে আছি—এর মধ্যে ভারতবর্ষের একজন খ্যাতনামা লোকও এ দেশবাসীকে এ কথাটি জানানো উচিত মনে করেন নাই যে, আমি প্রতারক নহি। ইহার উপর আবার মিশনরী সম্প্রদায় সর্বদা আমার ছিদ্রানুসন্ধানে তৎপর হইয়াই আছে এবং ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান পত্রিকাগুলিতে আমার বিরুদ্ধে যাহা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি সংগ্রহ করিয়া এখানকার কাগজে ছাপা হইয়াছে। আর আপনারা এইটুকু জানিয়া রাখুন যে, এদেশের জনসাধারণ—ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান ও হিন্দুতে যে কি পার্থক্য, তাহার খুব বেশী সংবাদ রাখে না।

আমার এখানে আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য—নিজের একটি বিশেষ কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। আমি সমস্ত বিষয়টি পুনর্বার সবিস্তার আপনাকে বলিতেছি।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূল পার্থক্য এই যে, পাশ্চাত্য দেশে জাতীয়তাবোধ আছে, আর আমাদের তাহা নাই। অর্থাৎ শিক্ষা ও সভ্যতা এখানে (পাশ্চাত্যে) সর্বজনীন—জনসাধারণে অনুপ্রবিষ্ট। ভারতবর্ষের ও আমেরিকার উচ্চবর্ণের মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নাই সত্য, কিন্তু উভয় দেশের নিম্মবর্ণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ভারতবর্ষ জয় করা ইংরেজের পক্ষে এত সহজ হইয়াছিল কেন? যেহেতু তাহারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তাহা ছিলাম না। আমাদের দেশে একজন মহৎ লোক মারা গেলে বহু শতাব্দী ধরিয়া আর একজনের আবির্ভাবের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়, আর এদেশে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান পূর্ণ হইয়া যায়। আপনি মারা গেলে (ভগবান্ আমার দেশের সেবার জন্য আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন) আপনার স্থান পূর্ণ করিতে দেশ যথেষ্ট অসুবিধা বোধ করিবে; তাহা এখনই প্রতীয়মান হইতেছে, কারণ আপনাকে অবসর গ্রহণ করিতে দেওয়া হইতেছে না। বস্তুতঃ দেশে মহৎ ব্যক্তির অভাব ঘটিয়াছে। কেন তাহা হইয়াছে? কারণ এ দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র অতি বিস্তৃত, আর আমাদের দেশে অতি সঙ্কীর্ণক্ষেত্র হইতে তাঁহাদের উদ্ভব হইয়া থাকে। এ দেশের শিক্ষিত নরনারীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশী। তাই ত্রিশকোটি অধিবাসীর দেশ ভারতবর্ষ অপেক্ষা তিন চার কিম্বা ছয় কোটি নরনারী-অধ্যুষিত এ সকল দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র বিস্তৃততর। আপনি সহৃদয় বন্ধু, আমাকে ভুল বুঝিবেন না। আমাদের জাতীয় জীবনে ইহা একটি বিশেষ ত্রুটি এবং ইহা দূর করিতে হইবে।

জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা। আমাদের সমাজসংস্কারকগণ খুঁজিয়া পান না—ক্ষতটি কোথায়। বিধবা-বিবাহের প্রচলন দ্বারা তাঁহারা জাতিকে উদ্ধার করিতে চাহেন। আপনি কি মনে করেন যে, বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? আমাদের ধর্মের কোন অপরাধ নাই, কারণ মূর্তিপূজায় বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না। সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি—যাহারা কুটীরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান—প্রত্যেকের পায়ের তলায় পিষ্ট হইতে হইতে তাহাদের মনে এখন এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, ধনীর পদতলে নিষ্পেষিত হইবার জন্যই তাহাদের জন্ম। তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে। মূর্তিপূজা থাকিবে কি থাকিবে না, কতজন বিধবার পুনর্বার বিবাহ হইবে, জাতিভেদ-প্রথা ভাল কি মন্দ, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার আমার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেককেই তাহার নিজের মুক্তির পথ করিয়া লইতে হইবে। রাসায়নিক দ্রব্যের একত্র সমাবেশ করাই আমাদের কর্তব্য—দানাবাঁধার কার্য ঐশ্বরিক বিধানে স্বতই হইয়া যাইবে। আসুন, আমরা তাহাদের মাথায় ভাব প্রবেশ করাইয়া দিই—বাকীটুকু তাহারাই নিজেরাই করিবে। ইহার অর্থ, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতেও অসুবিধা আছে। দেউলিয়া গভর্ণমেণ্ট কোন সহায়তা করিবে না, করিতে সক্ষমও নহে; সুতরাং সেদিক হইতে সহায়তার কোন আশা নাই।

ধরুন, যদি আমরা গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিতে সক্ষমও হই, তবু দরিদ্রঘরের ছেলেরা সে সব স্কুলে পড়িতে আসিবে না; তাহারা বরং ঐ সময় জীবিকার্জনের জন্য হালচাষ করিতে বাহির হইয়া পড়িবে। আমাদের না আছে প্রচুর অর্থ—না আছে ইহাদিগকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিবার ক্ষমতা। সুতরাং সমস্যাটি নৈরাশ্যজনক বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু আমি ইহারই মধ্যে একটি পথ বাহির করিয়াছি। তাহা এই—যদি পর্বত মহম্মদের নিকট নাই আসে তবে মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে।৫২ দরিদ্র লোকেরা যদি শিক্ষার নিকট পৌঁছিতে না পারে (অর্থাৎ নিজেরা শিক্ষালাভে তৎপর না হয়), তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সব স্থানে যাইতে হইবে। প্রশ্ন হইতে পারে যে, কিরূপে তাহা সাধিত হইবে? আপনি আমার গুরুভ্রাতাগণকে দেখিয়া থাকিবেন। এক্ষণে ঐরূপ নিঃস্বার্থ, সৎ ও শিক্ষিত শত শত ব্যক্তি সমগ্র ভারতবর্ষ হইতে আমি পাইব। ইহাদিগকে গ্রামে গ্রামে, প্রতি দ্বারে দ্বারে শুধু ধর্মের নহে, পরন্তু শিক্ষার আলোকও বহন করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। আমাদের মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিধবাদিগকে শিক্ষয়িত্রীয় কাজে লাগাইবার গোড়াপত্তন আমি করিয়াছি।

মনে করুন, কোন একটি গ্রামের অধিবাসিগণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া কোন একটি গাছের তলায় অথবা অন্য কোন স্থানে সমবেত হইয়া বিশ্রম্ভালাপে সময়াতিপাত করিতেছে। সেই সময় জন-দুই শিক্ষিত সন্ন্যাসী তাহাদের মধ্যে গিয়া ছায়াচিত্র কিম্বা ক্যামেরার সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রাদি সম্বন্ধে কিম্বা বিভিন্ন জাতি বা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ছবি দেখাইয়া কিছু শিক্ষা দিল। এইরূপে গ্লোব, মানচিত্র প্রভৃতির সাহায্যে মুখে মুখে কত জিনিষই না শেখানো যাইতে পারে দেওয়ানজী! চক্ষুই যে জ্ঞানলাভের একমাত্র দ্বার তাহা নহে, পরন্তু কর্ণদ্বারাও শিক্ষার কার্য যথেষ্ট হইতে পারে। এইরূপে তাহারা নূতন চিন্তার সহিত পরিচিত হইতে পারে, নৈতিক শিক্ষা লাভ করিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ অপেক্ষাকৃত ভাল হইবে বলিয়া আশা করিতে পারে। ঐটুকু পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য—বাকীটুকু উহারা নিজেরাই করিবে।

এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে যে, সন্ন্যাসিগণ কিসের জন্য এ জাতীয় ত্যাগব্রত গ্রহণ করিবে এবং কেনই বা এ প্রকারের কাজ করিতে অগ্রসর হইবে? উত্তরে আমি বলিব—ধর্মের প্রেরণায়! প্রত্যেক নূতন ধর্ম-তরঙ্গেরই একটি নূতন কেন্দ্র প্রয়োজন। প্রাচীন ধর্ম শুধু নূতন কেন্দ্র-সহায়েই নূতনভাবে সঞ্জীবিত হইতে পারে। গোঁড়া মতবাদ সব গোল্লায় যাউক—উহাদের দ্বারা কোন কাজই হয় না। একটি খাঁটি চরিত্র, একটি সত্যিকার জীবন, একটি শক্তির কেন্দ্র—একজন দেবমানবই পথ দেখাইবেন। এই কেন্দ্রেই বিভিন্ন উপাদান একত্র হইবে এবং প্রচণ্ড তরঙ্গের মত সমাজের উপর পতিত হইয়া সব কিছু ভাসাইয়া লইয়া যাইবে, সমস্ত অপবিত্রতা মুছিয়া দিবে। আবার দেখুন, একটি কাষ্ঠখণ্ডকে উহার আঁশের অনুকূলেই যেমন সহজে চিরিয়া ফেলা যায়, তেমনি হিন্দুধর্মের দ্বারাই প্রাচীন হিন্দুধর্মের সংস্কার করিতে হইবে, নব্য সংস্কার-আন্দোলন দ্বারা নহে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারকগণকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়দেশের সংস্কৃতিধারা নিজ জীবনে মিলিত করিতে হইবে। সেই মহা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র প্রত্যক্ষ করিতেছেন বলিয়া মনে হয় কি? ঐ তরঙ্গের আগমনসূচক মৃদু গম্ভীর ধ্বনি শুনিতে পাইতেছেন কি? সেই শক্তিকেন্দ্র—সেই পথপ্রদর্শক দেবমানব ভারতবর্ষেই জন্মিয়াছিলেন। তিনি সেই মহান্ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এই যুবকদল ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। তাহারাই এ মহাব্রত উদ‍্‍যাপন করিবে।

এ কার্যের জন্য সঙ্ঘের প্রয়োজন এবং অন্ততঃ প্রথম দিকটায় সামান্য কিছু অর্থেরও প্রয়োজন। কিন্তু ভারতবর্ষে কে আমাদিগকে অর্থ দিবে? … দেওয়ানজী সাহেব, আমি সেইজন্যই আমেরিকায় আসিয়াছি। আপনার স্মরণ থাকিতে পারে, আমি সমস্ত অর্থ দরিদ্রগণের নিকট হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলাম; ধনী-সম্প্রদায়ের দান আমি গ্রহণ করিতে পারি নাই, কারণ তাহারা আমার ভাব বুঝিতে পারে নাই। এ দেশে এক বৎসর ক্রমান্বয়ে বক্তৃতা দিয়াও আমি বিশেষ কিছু করিতে পারি নাই—অবশ্য আমার ব্যক্তিগত কোন অভাব নাই, কিন্তু আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যের জন্য অর্থসংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার প্রথম কারণ, এবার আমেরিকায় বড় দুর্বৎসর চলিতেছে, হাজার হাজার গরীব বেকার। দ্বিতীয়তঃ মিশনরীরা এবং ‘—’ গণ আমার মতবাদ ধ্বংস করিতে চেষ্টা করিতেছে। তৃতীয়তঃ একটি বৎসর অতীত হইয়া গেল, কিন্তু আমার দেশের কেহ এই কথাটুকু আমেরিকাবাসিগণকে বলিতে পারিল না যে, আমি সত্যই সন্ন্যাসী, প্রতারক নই এবং আমি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি। শুধু এই কয়টি কথামাত্র, তাহাও তাহারা বলিতে পারিল না! আমার দেশবাসিগণকে সেজন্য আমি ‘বাহবা’ দিতেছি। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও দেওয়ানজী সাহেব, আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করি। যিনি গিরিগুহায়, দুর্গম বনে ও মরুভূমিতে আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন—আমার বিশ্বাস, তিনি আমার সঙ্গেই থাকিবেন। আর যদি তাহা না হয়, তবে আমা অপেক্ষা শক্তিমান্ কোন পুরুষ কোন দিন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়া এই মহৎ কার্য সম্পন্ন করিবেন। আজ সব কথাই আপনাকে খুলিয়া বলিলাম। হে মহাপ্রাণ বন্ধু, আমার দীর্ঘ পত্রের জন্য আমাকে মার্জনা করিবেন; যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন আমার প্রকৃত দরদী আর আমার প্রতি সদয়, আপনি তাঁহাদেরই একজন; আপনি আমার এই দীর্ঘ পত্রের জন্য ক্ষমা করিবেন। হে বন্ধু, আপনি আমাকে স্বপ্নবিলাসী কিম্বা কল্পনাপ্রিয় বলিয়া অবশ্য মনে করিতে পারেন, কিন্তু এইটুকু অন্ততঃ বিশ্বাস করিবেন যে, আমি সম্পূর্ণ অকপট; আর আমার চরিত্রের সর্বপ্রধান ত্রুটি এই যে, আমি আমার দেশকে ভালবাসি, বড় একান্তভাবেই ভালবাসি।

হে মহাপ্রাণ বন্ধুবর, ভগবানের আশীর্বাদ আপনার ও আপনার আত্মীয়স্বজনের উপর নিরন্তর বর্ষিত হউক, তাঁহার অঙ্গচ্ছায়া আপনার সকল প্রিয়জনকে আবৃত করিয়া রাখুক। আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা আপনি গ্রহণ করুন। আপনার নিকট আমার ঋণ অপরিসীম, কারণ আপনি শুধু বন্ধু নহেন, পরন্তু আজীবন ভগবান্ ও মাতৃভূমির সেবা সমভাবে করিয়া আসিতেছেন। ইতি

চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ

পুনশ্চ—আপনার নিকট একটু অনুগ্রহ ভিক্ষা করি। আমি নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া যাইতেছি। এই [হেল] পরিবারটি আমায় সর্বদা আশ্রয় দিয়াছে এবং আমাকে নিজ সন্তানের ন্যায় স্নেহ করিয়াছে। আর আমাদের স্বদেশীয়দের ও নিজেদের পুরোহিতকুলের কুৎসা সত্ত্বেও, এবং আমি তাহাদের নিকট কোন প্রকার প্রমাণলিপি পরিচয়পত্র বা ঐরূপ কোন কিছু না লইয়া আসা সত্ত্বেও তাহারা পশ্চাৎপদ হয় নাই। আপনি যদি আগ্রা ও লাহোরে প্রস্তুত দুই-তিনখানি গালিচা আমায় পাঠাইয়া দিতে পারেন, তবে তাহাদিগকে সামান্য কিছু উপহার দিবার সাধ আছে। ইহারা ঘরের মেঝেতে ভারতীয় গালিচা পাতিয়া রাখিতে খুব ভালবাসে—ইহা একটা বিশেষ বিলাসের বস্তু। … ইহাতে যদি অত্যধিক খরচ হয়, তবে আমি চাই না। আমি নিজে বেশ আছি। খাওয়া-দাওয়া ও বাড়ীভাড়া দেওয়ার মত এবং যখন খুশী ফিরিয়া যাওয়ার মত অর্থ আমার যথেষ্ট আছে।

আপনার
বি
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৮
(মহীশূরের মহারাজাকে লিখিত)
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
মহারাজ,
শ্রীনারায়ণ আপনার ও আপনার পরিবারবর্গের কল্যাণ করুন। আপনি অনুগ্রহপূর্বক সাহায্য করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি এদেশে আসিতে সমর্থ হইয়াছি। তারপর আমাকে এ দেশে সকলে বিশেষরূপে জানিতে পারিয়াছে। আর এ দেশের অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিগণ আমার সমুদয় অভাব পূরণ করিয়া দিয়াছেন। অনেক বিষয়ে এ এক আশ্চর্য দেশ ও এক অদ্ভুত জাতি! প্রথমতঃ জগতের মধ্যে কলকারখানার উন্নতিবিষয়ে এ জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দেশের লোক নানাপ্রকার শক্তিকে যেমন কাজে লাগায়, অন্য কোথাও তদ্রূপ নহে—এখানে কেবল কল আর কল! আবার দেখুন, ইহাদের সংখ্যা সমুদয় জগতের লোকসংখ্যার বিশ ভাগের এক ভাগ হইবে, কিন্তু ইহারা জগতের ধনরাশির পুরা এক-ষষ্ঠাংশ অধিকার করিয়া বসিয়া আছে। ইহাদের ঐশ্বর্যবিলাসের সীমা নাই, আবার সব জিনিষই এখানে অতিশয় দুর্মূল্য। এখানে শ্রমিকের মজুরী জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক, তথাপি শ্রমজীবী ও মূলধনীদের মধ্যে নিত্য বিবাদ চলিয়াছে।

তারপর আমেরিকান মহিলাগণের অবস্থার প্রতি সহজেই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। পৃথিবীর আর কোথাও স্ত্রীলোকের এত অধিকার নাই। ক্রমশঃ তাহারা সব আপনাদের হাতে লইতেছে; আর আশ্চর্যের বিষয়, এখানে শিক্ষিতা মহিলার সংখ্যা শিক্ষিত পুরুষ অপেক্ষা অধিক। অবশ্য খুব উচ্চ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অধিকাংশই পুরুষ। এই পর্যন্ত ইহাদের ভাল দিক্‌ বলা গেল। এখন ইহাদের দোষের কথা বলি। প্রথমতঃ মিশনরিগণ ভারতবর্ষে তাঁহাদের দেশের লোকের ধর্মপ্রবণতা সম্বন্ধে যতই বাজে গল্প করুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে এ দেশের ছয় কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের ভিতর জোর এক কোটি নব্বই লক্ষ লোকে একটু- আধটু ধর্ম করিয়া থাকে। অবশিষ্ট লোকে কেবল পানভোজন ও টাকা-রোজগার ছাড়া আর কিছুর জন্য মাথা ঘামায় না। পাশ্চাত্যেরা আমাদের জাতিভেদ সম্বন্ধে যতই তীব্র সমালোচনা করুন না কেন, তাঁহাদের আবার আমাদের অপেক্ষা জঘন্য জাতিভেদ আছে—অর্থগত জাতিভেদ। আমেরিকানরা বলে ‘সর্বশক্তিমান্ ডলার’ এখানে সব করিতে পারে। এদিকে আবার গরীবেরা নিঃস্ব। নিগ্রোদের (যাহাদের অধিকাংশ দক্ষিণ দিকে বাস করে) উপর ইহাদের ব্যবহার সম্বন্ধে বক্তব্য এই—উহা পৈশাচিক। সামান্য অপরাধে তাহাদিগকে বিনা বিচারে জীবিত অবস্থায় চামড়া ছাড়াইয়া মারিয়া ফেলে। এদেশে যতই আইন-কানুন, অন্য কোন দেশে এত নাই, আবার এদেশের লোকে আইনের যত কম মর্যাদা রাখিয়া চলে, তত আর কোন দেশেই নয়।

মোটের উপর আমাদের দরিদ্র হিন্দুরা এদের চেয়ে অনেক নীতিপরায়ণ। ইহাদের ধর্ম হয় ভণ্ডামি, না হয় গোঁড়ামি। পণ্ডিতেরা নাস্তিক, আর যাঁহারা একটু স্থিরবুদ্ধি ও চিন্তাশীল, তাঁহারা তাঁহাদের কুসংস্কার ও দুর্নীতিপূর্ণ ধর্মের উপর একেবারে বিরক্ত, তাঁহারা নূতন আলোকের জন্য ভারতের দিকে তাকাইয়া আছেন। মহারাজ, আপনি না দেখিলে বুঝিতে পারিবেন না, ইহারা পবিত্র বেদের গভীর চিন্তারাশির অতি সামান্য অংশও কত আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিয়া থাকে, কারণ আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মের উপর যে পুনঃ পুনঃ তীব্র আক্রমণ করিতেছে, বেদই কেবল উহাকে বাধা দিতে পারে এবং ধর্মের সহিত বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য বিধান করিতে পারে। ইহাদের—শূন্য হইতে সৃষ্টি, সৃষ্ট আত্মা, স্বর্গনামক স্থানে সিংহাসনে উপবিষ্ট অত্যাচারী ঈশ্বর, অনন্ত নরকাগ্নি প্রভৃতি মতবাদে সকল শিক্ষিত ব্যক্তিই বিরক্ত হইয়াছেন; আর সৃষ্টির অনাদিত্ব এবং আত্মার নিত্যত্ব ও আত্মায় পরমাত্মার স্থিতি সম্বন্ধে বেদের গভীর উপদেশসকল কোন-না-কোন আকারে ইঁহারা অতি দ্রুত গ্রহণ করিতেছেন। পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে জগতের সমুদয় শিক্ষিত ব্যক্তিই আমাদের পবিত্র বেদের শিক্ষানুযায়ী আত্মা ও সৃষ্টি—উভয়েরই অনাদিত্বে বিশ্বাসবান্ হইবেন, আর ঈশ্বরকে আমাদেরই সর্বোচ্চ পূর্ণ অবস্থা বলিয়া বুঝিবেন। এখন হইতেই ইহাদের সকল বিদ্বান্ পুরোহিতই এইভাবে বাইবেলের ব্যাখ্যা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ভারতবর্ষে যে সকল মিশনরী দেখিতে পান, তাহারা কোনরূপেই খ্রীষ্টধর্মের প্রতিনিধি নহে। আমার সিদ্ধান্ত এই—পাশ্চাত্যগণের আরও ধর্মশিক্ষার প্রয়োজন, আর আমাদের আরও ঐহিক উন্নতির প্রয়োজন।

ভারতের সমুদয় দুর্দশার মূল—জনসাধারণের দারিদ্র্য। পাশ্চাত্যদেশের দরিদ্রগণ পিশাচপ্রকৃতি, তুলনায় আমাদের দরিদ্রগণ দেবপ্রকৃতি। সুতরাং আমাদের পক্ষে দরিদ্রের অবস্থার উন্নতিসাধন অপেক্ষাকৃত সহজ। আমাদের নিম্নশ্রেণীর জন্য কর্তব্য এই, কেবল তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া এবং তাহাদের বিনষ্টপ্রায় ব্যক্তিত্ববোধ জাগাইয়া তোলা। আমাদের জনগণ ও রাজন্যগণের সম্মুখে এই এক বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র পড়িয়া রহিয়াছে। এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই চেষ্টা করা হয় নাই। পুরোহিতশক্তি ও পরাধীনতা তাহাদিগকে শত শত শতাব্দী ধরিয়া নিষ্পেষিত করিয়াছে, অবশেষে তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে যে তাহারাও মানুষ। তাহাদিগকে ভাল ভাল ভাব দিতে হইবে। তাহাদের চক্ষু খুলিয়া দিতে হইবে, যাহাতে তাহারা জানিতে পারে—জগতে কোথায় কি হইতেছে। তাহা হইলে তাহারা নিজেদের উদ্ধার নিজেরাই সাধন করিবে। প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক নরনারী নিজের উদ্ধার নিজেই সাধন করিয়া থাকে। তাহাদের এইটুকু সাহায্য করিতে হইবে—তাহাদিগকে কতকগুলি উচ্চ ভাব দিতে হইবে। অবশিষ্ট যাহা কিছু, তাহা উহার ফলস্বরূপ আপনিই আসিবে। আমাদের কর্তব্য কেবল রাসায়নিক উপাদানগুলিকে একত্র করা—অতঃপর প্রাকৃতিক নিয়মেই উহা দানা বাঁধিবে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য—কেবল তাহাদের মাথায় কতকগুলি ভাব প্রবিষ্ট করাইয়া দেওয়া, বাকী যাহা কিছু তাহারা নিজেরাই করিয়া লইবে।

ভারতে এই কাজটি করা বিশেষ দরকার। এই চিন্তা অনেক দিন হইতে আমার মনে রহিয়াছে। ভারতে ইহা কার্যে পরিণত করিতে পারি নাই, সেইজন্য এদেশে আসিয়াছি। দরিদ্রদিগকে শিক্ষাদানের প্রধান বাধা এইঃ মনে করুন, মহারাজ, গ্রামে গ্রামে গরীবদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন, তথাপি তাহাতে কোন উপকার হইবে না, কারণ ভারতে দারিদ্র্য এত অধিক যে, দরিদ্র বালকেরা বিদ্যালয়ে না গিয়া বরং মাঠে গিয়া পিতাকে তাহার কৃষি-কার্যে সহায়তা করিবে, অথবা অন্য কোনরূপে জীবিকা-অর্জনের চেষ্টা করিবে; সুতরাং যেমন পর্বত মহম্মদের নিকট না যাওয়াতে মহম্মদই পর্বতের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে, তবে তাহাদের নিকট শিক্ষা পৌঁছাইয়া দিতে হইবে।

আমাদের দেশে সহস্র দৃঢ়চিত্ত নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসী আছেন, তাঁহারা এখন গ্রামে গ্রামে যাইয়া লোককে ধর্ম শিখাইতেছেন। যদি তাঁহাদের মধ্যে কতকগুলিকে সাংসারিক প্রয়োজনীয় বিদ্যাসমূহের শিক্ষকরূপে সংগঠন করা যায়, তবে তাঁহারা এখন যেমন এক স্থান হইতে অপর স্থানে, লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়া ধর্মশিক্ষা দিয়া বেড়াইতেছেন, তাহার সঙ্গে সঙ্গে লৌকিক বিদ্যাও শিখাইবেন। মনে করুন, এইরূপ দুইজন লোক একখানি ক্যামেরা, একটি গোলক ও কতকগুলি ম্যাপ প্রভৃতি লইয়া কোন গ্রামে গেলেন। এই ক্যামেরা ম্যাপ প্রভৃতির সাহায্যে তাঁহারা অজ্ঞ লোকদিগকে জ্যোতিষ ও ভূগোলের অনেক তত্ত্ব শিখাইতে পারেন! তারপর যদি বিভিন্ন জাতির—জগতের প্রত্যেক দেশের লোকের বিবরণ গল্পচ্ছলে তাঁহাদের নিকট বলা যায়, তবে সমস্ত জীবন বই পড়িয়া তাহারা যাহা না শিখিতে পারে, তদপেক্ষা শতগুণে অধিক এইভাবে মুখে মুখে শিখিতে পারে। ইহা করিতে হইলে একটি সঙ্ঘ গঠনের আবশ্যক হয়, তাহাতে আবার টাকার দরকার। ভারতে এইজন্য কাজ করিবার যথেষ্ট লোক আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকা নাই। একটি চাকা গতিশীল করিতে প্রথমে অনেক কষ্ট; একবার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে উহা উত্তরোত্তর অধিকতর বেগে ঘুরিতে থাকে। আমি আমার স্বদেশে এই বিষয়ের জন্য যথেষ্ট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছি; কিন্তু ধনিগণের নিকট আমি এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র সহানুভূতি পাই নাই। মহামান্য মহারাজের সাহায্যে আমি এখানে আসিয়াছি। ভারতের দরিদ্রেরা মরুক বাঁচুক, আমেরিকানদের সে বিষয়ে খেয়াল নাই। আর আমাদের দেশের লোকেই যখন নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবে না, তখন ইহারাই বা ভাবিবে কেন?

হে মহামনা রাজন্! এই জীবন ক্ষণভঙ্গুর, জগতের ধন মান ঐশ্বর্য—সকলই ক্ষণস্থায়ী। তাহারাই যথার্থ জীবিত, যাহারা অপরের জন্য জীবনধারণ করে। অবশিষ্ট ব্যক্তিগণ বাঁচিয়া নাই, মরিয়া আছে। মহারাজের ন্যায় মহামনা একজন রাজবংশধর ইচ্ছা করিলে ভারতকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাইয়া দিতে পারেন, তাহাতে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ শ্রদ্ধার সহিত আপনার নাম স্মরণ করিবে। ঈশ্বর করুন, যেন আপনার মহৎ অন্তঃকরণ অজ্ঞতায় নিমগ্ন লক্ষ লক্ষ আর্ত ভারতবাসীর জন্য গভীরভাবে অনুভব করে। ইহাই প্রার্থনা—

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ৯৯
[রাও বাহাদুর নরসিংহাচারিয়াকে লিখিত]
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় মহাশয়,
আপনি আমাকে বরাবর যে অনুগ্রহ করিয়া থাকেন, তাহাতেই আমি আপনার নিকট একটি বিশেষ অনুরোধ করিতে সাহসী হইতেছি। মিসেস পটার পামার যুক্তরাজ্যের প্রধানা মহিলা। তিনি মহামেলার মহিলানেত্রী ছিলেন। সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার যাহাতে উন্নতি হয়, সে বিষয়ে তিনি বিশেষ উৎসাহী, মেয়েদের একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা। তিনি লেডি ডফরিনের বিশেষ বন্ধু এবং তাঁহার ধন ও পদমর্যাদাগুণে ইওরোপীয় রাজপরিবারসমূহের নিকট হইতে অনেক অভ্যর্থনা পাইয়াছেন। এ দেশে তিনি আমার প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি চীন, জাপান, শ্যাম ও ভারত সফরে বাহির হইতেছেন। অবশ্য ভারতের শাসনকর্তারা এবং বড় বড় লোকেরা তাঁহার আদর অভ্যর্থনা করিবেন। কিন্তু ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সাহায্য ছাড়াই আমাদের সমাজ দেখিবার জন্য তিনি বিশেষ উৎসুক। আমি অনেক সময় তাঁহাকে ভারতীয় নারীদের অবস্থা উন্নত করিবার জন্য আপনার মহতী চেষ্টার এবং মহীশূরে আপনার চমৎকার কলেজটির কথা বলিয়াছি। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের লোক আমেরিকায় আসিলে ইঁহারা যেরূপ সহৃদয় ব্যবহার করেন, তাহার প্রতিদানস্বরূপ এইরূপ ব্যক্তিদিগকে একটু আতিথেয়তা দেখানো কর্তব্য। আমি আশা করি, আপনারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা করিবেন ও আমাদের স্ত্রীলোকদের যথার্থ অবস্থা একটু দেখাইতে সাহায্য করিবেন। তিনি মিশনরী বা গোঁড়া খ্রীষ্টান নহেন—আপনি সে ভয় করিবেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে তিনি সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টাই করিতে চান। তাঁহার উদ্দেশ্যসাধনে এইরূপে সহায়তা করিলে এদেশে আমাকেও অনেকটা সাহায্য করা হইবে। প্রভু আপনাকে আশীর্বাদ করুন।

ভবদীয় চিরস্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১০০
[মিস মেরী ও হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
চিকাগো
২৬ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
শ্রেষ্ঠ হিন্দী কবি তুলসীদাস তাঁর রামায়ণের মঙ্গলাচরণে বলেছেন, ‘আমি সাধু অসাধু উভয়েরই চরণ বন্দনা করি; কিন্তু হায়, উভয়েই আমার নিকট সমভাবে দুঃখপ্রদ—অসাধু ব্যক্তি আমার নিকট আসা মাত্র আমাকে যাতনা দিতে থাকে, আর সাধু ব্যক্তি ছেড়ে যাবার সময় আমার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যান।’৫৩

আমি বলি ‘তথাস্তু’। আমার কাছে—ভগবানের প্রিয় সাধু ভক্তগণকে ভালবাসা ছাড়া সুখের ও ভালবাসার জিনিষ আর কিছুই নাই; আমার পক্ষে তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ মৃত্যুতুল্য। কিন্তু এ সব অনিবার্য। হে আমার প্রিয়তমের বংশীধ্বনি! তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চল, আমি অনুগমন করছি। হে মহৎস্বভাবা মধুরপ্রকৃতি সহৃদয়া পবিত্রস্বভাবগণ! হায়, আমি যদি ষ্টোয়িক (Stoic) দার্শনিকগণের মত সুখদুঃখে নির্বিকার হতে পারতাম!

আশা করি তোমরা সুন্দর গ্রাম্য দৃশ্য বেশ উপভোগ করছ।

‘যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥’—গীতা

… সমস্ত প্রাণীর পক্ষে যা রাত্রি, সংযমী তাতে জাগ্রত থাকেন; আর প্রাণিগণ যাতে জাগ্রত থাকে, আত্মজ্ঞানী মুনির পক্ষে তা রাত্রিস্বরূপ।

এই জগতের ধূলি পর্যন্ত যেন তোমাদের স্পর্শ করতে না পারে; কারণ, কবিরা বলে থাকেন, জগৎটা হচ্ছে একটা পুষ্পাচ্ছাদিত শব মাত্র। তাকে স্পর্শ কর না। তোমরা হোমা পাখীর বাচ্চা—এই মলিনতার পঙ্কিল পল্বলস্বরূপ জগৎ স্পর্শ করবার পূর্বেই তোমরা আকাশের দিকে আবার উড়ে যাও।

‘যে আছ চেতন ঘুমায়ো না আর!’

‘জগতের লোকের ভালবাসার অনেক বস্তু আছে—তারা সেগুলি ভালবাসুক; আমাদের প্রেমাস্পদ একজন মাত্র—সেই প্রভু। জগতের লোক যাই বলুক না, আমরা সে সব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। তবে যখন তারা আমাদের প্রেমাস্পদের ছবি আঁকতে যায় ও তাঁকে নানারূপ কিম্ভূতকিমাকার বিশেষণে বিশেষিত করে, তখনই আমাদের ভয় হয়। তাদের যা খুশী তাই করুক, আমাদের নিকট তিনি কেবল প্রেমাস্পদ মাত্র—তিনি আমার প্রিয়তম—প্রিয়তম—প্রিয়তম, আর কিছুই নন।’

‘তাঁর কত শক্তি, কত গুণ আছে—এমন কি আমাদের কল্যাণ করবারও কত শক্তি আছে, তাই বা কে জানতে চায়? আমরা চিরদিনের জন্য বলে রাখছি আমরা কিছু পাবার জন্য ভালবাসি না। আমরা প্রেমের দোকানদার নই, আমরা কিছু প্রতিদান চাই না, আমরা কেবল দিতে চাই।’

‘হে দার্শনিক! তুমি আমায় তাঁর স্বরূপের কথা বলতে আসছ, তাঁর ঐশ্বর্যের কথা—তাঁর গুণের কথা বলতে আসছ? মূর্খ, তুমি জান না, তাঁর অধরের একটি মাত্র চুম্বনের জন্য আমাদের প্রাণ বের হবার উপক্রম হচ্ছে। তোমার ও-সব বাজে জিনিষ পুঁটলি বেঁধে তোমার বাড়ী নিয়ে যাও—আমাকে আমার প্রিয়তমের একটি চুম্বন পাঠিয়ে দাও—পার কি?’

‘মূর্খ, তুমি কার সামনে নতজানু হয়ে ভয়ে প্রার্থনা করছ? আমি আমার গলার হার নিয়ে বকলসের মত তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়ে তাতে একগাছি সুতো বেঁধে তাঁকে আমার সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছি—ভয়, পাছে এক মুহূর্তের জন্য তিনি আমার নিকট থেকে পালিয়ে যান। ঐ হার—প্রেমের হার, ঐ সূত্র—প্রেমের জমাটবাঁধা ভাবের সূত্র। মূর্খ, তুমি তো সূক্ষ্ম তত্ত্ব বোঝ না যে, যিনি অসীম অনন্তস্বরূপ, তিনি প্রেমের বাঁধনে পড়ে আমার মুঠোর মধ্যে ধরা পড়েছেন। তুমি কি জান না যে, সেই জগন্নাথ প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়েন—তুমি কি জান না যে, যিনি এত বড় জগৎটাকে চালাচ্ছেন, তিনি বৃন্দাবনের গোপীদের নূপুর-ধ্বনির তালে তালে নাচতেন?’

এই যে পাগলের মত যা-তা লিখলাম, তার জন্য আমায় ক্ষমা করবে। অব্যক্তকে ব্যক্ত করবার ব্যর্থপ্রয়াসরূপ আমার এই ধৃষ্টতা মার্জনা করবে—এ কেবল প্রাণে প্রাণে অনুভব করবার জিনিষ। সদা আমার আশীর্বাদ জানবে।

তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (১০১-১১০)

পত্র সংখ্যা (১০১-১১০)

পত্র সংখ্যা- ১০১
[জনৈক মান্দ্রাজী শিষ্যকে লিখিত]

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৮ জুন, ১৮৯৪
প্রিয়—,
সেদিন মহীশূর থেকে জি. জি—র এক পত্র পেলাম। দুঃখের বিষয় জি. জি আমাকে সর্বজ্ঞ মনে করে; তা না হলে সে চিঠির মাথায় তার অদ্ভুত কানাড়া ঠিকানাটা আর একটু পরিষ্কার করে লিখত। তারপর—চিকাগো ছাড়া অন্য কোন জায়গায় আমাকে চিঠি পাঠানো বড্ড ভুল। অবশ্য গোড়ায় আমারই ভুল হয়েছিল—আমারই ভাবা উচিত ছিল, আমার বন্ধুদের সূক্ষ্ম বুদ্ধির কথা—তাঁরা তো আমার চিঠির মাথায় একটা ঠিকানা দেখলেই যেখানে খুশী আমার নামে চিঠি পাঠাচ্ছেন। আমাদের মান্দ্রাজ-বৃহস্পতিদের বল, তারা তো বেশ ভাল করেই জানত যে, তাদের চিঠি পৌঁছবার পূর্বেই হয়তো আমি সেখান থেকে এক হাজার মাইল দূরে চলে গেছি, কারণ আমি ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। চিকাগোয় আমার একজন বন্ধু আছেন, তাঁর বাড়ী হচ্ছে আমার প্রধান আড্ডা। এখানে আমার কাজের প্রসারের আশা প্রায় শূন্য বললেই হয়। কারণ—যদিও প্রসারের খুব সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু নিম্নোক্ত কারণে সে আশা একেবারে নির্মূল হয়েছেঃ

ভারতের খবর আমি যা কিছু পাচ্ছি, তা মান্দ্রাজের চিঠি থেকে। তোমাদের পত্রে ক্রমাগত শুনছি, ভারতে আমাকে সকলে খুব সুখ্যাতি করছে, কিন্তু সে তো—তুমি জেনেছ আর আমি জানছি, কারণ আলাসিঙ্গার প্রেরিত একটা তিন বর্গ-ইঞ্চি কাগজের টুকরো ছাড়া আমি একখানা ভারতীয় খবরের কাগজে আমার সম্বন্ধে কিছু বেরিয়েছে, তা দেখিনি। অন্যদিকে ভারতের খ্রীষ্টানরা যা কিছু বলছে, মিশনরীরা তা খুব সযত্নে সংগ্রহ করে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে এবং বাড়ী বাড়ী গিয়ে আমার বন্ধুরা যাতে আমায় ত্যাগ করেন, তার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য খুব ভালরকমেই সিদ্ধ হয়েছে, যেহেতু ভারত থেকে কেউ একটা কথাও আমার জন্য বলছে না। ভারতের হিন্দু পত্রিকাগুলো আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করতে পারে, কিন্তু তার একটা কথাও আমেরিকায় পৌঁছয়নি। তার জন্য এদেশের অনেকে মনে করছে, আমি একটা জুয়াচোর। একে তো মিশনরীরা আমার পিছু লেগেছে, তার উপর এখানকার হিন্দুরা হিংসা করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে; এক্ষেত্রে আমার একটা কথাও জবাব দেবার নেই। এখন মনে হচ্ছে, কেবল মান্দ্রাজের কতকগুলি ছোকরার পীড়াপীড়ির জন্য ধর্মমহাসভায় যাওয়া আমার আহাম্মকি হয়েছিল, কারণ তারা তো ছোকরা বৈ আর কিছুই নয়। অবশ্য আমি অনন্ত কালের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ, কিন্তু তারা তো গুটিকতক উৎসাহী যুবক ছাড়া আর কিছু নয়—কাজের ক্ষমতা তাদের যে একদম নেই। আমি কোন নিদর্শনপত্র নিয়ে আসিনি, আর যখন কারও অর্থসাহায্যের আবশ্যক হয়, তার নিদর্শনপত্র থাকা দরকার, তা না হলে মিশনরী ও ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধাচরণের সামনে—আমি যে জুয়াচোর নই, তা কি করে প্রমাণ করব? মনে করেছিলাম, গোটাকতক বাক্য ব্যয় করা ভারতের পক্ষে বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। মনে করেছিলাম, মান্দ্রাজে ও কলিকাতায় কয়েকজন ভদ্রলোক জড়ো করে এক-একটা সভা করে আমাকে এবং আমেরিকাবাসিগণকে আমার প্রতি সহৃদয় ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ সহ প্রস্তাব পাস করিয়ে, সেই প্রস্তাবটা দস্তুরমত নিয়মানুযায়ী অর্থাৎ সেই সভার সেক্রেটারীকে দিয়ে, আমেরিকায় ডাঃ ব্যারোজের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তথাকার বিভিন্ন কাগজে ছাপাতে অনুরোধ করা। ঐরূপ বষ্টন, নিউ ইয়র্ক ও চিকাগোর বিভিন্ন কাগজে পাঠানো বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। এখন দেখছি, ভারতের পক্ষে এই কাজটা বড়ই গুরুতর ও কঠিন, এক বছরের ভেতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলে না, আর এখানে সকলেই আমার বিপক্ষে। তোমরা নিজেদের ঘরে বসে আমার সম্বন্ধে যা খুশী বল না কেন, এখানে তার কে কি জানে? দু-মাসেরও উপর হল আলাসিঙ্গাকে আমি এ বিষয়ে লিখেছিলাম, কিন্তু সে আমার পত্রের জবাব পর্যন্ত দিলে না। আমার আশঙ্কা হয়, তার উৎসাহ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুতরাং তোমায় বলছি, আগে এ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখ, তারপর মান্দ্রাজীদের এই চিঠি দেখিও। এদিকে আমার গুরুভাইরা ছেলেমানুষের মত কেশব সেন সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা বলছে, আর মান্দ্রাজীরা থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে আমি চিঠিতে যা কিছু লিখছি, তাই তাদের বলছে—এতে শুধু শত্রুর সৃষ্টি করা হচ্ছে। হায়! যদি ভারতে একটা মাথাওয়ালা কাজের লোক আমার সহায়তা করবার জন্য পেতাম! কিন্তু তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, আমি এদেশে জুয়াচোর বলে গণ্য হলাম। আমারই আহাম্মকি হয়েছিল, কোন নিদর্শনপত্র না নিয়ে ধর্মমহাসভায় যাওয়া—আশা করেছিলাম, অনেক জুটে যাবে। এখন দেখছি, আমাকে একলা ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে। মোটের ওপর, আমেরিকানরা হিন্দুদের চেয়ে লাখোগুণ ভাল, আর আমি অকৃতজ্ঞ ও হৃদয়হীনদের দেশ অপেক্ষা এখানে অনেক ভাল কাজ করতে পারি। যাই হোক, আমাকে কর্ম করে আমার প্রারব্ধ ক্ষয় করতে হবে। আমার আর্থিক অবস্থার কথা যদি বলতে হয়, তবে বলি, আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছলই আছে এবং সচ্ছলই থাকবে। সমগ্র আমেরিকায় বিগত আদমসুমারিতে থিওসফিষ্টদের সংখ্যা সর্বসুদ্ধ মাত্র ৬২৫ জন—তাদের সঙ্গে মিশলে আমার সাহায্য হওয়া দূরে থাক, মুহূর্তের মধ্যে আমার কাজ চুরমার হয়ে যাবে। আলাসিঙ্গা বলছে, লণ্ডনে গিয়ে মিঃ ওল্ডের সঙ্গে দেখা করতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ও কি বাজে আহাম্মকের মত বকছে! বালক—ওরা কি বলছে, তা নিজেরাই বোঝে না। আর এই মান্দ্রাজী খোকার দল—নিজেদের ভেতর একটা বিষয়ও গোপন রাখতে পারে না!! সারাদিন বাজে বকা আর যেই কাজের সময় এল, অমনি আর কারও পাত্তা পাবার যো নেই!!! বোকারামেরা পঞ্চাশটা লোক জড়ো করে, কয়েকটা সভা করে আমার সাহায্যের জন্য গোটাকতক ফাঁকা কথা পাঠাতে পারলে না—তারা আবার সমগ্র জগৎকে শিক্ষা দেব বলে লম্বা কথা কয়!

আমি তোমাকে ফনোগ্রাফ সম্বন্ধে লিখেছি। এখানে এক রকম বৈদ্যুতিক পাখা আছে—দাম বিশ ডলার—বড় সুন্দর চলে। এই ব্যাটারিতে ১০০ ঘণ্টা কাজ হয়, তারপর যে-কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে নিলেই হল।

বিদায়, হিন্দুদের যথেষ্ট দেখা গেল। এখন তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক—যা আসুক অবনত মস্তকে স্বীকার করছি। যাই হোক, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভেবো না, মান্দ্রাজীরা আমার জন্য যতটা করেছে, আমি ততটা পাবারও উপযুক্ত ছিলাম না; আর তাদের ক্ষমতায় যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশী তারা করেছে। আমারই আহাম্মকি হয়েছিল—ক্ষণকালের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমরা হিন্দুরা এখনও মানুষ হয়নি—ক্ষণকালের জন্য আত্মনির্ভরতা হারিয়ে হিন্দুদের উপর নির্ভর করেছিলাম—তাতেই এই কষ্ট পেলাম। প্রতি মুহূর্তে আমি আশা করেছিলাম, ভারত থেকে কিছু আসবে, কিন্তু কিছুই এল না। বিশেষতঃ গত দুমাস প্রতি মুহূর্তে আমার উদ্বেগ ও যন্ত্রণার সীমা ছিল না—ভারত থেকে একখানা খবরের কাগজ পর্যন্ত এল না!! আমার বন্ধুরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে লাগল, কিছুই এল না—একটা আওয়াজ পর্যন্ত এল না; কাজেই অনেকের উৎসাহ চলে গেল, অনেকে আমায় ত্যাগ করলে। কিন্তু এ আমার মানুষের উপর—পশুধর্মী মানুষের উপর নির্ভর করার শাস্তি, আমার স্বদেশবাসীরা এখনও মানুষ হয়নি। তারা নিজেদের প্রশংসাবাদ শুনতে খুব প্রস্তুত আছে, কিন্তু তাদের একটা কথামাত্র কয়ে সাহায্য করবার যখন সময় আসে, তখন তাদের আর টিকি দেখতে পাবার যো নাই। মান্দ্রাজী যুবকগণকে আমার অনন্তকালের জন্য ধন্যবাদ—প্রভু তাদের সদাসর্বদা আশীর্বাদ করুন। কোন ভাব প্রচার করবার পক্ষে আমেরিকাই জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষেত্র—তাই আমি শীঘ্র আমেরিকা ত্যাগ করবার কল্পনা করছি না। কেন? এখানে খেতে পরতে পাচ্ছি, অনেকে সহৃদয় ব্যবহার করছেন, আর দু-দশটা ভাল কথা বলেই এই সব পাচ্ছি! এমন উন্নতমনা জাতকে ছেড়ে পশুপ্রকৃতি, অকৃতজ্ঞ, মস্তিষ্কহীন অনন্ত যুগের কুসংস্কারে বদ্ধ, দয়াহীন, মমতাহীন হতভাগাদের দেশে কি করতে যাব? অতএব আবার বলি—বিদায়। এই পত্রখানি একটু বিবেচনা করে লোককে দেখাতে পার। মান্দ্রাজীরা, এমন কি আলাসিঙ্গা পর্যন্ত, যার ওপর আমি এতটা আশা করেছিলাম—বড় সুবিবেচনার কাজ করেছে বলে মনে হয় না। ভাল কথা, তুমি মজুমদারের লেখা ‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত’৫৪ খানকতক চিকাগোয় পাঠাতে পার? কলিকাতায় অনেক আছে। আমার ঠিকানা ৫৪১ নং ডিয়ারবর্ন এভিনিউ (ষ্ট্রীট নহে), চিকাগো, অথবা C/o টমাস কুক, চিকাগো, ভুলো না যেন। অন্য কোন ঠিকানা দিলে অনেক দেরী ও গোলমাল হবে, কারণ আমি এখন ক্রমাগত ঘুরছি আর চিকাগোই আমার প্রধান আড্ডা; কিন্তু এই বুদ্ধিটুকুও আমার মান্দ্রাজী বন্ধুদের মাথায় ঢোকেনি। অনুগ্রহপূর্বক জি. জি., আলাসিঙ্গা, সেক্রেটারী ও আর আর সকলকে আমার অনন্তকালের জন্য আশীর্বাদ জানাবে—আমি সর্বদা তাদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমি তাদের উপর কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট হইনি—আমি নিজেরই প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি জীবনে এই একবার অপরের সাহায্যে নির্ভর করা-রূপ ভয়ানক ভুল করেছি; আর তার শাস্তিভোগও করেছি। এ আমারই দোষ, তাদের কিছু দোষ নেই। প্রভু মান্দ্রাজীদের আশীর্বাদ করুন—তাদের হৃদয়টা বাঙালীদের চেয়ে অনেক উন্নত। বাঙালীরা কেবল বাক্যসার—তাদের হৃদয় নেই, তারা অসার। বিদায়, বিদায়, আমি এখন সমুদ্রবক্ষে আমার তরণী ভাসিয়েছি—যা হবার হোক। কঠোর সমালোচনার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। বাস্তবিক তো আমার কোন দাবী-দাওয়া নেই। আমার যতটা পাবার অধিকার, তোমরা তার চেয়ে অনন্তগুণ আমার জন্য করেছ। আমার যেরূপ কর্ম, আমি তেমনই ফল পাব, আর যা ঘটুক আমাকে চুপটি করে মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন। ইতি

বিবেকানন্দ

পুঃ—আমার বোধ হয় আলাসিঙ্গার কলেজ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আমি তার কোন খবর পাইনি, আর সে আমাকে তার বাড়ীর ঠিকানাও দেয়নি।

ইতি বি

আমার আশঙ্কা হচ্ছে, কিডি সরে পড়েছে।

**********

পত্র সংখ্যা- ১০২
[মঠের সকল গুরুভ্রাতাকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪ [গ্রীষ্মকাল]

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমাদের পত্র পাইয়া সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। বলরামবাবুর স্ত্রীর শোকসংবাদে দুঃখিত হইলাম। প্রভুর ইচ্ছা। এ কার্যক্ষেত্র—ভোগক্ষেত্র নহে, সকলেই কাজ ফুরুলে ঘরে ফিরবে—কেউ আগে কেউ পাছে। ফকির গেছে, প্রভুর ইচ্ছা।

মহোৎসব বড়ই ধুমধামে হয়েছে, বেশ কথা, তাঁর নাম যতই ছড়ায় ততই ভাল। তবে একটি কথা—মহাপুরুষেরা বিশেষ শিক্ষা দিতে আসেন, নামের জন্যে নহে, কিন্তু চেলারা তাঁদের উপদেশ বানের জলে ভাসাইয়া নামের জন্য মারামারি করে—এই তো পৃথিবীর ইতিহাস। তাঁর নাম লোকে নেয় বা না নেয়, আমি কোন খাতিরে আনি না, তবে তাঁর উপদেশ জীবন শিক্ষা যাতে জগতে ছড়ায়, তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে প্রস্তুত। আমার মহাভয় শশীর ঐ ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘর মন্দ নয়, তবে ঐটি all in all (সর্বস্ব) করে সেই পুরানো ফ্যাশনের nonsense (বাজে ব্যাপার) করে ফেলবার একটা tendency (ঝোঁক) শশীর ভিতর আছে, আমার তাই ভয়। আমি জানি শশী ও নিরঞ্জন কেন ঐ পুরানো ছেঁড়া ceremonial (অনুষ্ঠানপদ্ধতি) নিয়ে ব্যস্ত। ওদের spirit (অন্তরাত্মা) চায় work (কাজ), কোন outlet (বাহির হবার পথ) নেই, তাই ঘণ্টা নেড়ে energy (শক্তি) খরচ করে।

শশী, তোকে একটা নূতন মতলব দিচ্ছি। যদি কার্যে পরিণত করিতে পারিস তবে জানব তোরা মরদ, আর কাজে আসবি। হরমোহন, ভবনাথ, কালীকৃষ্ণ বাবু, তারক-দা প্রভৃতি সকলে মিলে একটা যুক্তি কর। গোটাকতক ক্যামেরা, কতকগুলো ম্যাপ, গ্লোব, কিছু chemicals (রাসায়নিক দ্রব্য) ইত্যাদি চাই। তারপর একটা মস্ত কুঁড়ে চাই। তারপর কতকগুলো গরীব-গুরবো জুটিয়ে আনা চাই। তারপর তাদের Astronomy, Geography (জ্যোতিষ, ভূগোল) প্রভৃতির ছবি দেখাও আর ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ উপদেশ কর—কোন্ দেশে কি হয়, কি হচ্ছে, এ দুনিয়াটা কি, তাদের যাতে চোখ খুলে, তাই চেষ্টা কর—সন্ধ্যার পর, দিন-দুপুরে—কত গরীব মূর্খ বরানগরে আছে, তাদের ঘরে ঘরে যাও—চোখ খুলে দাও। পুঁথি-পাতড়ার কর্ম নয়—মুখে মুখে শিক্ষা দাও। তারপর ধীরে ধীরে centre extend (কেন্দ্রের প্রসার) কর—পার কি? না, শুধু ঘণ্টা নাড়া?

তারক-দার কথা মান্দ্রাজ হইতে সকল পাইয়াছি। তারা তাঁর উপর বড়ই প্রীত। তারক-দা, তুমি যদি কিছুদিন মান্দ্রাজে গিয়ে থাক, তাহলে অনেক কাজ হয়। কিন্তু প্রথমে এই কাজটা বরানগরে শুরু করে যাও। যোগীন-মা, গোলাপ-মা কতকগুলি বিধবা চেলা বানাতে পারে না কি? আর তোমরা তাদের মাথায় কিঞ্চিৎ বিদ্যে-সাদ্যি দিতে পার না কি? তারপর তাদের ঘরে ঘরে ‘রামকৃষ্ণ’ ভজাতে আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যে শেখাতে পাঠিয়ে দিতে পার না কি? …

উঠে পড়ে লেগে যাও দিকি। গপ্প মারা ঘণ্টা নাড়ার কাল গেছে হে বাপু, কার্য করিতে হইবেক। দেখি বাঙালীর ধর্ম কতদূর গড়ায়। নিরঞ্জন লিখছে যে লাটুর গরম কাপড় চাই। এরা গরম কাপড় ইওরোপ আর ইণ্ডিয়া থেকে আনায়। যে দামে এখানে গরম কাপড় কিনব, তার সিকি দামে সেই কাপড় কলিকাতায় মিলবে। লাটুর আক্ষেপ শীঘ্রই দূর করিব। কবে ইওরোপ যাব জানি না, আমার সকলই অনিশ্চিত—এদেশে এক রকম চলছে, এই পর্যন্ত।

এ বড় মজার দেশ। গরমি পড়েছে—আজ সকালবেলা আমাদের বৈশাখের গরমি, আর এখন এলাহাবাদের মাঘ মাসের শীত!! চার ঘণ্টার ভেতর এত পরিবর্তন! এখানের হোটেলের কথা কি বলিব! নিউ ইয়র্কে এক হোটেল আছেন, যেখানে ৫০০০৲ টাকা পর্যন্ত রোজ ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া। ভোগবিলাসের দেশ ইওরোপেও এমন নাই—এরা হল পৃথিবীর মধ্যে ধনী দেশ—টাকা খোলামকুচির মত খরচ হয়ে যায়। আমি কদাচ হোটেলে থাকি, আমি প্রায়ই এদের বড় বড় লোকের অতিথি—আমি এদের একজন নামজাদা মানুষ এখন। মুলুকসুদ্ধ লোকে আমায় জানে, সুতরাং যেখানে যাই, আগ বাড়িয়ে আমায় ঘরে তুলে নেয়। মিঃ হেল, যাঁর বাড়ীতে চিকাগোয় আমার centre (কেন্দ্র), তার স্ত্রীকে আমি ‘মা’ বলি, আর তাঁর মেয়েরা আমাকে ‘দাদা’ বলে; এমন মহা পবিত্র দয়ালু পরিবার আমি তো আর দেখি না। আরে ভাই, তা নইলে কি এদের উপর ভগবানের এত কৃপা? কি দয়া এদের! যদি খবর পেলে যে, একজন গরীব ফলানা জায়গায় কষ্টে রয়েছে, মেয়েমদ্দে চলল—তাকে খাবার, কাপড় দিতে, কাজ জুটিয়ে দিতে! আর আমরা কি করি!

এরা গরমিকালে বাড়ী ছেড়ে বিদেশে অথবা সমুদ্রের কিনারায় যায়। আমিও যাব একটা কোন জায়গায়—এখনও ঠিক করি নাই। আর সকল—যেমন ইংরেজদের দেখছ, তেমনি আর কি। বইপত্র সব আছে বটে, কিন্তু মহা মাগ‍্‍গি, সে দামে ৫ গুণ সেই জিনিষ কলিকাতায় মেলে অর্থাৎ এরা বিদেশী মাল দেশে আসতে দেবে না। মহা কর বসিয়ে দেয়—কাজেই আগুন হয়ে দাঁড়ায়। আর এরা বড় একটা কাপড়-চোপড় বানায় না—এরা যন্ত্র-আওজার আর গম, চাল, তুলা ইত্যাদি তৈয়ার করে—তা সস্তা বটে।

ভাল কথা, এখানে ইলিস মাছ অপর্যাপ্ত আজকাল। ভরপেট খাও, সব হজম। ফল অনেক—কলা, নেবু, পেয়ারা, আপেল, বাদাম, কিসমিস, আঙ্গুর যথেষ্ট, আরও অনেক ফল ক্যালিফোর্নিয়া হতে আসে। আনারস ঢের—তবে আম, নিচু ইত্যাদি নাই।

এক রকম শাক আছে, Spinach—যা রাঁধলে ঠিক আমাদের নটে শাকের মত খেতে লাগে, আর যেগুলোকে এরা Asparagus (এষ্পারেগাস) বলে, তা ঠিক যেন কচি ডেঙ্গোর ডাঁটা, তবে ‘গোপালের মার চচ্চড়ি’ নেই বাবা। কলায়ের দাল কি কোন দাল নেই, এরা জানেও না। ভাত আছে, পাঁউরুটি আছেন, হর-রঙের নানা রকমের মাছমাংস আছেন। এদের খানা ফরাসীদের মত। দুধ আছেন, দই কদাচ, ঘোল অপর্যাপ্ত। মাঠা (cream) সর্বদাই ব্যবহার। চায়ে, কাফিতে, সকল তাতেই ঐ মাঠা (cream)—সর নয়, দুধের মাঠা। আর মাখন তো আছেন, আর বরফ-জল—শীত কি গ্রীষ্ম, দিন কি রাত্রি, ঘোর সর্দি কি জ্বর—এন্তের৫৫ বরফ-জল। এরা scientific (বৈজ্ঞানিক) মানুষ, সর্দিতে বরফ-জল খেলে বাড়ে শুনলে হাসে। খুব খাও, খুব ভাল। আর কুলপি এন্তের নানা আকারের।

নায়াগারা falls (জলপ্রপাত) হরির ইচ্ছায় ৭।৮ বার তো দেখলুম। খুব grand (উচ্চভাবোদ্দীপক) বটে, তবে যত শুনেছ, তা নয়। একদিন শীতকালে Aurora Borealis ৫৬ হয়েছিল। আর কিছুই লেখবার মত খুঁজে পাচ্ছি না। এ-সব চিঠি বাজার কর না।

মা-ঠাকুরাণীর খরচপত্র কেমন চলছে, তোমরা তা তো কিছুই লেখ নাই। খালি childish prattle (আবোলতাবোল)!! ও-সকল জানবার আমার এ জন্মে বড় একটা সময় নাই, next time-এ (আগামী বারে) দেখা যাবে।

যোগেন বোধ হয় এতদিনে বেশ সেরে গেছে। সারদার ঘুরঘুরে রোগ এখনও শান্তি হয় নাই। একটা power of organisation (সঙ্ঘ চালাবার শক্তি) চাই—বুঝেছ? তোমাদের ভিতর কারুর মাথায় ততটুকু ঘি আছে কি? যদি থাকে তো বুদ্ধি খেলাও দিকি—তারক দাদা, শরৎ, হরি—এরা পারবে। শশীর originality (মৌলিকতা) ভারী কম, তবে খুব good workman, perservering (ভাল কাজের লোক—অধ্যবসায়শীল), সেটা বড়ই দরকার, শশী খুব executive (কাজের লোক), বাদবাকী—এরা যা বলে, তাই শুনে চলো। কতকগুলো চেলা চাই—fiery young men (অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত যুবক), বুঝতে পারলে? Intelligent and brave (বুদ্ধিমান্ ও সাহসী), যমের মুখে যেতে পারে, সাঁতার দিয়ে সাগর পারে যেতে প্রস্তুত, বুঝলে? Hundreds (শত শত) ঐ রকম চাই, মেয়ে-মদ্দ both (দুই)—প্রাণপণে তারই চেষ্টা কর—চেলা বনাও আর আমাদের purity drilling (পবিত্রতার সাধন) যন্ত্রে ফেলে দাও।

তোমাদের আক্কেল বুদ্ধি এক পয়সাও নাই। Indian Mirrorকে ‘পরমহংস মশায় নরেনকে হেন বলতেন, তেন বলতেন’ কেন বলতে গেলে? আর আজগুবি ফাজগুবি যত—পরমহংস মশায়ের বুঝি আর কিছুই ছিল না? খালি thought-reading (পরের মনের কথা বলতে পারা) আর nonsense (বাজে) আজগুবি! দু-পয়সার brain (মস্তিষ্ক)-গুলো! ঘৃণা হয়ে যায়! তোদের নিজের বুদ্ধি বড় একটা খেলাতে হবে না—সাদা বাঙলা কয়ে যা দিকি।

বাবুরামের লম্বা পত্র পড়লাম। বুড়ো বেঁচে আছে—বেশ কথা! তোমাদের আড্ডাটা নাকি বড় malarious (ম্যালেরিয়াগ্রস্ত)—রাখাল আর হরি লিখছেন। রাজাকে আর হরিকে আমার বহুত বহুত দণ্ডবৎ লাট্টিবৎ ইষ্টিকবৎ ছতরীবৎ দিবে। বাবুরাম অনেক delirium (প্রলাপ) বকেছে। সাণ্ডেল আনাগোনা করছে, বেশ বেশ। গুপ্তকে তোমরা চিঠিপত্র লেখ—আমার ভালবাসা জানিও ও যত্ন কর। সব ঠিক আসবে ধীরে ধীরে। আমার বহুত চিঠি লেখবার সময় বড় একটা হয় না। Lecture ফেক‍্‍চার (বক্তৃতা) তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছি। বাকী সব দাঁড়াঝাঁপ, যা মুখে আসে গুরুদেব জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই নাই। একবার ডেট্রয়েটে তিন ঘণ্টা ঝাড়া বুলি ঝেড়েছিলুম। আমি নিজে অবাক্ হয়ে যাই সময়ে সময়ে; ‘মধো, তোর পেটে এতও ছিল!!’ এরা সব বলে, পুঁথি লেখ; একটা এইবার লিখতে ফিকতে হবে দেখছি। ঐ তো মুশকিল, কাগজ কলম নিয়ে কে হাঙ্গাম করে বাবা!

কোন চিঠি বাজার গুজব করিসনি, খবরদার! চ্যাঙড়ামো নাকি? যা করতে বলছি পার তো কর, না পার তো মিছে ফেচাং কর না। তোমাদের বাড়ীতে কটা ঘর আছে, কেমন করে চলছে, রাঁধুনী-ফাঁধুনী আছে কিনা—সব লিখবে। মা ঠাকুরাণীকে আমার বহুত বহুত সাষ্টাঙ্গ দিবে। তারকদাদা আর শরতের বুদ্ধি নিয়ে যে কাজটা করতে বলেছি—করবার চেষ্টা করবে—দেখব কেমন বাহাদুর। এইটুকু যদি না করতে পার তাহলে তোমাদের ওপর হতে আমার সব বিশ্বাস আর ভরসা চলে যাবে। মিছামিছি কর্তাভজার দল বাঁধতে আমার ইচ্ছা নাই—I will wash my hands off you for ever (তোমাদের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই আমি আর রাখব না)।

সমাজকে, জগৎকে electrify (বৈদ্যুতিকশক্তিসম্পন্ন) করতে হবে। বসে বসে গপ্পবাজির আর ঘণ্টা নাড়ার কাজ? ঘণ্টা নাড়া গৃহস্থের কর্ম, মহীন্দ্র মাষ্টার, রামবাবু করুন গে। তোমাদের কাজ distribution and propagation of thought currents (ভাবপ্রবাহ বিস্তার)। তাই যদি পার তবে ঠিক, নইলে বেকার। রোজকার করে খাওগে। মিছে eating the begging bread of idleness is of no use (অনায়াসলব্ধ ভিক্ষান্ন খাওয়া নিরর্থক) বুঝলে বাপু? কিমধিকমিতি

নরেন্দ্র

Character formed (চরিত্র গঠিত) হয়ে যাক, তারপর আমি আসছি, বুঝলে? দু হাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার সন্ন্যাসী চাই, মেয়ে-মদ্দ—বুঝলে? গৌর-মা, যোগেন-মা, গোলাপ-মা কি করছেন? চেলা চাই at any risk (যে-কোন রকমে হোক)। তাঁদের গিয়ে বলবে আর তোমরা প্রাণপণে চেষ্টা কর। গৃহস্থ চেলার কাজ নয়, ত্যাগী—বুঝলে? এক এক জনে ১০০ মাথা মুড়িয়ে ফেল, young educated men—not fools (শিক্ষিত যুবক—আহাম্মক নয়), তবে বলি বাহাদুর। হুলস্থুল বাঁধাতে হবে, হুঁকো ফুঁকো ফেলে কোমর বেঁধে খাড়া হয়ে যাও। তারকদাদা, মান্দ্রাজ কলিকাতার মাঝে বিদ্যুতের মত চক্র মারো দিকি, বার কতক। জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) কর, খালি চেলা কর, মায়ে মেয়ে-মদ্দ, যে আসে দে মাথা মুড়িয়ে, তারপর আমি আসছি। মহা spriritual tidal wave (আধ্যাত্মিক বন্যা) আসছে—নীচ মহৎ হয়ে যাবে, মূর্খ মহাপণ্ডিতের গুরু হয়ে যাবে তাঁর কৃপায়—‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’

Life is ever expanding, contraction is death (জীবন হচ্ছে সম্প্রসারণ, সঙ্কোচনই মৃত্যু)। যে আত্মম্ভরি আপনার আয়েস খুঁজছে, কুঁড়েমি করছে, তার নরকেও জায়গা নাই। যে আপনি নরক পর্যন্ত গিয়ে জীবের জন্য কাতর হয়, চেষ্টা করে, সেই রামকৃষ্ণের পুত্র—ইতরে কৃপণাঃ (অপরে কৃপার পাত্র)। যে এই মহা সন্ধিপূজার সময় কোমর বেঁধে খাড়া হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাঁর সন্দেশ বিতরণ করবে, সেই আমার ভাই, সেই তাঁর ছেলে, বাকী যে তা না পার—তফাত হয়ে যাও এই বেলা ভালয় ভালয়।

এই চিঠি তোমরা পড়বে—যোগেন-মা, গোলাপ-মা সকলকে শুনাবে। এই test (পরীক্ষা), যে রামকৃষ্ণের ছেলে, সে আপনার ভাল চায় না, ‘প্রাণাত্যয়েঽপি পরকল্যাণচিকীর্ষবঃ’ (প্রাণ দিয়েও পরের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী) তারা। যারা আপনার আয়েস চায়, কুঁড়েমি চায়, যারা আপনার জিদের সামনে সকলের মাথা বলি দিতে রাজী, তারা আমাদের কেউ নয়, তারা তফাত হয়ে যাক, এই বেলা ভালয় ভালয়। তাঁর চরিত্র, তাঁর শিক্ষা, ধর্ম চারিদিকে ছড়াও—এই সাধন, এই ভজন; এই সাধন, এই সিদ্ধি। উঠ, উঠ, মহাতরঙ্গ আসছে, Onward, onward (এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও)। মেয়ে-মদ্দে আচণ্ডাল সব পবিত্র তাঁর কাছে—Onward, onward, নামের সময় নাই, যশের সময় নাই, মুক্তির সময় নাই, ভক্তির সময় নাই, দেখা যাবে পরে। এখন এ জন্মে অনন্ত বিস্তার, তাঁর মহান্ চরিত্রের, তাঁর মহান্ জীবনের, তাঁর অনন্ত আত্মার। এই কার্য—আর কিছু নাই। যেখানে তাঁর নাম যাবে, কীটপতঙ্গ পর্যন্ত দেবতা হয়ে যাবে, হয়ে যাচ্ছে, দেখেও দেখছ না? এ কি ছেলেখেলা, এ কি জ্যাঠামি, এ কি চ্যাংড়ামি—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’—হরে হরে। তিনি পিছে আছেন। আমি আর লিখতে পারছি না—Onward, এই কথাটি খালি বলছি, যে যে এই চিঠি পড়বে, তাদের ভিতর আমার spirit (শক্তি) আসবে, বিশ্বাস কর। Onward, হরে হরে। চিঠি বাজার কর না। আমার হাত ধরে কে লেখাচ্ছে। Onward, হরে হরে। সব ভেসে যাবে—হুঁশিয়ার—তিনি আসছেন। যে যে তাঁর সেবার জন্য—তাঁর সেবা নয়—তাঁর ছেলেদের—গরীব-গুরবো, পাপী-তাপী, কীট-পতঙ্গ পর্যন্ত, তাদের সেবার জন্য যে যে তৈরী হবে, তাদের ভেতর তিনি আসবেন—তাদের মুখে সরস্বতী বসবেন, তাদের বক্ষে মহামায়া মহাশক্তি বসবেন। যেগুলো নাস্তিক, অবিশ্বাসী, নরাধম, বিলাসী—তারা কি করতে আমাদের ঘরে এসেছে? তারা চলে যাক।

আমি আর লিখতে পারছি না, বাকী তিনি নিজে বলুন গে।

ইতি নরেন্দ্র

পুঃ—একটা বড় খাতা রাখবে এবং তাহাতে যখন যে স্থান হইতে কোন পত্র আসে তাহার একটা চুম্বক লিখিয়া রাখিবে। তাহা হইলে উত্তর দিবার বেলায় ভুলচুক হইবে না। Organisation (সঙ্ঘ) শব্দের অর্থ division of labour (শ্রমবিভাগ)—প্রত্যেকে আপনার আপনার কাজ করে এবং সকল কাজ মিলে একটা সুন্দর ভাব হয়। …

বিশেষ অনুধাবন করে যা যা লিখলাম তা করিবে। আমার কবিতা৫৭ কপি করে রেখো, পরে আরও পাঠাব।
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৩
[মিসেস হেলকে লিখিত]
C/o. ডাঃ ই. গার্নসি
Fishkill Landing, N. Y.
জুলাই, ১৮৯৪

মা,
কাল এখানে এসেছি। কয়েক দিন থাকব। নিউ ইয়র্কে আপনার এক পত্র পেয়েছিলাম, কিন্তু ‘ইণ্টিরিয়র’ পাইনি। তাতে খুশীই হয়েছি; কারণ আমি এখনও নিখুঁত হইনি; আর প্রেসবিটেরিয়ন ধর্মযাজকদের—বিশেষতঃ ‘ইণ্টিরিয়র’দের—আমার প্রতি যে নিঃস্বার্থ ভালবাসা আছে, তা জেনে পাছে এই ‘প্রেমিক’ খ্রীষ্টান মহোদয়গণের উপর আমার বিদ্বেষ উদ্বুদ্ধ হয়, এই জন্য তফাতেই থাকতে চাই। আমাদের ধর্মের শিক্ষা—ক্রোধ সঙ্গত (সমর্থনযোগ্য) হলেও মহাপাপ। নিজ নিজ ধর্মই অনুসরণীয়। ‘সাধারণ’ ও ‘ধর্মসংক্রান্ত’ ভেদে ক্রোধ, হত্যা, অপবাদ প্রভৃতির মধ্যে কোন তফাত করতে পারি না—শত চেষ্টা সত্ত্বেও। এই সূক্ষ্ম নৈতিক পার্থক্যবোধ যেন আমার স্বজাতীয়গণের মধ্যে কখনও প্রবেশ না করে। ঠাট্টা থাক, শুনুন মাদার চার্চ, আপনাকে বলছি—এরা যে কপট, ভণ্ড, স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠাপ্রিয়—তা বেশ স্পষ্ট দেখে আমি এদের উন্মত্ত আস্ফালন মোটেই গ্রাহ্য করি না।

এইবার ছবির কথা বলিঃ প্রথমে মেয়েরা কয়েকটি আনে, পরে আপনি কয়েক কপি আনেন। আপনি তো জানেন মোট ৫০ কপি দেবার কথা। এ বিষয়ে ভগিনী ইসাবেল আমার চেয়ে বেশী জানেন।

আপনি ও ফাদার পোপ আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রীতি জানবেন। ইতি

আপনাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—গরম কেমন উপভোগ করেছেন? এখানকার তাপ আমার বেশ সহ্য হচ্ছে। সমুদ্রতীরে সোয়াম‍্‍স্কটে (Swampscot) যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন এক অতি ধনী মহিলা; গত শীতে নিউ ইয়র্কে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়। ধন্যবাদ সহ প্রত্যাখান জানিয়েছি। এ দেশে কারও আতিথ্যগ্রহণ-বিষয়ে আমি এখন খুব সতর্ক—বিশেষ করে ধনী লোকের। খুব ধনবান্‌দের আরও কয়েকটি নিমন্ত্রণ আসে, সেগুলিও প্রত্যাখ্যান করেছি। এতদিনে এদের কার্যকলাপ বেশ বুঝলাম। আন্তরিকতার জন্য ভগবান্ আপনাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন; হায়, জগতে ইহা এতই বিরল!

আপনার স্নেহের
বি
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৪
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৯ জুলাই, ১৮৯৪
ভগিনীগণ,
জয় জগদম্বে! আমি আশারও অধিক পেয়েছি। মা আপন প্রচারককে মর্যাদায় অভিভূত করেছেন। তাঁর দয়া দেখে আমি শিশুর মত কাঁদছি। ভগিনীগণ! তাঁর দাসকে তিনি কখনও ত্যাগ করেন না। আমি যে চিঠিখানি তোমাদের পাঠিয়েছি, তা দেখলে সবই বুঝতে পারবে। আমেরিকার লোকেরা শীঘ্রই ছাপা কাগজগুলি পাবে। পত্র যাঁদের নাম আছে, তাঁরা আমাদের দেশের সেরা লোক। সভাপতি ছিলেন কলিকাতার এক অভিজাতশ্রেষ্ঠ, অপর ব্যক্তি মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন কলিকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ও ভারতীয় ব্রাহ্মণ-সমাজের শীর্ষস্থানীয়। তাঁর এই মর্যাদা গভর্ণমেণ্টেরও অনুমোদিত। ভগিনীগণ! আমি কি পাষণ্ড! তাঁর এত দয়া প্রত্যক্ষ করেও মাঝে মাঝে বিশ্বাস প্রায় হারিয়ে ফেলি। সর্বদা তিনি রক্ষা করছেন দেখেও মন কখনও কখনও বিষাদগ্রস্ত হয়। ভগিনীগণ! ভগবান্‌ একজন আছেন জানবে, তিনি পিতা, তিনি মাতা; তাঁর সন্তানদের তিনি কখনও পরিত্যাগ করেন না—না, না, না। নানা রকম বিকৃত মতবাদ ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে সরল শিশুর মত তাঁর শরণাগত হও। আমি আর লিখতে পারছি না, মেয়েদের মত কাঁদছি।

জয় প্রভু, জয় ভগবান্!

তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৫
U. S. A
১১ জুলাই, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি ৫৪১ নং ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো ছাড়া আর কোন ঠিকানায় আমায় পত্র লিখো না। তোমার শেষ চিঠিখানা সারা দেশ ঘুরে আমার কাছে পৌঁছেছে—আর পত্রটা যে শেষে পৌঁছল, মারা গেল না, তার কারণ এখানে আমার কথা সকলে বেশ ভালরকম জানে। সভার খানকতক প্রস্তাব ডাঃ ব্যারোজকে পাঠাবে—তার সঙ্গে একখানা পত্র লিখে আমার প্রতি সহৃদয় ব্যবহারের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেবে এবং উহা আমেরিকার কতকগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশ করবার জন্য অনুরোধ করবে। মিশনরীরা আমার নামে এই যে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে যে, আমি কারও প্রতিনিধি নই—ঐতেই তার উত্তম প্রতিবাদ হবে। বৎস, কি করে কাজ করতে হয়, শেখো। এইভাবে দস্তুরমত প্রণালীতে কাজ করতে পারলে আমরা খুব বড় বড় কাজ করতে নিশ্চিতই সমর্থ হব। গত বছর আমি কেবল বীজ বপন করেছি—এই বছর ফসল কাটতে চাই। ইতোমধ্যে ভারতে যতটা সম্ভব আন্দোলন চালাও। কিডি নিজের ভাবে চলুক—সে ঠিক পথে দাঁড়াবে। আমি তার ভার নিয়েছি—সে নিজের মতে চলুক, এ বিষয়ে তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তাকে আমার আশীর্বাদ জানাবে। পত্রিকাখানা বার কর—আমি মাঝে মাঝে প্রবন্ধ পাঠাব। বষ্টনের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট (Wright)-কে একখানা প্রস্তাব পাঠাবে, আর সঙ্গে সঙ্গে একখানা পত্র লিখে এই বলে তাঁকে ধন্যবাদ দেবে যে, তিনি সর্বপ্রথম আমেরিকায় আমার বন্ধুরূপে দাঁড়িয়েছিলেন, আর তাঁকেও ঐটি কাগজে ছাপাতে অনুরোধ করবে; তা হলে মিশনরীদের (আমি যে কারু প্রতিনিধি হয়ে আসিনি) এ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। ডেট্রয়েটের বক্তৃতায় আমি ৯০০ ডলার অর্থাৎ ২৭০০৲ টাকা পেয়েছিলাম। অন্যান্য বক্তৃতায় একটাতে এক ঘণ্টায় আমি ২৫০০ ডলার অর্থাৎ ৭৫০০৲ টাকা রোজগার করি, কিন্তু পাই মাত্র ২০০ ডলার। একটা জুয়াচোর বক্তৃতা কোম্পানী আমায় ঠকিয়েছিল। আমি তাদের সংস্রব ছেড়ে দিয়েছি। এখানে খরচও হয়ে গেছে অনেক টাকা—হাতে আছে মাত্র ৩০০০ ডলার। আসছে বছরে আবার আমায় অনেক জিনিষ ছাপাতে হবে।

আমি এইবার নিয়মিতভাবে কাজ করব মনে করছি। কলিকাতায় লেখ, তারা আমার ও আমার কাজ সম্বন্ধে কাগজে যা কিছু বেরোয়, কিছুমাত্র বাদ না দিয়ে যেন পাঠায়, তোমরাও মান্দ্রাজ থেকে পাঠাতে থাক। খুব আন্দোলন চালাও। কেবল ইচ্ছাশক্তিতেই সব হবে। কাগজ ছাপানো ও অন্যান্য খরচের জন্য মাঝে মাঝে তোমাদের কাছে টাকা পাঠাবার চেষ্টা করব। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তোমাদের একটা সমিতি স্থাপন করতে হবে—তার নিয়মিত অধিবেশন হওয়া চাই, আর আমাকে যত পার, সব খবরাখবর লিখবে। আমিও যাতে নিয়মিতভাবে কাজ করতে পারি, তার চেষ্টা করছি। এই বছরে অর্থাৎ আগামী শীত ঋতুতে আমি অনেক টাকা পাব—সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে তোমরা এগিয়ে চল। তোমরা পল কেরসকে (Dr. Paul Carus) একখানা পত্র লিখো, আর যদিও তিনি আমার বন্ধুই আছেন, তথাপি তোমরা তাঁকে আমাদের জন্য কাজ করবার অনুরোধ কর। মোট কথা যতদূর পার আন্দোলন চালাও—কেবল সত্যের অপলাপ না হয়, এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখো। বৎসগণ, কাজে লাগো—তোমাদের ভিতর আগুন জ্বলে উঠবে। মিসেস হেল (Mrs. G. W. Hale) আমার পরম বন্ধু—আমি তাঁকে ‘মা’ বলি এবং তাঁর কন্যাদের ‘ভগিনী’ বলি। তাঁকেও একখানা প্রস্তাব পাঠিয়ে দিও—আর একখানা পত্র লিখে তোমাদের তরফ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ দিও। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করবার ভাবটা আমাদের চরিত্রে একেবারে নাই, এটা যাতে আসে—তার চেষ্টা করতে হবে। এটি করবার রহস্য হচ্ছে ঈর্ষার অভাব। সর্বদাই তোমার ভ্রাতার মতে মত দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে—সর্বদাই যাতে মিলে মিশে শান্তভাবে কাজ হয়, তার চেষ্টা করতে হবে। এটাই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করবার সমগ্র রহস্য। সাহসের সহিত যুদ্ধ কর। জীবন তো ক্ষণস্থায়ী—একটা মহৎ উদ্দেশ্যে জীবনটা সমর্পণ কর।

তুমি নরসিংহ সম্বন্ধে কিছু লেখনি কেন? সে এক রকম অনশনে দিন কাটাচ্ছে। আমি তাকে কিছু দিয়েছিলাম, তারপর সে কোথায় যে চলে গেল, কিছু জানি না; সে আমায় কিছু লেখে না। অক্ষয় ভাল ছেলে, আমি তাকে খুব ভালবাসি। থিওসফিষ্টদের সঙ্গে বিবাদ করবার আবশ্যক নেই। আমি যা কিছু লিখি, তাদের কাছে গিয়ে সব বল না। আহাম্মক! থিওসফিষ্টরা আগে এসে আমাদের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে—জান তো? জজ৫৮ হচ্ছেন হিন্দু আর কর্ণেল অলকট বৌদ্ধ। জজ এখানকার একজন খুব উপযুক্ত ব্যক্তি। এখন হিন্দু থিওসফিষ্টদের বল, তারা যেন জজকে সমর্থন করে। এমন কি, যদি তোমরা তাঁকে সমধর্মাবলম্বী বলে সম্বোধন করে এবং তিনি আমেরিকায় হিন্দুধর্মপ্রচারের জন্য যে পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ দিয়ে এক পত্র লিখতে পার, তাতে তাঁর বুকটা দশ হাত হয়ে উঠবে। আমরা কোন সম্প্রদায়ে যোগ দেব না, কিন্তু সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করব ও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করব।

এটা স্মরণ রেখো যে, আমি এখন ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুতরাং ‘৫৪১ ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো’ হচ্ছে আমার কেন্দ্র। সর্বদা ঐ ঠিকানাতেই পত্র দেবে, আর ভারতে যা কিছু হচ্ছে—সব খুঁটিনাটি আমাকে জানাবে আর কাগজে আমাদের সম্বন্ধে যা কিছু বার হচ্ছে, তার একটা টুকরো পর্যন্ত পাঠাতে ভুলো না। আমি জি. জি.-র কাছ থেকে একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছি। প্রভু এই বীরহৃদয় ও আদর্শচরিত্র বালকদের আশীর্বাদ করুন। বালাজী, সেক্রেটারী এবং আমাদের সকল বন্ধুকে আমার ভালবাসা জানাবে। কাজ কর, কাজ কর—সকলকে তোমার ভালবাসার দ্বারা জয় কর। আমি মহীশূরের রাজাকে একখানা পত্র লিখেছি ও কয়েকখানা ফটোগ্রাফ পাঠিয়েছি। তোমাদের কাছে যে ফটো পাঠিয়েছি, তা নিশ্চয়ই এতদিনে পেয়েছ। একখানা রামনাদের রাজাকে উপহার দিও—তাঁর ভেতর যতটা ভাব ঢোকাতে পার, চেষ্টা কর। খেতড়ির রাজার সঙ্গে সর্বদা পত্রব্যবহার রাখবে। বিস্তারের চেষ্টা কর। মনে রেখো, জীবনের একমাত্র চিহ্ন হচ্ছে গতি ও উন্নতি। আমি তোমার চিঠি আসতে বিলম্ব দেখে প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম—এখন দেখছি, তোমার আহাম্মকিতেই এত দেরী হয়েছে। বুঝতে পারছ তো, আমি ক্রমাগত ঘুরছি আর চিঠি-বেচারাকে ক্রমাগত নানাস্থান খুঁজে তবে আমাকে বার করতে হয়। আরও তোমাদের এটি বিশেষ করে মনে রাখতে হবে যে, সব কাজ দস্তুরমত নিয়ম-মাফিক করতে হবে। যে প্রস্তাবগুলি সভায় পাস হয়েছে, সেগুলি ধর্মমহাসভার সভাপতি, চিকাগো, ডাঃ ব্যারোজ (Dr. J. H. Barrows)-কে পাঠাবে এবং তাঁকে অনুরোধ করবে যে, ঐ প্রস্তাব ও পত্র যেন তিনি খবরের কাগজে ছাপান।

ডাঃ ব্যারোজকে ও ডাঃ পল কেরসকে ঐগুলি ছাপার জন্য অনুরোধ-পত্রও যেন ঐরূপ সভার প্রতিনিধিস্থানীয় কারও কাছ থেকে যায়। বিশ্ব মহামেলার (ডেট্রয়েট, মিশিগান) সভাপতি, সেনেটার পামার (Palmer)-কে পাঠাবে—তিনি আমার প্রতি বড়ই সহৃদয় ব্যবহার করেছিলেন। মিসেস ব্যাগ‍্‍লি (J. J. Bagley)-কে ওয়াশিংটন এভিনিউ, ডেট্রয়েট, এই ঠিকানায় একখানা পাঠাবে, আর তাঁকে অনুরোধ করবে যে, সেটা যেন কাগজে প্রকাশ করা হয় ইত্যাদি। খবরের কাগজ প্রভৃতিতে দেওয়া গৌণ—দস্তুর মাফিক পাঠানোই হচ্ছে আসল অর্থাৎ ব্যারোজ প্রভৃতি প্রতিনিধিকল্প ব্যক্তিগণের হাত দিয়ে আসা চাই, তবেই সেটি একটি নিদর্শনরূপে গণ্য হবে। খবরের কাগজে অমনি অমনি কিছু বেরুলে সেটি নিদর্শনরূপে গণ্য হয় না। সব চেয়ে নিয়ম অনুযায়ী উপায় হচ্ছে ডাঃ ব্যারোজকে পাঠানো ও তাঁকে কাগজে প্রকাশ করতে অনুরোধ করা। আমি এসব কথা লিখছি, তার কারণ এই যে, আমার মনে হয়, তোমরা অন্য জাতের আদব-কায়দা জান না। যদি কলিকাতা থেকেও বড় বড় নাম দিয়ে—এ রকম সব আসে, তাহলে আমেরিকানরা যাকে বলে ‘boom’, তাই পাব (আমার স্বপক্ষে খুব হুজুক মেচে যাবে) আর যুদ্ধের অর্ধেক জয় হয়ে যাবে। তখন ইয়াঙ্কিদের বিশ্বাস হবে যে, আমি হিন্দুদের যথার্থ প্রতিনিধি, আর তখনই তারা তাদের গাঁট থেকে পয়সা বার করবে। স্থিরভাবে লেগে থাকো—এ পর্যন্ত আমরা অদ্ভুত কার্য করেছি। হে বীরগণ, এগিয়ে যাও, আমরা নিশ্চয় জয়লাভ করব। মান্দ্রাজ থেকে যে কাগজখানা বার হবার কথা হচ্ছিল, তার কি হল? সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সভাসমিতি স্থাপন করতে থাকো, কাজে লেগে যাও—এই একমাত্র উপায়। কিডিকে দিয়ে লেখাতে থাকো, তাতেই তার মেজাজ ঠিক থাকবে। এ সময়টা বেশী বক্তৃতা করবার সুবিধা নেই, সুতরাং এখন আমাকে কলম ধরে বসে লিখতে হবে। অবশ্য সর্বক্ষণই আমাকে কঠিন কার্যে নিযুক্ত থাকতে হবে, তারপর শীত ঋতু এলে লোকে যখন তাদের বাড়ী ফিরবে, তখন আবার বক্তৃতাদি শুরু করে এবার সভাসমিতি স্থাপন করতে থাকব। সকলকে আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা। খুব খাটো। সম্পূর্ণ পবিত্র হও—উৎসাহাগ্নি আপনিই জ্বলে উঠবে।

শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

পুঃ—সকলকে আমার ভালবাসা। আমি কাকেও কখনও ভুলি না। তবে নেহাত অলস বলে সকলকে আলাদা আলাদা লিখতে পারি না। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।

বি

পুঃ—তোমার ট্রিপ্লিকেনের ঠিকানা অথবা যদি কোন সভাসমিতি স্থাপন করে থাকো, তার ঠিকানা আমায় পাঠাবে।

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৬
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
সোয়াম‍্স্কট্
২৬ জুলাই, ১৮৯৪
প্রিয় খুকীরা
দেখো, আমার চিঠিগুলো যেন নিজেদের বাইরে না যায়। ভগিনী মেরীর এক সুন্দর পত্র পেয়েছি। দেখছ তো সমাজে আমি কি রকম বেড়ে চলেছি। এ সব ভগিনী জিনীর (Jeany) শিক্ষার ফলে। খেলা দৌড়ঝাঁপে সে ধুরন্ধর, মিনিটে ৫০০ হিসাবে ইতরভাষা ব্যবহারে দক্ষ, কথার তোড়ে অদ্বিতীয়, ধর্মের বড় ধার ধারে না, তবে ঐ যা একটু-আধটু। সে আজ বাড়ী গেল, আমি গ্রীনএকারে যাচ্ছি। মিসেস ব্রীডের কাছে গিয়েছিলাম, মিসেস স্টোন সেখানে ছিলেন। মিসেস পুলম্যান প্রভৃতি আমার এখানকার হোমরাচোমরা বন্ধুগণ মিসেস স্টোনের কাছে আছেন। তাঁদের সৌজন্য আগের মতই। গ্রীনএকার থেকে ফেরবার পথে কয়েক দিনের জন্য এনিসস্কোয়ামে যাব মিসেস ব্যাগলির সঙ্গে দেখা করবার জন্য। দূর ছাই, সব ভুলে যাই; সমুদ্রে স্নান করছি ডুবে ডুবে মাছের মত—বেশ লাগছে। ‘প্রান্তর মাঝে’ … (‘dans la plaine’) ইত্যাদি কি ছাইভস্ম গানটি হ্যারিয়েট আমায় শিখিয়েছিল; জাহান্নমে যাক! এক ফরাসী পণ্ডিত আমার অদ্ভুত অনুবাদ শুনে হেসে কুটিপাটি। এইরকম করে তোমরা আমায় ফরাসী শিখিয়েছিলে, বেকুফের দল। তোমরা ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছ তো? বেশ হয়েছে, গরমে ভাজা হয়ে যাচ্ছ। আঃ এখানে কেমন সুন্দর ঠাণ্ডা! যখন ভাবি তোমরা চার জনে গরমে ভাজা পোড়া সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছ, আর আমি এখানে কি তোফা ঠাণ্ডা উপভোগ করছি, তখন আমার আনন্দ শতগুণ বেড়ে যায়। আ হা হা হা।

নিউ ইয়র্ক প্রদেশের কোন স্থানে মিস ফিলিপ‍্‍সের পাহাড় হ্রদ নদী জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর একটি স্থান আছে। আর কি চাই! আমি যাচ্ছি স্থানটিকে হিমালয়ে পরিণত করে সেখানে একটি মঠ খুলতে—নিশ্চয়ই। তর্জন গর্জন, লাথি ঝগড়ায় তোলপাড় এই আমেরিকায় ধর্মের মতভেদের আবর্তে আর একটি নূতন বিরোধের সৃষ্টি না করে এদেশ থেকে যাচ্ছি না।

ভ্রাতঃ, আপনার মত বলিষ্ঠ হৃদয় সহজে মেলে না। এটা একটা আজব জায়গা—আমাদের এই দুনিয়াটা। তবে এই দেশে যেখানে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, সামান্য ‘পরিচয়পত্র’ও যেখানে আমার নেই, সেখানে এখানকার মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণে সহৃদয়তা পেয়েছি, তার জন্য সব জড়িয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মঙ্গলমুখী।

হ্রদটির ক্ষণিক স্মৃতি কখনও কখনও তোমাদের মনে জাগে নিশ্চয়। দুপুরের গরমে ভাববে হ্রদের একেবারে নীচে তলিয়ে যাচ্ছ, যতক্ষণ না বেশ স্নিগ্ধ বোধ কর। তারপর সেই তলদেশে স্নিগ্ধতার মাঝে চুপ করে পড়ে থাকবে—তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে, কিন্তু নিদ্রাভিভূত হবে না—স্বপ্ন-বিজড়িত অর্ধচেতন অবস্থায়। ঐ যেমন আফিমের নেশায় হয়—অনেকটা সেই রকম। ভারী চমৎকার। তার উপর খুব বরফ-ঠাণ্ডা জলও খেতে থাকো। মাংসপেশীতে এক একবার এমন খিল ধরে যাতে হাতী পর্যন্ত কাবু হয়ে পড়বে; ভগবান্‌ আমাকে রক্ষা করুন। আর আমি ঠাণ্ডা জলে নাবচি না।

স্নেহের আধুনিকারা! তোমরা সকলে সুখী হও—সর্বদা এই প্রার্থনা করি।

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৭
[মিস মেরী ও মিস হ্যরিয়েট হেলকে লিখিত]

গ্রীনএকার ইন, ইলিয়ট, মেন
৩১ জুলাই, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনীগণ,
আমি অনেকদিন তোমাদের কোন পত্রাদি লিখিনি, লিখবারও বড় কিছু ছিল না। এটা একটা বড় সরাই ও খামার বাড়ী; এখানে ক্রিশ্চান সায়েণ্টিস্টরা৫৯ তাদের সমিতির বৈঠক বসিয়েছে। যে মহিলাটির মাথায় এই বৈঠকের কল্পনাটা প্রথমে আসে, তিনি গত বসন্তকালে নিউ ইয়র্কে আমাকে এখানে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করেন, তাই এখানে এসেছি। এ জায়গাটি বেশ সুন্দর ও ঠাণ্ডা, তাতে কোন সন্দেহ নাই, আর আমার চিকাগোর অনেক পুরাতন বন্ধু এখানে রয়েছেন। মিসেস মিল‍্স‍্ ও মিস স্টকহ্যামের কথা তোমাদের স্মরণ থাকতে পারে। তাঁরা এবং আর কতকগুলি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা নদীতীরে খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে বাস করছেন। তাঁরা খুব স্ফূর্তিতে আছেন এবং কখনও কখনও তাঁরা সকলেই সারাদিন, যাকে তোমরা বৈজ্ঞানিক পোষাক বল, তাই পরে থাকেন। বক্তৃতা প্রায় প্রত্যহই হয়। বষ্টন থেকে মিঃ কলভিল নামে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। লোকে বলে, তিনি প্রত্যহ ভাবাবিষ্ট হয়ে বক্তৃতা করে থাকেন—‘ইউনিভার্সাল ট্রুথ’-এর সম্পাদিকা, যিনি ‘জিমি মি‌ল্‌স্’ প্রাসাদের উপর তলায় থাকতেন—এখানে এসে বসবাস করছেন। তিনি উপাসনা পরিচালনা করছেন আর মনঃশক্তিবলে সব রকমের ব্যারাম ভাল করবার শিক্ষা দিচ্ছেন—মনে হয়, এঁরা শীঘ্রই অন্ধকে চক্ষুদান এবং এই ধরনের নানা কর্ম সম্পাদন করবেন! মোট কথা, এই সম্মিলনটি এক অদ্ভুত রকমের। এরা সামাজিক বাঁধাবাঁধি নিয়ম বড় গ্রাহ্য করে না—সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ও বেশ আনন্দে আছে। মিসেস মিল‍্স্ বেশ প্রতিভাসম্পন্না, অন্যান্য অনেক মহিলাও তদ্রূপ। … ডেট্রয়েটবাসিনী আর একটি উচ্চশিক্ষিতা মহিলা সমুদ্রতীর থেকে পনর মাইল দূরবর্তী একটি দ্বীপে আমায় নিয়ে যাবেন—আশা করি তথায় আমাদের পরমানন্দে সময় কাটবে। মিস আর্থার স্মিথ এখানে রয়েছেন। মিস গার্নসি সোয়াম‍্স্কট থেকে বাড়ী গেছেন। আমি এখান থেকে এনিস্কোয়াম যেতে পারি বোধ হয়।

এ স্থানটি সুন্দর ও মনোরম—এখানে স্নান করার ভারি সুবিধা। কোরা স্টকহ্যাম আমার জন্য একটি স্নানের পোষাক করে দিয়েছেন—আমিও ঠিক হাঁসের মত জলে নেমে স্নান করে মজা করছি—এমন কি জল-কাদায় যারা বাস করে (যেমন হাঁস-ব্যাঙ) তাদের পক্ষেও বেশ উপভোগ্য।

আর বেশী কিছু লেখবার পাচ্ছি না—আমি এখন এত ব্যস্ত যে, মাদার চার্চকে পৃথক্‌ভাবে লেখবার আমার সময় নেই। মিস হাউ-কে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাবে।

বষ্টনের মিঃ উড্‌ এখানে রয়েছেন—তিনি তোমাদের সম্প্রদায়ের একজন প্রধান পাণ্ডা। তবে ‘হোয়ার্লপুল’ মহোদয়ার৬০ সম্প্রদায়ভুক্ত হতে তাঁর বিশেষ আপত্তি—সেই জন্য তিনি দার্শনিক-রাসায়নিক-ভৌতিক-আধ্যাত্মিক আরও কত কি বিশেষণ দিয়ে নিজেকে একজন মনঃশক্তি-প্রভাবে আরোগ্যকারী বলে পরিচিত করতে চান। কাল এখানে একটা ভয়ানক ঝড় উঠেছিল—তাতে তাঁবুগুলোর উত্তমমধ্যম ‘চিকিৎসা’ হয়ে গেছে। যে বড় তাঁবুর নীচে তাঁদের এইসব বক্তৃতা চলছিল, ঐ ‘চিকিৎসার’ চোটে সেটির এত আধ্যাত্মিকতা বেড়ে উঠেছিল যে, সেটি মর্ত্যলোকের দৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে, আর প্রায় দুশ’ চেয়ার আধ্যাত্মিক ভাবে গদ্‌গদ হয়ে জমির চারিদিকে নৃত্য আরম্ভ করেছিল। মিল‍্‍স্ কোম্পানীর মিসেস ফিগ‍্‍স‍্ প্রত্যহ প্রাতে একটা করে ক্লাস করে থাকেন আর মিসেস মিল‍্স‍্ ব্যস্তসমস্ত হয়ে সমস্ত জায়গাটায় যেন লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন—ওরা সকলেই খুব আনন্দে মেতে আছে। আমি বিশেষতঃ কোরাকে দেখে ভারী খুশী হয়েছি, গত শীত-ঋতুতে ওরা বিশেষ কষ্ট পেয়েছে—একটু আনন্দ করলে ওর পক্ষে ভালই হবে।

তাঁবুতে ওরা যে রকম স্বাধীনভাবে রয়েছে, শুনলে তোমরা বিস্মিত হবে। তবে এরা সকলেই বড় ভাল ও শুদ্ধাত্মা, একটু খেয়ালী—এই যা।

আমি এখানে আগামী শনিবার পর্যন্ত আছি—সুতরাং তোমরা যদি পত্র পাওয়া মাত্র জবাব দাও, তবে এখান থেকে চলে যাবার পূর্বেই পেতে পারি। এখানে একটি যুবক রোজ গান করে—সে পেশাদার; তার ভাবী পত্নী ও বোনের সঙ্গে এখানে আছে; ভাবী পত্নীটি বেশ গাইতে পারে, পরমা সুন্দরী। এই সেদিন রাত্রিতে ছাউনির সকলে একটা পাইন গাছের তলায় শুতে গিয়েছিল—আমি রোজ প্রাতে ঐ গাছতলাটায় হিন্দু ধরনে বসে এদের উপদেশ দিয়ে থাকি। অবশ্য আমিও তাদের সঙ্গে গেছলাম—তারকাখচিত আকাশের নীচে জননী ধরিত্রীর কোলে শুয়ে রাতটা বড় আনন্দেই কেটেছিল—আমি তো এই আনন্দের সবটুকু উপভোগ করেছি।

এক বৎসর হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই রাত্রিটা যে কি আনন্দে কেটেছিল—মাটিতে শোওয়া, বনে গাছতলায় বসে ধ্যান—তা তোমাদের কি বলব! সরাইয়ে যারা রয়েছে তারা অল্পবিস্তর অবস্থাপন্ন, আর তাঁবুর লোকেরা সুস্থ সবল শুদ্ধ অকপট নরনারী। আমি তাদের সকলকে ‘শিবোঽহং’ করতে শেখাই, আর তারা তাই আবৃত্তি করতে থাকে—সকলেই কি সরল ও শুদ্ধ এবং অসীম সাহসী! সুতরাং এদের শিক্ষা দিয়ে আমিও পরম আনন্দ ও গৌরব বোধ করছি। ভগবানকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাকে নিঃস্ব করেছেন; ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তিনি এই তাঁবুবাসীদের দরিদ্র করেছেন। শৌখীন বাবুরা ও শৌখীন মেয়েরা রয়েছেন হোটেলে; কিন্তু তাঁবুবাসীদের স্নায়ুগুলি যেন লোহা দিয়ে বাঁধানো, মন তিন-পুরু ইস্পাতে তৈরী আর আত্মা অগ্নিময়। কাল যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল আর ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে ফেলছিল, তখন এই নির্ভীক বীরহৃদয় ব্যক্তিগণ আত্মার অনন্ত মহিমায় বিশ্বাস দৃঢ় রেখে ঝড়ে যাতে উড়িয়ে না নিয়ে যায়, সেজন্য তাদের তাঁবুর দড়ি ধরে কেমন ঝুলছিল, তা দেখলে তোমাদের হৃদয় প্রশস্ত ও উন্নত হত। আমি এদের জুড়ি দেখতে ৫০ ক্রোশ যেতে প্রস্তুত আছি। প্রভু তাদের আশীর্বাদ করুন। আশা করি, তোমরা তোমাদের সুন্দর পল্লীনিবাসে বেশ আনন্দে আছ। আমার জন্য এক মুহূর্তও ভেব না—আমাকে তিনি দেখবেনই দেখবেন, আর যদি না দেখেন নিশ্চিত জানব, আমার যাবার সময় হয়েছে—আমি আনন্দে চলে যাব।

‘হে মাধব, অনেকে তোমায় অনেক জিনিষ দেয়—আমি গরীব—আমার আর কিছু নেই, কেবল এই শরীর মন ও আত্মা আছে—এইগুলি সব তোমার পাদপদ্মে সমর্পণ করলাম—হে জগদ‍্‍ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, দয়া করে এইগুলি গ্রহণ করতেই হবে—নিতে অস্বীকার করলে চলবে না।’ আমি তাই আমার সর্বস্ব চিরকালের জন্য দিয়েছি। একটা কথা—এরা কতকটা শুষ্ক ধরনের লোক, আর সমগ্র জগতে খুব কম লোকই আছে, যারা শুষ্ক নয়। তারা ‘মাধব’ অর্থাৎ ভগবান্ যে রসস্বরূপ, তা একেবারে বোঝে না। তারা হয় জ্ঞানচচ্চড়ি অথবা ঝাড়ফুঁক করে রোগ আরাম করা, টেবিলে ভূত নাবানো, ডাইনী-বিদ্যা ইত্যাদির পিছনে ছোটে। এ দেশে যত প্রেম, স্বাধীনতা, তেজের কথা শোনা যায়, আর কোথাও তত শুনিনি, কিন্তু এখানকার লোকে এগুলি যত কম বোঝে, তত আর কোথাও নয়। এখানে ঈশ্বরের ধারণা—হয় ‘সভয়ং বজ্রমুদ্যতং’ অথবা রোগ-আরামকারী শক্তিবিশেষ অথবা কোন প্রকার স্পন্দন, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভু এদের মঙ্গল করুন। এরা আবার দিনরাত তোতা পাখীর মত ‘প্রেম প্রেম প্রেম’ করে চেঁচাচ্ছে!

এবার তোমাদের সৎ কল্পনা এবং শুভ চিন্তার সামগ্রী খানিকটা দিচ্ছি। তোমরা সুশীলা ও উন্নতহৃদয়া। এদের মত চৈতন্যকে জড়ের ভূমিতে টেনে না এনে—জড়কে চৈতন্যে পরিণত কর, অন্ততঃ প্রত্যহ একবার করে সেই চৈতন্যরাজ্যের—সেই অনন্ত সৌন্দর্য, শান্তি ও পবিত্রতার রাজ্যের একটু আভাস পাবার এবং দিনরাত সেই ভাবভূমিতে বাস করবার চেষ্টা কর। অস্বাভাবিক অলৌকিক কিছু কখনও খুঁজো না, ওগুলি পায়ের আঙুল দিয়েও যেন স্পর্শ কর না। তোমাদের আত্মা দিবারাত্র অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় তোমাদের হৃদয়সিংহাসনবাসী সেই প্রিয়তমের পাদপদ্মে গিয়ে সংলগ্ন হতে থাকুক, বাকী যা কিছু অর্থাৎ দেহ প্রভৃতি—তাদের যা হবার হোক গে।

জীবনটা ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নমাত্র, যৌবন ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়; দিবারাত্র বল, ‘তুমি আমার পিতা, মাতা, স্বামী, দয়িত, প্রভু, ঈশ্বর—আমি তোমা ছাড়া আর কিছু চাই না, আর কিছুই চাই না, আর কিছুই না। তুমি আমাতে, আমি তোমাতে—আমি তুমি, তুমি আমি।’ ধন চলে যায়, সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যায়, জীবন দ্রুতগতিতে চলে যায়, শক্তি লোপ পেয়ে যায়, কিন্তু প্রভু চিরদিনই থাকেন—প্রেম চিরদিনই থাকে। যদি এই দেহযন্ত্রটাকে ঠিক রাখতে পারায় কিছু গৌরব থাকে, তবে দেহের অসুখের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাতে অসুখের ভাব আসতে না দেওয়া আরও গৌরবের কথা। জড়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখাই—তুমি যে জড় নও তার একমাত্র প্রমাণ।

ঈশ্বরে লেগে থাকো—দেহে বা অন্য কোথাও কি হচ্ছে, কে গ্রাহ্য করে? যখন নানা বিপদ দুঃখ এসে বিভীষিকা দেখাতে থাকে, তখন বল, ‘হে আমার ভগবান্, হে আমার প্রিয়’; যখন মৃত্যুর ভীষণ যাতনা হতে থাকে, তখনও বল, ‘হে আমার ভগবান্‌, হে আমার প্রিয়’; জগতে যত রকম দুঃখ বিপদ আসতে পারে তা এলেও বল, ‘হে ভগবান্, হে আমার প্রিয়, তুমি এইখানেই রয়েছ, তোমাকে আমি দেখছি, তুমি আমার সঙ্গে রয়েছ, তোমাকে আমি অনুভব করছি। আমি তোমার, আমায় টেনে নাও, প্রভু; আমি এই জগতের নই, আমি তোমার—তুমি আমায় ত্যাগ কর না।’ হীরার খনি ছেড়ে কাঁচখণ্ডের অন্বেষণে যেও না। এই জীবনটা একটা মস্ত সুযোগ—তোমরা কি এই সুযোগ অবহেলা করে সংসারের সুখ খুঁজতে যাবে? তিনি সকল আনন্দের প্রস্রবণ—সেই পরম বস্তুর অনুসন্ধান কর, সেই পরম বস্তুই তোমাদের জীবনের লক্ষ্য হোক, তা হলে নিশ্চয়ই সেই পরম বস্তু লাভ করবে। সর্বদা আমার আশীর্বাদ জানবে।

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৮
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
গ্রীনএকার
১১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
এ যাবৎ গ্রীনএকারেই আছি। জায়গাটি বেশ লাগল। সকলেই খুব সহৃদয়। কেনিলওয়ার্থের মিসেস প্র্যাট-নাম্নী চিকাগোবাসিনী মহিলা আমার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়ে পাঁচশত ডলার দিতে চান। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমায় কিন্তু কথা দিতে হয়েছে যে, অর্থের প্রয়োজন হলেই তাঁকে জানাব। আশা করি, ভগবান্ আমাকে সেরূপ অবস্থায় ফেলবেন না। একমাত্র তাঁর সহায়তাই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত। মায়ের বা তোমাদের কোন পত্র আমি পাইনি; কলিকাতা থেকে ফনোগ্রাফটির পৌঁছানো সংবাদও আসেনি।

আমার চিঠিতে যদি পীড়াদায়ক কোন কিছু থাকে, আশা করি তোমরা বুঝতে পারবে যে, সেটা স্নেহের ভাব থেকেই লেখা হয়েছিল। তোমাদের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা-প্রকাশ অনাবশ্যক। ভগবান্ তোমাদিগকে সুখী করুন। তাঁহার অশেষ আশীর্বাদ তোমাদের ও তোমাদের প্রিয়জনের উপর বর্ষিত হোক। তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট আমি চিরঋণী। তোমরা তো তা জানই এবং অনুভব কর। আমি কথায় তা প্রকাশ করতে অক্ষম। রবিবার বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি প্লিমাথে কর্ণেল হিগিনসনের ‘Sympathy of Religions’-এর অধিবেশনে। কোরা স্টকহ্যাম্ গাছতলায় আমাদের দলের ছবি তুলেছিলেন, তারই একটি এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এটা কিন্তু কাঁচা প্রতিলিপিমাত্র, আলোতে অস্পষ্ট হয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল এখন কিছু পাচ্ছি না। অনুগ্রহ করে মিস হাউকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও প্রীতি জানিও। আমার প্রতি তাঁর অশেষ দয়া। বর্তমানে আমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলে সানন্দে জানাব। মনে করছি, মাত্র দু-দিনের জন্য একবার প্লিমাথ থেকে ফিশকিলে যাব। সেখান থেকে তোমাদের আবার পত্র দেব। আশা করি—আশা করি কেন, জানিই তোমরা সুখে আছ, কারণ পবিত্র সজ্জন কখনও অসুখী হয় না। অল্প যে কয় সপ্তাহ এখানে থাকব, আশা করি আনন্দেই কাটবে। আগামী শরৎকালে নিউ ইয়র্কে থাকব। নিউ ইয়র্ক চমৎকার জায়গা। সেখানকার লোকের যে অধ্যবসায়, অন্যান্য নগরবাসিগণের মধ্যে তা দেখা যায় না। মিসেস পটার পামারের এক চিঠি পেয়েছি; অগষ্ট মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য লিখেছেন। মহিলাটি বেশ সহৃদয়, উদার ইত্যাদি। অধিক আর কি? ‘নৈতিক অনুশীলন সমিতি’র (Ethical Culture Society) সভাপতি নিউ ইয়র্কনিবাসী আমার বন্ধু ডাক্তার জেন‍্স্ এখানে রয়েছেন। তিনি বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেছেন। আমি তাঁর বক্তৃতা শুনতে অবশ্য যাব। তাঁর সঙ্গে আমার মতের খুবই ঐক্য আছে। তোমরা চিরসুখী হও।

তোমাদের চিরশুভার্থী ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১০৯
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
এনিস্কোয়াম্
মিসেস ব্যাগলির বাটী
৩১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
মান্দ্রাজীদের পত্রখানি কালকের ‘বষ্টন ট্রান্সক্রিপ্ট্’ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তোমাকে এক কপি পাঠাবার ইচ্ছা আছে। চিকাগোর কোন কাগজে হয়তো দেখে থাকবে। কুক এণ্ড সন্সের অফিসে আমার চিঠিপত্র থাকবে। অন্ততঃ আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে আছি, ঐদিন এখানে বক্তৃতা দেব।

দয়া করে কুকের অফিসে আমার পত্রাদি এসেছে কিনা সন্ধান নিও এবং এলে পর এখানে পাঠিয়ে দিও।

কিছুদিন হল তোমাদের কোন খবর পাইনি। মাদার চার্চকে কাল দুখানি ছবি পাঠিয়েছি। আশা করি তোমাদের ভাল লাগবে। ভারতবর্ষের চিঠিপত্রাদির জন্য আমি বিশেষ উদ্বিগ্ন। সকলকে ভালবাসা।

তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********
পত্র সংখ্যা- ১১০
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩১ অগষ্ট, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র আমি ‘বষ্টন ট্রান্সক্রিপ্ট’-এ মান্দ্রাজের সভার প্রস্তাবগুলি অবলম্বন করে একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ দেখলাম। আমার নিকট ঐ প্রস্তাবগুলির কিছুই পৌঁছায়নি। যদি তোমরা ইতিপূর্বেই পাঠিয়ে থাকো, তবে শীঘ্রই পৌঁছবে। প্রিয় বৎস, এ পর্যন্ত তোমরা অদ্ভুত কর্ম করেছ। কখনও কখনও একটু ঘাবড়ে গিয়ে যা লিখি, তাতে কিছু মনে কর না। মনে করে দেখ, দেশ থেকে ১৫,০০০ মাইল দূরে একলা রয়েছি—গোঁড়া শত্রুভাবাপন্ন খ্রীষ্টানদের সঙ্গে আগাগোড়া লড়াই করে চলতে হয়েছে—এতে কখনও কখনও একটু ঘাবড়ে যেতে হয়। হে বীরহৃদয় বৎস, এইগুলি মনে রেখে কাজ করে যাও। বোধ হয় ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে শুনেছ, জি. জি.-র কাছ থেকে একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছিলাম। এমন করে ঠিকানাটা লিখেছিল যে, আমি মোটেই বুঝতে পারিনি। তাইতে তার কাছে সাক্ষাৎভাবে জবাব দিতে পারিনি। তবে সে যা যা চেয়েছিল, আমি সব করেছি—আমার ফটোগ্রাফগুলি পাঠিয়েছি ও মহীশূরের রাজাকে পত্র লিখেছি। আমি খেতড়ির রাজাকে একটা ফনোগ্রাফ পাঠিয়েছি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্তিস্বীকার-পত্র এখনও পাইনি। খবরটা নিও তো। আমি কুক এণ্ড সন্স, র‍্যামপার্ট রো, বোম্বাই ঠিকানায় তা পাঠিয়েছি। ঐ সম্বন্ধে সব খবর জিজ্ঞাসা করে রাজাকে একখানা পত্র লিখো। ৮ই জুন তারিখে লেখা রাজার একখানা পত্র পেয়েছি। যদি ঐ তারিখের পর কিছু লিখে থাকেন, তা এখনও পাইনি।

আমার সম্বন্ধে ভারতের কাগজে যা কিছু বেরোবে সেই কাগজখানাই আমায় পাঠাবে। আমি কাগজটাতেই তা পড়তে চাই—বুঝলে? চারুচন্দ্রবাবু, যিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয় ব্যবহার করেছেন, তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখবে। তাঁকে আমার হৃদয়ের ধন্যবাদ জানাবে, কিন্তু—(চুপি চুপি বলছি) দুঃখের বিষয় তাঁর কথা আমার কিছু মনে পড়ছে না। তুমি তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আমায় জানাবে কি? থিওসফিষ্টরা এখন আমায় পছন্দ করছে বটে, কিন্তু এখানে তাদের সংখ্যা সর্বসুদ্ধ ৬৫০ জন মাত্র। তারপর ক্রিশ্চান সায়েণ্টিস্টরা আছেন, তাঁরা সকলেই আমায় পছন্দ করেন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ হবে। আমি উভয় দলের সঙ্গেই কাজ করি বটে, কিন্তু কারও দলে যোগ দিই না, আর ভগবৎকৃপায় উভয় দলকেই ঠিক পথে গড়ে তুলব, কারণ তারা কতকগুলো আধা-উপলব্ধ সত্য কপচাচ্ছে বৈ তো নয়।

এই পত্র তোমার কাছে পৌঁছবার পূর্বেই আশা করি নরসিংহ টাকাকড়ি ইত্যাদি সব পাবে।

আমি ‘ক্যাটের’ কাছ থেকে এক পত্র পেলাম, কিন্তু তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একখানা বই লিখতে হয়, সুতরাং তোমার এই পত্রের মধ্যেই তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছি, আর তোমায় স্মরণ করিয়ে দিতে বলছি যে, আমাদের উভয়ের মতামত বিভিন্ন হলেও তাতে কিছু এসে যাবে না—সে একটা বিষয় একভাবে দেখছে, আমি না হয় আর একভাবে দেখছি, এই এক জিনিষকে বিভিন্নভাবে দেখা স্বীকার করে নিলেই তো আমাদের উভয়ের ভাবের এক রকম সমন্বয় হল। সুতরাং বিশ্বাস সে যাই করুক, তাতে কিছু এসে যায় না—কাজ করুক।

বালাজী, জি. জি., কিডি, ডাক্তার ও আমাদের সব বন্ধুকে আমার ভালবাসা জানাবে, আর যে-সকল স্বদেশহিতৈষী মহাত্মা তাঁদের দেশের জন্য মতবিভিন্নতা গ্রাহ্য না করে সাহসের ও মহৎ অন্তঃকরণের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদেরও আমার হৃদয়ের অগাধ ভালবাসা জানাবে।

একটি ছোটখাট সমিতি প্রতিষ্ঠা কর, তার মুখপত্রস্বরূপ একখানা সাময়িক পত্র বার কর—তুমি তার সম্পাদক হও। কাগজটা বার করবার ও কাজটা আরম্ভ করে দেবার জন্য খুব কমপক্ষে কত খরচা পড়ে, হিসেব করে আমায় জানাবে, আর সমিতিটার নাম ও ঠিকানা জানাবে। আমি তা হলে তার জন্যে টাকা পাঠাব—শুধু তাই নয়, আমেরিকার আরও অনেককে ধরে তাঁরা যাতে বছরে মোটা চাঁদা দেন, তা করব। কলিকাতায়ও ঐ রকম করতে বল। আমাকে ব—র ঠিকানা পাঠাবে। সে বেশ ভাল ও মহৎ লোক। সে আমাদের সঙ্গে মিশে বেশ সুন্দর কাজ করবে।

তোমাকে সমস্ত জিনিষটার ভার নিতে হবে, সর্দার হিসাবে নয়, সেবকভাবে—বুঝলে? এতটুকু কর্তৃত্বের ভাব দেখালে লোকের মনে ঈর্ষার ভাব জেগে উঠবে—তাতে সব মাটি হয়ে যাবে। যে যা বলে, তাইতে সায় দিয়ে যাও; কেবল চেষ্টা কর—আমার সব বন্ধুদের একসঙ্গে জড়ো করে রাখতে। বুঝলে? আর আস্তে আস্তে কাজ করে তার উন্নতির চেষ্টা কর। জি.জি. ও অন্যান্য যাদের এখনই রোজগার করবার প্রয়োজন নেই, তারা এখন যেমন করছে তেমনি করে যাক অর্থাৎ চারিদিকে ভাব ছড়াক। জি.জি. মহীশূরে বেশ কাজ করছে। এই রকমই তো করতে হবে। মহীশূর কালে আমাদের একটা বড় আড্ডা হয়ে দাঁড়াবে।

আমি এখন আমার ভাবগুলি পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করব ভাবছি—তারপর আগামী শীতে সারা দেশটা ঘুরে সমিতি স্থাপন করব। এ একটা মস্ত কার্যক্ষেত্র, আর এখানে যত কাজ হতে থাকবে, ততই ইংলণ্ড এই ভাব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। হে বীরহৃদয় বৎস, এতদিন পর্যন্ত বেশ কাজ করেছ। প্রভু তোমাদের ভেতর সব শক্তি দিবেন।

আমার হাতে এখন ৯০০০৲ টাকা আছে—তার কতকটা ভারতের কাজ আরম্ভ করে দেবার জন্য পাঠাব, আর এখানে অনেককে ধরে তাদের দিয়ে বাৎসরিক ও ষাণ্মাসিক বা মাসিক হিসাবে টাকাকড়ি পাঠাবার বন্দোবস্ত করব। এখন তুমি সমিতিটা খুলে ফেল ও কাগজটা বের করে দাও এবং আর আর আনুষঙ্গিক বা আবশ্যক, তার তোড়জোড় কর। এ ব্যাপারটা খুব অল্প লোকের ভেতর গোপন রেখো; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মান্দ্রাজে একটা মন্দির করবার জন্য মহীশূর ও অন্যান্য স্থান থেকে টাকা তোলবার চেষ্টা কর—তাতে একটা পুস্তকালয় থাকবে, অফিস ও ধর্মপ্রচারকদের অর্থাৎ যদি কোন সন্ন্যাসী বা বৈরাগী এসে পড়ে, তাদের জন্য কয়েকটা ঘর থাকবে। এইরূপে আমরা ধীরে ধীরে কাজে অগ্রসর হব।

সদা স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুঃ—তুমি তো জান টাকা রাখা—এমন কি, টাকা ছোঁয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে বড় মুশকিল। উহা আমার পক্ষে বেজায় বিরক্তিকর আর ওতে মনকে বড় নীচু করে দেয়। সেই কারণে কাজের দিকটা এবং টাকাকড়ি-সংক্রান্ত ব্যাপারটার বন্দোবস্ত করবার জন্য তোমাদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একটা সমিতি স্থাপন করতেই হবে। এখানে আমার যে-সব বন্ধু আছেন, তাঁরাই আমার সব টাকাকড়ির বন্দোবস্ত করে থাকেন—বুঝলে? এই ভয়ানক টাকাকড়ির হাঙ্গামা থেকে রেহাই পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। সুতরাং যত শীঘ্র তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পার এবং তুমি সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হয়ে আমার বন্ধু ও সহায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে পত্রাদি ব্যবহার করতে পার, ততই তোমাদের ও আমার—উভয় পক্ষের মঙ্গল। এইটি শীগগির করে ফেলে আমাকে লেখো। সমিতির একটা অসাম্প্রদায়িক নাম দিও—আমার মনে হচ্ছে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামটা হলে মন্দ হয় না। ঐ নামটা দিলে তাতে হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদেরও আমাদের দিকে আকৃষ্ট করবে। ‘প্রবুদ্ধ’ শব্দটার ধ্বনিতেই (‘প্র+বুদ্ধ’) ‘বুদ্ধের’ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে ‘ভারত’ জুড়লে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন বোঝাতে পারে। যাই হোক, আমাদের সকল বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ কর—তাঁরা যা ভাল বিবেচনা করেন।

মঠে আমার গুরুভাইদেরও এইরূপে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজকর্ম করতে বলবে, তবে টাকাকড়ির কাজ সব তোমাকেই করতে হবে। তাঁরা সন্ন্যাসী, তাঁরা টাকাকড়ি ঘাঁটা পছন্দ করবেন না। আলাসিঙ্গা, জেনে রেখো ভবিষ্যতে তোমায় অনেক বড় বড় কাজ করতে হবে। অথবা তুমি যদি ভাল বোঝ, কতকগুলি বড়লোককে ধরে তাদের রাজী করিয়ে সমিতির কর্মকর্তারূপে তাদের নাম প্রকাশ করবে। আসল কাজ করতে হবে তোমাকে—তাদের নামে অনেক কাজ হবে। তোমার যদি সাংসারিক কাজকর্ম খুব বেশী থাকে এবং তার দরুন যদি এ-সব করবার তোমার সময় না থাকে, তবে জি. জি. সমিতির এই বৈষয়িক দিকটার ভার নিক—আর আমি আশা করি, পেট চালাবার জন্যে যাতে কলেজের কাজের ওপর তোমায় নির্ভর না করতে হয়, তার চেষ্টা করব। তা হলে তুমি নিজে উপোস না করে আর পরিবারদের উপোস না করিয়ে সর্বান্তঃকরণে এই কাজে নিযুক্ত হতে পারবে। কাজে লাগো, বৎস, কাজে লাগো। কাজের কঠিন ভাগটা অনেকটা সিধে হয়ে এসেছে। এখন প্রতি বৎসর কাজ গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে। আর তোমরা যদি কোনরকমে কাজটা চালিয়ে যেতে পার, তাহলে আমি ভারতে ফিরে গেলে কাজের দ্রুত উন্নতি হতে থাকবে। তোমরা যে এতদূর করেছ, এই ভেবে খুব আনন্দ কর। যখন মনে নিরাশ ভাব আসবে, তখন ভেবে দেখো, এক বছরের ভেতর কত কাজ হয়েছে। আমরা নগণ্য অবস্থা থেকে উঠেছি—এখন সমগ্র জগৎ আমাদের দিকে আশায় চেয়ে রয়েছে। শুধু ভারত নয়, সমগ্র জগৎ আমাদের কাছ থেকে বড় বড় জিনিষ আশা করছে। নির্বোধ মিশনরীরা, ম— ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ কেহই সত্য, প্রেম ও অকপটতার শক্তিকে বাধা দিতে পারবে না। তোমাদের কি মন মুখ এক হয়েছে? তোমরা কি মৃত্যুভয় পর্যন্ত তুচ্ছ করে নিঃস্বার্থভাবে থাকতে পার? তোমাদের হৃদয়ে প্রেম আছে তো? যদি এইগুলি তোমাদের থাকে, তবে তোমাদের কোন কিছুকে—এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত ভয় করবার দরকার নেই। এগিয়ে যাও, বৎসগণ। সমগ্র জগৎ জ্ঞানালোক চাইছে—উৎসুক নয়নে তার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেবল ভারতেই সে জ্ঞানালোক আছে—ইন্দ্রজাল, মূক অভিনয় বা বুজরুকিতে নয়, আছে প্রকৃত ধর্মের মর্মকথায়, উচ্চতম আধ্যাত্মিক সত্যের মহিমময় উপদেশে। জগৎকে সেই শিক্ষার ভাগী করবার জন্যই প্রভু এই জাতটাকে নানা দুঃখদুর্বিপাকের মধ্যে দিয়েও আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন সময় হয়েছে। হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। কুকুরের ‘ঘেউ ঘেউ’ ডাকে ভয় পেও না—এমন কি আকাশ থেকে প্রবল বজ্রাঘাত হলেও ভয় পেও না—খাড়া হয়ে ওঠ, ওঠ, কাজ কর।

তোমাদের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (১১১-১২০)

পত্র সংখ্যা (১১১-১২০)

পত্র সংখ্যা- ১১১
[মিঃ ল্যাণ্ডস্‌বার্গকে৬১ লিখিত]
বেল ভিউ হোটেল, বষ্টন
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

অভিন্নহৃদয়েষু,
তুমি কিছু মনে করিও না, গুরু হিসাবে তোমাকে উপদেশ দিবার অধিকার আমার আছে বলিয়াই আমি জোর করিয়া বলিতেছি যে, তুমি নিজের ব্যবহারের জন্য কিছু বস্ত্রাদি অবশ্য ক্রয় করিবে, কারণ এগুলির অভাব এদেশে কোন কাজ করার পক্ষে তোমার প্রতিবন্ধকস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইবে। একবার কাজ শুরু হইয়া গেলে অবশ্য তুমি ইচ্ছামত পোষাক পরিধান করিতে পার, তাহাতে কেহ কোন আপত্তি করিবে না।

আমাকে ধন্যবাদ দিবার কোন প্রয়োজন নাই, কারণ ইহা আমার কর্তব্যমাত্র। হিন্দু আইন অনুসারে শিষ্যই সন্ন্যাসীর উত্তরাধিকারী, যদি সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে তাহার কোন পুত্রও জন্মিয়া থাকে, তথাপি সে উত্তরাধিকারী নহে। এ সম্বন্ধ খাঁটি আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ—ইয়াঙ্কির ‘অভিভাবকগিরি’ ব্যবসা নহে, বুঝিতেই পারিতেছ।

তোমার সাফল্যের জন্য প্রার্থনা ও আশীর্বাদ করি। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১২
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ
বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনী,
আজ সকালে তোমার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি পেলাম। প্রায় সপ্তাহখানেক হল এই হোটেলে আছি। আরও কিছুকাল বষ্টনে থাকব। গাউন তো এতগুলো রয়েছে, সেগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। এনিস্কোয়ামে যখন খুব ভিজে যাই, তখন পরনে ছিল সেই ভাল কালো পোষাক—যেটি তোমার খুব পছন্দ। মনে হয়, এটি আর নষ্ট হচ্ছে না; আমার নির্গুণ ব্রহ্মধ্যান এর ভিতরেও প্রবিষ্ট হয়েছে! গ্রীষ্মকাল খুব আনন্দে কাটিয়েছ জেনে বিশেষ খুশী হলাম। আমি তো ভবঘুরের মত ঘুরেই বেড়াচ্ছি। এবহিউ-লিখিত তিব্বতদেশীয় ভবঘুরে লামাদের বর্ণনা সম্প্রতি পড়ে খুব আমোদ পেলাম—আমাদের সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়ের যথার্থ চিত্র। লেখক বলেন এরা অদ্ভুত লোক, খুশীমত এসে হাজির হয়, যার সঙ্গে হোক, খায়—নিমন্ত্রিত বা অনিমন্ত্রিত। যেখানে খুশী থাকবে, যেখানে খুশী চলে যাবে। এমন পাহাড় নেই যা তারা আরোহণ করেনি, এমন নদী নেই যা তারা অতিক্রম করেনি। তাদের অবিদিত কোন জাতি নেই, অকথিত কোন ভাষা নাই। লেখকের অভিমত, যে শক্তিবশে গ্রহগুলি সদা ঘূর্ণায়মান তারই কিয়দংশ ভগবান্ এদের দিয়ে থাকবেন। আজ এই ভবঘুরে লামাটি লেখবার আগ্রহ দ্বারা আবিষ্ট হয়ে সোজা একটি দোকানে গিয়ে লেখবার যাবতীয় উপকরণ সহ বোতাম-লাগানো কাঠের ছোট দোয়াত সমেত একটি পোর্টফোলিও কিনে এনেছে। শুভ সঙ্কল্প। মনে হয়, গত মাসে ভারত হতে প্রচুর চিঠিপত্র এসেছে। আমার দেশবাসিগণ আমার কাজের এরূপ তারিফ করায় খুব খুশী হলাম। তারা যথেষ্ট করেছে। আর কিছু তো লেখবার দেখতে পাচ্ছি না। অধ্যাপক রাইট, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা খুব খাতির যত্ন করেছিলেন, সর্বদা যেমন করে থাকেন। ভাষায় তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারছি না। এ পর্যন্ত সবই ভাল যাচ্ছে। তবে একটু বিশ্রী সর্দি হয়েছিল। এখন প্রায় নেই। অনিদ্রার জন্য ক্রিশ্চান সায়েন্স অনুসরণ করে বেশ ফল পেয়েছি। তোমরা সুখী হও। ইতি

চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুঃ—মাকে জানিও, এখন আর কোট চাই না।

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৩
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ
বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
মা সারা,
আমি তোমাকে মোটেই ভুলে যাইনি। তুমি কি মনে কর, আমি কখনও এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারি? তুমি আমাকে তোমার ঠিকানা দাওনি, তবু মিস ফিলিপ্‌স্ ল্যাণ্ডসবার্গকে প্রেরিত সংবাদ থেকে তোমার খবর পাচ্ছি। বোধ হয় মান্দ্রাজ থেকে আমায় যে অভিনন্দন পাঠিয়েছে, তা তুমি দেখেছ। আমি তোমাকে পাঠাবার জন্য খানকতক পাঠাচ্ছি ল্যাণ্ডসবার্গের কাছে।

হিন্দু সন্তান কখনও মাকে টাকা ধার দেয় না, সন্তানের ওপর মায়ের সর্ববিধ অধিকার আছে, সন্তানেরও মায়ের ওপর। সেই তুচ্ছ ডলার কটি আমাকে ফিরিয়ে দেবার কথা বলাতে তোমার ওপর আমার বড় রাগ হয়েছে। তোমার ধার আমি কোন কালে শুধতে পারব না।

এখন আমি বষ্টনের কয়েক জায়গায় বক্তৃতা দিচ্ছি। এখন চাই এমন একটা জায়গা, যেখানে বসে আমার ভাবরাশি লিপিবদ্ধ করতে পারি। বক্তৃতা যথেষ্ট হল, এখন আমি লিখতে চাই। আমার বোধ হয়, তার জন্য আমাকে নিউ ইয়র্কে যেতে হবে। মিসেস গার্নিস আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করেছিলেন এবং তিনি সদাই আমায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক। আমি মনে করছি, তাঁর ওখানে গিয়ে বসে বসে বই লিখব।

তোমার সদা স্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৪
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… আমি ক্রমাগত এক স্থান থেকে অপর স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সর্বদা কাজ করছি, বক্তৃতা দিচ্ছি, ক্লাস করছি এবং লোককে নানা রকমে বেদান্ত শিক্ষা দিচ্ছি।

আমি যে বই লেখবার সঙ্কল্প করেছিলাম, এখনও তার এক পঙ‍্ক্তি লিখতে পারিনি। সম্ভবতঃ পরে এ কাজ হাতে নিতে পারব। এখানে উদার মতাবলম্বীদের মধ্যে আমি কতকগুলি পরম বন্ধু পেয়েছি, গোঁড়া খ্রীষ্টানদের মধ্যেও কয়েক জনকে পেয়েছি, আশা করি, শীঘ্রই ভারতে ফিরব। এ দেশ তো যথেষ্ট ঘাঁটা হল, বিশেষতঃ অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। সাধারণের সমক্ষে বিস্তর বক্তৃতা করায় এবং একস্থানে স্থিরভাবে না থেকে ক্রমাগত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সেখানে ঘোরার দরুন এই দুর্বলতা এসেছে। … সুতরাং বুঝছ আমি শীঘ্রই ফিরছি। কতকগুলি লোকের আমি খুব প্রিয় হয়ে উঠেছি, আর তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে; তারা অবশ্যই চাইবে, আমি বরাবর এখানে থেকে যাই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে—খবরের কাগজে নাম বেরনো এবং সর্বসাধারণের ভেতর কাজ করার দরুন ভুয়ো লোকমান্য তো যথেষ্ট হল—আর কেন? আমার ও-সবের একদম ইচ্ছা নেই।

… কোন দেশের অধিকাংশ লোকই কখনও কেবল সহানুভূতিবশে লোকের উপকার করে না। খ্রীষ্টানদের দেশে কতকগুলি লোক যে সৎকার্যে অর্থব্যয় করে, অনেক সময়ে তার ভেতর কোন মতলব থাকে, কিম্বা নরকের ভয়ে ঐরূপ করে থাকে। আমাদের বাঙলাদেশে যেমন চলিত কথায় বলে, ‘জুতো মেরে গরু দান।’ এখানে সেই রকম দানই বেশী! সর্বত্র তাই। আবার আমাদের জাতের তুলনায় পাশ্চাত্যেরা অধিকতর কৃপণ। আমি অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি যে, এশিয়াবাসীরা জগতের সকল জাতের চেয়ে বেশী দানশীল জাত, তবে তারা যে বড় গরীব।

কয়েক মাস আমি নিউ ইয়র্কে বাস করবার জন্য যাচ্ছি। ঐ শহরটি সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের যেন মাথা, হাত ও ধনভাণ্ডারস্বরূপ; অবশ্য বোষ্টনকে ‘ব্রাহ্মণের শহর’ (বিদ্যাচর্চাবহুল স্থান) বলে বটে। আমেরিকায় হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার প্রতি সহানুভূতি করে থাকে। … নিউ ইয়র্কের লোকগুলির খুব খোলা মন। সেখানে আমার কতকগুলি বিশিষ্ট গণ্যমান্য বন্ধু আছেন। দেখি, সেখানে কি করতে পারা যায়। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এই বক্তৃতা-ব্যবসায়ে আমি দিন দিন বিরক্ত হয়ে পড়ছি। পাশ্চাত্যদেশের লোকের পক্ষে ধর্মের উচ্চাদর্শ বুঝতে এখনও বহুদিন লাগবে। টাকাই হল এদের সর্বস্ব। যদি কোন ধর্মে টাকা হয়, রোগ সেরে যায়, রূপ হয়, দীর্ঘ জীবনলাভের আশা হয়, তবেই সকলে সেই ধর্মের দিকে ঝুঁকবে, নতুবা নয়। … বালাজী, জি. জি এবং আমাদের বন্ধুবর্গের সকলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে।

তোমাদের প্রতি চিরপ্রেমসম্পন্ন
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৫
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

প্রিয় কিডি,
তোমার এত শীঘ্র সংসারত্যাগের সংকল্প শুনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম। ফল পাকলে আপনি গাছ থেকে পড়ে যায়; অতএব সময়ের অপেক্ষা কর; তাড়াতাড়ি করো না। বিশেষ, কোন আহাম্মকি কাজ করে অপরকে কষ্ট দেবার অধিকার কারও নেই। সবুর কর, ধৈর্য ধরে থাক, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।

বালাজী, জি. জি. ও আমাদের অপর সকল বন্ধুকে আমার বিশেষ ভালবাসা জানাবে। তুমিও অনন্তকালের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।

আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৬
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

নিউ ইয়র্ক
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

কল্যাণবরেষু,
তোমাদের কয়েকখানা পত্র পাইলাম। শশী প্রভৃতি যে ধূমক্ষেত্র মাচাচ্চে, এতে আমি বড়ই খুশী। ধূমক্ষেত্র মাচাতে হবে, এর কম চলবে না। কুছ পরোয়া নেই। দুনিয়াময় ধূমক্ষেত্র মোচে যাবে, ‘বাহ গুরুকা ফতে!’ আরে দাদা ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ (ভাল কাজে অনেক বিঘ্ন হয়), ঐ বিঘ্নের গুঁতোয় বড়লোক তৈরী হয়ে যায়। চারু কে, এখন বুঝতে পেরেছি; তাকে আমি ছেলেমানুষ দেখে এসেছি কিনা, তাই ঠাওরে উঠতে পারিনি। তাকে আমার অনেক আশীর্বাদ। বলি মোহন, মিশনরী-ফিশনরীর কর্ম কি এ ধাক্কা সামলায়? এখন মিশনরীর ঘরে বাঘ সেঁধিয়েছে। এখানকার দিগ‍্‍গজ দিগ‍্‍গজ পাদ্রীতে ঢের চেষ্টা-বেষ্টা করলে—এ গিরিগোবর্ধন টলাবার যো কি। মোগল পাঠান হদ্দ হল, এখন কি তাঁতীর কর্ম ফার্সি পড়া? ও সব চলবে না ভায়া, কিছু চিন্তা করো না। সকল কাজেই একদল বাহবা দেবে, আর একদল দুষমনাই করবে। আপনার কার্য করে চলে যাও—কারুর কথার জবাব দেবার আবশ্যক কি? ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং, সত্যেনৈব পন্থা বিততো দেবযানঃ।’১গুরুপ্রসন্নবাবুকে এক পত্র লিখিতেছি। টাকার ভাবনা নাই, মোহন। সব হবে ধীরে ধীরে।

এ দেশে গরমীর দিনে সকলে দরিয়ার কিনারায় যায়—আমিও গিয়েছিলাম, অবশ্য পরের স্কন্ধে। এদের নৌকা আর জাহাজ চালাবার বড়ই বাতিক। ইয়াট বলে ছোট ছোট জাহাজ ছেলে-বুড়ো যার পয়সা আছে, তারই একটা আছে। তাইতে পাল তুলে দরিয়ায় যায় আর ঘরে আসে, খায় দায়—নাচে কোঁদে—গান বাজনা তো দিবারাত্র। পিয়ানোর জ্বালায় ঘরে তিষ্ঠাবার যো নাই।

ঐ যে G. W. Hale (হেল)-এর ঠিকানায় চিঠি দাও, তাদের কথা কিছু বলি। হেল আর তার স্ত্রী, বুড়ো-বুড়ী। আর দুই মেয়ে, দুই ভাইঝি, এক ছেলে। ছেলে রোজগার করতে দোসরা জায়গায় থাকে। মেয়েরা ঘরে থাকে। এদের দেশে মেয়ের সম্বন্ধেই সম্বন্ধ। ছেলে বে করে পর হয়ে যায়—মেয়ের স্বামী ঘন ঘন স্ত্রীর বাপের বাড়ী যায়। এরা বলে—

‘Son is son till he gets a wife
The daughter is daughter all her life.’২

চারজনেই যুবতী—বে থা করেনি। বে হওয়া এদেশে বড়ই হাঙ্গাম। প্রথম মনের মত বর চাই। দ্বিতীয় পয়সা চাই। ছোঁড়া বেটারা ইয়ারকি দিতে বড়ই মজবুত—ধরা দেবার বেলা পগার পার। ছুঁড়ীরা নেচে কুঁদে একটা স্বামী যোগাড় করে, ছোঁড়া বেটারা ফাঁদে পা দিতে বড়ই নারাজ। এই রকম করতে করতে একটা ‘লভ্’ হয়ে পড়ে—তখন সাদি হয়। এই হল সাধারণ—তবে হেলের মেয়েরা রূপসী, বড়মানষের ঝি, ইউনিভার্সিটি ‘গার্ল’ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)—নাচতে গাইতে পিয়ানো বাজাতে অদ্বিতীয়া—অনেক ছোঁড়া ফেঁ ফেঁ করে—তাদের বড় পসন্দয় আসে না। তারা বোধ হয় বে থা করবে না—তার উপর আমার সংস্রবে ঘোর বৈরিগ্যি উপস্থিত। তারা এখন ব্রহ্মচিন্তায় ব্যস্ত।

মেরী আর হ্যারিয়েট হল মেয়ে, আর এক হ্যারিয়েট আর ইসাবেল হল ভাইঝি। মেয়ে দুইটির চুল সোনালী অর্থাৎ [তারা] ব্লণ্ড, আর ভাইঝি দুটি brunette [ব্রানেট] অর্থাৎ কালো চুল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—এরা সব জানে। ভাইঝিদের তত পয়সা নেই—তারা একটা Kindergarten School (কিণ্ডারগার্টেন স্কুল) করে, মেয়েরা কিছু রোজগার করে না। এদের দেশের অনেক মেয়ে রোজগার করে। কেউ কারুর উপর নির্ভর করে না। ক্রোড়পতির ছেলেও রোজগার করে, তবে বে করে, আর আপনার বাড়ী ভাড়া করে থাকে। মেয়েরা আমাকে দাদা বলে, আমি তাদের মাকে মা বলি। আমার মালপত্র সব তাদের বাড়ীতে—আমি যেখানেই কেন যাই না। তারা সব ঠিকানা করে। এদেশের ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই রোজগার করতে যায়, আর মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেখে—তাইতে করে একটা সভায় দেখবে যে 90 per cent. (শতকরা ৯০ জন) মেয়ে। ছোঁড়ারা তাদের কাছে কলকেও পায় না।

এদেশে ভূতুড়ে অনেক। মিডিয়ম (Medium) হল যে ভূত আনে। মিডিয়ম একটা পর্দার আড়ালে যায়, আর পর্দার ভেতর থেকে ভূত বেরুতে আরম্ভ করে—বড় ছোট, হর-রঙের। আমি গোটাকতক দেখলাম বটে, কিন্তু ঠকবাজি বলেই বোধ হল। আর গোটাকতক দেখে তবে ঠিক সিদ্ধান্ত করব। ভূতুড়েরা অনেকে আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে।

দোসরা হচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স—এরাই হচ্চে আজকালকার বড় দল—সর্ব ঘটে। বড়ই ছড়াচ্ছে—গোঁড়া বেটাদের বুকে শেল বিঁধছে। এরা হচ্চে বেদান্তী অর্থাৎ গোটাকতক অদ্বৈতবাদের মত যোগাড় করে তাকে বাইবেলের মধ্যে ঢুকিয়েছে আর ‘সোঽহং সোঽহং’ বলে রোগ ভাল করে দেয়—মনের জোরে। এরা সকলেই আমাকে বড় খাতির করে।

আজকাল গোঁড়া বেটাদের ত্রাহি-ত্রাহি এদেশে। Devil worship৩ আর বড় একখানা চলছে না। আমাকে বেটারা যমের মত দেখে। বলে, কোথা থেকে এ বেটা এল, রাজ্যির মেয়ে-মদ্দ ওর পিছু পিছু ফেরে—গোঁড়ামির জড় মারবার যোগাড়ে আছে। আগুন ধরে গেছে বাবা! গুরুর কৃপায় যে আগুন ধরে গেছে, তা নিববার নয়। কালে গোঁড়াদের দম নিকলে যাবে। কি বাঘ ঘরে ঢুকিয়েছেন, তা বাছাধনেরা টের পাচ্ছেন। থিওসফিষ্টদের জোর বড় একটা নাই। তবে তারাও গোঁড়াদের খুব পিছু লেগে আছে।

এই ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স ঠিক আমাদের কর্তাভজা। বল ‘রোগ নেই’—বস্, ভাল হয়ে গেল, আর বল্ ‘সোঽহং’, বস্—ছুটি, চরে খাওগে। দেশ ঘোর materialist (জড়বাদী)। এই ক্রিশ্চিয়ান দেশের লোক—ব্যামো ভাল কর, আজগুবি কর; পয়সার রাস্তা হয়, তবে ধর্ম মানে—অন্য কিছু বড় বোঝে না। তবে কেউ কেউ বেশ আছে। যত বেটা দুষ্টু বজ্জাত, ঠক-জোচ্চোর মিশনরীরা তাদের ঘাড় ভাঙে আর তাদের পাপ মোচন করে। … এরা আমাতে এক নূতন ডৌলের মানুষ দেখেছে। গোঁড়া বেটাদের পর্যন্ত আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে, আর এখন সকলে বড়ই ভক্তি করছে—বাবা ব্রহ্মচর্যের চেয়ে কি আর বল আছে?

আমি এখন মান্দ্রাজীদের Address (অভিনন্দন), যা এখানকার সব কাগজে ছেপে ধূমক্ষেত্র মোচে গিয়েছিল, তারই জবাব লিখতে ব্যস্ত। যদি সস্তা হয় তো ছাপিয়ে পাঠাব, যদি মাগগি হয় তো type-writing (টাইপ) করে পাঠিয়ে দেব। তোমাদেরও এক কপি পাঠাব—‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ ছাপিয়ে দিও।

এদেশের অবিবাহিত মেয়েরা বড়ই ভাল, তারা ভয় ডর করে। … এরা হল বিরোচনের জাত। শরীর হল এদের ধর্ম, তাই মাজা, তাই ঘষা—তাই নিয়ে আছে। নখ কাটবার হাজার যন্ত্র, চুল কাটবার দশ হাজার, আর কাপড়-পোষাক গন্ধ-মসলার ঠিক-ঠিকানা কি! … এরা ভাল মানুষ, দয়াবান্ সত্যবাদী। সব ভাল, কিন্তু ঐ যে ‘ভোগ’, ঐ ওদের ভগবান্—টাকার নদী, রূপের তরঙ্গ, বিদ্যার ঢেউ, বিলাসের ছড়াছড়ি।

কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা॥—গীতা, ৪।১২

অদ্ভুত তেজ আর বলের বিকাশ—কি জোর, কি কার্যকুশলতা, কি ওজস্বিতা! হাতীর মত ঘোড়া—বড় বড় বাড়ীর মত গাড়ী টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এইখান থেকেই শুরু ঐ ডৌল সব। মহাশক্তির বিকাশ—এরা বামাচারী। তারই সিদ্ধি এখানে, আর কি! যাক—এদের মেয়ে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম বাবা! আমাকে যেন বাচ্ছাটির মত ঘাটে-মাঠে দোকান-হাটে নিয়ে যায়। সব কাজ করে—আমি তার সিকিও করতে পারিনি। এরা রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, আমি এদের পুষ্যিপুত্তুর, এরা সাক্ষাৎ জগদম্বা; বাবা! এদের পূজা করলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। আরে রাম বল, আমরা কি মানুষের মধ্যে? এই রকম মা জগদম্বা যদি ১০০০ আমাদের দেশে তৈরী করে মরতে পারি, তবে নিশ্চিত হয়ে মরব। তবে তোদের দেশের লোক মানুষের মধ্যে হবে। তোদের পুরুষগুলো এদের মেয়েদের কাছে ঘেঁষবার যুগ্যি নয়—তোদের মেয়েদের কথাই বা কি! হরে হরে, আরে বাবা, কি মহাপাপী! ১০ বৎসরের মেয়ের বর যুগিয়ে দেয়। হে প্রভু, হে প্রভু! কিমধিকমিতি—

আমি এদের এই আশ্চর্যি মেয়ে দেখি। একি মা জগদম্বার কৃপা! একি মেয়ে রে বাবা! মদ্দগুলোকে কোণে ঠেলে দেবার যোগাড় করেছে। মদ্দগুলো হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছে। মা তোরই কৃপা। গোলাপ-মা যা করেছে, তাতে আমি বড়ই খুশী। গোলাপ-মা বা গৌর-মা তাদের মন্ত্র দিয়ে দিক্ না কেন? মেয়ে-পুরুষের ভেদটার জড় মেরে তবে ছাড়ব। আত্মাতে কি লিঙ্গভেদ আছে নাকি? দূর কর মেয়ে আর মদ্দ, সব আত্মা। শরীরাভিমান ছেড়ে দাঁড়া। বলো ‘অস্তি অস্তি’; ‘নাস্তি নাস্তি’ করে দেশটা গেল! সোঽহং সোঽহং শিবোঽহং। কি উৎপাত! প্রত্যেক আত্মাতে অনন্ত শক্তি আছে; ওরে হতভাগাগুলো, নেই নেই বলে কি কুকুর বেড়াল হয়ে যাবি নাকি? কিসের নেই? কার নেই? শিবোঽহং শিবোঽহং। নেই নেই শুনলে আমার মাথায় যেন বজ্র মারে। রাম রাম, গরু তাড়াতে তাড়াতে জন্ম গেল! ঐ যে ছুঁচোগিরি, ‘দীনাহীনা’ ভাব—ও হল ব্যারাম। ও কি দীনতা? ও গুপ্ত অহঙ্কার! ন লিঙ্গং ধর্মকারণং, সমতা সর্বভূতেষু এতন্মুক্তস্য লক্ষণম্। অস্তি অস্তি অস্তি, সোঽহং, সোঽহং চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহং। ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’৪। ছুঁচোগিরি করবি তো চিরকাল পড়ে থাকতে হবে। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’৫। শশী, তুই কিছু মনে করিস না—আমি সময়ে সময়ে nervous (দুর্বল) হয়ে পড়ি, দু-কথা বলে দিই। আমায় জানিস তো? তুই যে গোঁড়ামিতে নাই, তাতে আমি বড়ই খুশী। Avalanche৬ এর মত দুনিয়ার উপর পড়—দুনিয়া ফেটে যাক চড় চড় করে, হর হর মহাদেব। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’ (আপনিই আপনাকে উদ্ধার করবে)।

রামদয়ালবাবু আমাকে এক পত্র লেখেন, আর তুলসীরামের এক পত্র পাইয়াছি। পলিটিক্যাল বিষয় তোমরা কেউ ছুঁয়ো না, এবং তুলসীরামবাবু যেন পলিটিক্যাল পত্র না লেখে। এখন পাবলিক ম্যান, অনর্থক শত্রু বাড়াবার দরকার নাই। তবে যদি পুলিশ-ফুলিশ পেছনে লাগে তোদের—‘দাঁড়িয়ে জান দে’। ওরে বাপ, এমন দিন কি হবে যে, পরোপকারায় জান যাবে? ওরে হতভাগারা, এ দুনিয়া ছেলেখেলা নয়—বড় লোক তাঁরা, যাঁরা আপনার বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তা তৈরী করেন। এই হয়ে আসছে চিরকাল। একজন আপনার শরীর দিয়ে সেতু বানায়, আর হাজার লোক তার উপর দিয়ে নদী পার হয়। এবমস্তু, এবমস্তু, শিবোঽহং, শিবোঽহং (এইরূপই হউক, আমিই শিব)। রামদয়ালবাবুর কথামত ১০০ ফটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেব। তিনি বেচতে চান। টাকা আমাকে পাঠাতে হবে না, মঠে দিতে বলো। আমার এখানে ঢের টাকা আছে, কোন অভাব নাই—ইওরোপ বেড়াবার আর পুঁথিপত্র ছাপাবার জন্য। এ চিঠি ফাঁস করিস না।

আশীর্বাদক
নরেন্দ্র

এইবার কাজ ঠিক চলবে, আমি দেখতে পাচ্ছি। Nothing succeeds as success (কৃতকার্যতা যে সাফল্য এনে দেয়, আর কিছু তা পারে না)। বলি শশী, তুমি ঘর জাগাও—এই তোমার কাজ। … কালী হোক business manager (বিষয়কার্যের পরিচালক)। মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা খাড়া করতে পারলে তখন আমি অনেকটা নিশ্চিন্তি। বুঝতে পারিস? দুই তিন হাজার টাকার মত একটা জায়গা দেখ। জায়গাটা বড় চাই। আপাততঃ মেটে ঘর, কালে তার উপর অট্টালিকা খাড়া হয়ে যাবে। যত শীঘ্র পার জায়গা দেখ। আমাকে চিঠি লিখবে। কালীকৃষ্ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করবে, কি রকম করে টাকা পাঠাতে হয়—Cook-এর দ্বারা কি প্রকারে। যত শীঘ্র পার ঐ কাজটা হওয়া চাই। ঐটি হলে বস্, আদ্দেক হাঁপ ছাড়ি। জায়গাটা বড় চাই, তারপর দেখা যাবে। আমাদের জন্য চিন্তা নাই, ধীরে ধীরে সব হবে। কলিকাতার যত কাছে হয় ততই ভাল। একবার জায়গা হলে মা-ঠাকুরাণীকে centre (কেন্দ্র) করে গৌর-মা, গোলাপ-মা একটা বেডোল হুজুক মাচিয়ে দিক্। মান্দ্রাজে হুজুক খুব মেচেছে, ভাল কথা বটে।

তোমাদের একটা কিনা কাগজ ছাপাবার কথা ছিল, তার কি খবর? সকলের সঙ্গে মিশতে হবে, কাউকে চটাতে হবে না। All the powers of good against all the powers of evil৭—এই হচ্ছে কথা। বিজয়বাবুকে খাতির-যত্ন যথোচিত করবে। Do not insist upon everybody’s believing in our Guru.৮

আমি গোলাপ-মাকে একটা আলাদা পত্র লিখছি, পৌঁছে দিও। এখন তলিয়ে বুঝ—শশী ঘর ছেড়ে যেতে পারবে না; কালী বিষয়কার্য দেখবে আর চিঠিপত্র লিখবে। হয় সারদা, নয় শরৎ, নয় কালী—এদের সকলে একেবারে বাইরে না যায়—একজন যেন মঠে থাকে। তারপর যারা বাইরে যাবে, তারা যে-সকল লোক আমাদের সঙ্গে sympathy (সহানুভূতি) করবে, তাদের সঙ্গে মঠের যেন যোগ করে দেয়। কালী তাদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে। একটা খবরের কাগজ তোমাদের edit (সম্পাদন) করতে হবে, আদ্দেক বাঙলা, আদ্দেক হিন্দী—পার তো আর একটা ইংরেজীতে। পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছ—খবরের কাগজের subscriber (গ্রাহক) সংগ্রহ করতে ক-দিন লাগে? যারা বাহিরে আছে, subscriber (গ্রাহক) যোগাড় করুক। গুপ্ত৯—হিন্দী দিকটা লিখুক, বা অনেক হিন্দী লিখবার লোক পাওয়া যাবে। মিছে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। যে যেখানে যাবে, সেইখানেই একটা permanent (স্থায়ী) টোল পাততে হবে। তবে লোক change (পরিবর্তিত) হতে থাকবে। আমি একটা পুঁথি লিখছি—এটা শেষ হলেই এক দৌড়ে ঘর আর কি! আর আমি বড় nervous (দুর্বল) হয়ে পড়েছি—কিছুদিন চুপ করে থাকার বড় দরকার। মান্দ্রাজীদের সঙ্গে সর্বদা correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে ও জায়গায় জায়গায় টোল খোলবার চেষ্টা করবে। বাকী বুদ্ধি তিনি দিবেন। সর্বদা মনে রেখো যে, পরমহংসদেব জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন—নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন, তাই ছড়াও। তাঁর নামের দরকার নেই—তাঁর নাম আপনা হতে হবে। ‘আমার গুরুজীকে মানতেই হবে’ বললেই দল বাঁধবে, আর সব ফাঁস হয়ে যাবে—সাবধান! সকলকেই মিষ্টি বচন—চটলে সব কাজ পণ্ড হয়। যে যা বলে বলুক, আপনার গোঁয়ে চলে যাও—দুনিয়া তোমার পায়ের তলায় আসবে, ভাবনা নেই। বলে—একে বিশ্বাস কর, ওকে বিশ্বাস কর; বলি, প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি। Have faith in yourself, all power is in you. Be conscious and bring it out১০—বল্, আমি সব করতে পারি। ‘নেই নেই বললে সাপের বিষ নেই হয়ে যায়।’ খবরদার, No ‘নেই নেই’ (নেই নেই নয়); বল্—‘হাঁ হাঁ,’ ‘সোঽহং সোঽহং’।

কিন্নাম রোদিষি সখে ত্বয়ি সর্বশক্তিঃ
আমন্ত্রয়স্ব ভগবন্ ভগদং স্বরূপম্।
ত্রৈলোক্যমেতদখিলং তব পাদমূলে
আত্মৈব হি প্রভবতে ন জড়ঃ কদাচিৎ॥১১

মহা হুঙ্কারের সহিত কার্য আরম্ভ করে দাও। ভয় কি? কার সাধ্য বাধা দেয়? কুর্মস্তারকচর্বণং ত্রিভুবনমুৎপাটয়ামো বলাৎ। কিং ভো ন বিজানাস্যম্মান্—রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্।১২ ডর? কার ডর? কাদের ডর?

ক্ষীণাঃ স্ম দীনাঃ সকরুণা জল্পন্তি মূঢ়া জনাঃ
নাস্তিক্যস্ত্বিদন্তু অহহ দেহাত্মবাদাতুরাঃ।
প্রাপ্তাঃ স্ম বীরা গতভয়া অভয়ং প্রতিষ্ঠাং যদা
আস্তিক্যস্ত্বিদন্তু চিনুমঃ রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্॥

পীত্বা পীত্বা পরমপীযূষং বীতসংসাররাগাঃ
হিত্বা হিত্বা সকলকলহপ্রাপিণীং স্বার্থসিদ্ধিম্।
ধ্যাত্বা ধ্যাত্বা শ্রীগুরুচরণং সর্বকল্যাণরূপং
নত্বা নত্বা সকলভবনং পাতুমামন্ত্রয়ামঃ॥
প্রাপ্তং যদ্বৈ ত্বনাদিনিধনং বেদোদধিং মথিত্বা
দত্তং যস্য প্রকরণে হরিহর ব্রহ্মাদিদেবৈর্বলম্‌।

পূর্ণং যত্তু প্রাণসারৈর্ভৌমনারায়ণানাং
রামকৃষ্ণস্তনুং ধত্তে তৎপূর্ণপাত্রমিদং ভোঃ॥১৩

ইংরেজী লেখাপড়া-জানা young men (যুবক)-দের ভিতর কার্য করতে হবে। ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ (ত্যাগের দ্বারাই অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন)। ত্যাগ, ত্যাগ—এইটি খুব প্রচার করা চাই। ত্যাগী না হলে তেজ হবে না। কার্য আরম্ভ করে দাও। তোমরা যদি একবার গোঁ ভরে কার্য আরম্ভ করে দাও, তা হলে আমি বোধ হয় কিছুদিন বিরাম লাভ করতে পারি। তার জন্যই বোধ হয় কোথাও বসতে পারতুম না—এত হাঙ্গাম করতে হবে না কি? মান্দ্রাজ থেকে আজ অনেক খবর এল। মান্দ্রাজীরা তোলপাড়টা করছে ভাল। মান্দ্রাজের মিটিং-এর খবর সব ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ (Indian Mirror)-এ ছাপিয়ে দিও। আর কি অধিক লিখিব? সব খবর আমাকে খুঁটি-নাটি পাঠাবে। ইতি

বাবুরাম, যোগেন অত ভুগছে কেন?—‘দীনাহীনা’ ভাবের জ্বালায়। ব্যামো-ফ্যামো সব ঝেড়ে ফেলে দিতে বল—এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যামো-ফ্যামো সেরে যাবে। আত্মাতে কি ব্যামো ধরে না কি? ছুট! ঘণ্টাভর বসে ভাবতে বল—‘আমি আত্মা—আমাতে আবার রোগ কি?’ সব চলে যাবে। তোমরা সকলে ভাব—‘আমরা অনন্ত বলশালী আত্মা’; দেখ দিকি কি বল বেরোয়। ‘দীনহীনা!’ কিসের ‘দীনহীনা’? আমি ব্রহ্মময়ীর বেটা! কিসের রোগ, কিসের ভয়, কিসের অভাব? ‘দীনহীনা’ ভাবকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় কর দিকি। সব মঙ্গল হবে। No negative, all positive, affirmative—I am, God is and everything is in me. I will manifest health, purity, knowledge, whatever I want.১৪আরে, এরা ম্লেচ্ছগুলো আমার কথা বুঝতে লাগল, আর তোমরা বসে বসে ‘দীনাহীনা’ ব্যামোয় ভোগো? কার ব্যামো—কিসের রোগ? ঝেড়ে ফেলে দে! বলে, ‘আমি কি তোমার মত বোকা?’ আত্মায় আত্মায় কি ভেদ আছে? গুলিখোর জল ছুঁতে বড় ভয় পায়। ‘দীনহীনা’ কি এইসি তেইসি—নেই মাঙ্গতা ‘দীনাক্ষীণা’! ‘বীর্যমসি বীর্যং, বলমসি বলম, ওজোঽসি ওজঃ, সহোঽসি সহো ময়ি ধেহি’।১৫ রোজ ঠাকুরপূজার সময় যে আসন প্রতিষ্ঠা—আত্মানম্ অচ্ছিদ্রং ভাবয়েৎ (আত্মাকে অচ্ছিদ্র ভাবনা করিবে)—ওর মানে কি? বল—আমার ভেতর সব আছে, ইচ্ছা হলে বেরুবে। তুমি নিজের মনে মনে বল, বাবুরাম যোগেন আত্মা—তারা পূর্ণ, তাদের আবার রোগ কি? বল ঘণ্টাখানেক দুচার দিন। সব রোগ বালাই দূর হয়ে যাবে। কিমধিকমিতি—

নরেন্দ্র
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৭
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

হোটেল বেল ভিউ, ইওরোপীয়ান প্ল্যান
বীকন ষ্ট্রীট, বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪

প্রিয় মিসেস বুল,
আমি আপনার কৃপালিপি দুইখানিই পেয়েছি। আমাকে শনিবারে মেলরোজ ফিরে গিয়ে সোমবার পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে। মঙ্গলবার আপনার ওখানে যাব। কিন্তু ঠিক কোন্ জায়গাটায় আপনার বাড়ী আমি ভুলে গেছি; আপনি অনুগ্রহ করে যদি আমায় লেখেন। আমার প্রতি অনুগ্রহের জন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না—কারণ, আপনি যা দিতে চেয়েছেন, ঠিক সেই জিনিষটাই আমি খুঁজছিলাম—লেখবার জন্য একটা নির্জন জায়গা। অবশ্য আপনি দয়া করে যতটা জায়গা আমার জন্য দিতে চেয়েছেন, তার চেয়ে কম জায়গাতেই আমার চলে যাবে। আমি যেখানে হয় গুড়িসুড়ি মেরে পড়ে আরামে থাকতে পারব।

আপনার সদা বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৮
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… কলিকাতা থেকে আমার বক্তৃতা ও কথাবার্তা সম্বন্ধে যে-সব বই ছাপা হয়েছে, তাতে একটা জিনিষ আমি দেখতে পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কতকগুলি এরূপভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, পড়লে বোধ হয় যেন আমি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছি। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু আমি একজন রাজনীতিক নই, অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীও নই। আমার লক্ষ্য কেবল ভেতরের আত্মতত্ত্বের দিকে; সেইটি যদি ঠিক হয়ে যায়, তবে আর সবই ঠিক হয়ে যাবে—এই আমার মত। … অতএব তুমি কলিকাতার লোকদের অবশ্য অবশ্য সাবধান করে দেবে, যেন আমার কোন লেখা বা কথার ভেতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিথ্যা করে আরোপিত করা না হয়। কি আহাম্মকি! … শুনলাম, রেভারেণ্ড কালীচরণ বাঁড়ুয্যে নাকি খ্রীষ্টান মিশনরীদের সমক্ষে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, আমি একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি। যদি সর্বসাধারণের সমক্ষে এ কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আমার তরফ থেকে তাঁকে প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি কলিকাতার যে-কোন সংবাদপত্রে লিখে হয় তা প্রমাণ করুন, নতুবা তাঁর ঐ বাজে আহাম্মকি কথাটা প্রত্যাহার করুন। এটা অন্য ধর্মাবলম্বীকে অপদস্থ করবার খ্রীষ্টান মিশনরীদের একটা অপকৌশলমাত্র। আমি সাধারণভাবে খ্রীষ্টান-পরিচালিত শাসনতন্ত্রকে লক্ষ্য করে সরলভাবে সমালোচনার ছলে কয়েকটা কড়া কথা বলেছি। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আমার রাজনৈতিক বা ঐ রকম কিছু চর্চার দিকে কিছু ঝোঁক আছে, অথবা রাজনীতি বা তৎসদৃশ কিছুর সঙ্গে আমার কোনরূপ সম্পর্ক আছে। যাঁরা ভাবেন, ঐ সব বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে ছাপান একটা খুব জমকাল ব্যাপার, আর যাঁরা প্রমাণ করতে চান যে আমি একজন রাজনৈতিক প্রচারক, তাঁদের আমি বলি, ‘হে ঈশ্বর, আমার বন্ধুদের হাত থেকে আমায় রক্ষা কর।’

… আমার বন্ধুগণকে বলবে, যাঁরা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর—একদম চুপ থাকা। আমি তাঁদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাঁদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাঁদের সঙ্গে এক দরের হয়ে পড়লুম। তাদের বলবে—সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। তাদের (আমার বন্ধুদের) এখনও ঢের শিখতে হবে, তারা তো এখনও শিশুতুল্য। তারা বালক—তারা এখনও আহাম্মকের মত সোনার স্বপন দেখছে!

… সাধারণের সহিত জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুকে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে—হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।

তোমার প্রতি চিরস্নেহপূর্ণ
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১১৯
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি যে-সকল কাগজ পাঠাইয়াছিলে, তাহা যথাসময়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আর এত দিনে তুমিও নিশ্চয় আমেরিকার কাগজে যে-সকল মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার কিছু কিছু পাইয়া থাকিবে। এখন সব ঠিক হইয়াছে। সর্বদা কলিকাতায় চিঠিপত্র লিখিবে। বৎস, এ পর্যন্ত তুমি সাহস দেখাইয়া আপনাকে গৌরবমণ্ডিত করিয়াছ। জি. জি-ও বড়ই অদ্ভুত ও সুন্দর কার্য করিয়াছে। হে আমার সাহসী নিঃস্বার্থ সন্তানগণ, তোমরা সকলেই বড় সুন্দর কার্য করিয়াছ। আমি তোমাদের কথা স্মরণ করিয়া বড়ই গৌরব অনুভব করিতেছি। ভারত তোমাদের লইয়া গৌরব অনুভব করিতেছে। তোমাদের যে খবরের কাগজ বাহির করিবার সঙ্কল্প ছিল, তাহা ছাড়িও না। খেতড়ির রাজা ও কাঠিয়াওয়াড়স্থ লিমডির ঠাকুর সাহেব—যাহাতে আমার কার্যের বিষয় সর্বদা সংবাদ পান, তাহা করিবে। আমি মান্দ্রাজ অভিনন্দনের একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখিতেছি। যদি সস্তায় হয়, এখান হইতেই ছাপাইয়া পাঠাইয়া দিব, নতুবা টাইপ করিয়া পাঠাইয়া দিব। ভরসায় বুক বাঁধ—নিরাশ হইও না। এরূপ সুন্দরভাবে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর যদি আবার তোমার নৈরাশ্য আসে, তাহা হইলে তুমি মূর্খ। আমাদের কার্যের আরম্ভ যেরূপ সুন্দর হইয়াছে, আর কোন কার্যের আরম্ভ সেরূপ দেখা যায় না; আমাদের কার্য ভারতে ও তাহার বাহিরে যেরূপ দ্রুত বিস্তৃত হইয়াছে, এ পর্যন্ত ভারতে আর কোন আন্দোলন সেরূপ হয় নাই।

আমি ভারতের বাহিরে কোনরূপ প্রণালীবদ্ধ কার্য বা সভাসমিতি করিতে ইচ্ছা করি না। ঐরূপ করিবার কোন উপকারিতা বুঝি না। ভারতই আমাদের কার্যক্ষেত্র, আর বিদেশে আমাদের কার্য সমাদৃত হওয়ার এইটুকু মূল্য যে, উহাতে ভারত জাগিবে; এই পর্যন্ত। আমেরিকার ব্যাপারে ভারতে আমাদের কার্য করিবার অধিকার ও সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। এখন ভাববিস্তারের জন্য আমাদের দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা—এখন এই দুইটি কেন্দ্র হইয়াছে। অতি শীঘ্রই ভারতে আরও শত শত কেন্দ্র হইবে।

যদি পার তবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র উভয়ই বাহির কর। আমার যে-সকল ভ্রাতা চারিদিকে ঘুরিতেছেন, তাঁহারা গ্রাহক সংগ্রহ করিবেন; আমিও অনেক গ্রাহক যোগাড় করিব এবং মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু টাকা পাঠাইব। মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হইও না, সব ঠিক হইয়া যাইবে।

আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।

ইচ্ছাশক্তিই জগৎকে পরিচালিত করিয়া থাকে। হে বৎস, যুবকগণ খ্রীষ্টান হইয়া যাইতেছে বলিয়া দুঃখিত হইও না। আমাদের নিজেদের দোষেই ইহা ঘটিতেছে।

এইমাত্র রাশীকৃত সংবাদপত্র ও পরমহংসদেবের জীবনী আসিল—আমি সমুদয় পড়িয়া তারপর আবার কলম ধরিতেছি। আমাদের সমাজে, বিশেষতঃ মান্দ্রাজে এখন যে প্রকার অযথা নিয়ম ও আচারবন্ধন রহিয়াছে, তাহাতে তাহারা ঐরূপ না হইয়াই বা করে কি? উন্নতির জন্য প্রথম চাই স্বাধীনতা। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আত্মার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, তাই (এদেশে) ধর্মের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও বিকাশ হইয়াছে। কিন্তু তাঁহারা দেহকে যতপ্রকার বন্ধনের মধ্যে ফেলিলেন, কাজে কাজেই সমাজের বিকাশ হইল না। পাশ্চাত্য দেশে ঠিক ইহার বিপরীত—সমাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ধর্মে কিছুমাত্র নাই। ইহার ফলে তথায় ধর্ম নিতান্ত অপরিণত এবং সমাজ সুন্দর উন্নত হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে প্রাচ্যদেশীয় সমাজের চরণ হইতে বন্ধন-শৃঙ্খল ক্রমশঃ দূর হইতেছে, পাশ্চাত্যে ধর্মেরও ঠিক তাহাই হইতেছে। তোমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে এবং সহিষ্ণুতার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে।

প্রত্যেকের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের আদর্শ ধর্মমুখী বা অন্তর্মুখী, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বা বহির্মুখী। পাশ্চাত্য এতটুকু আধ্যাত্মিক উন্নতিও সমাজের উন্নতির ভিতর দিয়া করিতে চায়, আর প্রাচ্য এতটুকু সামাজিক শক্তিও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়া লাভ করিতে চায়।

এই জন্য আধুনিক সংস্কারকগণ প্রথমেই ভারতের ধর্মকে নষ্ট না করিয়া সংস্কারের আর কোন উপায় দেখিতে পান না। তাঁহারা উহার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বিফলমনোরথ হইয়াছেন। ইহার কারণ কি? কারণ—তাঁহাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তাঁহাদের নিজের ধর্ম উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করিয়াছেন; আর তাঁহাদের একজনও ‘সকল ধর্মের প্রসূতি’কে বুঝিবার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, সেই সাধনার মধ্য দিয়া যান নাই! ঈশ্বরেচ্ছায় আমি এই সমস্যার মীমাংসা করিয়াছি বলিয়া দাবী করি। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য ধর্মকে নষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই এবং ধর্মের জন্যই যে সমাজের এই অবস্থা তাহা নহে, বরং ধর্মকে সামাজিক ব্যাপারে যেভাবে কাজে লাগান উচিত, তাহা হয় নাই বলিয়াই সমাজের এই অবস্থা। আমি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ হইতে ইহার প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। আমি ইহাই শিক্ষা দিতেছি, আর আমাদিগকে ইহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য সারা জীবন চেষ্টা করিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু ইহাতে সময় লাগিবে—অনেক সময় ও দীর্ঘকালব্যাপী আলোচনার প্রয়োজন। সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর এবং কাজ করিয়া যাও। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’।

আমি তোমাদের অভিনন্দনের উত্তর দিবার জন্য ব্যস্ত আছি। ইহা ছাপাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। তা যদি সম্ভবপর না হয়, খানিকটা খানিকটা করিয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ ও অন্যান্য কাগজে ছাপাইবে।

তোমাদেরই
বিবেকানন্দ

পুঃ—বর্তমান হিন্দুসমাজ কেবল আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন মানুষের জন্য গঠিত এবং অন্য সকলকেই নির্দয়ভাবে পিষিয়া ফেলে। কেন? যাহারা সাংসারিক অসার বিষয়—যথা রূপরসাদি—একটু আধটু সম্ভোগ করিতে চায়, তাহারা কোথা যাইবে? তোমাদের ধর্ম যেমন উত্তম মধ্যম ও অধম—সকল প্রকার অধিকারীকেই গ্রহণ করিয়া থাকে, তোমাদের সমাজেরও তেমনি উচিত উচ্চ-নীচভাবাপন্ন সকলকে গ্রহণ করা। ইহার উপায়—প্রথমে তোমাদিগকে ধর্মের প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে হইবে, পরে সামাজিক বিষয়ে উহা লাগাইতে হইবে। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এই কাজ করিতে হইবে। ইতি—

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ১২০
[হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
অনেক দিন হইল আপনার অনুগ্রহ-পত্র পাইয়াছি, কিন্তু লিখিবার মত কিছুই ছিল না বলিয়া উত্তর দিতে দেরী করিলাম। মিঃ হেল-এর নিকট লিখিত আপনার চিঠি খুবই সন্তোষজনক হইয়াছে, কারণ উহাদের নিকট আমার ঐটুকুই দেনা ছিল। আমি এ সময়টা এদেশের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছি এবং সব কিছু দেখিতেছি, এবং তাহার ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে একটি মাত্র দেশ আছে, যেখানে মানুষ ধর্ম কি বস্তু তাহা বোঝে—সে দেশ হইল ভারতবর্ষ। হিন্দুদিগের সকল দোষত্রুটি সত্ত্বেও তাহারা নৈতিক চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতায় অন্যান্য জাতি অপেক্ষা বহু ঊর্ধ্বে; আর তাহার নিঃস্বার্থ সন্তানগণের যথাযোগ্য যত্ন চেষ্টা ও উদ্যমের দ্বারা পাশ্চাত্যের কর্মৈষণা ও তেজস্বিতার কিছু উপাদান হিন্দুদের শান্ত গুণাবলীর সহিত মিলিত করিলে—এ যাবৎ পৃথিবীতে যত প্রকার মানুষ দেখা গিয়াছে, তদপেক্ষা অনেক উৎকৃষ্ট ধরনের মানুষ আবির্ভূত হইবে।

কবে ভারতবর্ষে ফিরিতে পারিব, বলিতে পারি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এদেশের যথেষ্ট আমি দেখিয়াছি, সুতরাং শীঘ্রই ইওরোপ রওনা হইতেছি—তারপর ভারতবর্ষ।

আপনার ও আপনার ভ্রাতৃমণ্ডলীর প্রতি আমার ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি। ইতি—

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা (১২১-১২৮)

পত্র সংখ্যা (১২১-১২৮)

পত্র সংখ্যা- ১২১
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]

বাল্টিমোর, আমেরিকা
২২ অক্টোবর, ১৮৯৪

প্রেমাস্পদেষু,
তোমার১৬ পত্রপাঠে সকল সমাচার অবগত হইলাম। শ্রীমান অক্ষয়কুমার ঘোষের এক পত্র লণ্ডন নগর হইতে অদ্য পাইলাম, তাহাতেও অনেক বিষয় জ্ঞাত হইলাম।

তোমাদের Address from the Town Hall meeting (টাউন হলের সভা হইতে অভিনন্দন) এস্থানের খবরের কাগজে বাহির হইয়া গিয়াছে। একেবারে Telegraph (টেলিগ্রাফ) করিবার আবশ্যক ছিল না। যাহা হউক, সকল কার্য কুশলে সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে—এই পরম মঙ্গল। এ-সকল মিটিং ও Address-এর (অভিনন্দনের) প্রধান উদ্দেশ্য এদেশের জন্য নহে, কিন্তু ভারতবর্ষের জন্য। এক্ষণে তোমরা নিজেদের শক্তির পরিচয় পাইলে—Strike the iron while it is hot.১৭ মহাশক্তিতে কার্যক্ষেত্রে অবতরণ কর। কুঁড়েমির কাজ নয়। ঈর্ষা অহমিকাভাব গঙ্গার জলে জন্মের মত বিসর্জন দাও ও মহাবলে কাজে লাগিয়া যাও। বাকী প্রভু সব পথ দেখাইয়া দিবেন। মহা বন্যায় সমস্ত পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। মাষ্টার মহাশয় ও G. C. Ghosh (গিরিশচন্দ্র ঘোষ) প্রভৃতির দুই বৃহৎ পত্র পাইলাম। তাঁহাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। But work, work, work (কিন্তু কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর)—এই মূলমন্ত্র। আমি আর কিছু দেখিতে পাইতেছি না। এদেশে কার্যের বিরাম নাই—সমস্ত দেশ দাবড়ে বেড়াচ্ছি। যেখানে তাঁর তেজের বীজ পড়িবে, সেইখানেই ফল ফলিবে—অদ্য বা শতাব্দান্তে বা। কারুর সঙ্গেই বিবাদে আবশ্যক নাই। সকলের সঙ্গে সহানুভূতি করিয়া কার্য করিতে হইবে। তবে আশু ফল হইবে।

মীরাটের যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যায় এক পত্র লিখিয়াছেন। তোমাদের দ্বারা যদি তাঁহার কোন সহায়তা হয়, করিবে। জগতের হিত করা আমাদের উদ্দেশ্য, আপনাদের নাম বাজান উদ্দেশ্য নহে। যোগেন ও বাবুরাম বোধ হয় এত দিনে বেশ সারিয়া গিয়াছে। নিরঞ্জন বোধ হয় Ceylon (সিংহল) হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। সে Ceylon (সিংহল)-এ পালি ভাষা শিক্ষা কেন না করে এবং বৌদ্ধগ্রন্থ অধ্যয়ন কেন না করে, তাহা তো বুঝিতে পারি না। অনর্থক ভ্রমণে কি ফল? এবারকার উৎসব এমন করিবে যে, ভারতে পূর্বে আর হয় নাই। এখন হইতেই তাহার উদ্যোগ কর এবং উক্ত উৎসবের মধ্যে অনেকেই হয়তো কিছু কিছু সহায়তা করিলে আমাদের একটা স্থান হইয়া যাইবে। সকল বড়লোকের কাছে যাতায়াত করিবে। আমি যে-সকল চিঠিপত্র লিখি বা আমার সম্বন্ধে যাহা খবরের কাগজে পাও, তাহা সমস্ত না ছাপাইয়া যাহা বিবাদশূন্য এবং রাজনীতি সম্বন্ধে নহে, তন্মাত্র ছাপাইবে।

পূর্বের পত্রে লিখিয়াছি যে, তোমরা মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা স্থির করিয়া আমাকে পত্র লিখিবে। যত শীঘ্র পার। Businessman (কাজের লোক) হওয়া চাই, অন্ততঃ এক জনের। গোপালের এবং সাণ্ডেলের দেনা এখনও আছে কিনা এবং কত দেনা লিখিবে।

তাঁহার যাহারা শরণাগত, তাহাদের ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ পদতলে, মাভৈঃ মাভৈঃ। সকল হইবে ধীরে ধীরে। তোমাদের নিকট এই চাই—হামবড়া বা দলাদলি বা ঈর্ষা একেবারে জন্মের মত বিদায় করিতে হইবে। পৃথিবীর ন্যায় সর্বংসহ হইতে হইবে; এইটি যদি পার, দুনিয়া তোমাদের পায়ের তলায় আসিবে।

এবারকার জন্মোৎসবে বোধ হয় আমি যোগদান করিতে পারিব। আমি পারি বা না পারি, এখন হইতে তার সূত্রপাত করিলে তবে মহা উৎসব হইতে পারিবে। অধিক লোক একত্র হইলে খিচুড়ি প্রভৃতি বসাইয়া খাওয়ান বড়ই অসম্ভব ও খাওয়া দাওয়া করিতেই দিন যায়। এজন্য যদি অধিক লোক হয়, তাহা হইলে দাঁড়া-প্রসাদ, অর্থাৎ একটা সরাতে লুচি প্রভৃতি হাতে হাতে দিলেই যথেষ্ট হইবে। মহোৎসবাদিতে পেটের খাওয়া কম করিয়া মস্তিষ্কের খাওয়া কিছু দিতে চেষ্টা করিবে। যদি ২০ হাজার লোকে চারি আনা করিয়া দেয় তো ৫ হাজার টাকা উঠিয়া যায়। পরমহংসদেবের জীবন এবং তাঁহার শিক্ষা এবং অন্যান্য শাস্ত্র হইতে উপদেশ করিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙলার গ্রামে গ্রামে প্রায় হরিসভা আছে। ঐগুলিকে ধীরে ধীরে লইতে হইবে—বুঝিতে পার কিনা? সর্বদা আমাকে পত্র লিখিবে। অধিক newspaper cutting (খবরের কাগজের অংশ) পাঠাইবার আবশ্যক নাই—অনেক হইয়াছে। ইতি—

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২২
ওয়াশিংটন
২৩ অক্টোবর, ১৮৯৪

প্রিয় বিহিমিয়া চাঁদ,
আমি এদেশে বেশ ভাল আছি। এতদিনে আমি ইহাদের নিজেদের ধর্মাচার্যগণের মধ্যে একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছি। ইহারা সকলে আমাকে এবং আমার উপদেশ পছন্দ করে। সম্ভবতঃ আমি আগামী শীতে ভারতে ফিরিব। আপনি বোম্বাইয়ে মিঃ গান্ধীকে জানেন কি? তিনি এখনও চিকাগোতেই আছেন। ভারতে যেমন আমার অভ্যাস ছিল, এখানেও সেইরূপ আমি সমস্ত দেশের ভিতর ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছি। প্রভেদ এইটুকু যে, এখানে উপদেশ দিয়া, প্রচার করিয়া বেড়াইতেছি। সহস্র সহস্র ব্যক্তি খুব আগ্রহ ও যত্নের সহিত আমার কথা শুনিয়াছে। এদেশে থাকা খুব ব্যয়সাধ্য, কিন্তু প্রভু সর্বত্রই যোগাড় করিয়া দিতেছেন।

ওখানে (লিমডি, রাজপুতানায়) আমার সমস্ত বন্ধুদের ও আপনাকে ভালবাসা জানাইতেছি। ইতি

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৩
[মিসেস হেলকে লিখিত]
১১২৫ সেণ্ট পল ষ্ট্রীট
বাল্টিমোর
অক্টোবর, ১৮৯৪

মা,
দেখুন, আমি কোথায় এসে পড়েছি। ‘চিকাগো ট্রিবিউনে’ ভারতের একটি টেলিগ্রাফ লক্ষ্য করেছেন কি? এখান থেকে যাব ওয়াশিংটন; সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া। তারপর নিউ ইয়র্ক। ফিলাডেলফিয়ায় আমাকে মিস মেরীর ঠিকানা পাঠাবেন। নিউ ইয়র্ক যাবার পথে তার সঙ্গে দেখা করে যাব। আশা করি এতদিনে আপনি নিরুদ্বেগ হয়েছেন।

আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৪
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৭০৩ ফার্ষ্ট ষ্ট্রীট
ওয়াশিংটন

প্রিয় ভগিনী,
তুমি অনুগ্রহ করে যে পত্র দুখানি লিখেছিলে সেগুলি পেয়েছি। আজ এখানে, কাল বাল্টিমোরে আমার বক্তৃতা হবে; পুনরায় সোমবার বাল্টিমোরে ও মঙ্গলবার এখানে। তার দিন কয়েক পরে যাচ্ছি ফিলাডেলফিয়া। ওয়াশিংটন থেকে যাবার দিন তোমাকে পত্র দেব। অধ্যাপক রাইটের সঙ্গে দেখা করবার জন্যই ফিলাডেলফিয়ায় মাত্র দিনকয়েক থাকব। ওখান থেকে নিউ ইয়র্ক। বার কয়েক নিউ ইয়র্ক—বোষ্টন দৌড়াদৌড়ি করে ডেট্রয়েট হয়ে চিকাগোয় যাব। তারপর প্রবীণ (Senator) পামার যেমন বলেন—‘সাঁ করে ইংলণ্ডে।’

‘ধর্মে’র ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘রিলিজন্’। কলিকাতাবাসিগণ পেট্রোর প্রতি রূঢ় ব্যবহার করায় আমি খুব দুঃখিত। আমি এখানে বেশ সদ্ব্যবহার পেয়েছি, কাজও চমৎকার হচ্ছে। ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কেবল ভারত থেকে বোঝা বোঝা সংবাদপত্র আসায় বিরক্ত হয়েছিলাম। ‘মাদার চার্চ’ ও মিসেস গার্নসিকে সেগুলি গাড়ী বোঝাই করে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতে ওদের নিষেধ করে দিলাম, আর যেন সংবাদপত্র না পাঠায়। ভারতে খুব হইচই পড়ে গিয়েছে। আলাসিঙ্গা লিখেছে, দেশ জুড়ে গ্রামে গ্রামে আমার নাম রটেছে। ফলে পূর্বেকার যে শান্তি আর রইল না; এর পর আর কোথাও বিশ্রাম বা অবসর পাওয়া কঠিন। ভারতের এই সংবাদপত্রগুলি আমাকে শেষ না করে ছাড়বে না দেখছি। কবে কি খেয়েছি, কখন হেঁচেছি—সব কিছু ছাপাবে। অবশ্য বোকামি আমারই। প্রকৃতপক্ষে এখানে এসেছিলাম নিঃশব্দে কিছু অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে; কিন্তু ফাঁদে পড়ে গেছি, আর এখন চুপচাপ থাকতে পাব না। সকলে আনন্দে থাক।

তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৫
[ইসাবেল ম্যাক‍্‍কিণ্ডলিকে লিখিত]

১৭০৮ ডব্লিউ, ১ ষ্ট্রীট, ওয়াশিংটন
২৬ (?) অক্টোবর, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনী,
আমার দীর্ঘ নীরবতার জন্য ক্ষমা করো। ‘মাদার চার্চ’কে কিন্তু আমি নিয়মিত চিঠি লিখে যাচ্ছি। তোমরা সকলে নিশ্চয়ই সুন্দর শীতল আবহাওয়া উপভোগ করছ। আমিও বাল্টিমোর ও ওয়াশিংটনকে খুব উপভোগ করছি। এখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাব। আমার ধারণা ছিল মিস মেরী ফিলাডেলফিয়ায় আছে; সুতরাং আমি তার ঠিকানা চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিলাডেলফিয়ার কাছাকাছি অন্য কোন জায়গায় আছে। তাই মাদার চার্চের কথামত সে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কষ্ট স্বীকার করুক, এ আমি চাই না।

যে মহিলাটির কাছে আমি আছি, তাঁর নাম মিস টটন, মিস হাউ-এর এক ভাইঝি। এখন এক সপ্তাহ তাঁর অতিথি হয়ে থাকব। সুতরাং তুমি তাঁর ঠিকানায় চিঠি লিখতে পার।

এই শীতে জানুআরী-ফেব্রুআরীর কোন এক সময়ে আমার ইংলণ্ডে যাবার ইচ্ছা। লণ্ডনের এক মহিলার কাছে আমার এক বন্ধু আছেন। মহিলাটি তাঁর আতিথ্যগ্রহণের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওদিকে ফিরে যাবার জন্য ভারত থেকে প্রতিদিন তাগিদ দিচ্ছে।

কার্টুনে পিটুকে কেমন লাগল? কাউকে কিন্তু দেখিও না। পিটুকে নিয়ে এইভাবে তামাশা করা কিন্তু আমাদের দেশের লোকের অন্যায়। তোমার কাছ থেকে চিঠি পেতে সব সময় আমার কত না আগ্রহ; দয়া করে যদি লেখাকে আর একটু স্পষ্ট করার পরিশ্রম করো। দোহাই, এই প্রস্তাবে চটে যেও না যেন।

তোমার সদা স্নেহময় ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৬
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনি অনুগ্রহ করে আমায় মিঃ ফ্রেডারিক ডগলাসের নামে যে পরিচয়পত্র দিয়েছেন, সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাল্টিমোরে এক হোটেলওয়ালার নিকট আমি যে দুর্ব্যবহার পেয়েছি, সেজন্য আপনি দুঃখিত হবেন না। যেমন সর্বত্রই হয়েছে, এখানেও তেমনি—আমেরিকার নারীগণ আমাকে এই বিপদ হতে উদ্ধার করেছিলেন, তারপর আমি বেশ স্বচ্ছন্দে ছিলাম। এখানে মিসেস টটনের বাড়ীতে বাস করছি। ইনি আমার চিকাগোর জনৈক বন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্রী। সুতরাং সব দিকেই বেশ সুবিধা হচ্ছে। ইতি

বিবেকানন্দ
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৭
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমার শুভ আশীর্বাদ জানিবে। এতদিনে তুমি নিশ্চয়ই আমার অপর পত্রখানি পাইয়াছ। আমি কখনও কখনও তোমাদিগকে কড়া চিঠি লিখি, সেজন্য কিছু মনে করিও না। তোমাদিগের সকলকে আমি কতদূর ভালবাসি, তাহা তুমি ভালরূপই জান।

তুমি অনেকবার আমি কোথায় কোথায় ঘুরিতেছি, কি করিতেছি, তাহার সমুদয় বিবরণ ও আমার বক্তৃতাগুলির সংক্ষিপ্ত আভাস জানিতে চাহিয়াছ। মোটামুটি জানিয়া রাখ, ভারতেও যাহা করিতাম, এখানে ঠিক তাহাই করিতেছি। ভগবান্ যেখানে লইয়া যাইতেছেন, সেখানেই যাইতেছি—পূর্ব হইতে সঙ্কল্প করিয়া আমার কোন কার্য হয় না। আরও একটি বিষয় স্মরণ রাখিও, আমাকে অবিশ্রান্ত কার্য করিতে হয়, সুতরাং আমার চিন্তারাশি একত্র করিয়া পুস্তকাকারে গ্রথিত করিবার অবসর নাই। এত বেশী কাজ রাতদিন করিতে হইতেছে যে, আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হইয়া পড়িতেছে—আমি ইহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি। ভারত হইতে যথেষ্ট কাগজপত্র আসিয়াছে, আর আবশ্যক নাই। তুমি এবং মান্দ্রাজের অন্যান্য বন্ধুগণ আমার জন্য যে নিঃস্বার্থভাবে কঠোর পরিশ্রম করিয়াছ, তাহার জন্য তোমাদের নিকট আমি যে কি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ, তাহা বলিতে পারি না। তবে ইহা জানিয়া রাখ, তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহার উদ্দেশ্য আমার নাম বাজান নহে; তোমাদের শক্তি সম্বন্ধে তোমাদিগকে সজাগ করাই ইহার উদ্দেশ্য। সংগঠন-কার্যে আমি পটু নই; ধ্যানধারণা ও অধ্যয়নের উপরই আমার ঝোঁক। আমার মনে হয়, যথেষ্ট কাজ করিয়াছি—এখন একটু বিশ্রাম করিতে চাই। আমি এক্ষণে আমার গুরুদেবের নিকট হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই লোককে একটু শিক্ষা দিব। তোমরা এখন জানিয়াছ, তোমরা কি করিতে পার। মান্দ্রাজের যুবকগণ, তোমরাই প্রকৃতপক্ষে সব করিয়াছ—আমি তো নামমাত্র নেতা! আমি সংসারত্যাগী (অনাসক্ত সন্ন্যাসী); আমি কেবল একটি জিনিষ চাই। যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করিতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে একমুঠো খাবার দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। যত উচ্চ মতবাদ হউক, যত সুবিন্যস্ত দার্শনিক তত্ত্বই উহাতে থাকুক, যতক্ষণ উহা মত বা পুস্তকেই আবদ্ধ, ততক্ষণ উহাকে আমি ‘ধর্ম’ নাম দিই না। চক্ষু আমাদের পৃষ্ঠের দিকে নয়, সামনের দিকে—অতএব সম্মুখে অগ্রসর হও, আর যে ধর্মকে তোমরা নিজের ধর্ম বলিয়া গৌরব কর, তাহার উপদেশগুলি কার্যে পরিণত কর—ঈশ্বর তোমাদিগের সাহায্য করুন।

আমার উপর নির্ভর করিও না, নিজেদের উপর নির্ভর করিতে শেখ। আমি যে সর্বসাধারণের ভিতর একটা উৎসাহ উদ্দীপিত করিবার উপলক্ষ হইয়াছি, ইহাতে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। এই উৎসাহের সুযোগ লইয়া অগ্রসর হও—এই উৎসাহস্রোতে গা ঢালিয়া দাও, সব ঠিক হইয়া যাইবে।

হে বৎস, যথার্থ ভালবাসা কখনও বিফল হয় না। আজই হউক, কালই হউক, শত শত যুগ পরেই হউক, সত্যের জয় হইবেই, প্রেমের জয় হইবেই। তোমরা কি মানুষকে ভালবাস? ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাইতেছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল—সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নহে? অগ্রে তাহাদের উপাসনা কর না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করিয়া কূপ খনন করিতেছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস কর। নামযশের ফাঁকা চাকচিক্যে কি হইবে? খবরের কাগজে কি বলে না বলে, আমি সে দিকে লক্ষ্য করি না। তোমার হৃদয়ে প্রেম আছে তো? তবেই তুমি সর্বশক্তিমান্। তুমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম তো? তাহাই যদি হও, তবে তোমার শক্তি কে রোধ করিতে পারে? চরিত্রবলে মানুষ সর্বত্রই জয়ী হয়। ঈশ্বরই তাঁহার সন্তানগণকে সমুদ্রগর্ভে রক্ষা করিয়া থাকেন! তোমাদের মাতৃভূমি বীর সন্তান চাহিতেছেন—তোমরা বীর হও। ঈশ্বর তোমাদিগকে আশীর্বাদ করুন। সকলেই আমাকে ভারতে আসিতে বলিতেছে। তাহারা মনে করে, আমি গেলে তাহারা বেশী কাজ করিতে পারিবে। বন্ধু, তাহারা ভুল বুঝিয়াছে। আজকাল যে উৎসাহ দেখা যাইতেছে, ইহা একটু স্বদেশহিতৈষণা মাত্র—ইহাতে কোন কাজ হইবে না। যদি উহা খাঁটি হয়, তবে দেখিবে অল্পকালের মধ্যেই শত শত বীর অগ্রসর হইয়া কার্যে লাগিয়া যাইবে। অতএব জানিয়া রাখ যে, তোমরাই সব করিয়াছ, ইহা জানিয়া আরও কার্য করিতে থাক, আমার দিকে তাকাইও না।

অক্ষয় এখন লণ্ডনে আছে—সে লণ্ডনে মিস মূলারের নিকট যাইবার জন্য আমাকে একখানি সুন্দর নিমন্ত্রণপত্র লিখিয়াছে। বোধ হয়, আগামী জানুআরী বা ফেব্রুআরীতে লণ্ডন যাইব। ভট্টাচার্য আমাকে ভারতে যাইতে লিখিতেছেন। এস্থান প্রচারের উপযুক্ত ক্ষেত্র। বিভিন্ন মতবাদ লইয়া কি করিব? আমি ভগবানের দাস। উচ্চ উচ্চ তত্ত্ব প্রচার করিবার উপযুক্ত ক্ষেত্র এদেশ অপেক্ষা আর কোথায় পাইব? এখানে যদি একজন আমার বিরুদ্ধে থাকে তো শত শত জন আমায় সাহায্য করিতে প্রস্তুত। এখানে মানুষ মানুষের জন্য ভাবে, নিজের ভ্রাতাদের জন্য কাঁদে, আর এখানকার মেয়েরা দেবীর মত। মূর্খদিগকেও যদি প্রশংসা করা যায়, তবে তাহারাও কার্যে অগ্রসর হয়। যদি সব দিকে সুবিধা হয়, তবে অতি কাপুরুষও বীরের ভাব ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত বীর নীরবে কার্য করিয়া চলিয়া যান। একজন বুদ্ধ জগতে প্রকাশিত হইবার পূর্বে কত শত বুদ্ধ নীরবে জীবন দিয়া গিয়াছেন!

প্রিয় বৎস আলাসিঙ্গা, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, মানুষকে বিশ্বাস করি; দুঃখী দরিদ্রকে সাহায্য করা, পরের সেবার জন্য নরকে যাইতে প্রস্তুত হওয়া—আমি খুব বড় কাজ বলিয়া বিশ্বাস করি। পাশ্চাত্যগণের কথা কি বলিব, তাহারা আমাকে খাইতে দিয়াছে, পরিতে দিয়াছে, আশ্রয় দিয়াছে, তাহারা আমার সহিত পরম বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিয়াছে—খুব গোঁড়া খ্রীষ্টান পর্যন্ত। তাহাদের একজন পাদ্রী যদি ভারতে যায়, আমাদের দেশের লোক তাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করে? তোমরা তাহাদিগকে স্পর্শ পর্যন্ত কর না, তাহারা যে ম্লেচ্ছ!!! বৎস, কোন ব্যক্তি—কোন জাতিই অপরকে ঘৃণা করিলে জীবিত থাকিতে পারে না। যখনই ভারতবাসীরা ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ আবিষ্কার করিল ও অপর জাতির সহিত সর্ববিধ সংস্রব পরিত্যাগ করিল, তখনই ভারতের অদৃষ্টে ঘোর সর্বনাশের সূত্রপাত হইল। তোমরা ভারতেতর দেশবাসীদের প্রতি উক্ত ভাবপোষণ সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইও। বেদান্তের কথা ফস্ ফস্ মুখে আওড়ান খুব ভাল বটে, কিন্তু উহার একটি ক্ষুদ্র উপদেশও কার্যে পরিণত করা কি কঠিন!

আমি শীঘ্রই এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, সুতরাং এখানে আর খবরের কাগজ পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। প্রভু তোমাকে চিরদিনের জন্য আশীর্বাদ করুন।

তোমাদের চিরকল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

পুঃ—দুইটি জিনিষ হইতে বিশেষ সাবধান থাকিবে—ক্ষমতাপ্রিয়তা ও ঈর্ষা। সর্বদা আত্মবিশ্বাস অভ্যাস করিতে চেষ্টা কর। ইতি

বি
**********

পত্র সংখ্যা- ১২৮
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহ লিপি পাইয়াছি। আপনি যে এখানেও আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, তাহা আপনার সৌজন্যের নিদর্শন। আপনার বন্ধু নারায়ণ হেমচন্দ্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় নাই বলিয়াই আমার বিশ্বাস। আমি এখানে বহু চমকপ্রদ এবং অপূর্ব দৃশ্যাদি দেখিয়াছি।

আপনার ইওরোপে আসিবার বিশেষ সম্ভাবনা আছে জানিয়া সুখী হইলাম। যে প্রকারেই হউক এ সুযোগ অবশ্য গ্রহণ করিবেন। জগতের অন্যান্য জাতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকাই আমাদের অধঃপতনের হেতু এবং পুনর্বার সকলের সহিত একযোগে জগতের জীবনধারায় ফিরিয়া যাইতে পারিলেই সে অবস্থার প্রতিকার হইবে। গতিই তো জীবন। আমেরিকা একটি অদ্ভুত দেশ। দরিদ্র ও স্ত্রীজাতির পক্ষে এদেশ যেন স্বর্গের মত। এদেশে দরিদ্র একরূপ নাই বলিলেই চলে এবং অন্য কোথাও মেয়েরা এদেশের মেয়েদের মত স্বাধীন শিক্ষিত ও উন্নত নহে। সমাজে উহারাই সব।

ইহা এক অপূর্ব শিক্ষা। সন্ন্যাসজীবনের কোন ধর্ম—এমন কি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি জিনিষগুলি পর্যন্ত আমাকে পরিবর্তিত করিতে হয় নাই, অথচ এই অতিথিবৎসল দেশে প্রত্যেকটি গৃহদ্বারই আমার জন্য উন্মুক্ত। যে প্রভু ভারতবর্ষে আমাকে পরিচালিত করিয়াছেন, তিনি কি আর এখানে আমাকে পরিচালিত করিবেন না? তিনি তো করিতেছেনই! একজন সন্ন্যাসীর এদেশে আসিবার কী প্রয়োজন ছিল, আপনি হয়তো তাহা বুঝিতে পারেন না, কিন্তু ইহার প্রয়োজন ছিল। জগতের নিকট আপনাদের পরিচয়ের একমাত্র দাবী—ধর্ম, এবং সেই ধর্মের পতাকাবাহী যথার্থ খাঁটি লোক ভারতের বাহিরে প্রেরণ করিতে হইবে, আর তাহা হইলেই ভারতবর্ষ যে আজও বাঁচিয়া আছে, এ কথা জগতের অন্যান্য জাতি বুঝিতে পারিবে।

বস্তুতঃ যথার্থ প্রতিনিধিস্থানীয় কিছু লোকের এখন ভারতের বাহিরে জগতের অন্যান্য দেশে যাইয়া ইহা প্রতিষ্ঠা করা উচিত যে, ভারতবাসীরা বর্বর কিম্বা অসভ্য নহে। ঘরে বসিয়া হয়তো আপনারা ইহার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করিতে পারিবেন না, কিন্তু আপনাদের জাতীয় জীবনের জন্য ইহার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে—আমার এ-কথা বিশ্বাস করুন।

যে সন্ন্যাসীর অন্তরে অপরের কল্যাণ-সাধন-স্পৃহা বর্তমান নাই, সে সন্ন্যাসীই নহে—সে তো পশুমাত্র!

আমি অলস পর্যটক নহি, কিম্বা দৃশ্য দেখিয়া বেড়ানও আমার পেশা নহে। যদি বাঁচিয়া থাকেন, তবে আমার কার্যকলাপ দেখিতে পাইবেন এবং আজীবন আমাকে আশীর্বাদ করিবেন।

দ্বিবেদী মহাশয়ের প্রবন্ধ ধর্মমহাসভার পক্ষে অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়ায় উহাকে কাটিয়া ছাঁটিয়া ছোট করিতে হইয়াছিল। ধর্মমহাসভায় আমি কিছু বলিয়াছিলাম এবং তাহা কতটা ফলপ্রসূ হইয়াছিল তাহার নিদর্শনস্বরূপ আমার হাতের কাছে যে দু-চারিটি দৈনিক ও মাসিক পত্রিকা পড়িয়া আছে, তাহা হইতেই কিছু কিছু কাটিয়া পাঠাইতেছি। নিজের ঢাক নিজে পিটান আমার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু আপনি আমাকে স্নেহ করেন, সেই সূত্রে আপনার নিকট বিশ্বাস করিয়া আমি এ-কথা অবশ্য বলিব যে, ইতোপূর্বে কোন হিন্দু এদেশে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই এবং আমার আমেরিকা আগমনে যদি অন্য কোন কাজ নাও হইয়া থাকে, আমেরিকাবাসিগণ অন্ততঃ এটুকু উপলব্ধি করিয়াছে যে, আজও ভারতবর্ষে এমন মানুষের আবির্ভাব হইয়া থাকে, যাঁহাদের পাদমূলে বসিয়া জগতের সর্বাপেক্ষা সভ্য জাতিও ধর্ম এবং নীতি শিক্ষা লাভ করিতে পারে। আর হিন্দুজাতি যে একজন সন্ন্যাসীকে প্রতিনিধিরূপে এদেশে প্রেরণ করিয়াছিল, তাহার সার্থকতা উহাতেই যথেষ্টরূপে সাধিত হইয়াছে বলিয়া কি আপনার মনে হয় না? বিস্তারিত বিবরণ বীরচাঁদ গান্ধীর নিকট অবগত হইবেন।

কয়েকটি পত্রিকা হইতে অংশবিশেষ আমি নিয়ে উদ্ধৃত করিতেছিঃ

‘সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার অনেকগুলিই বিশেষ বাগ্মিতাপূর্ণ হইয়াছিল সত্য, কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসী ধর্মমহাসভার মূল নীতি ও উহার সীমাবদ্ধতা যেরূপ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, অন্য কেহই তাহা করিতে পারে নাই। তাঁহার বক্তৃতার সবটুকু আমি উদ্ধৃত করিতেছি এবং শ্রোতৃবৃন্দের উপর উহার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, দৈবশক্তিসম্পন্ন বক্তা তিনি এবং তাঁহার অকপট উক্তিসমূহ যে মধুর ভাষার মধ্য দিয়া তিনি প্রকাশ করেন, তাহা তদীয় গৈরিক বসন এবং বুদ্ধিদীপ্ত দৃঢ় মুখমণ্ডল অপেক্ষা কম আকর্ষণীয় নয়।’— (নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক)

ঐ পৃষ্ঠাতেই পুনর্বার লিখিত আছেঃ

‘তাঁহার শিক্ষা, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদের সম্মুখে হিন্দু সভ্যতার এক নূতন ধারা উন্মুক্ত করিয়াছে। তাঁহার প্রতিভাদীপ্ত মুখমণ্ডল, গম্ভীর ও সুললিত কণ্ঠস্বর স্বতই মানুষকে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট করে এবং ঐ বিধিদত্ত সম্পদ‍সহায়ে এদেশের বহু ক্লাব ও গীর্জায় প্রচারের ফলে আজ আমরা তাঁর মতবাদের সহিত পরিচিত হইয়াছি। কোন প্রকার নোট প্রস্তুত করিয়া তিনি বক্তৃতা করেন না। কিন্তু নিজ বক্তব্য বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিয়া অপূর্ব কৌশল ও ঐকান্তিকতা সহকারে তিনি মীমাংসায় উপনীত হন এবং অন্তরের গভীর প্রেরণা তাঁহার বাগ্মিতাকে অপূর্বভাবে সার্থক করিয়া তোলে।’

‘ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিরূপে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া আমরা বুঝিতেছি যে, এই শিক্ষিত জাতির মধ্যে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করা কত নির্বুদ্ধিতার কাজ।’—(হের‍্যাল্ড, এখানকার শ্রেষ্ঠ কাগজ)

আর অধিক উদ্ধৃত করিলাম না, পাছে আমায় দাম্ভিক বলিয়া মনে করেন। কিন্তু আপনাদের বর্তমান অবস্থা প্রায় কূপমণ্ডূকের মত হইয়াছে বলিয়া এবং বহির্জগতে কোথায় কি ঘটিতেছে, তাহার দিকে দৃষ্টি দিবার মত অবস্থা আপনাদের নাই দেখিয়া এটুকু লেখা প্রয়োজন বোধ করিয়াছি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে আপনার কথা বলিতেছি না—আপনাকে মহাপ্রাণ বলিয়া জানি, কিন্তু জাতির সর্বসাধারণের পক্ষে আমার উক্তি প্রযোজ্য।

আমি ভারতবর্ষে যেমন ছিলাম এখানেও ঠিক তেমনি আছি, কেবল এই বিশেষ উন্নত ও মার্জিত দেশে যথেষ্ট সমাদর ও সহানুভূতি লাভ করিতেছি—যাহা আমাদের দেশের নির্বোধগণ স্বপ্নেও চিন্তা করিতে পারে না। আমাদের দেশে সাধুকে এক টুকরা রুটি দিতেও সবাই কুণ্ঠিত হয় আর এখানে একটি বক্তৃতার জন্য এক হাজার টাকা দিতেও সকলে প্রস্তুত; এবং যে উপদেশ ইহারা লাভ করিল, তাহার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকে।

এই অপরিচিত দেশের নরনারী আমাকে যতটুকু বুঝিতে পারিতেছে, ভারতবর্ষে কেহ কখনও ততটুকু বোঝে নাই। আমি ইচ্ছা করিলে এখন এখানে পরম আরামের মধ্যে জীবন কাটাতেই পারি, কিন্তু আমি সন্ন্যাসী এবং সমস্ত দোষত্রুটি সত্ত্বেও ভারতবর্ষকে ভালবাসি। অতএব দু-চারি মাস পরেই দেশে ফিরিতেছি এবং যাহারা কৃতজ্ঞতার ধারও ধারে না, তাহাদের মধ্যে পূর্বের মত নগরে নগরে ধর্ম ও উন্নতির বীজ বপন করিতে থাকিব।

আমেরিকার জনসাধারণ ভিন্নধর্মাবলম্বী হইয়াও আমার প্রতি যে সহায়তা সহানুভূতি শ্রদ্ধা ও আনুকূল্য দেখাইয়াছে, তাহার সহিত আমার নিজ দেশের স্বার্থপরতা অকৃতজ্ঞতা ও ভিক্ষুক-মনোবৃত্তির তুলনা করিয়া আমি লজ্জা অনুভব করি এবং সেই জন্যই আপনাকে বলি যে, দেশের বাহিরে আসিয়া অন্যান্য দেশ দেখুন এবং নিজ অবস্থার সহিত তুলনা করুন।

এখন, এই-সকল উদ্ধৃত অংশ পাঠ করিবার পর, ভারতবর্ষ হইতে একজন সন্ন্যাসী এদেশে প্রেরণ করা সমীচীন হইয়াছে বলিয়া আপনার মনে হয় কি?

অনুগ্রহপূর্বক এই চিঠি প্রকাশ করিবেন না। ভারতবর্ষে থাকিতেও যেমন, এখানেও ঠিক তেমনি—অপকৌশল দ্বারা নাম করাকে আমি ঘৃণা করি।

আমি প্রভুর কার্য করিয়া যাইতেছি এবং তিনি যেথায় লইয়া যাইবেন সেখানেই যাইব। ‘মূকং করোতি বাচালং’ ইত্যাদি—যাঁহার কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি মানুষের সাহায্যের অপেক্ষা রাখি না। যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তবে ভারতবর্ষে কিম্বা আমেরিকায় কিম্বা উত্তর মেরুতে সর্বত্র তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আর যদি তিনি সাহায্য না করেন, তবে অন্য কেহই করিতে পারিবে না। চিরকাল প্রভুর জয় হউক। ইতি

আশীর্বাদক
আপনাদের বিবেকানন্দ
**********

Post a Comment

0 Comments