স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
নবম খণ্ড
স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে
===================
পূর্বাভাষ
ব্যক্তিগণ—স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁহার গুরুভ্রাতৃবৃন্দ ও শিষ্যমণ্ডলী। কয়েক জন পাশ্চাত্য অভ্যাগত এবং শিষ্য—ধীরামাতা, জয়া নাম্নী এক মহিলা ও নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।
স্থান—ভারতের বিভিন্ন অংশ
কাল—১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দ
এ বৎসর দিনগুলি কি সুন্দর ভাবেই না কাটিয়াছে! এই সময়েই যে আদর্শ বাস্তবে পরিণত হইয়াছে! প্রথমে নদীতীরে বেলুড়ের কুটীরে, তারপর হিমালয়-বক্ষে নৈনীতাল ও আলমোড়ায়, পরিশেষে কাশ্মীরে নানা স্থানে পরিভ্রমণ-কালে—সর্বত্রই সব সময় আসিয়াছিল, যাহা কখনও ভুলিবার নয়, এমন সব কথা শুনিয়াছি, যাহা আমাদের সারা জীবন ধরিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে থাকিবে।
বিরাট প্রতিভার বিশাল খেয়ালে আমরা কৌতুক করিয়াছি, বীরত্বের উচ্ছ্বাসে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছি—এ সমস্ত দিব্য লীলার, মনে হয়, শিশু ভগবান্ যেন জাগিয়া উঠিতেছেন, আর আমরা দাঁড়াইয়া সাক্ষিস্বরূপ নিরীক্ষণ করিয়াছি!
… দেখিতেছি নক্ষত্রালোকিত হিমাচল-অরণ্যানীর দৃশ্যাবলী আর দেখিতেছি দিল্লী এবং তাজের রাজভোগ্য সৌন্দর্যরাশি। স্মৃতির এই সকল নিদর্শন বর্ণনা করিতে কাহার না আগ্রহ হয়! কিন্তু বর্ণনায় উহা বিবর্ণ হইয়া উঠিবে—কেন না সে যে অসম্ভব! তাই স্মৃতির আলেখ্যে নয়, স্মৃতির আলোকেই তাহাদের অক্ষয় পুণ্যপ্রতিষ্ঠা। আর সেই প্রতিষ্ঠায় চিরসংযুক্ত হইয়া বিদ্যমান থাকিবে তথাকার কোমলহৃদয় শান্তপ্রকৃতি অধিবাসিবৃন্দ।
কিরূপ মানসিক অবস্থায় নূতন নূতন ধর্ম-বিশ্বাস প্রসূত হয়, এবং কী ধরনের মহাপুরুষেরা এইরূপ ধর্ম-বিশ্বাস সঞ্চারিত করেন—আমরা তাহা কতকটা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। কারণ, আমরা এমন এক মহাপুরুষের সঙ্গলাভ করিয়াছি, যিনি সকল রকম লোককেই নিজের কাছে আকর্ষণ করিতেন, সকলের বক্তব্য শুনিতেন, সকলের প্রতি সহানুভূতি দেখাইতেন, কাহাকেও প্রত্যাখ্যান করেন নাই।
বিদেশীর উপহাসস্থল, কিন্তু দেশবাসীর পূজাস্পদ ভিক্ষুকের বেশে তাঁহাকে আমরা দেখিয়াছি; তাই মনে হয়—শ্রমলব্ধ জীবিকা, সামান্য কুটীরে বাস, এবং শস্যক্ষেত্রবাহী সাধারণ পথ—কেবল এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপটের মধ্যেই এমন জীবনের প্রকৃত শোভা ফুটিতে পারে।
তাঁহার স্বদেশবাসী বিদ্বান্ রাষ্ট্রনীতি-বিশারদ পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁহাকে যেমন ভালবাসিতেন, নিরক্ষর অজ্ঞেরাও তাঁহাকে তেমনি ভালবাসিত। তাঁহার নৌকার মাঝি-মাল্লারা পথ চাহিয়া থাকিত, কতক্ষণে তিনি আবার নৌকায় ফিরিয়া আসিবেন। যে গৃহে তিনি অতিথি হইতেন, সেই গৃহের পরিচারক ভৃত্যদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়িয়া যাইত, কে আগে তাঁহার সেবা করিবে। আর এই সকল ব্যাপার সর্বদাই যেন একটা খেলার আবরণে জড়িত থাকিত। ‘তাঁহারা যে ভগবানের খেলার সঙ্গী’—এই ভাব তাহাদের মনে স্বতই জাগরূক থাকিত।
যাঁহারা এরূপ শুভমুহূর্তের আস্বাদ পাইয়াছেন, জীবন তাঁহাদের নিকট অধিকতর মূল্যবান্, অধিকতর মধুময়। দীর্ঘ নিরানন্দ রজনীর তালবন-সঞ্চারী বায়ুও উদ্বেগ ও আশঙ্কার পরিবর্তে তাঁহাদের কর্ণে শান্তিময় ‘শিব! শিব!’ বাণী ধ্বনিত করিয়া তোলে।
===================
অধ্যায় - ০১
স্থান—বেলুড় গঙ্গাতীরে একখানি বাড়ী
কাল—মার্চ হইতে ১১ মে পর্যন্ত
গঙ্গাতীরস্থ বাড়ীখানির সম্বন্ধে স্বামীজী একজনকে বলিয়াছিলেন, ‘ধীরামাতার ক্ষুদ্র বাড়ীখানি তোমার স্বর্গ বলিয়া মনে হইবে। কারণ, ইহার আগাগোড়া সবটাই ভালবাসা-মাখা।’
বাস্তবিকই তাই। ভিতরে এক অবিচ্ছিন্ন মেলা-মেশার ভাব, এবং বাহিরে প্রতি জিনিষটি সমান সুন্দর; শ্যামল বিস্তৃত শষ্পরাজি, উন্নত নারিকেল বৃক্ষগুলি, বনমধ্যস্থ ছোট ছোট বাদামী রঙের গ্রামগুলি—সবই সুন্দর!
যাঁহাদের মনে অতীতের স্মৃতি জাগরূক রহিয়াছে, এমন অনেকে মাঝে মাঝে আসিতেন, এবং আমরা স্বামীজীর অষ্টবর্ষব্যাপী ভ্রমণের কিছু কিছু বিবরণ শুনিতে পাইতাম; গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন-কালে তাঁহার নাম-পরিবর্তনের কথা, তাঁহার নির্বিকল্প সমাধির কথা, এবং যাহা বাক্যের অতীত ও সাধারণ দৃষ্টির বহির্ভূত, যাহা কেবল প্রেমিক হৃদয়েরই অনুভবগম্য, পরার্থে স্বামীজীর সেই পবিত্র মর্মবেদনার কথাও আমরা শ্রবণ করিতাম। আর স্বয়ং স্বামীজী তথায় আসিতেন, উমা-মহেশ্বরের ও রাধাকৃষ্ণের গল্প বলিতেন, কত গান ও কবিতার আংশিক আবৃত্তি করিতেন।
বেশীর ভাগ, তিনি আজ একটি, কাল একটি—এইরূপ করিয়া ভারতীয় ধর্মগুলিই আমাদের নিকট বর্ণনা করিতেন; তাঁহার যখন যেমন খেয়াল হইত, যেন তদনুসারেই কোন একটিকে বাছিয়া লইতেন। কিন্তু তিনি কেবল যে ধর্মবিষয়ক উপদেশই আমাদিগকে দিতেন, তাহা নহে। কখনও ইতিহাস, কখনও লৌকিক উপকথা, কখনও বা বিভিন্ন সমাজ, জাতিবিভাগ ও লোকাচারের বহুবিধ উদ্ভট পরিণতি ও অসঙ্গতি—এ সকলেরও আলোচনা হইত। বাস্তবিক তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মনে হইত, যেন ভারতমাতা শেষ এবং শ্রেষ্ঠ পুরাণ-স্বরূপ হইয়া তাঁহার শ্রীমুখাবলম্বনে স্বয়ং প্রকটিত হইতেছেন।
ভারত-সংক্রান্ত বিষয়ে, যাহা কিছু পাশ্চাত্য মনের পক্ষে আস্বাদ করা অসম্ভব বলিয়া তাঁহার বোধ হইত, সেগুলিকে শিক্ষার প্রারম্ভেই খুব করিয়া বাড়াইয়া আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিতেন। এইরূপে, হয়তো তিনি হরগৌরীমিলনাত্মক একটি কবিতা১ আবৃত্তি করিতেনঃ
কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ, … …
শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়। চাম্পেয়গৌরার্ধশরীরকায়ৈ,
সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়, কর্পূরগৌরার্ধশরীরকায়।
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥ ধম্মিল্লবত্যৈ চ জটাধরায়,
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
কপালমালাপরিশোভিতায়। অম্ভোধরশ্যামলকুন্তলায়ৈ,
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়, বিভূতিভূষাঙ্গজটাধরায়।
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥ জগজ্জনন্যৈ জগদেকপিত্রে,
… … নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
আলোচনার বিষয় যাহাই হউক না কেন, উহা সর্বদাই পরিণামে অদ্বয় অনন্তের কথায় পর্যবসিত হইত। সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব অথবা বিজ্ঞান—যে-কোন তত্ত্বের বিচারেই তিনি প্রবৃত্তি হউন না কেন, সেটি যে সেই চরম অনুভূতিরই একটি দৃষ্টান্ত মাত্র, তাহা তিনি সদাই আমাদের মনে বদ্ধমূল করিয়া দিতেন। তাঁহার চক্ষে কোন জিনিষই ধর্মের এলাকার বহির্ভূত ছিল না। বন্ধনমাত্রকেই তিনি অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন, এবং যাহারা ‘শৃঙ্খলকে পুণ্যের আররণে ঢাকিতে চাহে’ তাহাদিগকে তিনি ভয়ানক লোক বলিয়া গণ্য করিতেন; কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চ স্তরের রসশিল্পের এবং এই বিষয়ের মধ্যে প্রকৃত সমালোচক যে ব্যবধান দেখিতে পান, তাহা কখনও তাঁহার দৃষ্টি এড়াইত না। একদিন আমরা কয়েক জন ইওরোপীয় ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম। স্বামীজী সেদিন পারসিক কবিতার বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছিলেনঃ
‘প্রিয়তমের মুখের একটি তিলের বদলে আমি সমরকন্দের সমস্ত ঐশ্বর্য বিলাইয়া দিতে প্রস্তুত!’
এই পদটি আবৃত্তি করিতে করিতে তিনি সহসা সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, ‘দেখ, যে লোক একটা প্রেমসঙ্গীতের মাধুর্য বুঝিতে পারে না, তাহার জন্য আমি এক কানাকড়িও দিতে রাজী নই।’ তাঁহার কথাবর্তা সরস উক্তসমূহে পূর্ণ থাকিত। সেই দিনই অপরাহ্নে, কোন রাজনৈতিক বিষয়ের বিচার করিতে করিতে তিনি বলিলেন, ‘দেখা যাইতেছে যে, একটি জাতিগঠনের পক্ষে সাধারণ প্রীতির ন্যায় একটা সাধারণ বিরাগেরও আবশ্যকতা আছে!’
কয়েক মাস পরে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘যাহার জগতে কোন বিশেষ কাজ করিবার আছে, তাহার কাছে আমি কখনও উমা এবং মহেশ্বর ভিন্ন অন্য দেবদেবীর কথা বলি না। কারণ, মহেশ্বর এবং জগন্মাতা হইতেই কর্মবীরগণের উদ্ভব।’ ভগবানের প্রতি উদ্দাম প্রেমে আত্মহারা হওয়া যে কি জিনিষ, তাহার আভাস তিনি না দিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাই তিনি আমাদের কাছে এই সব গানও সুর-সংযোগে গাহিতেনঃ
‘প্রেমের রাজা কুঞ্জবনে কিশোরী,
প্রেমের দ্বারে আছে দ্বারী, করে মোহন বাঁশরী,
বাঁশী বলচে রে সদাই, প্রেম বিলাবে কল্পতরু রাই,
কারু যেতে মানা নাই!
ডাকচে বাঁশী—আয় পিপাসী জয় রাধে নাম গান করে।’২
তিনি তাঁহার বন্ধু-রচিত৩ গোপগোপীগণের উত্তর-প্রত্যুত্তর-সূচক ভাবগম্ভীর গীতটিও গাহিয়া শুনাইতেনঃ
‘পরমাত্মক পীতবসন নবঘনশ্যামকায়।
কালা ব্রজের রাখাল ধরে রাধার পায়।
বন্দ প্রাণ নন্দদুলাল নমো নমো পদপঙ্কজে,
মরি মরি মরি, বাঁকা নয়ন গোপীর মন মজে।
পাণ্ডবসখা সারথি রথে, বাঁশী বাজায় ব্রজের ঘাটে পথে।
যজ্ঞেশ্বর বীতভয় হর যাদবরায়,
প্রেমে রাধা বলে নয়ন ভেসে যায়।’
২৫ মার্চ। প্রাতে কুটীরে আসিয়া সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা সেখানে অতিবাহিত করা, আবার বৈকালে পুনরায় আসা—ইহাই স্বামীজীর এই সময়ের নিয়ম ছিল। কিন্ত এইরূপ সাক্ষাতের দ্বিতীয় দিন সকালে—শুক্রবার ঈশাহিগণের জ্ঞাপনোৎসবের৪ দিন—তিনি ফিরিবার সময় আমাদের তিন জনকে সঙ্গে করিয়া মঠে লইয়া গেলেন, এবং সেখানে ঠাকুরঘরে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানান্তে একজনকে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করিলেন। সেই প্রভাতটি জীবনে সর্বাপেক্ষা আনন্দময় প্রভাত! পূজাশেষে আমরা উপর তলায় গেলাম। স্বামীজী যোগী শিবের ন্যায় জটা, বিভূতি ও হাড়ের কুণ্ডল পরিধান করিয়া একঘণ্টাকাল ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র-সংযোগে ভারতীয় গীত গাহিলেন।
তারপর সন্ধ্যার সময় গঙ্গাবক্ষে আমাদের নৌকায় বসিয়া তিনি আমাদের নিকট অকপটভাবে তাঁহার গুরুদেবের নিকট হইতে দায়রূপে প্রাপ্ত সেই মহৎ কার্য সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন এবং ভাবনাবিষয়ক অনেক কথা বলিলেন।
আর এক সপ্তাহ পরেই তিনি দার্জিলিঙ যাত্রা করিলেন।
৩ মে। তারপর আমাদের মধ্যে দুইজন পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর গৃহে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলেন। তখনকার রাজনীতিক গগন তমসাচ্ছন্ন। একটা ঝড়ের সূচনা দেখা যাইতেছিল। ইতঃপূর্বেই প্লেগ, আতঙ্ক এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিজ নিজ ভীষণ মূর্তি দেখাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। আচার্যদেব আমাদের দুইজনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘মা কালীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কতকগুলি লোক ব্যঙ্গ করে। কিন্তু ঐ দেখ, আজ মা প্রজাগণের মধ্যে আবির্ভূতা হইয়াছেন। ভয়ে তাহারা কূলকিনারা দেখিতে পাইতেছে না, এবং মৃত্যুর দণ্ডদাতা সৈনিকবৃন্দের ডাক পড়িয়াছে। কে বলিতে পারে যে, ভগবান্ শুভের ন্যায় অশুভ রূপেও আত্মপ্রকাশ করেন না! কিন্তু কেবল হিন্দুই তাঁহাকে অশুভ রূপেও পূজা করিতে সাহস করে।’
মহামারী দেখা দিয়াছিল এবং জনসাধারণকে সাহস দিবার জন্য ব্যবস্থাও চলিতেছিল। যতদিন এই আশঙ্কা সব দিক্ আতঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিল, ততদিন স্বামীজী কলিকাতা পরিত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন না। এই আশঙ্কা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু সঙ্গে সেই সুখের দিনগুলিও অন্তর্হিত হইল। আমাদেরও যাত্রা করিবার সময় আসিল।
===================
অধ্যায় - ০২
স্থান—হিমালয়
কাল—১১ হইতে ২৫ মে পর্যন্ত
আমরা একটি বড় দল, অথবা প্রকৃতপক্ষে দুইটি দল—বুধবার সন্ধ্যাকালে হাওড়া ষ্টেশন হইতে যাত্রা করিয়া শুক্রবার প্রাতে হিমালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম।
তিনটি ঘটনা নৈনীতালকে মধুময় করিয়া তুলিয়াছিল—খেতড়ির রাজাকে আমাদের নিকট পরিচিত করিয়া দিয়া আচার্যদেবের আহ্লাদ; দুইজন বাঈজীর আমাদিগের নিকট সন্ধান জানিয়া লইয়া স্বামীজীর নিকট গমন এবং অন্যের নিষেধ সত্ত্বেও স্বামীজীর তাঁহাদিগকে সাদর অভ্যর্থনা করা; আর একজন মুসলমান ভদ্রলোকের এই উক্তিঃ ‘স্বামীজী, যদি ভবিষ্যতে কেহ আপনাকে অবতার বলিয়া দাবী করেন, স্মরণ রাখিবেন যে, আমি মুসলমান হইয়াও তাঁহাদের সকলের অগ্রণী।’
এই নৈনীতালেই স্বামীজী রাজা রামমোহন রায় সম্বন্ধে অনেক কথা বলেন, তাহাতে তিনি তিনটি বিষয় এই আচার্যের শিক্ষার মূলসূত্র বলিয়া নির্দেশ করেনঃ তাঁহার বেদান্ত গ্রহণ, স্বদেশপ্রেম প্রচার, এবং হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে ভালবাসা। এই-সকল বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের উদারতা ও ভবিষ্যদ্দর্শিতা যে কার্যপ্রণালীর সূচনা করিয়াছিল, তিনি নিজে মাত্র তাহাই অবলম্বন করিয়া অগ্রসর হইয়াছেন বলিয়া দাবী করিতেন।
নর্তকীদ্বয়-সংক্রান্ত ঘটনাটি আমাদের নৈনী-সরোবরের উপরে অবস্থিত মন্দিরদ্বয় দর্শন উপলক্ষে ঘটিয়াছিল। এইস্থানে আমরা দুইজন বাঈজীকে পূজায় রত দেখিলাম। পূজান্তে তাহারা আমাদের নিকট আসিল, এবং আমরা ভাঙা ভাঙা ভাষায় তাহাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিলাম। স্বামীজী তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে অস্বীকার করায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মনোমধ্যে একটা আন্দোলন চলিয়াছিল। খেতড়ির বাঈজীর যে গল্প তিনি বারংবার করিতেন, তাহা প্রথমবার সম্ভবতঃ এই নৈনীতালের বাঈজীদের প্রসঙ্গেই বলিয়াছিলেন। খেতড়ির সেই বাঈজীকে দেখিতে যাইবার নিমন্ত্রণ পাইয়া তিনি ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, কিন্তু পরিশেষে অনেক অনুরোধে তথায় গমন করেন এবং তাহার সঙ্গীতটি শ্রবণ করেনঃ
প্রভু মেরা অবগুণ চিত ন ধরো, সমদরশী হৈ নাম তুম্হারো।
এক লোহ পূজামে রহত হৈ, এক রহে ব্যাধ ঘর পরো।
পারশকে মন দ্বিধা নেহী হোয়, দুঁহু এক কাঞ্চন করো॥
এক নদী এক নহর বহত মিলি নীর ভয়ো।
জব মিলে তব এক বরণ হোয়, গঙ্গানাম পরো॥
এক মায়া, এক ব্রহ্ম, কহত সুরদাস ঝগরো।
অজ্ঞানসে ভেদ হোয়, জ্ঞানী কাহে ভেদ করো॥
অতঃপর আচার্যদেব নিজ মুখে বলিয়াছেন, যেন তাঁহার চক্ষের সম্মুখ হইতে একটি পর্দা উঠিয়া গেল এবং, সবই যে এক বৈ দুই নহে—এই উপলব্ধি করিয়া তিনি তারপর আর কাহাকেও মন্দ বলিয়া দেখিতেন না।
যখন আমরা নৈনীতাল হইতে আলমোড়া যাত্রা করিলাম তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, এবং বনপথ অতিবাহন করিতে করিতেই রাত্রি হইয়া গেল। অবশেষে বৃক্ষরাজির অন্তরালে পর্বতগাত্রে অপরূপভাবে স্থাপিত একটি ডাকবাংলায় পৌঁছিলাম। স্বামীজী কিয়ৎক্ষণ পরে দলবলসহ তথায় পৌঁছিলেন। তাঁহার বদন আনন্দোৎফুল্ল, স্বীয় অতিথিগণের স্বাচ্ছন্দ্যবিধায়ক প্রত্যেক খুঁটিনাটির দিকে তাঁহার পূর্ণ দৃষ্টি।
প্রাতরাশের সময় আমাদের নিকট আসিয়া কয়েক ঘণ্টা কথাবার্তায় কাটাইয়া দেওয়া স্বামীজীর পুরাতন অভ্যাস ছিল। আমাদের আলমোড়া পৌঁছিবার দিন হইতেই স্বামীজী এই অভ্যাস পুনরায় শুরু করিলেন। তখন (এবং সকল সময়ই) তিনি অতি অল্প সময় ঘুমাইতেন এবং মনে হয়, তিনি যে এত প্রাতে আমাদের নিকট আসিতেন, তাহা অনেক সময় আরও সকালে সন্ন্যাসিগণের সহিত তাঁহার এক প্রস্থ ভ্রমণ শেষ করিয়া ফিরিবার মুখে। কখনও কখনও, কিন্তু কালেভদ্রে, বৈকালেও আমরা তাঁহার দেখা পাইতাম, হয় তিনিই বেড়াইতে বাহির হইতেন, নয় তো আমরা নিজেরাই, তিনি যেখানে দলবলসহ অবস্থান করিতেছিলেন, সেই ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের গৃহে যাইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতাম।
আলমোড়ার এই প্রাতঃকালীন কথোপকথনগুলিতে একটি নূতন এবং অনুভূতপূর্ব ব্যাপার আসিয়া জুটিয়াছিল। উহার স্মৃতি কষ্টকর হইলেও শিক্ষাপ্রদ। স্বামীজী উল্লাসের সহিত তাঁহার দীক্ষিতা এক ইংরেজ মহিলাকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তুমি এখন কোন্ জাতিভুক্তা? উত্তর শুনিয়া স্বামীজী বিস্মিত হইলেন, দেখিলেন—তিনি ইংরেজের জাতীয় পতাকাকে কি প্রগাঢ় ভক্তি ও পূজার চক্ষে দেখেন; দেখিলেন—একজন ভারতীয় নারীর তাঁহার ইষ্টদেবতার প্রতি যে ভাব, ইহারও এই পতাকার প্রতি অনেকটা সেই ভাব। স্বামীজী বলিয়া উঠিয়াছিলেন, ‘বাস্তবিকই, তোমার যেরূপ স্বজাতিপ্রেম, উহা তো পাপ! অধিকাংশ লোকই যে স্বার্থের প্ররোচনায় কাজ করিয়া থাকে, আমি চাই, তুমি এইটুকু বোঝ; কিন্তু তুমি ক্রমাগত ইহাকে উল্টাইয়া দিয়া বলিয়া থাক যে, একটি জাতিবিশেষের সকলেই দেবতা। অজ্ঞতাকে এরূপে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা তো শয়তানি!’
সুতরাং আলমোড়ার এই প্রাতঃকালীন আলোচনাসমূহ আমাদের সামাজিক, সাহিত্যিক ও ললিতকলা-বিষয়ক বদ্ধমূল পূর্ব সংস্কারগুলির সহিত সংঘর্ষের আকার ধারণ করিত, অথবা তাহাতে ভারতীয় এবং ইওরোপীয় ইতিহাস ও উচ্চ উচ্চ ভাবের তুলনা চলিত, এবং অনেক সময় অতি মূল্যবান্ প্রাসঙ্গিক মন্তব্যও শুনিতে পাইতাম। স্বামীজীর একটি বিশেষত্ব এই ছিল যে, কোন দেশবিশেষ বা সমাজবিশেষের মধ্যে অবস্থানকালে তিনি উহার দোষগুলিকে প্রকাশ্যে এবং তীব্রভাবে সমালোচনা করিতেন, কিন্তু তথা হইতে চলিয়া আসিবার পর যেন সেখানকার গুণ ভিন্ন অন্য কিছুই তাঁহার মনে নাই, এইরূপ বোধ হইত।
===================
অধ্যায় - ০৩
স্থান—আলমোড়া
কাল—মে ও জুন
প্রথন দিন সকালে কথোপকথনের বিষয় ছিল—সভ্যতার মূল আদর্শ প্রতীচ্যে সত্য, প্রাচ্যে ব্রহ্মচর্য। হিন্দু-বিবাহ-রীতিগুলিকে তিনি এই বলিয়া সমর্থন করিলেন যে, তাহার এই আদর্শের অনুসরণের ফলেই জন্মিয়াছে এবং সর্ববিধ সংহতিগঠনেই স্ত্রীলোকের রক্ষাবিধান প্রয়োজন। সমস্ত বিষয়টির অদ্বৈতবাদের সহিত কি সম্বন্ধ, তাহাও তিনি বিশ্লেষণপূর্বক দেখাইলেন।
আর একদিন সকালে তিনি এই বলিয়া কথা আরম্ভ করিলেনঃ যেমন জগতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি মুখ্য জাতি আছে, তেমনি চারিটি মুখ্যজাতীয় কার্যও আছে—ধর্মসন্বন্ধীয় কার্য অর্থাৎ পৌরোহিত্য, যাহা হিন্দুরা নিষ্পন্ন করিতেছে; সামরিক কার্য, যাহা রোমক সাম্রাজ্যের হস্তে ছিল; বাণিজ্যবিষয়ক কার্য, যাহা আজকালকার ইংলণ্ড করিতেছে; এবং প্রজাতন্ত্রমূলক কার্য, যাহা আমেরিকা ভবিষ্যতে সম্পন্ন করিবে। এই স্থলে তিনি, কিরূপে আমেরিকা অতঃপর শূদ্রজাতির স্বাধীনতা এবং একযোগে কার্যকারণরূপ সমস্যাগুলি পূরণ করিবে, সে বিষয়ে কল্পনাসহায়ে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কনে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং যিনি আমেরিকাবাসী নন, এরূপ একজন শ্রোতার দিকে ফিরিয়া মার্কিন জাতি কিরূপ বদান্যতার সহিত সেখানকার আদিম অধিবাসিগণের জন্য বন্দোবস্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, সে বিষয় বর্ণনা করিলেন।
তিনি উল্লাসপূর্বক ভারতবর্ষের অথবা মোগলবংশের ইতিহাসের সার সঙ্কলন করিয়া দিতেন। মোগলগণের গরিমা স্বামীজী শতমুখে বর্ণনা করিতেন। এই সারা গ্রীষ্ম-ঋতুটিতে তিনি প্রায়ই মধ্যে মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া দিল্লী ও আগ্রার বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইতেন। একবার তিনি তাজমহলকে এইরূপ বর্ণনা করেন, ‘ক্ষীণালোক, তারপর আরও ক্ষীণালোক—আর সেখানে একটি সমাধি!’—আর একবার তিনি শাজাহানের কথা বলিতে বলিতে সহসা উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, ‘আহা, তিনিই মোগলকুলের ভূষণস্বরূপ ছিলেন!’ অমন সৌন্দর্যানুরাগ ও সৌন্দর্যবোধ ইতিহাসে আর দেখা যায় না। আবার নিজেও একজন কলাবিদ্ লোক ছিলেন! আমি তাঁহার স্বহস্তচিত্রিত একখানি পাণ্ডুলিপি দেখিয়াছি, সেখানি ভারতবর্ষের কলা-সম্পদের অঙ্গবিশেষ। কি প্রতিভা!’ আকবরের প্রসঙ্গ তিনি আরও বেশী করিয়া করিতেন। আগ্রার সন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাচ্ছাদিত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামীজীর কণ্ঠ যেন অশ্রুগদগদ হইয়া আসিত।
সর্ববিধ বিশ্বজননী ভাবও আচার্যদেবের হৃদয়ে উদিত হইত। একদিন তিনি চীনদেশকে জগতের কোষাগার বলিয়া বর্ণনা করিলেন; এবং বলিলেন, তত্রত্য মন্দিরগুলির দ্বারদেশের উপরিভাগে প্রাচীন বাঙলা-লিপি খোদিত দেখিয়া তাঁহার রোমাঞ্চ হইয়াছিল।
কথাপ্রসঙ্গে তিনি সুদূর ইটালী পর্যন্ত চলিয়া যাইতেন। ইটালী তাঁহার নিকট ‘ইওরোপের সকল দেশের শীর্ষস্থানীয়, ধর্ম ও শিল্পের দেশ, একাধারে সাম্রাজ্যসংহতি ও ম্যাটসিনির জন্মভূমি, এবং উচ্চভাব সভ্যতা ও স্বাধীনতার প্রসূতি!’
একদিন শিবাজী ও মহারাষ্ট্র-জাতি সম্বন্ধে এবং কিরূপে শিবাজী সাধুবেশে বর্ষব্যাপী ভ্রমণের ফলে রায়গড় প্রত্যাবর্তন করেন, সে বিষয়ে কথা হইল। স্বামীজী বলিলেন, ‘আজও পর্যন্ত ভারতের কর্তৃপক্ষ সন্ন্যাসীকে ভয় করে, পাছে তাহার গৈরিক বসনের নীচে আর একজন শিবাজী লুক্কায়িত থাকে।’
অনেক সময়, ‘আর্যগণ কাহারা এবং তাঁহাদের লক্ষণ কি?’—এই প্রশ্ন তাঁহার পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করিত। তাঁহাদের উৎপত্তি-নির্ণয় এক জটিল সমস্যা—এইরূপ মত প্রকাশ করিয়া তিনি কিরূপে সুইজারলণ্ডে থাকিয়াও বোধ করিতেন যেন চীনদেশে রহিয়াছেন—উভয় জাতির আকৃতিগত সাদৃশ্য এত বেশী, সে গল্পও আমাদের নিকট করিতেন। নরওয়ের কতক অংশের সম্বন্ধেও এটি সত্য বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল। তারপর দেশভেদে আকৃতিভেদ সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য এবং সেই হাঙ্গেরীদেশীয় পণ্ডিতের মর্মস্পর্শী গল্প (যিনি ‘তিব্বতই হুনদিগের আদিস্থান’ এই আবিষ্কার করিয়াছিলেন এবং দার্জিলিঙে যাঁহার সমাধি আছে)—এইরূপ নানা কথা শুনিতে পাইতাম।
কখনও কখনও ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়গণের বিরোধের আলোচনা-প্রসঙ্গে স্বামীজী ভারতবর্ষের সমগ্র ইতিহাসকে এতদুভয়ের সংঘর্ষ মাত্র বলিয়া বর্ণনা করিতেন; এবং জাতির উন্নতিশীল, এবং শৃঙ্খল-অপনয়নকারী প্রেরণাসমূহ ক্ষত্রিয়গণের মধ্যেই চিরকাল নিহিত ছিল, তাহাও বলিতেন। আধুনিক বাঙলার কায়স্থগণই যে মৌর্যরাজত্বের পূর্বতন ক্ষত্রিয়কুল, তাঁহার এই বিশ্বাসের অনুকূলে তিনি উৎকৃষ্ট যুক্তির অবতারণা করিতে পারিতেন। তিনি এই দুই পরস্পরবিরোধী সভ্যতাদর্শের এইরূপ চিত্র উপস্থাপিত করিতেনঃ একটি প্রাচীন, গভীর এবং পরম্পরাগত আচার-ব্যবহারের প্রতি চিরবর্ধমান-শ্রদ্ধাসম্পন্ন; অপরটি স্পর্ধাশীল, আবেগপ্রবণ এবং উদারদৃষ্টি-সম্পন্ন। রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান্ বুদ্ধ—ইঁহারা সকলেই ব্রাহ্মণকুলে না জন্মিয়া যে ক্ষত্রিয়কুলে উৎপন্ন হইয়াছিলেন, সেটি ঐতিহাসিক ক্রমপরিণতির এক গভীর নিয়মেরই ফলস্বরূপ। এই আপাত-বিসংবাদী সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যাত হইবামাত্র মনে হইত, বৌদ্ধধর্ম জাতিভেদ ধ্বংস করিবার একটি সূত্র—‘ক্ষত্রিয়কুল কর্তৃক উদ্ভাবিত ধর্ম’ ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাঙ্ঘাতিক প্রতিপক্ষ।
বুদ্ধ সম্বন্ধে স্বামীজী যে সময় কথা কহিতেন, সেটি একটি মাহেন্দ্রক্ষণ; কারণ জনৈক শ্রোত্রী স্বামীজীর একটি কথা হইতে বৌদ্ধধর্মের ব্রাহ্মণ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবটিই তাঁহার মনোগত ভাব, এই ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত করিয়া বলিলেন, ‘স্বামীজী! আমি জানিতাম না যে, আপনি বৌদ্ধ!’ উক্ত নাম শ্রবণে তাঁহার মুখমণ্ডল দিব্যভাবে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘আমি বুদ্ধের দাসানুদাসগণের দাস। তাঁহার মত কেহ কখনও জন্মিয়াছেন কি? স্বয়ং ভগবান্ হইয়াও তিনি নিজের জন্য একটি কাজও করেন নাই—আর কি হৃদয়! সমস্ত জগৎটাকে তিনি ক্রোড়ে টানিয়া লইয়াছেন। এত দয়া যে, রাজপুত্র এবং সন্ন্যাসী হইয়াও একটি ছাগশিশুকে বাঁচাইবার জন্য প্রাণ দিতে উদ্যত! এত প্রেম যে, এক ব্যাঘ্রীর ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য স্বীয় শরীর পর্যন্ত দান করিয়াছিলেন এবং আশ্রয়দাতা এক চণ্ডালের জন্য আত্মবলি দিয়া তাহাকে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন! আর আমার বাল্যকালে একদিন তিনি আমার গৃহে আসিয়াছিলেন, আমি তাঁহার পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হইয়াছিলাম! কারণ, আমি বুঝিয়াছিলাম ভগবান্ বুদ্ধই স্বয়ং আসিয়াছেন!’
অনেক বার—কখনও বেলুড়ে অবস্থানকালে এবং কখনও তাহার পরে—তিনি এই ভাবে বুদ্ধদেবের কথা বলিয়াছিলেন। একদিন তিনি আমাদিগকে—প্রাণস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করিয়া বলেন সেই রূপসী অম্বাপালীর উপাখ্যান, যিনি মুখ্যবারাঙ্গনা হইয়াও বুদ্ধকে পরিতোষপূর্বক ভোজন করাইয়াছিলেন।
একদিন প্রাতঃকালে এক সর্বাপেক্ষা অধিক নূতনত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা হইয়াছিল। সেদিনকার দীর্ঘ আলোচনার বিষয় ছিল ‘ভক্তি’—প্রেমাস্পদের সহিত সম্পূর্ণ তাদাত্ম্য, যাহা চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ভূম্যধিকারী ভক্তবীর রায় রামানন্দের মুখে এরূপ সুন্দরভাবে প্রকাশ পাইয়াছেঃ
পহিলহি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল;
অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।
না সো রমণ, না হাম রমণী
দুঁহু মন মনোভাব পেশল জানি।৫
সেই দিন প্রাতঃকালেই তিনি পারস্যের বাব-পন্থিগণের (Babists) কথা বলিয়াছিলেন—সেই পরার্থে আত্মবলিদানের যুগের কথা, যখন স্ত্রীজাতিকর্তৃক অনুপ্রাণিত হইয়া পুরুষগণ কাজ করিত এবং তাহাদিগকে ভক্তির চক্ষে দেখিত। নিশ্চিয় সেই সময়েই তিনি বলিয়াছিলেন, প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া ভালবাসিতে পারে বলিয়াই তরুণবয়স্কগণের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব; এবং তাহাদের মধ্যে ভাবী মহৎ কার্যের বীজ সূক্ষ্মভাবে নিহিত থাকে—ইহাই তাঁহার ধারণা।
আর একদিন অরুণোদয়কালে উদ্যান হইতে যখন ঊষার আলোকরঞ্জিত চিরতুষাররাশি দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, সেই সময় স্বামীজী আসিয়া শিব ও উমা সম্বন্ধে দীর্ঘ আলাপ করিতে করিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘ঐ যে ঊর্ধ্বে শ্বেতকায় তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গরাজি, উহাই শিব; আর তাঁহার উপর যে আলোকসম্পাত হইয়াছে, তাহাই জগজ্জননী!’ কারণ, এই সময়ে এই চিন্তাই তাঁহার মনকে বিশেষভাবে অধিকার করিয়াছিল যে, ঈশ্বরই জগৎ—তিনি জগতের ভিতরে বা বাহিরে নহেন, আর জগৎও ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিমা নহে, পরন্তু ঈশ্বরই এই জগৎ এবং যাহা কিছু আছে সব।
একদিন সন্ধ্যাকালে পরমহংস শুকের আখ্যানটি আমরা শুনিয়াছিলাম।
বাস্তবিক, শুকই ছিলেন স্বামীজীর মনের মত যোগী। তাঁহার নিকট শুক সেই সর্বোচ্চ অপরোক্ষানুভূতির আদর্শরূপ, যাহার তুলনায় জীবজগৎ ছেলেখেলা মাত্র! বহুদিন পরে আমরা শুনিয়াছিলাম কিশোর স্বামীজী (নরেন্দ্রনাথ)-কে শ্রীরামকৃষ্ণ বর্ণনা করিয়াছিলেন ‘যেন আমার শুকদেব’। ‘অহং বেদ্মি শুকো বেত্তি ব্যাসো বেত্তি ন বেত্তি বা’—গীতার প্রকৃত অর্থ আমি জানি এবং শুক জানে, আর ব্যাস জানিলেও জানিতে পারেন। ভগবদ্গীতার গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ এবং শুকের মাহাত্ম্য-দ্যোতক এই শিববাক্য দাঁড়াইয়া উচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহার মুখে যে অপূর্ব ভাবের বিকাশ হইয়াছিল, তাহা আমি কখনই ভুলিতে পারিব না; তিনি যেন আনন্দসমুদ্রের গভীর তলদেশ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।
আর একদিন স্বামীজী, হিন্দু-সভ্যতার চিরন্তন উপকূলে—আধুনিক চিন্তাতরঙ্গরাজির বহুদূরব্যাপী প্লাবনের প্রথম ফলস্বরূপ বঙ্গদেশে যে-সকল উদারহৃদয় মহাপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাঁহাদিগের কথা বলিয়াছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের কথা আমরা ইতঃপূর্বেই নৈনীতালে তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম। এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে তিনি সাগ্রহে বলিলেন, ‘উত্তর ভারতে আমার বয়সের এমন একজন লোকও নাই, যাহার উপর তাঁহার প্রভাব না পড়িয়াছে!’ এই দুই ব্যক্তি এবং শ্রীরামকৃষ্ণ যে একই অঞ্চলে মাত্র কয়েক ক্রোশের ব্যবধানে জন্মিয়াছেন, এ কথা মনে হইলে তিনি যারপরনাই আনন্দ অনুভব করিতেন।
স্বামীজী এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমাদের নিকট ‘বিধবাবিবাহ-প্রবর্তনকারী এবং বহুবিবাহ-রোধকারী মহাবীর’ বলিয়া উল্লেখ করিলেন। কিন্তু সে-সম্বন্ধে তাঁহার (বিদ্যাসাগরের) একটি প্রিয় গল্প ছিল, সেটি এইঃ
একদিন তিনি ব্যবস্থাপক সভা হইতে—এই চিন্তা করিতে করিতে গৃহে ফিরিতেছেন, ঐরূপ স্থানে সাহেবী পরিচ্ছদ পরিধান করা উচিত কিনা, এমন সময় তিনি দেখিলেন যে, ধীরে সুস্থে এবং গুরুগম্ভীর চালে গৃহগমনরত এক স্থূলকায় মোগলের নিকট এক ব্যক্তি দ্রুতপদে আসিয়া সংবাদ দিল, ‘মহাশয়, আপনার বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছে!’ এই সংবাদে মোগলপ্রবরের গতির লেশমাত্রও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিল না; ইহা দেখিয়া সংবাদবাহক ইঙ্গিতে ঈষৎ বিজ্ঞজনোচিত বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছিল। তৎক্ষণাৎ তাহার প্রভু ক্রোধে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘পাজি! খানকয়েক বাখারি পুড়িয়া যাইতেছে বলিয়া তুই আমায় বাপ-পিতামহের চাল ছাড়িয়া দিতে বলিস!’—এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাহার পশ্চাতে আসিতে আসিতে দৃঢ় সঙ্কল্প করিলেন যে, ধুতি চাদর এবং চটি জুতা কোনক্রমে ছাড়া হইবে না; ফলে দরবার যাত্রাকালে একটা জামা ও একজোড়া জুতা পর্যন্ত পরিলেন না!
‘বালবিধবাগণের বিবাহ চলিতে পারে কিনা?’—মাতার এইরূপ সাগ্রহ প্রশ্নে শাস্ত্রপাঠার্থ বিদ্যাসাগরের একমাসের জন্য নির্জনগমনের চিত্রটি খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। নির্জনবাসের পর তিনি শাস্ত্র এরূপ পুনর্বিবাহের প্রতিপক্ষ নহেন’, এই মত প্রকাশ করিয়া এ-বিষয়ে পণ্ডিতগণের স্বাক্ষরযুক্ত সম্মতি-পত্র সংগ্রহ করিলেন। পরে কতিপয় দেশীয় রাজা ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হওয়ায় পণ্ডিতগণ নিজ নিজ স্বাক্ষর প্রত্যাহার করিলেন; সুতরাং সরকার বাহাদুর এই আন্দোলনের পক্ষে সাহায্য করিতে কৃতসঙ্কল্প না হইলে ইহা কখনই আইনরূপে পরিণত হইত না। স্বামীজী আরও বলিলেন, ‘আর আজকাল এই সমস্যা সামাজিক ভিত্তির উপর স্থাপিত না হইয়া বরং একটা অর্থনীতিসংক্রান্ত ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’
যে ব্যক্তি কেবল নৈতিক বলে বহুবিবাহকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তিনি যে প্রভূত আধ্যাত্মিকশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, তাহা আমরা অনুধাবন করিতে পারিলাম। যখন শুনিলাম যে, এই মহাপুরুষ ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে অনাহারে এবং রোগে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় মর্মাহত হইয়া ‘আর ভগবান্ মানি না’ বলিয়া সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞেয়বাদের চিন্তাস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন, তখন ‘পোশাকী’ মতবাদের উপর ভারতবাসীর কিরূপ অনাস্থা, তাহা সম্যক্ উপলব্ধি করিয়া আমরা যারপরনাই বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিলাম।
বাঙলার শিক্ষাব্রতীদের মধ্যে একজনের নাম স্বামীজী ইঁহার নামের সহিত উল্লেখ করিয়াছিলেন, তিনি ডেভিড হেয়ার; সেই বৃদ্ধ স্কটল্যাণ্ডবাসী নিরীশ্বরবাদী—মৃত্যুর পর যাঁহাকে কলিকাতার যাজকবৃন্দ ঈশাহিজনোচিত সমাধি-দানে অস্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি বিসূচিকারোগাক্রান্ত এক পুরাতন ছাত্রের শুশ্রূষা করিতে করিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁহার নিজ ছাত্রগণ তাঁহার মৃতদেহ বহন করিয়া এক সমতল ভূমিখণ্ডে সমাধিস্থল করিল, এবং উক্ত সমাধি তাহাদের নিকট এক তীর্থে পরিণত হইল। সেই স্থানই আজ শিক্ষার কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া কলেজ স্কোয়ার নামে অভিহিত হইয়াছে, আর তাঁহার বিদ্যালয়ও আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত, এবং আজিও কলিকাতার ছাত্রবৃন্দ তীর্থের ন্যায় তাঁহার সমাধিস্থান দর্শনে গিয়া থাকে।
এইদিন আমরা কথাবার্তার মধ্যে কোন সুযোগে স্বামীজীকে জেরা করিয়া বসিলাম—ঈশাহিধর্ম তাঁহার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে কিনা। এইরূপ সমস্যা যে কেহ সাহস করিয়া উত্থাপন করিতে পারিয়াছে, ইহা শুনিয়া তিনি হাস্য সংবরণ করিতে পারিলেন না; এবং আমাদিগকে খুব গৌরবের সহিত বলিলেন যে, তাঁহার পুরাতন শিক্ষক স্কটল্যাণ্ডবাসী হেষ্টিসাহেবের সহিত মেলামেশাতেই ঈশাদি প্রচারকগণের সহিত তাঁহার একমাত্র সংস্পর্শলাভ ঘটিয়াছিল। এই উগ্রমস্তিষ্ক বৃদ্ধ অতি সামান্য ব্যয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন এবং নিজ গৃহকে তাঁহার ছাত্রদেরই গৃহ বলিয়া মনে করিতেন। তিনি প্রথমে স্বামীজীকে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাইতে বলিয়াছিলেন, এবং তাঁহার ভারত-প্রবাসের শেষভাগে বলিতেন, ‘হাঁ বাবা, তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! সত্যই সব ঈশ্বর!’ স্বামীজী সানন্দে বলিলেন, ‘আমি তাঁহার সম্পর্কে গৌরবান্বিত, তিনি যে আমাকে তেমন ঈশাহিভাবাপন্ন করিয়াছিলেন, এ-কথা তোমরা বলিতে পার কি? আমার তো মনে হয় না।’
লঘুতর প্রসঙ্গেও আমরা চমৎকার চমৎকার গল্প শুনিতাম। তাহার একটিঃ আমেরিকার এক নগরে স্বামীজী এক ভাড়াটিয়া বাড়ীতে বাস করিতেন। সেখানে তাঁহাকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে হইত, রন্ধনকালে এক অভিনেত্রী এবং এক দম্পতির সহিত তাঁহার প্রায়ই দেখা হইত। অভিনেত্রী প্রত্যহ একটি করিয়া পেরু কাবাব করিয়া খাইত এবং সেই দম্পতি লোকের ভূত নামাইয়া জীবিকা নির্বাহ করিত। স্বামীজী ঐ ভদ্রলোকটিকে তাঁহার লোকঠকান ব্যবসা হইতে নিবৃত্তি করিবার জন্য ভর্ৎসনা-সহকারে বলিতেন, ‘তোমার এরূপ করা কখনও উচিত নহে।’ অমনি স্ত্রীটি পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়া সাগ্রহে বলিত, ‘হাঁ, মহাশয়! আমিও তো উঁহাকে ঠিক ঐ কথাই বলিয়া থাকি; কারণ উনিই যত ভূত সাজিয়া মরেন, আর টাকাকড়ি যা কিছু তা মিসেস উইলিয়াম্স্ই লইয়া যায়।’
এক ইঞ্জিনীয়র যুবকের গল্পও বলিয়াছিলেন। লোকটি লেখাপড়া জানিত। একদিন ভূতুড়ে কাণ্ডের অভিনয়কালে স্থূলকায়া মিসেস উইলিয়াম্স্ পর্দার আড়াল হইতে তাহার ক্ষীণকায়া জননীরূপে আবির্ভূতা হইলে সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘মা, মা, তুমি প্রেতরাজ্যে গিয়া কি মোটাই হইয়াছ!’ স্বামীজী বলিলেন, ‘এই দৃশ্য দেখিয়া আমি মর্মাহত হইলাম; কারণ আমার মনে হইল যে, লোকটার মাথা একেবারে বিগড়াইয়াছে!’ কিন্তু স্বামীজী হটিবার পাত্র নহেন। তিনি সেই ইঞ্জিনীয়র যুবককে এক রুশদেশীয় চিত্রকরের গল্প বলিলেন। চিত্রকর এক কৃষকের মৃত পিতার আলেখ্য অঙ্কিত করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, এবং আকৃতির পরিচয়স্বরূপে এইমাত্র শুনিয়াছিলেন, ‘তোমায় তো বাপু—কতবার বলিলাম, তাঁর নাকের উপর একটি আঁচিল ছিল!’ অবশেষে চিত্রকর এক সাধারণ কৃষকের চিত্র অঙ্কিত করিয়া, তাহার নাসিকাদেশে এক বৃহৎ আঁচিল বসাইয়া দিয়া সংবাদ দিলেন, ‘ছবি প্রস্তুত’ এবং কৃষকপুত্রকে উহা দেখিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। সে আসিয়া কিছুক্ষণ চিত্রের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকিবার পর শোকবিহ্বল চিত্তে বলিয়া উঠিল, ‘বাবা! বাবা! তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর তুমি কত বদলে গেছ!’ এই ঘটনার পরে ইঞ্জিনীয়র যুবক আর স্বামীজীর সঙ্গে বাক্যালাপ করিত না।
যাহা হউক, এই প্রকার সাধারণভাবে চিত্তাকর্ষক নানা বিষয় থাকা সত্ত্বেও স্বামীজীর মনের ভিতর এই সময় একটা সংগ্রাম প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। জীবনে নির্যাতনের কথা আশ্চর্যভাবে তিনি অনেকবার বলিয়াছিলেন; এবং তাঁহার বিশ্রাম ও শান্তির যে একান্ত প্রয়োজন হইয়াছিল—এ বিষয়ে তিনি দু-একটি কথা বলিয়াছিলেন বটে, অতি অল্প হইলেও তাহাই যথেষ্ট। তিনি কয়েক ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘নির্জনবাসের জন্য আমার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছে, আমি একাকী বনাঞ্চলে যাইয়া শান্তিলাভ করিব।’
তারপর ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিয়া, তিনি মাথার উপর তরুণ চন্দ্রের দীপ্তি দেখিতে পাইয়া বলিলেন, ‘মুসলমানগণ শুক্লপক্ষীয় শশিকলাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিয়া থাকেন। আইস, আমরাও নবীন শশিকলার সহিত নবজীবন আরম্ভ করি!’—এই বলিয়া তিনি তাঁহার মানস-কন্যাকে প্রাণ খুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন।
২৫ মে। তিনি যেদিন যাত্রা করিলেন, সেদিন বুধবার। শনিবারে ফিরিয়া আসিলেন। পূর্বেও তিনি প্রতিদিন দশঘণ্টা করিয়া অরণ্যানীর নির্জনতার মধ্যে বাস করিতেন বটে কিন্তু রাত্রিকালে নিজ তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলে চারিদিক হইতে এত লোক সঙ্গলাভের জন্য সাগ্রহে তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিত যে, তাঁহার ভাব ভঙ্গ হইয়া যাইত, এবং সেইজন্যই তিনি এইরূপে পলায়ন করিয়াছিলেন। এখন তাঁহার মুখমণ্ডলে জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠিয়াছে। তিনি দেখিয়াছেন যে, তিনি এখনও সেই পুরাতন, নগ্নপদে ভ্রমণক্ষম এবং শীতাতপ ও অল্পাহার-সহিষ্ণু সন্ন্যাসীই আছেন; প্রতীচ্য-বাস তাঁহার ক্ষতি করিতে পারে নাই।
২ জুন। শুক্রবার প্রাতঃকালে আমরা বসিয়া কাজ কর্ম করিতেছিলাম, এমন সময়ে এক ‘তার’ আসিল। তারটি একদিন দেরীতে আসিয়াছিল। তাহাতে লেখা ছিল—‘কল্য রাত্রে উতকামণ্ডে গুডউইনের দেহত্যাগ হইয়াছে।’ সে অঞ্চল যে (typhoid) মহামারীর সূত্রপাত হইতেছিল, আমাদের বন্ধু তাহারই করালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন; তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীজীর কথা কহিয়াছিলেন।
৫ জুন। রবিবার সন্ধ্যার সময় স্বামীজী স্বীয় আবাসে ফিরিয়া আসিলেন। আমাদের ফটক এবং উঠান হইয়াই তাঁহার রাস্তা। তিনি সেই রাস্তা ধরিয়া আসিলেন এবং সেই প্রাঙ্গণে আমরা মুহূর্তেকের জন্য বসিয়া তাঁহার সহিত কথা কহিলাম। তিনি দুঃসংবাদের বিষয় জানিতেন না, কিন্তু ইতঃপূর্বেই যেন এক গভীর বিষাদচ্ছায়া তাঁহাকেও আচ্ছন্ন করিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া তিনি আমাদিগকে সেই মহাপুরুষের৬ কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন, যিনি গোখুরা সর্প কর্তৃক দষ্ট হইয়া এইমাত্র বলিয়াছিলেন, ‘প্রেমময়ের নিকট হইতে দূত আসিয়াছে,’ এবং যাঁহাকে স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, এইমাত্র আমি এক পত্র পাইলাম, তাহাতে লেখা আছে ‘পওহারী বাবা নিজ দেহ দ্বারা তাঁহার যজ্ঞসমূহের পূর্ণাহুতি প্রদান করিয়াছে। হোমাগ্নিতে তিনি স্বীয় দেহ ভস্মীভূত করিয়াছেন।’ তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিলেন, ‘স্বামীজী! এটি কি অত্যন্ত খারাপ কাজ হয় নাই?’
স্বামীজী গভীর আবেগ-কম্পিতকণ্ঠে উত্তর করিলেন, ‘তাহা আমি জানি না। তিনি এত বড় মহাপুরুষ ছিলেন যে, আমি তাঁহার কার্যকলাপ বিচার করিবার অধিকারী নই। তিনি কি করিতেছিলেন, তাহা তিনিই জানিতেন।’
৬ জুন। পরদিন প্রাতে তিনি খুব সকাল সকাল আসিলেন। দেখিলাম, তিনি এক গভীরভাবে ভাবিত। পরে বলিলেন যে, তিনি রাত্রি চারিটা হইতেই জাগরিত এবং একজন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া গুডউইন-সাহেবের মৃত্যুসংবাদ তাঁহাকে দিয়াছে। আঘাতটি তিনি নীরবে সহিয়া লইলেন, কয়েক দিন পরে তিনি যে-স্থানে প্রথম ইহা পাইয়াছিলেন, সে-স্থানেই আর থাকিতে চাহিলেন না; বলিলেন, তাঁহার সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত শিষ্যের আকৃতি রাতদিন তাঁহার মনে পড়িতেছে, এবং ইহা যে দুর্বলতা, এ-কথাও জ্ঞাপন করিলেন। ইহা যে দোষাবহ, তাহা দেখাইবার জন্য তিনি বলিলেন যে, কাহারও স্মৃতি দ্বারা এইরূপে পীড়িত হওয়াও যা, আর ক্রমবিকাশের উচ্চতর সোপানে মৎস্য কিম্বা কুক্কুরসুলভ লক্ষণগুলি অবিকল বজায় রাখাও তাই, ইহাতে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নাই। মানুষকে এই ভ্রম জয় করিতে হইবে এবং জানিতে হইবে যে, মৃতব্যক্তিগণ যেমন আগে ছিলেন, এখনও ঠিক তেমনি—এইখানে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। তাঁহাদের অনুপস্থিতি এবং বিচ্ছেদটাই শুধু কাল্পনিক। আবার পরক্ষণেই কোন ব্যক্তিবিশেষের (সগুণ ঈশ্বরের) ইচ্ছানুসারে এই জগৎ পরিচালিত হইতেছে, এইরূপ নির্বুদ্ধিতামূলক কল্পনার বিরুদ্ধে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, ‘গুডউইনকে মারিয়া ফেলার জন্য এরূপ ঈশ্বরকে যুদ্ধে নিপাত করাটা মানুষের অধিকার এবং কর্তব্যের মধ্যে নহে কি?—গুডউইন বাঁচিয়া থাকিলে কত বড় বড় কাজ করিতে পারিত!
স্বামীজীর এই উক্তিটির সহিত, এক বৎসর পরে যে আর একটি উক্তি শুনিয়াছিলাম, তাহার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। আমরা যে-সকল অলীক কল্পনা সহায়ে সান্ত্বনা পাইবার চেষ্টা করি, তাহা দেখিয়া ঠিক এইরূপ তীব্র বিস্ময়ের সহিত তিনি বলিয়া উঠিয়াছিলেন, ‘দেখ, প্রত্যেক ক্ষুদ্র শাসক এবং কর্মচারীর জন্য অবসর ও বিশ্রামের সময় নির্দিষ্ট আছে। আর চিরন্তন শাসক ঈশ্বরই বুঝি শুধু চিরকাল বিচারাসনে বসিয়া থাকিবেন, তাঁহার আর কখনও ছুটি মিলিবে না!’
কিন্তু এই প্রথম কয়েক ঘণ্টা স্বামীজী তাঁহার বিয়োগদুঃখে অটল রহিলেন এবং আমাদের সহিত বসিয়া ধীরভাবে নানা কথা কহিতে লাগিলেন। সেদিন প্রাতঃকালে তিনি ক্রমাগত ভক্তি যে তপস্যায় পরিণত হয়, সেই কথা বলিতে লাগিলেন, কিরূপে প্রগাঢ় ভগবৎ-প্রেমের খরতর প্রবাহ মানুষকে ব্যক্তিত্বের সীমা ছাড়াইয়া বহুদূর ভাসাইয়া লইয়া গেলেও আবার তাহাকে এমন একস্থানে ছাড়িয়া দিয়া যায়, যেখানে সে ব্যক্তিত্বের মধুর বন্ধন হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য ছটফট করে।
সেদিন সকালের ত্যাগসম্বন্ধীয় উপদেশসমূহ শ্রোতৃবর্গের মধ্যে একজনের নিকট অতি কঠিন বলিয়া বোধ হইল; পুনরায় তিনি আসিলে উক্ত মহিলা তাঁহাকে বলিলেন, ‘আমার ধারণা—অনাসক্ত হইয়া ভালবাসায় কোনরূপ দুঃখোৎপত্তির সম্ভাবনা নাই, এবং ইহা স্বয়ংই সাধ্যস্বরূপ।’
হঠাৎ গম্ভীরভাব ধারণ করিয়া স্বামীজী তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এই যে ত্যাগ-রহিত ভক্তির কথা বলিতেছ, এটা কি? ইহা অত্যন্ত হানিকার!’ সত্যই যদি অনাসক্ত হইতে হয়, তবে কিরূপ কঠোর আত্মসংযমের অভ্যাস আবশ্যক, কিরূপে স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলির আবরণ উন্মোচন করা চাই এবং অতি কুসুম-কোমল হৃদয়েরও যে, যে-কোন মুহূর্তে সংসারের পাপ-কালিমায় কলুষিত হইবার আশঙ্কা বর্তমান, এই সম্বন্ধে তিনি সেইখানে এক ঘণ্টা বা ততোধিক কাল দাঁড়াইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। তিনি সেই ভারতবর্ষীয়া সন্ন্যাসিনীর কথা উল্লেখ করিলেন, যিনি ‘মানুষ কখনও ধর্মপথে আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ জ্ঞান করিতে পারে?’ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া উত্তরস্বরূপ ‘এক খুরি ছাই’ প্রেরণ করিয়াছিলেন। রিপুগণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সুদীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর, এবং যে-কোন মুহূর্তেই বিজেতার বিজিত হওয়ার আশঙ্কা রহিয়াছে।
বহু সপ্তাহ পরে কাশ্মীরে যখন তিনি পুনরায় (ত্যাগ, সংযম, দীনতার) কথা কহিতেছিলেন, সেই সময় আমাদের মধ্যে একজন সাহস করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—তিনি এইরূপে যে-ভাবের উদ্রেক করিয়া দিতেছেন, উহা ইওরোপ যে দুঃখ-উপাসনাকে রোগীর লক্ষণ বলিয়া অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখে, তাহাই কিনা?
মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া স্বামীজী উত্তর করিলেন, ‘আর সুখের পূজাটাই বুঝি ভারি উঁচুদরের জিনিষ?’ তারপর একটু থামিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘কিন্তু আসল কথা এই যে, আমরা দুঃখেরও পূজা করি না, সুখেরও পূজা করি না; এই উভয়ের মধ্য দিয়া যাহা সুখদুঃখের অতীত, তাহাই লাভ করা আমাদের উদ্দেশ্য।’
৯ জুন। এই বৃহস্পতিবার প্রভাতে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে কথাবার্তা হইল। জন্মগত হিন্দু শিক্ষাদীক্ষার জন্য স্বামীজীর মনের এক বিশেষত্ব এই ছিল যে, তিনি হয়তো একদিন কোন একটি ভাবে ভাবিত হইয়া সেই ভাবের গুণব্যাখ্যা করিলেন, আবার পর দিনই হয়তো উহাকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করিয়া একেবারে বিধ্বস্ত করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারিতেন। এইরূপ চিন্তাপ্রণালীর প্রথম আভাস তিনি বাল্যকালে তাঁহার গুরুদেবের নিকট পাইয়াছিলেন। কোন এক ধর্মভাবের ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা-বিষয়ে সন্দিহান হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, ‘কি! তাহা হইলে তুমি কি মনে কর না যে, যাহারা এরূপ সব ভাবের ধারণা করিতে পারিত, তাহারাই সেই সব ভাবের মূর্তিমান বিগ্রহ ছিল?’
যেমন খ্রীষ্টের অস্তিত্ব-বিষয়ে, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব-সম্বন্ধেও তিনি কখনও কখনও তাঁহার স্বভাবসুলভ সাধারণ সন্দেহের ভাবে কথাবার্তা বলিতেনঃ ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদই সৌভাগ্যক্রমে ‘শত্রু-মিত্র’ দুই-ই পাইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের জীবনের ঐতিহাসিক অংশে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তো সকলের চেয়ে বেশী অস্পষ্ট। কবি, রাখাল, শক্তিশালী শাসক, যোদ্ধা এবং ঋষি—হয়তো এই সব ভাবগুলি একত্র করিয়া গীতাহস্তে এক সুন্দর মূর্তিতে পরিণত করা হইয়াছিল।
আজ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সকল অবতারের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বর্ণিত হইলেন, পরবর্তী অপূর্ব চিত্রে ভগবান্ সারথিবেশে অশ্বগুলিকে সংযত করিয়া রণক্ষত্রের চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন এবং নিমেষে ব্যূহসংস্থান লক্ষ্য করিয়া শিষ্যস্থানীয় রাজপুত্রকে গীতার গভীর আধ্যাত্মিক সত্যগুলি শুনাইতে আরম্ভ করিলেন।
স্বামীজী একটা কথা বারংবার বলিতেন যে, ভারতবর্ষীয় বৈষ্ণবগণ কল্পনামূলক গীতিকাব্যের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।
কিন্তু এই কয় দিবস যাবৎ স্বামীজী কোথাও গিয়া একাকী বাস করিবার জন্য ছটফট করিতেছিলেন। যে-স্থানে তিনি গুডউনের মৃত্যুসংবাদ পাইয়াছেন, সেই স্থান তাঁহার নিকট অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল, এবং পত্র আদান-প্রদানে সেই ক্ষত ক্রমাগত নূতন হইয়া উঠিতেছিল। একদিন তিনি বলিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বাহির হইতে কেবল ভক্তিময় বলিয়া মনে হইলেও প্রকৃতপক্ষে ভিতরে তিনি পূর্ণ জ্ঞানময় ছিলেন; কিন্তু তিনি (স্বামীজী) নিজে বাহ্যতঃ কেবল জ্ঞানময় বলিয়া মনে হইলেও ভিতরে ভক্তিতে পূর্ণ, এবং সেইজন্য মাঝে মাঝে তাঁহাতে নারী-সুলভ দুর্বলতা ও কোমলতার ভাব দেখা যাইত।
একদিন তিনি কোন একজনের লেখার কয়েকটি ক্রুটিপূর্ণ পঙ্ক্তি লইয়া গেলেন এবং উহাকে একটি ক্ষুদ্র কবিতারূপে৭ফিরাইয়া আনিলেন। সেটি স্বামিহীনা গুডউইন-জননীকে তাঁহার পুত্রের স্মরণে স্বামীজী-প্রদত্ত চিহ্নস্বরূপ প্রেরিত হইল।
সংশোধনের পর আসল কবিতাটির কিছুই রহিল না বলিয়া এবং যাঁহার লেখা সংশোধিত হইল, তিনি ক্ষুণ্ণ হইবেন এইরূপ আশঙ্কা করিয়া, তিনি আগ্রহ-সহকারে অনেকক্ষণ ধরিয়া বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিতে লাগিলেন, ‘কেবল ছন্দ ও মাত্রা মিলাইয়া কথা গাঁথা অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণভাবে অনুভব করা কত বড় জিনিষ!’
১০ জুন। আলমোড়া-বাসের শেষদিন অপরাহ্নে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের সেই প্রাণঘাতিনী পীড়ার গল্প শুনিলাম। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার আহূত হইয়াছিলেন। তিনি আসিয়া রোগটিকে রোহিণী নামক ব্যাধি (Cancer) বলিয়া নির্দেশ করেন এবং ফিরিবার পূর্বে শিষ্যগণকে বহুবার বুঝাইয়া দেন—ইহা সংক্রামক রোগ। অর্ধ ঘণ্টা পরে ‘নরেন্দ্র’ (তখন তাঁহার ঐ নাম ছিল) আসিয়া দেখিলেন, শিষ্যেরা একত্র হইয়া ঐ-বিষয়ে আলোচনা করিতেছেন। ডাক্তার কি বলিয়া গিয়াছেন নিবিষ্টচিত্তে শুনিয়া, তারপর মেজের দিকে তাকাইয়া তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের গোড়ায় ভুক্তাবশিষ্ট পায়সের বাটিটি দেখিতে পাইলেন। গলদেশের খাদ্যবাহী নলীটির সঙ্কোচনবশতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ উক্ত পায়স গলাধঃকরণ করিবার জন্য অনেকবার ব্যর্থচেষ্টা করিয়াছিলেন, সুতরাং উহা তাঁহার মুখ হইতে বার বার বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, এবং ঐ দুঃসাধ্য রোগের বীজাণুপূর্ণ শ্লেষ্মা ও পুঁজ নিশ্চয়ই তাহার সহিত ছিল। ‘নরেন্দ্র’ বাটিটি উঠাইয়া লইয়া সর্বসমক্ষে উহা নিঃশেষে পান করিয়া ফেলিলেন। ক্যান্সারের সংক্রামকতার কথা আর কখনও শিষ্যগণের মধ্যে উত্থাপিত হয় নাই।
===================
অধ্যায় - ০৪
কাঠগুদামের পথে
১১ জুন। শনিবার প্রাতে আমরা আলমোড়া ত্যাগ করিলাম। কাঠগুদাম পৌঁছিতে আমাদের আড়াই দিন লাগিয়াছিল।
রাস্তার এক স্থানে এক অদ্ভুত রকমের পুরানো পানচাক্কীর এবং শূন্য কামারশালের কাছে আসিয়া স্বামীজী ধীরামাতাকে বলিলেন, ‘লোকে বলে, এই পার্বত্য অঞ্চলে একজাতীয় গন্ধর্বসদৃশ অশরীরী জীবের বাস। আমি একটি সত্য ঘটনা জানি, তাহাতে এক ব্যক্তি এইখানে প্রথমে ঐ সকল মূর্তির দর্শন পান এবং তাহার বহু পরে এই জনশ্রুতির বিষয় অবগত হন।’
এখন গোলাপের মরসুম উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু অপর এক প্রকার ফুল (কামিনী ফুল) ফুটিয়া রহিয়াছে, স্পর্শমাত্রেই উহা ঝরিয়া পড়ে। ভারতীয় কাব্যজগতের সহিত ইহার স্মৃতি বিশেষভাবে জড়িত বলিয়া স্বামীজী উহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন।
১৩ জুন। রবিবার অপরাহ্নে আমরা সমতল ভূমির সন্নিকটে একটি হ্রদ ও জলপ্রপাতের উপরিভাগে একস্থানে বিশ্রাম করিলাম। সেইখানে স্বামীজী আমাদের জন্য রুদ্র-স্তুতিটির অনুবাদ করিলেনঃ
‘অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মাঽমৃতং গময়।
আবিরাবির্ম এধি, রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্।’
আমাদিগকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, আমাদিগকে তম হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, আমাদিগকে মৃত্যু হইতে অমৃতে লইয়া যাও, আমাদিগের নিকট আবির্ভূত হও, আবির্ভূত হও, আমাদিগের নিকট আগমন কর। হে রুদ্র, তোমার যে করুণাপূর্ণ দক্ষিণমুখ, তদ্দ্বারা আমাদিগকে নিত্য রক্ষা কর।
‘আবিরাবির্ম এধি’—এই অংশের অনুবাদে তিনি অনেকক্ষণ ইতস্ততঃ করিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, ইহার অনুবাদ এইরূপ দিবেন কিনাঃ ‘আমাদের অন্তস্তলে আসিয়া আমাদের সহিত মিলিত হও।’ কিন্তু অবশেষে তিনি আমাদের নিকট তাঁহার চিন্তার কারণ ব্যক্ত করিয়া সঙ্কোচের সহিত বলিলেন, ‘ইহার আসল মানে এই, আমাদেরই ভিতর দিয়া আমাদের নিকট আইস।’ ইহার আরও আক্ষরিক অনুবাদ এইরূপ হইবে, ‘হে রুদ্র, তুমি কেবল তোমার নিজের নিকটেই প্রকাশিত আছ, তুমি আমাদের নিকটেও আত্মপ্রকাশ কর।’ এক্ষণে তাঁহার অনুবাদটিকে সমাধিকালীন অনুভূতিরই এক ক্ষিপ্র ও সাক্ষাৎ প্রতিরূপ মাত্র বলিয়া মনে করি। উহা যেন সংস্কৃতের মধ্য হইতে সজীব হৃদয়টিকে পৃথক্ করিয়া লইয়া তাহাকেই পুনরায় ইংরেজী ভাষার আবরণে প্রকাশ করিতেছে।
বাস্তবিক সে অপরাহ্নটি যেন অনুবাদের শুভলগ্ন বলিয়া মনে হইল, এবং তিনি হিন্দুদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অঙ্গীভূত অতি সুন্দর মন্ত্রগুলির অন্যতম মন্ত্রটির৮ কিছু কিছু আমাদের নিকটে অনুবাদ করিয়া দিলেনঃ
আমি পরব্রহ্মকে লাভ করিতে ইচ্ছা করিতেছি; বায়ুসকল আমার অনুকূল হউক, নদীসকল অনুকূল হউক, ওষধিসকল অনুকূল হউক, রাত্রি ও ঊষা আমাদের অনুকূল হউক, পৃথিবীর ধূলি আমাদের অনুকূল হউক, দ্যৌরূপী পিতা আমাদের অনুকূল হউন, বনস্পতি সকল আমাদের অনুকূল হউক, সূর্য আমাদের অনুকূল হউন, গোসকলও আমাদের অনুকূল হউক। ওঁ মধু, ওঁ মধু, ওঁ মধু।
পরে স্বামীজী খেতড়ির নর্তকীর নিকট সুরদাসের যে গানটি শুনিয়াছিলেন, সেটি আমাদের নিকট পুনরায় গাহিলেনঃ
প্রভু মেরা অবগুণ চিত ন ধরো,
সমদরশী হৈ নাম তুমহারো, ইত্যাদি—।৯
সেই দিন কি আর এক দিন, তিনি আমাদের নিকট কাশীর সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা বলিলেন, যিনি তাঁহাকে একপাল বানর কর্তৃক উত্ত্যক্ত দেখিয়া, এবং তিনি পশ্চাৎপদ হইয়া ফিরিয়া পলাইতে পারেন, এই আশঙ্কা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিয়াছিলেন, ‘সর্বদা জানোয়ারগুলার সম্মুখীন হইও।’
বড় আনন্দেই আমরা উক্ত কয়দিন পথ চলিয়াছিলাম। প্রতিদিনই চটিতে পৌঁছিয়া দুঃখ বোধ হইত। এই সময়ে রেলযোগে ‘তরাই’ নামক সেই ম্যালেরিয়া-গ্রস্ত ভূখণ্ড অতিক্রম করিতে আমাদের একটি সারা বিকাল লাগিয়াছিল, এবং স্বামীজী আমাদের স্মরণ করাইয়া দিলেন যে, ইহাই বুদ্ধের জন্মভূমি।
===================
অধ্যায় - ০৫
স্থান—বেরিলী হইতে বারামুল্লা
কাল—১৪ হইতে ২০ জুন
১৪ জুন। পরদিন আমরা পঞ্জাব প্রবেশ করিলাম; এই ঘটনায় স্বামীজী অতিশয় উল্লসিত হইলেন। এই প্রদেশের প্রতি তাঁহার এত প্রীতি ছিল যে, উহা ঠিক যেন তাঁহার জন্মভূমি বলিয়া বোধ হইত। স্বামীজী বলিলেন, ‘এখানে মেয়েরা চরকা কাটিতে কাটিতে তাহার ‘সোঽহং সোঽহং’ ধ্বনি শুনিয়া থাকে।’ বলিতে বলিতে সহসা বিষয়ান্তর আলোচনায় তিনি সুদূর অতীতে চলিয়া গেলেন এবং আমাদের সমক্ষে যবনগণের সিন্ধুনদ-তীরে অভিযান, চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাব এবং বৌদ্ধসাম্রাজ্যের বিস্তার, এই-সকল মহান্ ঐতিহাসিক দৃশ্যাবলী একে একে উদ্ঘাটন করিতে লাগিলেন। এই গ্রীষ্মে তিনি যেমন করিয়া হউক আটক পর্যন্ত গিয়া, যেখানে বিজয়ী সেকেন্দর প্রতিহত হইয়াছিলেন, সেই স্থানটি স্বচক্ষে দর্শন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। তিনি আমাদের নিকট গান্ধার-ভাস্কর্যের বর্ণনা করিলেন (নিশ্চয়ই সেগুলি তিনি পূর্ব বৎসর লাহোরের যাদুঘরে দেখিয়া থাকিবেন) এবং ‘কলাবিদ্যা-সম্বন্ধে ভারতবর্ষ চিরকাল যবনগণের শিষ্যত্ব করিয়াছে’—ইওরোপীয়গণের এই অর্থহীন অন্যায় দাবী নিরাকরণ করিতে করিতে তিনি যারপরনাই উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। গোধূলির আলোকে এই সকল পার্বত্য ভূখণ্ডের কোন একটি অতিক্রমকালে স্বামীজী আমাদিগকে তাঁহার সেই বহুদিন পূর্বের অপূর্ব দর্শনের কথা বলিলেন। তিনি তখন সবেমাত্র সন্ন্যাস-জীবনে পদার্পণ করিয়াছেন এবং পরে তাঁহার বরাবর এই বিশ্বাস ছিল যে, সংস্কৃতে মন্ত্র আবৃত্তি করিবার প্রাচীন রীতি তিনি এই ঘটনা হইতেই পুনঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
তিনি বলিলেন, ‘সন্ধ্যা হইয়াছে; আর্যগণ সবেমাত্র সিন্ধুনদ-তীরে পদার্পণ করিয়াছেন, ইহা সেই যুগের সন্ধ্যা। দেখিলাম, বিশাল নদের তীরে বসিয়া এক বৃদ্ধ। অন্ধকার-তরঙ্গের পর অন্ধকার তরঙ্গ আসিয়া তাঁহার উপর পড়িতেছে, আর তিনি ঋগ্বেদ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন। তারপর আমি সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হইলাম এবং আবৃত্তি করিয়া যাইতে লাগিলাম। বহু প্রাচীনকালে আমরা যে সুর ব্যবহার করিতাম, ইহা সেই সুর।’
এই আলোচনা-প্রসঙ্গে আর একদিন তিনি বলিতেছিলেন, ‘শঙ্করাচার্য বেদের ধ্বনিটিকে ঠিক ধরিতে পারিয়াছিলেন, উহাই আমাদের জাতীয় তান। বলিতে কি, আমার চিরন্তন ধারণা—’ বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার কণ্ঠস্বর যেন আবেগময় হইয়া আসিল এবং দৃষ্টি যেন সুদূরে নিবদ্ধ হইল—‘আমার চিরন্তন ধারণা এই যে, তাঁহারও শৈশবে আমার মত কোন এক অলৌকিক দর্শন-লাভ নিশ্চয়ই ঘটিয়াছিল, এবং তিনি ঐরূপে সেই প্রাচীন তানকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। ইহা সত্য হউক বা না হউক, বেদ ও উপনিষদ্সমূহের সৌন্দর্যকে স্পন্দিত করাই তাঁহার সমগ্র জীবনের কাজ।’
রাওলপিণ্ডি হইতে মরী পর্যন্ত আমরা টঙ্গায় গেলাম এবং কাশ্মীর-যাত্রার পূর্বে তথায় কয়েক দিন অতিবাহিত করিলাম। এইখানে স্বামীজী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যদি তিনি প্রাচীনপন্থী পরিবেশে কোন ইওরোপীয়কে শিষ্যরূপে বা স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণ করাইতে কোন চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তাহা বাঙলা দেশে করাই ভাল। পঞ্জাবে বিদেশীয়দিগের প্রতি অবিশ্বাস এত প্রবল যে, সেখানে এরূপ কোন কার্যের সফলতার সম্ভাবনা নাই। মধ্যে মধ্যে এই সমস্যাটি তাঁহার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিত; এবং তিনি কখনও কখনও বলিতেন যে, বাঙালীরা রাজনীতি-বিষয়ে ইংরেজের বিরোধী, অথচ উভয়ের মধ্যে পরস্পর ভালবাসা ও বিশ্বাসের একটা প্রবণতা রহিয়াছে; ইহা আপাতবিরুদ্ধ হইলেও সত্য।
অপরাহ্নের অনেকটা সময় আমরা ঝড়ের জন্য ঘরের মধ্যে কাটাইতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ডুলাই-এ আমাদের হিন্দুধর্ম-বিষয়ক জ্ঞানলাভের এক নূতন অধ্যায় খুলিয়া গেল। কারণ, স্বামীজী গম্ভীর ও বিশদভাবে এই ধর্মের আধুনিক অধোগতির কথা আমাদিগকে বলিলেন, এবং উহাতে যে-সকল কুরীতি বামাচার নামে প্রচলিত রহিয়াছে, সেগুলির প্রতি স্বীয় আপসহীন বিরোধিতার কথাও উল্লেখ করিলেন।
যিনি কাহাকেও নিরাশ করা সহ্য করিতে পারিতেন না, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ এই সব কি দৃষ্টিতে দেখিতেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, ‘ঠাকুর বলিতেন—হাঁ, তা বটে, কিন্তু প্রত্যেক বাড়ীরই একটা পায়খানার দুয়ারও তো আছে!’ অতঃপর স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন যে, সকল দেশেই যে-সকল সম্প্রদায়ে কদাচারের ভিতর দিয়া ধর্মলাভের চেষ্টা করা হয়, তাহারা এই শ্রেণীভুক্ত।
আমরা স্বামীজীর সহিত পালা করিয়া টঙ্গায় যাইবার ব্যবস্থা করিলাম, এবং এই পরবর্তী দিনটি যেন অতীত স্মৃতির আলোচনাতেই পূর্ণ ছিল।
তিনি ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ সত্তার সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেন, এবং প্রেমই যে পাপের একমাত্র ঔষধ, তাহাও বলিলেন। তাঁহার স্কুলের একজন সহপাঠী বড় হইয়া ধনশালী হইলেন, কিন্তু তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙিয়া গেল। রোগটির ঠিক পরিচয় পাওয়া যাইতেছিল না; উহার ফলে দিন দিন তাঁহার জীবনীশক্তি ক্ষীণ হইতেছিল, এবং চিকিৎসকগণের নৈপুণ্য সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়াছিল। অবশেষে ‘স্বামীজী চিরকাল ধর্মাভাবাপন্ন’—ইহা জানা থাকায় এবং অন্য সব উপায় বিফল হইলে মানুষ ধর্মের আশ্রয় লয় বলিয়া তিনি স্বামীজীকে একবার আসিতে অনুরোধ করিয়া লোক পাঠাইলেন। আচার্যদেব তথায় পৌঁছিলে একটি কৌতুককর ঘটনা ঘটিল।
‘যিনি ব্রহ্মকে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ব্রহ্ম তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন; যিনি ক্ষত্রিয়কে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ক্ষত্রিয় তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন; এবং যিনি লোকসকলকে আপনা হইতে অন্যত্র ভাবেন, লোকসকল তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন।’—এই শ্রুতিবাক্য১০ তাঁহার মনে পড়িল এবং রোগীও ইহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়া রোগ হইতে মুক্ত হইলেন। পরে স্বামীজী বলিলেন, ‘সুতরাং যদিও আমি অনেক সময় তোমাদের মনের মত কথা বলি না, বা রাগিয়া কথা বলি, তথাপি মনে রাখিও যে, প্রেম ভিন্ন অন্য কিছু প্রচার করা আদৌ আমার অন্তরের ভাব নহে। আমরা যে পরস্পরকে ভালবাসি, এইটুকু হৃদয়ঙ্গম হইলেই এই সব গণ্ডগোল মিটিয়া যাইবে!’
সম্ভবতঃ সেই দিনই (অথবা পূর্বদিনও হইতে পারে) তিনি ‘মহাদেব’-প্রসঙ্গে আমাদের নিকট বলিলেন, শৈশবে তাঁহার জননী পুত্রের দুষ্টামি দেখিয়া হতাশ হইয়া বলিতেন, ‘এত জপ, এত উপবাসের ফলে শিব কিনা একটি পুণ্যাত্মার পরিবর্তে তোকে—ভূতকে পাঠাইলেন!’ অবশেষে তিনি যে সত্য-সত্যই শিবের একটি ভূত, এই ধারণা তাঁহাকে পাইয়া বসিল। তাঁহার মনে হইল, যেন কোন শাস্তির নিমিত্ত তিনি কিছুদিনের জন্য শিবলোক হইতে নির্বাসিত হইয়াছেন, আর তাঁহার জীবনের একমাত্র চেষ্টা হইবে—সেখানে ফিরিয়া যাওয়া।
তিনি একদিন বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রথম আচার-মর্যাদালঙ্ঘন পাঁচ বৎসর বয়সে হইয়াছিল। সেই সময় তিনি খাইতে খাইতে ডান হাত এঁটো-মাখা থাকিলে বাঁ হাতে জলের গেলাস তুলিয়া লওয়া কেন অধিক পরিচ্ছন্নতার কাজ হইবে না, এই মর্মে তাঁহার মাতার সহিত এক তুমুল তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই দুষ্টামি অথবা এই জাতীয় অন্য সব দুষ্টামির জন্য জননীর অমোঘ ঔষধ ছিল—বালককে জলের কলের নীচে বসাইয়া দেওয়া, এবং তাঁহার মস্তকে শীতল জলধারা পড়িতে থাকিলে ‘শিব! শিব!’ উচ্চারণ করা। স্বামীজী বলিলেন, এই উপায়টি কখনও বিফল হইত না। মাতার জপ তাঁহাকে তাঁহার নির্বাসনের কথা মনে পড়াইয়া দিত, এবং তিনি মনে মনে ‘না, না, এবার আর নয়!’ এই বলিয়া আবার শান্ত এবং বাধ্য হইতেন।
মহাদেবের প্রতি তাঁহার অপরিসীম ভালবাসা ছিল, এবং একদা তিনি ভারতের ভাবী স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন, যদি তাহারা তাহাদের নূতন নূতন কর্তব্যের মধ্যে মনে করিয়া মধ্যে মধ্যে শুধু ‘শিব! শিব!’ বলে, তাহা হইলেই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট পূজা করা হইবে। তাঁহার নিকট হিমালয়ের বাতাস পর্যন্ত সেই অনাদি অনন্ত ধ্যানের বিষয়ীভূত মূর্তি দ্বারা ওতপ্রোত, যে-ধ্যান সুখচিন্তার দ্বারা ভগ্ন হইবার নহে; এবং তিনি বলিলেন—এই গ্রীষ্ম ঋতুতেই তিনি প্রথম সেই প্রাকৃতিক কাহিনীর অর্থ বুঝিলেন, যাহাতে মহাদেবের মস্তকে এবং সমতল প্রদেশে অবতরণের পূর্বে, শিবের জটার মধ্যে সুরধুনীর ইতস্ততঃ সঞ্চারণ কল্পিত হইয়াছে। তিনি বলিলেন যে, তিনি বহুদিন ধরিয়া পর্বতমধ্যবাহিনী নদী ও জলপ্রপাতসকল কি কথা বলে, ইহা জানিবার জন্য অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং অবশেষে জানিয়াছেন, ইহা সেই অনাদি অনন্ত ‘হর হর বম্ বম্’ ধ্বনি! তিনি একদিন শিবের প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন, ‘হ্যাঁ, তিনিই মহেশ্বর, শান্ত, সুন্দর এবং মৌন! আর আমি তাঁহার পরম ভক্ত।’
আর এক সময় তাঁহার বক্তব্য বিষয় ছিল—বিবাহ কিরূপে ঈশ্বরের সহিত জীবাত্মার সম্বন্ধেরই আদর্শস্বরূপ। তিনি উৎসাহভরে বলিলেন, ‘এই জন্যই—যদিও মাতার স্নেহ কতকাংশে এতদপেক্ষা মহত্তর, তথাপি পৃথিবীসুদ্ধ লোক স্বামী-স্ত্রীর প্রেমকেই আদর্শ বলিয়া থাকে। অপর কোন প্রেমেই এরূপ মনের মতন করিয়া গড়িয়া লইবার অপূর্ব শক্তি নাই। প্রেমাস্পদকে যেমনটি কল্পনা করা যায়, সত্য সত্যই সে ঠিক তেমনটিই হইয়া উঠে, এই প্রেমে প্রেমাস্পদকে রূপান্তরিত করিয়া দেয়।’
পরে কথাপ্রসঙ্গে জাতীয় আদর্শের কথা উঠিল, এবং বিদেশপ্রত্যাগত পান্থ কিরূপ আনন্দের সহিত আবার স্বদেশের নরনারীকে স্বাগত জানায়, স্বামীজী তাহা উল্লেখ করিলেন। সারা জীবন ধরিয়া মানুষ অজ্ঞাতসারে এই শিক্ষা লাভ করিয়া আসে যে, সে স্বদেশবাসীর মুখে এবং আকৃতিতে ভাবের মৃদুতম আলোড়নটি পর্যন্ত বুঝিতে পারে।
পথে যাইতে যাইতে আমাদের পুনরায় একদল পদচারী সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হইল। তাঁহাদের কৃচ্ছ্রানুরাগ দেখিয়া স্বামীজী কঠোর তপস্যাকে ‘বর্বরতা’ বলিয়া তীব্র সমালোচনা করিতে লাগিলেন। যাত্রিগণ তাহাদের আদর্শের নামে ধীরে ধীরে ক্রোশের পর ক্রোশ পথ অতিবাহন করিতেছে, এই দৃশ্যে তাঁহার মনে কষ্টকর স্মৃতি-পরম্পরার উদয় হইল, এবং মানব-সাধারণের পক্ষ হইতে তিনি ধর্মের উৎপীড়নে অধীর হইয়া উঠিলেন। পরে আবার ঐ ভাব যেমন হঠাৎ আসিয়াছিল, তেমনই হঠাৎ চলিয়া গেল এবং তৎপরিবর্তে সমান দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্ত হইল—এই ‘বর্বরতা‘ না থাকিলে বিলাস আসিয়া মানুষের সমুদয় মনুষ্যত্ব অপহরণ করিত।
===================
অধ্যায় - ০৬
কাশ্মীর উপত্যকা
স্থান—বিতস্তা নদী (বারামুল্লা হইতে শ্রীনগর)
কাল—২০ হইতে ২২ জুন
‘ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়’—পরম উল্লাসে এই কথা বলিতে বলিতে স্বামীজী আমাদের ডাকবাংলার কামরায় ফিরিয়া আসিলেন, এবং ছাতাটি জানুদ্বয়ের উপর রাখিয়া উপবেশন করিলেন; কোন সঙ্গী না লইয়া আসায় তাঁহাকেই সাধারণ ছোটখাট কাজগুলি সম্পাদন করিতে হইতেছিল, ডোঙা ভাড়া করা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তিনি বাহির হইয়াছিলেন। কিন্তু বাহির হইয়াই হঠাৎ একজন লোকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়, তিনি স্বামীজীর নাম শ্রবণে কাজের সমস্ত ভার নিজের উপর লইয়া তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে ফিরিয়া যাইতে বলিয়াছিলেন। সুতরাং দিনটি আমাদের আনন্দে কাটিয়াছিল। আমরা সামাভারে তৈরী কাশ্মীরী চা পান করিলাম, এবং ঐ দেশের মোরব্বা খাইলাম। পরে প্রায় চারিটার সময় আমরা তিনডোঙ্গা-বিশিষ্ট এক ক্ষুদ্র নৌ-বহর অধিকার করিলাম এবং আর বিলম্ব না করিয়া শ্রীনগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। প্রথম সন্ধ্যাটিতে আমরা স্বামীজীর জনৈক বন্ধুর বাগানের পাশে নঙ্গর করিয়াছিলাম।
পরদিন আমরা তুষারমণ্ডিত পর্বতরাজি দ্বারা পরিবেষ্টিত এক মনোরম উপত্যকায় উপস্থিত হইলাম। ইহাই ‘কাশ্মীর উপত্যকা’ নামে পরিচিত; কিন্তু হয়তো ‘শ্রীনগর উপত্যকা’ বলিলে ইহার ঠিক ঠিক পরিচয় দেওয়া হয়।
সেই প্রথম প্রভাতে ক্ষেতের উপর দিয়া লম্বা এক চোট ভ্রমণের পর আমরা এক বিস্তৃত গোচারণ-ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড চেনার গাছের নিকট উপস্থিত হইলাম। সত্য-সত্যই দেখিলাম, যেন এই গাছের কোটরে প্রবাদোক্ত বিশটা গরু স্থান পাইতে পারে! কিরূপে ইহাকে এক সাধু-নিবাসের উপযোগী করিয়া লওয়া যাইতে পারে, স্বামীজী এই স্থাপত্যবিষয়ক আলোচনায় ব্যাপৃত হইলেন। বাস্তবিকই এ সজীব বৃক্ষটির কোটরে একটি ক্ষুদ্র কুটীর নির্মিত হইতে পারিত। পরে তিনি ধ্যানের কথা বলিতে লাগিলেন; ফলে দাঁড়াইল এই যে, ভবিষ্যতে চেনার গাছ দেখিলেই ঐ কথার স্মৃতি উহাকে পবিত্রতায় মণ্ডিত করিয়া দিবে!
তাঁহার সহিত আমরা নিকটস্থ গোলাবাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। সেখানে দেখিলাম, তরুতলে বসিয়া এক পরম সুশ্রী বর্ষীয়সী রমণী। তাঁহার মাথায় কাশ্মীরীনারী-সুলভ লাল টুপী এবং শ্বেত অবগুণ্ঠন। তিনি বসিয়া পশম হইতে সূতা কাটিতেছিলেন এবং তাঁহার চারি পাশে তাঁহার দুই পুত্রবধূ এবং তাহাদের ছেলেপিলেরা তাঁহাকে সাহায্য করিতেছে। স্বামীজী পূর্ব শরৎ ঋতুতে আর একবার এই গোলাবাড়ীতে আসিয়াছিলেন, এবং সেই অবধি এই বৃদ্ধাটির স্বধর্মে আস্থা এবং গৌরব-বোধের কথা অনেকবার বলিয়াছিলেন। সে-বার তিনি জল খাইতে চাহিয়াছিলেন, এবং বৃদ্ধাও তৎক্ষণাৎ তাহাকে জল দিয়াছিলেন। বিদায় লইবার পূর্বে তিনি তাঁহাকে ধীরভাবে জিজ্ঞাসা লরিয়াছিলেন, ‘মা, আপনি কোন্ ধর্মাবলম্বিনী?’ সগর্বে জয়ের উল্লাসে উচ্চকণ্ঠে বৃদ্ধা উত্তর দিয়াছিলেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! প্রভুর কৃপায় আমি মুসলমানী!’ এক্ষণে এই মুসলমান পরিবারের সকলে মিলিয়া স্বামীজীকে পুরাতন বন্ধুরূপে অভ্যর্থনা করিলেন এবং তিনি যে বন্ধুগণকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রতিও তাঁহারা সর্ববিধ সৌজন্য-প্রকাশে রত হইলেন।
শ্রীনগর পৌঁছিতে দুই-তিন দিন লাগিয়াছিল, এবং একদিন সন্ধ্যাকালে আহারের পূর্বে ক্ষেতের উপর বেড়াইতে বেড়াইতে আমাদের মধ্যে একজন (যিনি কালীঘাট দেখিয়াছিলেন) আচার্যদেবের নিকট অভিযোগ করিলেন যে, কালীঘাটে ভক্তির অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস তাঁহার বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল, এবং বলিয়া উঠিলেন, ‘প্রতিমার সম্মুখে লোকে ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ হয় কেন?’ স্বামীজী একটি তিলের ক্ষেতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিতেছিলেন, ‘তিল আর্যগণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন তৈলবাহী বীজ’, কিন্তু এই প্রশ্নে তিনি হস্তস্থিত ক্ষুদ্র নীল ফুলটি ফেলিয়া দিলেন, পরে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া প্রশান্ত গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘এই পর্বতমালার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া আর সেই প্রতিমার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া কি একই কথা নয়?’
আচার্যদেব আমাদিগের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, গ্রীষ্মাবসানের পূর্বেই তিনি আমাদিগকে কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে লইয়া গিয়া ধ্যান শিক্ষা দিবেন। স্থির হইল যে, আমরা প্রথমে দেশটি দেখিব—তারপর নির্জনবাস করিব।
শ্রীনগরে প্রথম রজনীতে আমরা কতিপয় বাঙালী রাজকর্মচারীর গৃহে ভোজন করিয়াছিলাম, এবং নানা কথার প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য অভ্যাগতগণের মধ্যে একজন মত প্রকাশ করিলেন, ‘প্রত্যেক জাতির ইতিহাস কতকগুলি আদর্শের রূপায়ণ এবং বিকাশ-স্বরূপ; উক্ত জাতির সকল লোকেরই উচিত সেইগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া থাকা।’ আমরা দেখিয়া কৌতুক অনুভব করিলাম যে, উপস্থিত হিন্দুগণ ইহাতে আপত্তি উত্থাপন করিলেন। তাঁহাদের চক্ষে ইহা তো স্পষ্টই একটি বন্ধন, এবং মানবমন কখনই চিরকাল ইহার অধীন হইয়া থাকিতে পারে না। উক্ত মতের বন্ধনাত্মক অংশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া তাঁহারা সমগ্র ভাবটির প্রতিই অবিচার করিলেন বলিয়া মনে হইল। অবশেষে স্বামীজী মধ্যস্থ হইয়া বলিলেন, ‘তোমরা বোধ হয় স্বীকার করিবে যে, মানব প্রকৃতির ক্ষেত্রে চূড়ান্ত শ্রেণীভাগের একক (unit) মনস্তাত্ত্বিক; ভৌগোলিক বিভাগ অপেক্ষা ইহা অধিকতর স্থায়ী। প্রণালী হিসাবে এই ভাবগত সাদৃশ্যগ্রহণকে একদেশবর্তিতামূলক সাদৃশ্যগ্রহণ অপেক্ষা চিরস্থায়ী করা যায়।’ তারপর তিনি আমাদের সকলেরই পরিচিত দুইজনের কথা উল্লেখ করিলেন; তন্মধ্যে একজনকে—তিনি জীবনে যত খ্রীষ্টান দেখিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বরাবর মনে করিতেন অথচ তিনি একজন বঙ্গনারী; এবং আর একজনের জন্মভূমি পাশ্চাত্যে, কিন্তু স্বামীজী বলিতেন, ঐ ব্যক্তি তাঁহার চেয়েও ভাল হিন্দু। সব দিক্ ভাবিয়া দেখিলে এ অবস্থায় ইহাই কি সর্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয় ছিল না যে, উহাদের একে অপরের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া নিজ নিজ আদর্শের যথাসম্ভব প্রসার বিধান করে?
===================
অধ্যায় - ০৭
স্থান—শ্রীনগর
কাল—২২ জুন হইতে ১৫ জুলাই
প্রতিদিন প্রাতঃকালে স্বামীজী পূর্বের ন্যায় আমাদের নিকট আসিয়া দীর্ঘকাল কথাবার্তা কহিতেন—কখনও কাশ্মীর যে-সকল বিভিন্ন ধর্মযুগের মধ্য দিয়া চলিয়া আসিয়াছে তাহাদের সম্বন্ধে, কখনও বা বৌদ্ধধর্মের নীতি, কখনও বা শিবোপাসনার ইতিহাস, আবার হয়তো বা কণিষ্কের সময়ে শ্রীনগরের অবস্থা—এই সকল বিষয়ের কথোপকথন চলিত।
একদিন তিনি আমাদের মধ্যে একজনের সহিত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ বলিলেন, ‘আসল কথা এই যে, বৌদ্ধধর্ম অশোকের সময়ে এমন একটি কার্যের জন্যই উদ্যোগী হইয়াছিল, যাহার জন্য জগৎ এ যুগেই [সবেমাত্র আজকালই] উপযুক্ত হইয়াছে!’—তিনি সর্বধর্ম-সমন্বয়ের কথা বলিতেছিলেন। কিরূপে অশোকের ধর্মবিষয়ক একচ্ছত্রত্ব বার বার ঈশাহি ও মুসলমান ধর্মের তরঙ্গের পর তরঙ্গ দ্বারা চূর্ণ হইয়াছিল, কিরূপে আবার এতদুভয়ের প্রত্যেকেই মানবজাতির ধর্মবুদ্ধির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবী করিত, অবশেষে কি উপায়ে এই মহাসমন্বয় স্বল্পকালমধ্যেই সম্ভবপর হইবে বলিয়া অনুমিত হইতেছে—এই সকল বিষয়ের অবতারণা করিয়া তিনি এক অপূর্ব চিত্র আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিলেন।
আর একবার মধ্য-এশিয়ার দিগ্বিজয়ী বীর জেঙ্গিজ খাঁ অথবা চেঙ্গিজ খাঁ সম্বন্ধে কথা হইল। তিনি উত্তেজিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে তাঁহাকে একজন নীচ পরপীড়ক বলিয়া উল্লেখ করে, তোমরা শুনিয়া থাক; কিন্তু তাহা সত্য নহে! এইরূপ মহামনা ব্যক্তিগণ কখনও কেবল ধনলোলুপ বা নীচ হন না! তিনি এক রকম একত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার (সময়ের) জগৎকে তিনি এক করিতে চাহিতেছিলেন। নেপোলিয়নও সেই ছাঁচে গড়া লোক ছিলেন এবং সেকেন্দারও এই শ্রেণীর আর একজন। মাত্র এই তিন জন—অথবা হয়তো একই জীবাত্মা তিনটি পৃথক্ দিগ্বিজয়ে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল।’ তারপর একই অবতার-আত্মা ঐশী শক্তি দ্বারা পূর্ণ হইয়া জীবব্রহ্মৈক্য-সংস্থাপনের নিমিত্ত বারংবার ধর্মজগতে আবির্ভূত হইয়া আসিতেছেন বলিয়া তিনি যে বিশ্বাস করিতেন, তাঁহারই সম্বন্ধে বর্ণনা করিতে লাগিলেন।
এই সময়ে ‘প্রবুদ্ধ-ভারত’ মান্দ্রাজ হইতে মায়াবতীতে নবপ্রতিষ্ঠিত আশ্রমে স্থানান্তরিত হওয়ায় আমরা সকলে প্রায়ই ইহার কথা ভাবিতাম।
স্বামীজী এই পত্রিকাখানিকে বিশেষ ভালবাসিতেন। তৎপ্রদত্ত সুন্দর নামটিও তাহার পরিচয়। তাঁহার নিজের কয়েকখানি মুখপত্র থাকে, এজন্য তিনি সদাই উৎসুক ছিলেন। বর্তমান ভারতে শিক্ষাবিস্তার-কল্পে মাসিক পত্রের কি মূল্য, তাহা তিনি সম্যক্রূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, এবং অনুভব করিয়াছিলেন যে, বক্তৃতা এবং লোকহিতকর কার্যের ন্যায় এই উপায় দ্বারাও তাঁহার গুরুদেবের উপদেশাবলী প্রচার করা আবশ্যক। সুতরাং দিনের পর দিন তিনি যেমন বিভিন্ন কেন্দ্রের লোকহিতকর কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতেন, তাঁহার কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ঠিক সেইরূপ করিতেন। প্রতিদিন তিনি স্বামী স্বরূপানন্দের নব সম্পাদকত্বে আশু-প্রকাশোন্মুখ প্রথম সংখ্যাখানির বিষয়ে কথা পাড়িতেন। একদিন বৈকালে আমরা সকলে বসিয়া আছি, এমন সময়ে তিনি একখণ্ড কাগজ আমাদের নিকট আনিয়া বলিলেনঃ একখানি পত্র লিখিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু উহা কবিতাকারে এরূপ দাঁড়াইল—To the Awakened India.১১
২৬ জুন। আচার্যদেব আমাদের সকলকে ছাড়িয়া একাকী কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে যাইবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন। কিন্তু আমরা ইহা না জানিয়া তাঁহার সহিত ক্ষীরভবানী নামক শুভ্র প্রস্রবণগুলি দেখিতে যাইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম, ইতঃপূর্বে কখনও কোন খ্রীষ্টান বা মুসলমান সেখানে পদার্পণ করে নাই, পরে আমরা ইহা দর্শন করিয়া যে কতদূর কৃতার্থ হইয়াছি, তাহা বর্ণনাতীত; কারণ ভগবান্ যেন স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, এই নামটিই আমাদের নিকট সর্বাপেক্ষা পবিত্র হইয়া উঠিবে।
২৯ জুন। আর একদিন আমরা নিজেরাই বিনা আড়ম্বরে দুই তিন সহস্র ফুট উচ্চ একটি ক্ষুদ্র পর্বতের শিখরদেশে খুব ভারী ভারী উপকরণে গঠিত ‘তখ্ৎ-ই-সুলেমান’ নামক এক ক্ষুদ্র মন্দির দর্শন করিলাম। সেখানে শান্তি ও সৌন্দর্য বিরাজিত, নিম্নে বিখ্যাত ভাসমান উদ্যানগুলি চতুষ্পার্শ্বে বহু ক্রোশ ব্যাপিয়া রহিয়াছে, দেখা গেল। মন্দির এবং স্মৃতিসৌধাদির নির্মাণোপযোগী স্থান-নির্বাচনে হিন্দুগণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়, এই বিষয়টির অনুকূলে স্বামীজী যে তর্ক করিতেন, তখ্ৎ-ই-সুলেমান তাহার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণস্থল। লণ্ডনে তিনি যেমন একবার বলিয়াছিলেন যে, চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করিবার উদ্দেশ্যেই ঋষিগণ গিরিশীর্ষে বাস করিতেন, তেমনি এখন একটির পর একটি করিয়া ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তসহকারে দেখাইয়া দিলেন যে, ভারতবাসিগণ চিরকাল অতি সুন্দর এবং প্রধান প্রধান স্থানগুলি পূজামন্দির নির্মাণপূর্বক পবিত্রতা-মণ্ডিত করিয়া তুলিতেন। সেই সময়ের অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনে পড়িতেছে, যথাঃ
‘তুলসী জগমে আইয়ে সবসে মিলিয়ে ধায়।
ন জানৈ কেহি ভেকমে নারায়ণ মিলি যায়॥’
তুলসী জগতে আসিয়া সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া বাস করে। জানি না কোন্ রূপে নারায়ণ দেখা দেন!
‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।
কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ॥’
একমাত্র দেবতা সর্বভূতে লুকাইয়া আছেন; তিনি সর্বব্যাপী, সর্বভূতের অন্তরাত্মা, কর্মনিয়ামক, সর্বভূতের আধার, সাক্ষী, চৈতন্যবিধায়ক, নিঃসঙ্গ এবং গুণরহিত।
‘ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং’
সেখানে সূর্য প্রকাশ পান না, চন্দ্র-তারকাও নহে।
কিরূপে একজন রাবণকে রামরূপ ধারণ করিয়া সীতাকে প্রতারণা করিবার পরামর্শ দিয়াছিল, সে গল্পও আমরা শুনিলাম। রাবণ উত্তর দিয়াছিলেনঃ আমি কি এ-কথা ভাবি নাই? কিন্তু কোন লোকের রূপ ধারণা করিতে হইলে তাঁহাকে ধ্যান করিতে হইবে; আর রাম স্বয়ং ভগবান্। সুতরাং যখন আমি তাঁহার ধ্যান করি, তখন ব্রহ্মপদও তুচ্ছ হইয়া যায়—তখন পরস্ত্রীর কথা কিরূপে ভাবিব?—
‘তুচ্ছং ব্রহ্মপদং পরবধূসঙ্গঃ কুতঃ?’
পরে স্বামীজী মন্তব্যস্বরূপে বলিলেন, ‘সুতরাং দেখ, অত্যন্ত সাধারণ বা অপরাধীর জীবনেও এই-সব উচ্চ ভাবের আভাস পাওয়া যায়।’ পরদোষ-সমালোচনা সম্বন্ধে বরাবর এইরূপই হইত। তিনি চিরকাল মানবজীবনকে ঈশ্বরের প্রকাশ বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন, এবং কখনও কোন ঘোর দুষ্কার্যের বা দুষ্ট লোকের জঘন্য ও দুর্বৃত্ত ভাবটা লইয়া টানাটানি করিতেন না।
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥১৩ যাহা সর্বলোকের নিকট রাত্রি, সংযমী ব্যক্তি তাহাতে জাগরিত থাকেন; যাহাতে সকল লোক জাগরিত থাকে, তাহা তত্ত্বদর্শী মুনির নিকট রাত্রি (নিদ্রা-স্বরূপ)।
একদিন টমাস আ কেম্পিসের কথা এবং কিরূপে তিনি নিজে গীতা ও ‘ঈশানুসরণ’ মাত্র সম্বল করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে ভ্রমণ করিতেন—তাহা বলিতে বলিতে বলিলেন যে, এই পাশ্চাত্য সন্ন্যাসি-প্রবরের নামের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত একটি কথা তাঁহার মনে পড়িলঃ
ওহে লোকশিক্ষকগণ, চুপ কর! হে ভবিষ্যদ্বক্তৃগণ, তোমরাও থামো! প্রভো, শুধু তুমিই আমার অন্তরের অন্তরে কথা কও।
আবার আবৃত্তি করিতেনঃ
তপঃ ক্ব বৎসে ক্ব চ তাবকং বপুঃ।
পদং সহেত ভ্রমরস্য পেলবং
শিরীষপুষ্পং ন পুনঃ পতত্রিণঃ॥১৪
কঠোর দেহসাধ্য তপস্যাই বা কোথায়, আজ তোমার এই সুকোমল দেহই বা কোথায়? সুকুমার শিরীষপুষ্প ভ্রমরেরই চরণপাত সহিতে পারে, কিন্তু পক্ষীর ভার কদাচ সহ্য করিতে পারে না। অতএব উমা, মা আমার, তুমি তপস্যায় যাইও না। আবার গাহিতেনঃ
এস মা, এস মা, ও হৃদয়রমা পরাণপুতলী গো,
হৃদয়-আসনে হও মা আসীন, নিরখি তোমারে গো।
আছি জন্মাবধি তোর মুখ চেয়ে,
জান গো জননী কি যাতনা সয়ে,
একবার হৃদয়-কমল বিকাশ করিয়ে প্রকাশো তাহে আনন্দময়ী।
প্রায়ই মধ্যে মধ্যে গীতা সম্বন্ধে (সেই বিস্ময়কর কবিতা, যাহাতে দুর্বলতা বা কাপুরুষত্বের এতটুকু চিহ্ন মাত্র নাই!) দীর্ঘ কথোপকথন হইত। একদিন তিনি বলিলেন যে, স্ত্রীলোক এবং শূদ্রের জ্ঞানচর্চায় অধিকার নাই—এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ, সকল উপনিষদের সারভাগ গীতায় নিহিত। বাস্তবিকই গীতা ব্যতীত উপনিষদ্ বুঝা একপ্রকার অসম্ভব; এবং স্ত্রীলোক ও সকল জাতিই মহাভারত-পাঠে১৫ অধিকারী ছিল।
৪ জুলাই। অতি উল্লাসের সহিত গোপনে স্বামীজী এবং তাঁহার এক শিষ্যা (শিষ্যাগণের মধ্যে কেবল তিনিই আমেরিকাবাসী নহেন) ৪ জুলাই তারিখে একটি উৎসব করিবার আয়োজন করিলেন। ‘আমাদের আমেরিকার জাতীয় পতাকা নাই, এবং থাকিলে উহা দ্বারা আমাদের দলের অপর যাত্রিগণকে তাঁহাদের জাতীয়-উৎসব উপলক্ষে প্রাতরাশকালে অভিনন্দন করা যাইতে পারিত’, এই বলিয়া একজন দুঃখ করিতেছেন—ইহা তিনি শুনিতে পান। ৩ তারিখে অপরাহ্নে মহা ব্যস্ততার সহিত তিনি এক কাশ্মীরী পণ্ডিত দর্জীকে লইয়া আসিলেন এবং বুঝাইয়া দিলেন যে, যদি এই ব্যক্তিকে পতাকাটি কিরূপ করিতে হইবে বলিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সে সানন্দে সেইরূপ করিয়া দিবে। ফলে তারকা ও ডোরা দাগগুলি (Stars and Stripes) অত্যন্ত আনাড়ীর মত একখণ্ড বস্ত্রে আরোপিত হইল এবং উহা চিরশ্যামল গাছের (evergreen) কয়েকটি শাখার সহিত, ভোজনাগাররূপে ব্যবহৃত নৌকাখানির শিরোভাগে পেরেক দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইল। এমন সময়ে আমেরিকাবাসিগণ স্বাধীনতা-লাভের দিবসে (Independence Day) প্রাতঃকালীন চা পান করিবার জন্য নৌকাখানিতে পদার্পণ করিলেন। স্বামীজী এই ক্ষুদ্র উৎসবটিতে উপস্থিত থাকিবার জন্য আর এক জায়গায় যাওয়া স্থগিত করিয়াছিলেন, এবং তিনি অন্যান্য অভিভাষণের সহিত নিজে একটি কবিতা১৬ উপহার দিলেন। সেটি এক্ষণে স্বাগত-স্বরূপে সর্বসমক্ষে পঠিত হইলঃ To the Fourth of July.
৫ জুলাই। সেই দিন সন্ধ্যাকালে একজন, পাশ্চাত্যসমাজে প্রচলিত মেয়েলি শাস্ত্র অনুযায়ী পরিহাসচ্ছলে কবে তাঁহার বিবাহ হইবে দেখিবার জন্য নিজ থালায় কয়টি চেরী ফলের বিচি অবশিষ্ট আছে, গনিয়া দেখেন! স্বামীজী ইহাতে দুঃখিত হন। কি জানি কেন, স্বামীজী এই খেলাটিকে সত্য বলিয়া ধরিয়া লন এবং পরদিন প্রাতঃকালে যখন তিনি আসিলেন, তখন দেখিলাম, শ্রেষ্ঠ ত্যাগের প্রতি তাঁহার প্রবল অনুরাগ উথলিয়া পড়িতেছে।
৬ জুলাই। অপরাধীর সহিত যেন এক চিন্তা-ক্ষেত্রে দাঁড়াইবার যে সহৃদয় বাসনা তাঁহাতে প্রায়ই পরিলক্ষিত হইত, সেই ইচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘এই সব গার্হস্থ্য এবং বিবাহিত জীবনের ছায়া আমার মনে পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেখা দেয়!’ কিন্তু এই প্রসঙ্গে তিনি, যাহারা গার্হস্থ্য জীবনের জয়গান করে, তাহাদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞাভরে ত্যাগাদর্শের উপর জোর দিবার সময় যেন বহু উচ্চে উঠিয়া গেলেন। বলিয়া উঠিলেন, ‘জনক হওয়া কি এত সোজা?—সম্পূর্ণরূপে অনাসক্ত হইয়া রাজ-সিংহাসনে বসা? ধনের বা যশের অথবা স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কোন খেয়াল না রাখা?—পাশ্চাত্যে আমাকে বহু লোকে বলিয়াছে যে, তাহারা এই অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। কিন্তু আমি এইটুকুমাত্র বলিতে পারিয়াছিলাম—‘এমন সব মহাপুরুষ তো ভারতবর্ষে জন্মান না!’
তারপর তিনি অন্য দিক্টির কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রোতাদের মধ্যে একজনকে তিনি বলিলেনঃ এ-কথা মনে মনে বলিতে এবং তোমার সন্তানদিগকে শিখাইতে কখনও ভুলিও না যে,
মেরুসর্ষপয়োর্যদ্বৎ সূর্যখদ্যোতয়োরিব।
সরিৎসাগরয়োর্যদ্বৎ তথা ভিক্ষুগৃহস্থয়োঃ॥
মেরু এবং সর্ষপে যে প্রভেদ, সূর্য এবং খদ্যোতে যে প্রভেদ, সমুদ্র এবং ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী এবং গৃহীতেও সেই প্রভেদ।
‘সর্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্।’
পৃথিবীতে সকল বস্তুই ভয়যুক্ত, মানবের পক্ষে বৈরাগ্যই ভয়রহিত।
ভণ্ড সাধুরাও ধন্য, এবং যাহারা ব্রত উদ্যাপন করিতে অক্ষম হইয়াছে, তাহারাও ধন্য; কারণ তাহারাও আদর্শের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়াছে, এবং এইরূপে কতকাংশে অপরের সফলতার কারণ। আমরা যেন কখনও আমাদের আদর্শ না ভুলি—কোন মতেই না ভুলি। এই-সব মুহূর্তে তিনি প্রতিপাদ্য ভাবটির সহিত সর্বতোভাবে এক হইয়া যাইতেন। এই সব কথাবার্তা যখন হয়, তখন আমরা ডালহ্রদ হইতে শ্রীনগরে ফিরিয়াছি। ডালহ্রদ দর্শনই আমাদের ৪ জুলাই-এর উৎসবের প্রকৃত আনন্দ-অনুষ্ঠান।
পরবর্তী রবিবার, ১০ জুলাই রাত্রে বিভিন্ন সূত্রে আমরা সংবাদ পাইলাম যে, আচার্যদেব সোনমার্গের রাস্তা দিয়া অমরনাথ গিয়াছেন, এবং অপর একটি পথ দিয়া ফিরিবেন। কপর্দকমাত্র না লইয়া তিনি যাত্রা করিয়াছিলেন, কিন্তু হিন্দুশাসিত দেশীয় রাজ্যে এই ব্যাপার তাঁহার বন্ধুবর্গের কোন উদ্বেগের কারণ হয় নাই।
১৫ জুলাই। শুক্রবার অপরাহ্ণে পাঁচটার সময় আমরা নদীর অনুকূল স্রোতে কিয়দ্দূর যাইবার জন্য সবেমাত্র নৌকা খুলিয়াছি, এমন সময় ভৃত্যগণ দূরে তাহাদের কয়েকজন বন্ধুকে চিনিতে পারিল, এবং আমাদের সংবাদ দিল যে, স্বামীজীর নৌকা আমাদের অভিমুখে আসিতেছে।
এক ঘণ্টা পরেই তিনি আমাদের সহিত মিলিত হইলেন এবং বলিলেন, ফিরিয়া আসিয়া তিনি আনন্দ অনুভব করিলেন। এবারকার গ্রীষ্ম ঋতুতে অস্বাভাবিক গরম পড়িয়াছিল, এবং কয়েকটি তুষারবর্ত্ম (glacier) ধসিয়া যাওয়ায় সোনমার্গ হইয়া অমরনাথ যাইবার রাস্তাটি দুর্গম হইয়া গিয়াছে। এই ঘটনায় তিনি ফিরিয়া আসেন।
কিন্তু আমাদের কাশ্মীরবাসের কয়েক মাসে আমরা স্বামীজীর যে তিনটি মহান্ দর্শন ও ইহার ফলে বিপুল আনন্দোপলব্ধির পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাহার প্রথমটির সূত্রপাত এই সময় হইতেই। যেন আমরা স্বচক্ষে তাঁহার গুরুদেবের সেই উক্তির সত্যতা অনুভব করিতে পারিতেছিলামঃ
খানিকটা অজ্ঞান রহিয়াছে বটে। সেটুকু আমার ব্রহ্মময়ী মা-ই উহার মধ্যে রাখিয়া দিয়াছেন, তাঁহার কাজ হইবে বলিয়া। কিন্তু উহা ফিন-ফিনে কাগজের পর্দার মত, নিমিষের মধ্যে ছিঁড়িয়া ফেলা যায়।
===================
অধ্যায় - ০৮
স্থান—কাশ্মীর (পাণ্ড্রেন্থানের মন্দির)
কাল—১৬ হইতে ১৯ জুলাই
১৬ জুলাই। পর দিবস জনৈকা শিষ্যার স্বামীজীর সহিত একখানি ছোট নৌকা করিয়া নদীবক্ষে গমনের সুযোগ ঘটিয়াছিল। নৌকা স্রোতের অনুকূলে চলিতেছে, আর তিনিও রামপ্রসাদের গানগুলি একটির পর একটি গাহিয়া চলিয়াছেন, এবং মধ্যে মধ্যে একটু আধটু অনুবাদ করিয়া দিতেছেনঃ
‘ভূতলে আনিয়া মাগো করলি আমায় লোহা-পেটা,
(আমি) তবু কালী বলে ডাকি, মা, সাবাস আমার বুকের পাটা।’
অথবা,
‘মন কেন রে ভাবিস এত,
যেন মাতৃহীন বালকের মত’ ইত্যাদি।
তারপর শিশু কুপিত হইলে যেমন গর্ব ও অভিমানভরে বলিয়া থাকে, সেই ভাবের একটি গান গাহিলেন। তাহার শেষভাগটি এই—
‘আমি এমন মায়ের ছেলে নই যে,
বিমাতাকে মা বলিব।’
১৭ জুলাই। খুব সম্ভবতঃ ইহারই পরদিবস তিনি ধীরামাতার নৌকায় আসিয়া ভক্তি-প্রসঙ্গ করিতে থাকেন। প্রথমেই একাধারে হরগৌরীমিলনস্বরূপ সেই অদ্ভুত হিন্দুভাবটি কথিত হইল। তাহার কথাগুলি এখানে দেওয়া সহজ, কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরের অভাবে কথাগুলি কিরূপ প্রাণহীন মনে হইতেছে। তাহা ছাড়া তখনকার চতুষ্পার্শ্বের দৃশ্য কি অপরূপ ছিল!—ছবিখানির মত শ্রীনগর, লম্বার্ডি-দেশসুলভ সমুন্নতশির পপলার গাছগুলি, এবং দূরে চির-তুষাররাশি! সেই নদীগর্ভ উপত্যকায় মহান্ পর্বতরাজির পাদমূল হইতে কিঞ্চিৎ দূরে তিনি আবৃত্তি করিলেনঃ
কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ, শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়। সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ, কপালমালাপরিশোভিতায়।
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
* * *
সদা শিবানাং পরিভূষণায়ৈ সদাঽশিবানাং পরিভূষণায়।
শিবান্বিতায়ৈ চ শিবান্বিতায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
এবং পরক্ষণেই সেই ভাবেরই আর একরূপ—অপর ভাবে মগ্ন হইয়া তিনি আবৃত্তি করিলেনঃ
কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জোয়ার বয়ে যায়;
বইছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায়।
প্রেমের কিশোরী—প্রেম বিলাচ্ছেন সাধ করি,
রাধার প্রেমে বল্ রে হরি॥
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেমতরঙ্গে প্রাণ মাতায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে আয়, আয়, আয়।
তিনি এত তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রাতরাশ প্রস্তুত হইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত পড়িয়া রহিল, এবং অবশেষে ‘যখন এই-সব ভক্তির প্রসঙ্গ চলিতেছে, তখন আর খাবারের কি দরকার?’—এই বলিয়া তিনি অনিচ্ছাপূর্বক উঠিয়া গেলেন এবং অতি সত্বরই ফিরিয়া আসিয়া সেই বিষয়ের পুনরালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন।
কিন্তু—হয় এই সময়েই, না হয় অপর কোন সময়ে তিনি বলিয়াছিলেন যে, যাহার নিকট হইতে তিনি বড় বড় কার্যের প্রত্যাশা রাখেন, তাহার নিকট তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন না। কঠোর এবং আগ্রহবান্ কর্মীর জনক শিব, এবং কর্মীর পক্ষে তাঁহারই পদে উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত।
পরদিন তিনি আমাদিগকে শ্রীরামকৃষ্ণের একটি চমৎকার উপদেশ শুনাইলেন, তাহাতে অপরের সমালোচককে মৌমাছি বা মাছির সহিত তুলনা করা হইয়াছে। যাহারা মধু অন্বেষণ করে, তাহারাই মৌমাছি; আর যাহারা বাছিয়া বাছিয়া ঘায়ে বসে, তাহারাই মাছি।
পরে আমরা ইসলামাবাদ অভিমুখে যাত্রা করিলাম। ঘটনাচক্রে ইহাই বাস্তবিক অমরনাথ-যাত্রা হইয়া দাঁড়াইল।
১৯ জুলাই। প্রথম অপরাহ্নটিতে বিতস্তা নদীতীরে এক জঙ্গলের মধ্যে আমরা চির-অন্বেষিত পাণ্ড্রেন্থান মন্দির আবিষ্কার করিলাম। (পাণ্ড্রেন্থান কি পাণ্ড্রেস্থান—পাণ্ডবগণের স্থান?) …
স্বামীজীর চক্ষে স্থানটি ইতিহাসের অতি মধুর স্মৃতিবিজড়িত। ইহা বৌদ্ধধর্মের প্রত্যক্ষ নিদর্শনস্বরূপ এবং ইতঃপূর্বে তিনি কাশ্মীরের ইতিহাসকে যে চারিটি ধর্মযুগে বিভক্ত করিয়াছিলেন, ইহা সেগুলিরই অন্যতম।
(১) বৃক্ষ ও সর্পপূজার যুগ—এই সময় হইতেই নাগ-শব্দান্ত কুণ্ডনামগুলির প্রচলন, যথা বেরনাগ ইত্যাদি (২) বৌদ্ধধর্মের যুগ (৩) সৌরোপাসনার আকারে প্রচলিত হিন্দুধর্মের যুগ এবং (৪) মুসলমান-ধর্মের যুগ। তিনি বলিলেন, ভাস্কর্যই বৌদ্ধধর্মের বিশেষ শিল্প, এবং সূর্যচিহ্নিত চক্র অথবা পদ্ম ইহার খুব মামুলি কারুকার্যস্থানীয়। সর্পসম্বলিত মূর্তিগুলিতে বৌদ্ধধর্মের পূর্বেকার যুগের আভাস। কিন্তু সৌরোপাসনার কালে ভাস্কর্যের যথেষ্ট অবনতি হইয়াছিল, এই নিমিত্ত সূর্যমূর্তিটি নৈপুণ্য-বর্জিত।
তখন সূর্যাস্তের সময়—কি অপরূপ সূর্যাস্ত! পশ্চিম দিকের পর্বতগুলি গাঢ় লাল রঙে ঝক্ঝক্ করিতেছে। আরও উত্তরে বরফ ও মেঘে সেগুলি নীল দেখাইতেছিল। আকাশ হরিৎ এবং পীত, তাহার সহিত ঈষৎ লাল—উজ্জ্বল অগ্নিশিখার রঙের এবং ড্যাফোডিল ফুলের মত হরিদ্রাবর্ণ; তাহার পিছনেই নীল এবং ওপলের মত সাদা পটভূমি। আমরা দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম; তারপরেই ‘সুলেমানের সিংহাসন’ (যাহা ইতোমধ্যেই আমাদের প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল, সেই ক্ষুদ্র তখ্ৎ) নজরে পড়িবামাত্র আচার্যদেব বলিয়া উঠিলেন, ‘মন্দির স্থাপনে হিন্দু কি প্রতিভারই বিকাশ দেখায়! যেখানে চমৎকার দৃশ্য, হিন্দু সেই স্থানটি বাছিয়া লয়! দেখ, এই তখ্ৎ হইতে সমগ্র কাশ্মীরটি দেখিতে পাওয়া যায়। নীল জলরাশির মধ্য হইতে লোহিতাভ হরিপর্বত উঠিয়াছে, যেন মুকুট পরিয়া একটি সিংহ অর্ধশায়িতভাবে অবস্থান করিতেছে আর মার্তণ্ড-মন্দিরের পাদমূলে একটি উপত্যকা রহিয়াছে!’
আমাদের নৌকাগুলিকে বনপ্রান্ত হইতে অনতিদূরে নঙ্গর করা হইয়াছিল, এবং আমরা দেখিতে পাইলাম—আমাদিগের সদ্য-আবিষ্কৃত নিস্তব্ধ দেবালয় এবং বুদ্ধমূর্তিটি স্বামীজীর মনে গভীর ভাবের উদ্রেক করিয়াছে। সেই দিন সন্ধ্যার সময় আমরা ধীরামাতার বজরায় একত্র হইলাম, এবং তত্রত্য কথোপকথনের কিয়দংশ এখানে লিপিবদ্ধ হইল।
ঈশাহি ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড বৌদ্ধধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড হইতেই উদ্ভূত, আচার্যদেব এই মর্মে বলিতেছিলেন, কিন্তু আমাদের একজন এই মতটি আদৌ মানিতে চাহেন না।
উক্ত নারী॥ বৌদ্ধ কর্মকাণ্ডই বা কোথা হইতে আসিল?
স্বামীজী॥ বৈদিক কর্মকাণ্ড হইতে।
প্রশ্নকর্ত্রী॥ অথবা ইহা দক্ষিণ ইওরোপেও প্রচলিত ছিল বলিয়া এইরূপ সিদ্ধান্ত করাই ভাল নয় কি যে, বৌদ্ধ ঈশাহি এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড সবই এক সাধারণ ভূমি হতে উদ্ভূত?
স্বামীজী॥ না, তাহা হইতেই পারে না! তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণভাবে হিন্দুধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল! এমন কি, জাতি-বিভাগের বিরুদ্ধে পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম কিছু বলে নাই! অবশ্য জাতিবিভাগ তখনও কোন নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে নাই, এবং বুদ্ধদেব আদর্শটিকে পুনঃস্থাপন করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন মাত্র। মনু বলিতেছেন, যিনি এই জীবনেই ভগবৎ-সাক্ষাৎকার করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। বুদ্ধদেব সাধ্যমত এইটি কার্যে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র।
প্রশ্ন॥ কিন্তু ঈশাহি এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে কি সম্বন্ধ? তাহারা এক—ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারে? এমন কি, আমাদের পূজাপদ্ধতির যাহা মেরুদণ্ডস্বরূপ, আপনাদের ধর্মে তাহার নামগন্ধও নাই!
স্বামীজী॥ নিশ্চয়ই আছে! বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও ম্যাস (Mass) আছে, তাহাই দেবতার উদ্দেশে ভোগ নিবেদন করা, আর তোমাদের Blessed Sacramentআমাদের ‘প্রসাদ’ স্থানীয়। শুধু গ্রীষ্মপ্রধান দেশের প্রথানুযায়ী উহা হাঁটু না গাড়িয়া, বসিয়া বসিয়া নিবেদন করা হয়। তিব্বতের লোক হাঁটু গাড়িয়া থাকে। এতদ্ভিন্ন বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও ধূপদীপ দান এবং গীতবাদ্যের প্রথা আছে।
প্রশ্ন॥ কিন্তু ঈশাহি-ধর্মের মত ইহাতে কোন প্রার্থনা আছে কি?
কেহ এইভাবে আপত্তি তুলিলে স্বামীজী বরাবর তদুত্তরে কোন নির্ভীক আপাত- বিরুদ্ধ—কিন্তু অভ্রান্ত মত প্রয়োগ করিতেন, এবং তাহার মধ্যে কোন অভিনব এবং অচিন্তিতপূর্ব সামান্যীকরণ নিহিত থাকিত।
স্বামীজী॥ না; আর ঈশাহি-ধর্মেও কোনকালে ছিল না। এ তো ছাঁকা প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম, এবং প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম মুসলমানের নিকট হইতে—সম্ভবতঃ মূর জাতির প্রভাবের মধ্য দিয়া ইহা গ্রহণ করিয়াছিল।
পৌরোহিত্যের ভাব একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দেওয়া, সেটা একমাত্র মুসলমান ধর্মই করিয়াছে। যিনি অগ্রণী হইয়া প্রার্থনা পাঠ করেন, তিনি শ্রোতৃবর্গের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়ান এবং শুধু কোরান-পাঠই বেদী হইতে চলিতে পারে। প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম এই ভাবটিই আনিতে চেষ্টা করিয়াছে।
এমন কি, ‘tonsure’ পর্যন্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, উহাই আমাদের মুণ্ডন। জাস্টিনিয়ান দুইজন সন্ন্যাসীর নিকট হইতে মুসার যুগে প্রচলিত বিধি-নিষেধ গ্রহণ করিতেছেন, এইরূপ একখানি চিত্র আমি দেখিয়াছি। তাহাতে সাধুদ্বয়ের মস্তক সম্পূর্ণ মুণ্ডিত। বৌদ্ধযুগের প্রাক্কালীন হিন্দুধর্মে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী দুই-ই বর্তমান ছিল। ইওরোপ নিজ ধর্মসম্প্রদায়গুলি ‘থিবেইড’১৭ হইতে পাইয়াছে।
প্রশ্ন॥ এই হিসাবে তাহা হইলে আপনি ক্যাথলিক ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ডকে আর্য ক্রিয়াকাণ্ড বলিয়া স্বীকার করেন?
স্বামীজী॥ হাঁ। প্রায় সমগ্র ঈশাহি-ধর্মই আর্যধর্ম বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয়, খ্রীষ্ট বলিয়া কখনও কেহ ছিল না। ক্রীট দ্বীপের অদূরে সেই স্বপ্ন১৮ দেখা অবধি আমার বরাবর এই সন্দেহ! আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় এবং মিসরীয় ভাবের সংমিশ্রণ হয়; এবং উহাই য়াহুদী ও যাবনিক (গ্রীক) ধর্মের দ্বারা অনুরঞ্জিত হইয়া জগতে ঈশাহি-ধর্ম নামে প্রচারিত হইয়াছে।
জানই তো যে, ‘কার্যকলাপ’ এবং ‘পত্রাবলী’ (Acts and Epistles) ‘জীবনীচতুষ্টয়’ (Four Gospels) হইতে প্রাচীনতর, এবং সেণ্ট জন্ একটা কল্পনা। মাত্র একজন লোক সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ—তিনি সেণ্ট পল। তিনিও আবার স্বচক্ষে ঘটনাগুলি দেখেন নাই। না! ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল মাত্র বুদ্ধ এবং মহম্মদই স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্তারূপে দণ্ডায়মান; কারণ সৌভাগ্যক্রমে তাঁহারা জীবদ্দশাতেই শত্রু-মিত্র—দুই-ই লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে; যোগী, গোপ এবং পরাক্রান্ত নরপতি—এই-সব একত্র হইয়া গীতাহস্তে একখানি নয়নাভিরাম মূর্তির সৃষ্টি করিয়াছে।
রেনার (Rener) ঈশাজীবনী তো শুধু ফেনা। ইহা স্ট্রসের (Strauss) কাছে ঘেঁষিতে পারে না, স্ট্রসই সাচ্চা প্রত্নতত্ত্ববিৎ। ঈশার জীবনে দুইটি জিনিষ জীবন্ত ব্যক্তিগত লক্ষণে ভূষিত—সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা সুন্দর উপাখ্যান, ব্যভিচার-অপরাধে ধৃতা সেই রমণী এবং কূপ-পার্শ্ববর্তিনী সেই নারী।
এই শেষোক্ত ঘটনাটির ভারতীয় জীবনের সহিত কি অদ্ভুত সঙ্গতি! একটি স্ত্রীলোক জল তুলিতে আসিয়া দেখিল, কূপের ধারে বসিয়া একজন পীতবাস সাধু তাহার নিকট জল চাহিলেন। তারপর তিনি তাহাকে উপদেশ দিলেন এবং তাহার মনের গোটাকয়েক কথা বলিয়া দিলেন। … শুধু ভারতীয় গল্পে উপসংহারটা এইরূপ হইবে যে, যখন উক্ত নারী গ্রামবাসিগণকে সাধু দেখিতে এবং সাধুর কথা শুনিবার জন্য ডাকিতে গেল, সেই অবসরে সাধুটি সুযোগ বুঝিয়া পলাইয়া বনমধ্যে আশ্রয় লইলেন।
মোটের উপর আমার মনে হয়, জ্ঞানবৃদ্ধ হিলেলই (Rabbi Hillel) ঈশার উপদেশাবলীর উদ্ভবকর্তা, আর ন্যাজারীন নামে এক বহু প্রাচীন, কিন্তু অখ্যাত য়াহুদী সম্প্রদায় ছিল, উহাই সহসা সেণ্ট পল (St. Paul) কর্তৃক যেন বৈদ্যুতিক শক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া এক পৌরাণিক ব্যক্তিকে আরাধনার কেন্দ্ররূপে জোগাইয়া দিয়াছে।
পুনরুত্থান (Resurrection) জিনিষটা তো বসন্ত-দাহ (Spring cremation) প্রথারই রূপান্তর মাত্র। যাহাই হউক না কেন, দাহপ্রথা শুধু ধনী যবন (গ্রীক) ও রোমকগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, আর সূর্যঘটিত নব উপাখ্যানটি সেই অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যেই উহাকে সীমাবদ্ধ করিয়া থাকিবে।
কিন্তু বুদ্ধ! পৃথিবীতে যত লোক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তন্মধ্যে তিনিই যে সর্বশ্রেষ্ঠ, এ বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি নিজের জন্য একটিবারও নিঃশ্বাস লন নাই! সর্বোপরি, তিনি কখনও পূজা আকাঙ্ক্ষা করেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেনঃ বুদ্ধ কোন ব্যক্তি নহেন, উহা একটি অবস্থাবিশেষ। আমি দ্বার খুঁজিয়া পাইয়াছি। এস, তোমরা সকলেই প্রবেশ কর!
তিনি ‘পতিতা’ অম্বাপালীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। প্রাণনাশ হইবে জানিয়াও তিনি অন্ত্যজের গৃহে ভোজন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে অতিথিসৎকারককে এই মহামুক্তি-দানের জন্য ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট লোক পাঠান। সত্যলাভের পূর্বেই একটি ক্ষুদ্র ছাগ-শিশুর জন্য ভালবাসা ও দয়ায় কাতর! তোমাদের স্মরণ আছে, কিরূপে রাজপুত্র এবং সন্ন্যাসী হইয়াও তিনি নিজ মস্তক পর্যন্ত দিতে চাহিয়াছিলেন, যদি রাজা শুধু যে ছাগশিশুটিকে বলি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেটিকে মুক্তি দেন; এবং কিরূপে সেই রাজা তাঁহার অনুকম্পার নিদর্শনে মুগ্ধ হইয়া উক্ত ছাগশিশুটির প্রাণ দান করেন। জ্ঞানবিচার এবং সহৃদয়তার এমন অপূর্ব সংমিশ্রণ আর কোথাও দেখা যায় না! নিশ্চয়ই তাঁহার মত আর কেহ জন্মগ্রহণ করেন নাই, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।
===================
অধ্যায় - ০৯
স্থান—কাশ্মীর (বিতস্তাতীরে)
কাল—২০ হইতে ২৯ জুলাই
২০ জুলাই। সে দিন প্রাতঃকালে নদী প্রশস্ত, অগভীর এবং নির্মল ছিল। আমাদের দুইজন স্বামীজীর সহিত নদীর ধারে ধারে ক্ষেতের উপর দিয়া প্রায় তিন মাইল বেড়াইয়াছিলেন। স্বামীজী প্রথমে পাপবোধ-সম্বন্ধে আরম্ভ করিলেনঃ কিরূপে উহা মিশর, শেম-বংশাধিষ্ঠিত জনপদসমূহ এবং আর্যভূমি—এই তিনেরই সহিত সংশ্লিষ্ট। বেদে ইহার নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য। বেদে শয়তানকে ক্রোধের অধীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। পরে বৌদ্ধদের মধ্যে উহা কামের অধীশ্বর ‘মার’ নামে পরিচিত, এবং ভগবান্ বুদ্ধের একটি সর্বজনপ্রিয় নাম ‘মারজিৎ’।১৯ কিন্তু শয়তান যেন বাইবেলের হ্যামলেট, হিন্দুশাস্ত্রে ক্রোধের অধীশ্বর কখনও সেরূপে সৃষ্টিকে দুই ভাগ করিয়া ফেলে না। সে সর্বদাই মলিনতার (defilement) উদাহরণস্থল, কখনও দ্বৈতসত্তার নহে।
জরথুষ্ট্র কোন প্রাচীনতর ধর্মের সংস্কারক ছিলেন। তাঁহার মতে অর্মাজ্দ এবং আহ্রিমান্ পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ দেবের বিকাশমাত্র। সেই প্রাচীনতর ধর্ম বৈদান্তিক না হইয়া যায় না। সুতরাং মিশরীয়গণ এবং শেম-বংশধরগণ পাপবাদ আঁকড়াইয়া থাকে, আর আর্যগণ—যথা ভারতবাসী এবং গ্রীক যবনগণ—শীঘ্রই উহা পরিত্যাগ করে। ভারতবর্ষে পুণ্য ও পাপ বিদ্যা ও অবিদ্যায় পরিণত হইল, উভয়কেই ছাড়াইয়া যাইতে হইবে। আর্যগণের মধ্যে পারসিক এবং ইওরোপীয়গণ ধর্মচিন্তায় শেম-বংশধরগণের লক্ষণাক্রান্ত হইল; এই হেতুই তাহাদের মধ্যে পাপবোধ।
তারপরে এ-সকল কথা ছাড়িয়া বিষয়ান্তরের—ভারতবর্ষ ও তাহার ভবিষ্যতের—প্রসঙ্গ উঠিল। এরূপ প্রায়ই ঘটিত। কোন জাতিতে বল সঞ্চার করিতে হইলে উহাকে কিরূপ ভাব দেওয়া উচিত? তাহার নিজের উন্নতির গতি একদিকে চলিতেছে, তাহাকে ‘ক’ বলা যাউক। যে নূতন বল সঞ্চারিত হইবে তাহা কি সঙ্গে সঙ্গে উহার কিঞ্চিৎ হ্রাসও করিবে, যেমন ‘খ’? ইহার ফলে এতদুভয়ের মধ্যপথবর্তী এক পরিণতি হইবে, যেমন ‘গ’। ইহা তো জ্যামিতিক পরিবর্তনমাত্র। এরূপ তো চলিবে না। জাতীয় জীবন জৈবিক শক্তির ব্যাপার। আমাদিগকে সেই জীবনস্রোতটিতেই বলাধান করিতে হইবে, অবশিষ্ট কার্য উহা নিজে নিজেই করিয়া লইবে। বুদ্ধ ‘ত্যাগ’ প্রচার করিলেন এবং ভারত উহা শুনিল; এবং এক সহস্র বৎসর মধ্যে ভারত জাতীয় সম্পদের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিল। ত্যাগই ভারতের জাতীয় জীবনের উৎস। সেবা ও মুক্তি তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ। হিন্দুজননী সকলের শেষে আহার করেন। বিবাহ ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে, উহা জাতি ও বর্ণের কল্যাণের নিমিত্ত। নব্য সংস্কারকগণের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি সমস্যা-পূরণের অনুপযোগী এক পরীক্ষায় হস্তক্ষেপ করিয়া জীবন আহুতি দিয়াছেন, আর সমস্ত জাতি তাঁহাদের উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে।
তারপরে আবার কথাবার্তার ভাব বদলাইয়া গেল, এবং কেবল হাসিঠাট্টা, কৌতুক এবং গল্পগুজব চলিতে লাগিল। আমরা শুনিতে শুনিতে হাসিয়া অধীর হইতেছিলাম। এমন সময় নৌকা আসিয়া পৌঁছিল এবং সেদিনের মত কথাবার্তা শেষ হইল।
সেদিনকার সমস্ত বৈকাল এবং রাত্রি স্বামীজী পীড়িত হইয়া নিজ নৌকায় শুইয়াছিলেন। কিন্তু পরদিন যখন আমরা—বিজবেহার মন্দিরে অবতরণ করিলাম—ইতোমধ্যেই সেখানে অমরনাথযাত্রীর ভিড় লাগিয়া গিয়াছে—তখন তিনি আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য মিলিত হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। ‘শীঘ্র সারিয়া উঠা এবং শীঘ্র অসুখে পড়া’—চিরকালই তাঁহার বিশেষত্ব ছিল, এ-কথা তিনিও নিজের সম্বন্ধে বলিতেন। উহার পর, দিবসের অধিকাংশ সময়ই তিনি আমাদের সহিত ছিলেন, এবং অপরাহ্নে আমরা ইসলামাবাদ পৌঁছিলাম।
সেইদিন বৈকালে গোধূলির সময় আচার্যদেব ধীরামাতা ও জয়াকে নিজের সম্বন্ধে বলিতেছিলেন। তিনি দুই টুকরা পাথর হাতে লইয়া বলিতেছিলেন, ‘সুস্থ অবস্থায় আমার মন এটা ওটা সেটা লইয়া থাকিতে পারে, অথবা আমার সঙ্কল্পের জোর কমিয়া গিয়াছে মনে হইতে পারে, কিন্তু এতটুকু যন্ত্রণা বা পীড়া আসুক দেখি, ক্ষণিকের জন্যও আমি মৃত্যুর সামনা-সামনি হই দেখি, অমনি আমি এই রকম শক্ত হইয়া যাই’—বলিয়া পাথর দুখানিকে পরস্পর ঠুকিলেন—‘কারণ আমি ঈশ্বরের পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছি।’
গাছগুলির নীচে ঘাসের উপর বসিয়া আমরা নানা কথা কহিতে লাগিলাম, এবং দু-এক ঘণ্টা আধা-হাল্কা আধা-গম্ভীর কথাবার্তা চলিল। বৃন্দাবনে বানরগুলা কিরূপ দুষ্টামি করিতে পারে, তাহার অনেক বর্ণনা শুনিলাম। এবং আমরা নানা প্রশ্ন করিয়া জানিতে পারিলাম যে, পরিব্রাজক-জীবনে দুইটি বিভিন্ন ঘটনায় বিপদে যে সাহায্য আসিতেছে, স্বামীজী তাহা পূর্ব হইতে জানিতে পারিয়াছিলেন, এবং ভবিষ্যৎ-দর্শন সত্য হইয়াছিল। একবার তিনি কয়েক দিন ধরিয়া কিছু খাইতে পান নাই, এক রেল ষ্টেশনে ক্লান্তিতে মৃতকল্প হইয়া পড়িয়াছিলেন; এমন সময় সহসা তাঁহার মনে হইল যে, তাঁহাকে উঠিয়া কোন একটি রাস্তা দিয়া যাইতে হইবে, আর সেখানে তিনি একজন লোকের দেখা পাইবেন, যে তাঁহাকে সাহায্য করিবে। তিনি তদনুসারে কার্য করিলেন এবং এক থালা খাবার হাতে একজন লোকের দেখা পাইলেন। এই ব্যক্তি তাঁহার নিকটে আসিয়া তাঁহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, ‘যাঁহার নিকট আমি প্রেরিত হইয়াছি, আপনিই কি তিনি?’
তারপরে একটি শিশু আমাদের নিকট আনীত হইল, তাহার হাত খুব কাটিয়া গিয়াছে। স্বামীজীও বৃদ্ধামহলে প্রচলিত একটি ঔষধ প্রয়োগ করিলেন। ক্ষতস্থানটি তিনি জল দিয়া ধুইয়া, রক্ত পড়া বন্ধ করিবার জন্য এক টুকরা কাপড় পুড়াইয়া তাহার ছাই উক্তস্থানে চাপাইয়া দিলেন। গ্রামবাসিগণ আশ্বস্ত হইয়া শান্ত হইল, এবং সেই রাত্রির মত আমাদের গল্পগুজব বন্ধ হইল।
২৩ জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে হরেক রকমের একদল কুলি আমাদিগকে মার্তণ্ডের ধ্বংসাবশেষ দেখাইতে লইয়া যাইবার জন্য আপেল গাছগুলির নীচে একত্র হইয়াছিল। মার্তণ্ড মন্দির এক অদ্ভুত প্রাচীন সৌধ। উহাতে স্পষ্টই মন্দিরের অপেক্ষা মঠের লক্ষণ অধিক। উহা এক অপূর্ব স্থানে অবস্থিত এবং যে-সকল বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া উহা শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিয়াছিল, ঐগুলির বিভিন্ন নির্মাণ পদ্ধতির স্পষ্ট একত্র সমাবেশ-বশতই উহা আকর্ষণীয় হইয়াছিল। … সূর্যাস্তের আলোয় অশ্বপৃষ্ঠে প্রত্যাবর্তন অতি রমণীয় হয়। পূর্ব এবং পরদিনের এই সমস্ত সময়ের মধ্যে যে-সকল কথোপকথন হইয়াছিল, সেগুলির কিছু কিছু অংশ এখনও মনে পড়িতেছেঃ
‘কোন জাতিই, তা যবনই (Greek) হউন বা অন্য কোন জাতিই হউন, কোন কালে জাপানীদের ন্যায় স্বদেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া যান নাই। তাঁহারা কথা লইয়া থাকেন না, তাঁহারা কাজে করেন—দেশের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেন। আজকাল জাপানে এমন সব জমিদার আছেন—যাঁহারা সাম্রাজ্যের একত্ব-বিধানকল্পে বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহাদের জমিদারী ছাড়িয়া দিয়া কৃষিজীবী হইয়াছেন।২০ আর জাপানযুদ্ধে একটিও বিশ্বাসঘাতক পাওয়া যায় নাই। একবার সেটা ভাবিয়া দেখ!’
আবার কতকগুলি লোক ভাবপ্রকাশে অক্ষম—এই প্রসঙ্গে স্বামীজী বলিলেন, ‘আমি বরাবর লক্ষ্য করিয়াছি যে, লাজুক ও চাপা লোকেরা উত্তেজিত হইলে সবচেয়ে বেশী আসুরিক-ভাবাপন্ন হইয়া থাকে।’
আর একবার সন্ন্যাস-জীবনের ও ব্রহ্মচর্যের বিধিনিষেধ-প্রসঙ্গ স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, ‘যস্মাদ্ভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন গ্রাহ্যং চ স আত্মহা ভবেৎ’—যে সন্ন্যাসী সকামভাবে সুবর্ণ গ্রহণ করে, সে আত্মঘাতী ইত্যাদি।
২৪ জুলাই। অন্ধকার রাত্রি এবং অরণ্যানী, দ্রুমরাজিতলে পাইন কাষ্ঠের এক বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড, দুই তিনটি তাঁবু অন্ধকারের মধ্যে সাদা হইয়া দণ্ডায়মান, দূরে অগ্নিকুণ্ডপার্শ্বে উপবিষ্ট ভৃত্যগণের আকৃতি ও কণ্ঠস্বর এবং তিনটি শিষ্যসহ আচার্যদেব—পরবর্তী চিত্রটি এইরূপই। সহসা আচার্যদেব আমাদের মধ্যে একজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘কই, তুমি তো আজকাল তোমার ইস্কুলের কোন কথা বল না, তুমি কি মাঝে মাঝে উহার কথা ভুলিয়া যাও?’ পরে বলিতে লাগিলেন, ‘দেখ, আমার ভাবিবার ঢের জিনিষ আছে। একদিন আমি মান্দ্রাজের দিকে মন দিই, আর সেখানকার কাজের কথা ভাবি। আর একদিন আমি সব মনটা আমেরিকা বা ইংলণ্ড বা সিংহল অথবা কলিকাতায় দিই। এক্ষণে আমি তোমার ইস্কুলের কথা ভাবিতেছি।’
পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত একটি অস্থায়ী কার্য-প্রণালী যে অনেক চিন্তার পর স্থির হইয়াছে, উহার প্রারম্ভ যে সামান্য হইবে, শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাহী প্রসারতার ভাব বাতিল করিবার ঝোঁক এবং সমগ্র শিক্ষাদান-চেষ্টাটিকে যে ধর্মজীবনের উপর এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-পূজার উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়াছে—এই সমস্ত কথা তিনি মনোযোগের সহিত শুনিয়া বলিলেনঃ
তুমি সেই উৎসাহ বজায় রাখিবার জন্যই সাম্প্রদায়িক ভাব আশ্রয় করিবে, নয় কি? সমস্ত সম্প্রদায়ের পারে চলিয়া যাইবার জন্য তুমি একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করিবে। হাঁ, আমি বুঝিতে পারিয়াছি।
কতকগুলি বাধা স্পষ্টতঃ থাকিবেই থাকিবে। নানা কারণে প্রস্তাবিত আয়তনে হয়তো অনুষ্ঠানটি প্রায় অসম্ভব শুনায়। কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু এইটুকু লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন অনুষ্ঠানটি ঠিক ঠিক ভাবে সঙ্কল্প করা হয়, এবং কার্য-প্রণালী নির্দোষ হইলে উপায় উপকরণাদি জুটিবেই জুটিবে।—সব শুনিয়া তিনি একটু চুপ করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেনঃ
তুমি আমাকে ইহার সমালোচনা করিতে বলিতেছ, কিন্তু তাহা আমি করিতে পারিব না। কারণ, আমি তোমাকে ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত—আমি যতটা অনুপ্রাণিত ঠিক ততটা অনুপ্রাণিত বলিয়া মনে করি। অন্যান্য ধর্মে এবং আমাদের ধর্মে এইটুকুই প্রভেদ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বিগণ বিশ্বাস করেন যে, ঐ-সকল ধর্মের সংস্থাপকগণ ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত, আমরাও ঐরূপ বিশ্বাস করিয়া থাকি। কিন্তু আমিও তো তাঁহারই মত অনুপ্রাণিত আর তুমিও আমারই মত, আবার তোমার পরে তোমার বালিকারা এবং তাহাদের শিষ্যগণও সেইরূপ হইবে। সুতরাং তুমি যাহা সর্বাপেক্ষা ভাল বলিয়া বিবেচনা করিতেছ, আমি তাহাই করিতে তোমাকে সাহায্য করিব।
তারপর ধীরামাতা এবং জয়ার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, যে শিষ্যাটি নারীদের উন্নতি-বিধানের প্রতিনিধিরূপে দাঁড়াইবেন, তাঁহার উপর তিনি পাশ্চাত্যদেশে গমনকালে যে কি মহান্ দায়িত্ব অর্পণ করিয়া যাইবেন! উহা যে পুরুষগণের জন্য যে-কার্য অনুষ্ঠিত হইবে তদপেক্ষা গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ হইবে তাহাও বলিলেন। আমাদের মধ্যে উক্ত সেবিকাটির (worker) দিকে ফিরিয়া আরও বলিলেন, ‘হাঁ, তোমার বিশ্বাস আছে, কিন্তু যে জ্বলন্ত উৎসাহ দরকার—তাহা তোমার নাই। তোমাকে ‘দগ্ধেন্ধনমিবানলম্’ হইতে হইবে। শিব! শিব!’—এই বলিয়া মহাদেবের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিয়া তিনি আমাদিগের নিকট হইতে রাত্রির মত বিদায় লইলেন এবং আমরাও অনতিবিলম্বে শয়ন করিলাম।
২৫ জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে আমরা তাঁবুগুলির মধ্যে একটিতে সকাল সকাল প্রাতরাশ সম্পন্ন করিয়া অচ্ছাবল পর্যন্ত চলিলাম। আমাদের মধ্যে একজন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন—কতকগুলি পুরাতন রত্ন হারাইয়া গিয়াছিল, পুনরায় পাওয়া গিয়াছে, সেগুলি সবই উজ্জ্বল ও নূতন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু স্বামীজী ঈষৎ হাস্য করিয়া এই গল্প বলা বন্ধ করিয়া দিলেন এবং বলিলেন, ‘অমন ভাল স্বপ্নের কথা বলিতে নাই!’
অচ্ছাবলে আমরা জাহাঙ্গীরের আরও অনেক বাগান দেখিতে পাইলাম। আমরা বাগানগুলির চারিধারে বেড়াইলাম এবং একটি স্থির জলাশয়ে স্নান করিলাম। পরে আমরা প্রথম বাগানটিতে মধ্যাহ্নের পূর্বের জলযোগ সম্পন্ন করিলাম, এবং বৈকালে অশ্বপৃষ্ঠে ইসলামাবাদে নামিয়া আসিলাম।
উক্ত জলযোগ-কালে যখন সকলে বসিয়াছিলাম, তখন স্বামীজী তাঁহার কন্যাকে তাঁহার সঙ্গে অমরনাথ-গুহায় যাত্রা করিবার এবং তথায় মহাদেবের চরণে নিবেদিত হওয়ার জন্য আহ্বান করিলেন। ধীরামাতা সহাস্যে অনুমতি দিলেন, এবং পরবর্তী অর্ধঘণ্টা উল্লাস ও আনন্দ-জ্ঞাপনে অতীত হইল। ইতঃপূর্বেই বন্দোবস্ত হইয়াছিল যে, আমরা সকলেই পহলগাম পর্যন্ত যাইব এবং সেখান স্বামীজীর তীর্থযাত্রা হইতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করিব। সুতরাং আমরা সেইদিন সন্ধ্যার সময় নৌকায় পৌঁছিয়া জিনিষপত্র গুছাইয়া লইলাম এবং পত্রাদি লিখিলাম। পরদিন বৈকালে বওয়ান যাত্রা করিলাম।
===================
অধ্যায় - ১০
স্থান—কাশ্মীর (অমরনাথ)
কাল—২৯ জুলাই হইতে ৮ অগষ্ট
২৯ জুলাই। এই সময় হইতে আমরা স্বামীজীকে খুব কমই দেখিতে পাই। তিনি তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে খুব উৎসাহান্বিত ছিলেন, বেশীর ভাগ দিন একাহারী হইয়া থাকিতেন, এবং সাধুসঙ্গ ভিন্ন অন্য সঙ্গ বড় একটা চাহিতেন না। কোথাও তাঁবু খাটান হইলে কখনও কখনও তিনি মালা হাতে সেখানে আসিতেন। বওয়ান জায়গাটি একটি পল্লীগ্রামের মেলার মত—সমস্তটির উপর একটি ধর্মভাবের ছাপ রহিয়াছে, আর পুণ্য কুণ্ডগুলি ঐ ধর্মভাবের কেন্দ্রস্বরূপ। ইহার পর আমরা ধীরামাতার সহিত তাঁবুর দ্বারের নিকট গিয়া যে বহুসংখ্যক হিন্দীভাষী সাধু স্বামীজীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিতেছিলেন, তাঁহাদের কথাবার্তা শুনিতে সক্ষম হইয়াছিলাম।
বৃহস্পতিবারে আমরা পহলগামে পৌঁছিলাম; উপত্যকাটির নিম্নপ্রান্তে আমাদের ছাউনি পড়িল। দেখিলাম যে, আমাদিগকে আদৌ ঢুকিতে দেওয়া হইবে কিনা, সে-বিষয়ে স্বামীজীকে গুরুতর আপত্তিসমূহ নিরাকরণ করিতে হইতেছে। নাগা সাধুগণ তাঁহাকে সমর্থন করিতেছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, ‘স্বামীজী, ইহা সত্য যে আপনার শক্তি আছে, কিন্তু তাহা প্রকাশ করা আপনার উচিত নহে!’ বলিবামাত্র স্বামীজী চুপ করিয়া গেলেন! যাহা হউক, সেদিন অপরাহ্নে তিনি তাঁহার কন্যাকে আশীর্বাদলাভে ধন্য হইবার জন্য, ছাউনির চারিধারে ঘুরাইয়া আনিলেন—প্রকৃতপক্ষে উহা ভিক্ষা-বিতরণ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। আর, লোকে তাঁহাকে ধনী ঠাওরাইয়াছিল বলিয়াই হউক, অথবা তাঁহাকে শক্তিমান্ বলিয়া বুঝিয়া লইয়াছিল বলিয়াই হউক, পরদিবস আমাদের তাঁবুটি ছাউনির পুরোভাগে একটি মনোহর পাহাড়ের উপর তুলিয়া লওয়া হইয়াছিল।
পরবর্তী বিশ্রামস্থান চন্দনবাড়ী যাইবার রাস্তাটি কি সুন্দর! চন্দনবাড়ীর একটি গভীর গিরিবর্ত্মের কিনারায় আমরা ছাউনি ফেলিলাম। সমস্ত বৈকাল ধরিয়া বৃষ্টি হইয়াছে, এবং স্বামীজী মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আমার সহিত দেখা করিতে ও সামান্য একটু কথাবার্তা কহিতে আসিয়াছিলেন।
চন্দনবাড়ীর সন্নিকটে স্বামীজী জেদ করিলেন, ইহাই আমার প্রথম তুষারবর্ত্ম, অতএব আমাকে উহা খালি পায় অতিক্রম করিতে হইবে। জ্ঞাতব্য প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির উল্লেখ করিতে তিনি ভুলিলেন না। ইহার পরেই বহুসহস্রফুট-ব্যাপী এক বিকট চড়াই আমাদের ভাগ্যে পড়িল। তারপর এক সরু পথ, পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিয়াছে; সেই দীর্ঘ পথ ধরিয়া চলিলাম; এবং সর্বশেষে আর একটি খাড়া চড়াই। প্রথম পর্বতটির উপরিভাগের জমিটিকে একজাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাস (Edelweiss) ঠিক যেন গালিচা দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে। তারপরে রাস্তাটি শেষনাগ হইতে পাঁচশত ফুট উচ্চ দিয়া চলিয়াছে। শেষনাগের জল গতিহীন। অবশেষে আমরা তুষারমণ্ডিত শিখরগুলির মধ্যে ১৮০০০ ফুট উচ্চে এক ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় ছাউনি ফেলিলাম। ফার গাছগুলি বহু নিম্নে ছিল, সুতরাং সারা বৈকাল ও সন্ধ্যাবেলা কুলীরা চারিদিক হইতে জুনিপার গাছ সংগ্রহ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। স্থানীয় তহসিলদারের, স্বামীজীর এবং আমার তাঁবু খুব কাছাকাছি ছিল; সন্ধ্যাবেলায় সম্মুখভাগে এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বলিত হইল। আমাদের ছাউনি পড়িবার পর আমি আর স্বামীজীকে দেখি নাই।
পাঁচটি তটিনীর মিলনস্থল ‘পঞ্চতরণী’ যাইবার রাস্তা এতটা দীর্ঘ ছিল না। অধিকন্তু ইহা শেষনাগ অপেক্ষা নীচু এবং এখানকার ঠাণ্ডা বেশ শুষ্ক ও প্রীতিপ্রদ। ছাউনির সম্মুখে এক কঙ্করময় শুষ্ক নদীগর্ভ, উহার মধ্য দিয়া পাঁচটি তটিনী চলিয়াছে। ইহাদের সকলগুলিতেই—একটির পর অপরটিতে ভিজা কাপড়ে হাঁটিয়া গিয়া যাত্রিগণের স্নান করার বিধি। সম্পূর্ণরূপে লোকের নজর এড়াইয়া স্বামীজী কিন্তু এ-বিষয়ক নিয়মটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন।
এই-সকল উচ্চ স্থানে প্রায়ই দেখিতাম যে, আমরা তুষার-শৃঙ্গরাজির মহান্ পরিধির মধ্যে রহিয়াছি—এই নির্বাক্ বিপুলায়তন পর্বতগুলিই হিন্দুমনে ভস্মানুলিপ্ত ভগবান্ শঙ্করের ভাব উদ্রেক করিয়া দিয়াছে।
২ অগষ্ট। ২ অগষ্ট মঙ্গলবার, অমরনাথের সেই মহোৎসব দিনে আমরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকে যাত্রা করিলাম। সঙ্কীর্ণ উপত্যকাটিতে পৌঁছিলে সূর্যোদয় হইল। রাস্তার এই অংশটিতে যাতায়াত যে খুব নিরাপদ ছিল, তাহা নয়। কিন্তু যখন আমরা ডাণ্ডি ছাড়িয়া চড়াই করিতে আরম্ভ করিলাম, তখনই প্রকৃত বিপদের সূত্রপাত হইল। কোনমতে ওপারের—উতারটির তলদেশে পৌঁছিয়া আমাদিগকে অমরনাথের গুহা পর্যন্ত ক্রোশের পর ক্রোশ তুষারবর্ত্মের উপর দিয়া বহুকষ্টে যাইতে হইয়াছিল।
ক্লান্ত হইয়া স্বামীজী ইতোমধ্যে পিছনে পড়িয়াছিলেন। অনেক বিলম্বে তিনি আসিয়া পৌঁছিলেন, এবং ‘স্নান করিতে যাইতেছি’—মাত্র এই কথা বলিয়া আমাকে অগ্রসর হইতে বলিলেন। অর্ধ ঘণ্টা পরে তিনি গুহামধ্যে প্রবেশ করিলেন। সস্মিতবদনে তিনি প্রথমে অর্ধবৃত্তটির এক প্রান্তে, পরে অপর প্রান্তটিতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। স্থানটি বিশাল ছিল, এত বড় যে, সেখানে একটি গীর্জা ধরিতে পারে, এবং সুবৃহৎ তুষারময় শিবলিঙ্গটি প্রগাঢ়চ্ছায় এক গহ্বরে অবস্থিত থাকায় যেন নিজ সিংহাসনেই অধিরূঢ় বলিয়া মনে হইতেছিল। কয়েক মিনিট কাটিয়া যাইবার পর তিনি গুহা ত্যাগ করিবার উদ্যোগ করিলেন।
তাঁহার চক্ষে যেন স্বর্গের দ্বারসমূহ উদ্ঘাটিত হইয়াছে। তিনি সদাশিবের শ্রীপাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছেন। পরে বলিয়াছিলেন—পাছে তিনি ‘মূর্ছিত হইয়া পড়েন’ এইজন্য নিজেকে শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার দৈহিক ক্লান্তি এত অধিক হইয়াছিল যে, জনৈক ডাক্তার পরে বলিয়াছিলেন—তাঁহার হৃৎপিণ্ডের গতিরোধ হইবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তৎপরিবর্তে উহা চিরদিনের মত বর্ধিতায়তন হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার গুরুদেবের সেই কথাগুলি কি অদ্ভুতভাবে প্রায় সফল হইয়াছিল, ‘ও যখন নিজেকে জানতে পারবে, তখন আর এ শরীর রাখবে না!’
আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একখানি পাথরের উপর বসিয়া সেই সহৃদয় নাগা সন্ন্যাসী এবং আমার সহিত জলযোগ করিতে করিতে স্বামীজী বলিলেন, ‘আমি কি আনন্দই উপভোগ করিয়াছি! আমার মনে হইতেছিল যে, তুষারলিঙ্গটি সাক্ষাৎ শিব। আর সেখানে কোন বিত্তাপহারী ব্রাহ্মণ ছিল না, কোন ব্যবসা ছিল না, খারাপ কোন কিছু ছিল না। [সেখানে] কেবল নিরবচ্ছিন্ন পূজার ভাব। আর কোন তীর্থক্ষেত্রেই আমি এত আনন্দ উপভোগ করি নাই!’
পরে তিনি প্রায়ই আমাদিগকে তাঁহার সেই চিত্তবিহ্বলকারী দর্শনের কথা বলিতেন; উহা যেন তাঁহাকে একেবারে স্বীয় ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টানিয়া লইবে বলিয়া বোধ হইয়াছিল। তিনি শভ্র তুষারস্তম্ভটির কাব্যময় রূপের বর্ণনা করিতেন, এবং তিনিই ইঙ্গিত করিলেন, একদল মেষপালকই উক্ত স্থানটি প্রথম আবিষ্কার করে। কোন এক নিদাঘ-দিবসে তাহারা নিজ নিজ মেষযূথের সন্ধানে বহুদূরে গিয়া পড়িয়াছিল এবং এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখে যে, তাহারা অদ্রব-তুষাররূপী সাক্ষাৎ শ্রীভগবানের সান্নিধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। তিনি সর্বদা ইহাও বলিতেন, ‘সেইখানেই অমরনাথ আমাকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়াছেন।’ আর আমাকে তিনি বলিলেন, ‘তুমি এখন বুঝিতেছ না; কিন্তু তোমার তীর্থযাত্রা সম্পন্ন হইয়াছে, এবং ইহার ফল ফলিতেই হইবে। কারণ থাকিলেই কার্য নিশ্চিত। তুমি পরে আরও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিবে। ফল অবশ্যম্ভাবী।’
পরদিন প্রাতঃকালে আমরা যে রাস্তা দিয়া পহলগামে প্রত্যাবর্তন করিলাম, তাহা কি সুন্দর রাস্তা! সেই রজনীতে তাঁবুতে ফিরিয়া আমরা তাঁবু উঠাইলাম এবং অনেক পরে পুরা এক চটীভর রাস্তা চলিয়া একটি তুষারময় গিরিসঙ্কটে রাত্রির জন্য ছাউনি ফেলিলাম। এইখানে আমরা একজন কুলীকে কয়েক আনা পয়সা দিয়া একখানি চিঠি লইয়া আগে পাঠাইয়া দিলাম, কিন্তু পরদিন মধ্যাহ্নে পৌঁছিয়া দেখিলাম যে, ইহার কোনই প্রয়োজন ছিল না। কারণ সমস্ত প্রাতঃকাল ধরিয়া যাত্রিগণ দলে দলে আমাদের তাঁবুর নিকট দিয়া যাইবার সময় নিতান্ত বন্ধুভাবে, অপর সকলকে আমাদের সংবাদ দিবার জন্য, এবং আমরা যে খুব শীঘ্রই আসিতেছি—এই কথা জানাইবার জন্য, আমাদের তত্ত্ব লইয়া যাইতেছিল। প্রাতঃকালে সূর্যোদয়ের বহু পূর্বেই আমরা গাত্রোত্থান করিয়া পথ চলিতে আরম্ভ করিলাম। সম্মুখে সূর্য উদিত হইতেছেন এবং পশ্চাতে চন্দ্র অস্ত যাইতেছেন, এমন সময়ে আমরা ‘হাতিয়ার তলাও’ (Lake of Death) নামক হ্রদের উপরিভাগের রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিলাম। এই সেই হ্রদ—যেখানে এক বৎসর প্রায় চল্লিশ জন যাত্রী তাহাদেরই স্তোত্র-পাঠের কম্পনে স্থানচ্যুত একটি তুষারপ্রবাহ (avalanche) কর্তৃক সবেগে নিক্ষিপ্ত হইয়া নিহত হইয়াছিল! একটি ক্ষুদ্র পগ্ডাণ্ডী পথ খাড়া পাহাড়ের গা দিয়া নীচে নামিয়াছে। অতঃপর আমরা তথায় উপস্থিত হইলাম এবং ঐ পথে চলিয়া দূরত্ব যথেষ্ট কমাইতে সমর্থ হইয়াছিলাম। ঐ পথ সকলকেই পায়ে হাঁটিয়া তাড়াতাড়ি কষ্টেসৃষ্টে ঠেলাঠেলি করিয়া অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। তলদেশে গ্রামবাসিগণ প্রাতঃকালীন জলযোগের মতন একটা কিছু প্রস্তুত রাখিয়াছিল। স্থানে স্থনে অগ্নি প্রজ্বলিত ছিল, চাপাটী সেঁকা হইতেছিল, এবং চা-ও প্রস্তুত ছিল, শুধু ঢালিলেই হইল। এখন হইতে যেখানে যেখানে রাস্তা পৃথক্ হইয়া গিয়াছে, সেইখানেই যাত্রিগণ দলে দলে মুখ্য দল হইতে পৃথক্ হইয়া যাইতে লাগিল, এবং এই সারা পথ ধরিয়া আমাদের মধ্যে যে একটি একত্বের ভাব জন্মিয়াছিল, তাহা ক্রমশঃ হ্রাস পাইতে লাগিল।
সেই দিন সন্ধ্যার সময় পহলগামের উপরিভাগে আমরা এক গোল পাহাড়ের উপর পাইন কাঠের এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বালিত করিয়া এবং সতরঞ্চি বিছাইয়া গল্প করিতে লাগিলাম; আমাদের বন্ধু সেই নাগা সন্ন্যাসীটি আমাদের সহিত যোগ দিলেন, এবং যথেষ্ট কৌতুক-পরিহাসাদি চলিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই আমাদের ক্ষুদ্র দলটি ব্যতীত আর সকলে চলিয়া গেল। আর আমরা বসিয়া এই সব দৃশ্য উপভোগ করিতে লাগিলাম—উপরে চন্দ্রদেব হাসিতেছেন, তুষারশৃঙ্গগুলি মাথা তুলিয়া দণ্ডায়মান, নদী খরবেগে প্রবাহিতা, এবং চারিদিকে অসংখ্য পার্বত্য পাইন বৃক্ষ।
৮ অগষ্ট। পরদিন আমরা ইসলামাবাদ যাত্রা করিলাম, এবং সোমবার প্রভাতে প্রাতঃকালীন জলযোগে বসিয়াছি, এমন সময়ে মাঝিরা গুণ টানিয়া নৌকাগুলি নিরাপদে শ্রীনগরে আনিয়া লাগাইয়া দিল।
===================
অধ্যায় - ১১
স্থান—প্রত্যাবর্তনের পথে (শ্রীনগর)
কাল—৯ হইতে ১৩ অগষ্ট
৯ অগষ্ট। এই সময়ে আচার্যদেব ক্রমাগত আমাদের নিকট বিদায় লইবার কথা বলিতেছিলেন। সুতরাং যখন আমি খাতায় ‘রমতা সাধু বহতা পানি, ইস্মে ন কোই মৈল লখানি’—এই বাক্যটি লিপিবদ্ধ দেখিতে পাই, তখন আমি স্পষ্ট জানি, ইহার অর্থ কি। ‘যখনই আমায় কষ্ট সহ্য করিতে হয় এবং ভিক্ষোপজীবী হইতে হয়, তখনই আমি কত বেশী ভাল থাকি!’ এই সাগ্রহ কাতরোক্তি, স্বাধীনতা এবং সাধারণ লোকদের সঙ্গে মেলামেশার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, পদব্রজে স্বীয় দীর্ঘ দেশভ্রমণের চিত্রাঙ্কন এবং স্বস্থানে ফিরিয়া যাইবার জন্য পুনরায় আমাদিগের সহিত বারামুল্লায় সাক্ষাৎ, এই সবই উহার
যে নৌকার মাঝিরা স্বামীজীর আপনার হইয়া গিয়াছিল এবং যাহাদিগকে তিনি দুইটি ঋতু ধরিয়া সর্বতোভাবে সাহায্য করিয়া আসিয়াছেন, আজ তাহারা আমাদিগের নিকট বিদায় লইল। সহৃদয়তা এবং সহিষ্ণুতারও যে বাড়াবাড়ি হইতে পারে, তাহারই প্রমাণস্বরূপ পরে তিনি তাঁহার সহিত মাঝিদের সম্বন্ধরূপ সমগ্র ব্যাপারটি উল্লেখ করিতেন।
১০ অগষ্ট। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আমরা সকলে একজনের সহিত দেখা করিবার জন্য বাহির হইলাম। ফিরিবার সময় তাঁহার শিষ্যা নিবেদিতাকে তাঁহার সহিত ক্ষেতগুলির উপর দিয়া বেড়াইয়া আসিবার জন্য ডাকিলেন। তাঁহার কথাবার্তা সমস্তই ছিল স্ত্রীশিক্ষা-কার্য ও সে-বিষয়ে তাহার অভিপ্রায় কি, এই লইয়া। স্বদেশ এবং উহার ধর্মসমূহ সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা যে সমন্বয়মূলক, তাঁহার নিজের বিশেষত্ব শুধু এইটুকু যে, তিনি চাহেন—হিন্দুধর্ম নিষ্ক্রিয় না থাকিয়া সক্রিয় হউক এবং পরের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া তাহাদিগকে স্বমতে আনয়ন করিবার সামর্থ্য উহার থাকুক; কেবল অস্পৃশ্যতাকেই তিনি অস্বীকার করিতেন—এই-সব সম্বন্ধে তিনি বলিতে লাগিলেন। পরে তিনি গভীর ভাবের সহিত—যাঁহারা খুব প্রাচীনপন্থী (Orthodox), তাঁহাদের অনেকের অসাধারণ ধর্মভাব সম্বন্ধে বলিলেন। বলিলেন, ‘ভারতের অভাব কার্যকুশলতা (Practicality)। কিন্তু সেজন্য ভারত যেন কখনও পুরাতন চিন্তাশীল জীবনের উপর তাহার অধিকার ছাড়িয়া না দেয়।’
‘শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছেন, সমুদ্রের ন্যায় গভীর এবং আকাশের ন্যায় উদার হওয়াই আদর্শ। কিন্তু নিয়মনিষ্ঠার সহিত গভীর অন্তর্জীবনের কোন অপরিহার্য সম্পর্ক নাই, এই সম্বন্ধ আকস্মিক। আর যদি আমরা নিজেরা নিজেদের ঠিক করি, তাহা হইলে জগৎও ঠিক হইয়া যাইবে, কারণ আমরা সকলেই কি এক নহি? শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁহার ভিতরের নিগূঢ় তত্ত্বগুলির পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখিতেন; তথাপি বাহ্যদশায় তিনি পুরাদস্তুর কর্মতৎপর ও কর্মপটু ছিলেন।’
অতঃপর তিনি গুরুপূজা-রূপ সেই জটিল প্রশ্নটি সম্বন্ধে বলিলেন, ‘আমার নিজের জীবন সেই মহাপুরুষের চরিত্রের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ দ্বারা চালিত, কিন্তু এটি অপরের পক্ষে কতদূর খাটিবে, তাহা প্রত্যেকে নিজে নিজেই ঠিক করিয়া লইবে। অতীন্দ্রিয় তত্ত্বসকল শুধু যে একজন লোকের মধ্য দিয়াই জগতে প্রসারিত হয়, এমন নহে।’
১১ অগষ্ট। এই দিন করকোষ্ঠী দেখার জন্য আমাদের মধ্যে একজনকে স্বামীজীর নিকট ভর্ৎসনা সহ্য করিতে হইয়াছিল। তিনি বলিলেন, ‘এ জিনিষটাকে সকলেই চায়, তবু সমগ্র ভারত ইহাকে হেয় জ্ঞান করে, ঘৃণা করে।’ একজনের একটু বিশেষ ওকালতির উত্তরে বলিলেন, ‘চেহারা দেখিয়া চরিত্র বলিয়া দেওয়াও আমি সমর্থন করি না। বলিতে কি, তোমাদের অবতার এবং তাঁহার শিষ্যবর্গ যদি সিদ্ধাইগুলা না দেখাইতেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাকে আরও বেশী সত্যসন্ধ বলিয়া মনে করিতাম। এই কার্যের জন্য বুদ্ধ এক ভিক্ষুকে সঙ্ঘচ্যুত করিয়াছিলেন।’
১২ ও ১৩ অগষ্ট। স্বামীজী আজকাল একজন ব্রাহ্মণ পাচক রাখিয়াছেন। একজন মুসলমান পর্যন্ত তাঁহাকে রাঁধিয়া দিতে পারে, তাঁহার এইরূপ অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে অমরনাথ-যাত্রী সাধুদের যুক্তিগুলি বড়ই মর্মস্পর্শী ছিল। তাঁহারা বলিয়াছিলেন, ‘অন্ততঃ শিখদের দেশে এটি করিবেন না, স্বামীজী!’ এবং তিনিও অবশেষে সম্মতি দিয়াছিলেন। কিন্তু উপস্থিত তিনি তাঁহার মুসলমান মাঝির শিশু কন্যাটিকে উমারূপে পূজা করিতেছিলেন। ভালবাসা বলিতে সে শুধু সেবা করা বুঝিত, এবং স্বামীজীর কাশ্মীর ত্যাগের দিনে সেই শিশু তাঁহার জন্য একথাল আপেল সানন্দে নিজে সমস্ত পথ হাঁটিয়া টঙ্গায় তুলিয়া দিয়া গিয়াছিল। স্বামীজীকে তৎকালে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হইলেও বালিকাকে তিনি কখনও ভুলিয়া যান নাই। কাশ্মীরে থাকিতে থাকিতেই তিনি একদিনকার কথা প্রায়ই সানন্দে স্মরণ করিতেন। বালিকা সেদিন নৌকার গুণ টানিবার রাস্তায় একটি নীলবর্ণের ফুল দেখিতে পায়, এবং সেখানে বসিয়া উহাকে একবার এধারে, একবার ওধারে আঘাত করিতে করিতে কুড়ি মিনিট কাল সেই ফুলটির সহিত একাকী কাটায়।
নদীতটে একখণ্ড জমি ছিল, তাহার উপর তিনটি চেনার গাছ জন্মিয়াছিল। ইহাদের কথা ভাবিলেই আমরা এই সময়ে এক বিশেষ আনন্দ অনুভব করিতাম। কারণ—কাশ্মীরের মহারাজ স্বামীজীকে উহা দিবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন এবং আমাদের যে ভাবে কার্যে ‘দেশের লোকের দ্বারা, দেশের লোকের জন্য, এবং সেবক ও সেব্য—উভয়েরই প্রীতিকর’—এই মহান্ ভাব রূপায়িত হইবে, উক্ত স্থানটিকে তাহারই এক কর্ম-কেন্দ্র বলিয়া আমরা সকলে এক মানসচিত্র অঙ্কিত করিলাম।
নারীগণই গৃহনির্মাণস্থানের মাঙ্গলিক কার্য বিধান করিবেন, ভারতে প্রচলিত এই ধারণা জানা থাকায় একজন বলিয়া উঠিলেন, আমরা উক্ত স্থানে গিয়া কিছুক্ষণের জন্য ছাউনি ফেলিয়া উহাকে দখল করিয়া লইলে কিরূপ হয়? উক্ত স্থান ইওরোপীয়গণ কর্তৃক ব্যবহৃত ছাউনি ফেলিবার ছোটখাট স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বলিয়া ইহা সম্ভব হইয়াছিল।
===================
অধ্যায় - ১২
স্থান—চেনার-তলে ছাউনি, শ্রীনগর)
কাল—১৪ অগষ্ট হইতে ২০ সেপ্টেম্বর
১৪ অগষ্ট—৩ সেপ্টেম্বর। রবিবার প্রাতঃকাল; পরবর্তী অপরাহ্নে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে স্বামীজী আমাদের সহিত চা পান করিতে আসিতে সম্মত হন। একজন ইওরোপীয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তিনি বেদান্তের একজন অনুরাগী বলিয়া বোধ হইয়াছিল। এ-বিষয়ে স্বামীজীর কিন্তু কোন উৎসাহ দেখা গেল না। তিনি ঐ জিজ্ঞাসুকে বুঝাইবার জন্য যৎপরোনাস্তি ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার চেষ্টা একেবারেই নিষ্ফল হইয়াছিল। অন্যান্য কথার সঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি তো চাই—নিয়মলঙ্ঘন করা সম্ভব হউক, কিন্তু তা হয় কই? যদি সত্য-সত্যই আমরা কোন নিয়মের ব্যতিক্রম করিতে সমর্থ হইতাম, তাহা হইলে তো আমরা মুক্ত হইয়া যাইতাম। যাহাকে আপনি নিয়ম-ভঙ্গ বলেন, উহা তো অন্য এক প্রকারে নিয়মপালন মাত্র।’ তৎপরে তিনি তুরীয় অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যাঁহাকে তিনি কথাগুলি বলিলেন, তাঁহার শুনিবার কান ছিল না।
১৬ সেপ্টেম্বর। মঙ্গলবার দিন তিনি আর একবার মধ্যাহ্নভোজনে আমাদের ক্ষুদ্র ছাউনিতে আসিলেন। অপরাহ্নে এমন জোরে বৃষ্টি শুরু হইল যে, তাঁহার ফিরিয়া যাওয়া হইল না। নিকটে একখানি টডের ‘রাজস্থান’ পড়িয়াছিল, তাহাই উঠাইয়া লইয়া কথায় কথায় মীরাবাঈ-এর কথা পাড়িলেন। বলিলেন, ‘বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।’ যাহার সকল অংশই উত্তম এমন ‘টডে’র মধ্যে—যিনি রাণী হইয়াও রাণীত্ব পরিত্যাগ করিয়া কৃষ্ণ-প্রেমিকাগণের সঙ্গে পৃথিবীতে বিচরণ করিতে চাহিয়াছিলেন, সেই মীরাবাঈ-এর গল্পটি তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। তিনি যে শরণাগতি, প্রার্থনাপরতা ও সর্বজীবে সেবা প্রচার করিয়াছিলেন, উহা যে শ্রীচৈতন্য-প্রচারিত ‘নামে রুচি জীবে দয়া’র ভাব হইতে ভিন্ন, তাহাও উল্লেখ করিলেন। মীরাবাঈ স্বামীজীর অন্যতম প্রধান প্রেরণাদাত্রী। বিখ্যাত দস্যুদ্বয়ের হঠাৎ স্বভাব-পরিবর্তন, এবং শেষে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হইয়া তাঁহাকে বিগ্রহে লীন করিয়া ফেলিলেন—এই-সব গল্পের কথা লোকে অন্যান্য সূত্রে অবগত আছে, সেগুলিকে তিনি মীরাবাঈ-এর গল্পের অন্তর্ভুক্ত করিতেন। একবার তিনি মীরাবাঈ-এর একটি গীত আবৃত্তি এবং অনুবাদ করিয়া একজন মহিলাকে শুনাইতেছেন, শুনিলাম; আহা, যদি সবটা মনে রাখিতে পারিতাম! তাঁহার অনুবাদের প্রথম কথাগুলি এই, ‘ভাই লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক!’ এবং শেষাংশ এই ছিল—‘সেই অঙ্কা বঙ্কা নামক দস্যু ভ্রাতৃদ্বয়, সেই নিষ্ঠুর সুজন কসাই এবং খেলার ছলে টিয়াপাখীকে কৃষ্ণনাম করিতে শিখাইয়াছিল সেই গণিকা, তাহারা যদি উদ্ধার পাইয়া থাকে, তবে সকলেরই আশা আছে।’২১
আবার, আমি তাঁহাকে মীরাবাঈ-এর সেই অদ্ভুত গল্পটি বলিতে শুনিয়াছি। মীরাবাঈ বৃন্দাবনে পৌঁছিয়া জনৈক বিখ্যাত সাধুকে২২ নিমন্ত্রণ করেন। বৃন্দাবনে পুরুষের সহিত নারীগণের সাক্ষাৎ অকর্তব্য, এই বলিয়া সাধু যাইতে অস্বীকার করেন। যখন তিনবার এইরূপ ঘটিল, তখন ‘বৃন্দাবনে আর কেহ যে পুরুষ আছে, তাহা আমি জানিতাম না। আমার ধারণা ছিল—এখানে শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষরূপে বিরাজিত!’ এই বলিয়া মীরাবাঈ স্বয়ং তাঁহার নিকট গমন করিলেন। যখন বিস্মিত সাধুর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল, তখন ‘নির্বোধ, তুমি নাকি নিজেকে পুরুষ বলিয়া অভিহিত কর?’—এই বলিয়া তিনি স্বীয় অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করিয়া ফেলিলেন আর যেমন সাধু সভয়ে চীৎকার করিয়া তাঁহার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিলেন, অমনি তিনিও তাঁহাকে মাতা যেরূপে সন্তানকে আশীর্বাদ করেন, সেইরূপে আশীর্বাদ করিলেন।
অদ্য স্বামীজী আকবরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন, এবং উক্ত বাদশাহের সভাকবি তানসেনের রচিত তাঁহার সিংহাসনাধিরোহণ-বিষয়ক একটি গীত আমাদের নিকট গাহিলেন।
তারপর স্বামীজী নানা কথা কহিতে কহিতে ‘আমাদের জাতীয় বীর’ প্রতাপসিংহের সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেনঃ কেহ তাঁহাকে কখনও বশ্যতা স্বীকার করাইতে পারে নাই। হাঁ, একবার মুহূর্তের জন্য তিনি পরাভব স্বীকার করিতে প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন বটে। একদিন চিতোর হইতে পলায়নের পর মহারাণী স্বয়ং রাত্রের সামান্য খাবার প্রস্তুত করিয়াছেন, এমন সময়ে এক ক্ষুধিত মার্জার ছেলেদের জন্য যে রুটীখানি নিদিষ্ট ছিল, তাহারই উপর ঝাপট মারিয়া সেখানি লইয়া গেল। মেবার-রাজ স্বীয় শিশুসন্তানগুলিকে খাদ্যের জন্য কাঁদিতে দেখিলেন। তখন বাস্তবিকই তাঁহার বীরহৃদয় অবসন্ন হইয়া পড়িল। অদূরে স্বাচ্ছন্দ্য এবং শান্তির চিত্র দেখিয়া তিনি প্রলুব্ধ হইলেন, এবং মুহূর্তের জন্য তিনি এই অসমান যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া আকবরের সহিত মিত্রতা-স্থাপনের সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা কেবল এক মুহূর্তেরই জন্য। সনাতন বিশ্বনিয়ন্তা পরমেশ্বর তাঁহার প্রিয়জনকে রক্ষা করিয়া থাকেন। উক্ত চিত্র প্রতাপের মানসপট হইতে অন্তর্হিত হইতে না হইতেই এক রাজপুত নরপতির নিকট হইতে দূত আসিয়া তাঁহাকে সেই প্রসিদ্ধ কাগজপত্রগুলি দিল। তাহাতে লেখা ছিলঃ ‘বিধর্মীর সংস্পর্শে যাঁহার শোণিত কলুষিত হয় নাই, এরূপ লোক আমাদের মধ্যে মাত্র একজন আছেন। তাঁহারও মস্তক ভূমিস্পর্শ করিয়াছে, এ কথা যেন কেহ কখনও বলিতে না পারে।’ পাঠ করিবামাত্র প্রতাপের হৃদয় সাহস এবং নূতন আত্মপ্রত্যয়ে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল। তিনি বীরগর্বে দেশ হইতে শত্রুকুল নির্মূল করিয়া উদয়পুরে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
তারপর অনূঢ়া রাজনন্দিনী কৃষ্ণকুমারীর সেই অদ্ভুত গল্প শুনিলাম। একাধিক নরপতি একসঙ্গে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিতে চাহিতেছিলেন। আর যখন তিনটি বৃহৎ বাহিনী পুরদ্বারে উপস্থিত, তাঁহার পিতা কোন উপায়ান্তর না দেখিয়া কন্যাকে বিষ দিতে মনঃস্থ করিলেন। কৃষ্ণকুমারীর খুল্লতাতের উপর এই ভার অর্পিত হইল। বালিকা যখন নিদ্রিতা—সেই সময় খুল্লতাত উক্ত কার্য সম্পাদনার্থ তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু সৌন্দর্য ও কোমল বয়স দেখিয়া এবং শিশুকালের মুখও মনে পড়ায় তাঁহার যোদ্ধৃহৃদয় দমিয়া গেল এবং তিনি নির্দিষ্ট কার্য করিতে অক্ষম হইলেন। কোন শব্দ শুনিতে পাইয়া কৃষ্ণকুমারী জাগিয়া উঠিলেন এবং নির্ধারিত সঙ্কল্পের বিষয় অবগত হইয়া হাত বাড়াইয়া বাটিটি লইলেন এবং হাসিতে হাসিতে সেই বিষ পান করিয়া ফেলিলেন। এইরূপ ভূরি ভূরি গল্প আমরা শুনিতে লাগিলাম। কারণ, রাজপুত-বীরগণের এরূপ গল্প অসংখ্য।
২০ সেপ্টেম্বর। শনিবারে স্বামীজী দুই দিনের জন্য আমেরিকার রাজদূত ও তাঁহার পত্নীর আতিথ্য স্বীকার করতে ডাল হ্রদে গমন করিলেন। সোমবারে ফিরিয়া আসিলেন এবং মঙ্গলবারে স্বামীজী আমাদের নূতন ‘মঠে’ (আমরা ছাউনির ঐ আখ্যাই দিয়াছিলাম) আসিলেন এবং যাহাতে তিনি গাণ্ডেরবল যাত্রা করিবার পূর্বে কয়েক দিন আমাদের সহিত বাস করিতে পারেন—এই উদ্দেশ্যে তাঁহার নৌকাখানিকে আমাদের নৌকার খুব নিকটে লাগাইলেন।
[সম্পাদক (স্বামী সারদানন্দ)—লিখিত পরিশিষ্ট]
গাণ্ডেরবল হইতে স্বামীজী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ফিরিয়া আসিলেন, এবং বিশেষ কোন কারণবশতঃ তিনি যে কয়েক দিনের মধ্যেই বাঙলা দেশে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছেন, তাহা সকলের নিকট প্রকাশ করিলেন। স্বামীজীর ইওরোপীয় সঙ্গিগণ ইতঃপূর্বে শীত পড়িতেই লাহোর, দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি উত্তর-ভারতের মুখ্য নগরগুলি দেখিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। অতএব সকলেই একত্র লাহোরে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এখানে কয়জনকে উত্তর-ভারতের স্থানাদি দর্শন করিবার সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিতে রাখিয়া স্বামীজী সদলবলে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন।
===================
0 Comments