শ্যামপুকুরে কালীপূজা দিবসে ভক্তসঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

দ্বাবিংশ খণ্ড
শ্যামপুকুর বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্যামপুকুরে কালীপূজা দিবসে ভক্তসঙ্গে

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

৺কালীপূজার দিবসে শ্যামপুকুর বাটীতে ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরে বাটীর উপরের দক্ষিণের ঘরে দাঁড়াইয়া আছেন। বেলা ৯টা। ঠাকুরের পরিধানে শুদ্ধবস্ত্র এবং কপালে চন্দনের ফোঁটা।
মাস্টার ঠাকুরের আদেশে ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রসাদ আনিয়াছেন; প্রসাদ হস্তে ঠাকুর অতি ভক্তিভাবে দাঁড়াইয়া কিঞ্চিৎ মস্তকে ধারণ করিতেছেন। গ্রহণ করিবার সময় পাদুকা খুলিয়াছেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “বেশ প্রসাদ।”
আজ শুক্রবার (২২শে কার্তিক, ১২৯২); আশ্বিন অমাবস্যা, ৬ই নভেম্বর, ১৮৮৫। আজ ৺কালীপূজা।
ঠাকুর মাস্টারকে আদেশ করিয়াছিলেন ঠনঠনের ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতাকে পুষ্প, ডাব, চিনি, সন্দেশ দিয়ে আজ সকালে পূজা দিবে। মাস্টার স্নান করিয়া নগ্নপদে সকালে পূজা দিয়া আবার নগ্নপদে ঠাকুরের কাছে প্রসাদ আনিয়াছেন।
ঠাকুরের আর একটি আদেশ — ‘রামপ্রসাদের ও কমলাকান্তের গানের বই কিনিয়া আনিবে।’ ডাক্তার সরকারকে দিতে হইবে।
মাস্টার বলিতেছেন, “এই বই আনিয়াছি। রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানের বই।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, “এই গান সব (ডাক্তারের ভিতর) ঢুকিয়ে দেবে।”
গান – মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে।
সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে ৷৷
গান – কে জানে কালী কেমন। ষড়্‌দর্শনে না পায় দরশন।
গান – মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা ৷৷
গান – আয় মন বেড়াতে যাবি।
কালী কল্পতরু মূলে রে মন চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ৷৷
মাস্টার বলিলেন, আজ্ঞা হাঁ। ঠাকুর মাস্টারের সহিত ঘরে পায়চারি করিতেছেন — চটিজুতা পায়ে। অত অসুখ — সহাস্যবদন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর ও গানটাও বেশ! — ‘এ সংসার ধোঁকার টাটি’। আর ‘এ সংসার মজার কুটি! ও ভাই আনন্দ বাজারে লুটি।’
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।
ঠাকুর হঠাৎ চমকিত হইতেছেন। অমনি পাদুকা ত্যাগ করিয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইলেন। একেবারে সমাধিস্থ। আজ জগন্মাতার পূজা, তাই কি মুহুর্মুহুঃ চমকিত এবং সমাধিস্থ! অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া যেন অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিলেন।
==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কালীপূজার দিবসে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর সেই উপরের ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন; বেলা ১০টা। বিছানার উপর বালিশে ঠেসান দিয়া আছেন, ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া। রাম, রাখাল, নিরঞ্জন, কালীপদ, মাস্টার প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত আছেন। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় মুখুজ্জের কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাম প্রভৃতিকে) — হৃদে এখনও জমি জমি করছে। যখন দক্ষিণেশ্বরে তখন বলেছিল, শাল দাও, না হলে নালিশ করব।
“মা তাকে সরিয়ে দিলেন। লোকজন গেলে কেবল টাকা টাকা করত। সে যদি থাকত এ-সব লোক যেত না। মা সরিয়ে দিলেন।
“গো — অমনি আরম্ভ করেছিল। খুঁতখুঁত করত। গাড়িতে আমার সঙ্গে যাবে তা দেরি করত। অন্য ছোকরারা আমার কাছে এলে বিরক্ত হত। তাদের যদি আমি কলকাতায় দেখতে যেতাম — আমায় বলত, ওরা কি সংসার ছেড়ে আসবে তাই দেখতে যাবেন! জল-খাবার ছোকরাদের দেওয়া আগে ভয়ে বলতুম, তুই খা আর ওদের দে। জানতে পারলুম ও থাকবে না।
“তখন মাকে বললাম — মা ওকে হৃদের মতো একেবারে সরাস নে। তারপর শুনলাম বৃন্দাবনে যাবে।
“গো — যদি থাকত এই-সব ছোকরাদের হত না। ও বৃন্দাবনে চলে গেল তাই এই-সব ছোকরারা আসতে যেতে লাগল।”
গো (বিনীতভাবে) — আজ্ঞে, আমার তা মনে ছিল না।
রাম (দত্ত) — তোমার মন উনি যা বুঝবেন তা তুমি বুঝবে?
(গো) — চুপ করিয়া রহিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গো প্রতি) তুই কেন অমন করছিস — আমি তোকে সন্তান অপেক্ষা ভালবাসি!
“তুই চুপ কর না …… এখন তোর সে ভাব নাই।”
ভক্তদের সহিত কথাবার্তার পর তাঁহারা কক্ষান্তরে চলিয়া গেলে ঠাকুর গো – কে ডাকাইলেন ও বলিলেন, তুই কি কিছু মনে করেছিস।
গো — আজ্ঞে না।
ঠাকুর মাস্টারকে বলিলেন, আজ কালীপূজা, কিছু পূজার আয়োজন করা ভাল। ওদের একবার বলে এস। পাঁকাটি এনেছে কিনা জিজ্ঞাসা করো দেখি।
মাস্টার বৈঠকখানায় গিয়া ভক্তদের সমস্ত জানাইলেন। কালীপদ ও অন্যান্য ভক্তেরা পূজার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
বেলা আন্দাজ ২টার সময় ডাক্তার ঠাকুরকে দেখিতে আসিলেন। সঙ্গে অধ্যাপক নীলমণি। ঠাকুরের কাছে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। গিরিশ, কালীপদ, নিরঞ্জন, রাখাল, খোকা (মণীন্দ্র), লাটু, মাস্টার অনেকে। ঠাকুর সহাস্যবদন, ডাক্তারের সঙ্গে অসুখের কথা ও ঔষধাদির কথা একটু হইলে পর বলিতেছেন, “তোমার জন্য এই বই এসেছে।” ডাক্তারের হাতে মাস্টার সেই দুখানি বই দিলেন।
ডাক্তার গান শুনিতে চাইলেন। ঠাকুরের আদেশক্রমে মাস্টার ও একটি ভক্ত রামপ্রসাদের গান গাইতেছেন:
গান – মন কর কি তত্ত্ব তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে।
গান – কে জানে কালী কেমন ষড়দর্শনে না পায় দরশন।
গান – মন রে কৃষি কাজ জান না।
গান – আয় মন বেড়াতে যাবি।
ডাক্তার গিরিশকে বলিতেছেন, “তোমার ওই গানটি বেশ — বীণের গান — বুদ্ধ চরিতের।” ঠাকুরের ইঙ্গিতে গিরিশ ও কালীপদ দুইজনে মিলিয়া গান শুনাইতেছেন:
আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার।
যে যত্ন জানে বাজায় বিণে উঠে সুধা অনিবার ৷৷
তানে মানে বাঁধলে ডুরি, শত ধারে বয় মাধুরী।
বাজে না আলগা তারে, টানে ছিঁড়ে কোমল তার ৷৷
গান – জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ৷৷
কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন,
জাগিয়ে ঘুমাই কুহকে যেন।
এ কেমন ঘোর, হবে নাকি ভোর,
অধীর-অধীর যেমতি সমীর, অবিরাম গতি নিয়ত ধাই ৷৷
জানি না কেবা, এসেছি কোথায়,
কেন বা এসেছি, কোথা নিয়ে যায়,
যাই ভেসে ভেসে কত কত দেশে,
চারিদিকে গোল ওঠে নানা রোল।
কত আসে যায়, হাসে কাঁদে গায়,
এই আছে আর তখনি নাই ৷৷
কি কাজে এসেছি কি কাজে গেল,
কে জানে কেমন কি খেলা হল।
প্রবাহের বারি, রহিতে কি পারি,
যাই যাই কোথা কূল কি নাই?
কর হে চেতন, কে আছ চেতন,
কতদিনে আর ভাঙিবে স্বপন?
কে আছ চেতন ঘুমাইও না আর,
দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার।
কর তমঃ নাশ, হও হে প্রকাশ,
তোমা বিনা আর নাহিক উপায়,
তব পদে তাই শরণ চাই ৷৷
গান – আমায় ধর নিতাই
আমার প্রাণ যেন আক করে রে কেমন ৷৷
নিতাই, জীবকে হরি নাম বিলাতে,
উঠল গো ঢেউ প্রেম-নদীতে,
(এখন) সেই তরঙ্গে এখন আমি ভাসিয়ে যাই।
নিতাই যে দুঃখ আমার অন্তরে, দুঃখের কথা কইব কারে,
জীবের দুঃখে এখন আমি ভাসিয়ে যাই।
গান – প্রাণভরে আয় হরি বলি, নেচে আয় জগাই মাধাই।
গান – কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জুয়ারে বয়ে যায়।
বহিছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায় ৷৷
প্রেমের কিশোরী প্রেম বিলায় সাধ করি,
রাধার প্রেমে বল রে হরি।
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেম তরঙ্গে প্রাণ নাচায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে, আয় আয় আয় আয় ৷৷
গান শুনিতে শুনিতে দুই-তিনটি ভক্তের ভাব হইয়া গেল, — খোকার (মণীন্দ্রের), লাটুর! লাটু নিরঞ্জনের পার্শ্বে বসিয়াছিলেন। গান হইয়া গেলে ঠাকুরের সহিত ডাক্তার আবার কথা কহিতেছেন। গতকল্য প্রতাপ (মজুমদার) ঠাকুরকে ‘নাক্‌স্‌ ভমিকা’ ঔষধ দিয়াছিলেন। ডাক্তার সরকার শুনিয়া বিরক্ত হইয়াছেন।
ডাক্তার — আমি তো মরি নাই, নাক্‌স্‌ ভমিকা দেওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তোমার অবিদ্যা মরুক!
ডাক্তার — আমার কোনকালে অবিদ্যা নাই।
ডাক্তার অবিদ্যা মানে নষ্টা স্ত্রীলোক বুঝিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — না গো! সন্ন্যাসীর অবিদ্যা মরে যায় আর বিবেক সন্তান হয়। অবিদ্যা মা মরে গেলে অশৌচ হয়, — তাই বলে সন্ন্যাসীকে ছুঁতে নাই।
হরিবল্লভ আসিয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “তোমায় দেখলে আনন্দ হয়।” হরিবল্লভ অতি বিনীত। মাদুরের নিচে মাটির উপর বসিয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন। হরিবল্লভ কটকের বড় উকিল।
কাছে অধ্যাপক নীলমণি বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাঁহার মান রাখিতেছেন ও বলিতেছেন, আজ আমার খুব দিন। কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তার ও তাঁহার বন্ধু নীলমণি বিদায় গ্রহণ করিলেন। হরিবল্লভও আসিলেন। আসিবার সময় বলিলেন, আমি আবার আসব।
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

জগন্মাতা ৺কালীপূজা
শরৎকাল, অমাবস্যা, রাত্রি ৭টা। সেই উপরের ঘরেই পূজার সমস্ত আয়োজন হইয়াছে। নানাবিধ পুষ্প, চন্দন, বিল্বপত্র, জবা; পায়স ও নানাবিধ মিষ্টান্ন ঠাকুরের সম্মুখে ভক্তেরা আনিয়াছেন। ঠাকুর বসিয়া আছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। শরৎ, শশী, রাম, গিরিশ, চুনিলাল, মাস্টার, রাখাল, নিরঞ্জন, ছোট নরেন, বিহারী প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত।
ঠাকুর বলিতেছেন, “ধুনা আন”। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর জগন্মাতাকে সমস্ত নিবেদন করিলেন। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। মাস্টারের দিকে তাকাইয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “একটু সবাই ধ্যান করো”। ভক্তেরা সকলে একটু ধ্যান করিতেছেন।
দেখিতে দেখিতে গিরিশ ঠাকুরের পাদপদ্মে মালা দিলেন। মাস্টারও গন্ধপুষ্প দিলেন। তারপরেই রাখাল। তারপর রাম প্রভৃতি সকল ভক্তেরা চরণে ফুল দিতে লাগিলেন।
নিরঞ্জন পায়ে ফুল দিয়া ব্রহ্মময়ী ব্রহ্মময়ী বলিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া, পায়ে মাথা দিয়া প্রণাম করিতেছেন। ভক্তেরা সকলে ‘জয় মা! জয় মা!’ ধ্বনি করিতেছেন।
দেখিতে দেখিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হইয়াছেন। কি আশ্চর্য! ভক্তেরা অদ্ভুত রূপান্তর দেখিতেছেন। ঠাকুরের জ্যোতির্ময় বদনমণ্ডল! দুই হস্তে বরাভয়! ঠাকুর নিস্পন্দ বাহ্যশূন্য! উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। সাক্ষাৎ জগন্মাতা কি ঠাকুরের ভিতর আবিভূর্তা হইলেন!
সকলে অবাক্‌ হইয়া এই অদ্ভুত বরাভয়দায়িনী জগন্মাতার মূর্তি দর্শন করিতেছেন।
এইবারে ভক্তেরা স্তব করিতেছেন। আর একজন গান গাহিয়া স্তব করিতেছেন ও সকলে যোগদান করিয়া সমস্বরে গাইতেছেন।
গিরিশ স্তব করিতেছেন:
কে রে নিবিড় নীল কাদম্বিনী সুরসমাজে।
কে রে রক্তোৎপল চরণ যুগল হর উরসে বিরাজে ৷৷
কে রে রজনীকর নখরে বাস, দিনকর কত পদে প্রকাশ।
মৃদু মৃদু হাস ভাস, ঘন ঘন ঘন গরজে ৷৷
আবার গাইতেছেন:
দীনতারিণী, দূরিতহারিনী, সত্ত্বরজস্তম ত্রিগুণধারিণী,
সৃজন-পালন-নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্বস্বরূপিণী।
ত্বংহি কালী তারা পরমাপ্রকৃতি, ত্বংহি ব্যোম ব্যোমকেশ প্রসবিনী।
ত্বংহি স্থল জল অনিল অনল, ত্বংহি ব্যোম ব্যোমকেশ প্রসবিনী।
সাংখ্য পাতঞ্জল মীমাংসক ন্যায়, তন্ন তন্ন জ্ঞানে ধ্যানে সদা ধ্যায়,
বৈশেষিক বেদান্তে ভ্রমে হয়ে ভ্রান্ত, তথাপি অদ্যাপি জানিতে পারেনি ৷৷
নিরুপাধি আদি অন্তরহিত, করিতে সাধক জনার হিত,
গণেশাদি পঞ্চরূপে কালবঞ্চ ভবভয়হরা ত্রিকালবর্তিনী।
সাকার সাধকে তুমি সে সাকার, নিরাকার উপাসকে নিরাকার,
কেহ কেহ কয় ব্রহ্ম জ্যোতির্ময়, সেও তুমি নগতনয়া জননী।
যে অবধি যার অভিসন্ধি হয়, সে অবধি সে পরব্রহ্ম কয়,
তৎপরে তুরীয় অনির্বচনীয়, সকলি মা তারা ত্রিলোকব্যাপিনী।
বিহারী স্তব করিতেছেন:
মনেরি বাসনা শ্যামা শবাসনা শোন মা বলি,
হৃদয় মাঝে উদয় হইও মা, যখন হবে অন্তর্জলি।
তখন আমি মনে মনে, তুলব জবা বনে বনে,
মিশাইয়ে ভক্তি চন্দন মা, পদে দিব পুষ্পাঞ্জলি।
মণি গাহিতেছেন ভক্তসঙ্গে:
সকলি তোমারি ইচ্ছা মা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি,
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।
পঙ্কে বদ্ধ কর করী পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি,
কারে দাও মা ইন্দ্রত্বপদ কারে কর অধোগামী।
আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী,
আমি রথ তুমি রথী যেমন চালাও তেমনি চলি।
গান – তোমারি করুণায় মা সকলি হইতে পারে।
অলঙ্ঘ্য পর্বত সম বিঘ্ন বাধা যায় দূরে ৷৷
তুমি মঙ্গল নিধান, করিছ মঙ্গল বিধান।
তবে কেন বৃথা মরি ফলাফল চিন্তা করে ৷৷
গান – গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না।
গান — নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। আদেশ করিতেছেন, এই গানটি গাইতে —
গান – কখন কি রঙ্গে থাক মা শ্যামা সুধাতরঙ্গিণী।
গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর আবার আদেশ করিতেছেন —
গান – শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা।
ঠাকুর ভক্তবৃন্দের আনন্দের জন্য একটু পায়স মুখে দিতেছেন। কিন্তু একেবারে ভাবে বিভোর, বাহ্যশূন্য হইলেন!
কিয়ৎক্ষণ পরে ভক্তেরা সকলে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া প্রসাদ লইয়া বৈঠকখানা ঘরে গেলেন ও সকলে মিলিয়া আনন্দ করিতে করিতে সেই প্রসাদ পাইলেন। রাত ৯টা। ঠাকুর বলিয়া পাঠাইলেন — রাত হইয়াছে, সুরেন্দ্রের বাড়িতে আজ ৺কালীপূজা হবে, তোমরা সকলে নিমন্ত্রণে যাও।
ভক্তেরা আনন্দ করিতে করিতে সিমলা স্ট্রীটে সুরেন্দ্রের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। সুরেন্দ্র অতি যত্নসহকারে তাঁহাদিগকে উপরের বৈঠকখানা ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। বাটীতে উৎসব। সকলেই গীতবাদ্য ইত্যাদি লইয়া আনন্দ করিতেছেন।
সুরেন্দ্রের বাটীতে প্রসাদ পাইয়া বাড়িতে ফিরিতে ভক্তদের প্রায় দুই প্রহরের অধিক রাত্রি হইয়াছিল।
==========

Post a Comment

0 Comments