দক্ষিণেশ্বরে দ্বিজ, পণ্ডিতজী, মাষ্টার, কাপ্তেন, ত্রৈলােক্য, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ 

সপ্তদশ খণ্ড
শ্রীরামকৃষ্ণ কাপ্তেন, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে

দক্ষিণেশ্বরে দ্বিজ, পণ্ডিতজী, মাষ্টার, কাপ্তেন, ত্রৈলােক্য, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

ঠাকুরের গলার অসুখের সূত্রপাত
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বিশ্রাম করিতেছেন। আজ শনিবার, ১৩ই জুন, ১৮৮৫, (৩২শে জৈষ্ঠ, ১২৯২) জৈষ্ঠ শুক্লা প্রতিপদ, জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি। বেলা তিনটা। ঠাকুর খাওয়া-দাওয়ার পর ছোট খাটটিতে একটু বিশ্রাম করিতেছেন।
পণ্ডিতজী মেঝের উপর মাদুরে বসিয়া আছেন। একটি শোকাতুরা ব্রাহ্মণী ঘরের উত্তরের দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আছেন। কিশোরীও আছেন। মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। সঙ্গে দ্বিজ ইত্যাদি। অখিলবাবুর প্রতিবেশীও বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে একটি আসামী ছোকরা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু অসুস্থ আছেন। গলায় বিচি হইয়া সর্দির ভাব। গলার অসুখের এই প্রথম সূত্রপাত।
বড় গরম পড়াতে মাস্টারেরও শরীর অসুস্থ। ঠাকুরকে সর্বদা দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বরে আসিতে পারেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — এই যে তুমি এসেছ। বেশ বেলটি। তুমি কেমন আছ?
মাস্টার — আজ্ঞা, আগেকার চেয়ে একটু ভাল আছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বড় গরম পড়েছে। একটু একটু বরফ খেও। আমারও বাপু বড় গরম পড়ে কষ্ট হয়েছে। গরমেতে কুলপি বরফ — এই সব বেশি খাওয়া হয়েছিল। তাই গলায় বিচি হয়েছে। গয়ারে এমন বিশ্রী গন্ধ দেখি নাই।
“মাকে বলেছি, মা! ভাল করে দাও, আর কুলপি খাব না।
“তারপর আবার বলেছি, বরফও খাব না।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সত্যকথা — তাঁহার জ্ঞানী ও ভক্তের অবস্থা ]
“মাকে যেকালে বলছি ‘খাব না’ আর খাওয়া হবে না। তবে এমন হঠাৎ ভুল হয়ে যায়। বলেছিলাম, রবিবারে মাছ খাব না। এখন একদিন ভুলে খেয়ে ফেলেছি।
“কিন্তু জেনে-শুনে হবার জো নাই। সেদিন গাড়ু নিয়ে একজনকে ঝাউতলার দিকে আসতে বললুম। এখন সে বাহ্যে গিছল, তাই আর-একজন নিয়ে এসেছিল। আমি বাহ্যে করে এসে দেখি যে, আর-একজন গাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গাড়ুর জল নিতে পারলুম না। কি করি? মাটি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম — যতক্ষণ না সে এসে জল দিলে।
“মার পাদপদ্মে ফুল দিয়ে যখন সব ত্যাগ করতে লাগলাম, তখন বলতে লাগলাম, ‘মা! এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি; এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম; এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য; এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ; আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ কিন্তু এই লও তোমার সত্য, এই লও তোমার মিথ্যা — এ-কথা বলতে পারলাম না।”
একজন ভক্ত বরফ আনিয়াছিলেন। ঠাকুর পুনঃপুনঃ মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “হাঁগা খাব কি?”
মাস্টার বিনীতভাবে বলিতেছেন, “আজ্ঞা, তবে মার সঙ্গে পরামর্শ না করে খাবেন না।”
ঠাকুর অবশেষে বরফ খাইলেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — শুচি-অশুচি — এটি ভক্তি ভক্তের পক্ষে। জ্ঞানীর পক্ষে নয়। বিজয়ের শাশুড়ী বললে, ‘কই আমার কি হয়েছে? এখনও সকলের খেতে পারি না!’ আমি বললাম, ‘সকলের খেলেই কি জ্ঞান হয়? কুকুর যা তা খায়, তাই বলে কি কুকুর জ্ঞানী?’
(মাস্টারের প্রতি) — “আমি পাঁচ ব্যান্নন দিয়ে খাই কেন? পাছে একঘেয়ে হলে এদের (ভক্তদের) ছেড়ে দিতে হয়।
“কেশব সেনকে বললাম, আরও এগিয়ে কথা বললে তোমার দলটল থাকে না!
“জ্ঞানীর অবস্থায় দলটল মিথ্যা — স্বপ্নবৎ।…
“মাছ ছেড়ে দিলাম। প্রথম প্রথম কষ্ট হত, পরে তত কষ্ট হত না। পাখির বাসা যদি কেউ পুড়িয়ে দেয়, সে উড়ে উড়ে বেড়ায়; আকাশ আশ্রয় করে। দেহ, জগৎ — যদি ঠিক মিথ্যা বোধ হয়, তাহলে আত্মা সমাধিস্থ হয়।
“আগে ওই জ্ঞানীর অবস্থা ছিল। লোক ভাল লাগত না। হাটখোলায় অমুক একটি জ্ঞানী আছে, কি একটি ভক্ত আছে, এই শুনলাম; আবার কিছুদিন পরে শুনলাম, ওই সে মরে গেছে! তাই আর লোক ভাল লাগত না। তারপর তিনি (মা) মনকে নামালেন, ভক্তি-ভক্ততে মন রাখিয়ে দিলেন।”
মাস্টার অবাক্‌, ঠাকুরের অবস্থা পরিবর্তনের বিষয় শুনিতেছেন। এইবার ঈশ্বর মানুষ হয়ে কেন অবতার হন, তাই ঠাকুর বলিতেছেন।
[অবতার বা নরলীলার গুহ্য অর্থ — দ্বিজ ও পূর্বসংস্কার ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — মনুষ্যলীলা কেন জান? এর ভিতর তাঁর কথা শুনতে পাওয়া যায়। এর ভিতর তাঁর বিলাস, এর ভিতর তিনি রসাস্বাদন করেন।
“আর সব ভক্তদের ভিতর তাঁরই একটু একটু প্রকাশ! যেমন জিনিস অনেক চুষতে চুষতে একটু রস, ফুল চুষতে চুষতে একটু মধু। (মাস্টারের প্রতি) তুমি এটা বুঝেছ?”
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, বেশ বুঝেছি।
ঠাকুর দ্বিজর সহিত কথা কহিতেছেন। দ্বিজর বয়স ১৫।১৬, বাপ দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করিয়াছেন। দ্বিজ প্রায় মাস্টারের সঙ্গে আসেন। ঠাকুর তাঁহাকে স্নেহ করেন। দ্বিজ বলিতেছিলেন, বাবা তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে আসিতে দেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (দ্বিজর প্রতি) — তোর ভাইরাও? আমাকে কি অবজ্ঞা করে?
দ্বিজ চুপ করিয়া আছেন।
মাস্টার — সংসারের আর দু-চার ঠোক্কর খেলে যাদের একটু-আধটু যা অবজ্ঞা আছে, চলে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিমাতা আছে, ঘা (blow) তো খাচ্ছে।
সকলে একটু চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — একে (দ্বিজকে) পূর্ণর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিও না।
মাস্টার — যে আজ্ঞা। (দ্বিজর প্রতি) — পেনেটিতে যেও।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তাই সব্বাইকে বলছি — একে পাঠিয়ে দিও; ওকে পাঠিয়ে দিও। (মাস্টারের প্রতি) তুমি যাবে না?
ঠাকুর পেনেটির মহোৎসবে যাইবেন। তাই ভক্তদের সেখানে যাবার কথা বলিতেছেন।
মাস্টার — আজ্ঞা, ইচ্ছা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বড় নৌকা হবে, টলটল করবে না। গিরিশ ঘোষ যাবে না?
[‘হাঁ’ ‘না’ “Everlasting Yea — Everlasting Nay”]
ঠাকুর দ্বিজকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা এত ছোকরা আছে, এই বা আসে কেন? তুমি বল, অবশ্য আগেকার কিছু ছিল!
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সংস্কার। আগের জন্মে কর্ম করা আছে। সরল হয়ে শেষ জন্মে। শেষ জন্মে খ্যাপাটে ভাব থাকে।
“তবে কি জানো? — তাঁর ইচ্ছা। তঁর ‘হাঁ’তে জগতের সব হচ্চে; তঁর ‘না’তে হওয়া বন্ধ হচ্চে। মানুষের আশীর্বাদ করতে নাই কেন?
“মানুষের ইচ্ছায় কিছু হয় না, তাঁরই ইচ্ছাতে হয় — যায়!
“সেদিন কাপ্তেনের ওখানে গেলাম। রাস্তা দিয়ে ছোকরারা যাচ্ছে দেখলাম। তারা একরকমের। একটা ছোকরাকে দেখলাম, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স, বাঁকা সিঁতে কাটা, শিস দিতে দিতে যাচ্ছে! কেউ যাচ্ছে বলতে বলতে, ‘নগেন্দ্র! ক্ষীরোদ!’
“কেউ দেখি ঘোর তমো; — বাঁশী বাজাচ্ছে, — তাতেই একটু অহংকার হয়েছে। (দ্বিজর প্রতি) যার জ্ঞান হয়েছে, তার নিন্দার ভয় কি? তার কূটস্থ বুদ্ধি — কামারের নেয়াই, তার উপর কত হাতুড়ির ঘা পড়েছে, কিছুতেই কিছু হয় না।
“আমি (অমুকের) বাপকে দেখলাম রাস্তা দিয়ে যাচ্চে।”
মাস্টার — লোকটি বেশ সরল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু চোখ রাঙা।
[কাপ্তেনের চরিত্র ও শ্রীরামকৃষ্ণ — পুরুষ-প্রকৃতি যোগ ]
ঠাকুর কাপ্তেনের বাড়ি গিয়াছিলেন — সেই গল্প করিতেছেন। যে-সব ছেলেরা ঠাকুরের কাছে আসে, কাপ্তেন তাহাদের নিন্দা করিয়াছিলেন। হাজরামহাশয়ের কাছে বোধ হয় তাহাদের নিন্দা শুনিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাপ্তেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম পুরুষ আর প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই নাই। নারদ বলেছিলেন, হে রাম, যত পুরুষ দেখতে পাও, সব তোমার অংশ; আর যত স্ত্রী দেখতে পাও, সব সীতার অংশ।
“কাপ্তেন খুব খুশি। বললে, ‘আপনারই ঠিক বোধ হয়েছে, সব পুরুষ রামের অংশে রাম, সব স্ত্রী সীতার অংশে সীতা!’
“এই কথা এই বললে, আবার তারই পর ছোকরাদের নিন্দা আরম্ভ করলে! বলে, ‘ওরা ইংরাজী পড়ে, — যা তা খায়, ওরা তোমার কাছে সর্বদা যায়, — সে ভাল নয়। ওতে তোমার খারাপ হতে পারে। হাজরা যা একটি লোক, খুব লোক। ওদের অত যেতে দেবেন না।’ আমি প্রথমে বললাম, যায় তা কি করি?
“তারপর প্যাণ (প্রাণ) থেঁতলে দিলাম। ওর মেয়ে হাসতে লাগল। বললাম, যে লোকের বিষয়বুদ্ধি আছে, সে লোক থেকে ঈশ্বর অনেক দূর। বিষয়বুদ্ধি যদি না থাকে, সে ব্যক্তির তিনি হাতের ভিতর — অতি নিকটে।
“কাপ্তেন রাখালের কথায় বলে যে, ও সকলের বাড়িতে খায়। বুঝি হাজরার কাছে শুনেছে। তযন বললাম, লোকে হাজার তপজপ করুক, যদি বিষয়বুদ্ধি থাকে, তাহলে কিছুই হবে না; আর শূকর মাংস খেয়ে যদি ঈশ্বরে মন থাকে, সে ব্যক্তি ধন্য! তার ক্রমে ঈশ্বরলাভ হবেই। হাজরা এত তপজপ করে, কিন্তু ওর মধ্যে দালালি করবে — এই চেষ্টায় থাকে।
“তখন কাপ্তেন বলে, হাঁ, তা ও বাৎ ঠিক হ্যায়। তারপরে আমি বললাম, এই তুমি বললে, সব পুরুষ রামের অংশে রাম, সব স্ত্রী সীতার অংশে সীতা, আবার এখন এমন কথা বলছ!
“কাপ্তেন বললে, তা তো, কিন্তু তুমি সকলকে তো ভালবাস না!
“আমি বললাম, ‘আপো নারায়ণঃ’ সবই জল, কিন্তু কোনও জল খাওয়া যায়, কোনটিতে নাওয়া যায়, কোনও জলে শৌচ করে যায়। এই যে তোমার মাগ মেয়ে বসে আছে, আমি দেখছি সাক্ষাৎ আনন্দময়ী! কাপ্তেন তখন বলতে লাগল, ‘হাঁ, হাঁ, ও ঠিক হ্যায়’! তখন আবার আমার পায়ে ধরতে যায়।”
এই বলিয়া ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন। এইবার ঠাকুর কাপ্তেনের কত গুণ, তাহা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাপ্তেনের অনেক গুণ। রোজ নিত্যকর্ম, — নিজে ঠাকুর পূজা, — স্নানের মন্ত্রই কত! কাপ্তেন খুব একজন কর্মী, — পূজা জপ, আরতি, পাঠ, স্তব এ-সব নিত্যকর্ম করে।
[কাপ্তেন ও পাণ্ডিত্য — কাপ্তেন ও ঠাকুরের অবস্থা ]
“আমি কাপ্তেনকে বকতে লাগলাম; বললাম, তুমি পড়েই সব খারাপ করেছ। আর পোড়ো না!
“আমার অবস্থা কাপ্তেন বললে, উড্ডীয়মান ভাব। জীবাত্মা আর পরমাত্মা; জীবাত্মা যেন একটা পাখি, আর পরমাত্মা যেন আকাশ — চিদাকাশ। কাপ্তেন বললে, ‘তোমার জীবাত্মা চিদাকাশে উড়ে যায়, — তাই সমাধি’; (সহাস্যে) কাপ্তেন বাঙালীদের নিন্দা করলে। বললে, বাঙালীরা নির্বোধ! কাছে মাণিক রয়েছে চিনলে না!”
[গৃহস্থভক্ত ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — কর্ম কত দিন ]
“কাপ্তেনের বাপ খুব ভক্ত ছিল। ইংরেজের ফৌজে সুবাদারের কাজ করত। যুদ্ধক্ষেত্রে পূজার সময়ে পূজা করত, — একহাতে শিবপূজা, একহাতে তরবার-বন্দুক!
(মাস্টারের প্রতি) “তবে কি জানো, রাতদিন বিষয়কর্ম! মাগছেলে ঘিরে রয়েছে, যখনই যাই দেখি! আবার লোকজন হিসাবের খাতা মাঝে মাঝে আনে। এক-একবার ঈশ্বরেও মন যায়। যেমন বিকারের রোগী; বিকারের ঘোর লেগেই আছে, এক-একবার চটকা ভাঙে! তখন ‘জল খাব’ ‘জল খাব’ বলে চেঁচিয়ে উঠে; আবার জল দিতে দিতে অজ্ঞান হয়ে খায়, — কোন হুঁশ থাকে না! আমি তাই ওকে বললাম, — তুমি কর্মী। কাপ্তেন বললে, ‘আজ্ঞা, আমার পূজা এই সব করতে আনন্দ হয় — জীবের কর্ম বই আর উপায় নাই।
“আমি বললাম, কিন্তু কর্ম কি চিরকাল করতে হবে? মৌমাছি ভনভন কতক্ষণ করে? যতক্ষণ না ফুলে বসে। মধুপানের সময় ভনভনানি চলে যায়। কাপ্তেন বললে, ‘আপনার মতো আমরা কি পূজা আর আর কর্ম ত্যাগ করতে পারি?’ তার কিন্তু কথার ঠিক নাই, — কখনও বলে, ‘এ-সব জড়।’ কখনও বলে, ‘এ-সব চৈতন্য।’ আমি বলি, জড় আবার কি? সবই চৈতন্য!”
[পূর্ণ ও মাস্টার — জোর করে বিবাহ ও শ্রীরামকৃষ্ণ ]
পূর্ণর কথা ঠাকুর মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — পূর্ণকে আর-একবার দেখলে আমার ব্যাকুলতা একটু কম পড়বে! — কি চতুর! — আমার উপর খুব টান; সে বলে, আমারও বুক কেমন করে আপনাকে দেখবার জন্য। (মাস্টারের প্রতি) তোমার স্কুল থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়েছে, তাতে তোমার কি কিছু ক্ষতি হবে?
মাস্টার — যদি তাঁরা (বিদ্যাসাগর) — বলেন, তোমার জন্য ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিলে, — তাহলে আমার জবাব দিবার পথ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বলবে?
মাস্টার — এই কথা বলব, সাধুসঙ্গে ঈশ্বরচিন্তা হয়, সে আর মন্দ কাজ নয়; আর আপনারা যে বই পড়াতে দিয়েছেন, তাতেই আছে — ঈশ্বরকে প্রাণের সহিত ভালবাসবে।
ঠাকুর হাসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাপ্তেনের বাড়িতে ছোট নরেনকে ডাকলুম। বললাম, তোর বাড়িটা কোথায়? চল যাই। — সে বললে, ‘আসুন’। কিন্তু ভয়ে ভয়ে চলতে লাগল সঙ্গে, — পাছে বাপ জানতে পারে! (সকলের হাস্য)
(অখিলবাবুর প্রতিবেশীকে) — “হ্যাঁগা, তুমি অনেক কাল আস নাই। সাত-আট মাস হবে।”
প্রতিবেশী — আজ্ঞা, একবৎসর হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার সঙ্গে আর-একটি আসতেন।
প্রতিবেশী — আজ্ঞা হাঁ, নীলমণিবাবু।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি কেন আসেন না? — একবার তাঁকে আসতে বলো, তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিও। (প্রতিবেশীর সঙ্গী বালক দৃষ্টে) — এ-ছেলেটি কে?
প্রতিবেশী — এ-ছেলেটির বাড়ি আসামে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আসাম কোথা? কোন্‌ দিকে?
দ্বিজ আশুর কথা বলিতেছেন। আশুর বাবা তার বিবাহ দিবেন। আশুর ইচ্ছা নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখ দেখ, তার ইচ্ছা নাই, জোর করে বিবাহ দিচ্ছে।
ঠাকুর একটি ভক্তকে জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে ভক্তি করিতে বলিতেছেন, — “জ্যেষ্ঠ-ভাই, পিতা সম, খুব মানবি।”
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকাতত্ত্ব — জন্মমৃত্যুতত্ত্ব
পণ্ডিতজী বসিয়া আছেন, তিনি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লোক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, মাস্টারের প্রতি) — খুব ভাগবতের পণ্ডিত।
মাস্টার ও ভক্তেরা পণ্ডিতজীকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) — আচ্ছা জী! যোগমায়া কি?
পণ্ডিতজী যোগমায়ার একরকম ব্যাখ্যা করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — রাধিকাকে কেন যোগমায়া বলে না?
পণ্ডিতজী এই প্রশণের উত্তর একরকম দিলেন। তখন ঠাকুর নিজেই বলিতেছেন, রাধিকা বিশুদ্ধসত্ত্ব, প্রেমময়ী! যোগমায়ার ভিতরে তিনগুণই আছে — সত্ত্ব রজঃ তমঃ। শ্রীমতীর ভিতর বিশুদ্ধসত্ত্ব বই আর কিছুই নাই। (মাস্টারের প্রতি) নরেন্দ্র এখন শ্রীমতীকে খুব মানে, সে বলে, সচ্চিদানন্দকে যদি ভালবাসতে শিখতে হয় তো রাধিকার কাছে শেখা যায়।
“সচ্চিদানন্দ নিজে রসাস্বাদন করতে রাধিকার সৃষ্টি করেছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণের অঙ্গ থেকে রাধা বেরিয়েছেন। সচ্চিদানন্দকৃষ্ণই ‘আধার’ আর নিজেই শ্রীমতীরূপে ‘আধেয়’, — নিজের রস আস্বাদন করতে — অর্থাৎ সচ্চিদানন্দকে ভালবেসে আনন্দ সম্ভোগ করতে।
“তাই বৈষ্ণবদের গ্রন্থে আছে, রাধা জন্মগ্রহণ করে চোখ খুলেন নাই; অর্থাৎ এই ভাব যে — এ-চক্ষে আর কাকে দেখব? রাধিকাকে দেখতে যশোদা যখন কৃষ্ণকে কোলে করে গেলেন, তখন কৃষ্ণকে দেখবার জন্য রাধা চোখ খুললেন। কৃষ্ণ খেলার ছলে রাধার চক্ষে হাত দিছলেন। (আসামী বালকের প্রতি) একি দেখেছ, ছোট ছেলে চোখে হাত দেয়?”
[সংসারী ব্যক্তি ও শুদ্ধাত্মা ছোকরার প্রভেদ ]
পণ্ডিতজী ঠাকুরের কাছে বিদায় লইতেছেন।
পণ্ডিত — আমি বাড়ি যাচ্ছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) — কিছু হাতে হয়েছে।
পণ্ডিত — বাজার বড় মন্দা হ্যায়। রোজগার নেহি! —
পণ্ডিতজী কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — দেখো, — বিষয়ী আর ছোকরাদের কত তফাত। এই পণ্ডিত রাতদিন টাকা টাকা করছে! কলকাতায় এসেছে, পেটের জন্য, — তা না হলে বাড়ির সেগুলির পেট চলে না। তাই এর দ্বারে ওর দ্বারে যেতে হয়! মন একাগ্র করে ঈশ্বরচিন্তা করবে কখন? কিন্তু ছোকরাদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন নাই। ইচ্ছা করলেই ঈশ্বরেতে মন দিতে পারে।
“ছোকরারা বিষয়ীর সঙ্গ ভালবাসবে না। রাখাল মাঝে মাঝে বলত, বিষয়ী লোক আসতে দেখলে ভয় হয়।
“আমার যখন প্রথম এই অবস্থা হল, তখন বিষয়ী লোক আসতে দেখলে ঘরের দরজা বন্ধ করতাম।”
[পুত্র-কন্যা বিয়োগ জন্য শোক ও শ্রীরামকৃষ্ণ – পূর্বকথা ]
“দেশে শ্রীরাম মল্লিককে অত ভালবাসতাম, কিন্তু এখানে যখন এলো তখন ছুঁতে পারলাম না।
“শ্রীরামের সঙ্গে ছেলেবেলায় খুব প্রণয় ছিল। রাতদিন একসঙ্গে থাকতাম। একসঙ্গে শুয়ে থাকতাম। তখন ষোল-সতের বৎসর বয়স। লোকে বলত, এদের ভিতর একজন মেয়েমানুষ হলে দুজনের বিয়ে হত। তাদের বাড়িতে দুজনে খেলা করতাম, তখনকার সব কথা মনে পড়ছে। তাদের কুটুম্বেরা পালকি চড়ে আসত, বেয়ারগুলো ‘হিঞ্জোড়া হিঞ্জোড়া’ বলতে থাকত।
“শ্রীরামকে দেখব বলে কতবার লোক পাঠিয়েছি; এখন চানকে দোকান করেছে! সেদিন এসেছিল, দুদিন এখানে ছিল।
“শ্রীরাম বললে, ছেলেপিলে হয় নাই। ভাইপোটিকে মানুষ করেছিলাম। সেটি মরে গেছে। বলতে বলতে শ্রীরাম দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, চক্ষে জল এল, ভাইপোর জন্য খুব শোক হয়েছে।
“আবার বললে, ছেলে হয় নাই বলে স্ত্রীর যত স্নেহ ওই ভাইপোর উপর পড়েছিল; এখন সে শোকে অধীর হয়েছে। আমি তাকে বলি, ক্ষেপী! আর শোক করলে কি হবে? তুই কাশী যাবি?
“বলে ‘ক্ষেপী’ — একেবারে ডাইলিউট (dilute) হয়ে গেছে! তাকে ছুঁতে পারলাম না। দেখলাম তাতে আর কিছু নাই।”
ঠাকুর শোক সম্বন্ধে এই সকল কথা বলিতেছেন, এদিকে ঘরের উত্তরের দরজার কাছে সেই শোকাতুরা ব্রাহ্মণিটি দাঁড়াইয়া আছেন। ব্রাহ্মণী বিধবা। তার একমাত্র কন্যার খুব বড় ঘরে বিবাহ হইয়াছিল। মেয়েটির স্বামী রাজা উপাধিধারী, — কলিকাতানিবাসী, — জমিদার। মেয়েটি যখন বাপের বাড়ি আসিতেন, তখন সঙ্গে সেপাই-শান্ত্রী আসিত, — মায়ের বুক যেন দশ হাত হইত। সেই একমাত্র কন্যা কয়দিন হইল ইহলোক ত্যাগ করিয়া গিয়াছে!
ব্রাহ্মণী দাঁড়াইয়া ভাইপোর বিয়োগ জন্য শ্রীরাম মল্লিকের শোকের কথা শুনিলেন। তিনি কয়দিন ধরিয়া বাগবাজার হইতে পাগলের ন্যায় ছুটে ছুটে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিতে আসিতেছেন, যদি কোনও উপায় হয়; যদি তিনি এই দুর্জয় শোক নিবারণের কোনও ব্যবস্থা করিতে পারেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন —
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মণী ও ভক্তদের প্রতি) — একজন এসেছিল। খানিকক্ষণ বসে বলছে, ‘যাই একবার ছেলের চাঁদমুখটি দেখিগে।’
“আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, তবে রে শালা! ওঠ্‌ এখান থেকে। ঈশ্বরের চাঁদমুখের চেয়ে ছেলের চাঁদমুখ?”
[জন্মমৃত্যুতত্ত্ব — বাজিকরের ভেলকি ]
(মাস্টারের প্রতি) — “কি জানো, ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য! জীব, জগৎ, বাড়ি-ঘর-দ্বার, ছেলেপিলে, এ-সব বাজিকরের ভেলকি! বাজিকর কাঠি দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে, আর বলছে, লাগ লাগ লাগ! ঢাকা খুলে দেখ, কতকগুলি পাখি আকাশে উড়ে গেল। কিন্তু বাজিকরই সত্য, আর সব অনিত্য! এই আছে, এই নাই!
“কৈলাসে শিব বসে আছেন, নন্দী কাছে আছেন। এমন সময় একটা ভারী শব্দ হল। নন্দী জিজ্ঞাসা করলে, ঠাকুর! এ কিসের শব্দ হল? শিব বললেন, ‘রাবণ জন্মগ্রহণ করলে, তাই শব্দ।’ খানিক পরে আবার একটি ভয়ানক শব্দ হল। নন্দী জিজ্ঞাসা করলে — ‘এবার কিসের শব্দ?’ শিব হেসে বললেন, ‘এবার রাবণ বধ হল!’ জন্মমৃত্যু — এ-সব ভেলকির মতো! এই আছে এই নাই! ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য। জলই সত্য, জলের ভুড়ভুড়ি, এই আছে, এই নাই; ভুড়ভুড়ি জলে মিশে যায়, — যে জলে উৎপত্তি সেই জলেই লয়।
“ঈশ্বর যেন মহাসমুদ্র, জীবেরা যেন ভুড়ভুড়ি; তাঁতেই জন্ম, তাঁতেই লয়।
“ছেলেমেয়ে, — যেমন একটা বড় ভুড়ভুড়ির সঙ্গে পাঁচটা ছটা ছোট ভুড়ভুড়ি।
“ঈশ্বরই সত্য। তাঁর উপরে কিরূপে ভক্তি হয়, তাঁকে কেমন করে লাভ করা যায়, এখন এই চেষ্টা করো। শোক করে কি হবে?”
সকলে চুপ করিয়া আছেন। ব্রাহ্মণী বলিলেন, ‘তবে আমি আসি।’
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মণীর প্রতি সস্নেহে) — তুমি এখন যাবে? বড় ধুপ! — কেন, এদের সঙ্গে গাড়ি করে যাবে।
আজ জৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি, বেলা প্রায় তিনটা-চারটা। ভারী গ্রীষ্ম। একটি ভক্ত ঠাকুরকে একখানি নূতন চন্দনের পাখা আনিয়া দিলেন। ঠাকুর পাখা পাইয়া আনন্দিত হইলেন ও বলিলেন, “বা! বা!” “ওঁ তৎসৎ! কালী!” এই বলিয়া প্রথমেই ঠাকুরদের হাওয়া করিতেছেন। তাহার পরে মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখ, দেখ, কেমন হাওয়া।” মাস্টারও আনন্দিত হইয়া দেখিতেছেন।
=============

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কাপ্তেন ছেলেদের সঙ্গে করিয়া আসিয়াছেন।
ঠাকুর কিশোরীকে বলিলেন, “এদের সব দেখিয়ে এস তো, — ঠাকুরবাড়ি!”
ঠাকুর কাপ্তেনের সহিত কথা কহিতেছেন।
মাস্টার, দ্বিজ ইত্যাদি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। দমদমার মাস্টারও আসিয়াছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। তিনি কাপ্তেনকে ছোট খাটটির এক পার্শ্বে তাঁহার সম্মুখে বসিতে বলিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার কথা এদের বলছিলাম, — কত ভক্ত, কত পূজা, কত রকম আরতি!
কাপ্তেন (সলজ্জভাবে) — আমি কি পূজা আরতি করব? আমি কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — যে ‘আমি’ কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত, সেই আমিতেই দোষ। আমি ঈশ্বরের দাস, এ আমিতে দোষ নাই। আর বালকের আমি, — বালক কোনও গুণের বশ নয়। এই ঝগড়া করছে, আবার ভাব! এই খেলাঘর করলে কত যত্ন করে, আবার তৎক্ষণাৎ ভেঙে ফেললে! দাস আমি — বালকের আমি, এতে কোনও দোষ নাই। এ আমি আমির মধ্যে নয়, যেমন মিছরি মিষ্টের মধ্যে নয়। অন্য মিষ্টতে অসুখ করে, কিন্তু মিছরিতে বরং অমলনাশ হয়। আর যেমন ওঁকার শব্দের মধ্যে নয়।
“এই অহং দিয়ে সচ্চিদানন্দকে ভালবাসা যায়। অহং তো যাবে না — তাই ‘দাস আমি’, ‘ভক্তের আমি’। তা না হলে মানুষ কি লয়ে থাকে। গোপীদের কি ভালবাসা! (কাপ্তেনের প্রতি) তুমি গোপীদের কথা কিছু বল। তুমি অত ভাগবত পড়।”
কাপ্তেন — যখন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে আছেন, কোন ঐশ্বর্য নাই, তখনও গোপীরা তাঁকে প্রাণাপেক্ষা ভালবেসেছিলেন। তাই কৃষ্ণ বলেছিলেন, আমি তাদের ঋণ কেমন করে শুধবো? যে গোপীরা আমার প্রতি সব সমর্পণ করেছে, — দেহ, — মন, — চিত্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে বিভোর হইতেছেন। ‘গোবিন্দ!’ ‘গোবিন্দ!’ ‘গোবিন্দ!’ এই কথা বলিতে বলিতে আবিষ্ট হইতেছেন! প্রায় বাহ্যশূন্য। কাপ্তেন সবিসময়ে বলিতেছেন, ‘ধন্য!’ ‘ধন্য!’
কাপ্তেন ও সমবেত ভক্তগণ ঠাকুরের এই অদ্ভুত প্রেমাবস্থা দেখিতেছেন। যতক্ষণ না তিনি প্রকৃতিস্থ হন, ততক্ষণ তাঁহারা চুপ করিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তারপর?
কাপ্তেন — তিনি যোগীদিগের অগম্য — ‘যোগিভিরগম্যম্‌’ — আপনার ন্যায় যোগীদের অগম্য; কিন্তু গোপীদিগের গম্য। যোগীরা কত বৎসর যোগ করে যাঁকে পায় নাই; কিন্তু গোপীরা অনায়াসে তাঁকে পেয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — গোপীদের কাছে খাওয়া, খেলা, কাঁদা, আব্দার করা, এ-সব হয়েছে।
[শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও শ্রীকৃষ্ণ-চরিত্র — অবতারবাদ ]
একজন ভক্ত বলিলেন, ‘শ্রীযুক্ত বঙ্কিম কৃষ্ণ-চরিত্র লিখেছেন।’
শ্রীরামকৃষ্ণ — বঙ্কিম শ্রীকৃষ্ণ মানে, শ্রীমতী মানে না।
কাপ্তেন — বুঝি লীলা মানেন না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — আবার বলে নাকি কামাদি — এ-সব দরকার।
দমদম মাস্টার — নবজীবনে বঙ্কিম লিখেছেন — ধর্মের প্রয়োজন এই যে, শারীরিক, মনাসিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি সব বৃত্তির স্ফূর্তি হয়।
কাপ্তেন — ‘কামাদি দরকার’, তবে লীলা মানেন না। ঈশ্বর মানুষ হয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলেন, রাধাকৃষ্ণলীলা, তা মানেন না?
[পূর্ণব্রহ্মের অবতার — শুধু পাণ্ডিত্য ও প্রত্যক্ষের প্রভেদ —Mere booklearning and Realisation]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ও-সব কথা যে খবরের কাগজে নাই, কেমন করে মানা যায়!
“একজন তার বন্ধুকে এসে বললে, ‘ওহে! কাল ও-পাড়া দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, সে-বাড়িটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল।’ বন্ধু বললে, দাঁড়াও হে, একবার খবরের কাগজখানা দেখি। এখন বাড়ি হুড়মুড় করে পড়ার কথা খবরের কাগজে কিছুই নাই। তখন সে ব্যক্তি বললে, ‘কই খবরের কাগজে তো কিছুই নাই। — ও-সব কাজের কথা নয়।’ সে লোকটা বললে, ‘আমি যে দেখে এলাম।’ ও বললে, ‘তা হোক্‌ যেকালে খবরের কাগজে নাই, সেকালে ও-কথা বিশ্বাস করলুম না।’ ঈশ্বর মানুষ হয়ে লীলা করেন, এ-কথা কেমন করে বিশ্বাস করবে? এ-কথা যে ওদের ইংরাজী লেখাপড়ার ভিতর নাই! পূর্ণ অবতার বোঝানো বড় শক্ত, কি বল? চৌদ্দ পোয়ার ভিতর অনন্ত আসা!”
কাপ্তেন — ‘কৃষ্ণ ভগবান্‌ স্বয়ম্‌।’ বলবার সময় পূর্ণ ও অংশ বলতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — পূর্ণ ও অংশ, — যেমন অগ্নি ও তার স্ফুলিঙ্গ। অবতার ভক্তের জন্য, — জ্ঞানীর জন্য নয়। অধ্যাত্মরামায়ণে আছে — হে রাম! তুমিই ব্যাপ্য, তুমিই ব্যাপক, ‘বাচ্যবাচকভেদেন ত্বমেব পরমেশ্বর।’
কাপ্তেন — ‘বাচ্যবাচক’ অর্থাৎ ব্যাপ্য-ব্যাপক।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘ব্যাপক’ অর্থাৎ যেমন ছোট একটি রূপ, যেমন অবতার মানুষরূপ হয়েছেন।
=============

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

অহংকারই বিনাশের কারণ ও ঈশ্বরলাভের বিঘ্ন
সকলে বসিয়া আছেন। কাপ্তেন ও ভক্তদের সহিত ঠাকুর কথা কহিতেছেন। এমন সময় ব্রাহ্মসমাজের জয়গোপাল সেন ও ত্রৈলোক্য আসিয়া প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর সহাস্যে ত্রৈলোক্যের দিকে তাকাইয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — অহংকার আছে বলে ঈশ্বরদর্শন হয় না। ঈশ্বরের বাড়ির দরজার সামনে এই অহংকাররূপ গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে। এই গুঁড়ি উল্লঙ্ঘন না করলে তাঁর ঘরে প্রবেশ করা যায় না।
“একজন ভূতসিদ্ধ হয়েছিল। সিদ্ধ হয়ে যাই ডেকেছে, অমনি ভূতটি এসেছে। এসে বললে, ‘কি কাজ করতে হবে বল। কাজ যাই দিতে পারবে না, অমনি তোমার ঘাড় ভাঙব।’ সে ব্যক্তি যত কাজ দরকার ছিল, সব ক্রমে ক্রমে করিয়ে নিল। তারপর আর কাজ পায় না। ভূতটি বললে, ‘এইবার তোমার ঘাড় ভাঙি?’ সে বললে, ‘একটু দাঁড়াও, আমি আসছি’। এই বলে গুরুদেবের কাছে গিয়ে বললে, ‘মহাশয়! ভারী বিপদে পড়েছি, এই এই বিবরণ, এখন কি করি?’ গুরু তখন বললেন, তুই এক কর্ম কর, তাকে এই চুলগাছটি সোজা করতে বল। ভূতটি দিনরাত ওই করতে লাগল। চুল কি সোজা হয়? যেমন বাঁকা, তেমনি রহিল! অহংকারও এই যায়, আবার আসে।
“অহংকার ত্যাগ না করলে ঈশ্বরের কৃপা হয় না।
“কর্মের বাড়িতে যদি একজনকে ভাঁড়ারী করা যায়, যতক্ষণ ভাঁড়ারে সে থাকে ততক্ষণ কর্তা আসে না। যখন সে নিজে ইচ্ছা করে ভাঁড়ার ছেড়ে চলে যায়, তখনই কর্তা ঘরে চাবি দেয় ও নিজে ভাঁড়ারের বন্দোবস্ত করে।
“নাবালকেরই অছি। ছেলেমানুষ নিজে বিষয় রক্ষা করতে পারে না, রাজা ভার লন। অহংকার ত্যাগ না করলে ঈশ্বর ভার লন না।
বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীনারায়ণ বসে আছেন, হঠাৎ নারায়ণ উঠে দাঁড়ালেন। লক্ষ্মী পদসেবা করছিলেন; বললেন, ‘ঠাকুর কোথা যাও?’ নারায়ণ বললেন, ‘আমার একটি ভক্ত বড় বিপদে পড়েছে তাই তাকে রক্ষা করতে যাচ্ছি!’ এই বলে নারায়ণ বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার ফিরলেন। লক্ষ্মী বললেন, ‘ঠাকুর এত শীঘ্র ফিরলে যে?’ নারায়ণ হেসে বললেন, ‘ভক্তটি প্রেমে বিহ্বল হয়ে পথে চলে যাচ্ছিল, ধোপারা কাপড় শুকাতে দিছল, ভক্তটি মাড়িয়ে যাচ্ছিল। দেখে ধোপারা লাঠি লয়ে তাকে মারতে যাচ্ছিল। তাই আমি তাকে রক্ষা করতে গিয়েছিলাম’। লক্ষ্মী আবার বললেন, ‘ফিরে এলেন কেন?’ নারায়ণ হাসতে হাসতে বললেন, ‘সে ভক্তটি নিজে ধোপাদের মারবার জন্য ইট তুলেছে দেখলাম। (সকলের হাস্য) তাই আর আমি গেলাম না’।”
[পূর্বকথা — কেশব ও গৌরী — সোঽহম্‌ অবস্থার পর দাসভাব ]
“কেশব সেনকে বলেছিলাম, ‘অহং ত্যাগ করতে হবে।’ তাতে কেশব বললে, — তাহলে মহাশয় দল কেমন করে থাকে?
“আমি বললাম, ‘তোমার এ কি বুদ্ধি! — তুমি কাঁচা-আমি ত্যাগ কর, — যে আমিতে কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত করে, কিন্তু পাকা-আমি, দাস-আমি, ভক্তের আমি, — ত্যাগ করতে বলছি না। আমি ঈশ্বরের দাস, আমি ঈশ্বরের সন্তান, — এর নাম পাকা-আমি। এতে কোনও দোষ নাই’।”
ত্রৈলোক্য — অহংকার যাওয়া বড় শক্ত। লোকে মনে করে, বুঝি গেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — পাছে অহংকার হয় বলে গৌরী ‘আমি’ বলত না — বলত ‘ইনি’। আমিও তার দেখাদেখি বলতাম ‘ইনি’; ‘আমি খেয়েছি,’ না বলে, বলতাম ‘ইনি খেয়েছেন।’ সেজোবাবু তাই দেখে একদিন বললে, ‘সে কি বাবা, তুমি ও-সব কেন বলবে? ও-সব ওরা বলুক, ওদের অহংকার আছে। তোমার তো আর অহংকার নাই। তোমার ও-সব বলার কিছু দরকার নাই।’
“কেশবকে বললাম, ‘আমি’টা তো যাবে না, অতএব সে দাসভাবে থাক; — যেমন দাস। প্রহ্লাদ দুই ভাবে থাকতেন, কখনও বোধ করতেন ‘তুমিই আমি’ ‘আমিই তুমি’ — সোঽহম্‌। আবার যখন অহং বুদ্ধি আসত, তখন দেখতেন, আমি দাস তুমি প্রভু! একবার পাকা ‘সোঽহম্‌’ হলে পরে, তারপর দাসভাবে থাকা। যেমন আমি দাস।”
[ব্রহ্মজ্ঞানের লক্ষণ — ভক্তের আমি — কর্মত্যাগ ]
(কাপ্তেনের প্রতি) — “ব্রহ্মজ্ঞান হলে কতকগুলি লক্ষণে বুঝা যায়। শ্রীমদ্‌ভাগবতে জ্ঞানীর চারটি অবস্থার কথা আছে — (১) বালকবৎ, (২) জড়বৎ, (৩) উন্মাদবৎ, (৪) পিশাচবৎ। পাঁচ বছরের বালকের অবস্থা হয়। আবার কখনও পাগলের মতন ব্যবহার করে।
“কখনও জড়ের ন্যায় থাকে। এ অবস্থায় কর্ম করতে পারে না, কর্মত্যাগ হয়। তবে যদি বল জনকাদি কর্ম করেছিলেন; তা কি জানো, তখনকার লোক কর্মচারীদের উপর ভার দিয়ে নিশ্চিত হত। আর তখনকার লোকও খুব বিশ্বাসী ছিল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ কর্মত্যাগের কথা বলিতেছেন, আবার যাহাদের কর্মে আসক্তি আছে, তাহাদের অনাসক্ত হয়ে কর্ম করতে বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞান হলে বেশি কর্ম করতে পারে না।
ত্রৈলোক্য — কেন? পওহারি বাবা এমন যোগী কিন্তু লোকের ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেন, — এমন কি মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হাঁ, — তা বটে। দুর্গাচরণ ডাক্তার এতো মাতাল, চব্বিশ ঘন্টা মদ খেয়ে থাকত, কিন্তু কাজের বেলা ঠিক, — চিকিৎসা করবার সময় কোনরূপ ভুল হবে না। ভক্তিলাভ করে কর্ম করলে দোষ নাই। কিন্তু বড় কঠিন, খুব তপস্যা চাই!
“ঈশ্বরই সব করছেন, আমরা যন্ত্রস্বরূপ। কালীঘরের সামনে শিখরা বলেছিল, ‘ঈশ্বর দয়াময়’। আমি বললাম, দয়া কাদের উপর? শিখরা বললে, ‘কেন মহারাজ? আমাদের উপর।’ আমি বললাম, আমরা সকলে তাঁর ছেলে; ছেলের উপর আবার দয়া কি? তিনি ছেলেদের দেখছেন; তা তিনি দেখবেন না তো বামুনপাড়ার লোকে এসে দেখবে? আচ্ছা, যারা ‘দয়াময়’ বলে, তারা এটি ভাবে না যে, আমরা কি পরের ছেলে?”
কাপ্তেন — আজ্ঞা হাঁ, আপনার বলে বোধ থাকে না।
[ভক্ত ও পূজাদি — ঈশ্বর ভক্তবৎসল — পূর্ণজ্ঞানী ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে কি দয়াময় বলবে না? যতক্ষণ সাধনার অবস্থা, ততক্ষণ বলবে। তাঁকে লাভ হলে তবে ঠিক আপনার বাপ কি আপনার মা বলে বোধ হয়। যতক্ষণ না ঈশ্বরলাভ হয় ততক্ষণ বোধ হয় — আমরা সব দূরের লোক, পরের ছেলে।
“সাধনাবস্থায় তাঁকে সবই বলতে হয়। হাজরা নরেন্দ্রকে একদিন বলেছিল, ‘ঈশ্বর অনন্ত তাঁর ঐশ্বর্য অনন্ত। তিনি কি আর সন্দেশ কলা খাবেন? না গান শুনবেন? ও-সব মনের ভুল।’
“নরেন্দ্র অমনি দশ হাত নেবে গেল। তখন হাজরাকে বললাম, তুমি কি পাজী! ওদের অমন কথা বললে ওরা দাঁড়ায় কোথা? ভক্তি গেলে মানুষ কি লয়ে থাকে?তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য, তবুও তিনি ভক্তাধীন। বড় মানুষের দ্বারবান এসে বাবুর সভায় একধারে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কি একটি জিনিস আছে, কাপড়ে ঢাকা! অতি সঙ্কোচভাবে! বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কি দ্বারবান, হাতে কি আছে? দ্বারবান সঙ্কোচভাবে একটি আতা বার করে বাবুর সম্মুখে রাখলে ইচ্ছা বাবু ওটি খাবেন। বাবু দ্বারবানের ভক্তিভাব দেখে আতটি খুব আদর করে নিলেন, আর বললেন, আহ বেশ আতা! তুমি এটি কোথা থেকে কষ্ট করে আনলে ? 
“তিনি ভক্তাধীন ! দুৰ্য্যোধন অত যত্ন দেখালে, আর বললে, এখানে খাওয়া দাওয়া করুন, ঠাকুর (শ্রীকৃষ্ণ ) কিন্তু বিদুরের কুটিরে গেলেন। তিনি ভক্তবৎসল, বিদুরের শাকান্ন সুধার ন্যায় খেলেন ! 
 “পূর্ণজ্ঞানীর আর একটি লক্ষণ–‘পিশাচবৎ’! খাওয়া-দাওয়ার বিচার নাই—শুচি-অশুচির বিচার নাই ! পূর্ণজ্ঞানী ও পূর্ণমুখ, দুইজনেরই বাহিরের লক্ষণ এক রকম! পূর্ণজ্ঞানী হয় ত গঙ্গাস্নানে মন্ত্র পাঠ করলে না, ঠাকুরপুজা করবার সময় ফুলগুলি হয় ত এক সঙ্গে ঠাকুরের চরণে দিয়ে চলে এল, কোন তন্ত্র-মন্ত্র নাই।
[ কর্মী ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-কৰ্ম্ম কতক্ষণ?] 
“যতদিন সংসারের ভােগ করবার ইচ্ছা থাকে, ততদিন কর্মত্যাগ করতে পারে না। যতক্ষণ ভােগের আশা ততক্ষণ কর্ম।
“একটি পাখি জাহাজের মাস্তুলে অন্যমনস্কে বসে ছিল। জাহাজ গঙ্গার ভিতর ছিল, ক্রমে মহাসমুদ্রে এসে পড়ল। তখন পাখির চটকা ভাঙ্গলো, সে দেখলে চতুর্দিকে কূল-কিনারা নাই। তখন ডাঙায় ফিরে যাবার জন্য উত্তর দিকে উড়ে গেল। অনেক দূর গিয়ে শ্রান্ত হয়ে গেল, তবু কূল-কিনারা দেখতে পেলে না। তখন কি করে, ফিরে এসে আবার মাস্তুলে বসল।
“অনেকক্ষণ পরে পাখিটা আবার উড়ে গেল,-এবার পূর্ব দিকে গেল। সেদিকে কিছুই দেখতে পেলে না, চারিদিকে কেবল অকুল পাথার! তখন ভারী পরিশ্রান্ত হয়ে আবার জাহাজে ফিরে এসে মাস্তুলের উপর বসল। অনেকক্ষণ জিরিয়ে একবার দক্ষিণ দিকে গেল,এইরূপে আবার পশ্চিম দিকে গেল। যখন দেখলে কোথাও কূল-কিনারা নাই, তখন সেই মাস্তুলের উপর বসল, আর উঠল না। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে রইল। তখন মনে আর কোনও ব্যস্তভাব বা অশান্তি রইল না। নিশ্চিন্ত হয়েছে, আর কোনও চেষ্টাও নাই।”
কাপ্তেন—আহা কেয়া দৃষ্টান্ত ! | 
[ ভােগান্তে ব্যাকুলতা ও ঈশ্বর লাভ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসারী লােকেরা যখন সুখের জন্য চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, আর পায় না, আর শেষে পরিশ্রান্ত হয় ; যখন কামিনীকাঞ্চনে আসক্ত হয়ে কেবল দুঃখ পায়, তখনই বৈরাগ্য আসে, ত্যাগ আসে। ভােগ না করলে অনেকের ত্যাগ হয় না। কুটিচক আর বহূদক। সাধকদের ভিতরেও অনেকে কেউ কেউ অনেক তীর্থে ঘােরে। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না; অনেক তীর্থের উদক—কিনা জল খায় ! যখন ঘুরে ঘুরে ক্ষোভ মিটে যায়, তখন এক জায়গায় কুটির বেঁধে বসে। আর নিশ্চিন্ত ও চেষ্টাশূন্য হয়ে ভগবানকে চিন্তা করে।
“কিন্তু কি ভােগ সংসারে করবে? কামিনী-কাঞ্চন ভােগ ? সে ত ক্ষণিক আনন্দ। এই আছে, এই নাই !
“প্রায় মেঘ ও বর্ষা লেগে আছে, সূৰ্য্য দেখা যায় না! দুঃখের ভাগই বেশী । আর কামিনী-কাঞ্চনমেঘ সূর্যকে দেখতে দেয় না।
“কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “মশায়, ঈশ্বর কেন এমন সংসার করলেন ? আমাদের কি কোনও উপায় নাই ?
[ উপায়—ব্যাকুলতা-ত্যাগ ] 
“আমি বলি, উপায় থাকবে না কেন? তাঁর শরণাগত হও, আর ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, যাতে অনুকূল হাওয়া বয়,যাতে শুভযােগ ঘটে। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।
“একজনের ছেলেটি যায় যায় হয়েছিল। সে ব্যক্তি ব্যাকুল হয়ে, এর কাছে ওর কাছে উপায় জিজ্ঞাসা করে বেড়াচ্ছে। একজন বললে, . তুমি যদি এইটি যােগাড় করতে পারাে তো ভাল হয়,-স্বাতী নক্ষত্রের জল পড়বে মড়ার মাথার খুলির উপর। সেই জল একটি ব্যাঙ খেতে যাবে। সেই ব্যাঙকে একটি সাপে তাড়া করবে। ব্যাঙকে কামড়াতে গিয়ে সাপের বিষ ঐ মড়ার মাথার খুলিতে পড়বে, আর সেই ব্যাঙটি পালিয়ে যাবে। সেই বিষজল একটু লয়ে রােগীকে খাওয়াতে হবে।
“লােকটি অমনি ব্যাকুল হয়ে সেই ঔষধ খুঁজতে স্বাতী নক্ষত্রে বেরুল ! এমন সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরকে বলছে, ঠাকুর ! এইবার মড়ার মাথা জুটিয়ে দাও। খুঁজতে খুঁজতে দেখে, একটি মড়ার খুলি, তাতে স্বাতী নক্ষত্রের জল পড়েছে ; তখন আবার সে প্রার্থনা করে বলতে লাগল, দোহাই ঠাকুর ! এইবার আর কটি জুটিয়ে দাও --ব্যাঙ ও সাপ! তার যেমন ব্যাকুলতা তেমনি সব জুটে গেল। দেখতে দেখতে একটি সাপ ব্যাঙকে তাড়া করে আসছে, আর কামড়াতে গিয়ে তার বিষ, ঐ খুলির ভিতর পড়ে গেল। 
“ঈশ্বরের শরণাগত হয়ে, তাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকলে, তিনি শুবেনই শুনবেন—সব সুযােগ করে দেবেন।” 
কাপ্তেন—কেয়া দৃষ্টান্ত !
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তিনি সুযােগ করে দেন। হয় ত,—বিয়ে হল না, সব মন ঈশ্বরকে দিতে পারলে। হয়ত ভায়েরা রােজগার করতে লাগল বা একটি ছেলে মানুষ হয়ে গেল, তা হলে তােমার আর সংসার দেখতে হ’ল না। তখন তুমি অনায়াসে ষােল আনা মন ঈশ্বরকে দিতে পার। তবে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না হলে হবে না। ত্যাগ হলে তবে অজ্ঞান অবিদ্যা নাশ হয়। আতস কাচের উপর সূর্যের কিরণ পড়লে কত জিনিস পুড়ে যায়। কিন্তু ঘরের ভিতর ছায়া, সেখানে আতস কাঁচ লয়ে গেলে ওটি হয় না। ঘর ত্যাগ করে বাহিরে এসে। দাঁড়াতে হয়।
[ ঈশ্বর লাভের পর সংসার—জনকাদির ]
“তবে জ্ঞান লাভের পর কেউ সংসারে থাকে। তারা ঘর-বার দুইই দেখতে পায়। জ্ঞানের আলাে সংসারের ভিতর পড়ে, তাই তারা ভাল, মন্দ, নিত্য, অনিত্য,-এ সব সে আলােতে দেখতে পায়। 
“যারা অজ্ঞান, ঈশ্বরকে মানে না, অথচ সংসারে আছে, তারা যেন মাটির ঘরের ভিতর বাস করে। ক্ষীণ আলােতে শুধু ঘরের ভিতরটি দেখতে পায়। কিন্তু যারা জ্ঞান লাভ করেছে, ঈশ্বরকে জেনেছে, তারপর সংসারে আছে, তারা যেন শাসির ঘরের ভিতর বাস করে। ঘরের ভিতরও দেখতে পায়, ঘরের বাহিরের জিনিসও দেখতে পায়। জ্ঞান-সূর্যের আলাে ঘরের ভিতরে খুব প্রবেশ করে। সে ব্যক্তি ঘরের ভিতরের জিনিস খুব স্পষ্টরূপে দেখতে পায়, কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ, কোনটি নিত্য, কোন্‌টি অনিত্য।
“ঈশ্বরই৷কর্তা আর সব তার যন্ত্রস্বরূপ।
“তাই জ্ঞানীরও অহঙ্কার করবার যাে নাই। মহিম্নস্তব যে লিখেছিল, তার অহঙ্কার হয়েছিল। শিবের যাঁড় যখন দাঁত বার করে দেখালে, তখন তার অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে গেল। দেখলে, এক একটি দাঁত এক এক মন্ত্র ! তার মানে কি জান? এ সব মন্ত্র অনাদিকাল ছিল। তুমি কেবল উদ্ধার করলে। 
“গুরুগিরি করা ভাল নয়। ঈশ্বরের আদেশ না পেলে আচাৰ্য হওয়া যায় না। যে নিজে বলে, ‘আমি গুরু’ সে হীনবুদ্ধি। দাঁড়িপাল্লা দেখ নাই ? হাল্কা দিকটা উঁচু হয়, যে ব্যক্তি নিজে উঁচু হয়, সে হালকা। সকলেই গুরু হতে যায় !—শিষ্য পাওয়া যায় না।” 
ত্রৈলােক্য ছােট খাটটির উত্তর ধারে মেঝেতে বসিয়াছেন। ত্রৈলোক্য গান গাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “আহা ! তোমার কি গান।” ত্রৈলােক্য তানপুরা লইয়া গান করিতেছেন-
তুঝসে হামনে দিলকো লাগায়, যে কুচ হ্যায় সব তুহি হ্যায়। 
গান—তুমি সর্বস্ব আমার (হে নাথ!) প্রাণাধার সারাৎসার।
নাহি তােমা বিনে কেহ ত্রিভুবনে আপনার বুলিবার 
গান শুনিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে বিভাের হইতেছেন। আর বলিতেছেন, “আহা! তুমিই সব ! আহা! আহা!”
গান সমাপ্ত হইল। ছয়টা বাজিয়া গিয়াছে। ঠাকুর মুখ ধুইতে ঝাউতলার দিকে যাইতেছেন। সঙ্গে মাষ্টার ।
ঠাকুর হাসিতে হাসিতে গল্প করিতে করিতে যাইতেছেন। মাষ্টারকে হঠাৎ বলিলেন, “কই তোমরা খেলে না? আর ওরা খেলে না?”
ঠাকুর ভক্তদের প্রসাদ দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন।
[ নরেন্দ্র ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ] 
আজ সন্ধ্যার পর ঠাকুরের কলিকাতায় যাইবার কথা আছে। ঝাউতলা থেকে ফিরিবার সময় মাষ্টারকে বলিতেছেন, “তাই ত কার গাড়িতে যাই?”
সন্ধ্যা হইয়াছে। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধূন দেওয়া হইতেছে। ঠাকুরবাড়িতে সব স্থানে ফরাস আলো জ্বালিয়া দিল। রােশনচৌকী বাজিতেছে। এবার দ্বাদশ শিব-মন্দিরে, বিষ্ণুঘরে ও কালীঘরে আরতি হইবে।
ছােট খাটটিতে বসিয়া ঠাকুরদের নামকীর্তনাত্তর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের ধ্যান করিতেছেন। আরতি হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর এদিক ওদিক ঘরে পায়চারি করিতেছেন ও ভক্তদের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা কহিতেছেন। আর কলিকাতায় যাইবার জন্য মাষ্টারের সঙ্গে পরামর্শ করিতেছেন।
এমন সময় নরেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত। সঙ্গে শরৎ ও আরও দুই একটি ছোকরা। তাঁহারা আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। 
নরেন্দ্রকে দেখিয়া ঠাকুরের স্নেহ উথলিয়া পড়িল। যেমন কচি ছেলেকে আদর করে, ঠাকুর নরেন্দ্রের মুখে হাত দিয়া আদর করিতে লাগিলেন ও স্নেহপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “তুমি এসেছ ?”
ঘরের মধ্যে পশ্চিমাস্য হইয়া ঠাকুর দাঁড়াইয়া আছেন। নরেন্দ্র ও আর কয়টি ছােকরা ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া পূৰ্বাস্য হইয়া তাহার সম্মুখে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর মাষ্টারের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিতেছেন, “নরেন্দ্র এসেছে, আর যাওয়া যায় ? লােক দিয়ে নরেন্দ্রদের ডেকে পাঠিয়েছিলাম ; আর যাওয়া যায় ? কি বল ?” 
মাষ্টার—যে আজ্ঞা, আজ তবে থাক্।।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা কাল যাব, হয় নৌকায় নয় গাড়িতে। ( অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) তােমর তবে এস আজ, রাত হল।
ভক্তেরা সকলে একে একে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
============

Post a Comment

0 Comments