শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
তৃতীয় ভাগ
চতুর্দশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
===========
প্রথম পরিচ্ছেদ
ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় শ্রীযুক্ত বলরামের বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। গিরিশ, মাস্টার, বলরাম — ক্রমে ছোট নরেন, পল্টু, দ্বিজ, পূর্ণ, মহেন্দ্র মুখুজ্জে ইত্যাদি — অনেক ভক্ত উপস্থিত আছেন। ক্রমে ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল, জয়গোপাল সেন প্রভৃতি অনেক ভক্ত আসিলেন। মেয়ে ভক্তেরা অনেকেই আসিয়াছেন। তাঁহারা চিকের আড়ালে বসিয়া ঠাকুরের দর্শন করিতেছেন। মোহিনীর পরিবারও আসিয়াছেন — পুত্রশোকে উন্মাদের ন্যায় — তিনি ও তাঁহার ন্যায় সন্তপ্ত অনেকেই আসিয়াছেন, এই বিশ্বাস যে ঠাকুরের কাছে নিশ্চই শান্তিলাভ হইবে।আজ ১লা বৈশাখ, চৈত্র কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, ১২ই এপ্রিল, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, বেলা ৩টা হইবে।
মাস্টার আসিয়া দেখিলেন, ঠাকুর ভক্তের মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন ও নিজের সাধনা বিবরণ ও নানাবিধ আধ্যাত্মিক অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন। মাস্টার আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন ও তাঁহার কাছে আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — সে সময় (সাধনার সময়ে) ধ্যানে দেখতে পেতাম, সত্য সত্য একজন কাছে শূল হাতে করে বসে আছে। ভয় দেখাচ্ছে — যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন না রাখি শূলের বাড়ি আমায় মারবে। ঠিক মন না হলে বুক যাবে।
[নিত্য-লীলাযোগ — পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেকযোগ ]
“কখনও মা এমন অবস্থা করে দিতেন যে, নিত্য থেকে মন লীলায় নেমে আসত। আবার কখনও লীলা থেকে নিত্যে মন উঠে যেত।“যখন লীলায় মন নেমে আসত কখনও সীতারামকে রাতদিন চিন্তা করতাম। আর সীতারামের রূপ সর্বদা দর্শন হত — রামলালকে (রামের অষ্টধাতু নির্মিত ছোট বিগ্রহ) নিয়ে সর্বদা বেড়াতাম, কখনও খাওয়াতাম। আবার কখনও রাধাকৃষ্ণের ভাবে থাকতাম। ওই রূপ সর্বদা দর্শন হত। আবার কখনও গৌরাঙ্গের ভাবে থাকতাম, দুই ভাবের মিলন — পুরুষ ও প্রকৃতি ভাবের মিলন। এ অবস্থায় সর্বদাই গৌরাঙ্গের রূপ দর্শন হত। আবার অবস্থা বদলে গেল! সজনে তুলসী সব এক বোধ হতে লাগল। ঈশ্বরীয় রূপ আর ভাল লাগল না। বললাম, ‘কিন্তু তোমাদের বিচ্ছেদ আছে।’ তখন তাদের তলায় রাখলাম। ঘরে যত ঈশ্বরীয় পট বা ছবি ছিল সব খুলে ফেললাম। কেবল সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ সেই আদি পুরুষকে চিন্তা করতে লাগলাম। নিজে দাসীভাবে রইলুম — পুরুষের দাসী।
“আমি সবরকম সাধন করেছি। সাধনা তিন প্রকার — সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক। সাত্ত্বিক সাধনায় তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে বা তাঁর নামটি শুদ্ধ নিয়ে থাকে। আর কোন ফলাকাঙ্খা নাই। রাজসিক সাধনে নানারকম প্রক্রিয়া — এতবার পুরশ্চরণ করতে হবে, এত তীর্থ করতে হবে, পঞ্চতপা করতে হবে; ষোড়শোপচারে পূজা করতে হবে ইত্যাদি। তামসিক সাধন — তমোগুণ আশ্রয় করে সাধন। জয় কালী! কি, তুই দেখা দিবিনি! এই গলায় ছুরি দেব যদি দেখা না দিস। এ সাধনায় শুদ্ধাচার নাই — যেমন তন্ত্রের সাধন।
“সে অবস্থায় (সাধনার অবস্থায়) অদ্ভুত সব দর্শন হত, আত্মার রমণ প্রত্যক্ষ দেখলাম। আমার মতো রূপ একজন আমার শরীরের ভিতর প্রবেশ করলে! আর ষট্পদ্মের প্রত্যেক পদ্মের সঙ্গে রমণ করতে লাগল। ষট্পদ্ম মুদিত হয়েছিল — টক টক করে রমণ করে আর একটি পদ্ম প্রস্ফুটিত হয় — আর ঊর্ধ্বমুখ হয়ে যায়! এইরূপে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাপদ্ম, সহস্রার সকল পদ্মগুলি ফুটে উঠল। আর নিচে মুখ ছিল ঊর্ধ্বমুখ হল, প্রত্যক্ষ দেখলাম।”
[ধ্যানযোগ সাধনা — ‘নিবাত নিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্’ ]
“সাধনার সময় আমি ধ্যান করতে করতে আরোপ করতাম প্রদীপের শিখা — যখন হাওয়া নাই, একটুও নড়ে না — তার আরোপ করতাম।“গভীর ধ্যানে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়। একজন ব্যাধ পাখি মারবার জন্য তাগ করছে। কাছ দিয়ে বর চলে যাচ্ছে, সঙ্গে বরযাত্রীরা, কত রোশনাই, বাজনা, গাড়ি, ঘোড়া — কতক্ষণ ধরে কাছ দিয়ে চলে গেল। ব্যাধের কিন্তু হুঁশ নাই। সে জানতে পারলো না যে কাছ দিয়ে বর চলে গেল।
“একজন একলা একটি পুকুরের ধারে মাছ ধরছে। অনেকক্ষণ পরে ফাতনাটা নড়তে লাগল, মাঝে মাঝে কাত হতে লাগল। সে তখন ছিপ হাতে করে টান মারবার উদ্যোগ করছে। এমন সময় একজন পথিক কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছে, মহাশয়, অমুক বাঁড়ুজ্যেদের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন? সে ব্যক্তির হুঁশ নাই। তার হাত কাঁপছে, কেবল ফাতনার দিকে দৃষ্টি। তখন পথিক বিরক্ত হয়ে চলে গেল। সে অনেক দূরে চলে গেছে, এমন সময় ফাতনাটা ডুবে গেল, আর ও ব্যক্তি টান মেরে মাছটাকে আড়ায় তুললে। তখন গামছা দিয়ে মুখ পুঁছে, চিৎকার করে পথিককে ডাকছে — ওহে — শোনা — শোনো! পথিক ফিরতে চায় না, অনেক ডাকাডাকির পর ফিরল। এসে বলছে, কেন মহাশয়, আবার ডাকছ কেন? তখন সে বললে, তুমি আমায় কি বলছিলে? পথিক বললে, তখন অতবার করে জিজ্ঞাসা করলুম — আর এখন বলছো কি বললে! সে বললে, তখন যে ফাতনা ডুবছিল, তাই আমি কিছুই শুনতে পাই নাই।
“ধ্যানে এইরূপ একাগ্রতা হয়, অন্য কিছু দেখা যায় না শোনাও যায় না। স্পর্শবোধ পর্যন্ত হয় না। সাপ গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়, জানতে পারে না। যে ধ্যান করে সেও বুঝতে পারে না — সাপটাও জানতে পারে না।
“গভীর ধ্যানে ইন্দ্রিয়ের সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মন বহির্মুখ থাকে না — যেন বার-বাড়িতে কপাট পড়লো। ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয়! রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ — বাহিরে পড়ে থাকবে।
“ধ্যানের সময় প্রথম প্রথম ইন্দ্রিয়ের বিষয় সকল সামনে আসে — গভীর ধ্যানে সে সকল আর আসে না — বাহিরে পড়ে থাকে। ধ্যান করতে করতে আমার কত কি দর্শন হত। প্রতক্ষ দেখলাম — সামনে টাকার কাঁড়ি, শাল, একথালা সন্দেশ, দুটো মেয়ে, তাদের ফাঁদী নথ। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম আবার — মন তুই কি চাস? মন বললে, ‘না, কিছুই চাই না। ঈশ্বরের পাদপদ্ম ছাড়া আর কিছুই চাই না।’ মেয়েদের ভিতর-বার সমস্ত দেখতে পেলাম — যেমন, কাচের ঘরে সমস্ত জিনিস বার থেকে দেখা যায়! তাদের ভিতরে দেখলাম — নাড়ীভুঁড়ি, রক্ত, বিষ্ঠা, কৃমি, কফ, নাল, প্রস্রাব এই সব!”
[অষ্টসিদ্ধি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — গুরুগিরি ও বেশ্যাবৃত্তি ]
শ্রীযুক্ত গিরিশ ঠাকুরের নাম করিয়া ব্যারাম ভাল করিব — এই কথা মাঝে মাঝে বলিতেন।শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশ প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — যারা হীনবুদ্ধি তারা সিদ্ধাই চায়। ব্যারাম ভাল করা, মোকদ্দমা জিতানো, জলে হেঁটে চলে যাওয়া — এই সব। যারা শুদ্ধভক্ত তারা ঈশ্বরের পাদপদ্ম ছাড়া কিছুই চায় না। হৃদে একদিন বললে ‘মামা! মার কাছে কিছু শক্তি চাও, কিছু সিদ্ধাই চাও।’ আমার বালকের স্বভাব — কালীঘরে জপ করবার সময় মাকে বললাম, মা হৃদে বলছে কিছু সিদ্ধাই চাইতে। অমনি দেখিয়ে দিলে সামনে এসে পেছন ফিরে উবু হয়ে বসলো — একজন বুড়ো বেশ্যা, চল্লিশ বছর বয়স — ধামা পোঁদ — কালাপেড়ে কাপড় পরা — পড় পড় করে হাগছে! মা দেখিয়ে দিলেন যে, সিদ্ধাই এই বুড়ো বেশ্যার বিষ্ঠা! তখন হৃদেকে গিয়ে বকলাম আর বললাম, তুই কেন আমায় এরূপ কথা শিখিয়ে দিলি। তোর জন্যই তো আমার এরূপ হলো!
“যাদের একটু সিদ্ধাই থাকে তাদের প্রতিষ্ঠা, লােকমান্য এই সব হয়। অনেকের ইচ্ছা গুরুগিরি করি,-পাঁচ জনে গণে মানে,শিষ্য সেবক হয়, লোকে বলবে, গুরুচরণের ভাইয়ের আজ কাল বেশ সময়,—কত লােক আসছে যাচ্ছে,—শিষ্যি সেবক অনেক হয়েছে, ঘরে জিনিসপত্র থৈ থৈ করছে! কত জিনিস কত লােক এনে দিচ্ছে --সে যদি মনে করে—তার এমন শক্তি হয়েছে যে, কত লোককে খাওয়াতে পারে।
“গুরুগিরি বেশ্যাগিরির মত।—ছার টাকা কড়ি, লােকমান্য হওয়া, শরীরের সেবা, এই সবের জন্য আপনাকে বিক্রি করা। যে শরীর মন আত্মার দ্বারা ঈশ্বরকে লাভ করা যায় সেই শরীর মন আত্মাকে সামান্য জিনিসের জন্য এরূপ করে রাখা ভাল নয়। একজন বলেছিল, সাবির এখন খুব সময়—এখন তার বেশ হয়েছে,-একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছে,—ঘুঁটে রে, গােবর রে, তক্তাপােশ, দু'খানা বাসন হয়েছে, বিছানা, মাদুর, তাকিয়া—কতলোক বশীভূত, যাচ্ছে আসছে । অর্থাৎ সাবি এখন বেশ্যা হয়েছে তাই সুখ ধরে না! আগে সে ভদ্রলােকের বাড়ির দাসী ছিল, এখন বেশ্যা হয়েছে ! সামান্য জিনিসের জন্য নিজের সর্বনাশ!
[ শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনায় প্রলােভন (Temptation), ব্ৰহ্মজ্ঞান ও
তাভেদ বুদ্ধি ]
শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুসলমান ধর্ম
“সাধনার সময় ধ্যান করতে করতে আমি আরও কত কি দেখতাম। বেলতলায় ধ্যান করছি, পাপ পুরুষ এসে কত রকম লোভ দেখাতে লাগল। লড়ায়ে গােরার রূপ ধরে এসেছিল। টাকা, মান, রমণ সুখ, নানা রকম শক্তি, এই সব দিতে চাইলে। আমি মাকে ডাকতে লাগলাম।
বড় গুহ্যকথা। মা দেখা দিলেন, তখন আমি বললাম, মা ওকে কেটে ফেলাে। মার সেই রূপ-সেই ভুবনমােহনরূপ-মনে পড়ছে। কৃষ্ণময়ীর * রূপ!—কিন্তু চাউনিতে যেন জগৎটা নড়ছে!
ঠাকুর চুপ করিলেন। ঠাকুর আবার বলিতেছেন,—“আরও কত কি বলতে দেয় না!-মূখ যেন কে আটকে দেয় !
“সজনে তুলসী এক বােধ হতাে ! ভেদ-বুদ্ধি দূর করে দিলেন। বটতলায় ধ্যান করছি, দেখালে একজন দেড়ে মুসলমান (মােহম্মদ ) সানকি করে ভাত নিয়ে সামনে এলো। সানকি থেকে ম্লেচ্ছদের খাইয়ে আমাকে দুটি দিয়ে গেল। মা দেখালেন, এক বই দুই নাই। সচ্চিদানন্দই নানা রূপ ধরে রয়েছেন। তিনিই জীব জগৎ সমস্তই হয়েছেন। তিনিই অন্ন হয়েছেন।
[ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বালক-ভাব ও ভাবাবেশ ]
(গিরিশ, মাষ্টার প্রভৃতির প্রতি )—“আমার বালক-স্বভাব। হৃদে বললে, মামা, মাকে কিছু শক্তির কথা বলো,অমনি মাকে বলতে চললাম!এমনি অবস্থায় রেখেছে যে, যে ব্যক্তি কাছে থাকবে তার কথা শুনতে হয়। ছােট ছেলের যেমন কাছে লােক না থাকলে অন্ধকার দেখে, -আমারও সেইরূপ হতাে ! হৃদে কাছে না থাকলে প্রাণ যায় যায়। হতাে! ঐ দেখাে ঐ ভাবটা আসছে!-কথা কইতে কইতে উদ্দীপন হয়।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। দেশ কালবােধ চলিয়া যাইতেছে। অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। ভাবে বলিতেছেন, “এখনও তােমাদের দেখছি,কিন্তু বােধ হচ্ছে যেন চিরকাল তােমরা বসে আছ, কখন এসেছ, কোথায় এসেছ এ সব কিছু মনে নাই।”
ঠাকুর কিয়ৎকাল স্থির হইয়া রহিলেন।
কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন, “জল খাব।” সমাধিভঙ্গের পর মন নামাইবার জন্য ঠাকুর এই কথা প্রায় বলিয়া থাকেন। গিরিশ নৃতন আসিতেছেন, জানেন না তাই জল আনিতে উদ্যত হইলেন। ঠাকুর বারণ করিতেছেন আর বলিতেছেন, “না বাপু, এখন খেতে পারব না।” ঠাকুর ও ভক্তগণ ক্ষণকাল চুপ করিয়া আছেন। এইবার ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ( মাষ্টারের প্রতি )—হ্যাঁগা, আমার কি অপরাধ হলাে? এ সব (গুহ্য) কথা বলা ?
মাষ্টার কি বলিবেন চুপ করিয়া আছেন। তখন ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “না অপরাধ কেন হবে, আমি লােকের বিশ্বাসের জন্য বলেছি।” কিয়ৎপরে যেন কত অনুনয় করিয়া বলিতেছেন, “ওদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে?” (অর্থাৎ পূর্ণের সঙ্গে )।
মাষ্টার (সঙ্কুচিত ভাবে )—আজ্ঞে, এক্ষণই খবর পাঠাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সাগ্রহে)—ঐখানে খুঁটে মিলছে।
ঠাকুর কি বলিতেছিলেন যে অন্তরঙ্গ ভক্তদের ভিতর পূর্ণ শেষ ভক্ত, তাঁহার পর প্রায় কেহ নাই ?
============
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পূর্বকথা — শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাব — ব্রাহ্মণীর সেবা
গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতিকে সম্বোধন করিয়া ঠাকুর নিজের মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — সে অবস্থার পরে আনন্দও যেমন, আগে যন্ত্রণাও তেমনি। মহাভাব ঈশ্বরের ভাব — এই দেহ-মনকে তোলপাড় করে দেয়! যেন একটা বড় হাতি কুঁড়ে ঘরে ঢুকেছে। ঘর তোলপাড়! হয়তো ভেঙেচুড়ে যায়!
“ঈশ্বরের বিরহ-অগ্নি সামান্য নয়। রূপসনাতন যে গাছের তলায় বসে থাকতেন ওই অবস্থা হলে এইরকম আছে যে, গাছের পাতা ঝলসা-পোড়া হয়ে যেত! আমি এই অবস্থায় তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। নড়তে-চড়তে পারতাম না, এক জায়গায় পড়েছিলাম। হুঁশ হলে বামনী আমায় ঘরে স্নান করাতে নিয়ে গেল। কিন্তু হাত দিয়ে গা ছোঁবার জো ছিল না। গা মোটা চাদর দিয়ে ঢাকা। বামনী সেই চাদরের উপর হাত দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গিছল। গায়ে যে সব মাটি লেগেছিল, পুড়ে গিছল!
“যখন সেই অবস্থা আসত শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে যেন ফাল চালিয়ে যেত! ‘প্রাণ যায়, প্রাণ যায়’ এই করতাম। কিন্তু তারপরে খুব আনন্দ!”
ভক্তেরা এই মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) — এতদুর তোমাদের দরকার নাই। আমার ভাব কেবল নজিরের জন্য। তোমরা পাঁচটা নিয়ে আছ, আমি একটা নিয়ে আছি। আমার ঈশ্বর বই কিছু ভাল লাগে না। তাঁর ইচ্ছে। (সহাস্যে) একডেলে গাছও আছে আবার পাঁচডেলে গাছও আছে। (সহলের হাস্য)
“আমার অবস্থা নজিরের জন্য। তোমরা সংসার করো, অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে, পাঁকাল মাছের মতো। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে — তবু গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।”
গিরিশ (সহাস্যে) — আপনারও তো বিয়ে আছে। (হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — সংস্কারের জন্য বিয়ে করতে হয়, কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে! গলায় পৈতে পরিয়ে দেয় আবার খুলে খুলে পড়ে যায় — সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে, শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল — সংস্কারের জন্য। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল। (সকলের হাস্য)
“কামিনী-কাঞ্চনই সংসার — ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”
গিরিশ — কামিনী-কাঞ্চন ছাড়ে কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, বিবেকের জন্য প্রার্থনা কর। ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য — এরই নাম বিবেক! জল-ছাঁকা দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হয়। ময়লাটা একদিকে পড়ে — ভাল জল একদিকে পড়ে, বিবেকরূপ জল-ছাঁকা আরোপ করো। তোমরা তাঁকে জেনে সংসার করো। এরই নাম বিদ্যার সংসার।
“দেখ না, মেয়ে-মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের। পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে বসে আছে, তখন বলি, আহা! এরা গেছে। (মাস্টারের দিকে তাকাইয়া) — হারু এমন সুন্দর ছেলে, তাকে পেতনীতে পেয়েছে! — ‘ওরে হারু কোথা গেল’, ‘ওরে হারু কোথা গেল’। সব্বাই গিয়ে দেখে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে রূপ নাই, সে তেজ নাই, সে আনন্দ নাই! বটগাছের পেতনীতে হারুকে পেয়েছে।
“স্ত্রী যদি বলে ‘যাও তো একবার’ — অমনি উঠে দাঁড়ায়, ‘বসো তো’ — আমনি বসে পড়ে।
“একজন উমেদার বড়বাবুর কাছে আনাগোনা করে হায়রান হয়েছে। কর্ম আর হয় না। আফিসের বড়বাবু। তিনি বলেন, এখন খালি নাই, মাঝে মাঝে এসে দেখা করো। এইরূপে কতকাল কেটে গেল — উমেদার হতাশ হয়ে গেল। সে একজন বন্ধুর কাছে দুঃখ করছে। বন্ধু বললে তোর যেমন বুদ্ধি। — ওটার কাছে আনাগোনা করে পায়ের বাঁধন ছেঁড়া কেন? তুই গোলাপকে ধর, কালই তোর কর্ম হবে। উমেদার বললে, বটে! — আমি এক্ষণি চললুম। গোলাপ বড়বাবুর রাঁড়। উমেদার দেখা করে বললে, মা, তুমি এটি না করলে হবে না — আমি মহাবিপদে পড়েছি। ব্রাহ্মণের ছেলে আর কোথায় যাই! মা, অনেকদিন কাজকর্ম নাই, ছেলেপুলে না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি একটি কথা বলে দিলেই আমার একটি কাজ হয়। গোলাপ ব্রাহ্মণের ছেলেকে বললে, বাছা, কাকে বললে হয়? আর ভাবতে লাগল, আহা, ব্রাহ্মণের ছেলে বড় কষ্ট পাচ্ছে! উমেদার বললে, বড়বাবুকে একটি কথা বললে আমার নিশ্চয় একটা কর্ম হয়। গোলাপ বললে, আমি আজই বড়বাবুকে বলে ঠিক করে রাখব। তার পরদিন সকালে উমেদারের কাছে একটি লোক গিয়ে উপস্থিত; সে বললে, তুমি আজ থেকেই বড়বাবুর আফিসে বেরুবে। বড়বাবু সাহেবকে বললে, ‘এ ব্যক্তি বড় উপযুক্ত লোক। একে নিযুক্ত করা হয়েছে, এর দ্বারা আফিসের বিশেষ উপকার হবে।’
“এই কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে সকলে ভুলে আছে। আমার কিন্তু ও-সব ভাল লাগে না — মাইরি বলছি, ঈশ্বর বই আর কিছুই জানি না।”
=============
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সত্যকথা কলির তপস্যা — ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি
একজন ভক্ত — মহাশয়, নব-হুল্লোল বলে এক মত বেরিয়েছে। শ্রীযুক্ত ললিত চাটুজ্যে তার ভিতর আছেন।শ্রীরামকৃষ্ণ — নানা মত আছে। মত পথ। কিন্তু সব্বাই মনে করে, আমার মতই ঠিক — আমার ঘড়ি ঠিক চলছে।
গিরিশ (মাস্টারের প্রতি) — পোপ কি বলেন? It is with our judgements ইত্যাদি[1]।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — এর মানে কি গা?
মাস্টার — সব্বাই মনে করে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে, কিন্তু ঘড়িগুলো পরস্পর মেলে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে অন্য ঘড়ি যত ভুল হউক না, সূর্য কিন্তু ঠিক যাচ্ছে। সেই সূর্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়।
একজন ভক্ত — অমুকবাবু বড় মিথ্যা কথা কয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সত্যকথা কলির তপস্যা। কলিতে অন্য তপস্যা কঠিন। সত্যে থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায়। তুলসীদাস বলেছে, ‘সত্যকথা, অধীনতা, পরস্ত্রী মাতৃসমান — এইসে হরি না মিলে তুলসী ঝুট জবান্।’
“কেশব সেন বাপের ধার মেনেছিল, অন্য লোক হলে কখনও মানতো না, একে লেখাপড়া নাই। জোড়াসাঁকোর দেবেন্দ্রের সমাজে গিয়ে দেখলাম, কেশব সেন বেদীতে বসে ধ্যান করছে। তখন ছোকরা বয়েস। আমি সেজোবাবুকে বললাম, যতগুলি ধ্যান করছে এই ছোকরার ফতা (ফাত্না) ডুবেছে, — বড়শির কাছে মাছ এসে ঘুরছে।
“একজন — তার নাম করবো না — সে দশহাজার টাকার জন্য আদালতে মিথ্যা কথা কয়েছিল। জিতবে বলে আমাকে দিয়ে মা-কালীকে অর্ঘ্য দেওয়ালে। আমি বালকবুদ্ধিতে অর্ঘ্য দিলুম! বলে, বাবা এই অর্ঘটি মাকে দাও তো!”
ভক্ত — আচ্ছা লোক!
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু এমনি বিশ্বাস আমি দিলেই মা শুনবেন!
ললিতবাবুর কথায় ঠাকুর বলিতেছেন —
“অহংকার কি যায় গা! দুই-এক জনের দেখতে পাওয়া যায় না। বলরামের অহংকার নাই। আর এঁর নাই! — অন্য লোক হলে কত টেরী, তমো হত — বিদ্যার অহংকার হতো। মোটা বামুনের এখনও একটু একটু আছে! (মাস্টারের প্রতি) মহিম চক্রবর্তী অনেক পড়েছে, না?”
মাস্টার — আজ্ঞা হাঁ, অনেক বই পড়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তার সঙ্গে গিরিশ ঘোষের একবার আলাপ হয়। তাহলে একটু বিচার হয়।
গিরিশ (সহাস্যে) — তিনি বুঝি বলেন সাধনা করলে শ্রীকৃষ্ণের মতো সব্বাই হতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঠিক তা নয়, — তবে আভাসটা ওইরকম।
ভক্ত — আজ্ঞা, শ্রীকৃষ্ণের মতো সব্বাই কি হতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — অবতার বা অবতারের অংশ, এদের বলে ঈশ্বরকোটি আর সাধারণ লোকদের বলে জীব বা জীবকোটি। যারা জীবকোটি তারা সাধনা করে ঈশ্বরলাভ করতে পারে; তারা সমাধিস্থ হয়ে আর ফেরে না।
“যারা ঈশ্বরকোটি — তারা যেমন রাজার বেটা; সাততলার চাবি তাদের হাতে। তারা সাততলায় উঠে যায়, আবার ইচ্ছামতো নেমে আসতে পারে। জীবকোটি যেমন ছোট কর্মচারী, সাততলা বাড়ির খানিকটা যেতে পারে ওই পর্যন্ত।”
[জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় ]
“জনক জ্ঞানী, সাধন করে জ্ঞানলাভ করেছিল; শুকদেব জ্ঞানের মূর্তি।”গিরিশ — আহা!
শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধন করে শুকদেবের জ্ঞানলাভ করতে হয় নাই। নারদেরও শুকদেবের মতো ব্রহ্মজ্ঞান ছিল, কিন্তু ভক্তি নিয়ে ছিলেন — লোকশিক্ষার জন্য। প্রহ্লাদ কখনও সোঽহম্ ভাবে থাকতেন, কখনও দাসভাবে — সন্তানভাবে। হনুমানেরও ওই অবস্থা।
“মনে করলে সকলেরই এই অবস্থা হয় না। কোনও বাঁশের বেশি খোল, কোনও বাঁশের ফুটো ছোট।”
———————–
১ It is with our judgements as with our watches,
None goes just alike, yet each believes his own.
=============
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কামিনী-কাঞ্চন ও তীব্র বৈরাগ্য
একজন ভক্ত — আপনার এ-সব ভাব নজিরের জন্য, তাহলে আমাদের কি করতে হবে?শ্রীরামকৃষ্ণ — ভগবানলাভ করতে হলে তীব্র বৈরাগ্য দরকার। যা ঈশ্বরের পথে বিরুদ্ধ বলে বোধ হবে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করতে হয়। পরে হবে বলে ফেলে রাখা উচিত নয়। কামিনী-কাঞ্চন ঈশ্বরের পথে বিরোধী; ও-থেকে মন সরিয়ে নিতে হবে।
“ঢিমে তেতালা হলে হবে না। একজন গামছা কাঁধে স্নান করতে যাচ্ছে। পরিবার বললে, তুমি কোন কাজের নও, বয়স বাড়ছে, এখন এ-সব ত্যাগ করতে পারলে না। আমাকে ছেড়ে তুমি একদিনও থাকতে পার না। কিন্তু অমুক কেমন ত্যাগী!
স্বামী — কেন, সে কি করেছে?
পরিবার — তার ষোলজন মাগ, সে এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে। তুমি কখনও ত্যাগ করতে পারবে না।
স্বামী — এক-একজন করে ত্যাগ! ওরে খেপী, সে ত্যাগ করতে পারবে না। যে ত্যাগ করে সে কি একটু একটু করে ত্যাগ করে!
পরিবার — (সহাস্যে) — তবু তোমার চেয়ে ভাল।
স্বামী — খেপী, তুই বুঝিস না। তার কর্ম নয়, আমিই ত্যাগ করতে পারব, এই দ্যাখ্ আমি চললুম!
“এর নাম তীব্র বৈরাগ্য। যাই বিবেক এল তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করলে। গামছা কাঁধেই চলে গেল। সংসার গোছগাছ করতে এল না। বাড়ির দিকে একবার পেছন ফিরে চাইলেও না।
“যে ত্যাগ করবে তার খুব মনের বল চাই। ডাকাত পড়ার ভাব। অ্যায়!!! — ডাকাতি করবার আগে যেমন ডাকাতেরা বলে — মারো! লোটো! কাটো!
“কি আর তোমরা করবে? তাঁতে ভক্তি, প্রেম লাভ করে দিন কাটানো। কৃষ্ণের অদর্শনে যশোদা পাগলের ন্যায় শ্রীমতীর কাছে গেলেন। শ্রীমতী তাঁর শোক দেখে আদ্যাশক্তিরূপে দেখা দিলেন। বললেন, মা, আমার কাছে বর নাও। যশোদা বললেন, মা, আর কি লব? তবে এই বল, যেন কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণেরই সেবা করতে পারি। এই চক্ষে তার ভক্তদর্শন, — যেখানে যেখানে তার লীলা, এই পা দিয়ে সেখানে যেতে পারি, — এই হাতে তার সেবা আর তার ভক্তসেবা, — সব ইন্দ্রিয়, যেন তারই কাজ করে।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবার ভাবাবেশের উপক্রম হইতেছে। হঠাৎ আপনা-আপনি বলিতেছেন, “সংহারমূর্তি কালী! — না নিত্যকালী!”
ঠাকুর অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিলেন। এইবার একটু জলপান করিলেন। যশোদার কথা আবার বলিতে যাইতেছেন, শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে আসিয়া উপস্থিত। ইনি ও ইঁহার কনিষ্ঠ শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে ঠাকুরের কাছে নূতন যাওয়া-আসা করিতেছেন। মহেন্দ্রের ময়দার কল ও অন্যান্য ব্যবসা আছে। তাঁহার ভ্রাতা ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করিতেন। ইঁহাদের কাজকর্ম লোকজনে দেখে, নিজেদের খুব অবসর আছে। মহেন্দ্রের বয়স ৩৬।৩৭ হইবে, ভ্রাতার বয়স আন্দাজ ৩৪।৩৫। ইঁহাদের বাটী কেদেটি গ্রামে। কলিকাতা বাগবাজারেও একটি বসতবাটী আছে। তাঁহাদের সঙ্গে একটি ছোকরা ভক্ত আসা-যাওয়া করেন, তাঁহার নাম হরি। তাঁহার বিবাহ হইয়াছে; কিন্তু ঠাকুরের উপর বড় ভক্তি। মহেন্দ্র অনেকদিন দক্ষিণেশ্বরে যান নাই। হরিও যান নাই, আজ আসিয়াছেন। মহেন্দ্র গৌরবর্ণ ও সদা হাস্যমুখ, শরীর দোহারা। মহেন্দ্র ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। হরিও প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন এতদিন দক্ষিণেশ্বরে যাওনি গো?
মহেন্দ্র — আজ্ঞা, কেদেটিতে গিছলাম, কলকাতায় ছিলাম না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিগো ছেলেপুলে নাই, — কারু চাকরি করতে হয় না, — তবুও অবসর নাই! ভাল জ্বালা!
ভক্তেরা সকলে চুপ করিয়া আছেন। মহেন্দ্র একটু অপ্রস্তুত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি) — তোমায় বলি কেন, — তুমি সরল, উদার — তোমার ঈশ্বরে ভক্তি আছে।
মহেনদ্র — আজ্ঞে, আপনি আমার ভালোর জন্যই বলেছেন।
[বিষয়ী ও টাকাওয়ালা সাধু — সন্তানের মায়া ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর এখানকার যাত্রায় প্যালা দিতে হয় না। যদুর মা তাই বলে, ‘অন্য সাধু কেবল দাও দাও করে; বাবা, তোমার উটি নাই’। বিষয়ী লোকের টাকা খরচ হলে বিরক্ত হয়।“এক জায়গায় যাত্রা হচ্ছিল। একজন লোকের বসে শোনবার ভারী ইচ্ছা। কিন্তু সে উঁকি মেরে দেখলে যে আসরে প্যালা পড়ছে, তখন সেখান থেকে আস্তে আস্তে পালিয়ে গেল। আর-এক জায়গায় যাত্রা হচ্ছিল, সেই জায়গায় গেল। সন্ধান করে জানতে পারলে যে এখানে কেউ প্যালা দেবে না। ভারী ভিড় হয়েছে। সে দুই হাতে কুনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে আসরে গিয়ে উপস্থিত। আসরে ভাল করে বসে গোঁপে চাড়া দিয়ে শুনতে লাগল। (হাস্য)
“আর তোমার তো ছেলেপুলে নাই যে মন অন্যমনস্ক হবে। একজন ডেপুটি, আটশো টাকা মাইনে, কেশব সেনের বাড়িতে (নববৃন্দাবন) নাটক দেখতে গিছল। আমিও গিছলাম, আমার সঙ্গে রাখাল আরও কেউ কেউ গিছল। নাটক শুনবার জন্য আমি — যেখানে বসেছি তারা আমার পাশে বসেছে। রাখাল তখন একটু উঠে গিছল। ডেপুটি এসে ওইখানে বসল। আর তার ছোট ছেলেটিকে রাখালের জায়গায় বসালে। আমি বললুম, এখানে বসা হবে না, — আমার এমনি অবস্থা যে, কাছে যে বসবে সে যা বলবে তাই করতে হবে, তাই রাখালকে কাছে বসিয়েছিলাম। যতক্ষণ নাটক হল ডেপুটির কেবল ছেলের সঙ্গে কথা। শালা একবারও কি থিয়েটার দেখলে না! আবার শুনেছি নাকি মাগের দাস — ওঠ বললে ওঠে, বোস বললে বসে, — আবার একটা খাঁদা বানুরে ছেলের জন্য এই … তুমি ধ্যান-ট্যান তো কর?”
মহেন্দ্র — আজ্ঞে, একটু একটু হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — যাবে এক-একবার?
মহেন্দ্র (সহাস্যে) — আজ্ঞে, কোথায় গাঁট-টাঁট আছে আপনি জানেন, — আপনি দেখবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আগে যেও। — তবে তো টিপে-টুপে দেখব, কোথায় কি গাঁটি আছে! যাও না কেন?
মহেন্দ্র — কাজকর্মের ভিড়ে আসতে পারি না, — আবার কেদেটির বাড়ি মাঝে মাঝে দেখতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া, মহেন্দ্রের প্রতি) — এদের কি বাড়ি ঘর-দোর নাই? আর কাজকর্ম নাই? এরা আসে কেমন করে?
[পরিবারের বন্ধন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরির প্রতি) — তুই কেন আসিস নাই? তোর পরিবার এসেছে বুঝি?হরি — আজ্ঞা, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে কেন ভুলে গেলি?
হরি — আজ্ঞা, অসুখ করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের) — কাহিল হয়ে গেছে, — ওর ভক্তি তো কম নয়, ভক্তির চোট দেখে কে! উৎপেতে ভক্তি। (হাস্য)
ঠাকুর একটি ভক্তের পরিবারকে ‘হাবীর মা’ বলতেন। হাবীর মার ভাই আসিয়াছে, কলেজে পড়ে, বয়স আন্দাজ কুড়ি। তিনি ব্যাট খেলিতে যাইবেন, — গাত্রোত্থান করিলেন। ছোট ভাইও ঠাকুরের ভক্ত, সেই সঙ্গে গমন করিলেন। কিয়ৎ পরে দ্বিজ ফিরিয়া আসিলে ঠাকুর বলিলেন, “তুই গেলিনি?”
একজন ভক্ত বলিলেন, “উনি গান শুনিবেন তাই বুঝি ফিরে এলেন।”
আজ ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যের গান হইবে। পল্টু আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর বলিতেছেন, কে রে, — পল্টু যে রে!
আর একটি ছোকরা ভক্ত (পূর্ণ) আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর তাঁহাকে অনেক কষ্টে ডাকাইয়া আনিয়াছেন, বাড়ির লোকেরা কোনও মতে আসিতে দিবেন না। মাস্টার যে বিদ্যালয়ে পড়ান সেই বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে এই ছেলেটি পড়েন। ছেলেটি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রনাম করিলেন। ঠাকুর নিজের কাছে তাহাকে বসাইয়া আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন — মাস্টার শুধু কাছে বসিয়া আছেন, অন্যান্য ভক্তেরা অন্যমনস্ক হইয়া আছেন। গিরিশ এক পাশে বসিয়া কেশবচরিত পড়িতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ছোকরা ভক্তটির প্রতি) — এখানে এস।
গিরিশ (মাস্টারের প্রতি) — কে এ ছেলেটি?
মাস্টার (বিরক্ত হইয়া) — ছেলে আর কে?
গিরিশ (সহাস্যে) — It needs no ghost to tell me that.
মাস্টারের ভয় হইয়াছে পাছে পাঁচজন জানিতে পারিলে ছেলের বাড়িতে গোলযোগ হয় আর তাঁহার নামে দোষ হয়। ছেলেটির সঙ্গে ঠাকুরও সেইজন্য আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে সব কর? — যা বলে দিছিলাম?
ছেলেটি — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — স্বপনে কিছু দেখ? — আগুন-শিখা, মশালের আলো? সধবা মেয়ে? — শ্মশান-মশান? এ-সব দেখা বড় ভাল।
ছেলেটি — আপনাকে দেখেছি — বসে আছেন — কি বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি — উপদেশ? — কই, একটা বল দেখি।
ছেলেটি — মনে নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হোক, — ও খুব ভাল! — তোমার উন্নতি হবে — আমার উপর তো টান আছে?
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন — “কই সেখানে যাবে না?” — অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বরে। ছেলেটি বলিতেছে, “তা বলতে পারি না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন, সেখানে তোমার আত্মীয় কে আছে না?
ছেলেটি — আজ্ঞা হাঁ, কিন্তু সেখানে যাবার সুবিধা হবে না।
গিরিশ কেশবচরিত পড়িতেছেন। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ওই জীবনচরিত লিখিয়াছেন। ওই পুস্তকে লেখা আছে যে পরমহংসদেব আগে সংসারের উপর বড় বিরক্ত ছিলেন, কিন্তু কেশবের সহিত দেখাশুনা হবার পরে তিনি মত বদলাইয়াছেন — এখন পরমহংসদেব বলেন যে, সংসারেও ধর্ম হয়। এই কথা পড়িয়া কোন কোন ভক্তরা ঠাকুরকে বলিয়াছেন। ভক্তদের ইচ্ছা যে, ত্রৈলোক্যের সঙ্গে আজ এই বিষয় লইয়া কথা হয়। ঠাকুরকে বই পড়িয়া ওই সকল কথা শোনান হইয়াছিল।
[ঠাকুরের অবস্থা — ভক্তসঙ্গ ত্যাগ ]
গিরিশের হাতে বই দেখিয়া ঠাকুর গিরিশ, মাস্টার, রাম ও অন্যান্য ভক্তদের বলিতেছেন — “ওরা ওই নিয়ে আছে, তাই ‘সংসার সংসার’ করছে! — কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর রয়েছে। তাঁকে লাভ করলে ও কথা বলে না। ঈশ্বরের আনন্দ পেলে সংসার কাকবিষ্ঠা হয়ে যায়, — আবার মাঝে ভক্তসঙ্গ-ফঙ্গও ত্যাগ করেছিলাম! দেখলুম পট্ পট্ মরে যায়, আর শুনে ছট্ফট্ করি! এখন তবু একটু লোক নিয়ে থাকি।”============
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সংকীর্তনানন্দে ভক্তসঙ্গে
গিরিশ বাড়ি চলিয়া গেলেন। আবার আসিবেন।শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেনের সহিত ত্রৈলোক্য আসিয়া উপস্থিত। তাঁহারা ঠাকুরকে প্রনাম করিলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর তাঁহাদের কুশল প্রশ্ন করিতেছেন। ছোট নরেন আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, — কই তুই শনিবারে এলিনি? এইবার ত্রৈলোক্য গান গাইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা, তুমি আনন্দময়ীর গান সেদিন করলে, — কি গান! আর সব লোকের গান আলুনী লাগে! সেদিন নরেন্দ্রের গানও ভাল লাগল না। সেইটে অমনি অমনি হোক না।
ত্রৈলোক্য গাইতেছেন — ‘জয় শচীনন্দন’।
ঠাকুর মুখ ধুইতে যাইতেছেন। মেয়ে ভক্তেরা চিকের পার্শ্বে ব্যাকুল হইয়া বসিয়া আছেন। তাঁহাদের কাছে গিয়া একবার দর্শন দিবেন। ত্রৈলোক্যের গান চলিতেছে।
ঠাকুর ঘরের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, — একটু আনন্দময়ীর গান, — ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:
কত ভালবাস গো মা মানব সন্তানে,
মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে (গো মা)।
তব পদে অপরাধী, আছি আমি জন্মাবধি,
তবু চেয়ে মুখপানে প্রেমনয়নে, ডাকিছ মধুর বচনে,
মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে।
তোমার প্রেমের ভার, বহিতে পারি না গো আর,
প্রাণ উঠিছে কাঁদিয়া, হৃদয় ভেদিয়া, তব স্নেহ দরশনে,
লইনু শরণ মা গো তব শ্রীচরণে (গো মা) ৷৷
গান শুনিতে শুনিতে ছোট নরেন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছেন, যেন কাষ্ঠবৎ! ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখ, দেখ, কি গভীর ধ্যান! একেবারে বাহ্যশূন্য!”
গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর ত্রৈলোক্যকে এই গানটি গাইতে বলিলেন — ‘দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে।’
রাম বলিতেছেন, কিছু হরিনাম হোক! ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:
মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
হরি হরি হরি বলে, ভবসিন্ধু পারে চল।
মাস্টার আস্তে আস্তে বলিতেছেন, ‘গৌর-নিতাই তোমরা দুভাই।’
ঠাকুরও ওই গানটি গাইতে বলিতেছেন। ত্রৈলোক্য ও ভক্তেরা সকলে মিলিয়া গাইতেছেন:
গৌর নিতাই তোমরা দুভাই পরম দয়াল হে প্রভু!
ঠাকুরও যোগদান করিলেন। সমাপ্ত হইলে আর একটি ধরিলেন:
যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা ব্রজের কানাই বলাই তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
যারা আচণ্ডালে কোল দেয় তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
ওই গানের সঙ্গে ঠাকুর আর একটা গান গাহিতেছেন:
নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।
ঠাকুর আবার ধরিলেন:
কে হরিবোল হরিবোল বলিয়ে যায়?
যা রে মাধাই জেনে আয়।
বুঝি গৌর যায় আর নিতাই যায় রে।
যাদের সোনার নূপুর রাঙা পায়।
যাদের নেড়া মাথা ছেঁড়া কাঁথা রে।
যেন দেখি পাগলেরই প্রায়।
ছোট নরেন বিদায় লইতেছেন —
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুই বাপ-মাকে খুব ভক্তি করবি। — কিন্তু ঈশ্বরের পথে বাধা দিলে মানবিনি। খুব রোখ আনবি — শালার বাপ!
ছোট নরেন — কে জানে, আমার কিছু ভয় হয় না।
গিরিশ বাড়ি হইতে আবার আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সহিত আলাপ করিয়া দিতেছেন; আর বলিতেছেন, ‘একটু আলাপ তোমরা কর।’ একটু আলাপের পর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ‘সেই গানটি আর একবার,’ — ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:
[ঝিঁঝিট খাম্বাজ — ঠুংরী ]
জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ,
কিবা মৃণালনিন্দিত, আজানুলম্বিত, প্রেম প্রসারিত, কোমল যুগল কর
কিবা রুচির বদন-কমল, প্রেমরসে ঢল ঢল,
চিকুর কুন্তল, চারু গণ্ডস্থল, হরিপ্রেমে বিহ্বল, অপরূপ মনোহর।
মহাভাবে মণ্ডিত হরি রসে রঞ্জিত, আনন্দে পুলকিত অঙ্গ,
প্রমত্ত মাতঙ্গ, সোনার গৌরাঙ্গ,
আবেশে বিভোর অঙ্গ, অনুরাগে গরগর।
হরিগুণগায়ক, প্রেমরস নায়ক,
সাধু-হৃদিরঞ্জক, আলোকসামান্য, ভক্তিসিন্ধু শ্রীচৈতন্য,
আহা! ‘ভাই’ বলি চণ্ডালে, প্রেমভরে লন কোলে,
নাচেন দুবাহু তুলে, হরি বোল হরি বলে,
অবিরল ঝরে জলে নয়নে নিরন্তর!
‘কোথা হরি প্রাণধন’ — বলে করে রোদন,
মহাস্বেদ কম্পন, হুঙ্কার গর্জন,
পুলকে রোমাঞ্চিত, শরীর কদম্বিত,
ধুলায় বিলুণ্ঠিত সুন্দর কলেবর।
হরি-লীলা-রস-নিকেতন, ভক্তিরস-প্রস্রবণ;
দীনজনবান্ধব, বঙ্গের গৌরব, ধন্য ধন্য শ্রীচৈতন্য প্রেম শশধর।
‘গৌর হাসে কাঁদে নাচে গায়’ — এই কথা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন, — একেবারে বাহ্যশূন্য!
কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া — ত্রৈলোক্যকে অনুনয় বিনয় করিয়া বলিতেছেন, “একবার সেই গানটি! — কি দেখিলাম রে।”
ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:
কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতি; গৌরাঙ্গ মূরতি, দুনয়নে প্রেম বহে শত ধারে।
গান সমাপ্ত হইল। সন্ধ্যা হয়। ঠাকুর এখনও ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি) — বাজনা নাই! ভাল বাজনা থাকলে গান খুব জমে। (সহাস্যে) বলরামের আয়োজন কি জান, — বামুনের গোড্ডি (গরুটি) খাবে কম, দুধ দেবে হুড়হুড় করে! (সকলের হাস্য) বলরামের ভাব, — আপনারা গাও আপনারা বাজাও! (সকলের হাস্য)
===========
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যার সংসার — ঈশ্বরলাভের পর সংসার
সন্ধ্যা হইল। বলরামের বৈঠকখানায় ও বারান্দায় আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জগতের মাতাকে প্রণাম করিয়া, করে মূলমন্ত্র জপ করিয়া মধুর নাম করিতেছেন। ভক্তেরা চারিপার্শ্বে বসিয়া আছেন ও সেই মধুর নাম শুনিতেছেন। গিরিশ, মাস্টার, বলরাম, ত্রৈলোক্য ও অন্যান্য অনেক ভক্তরা এখনও আছেন। কেশবচরিত গ্রন্থে ঠাকুরের সংসার সম্বন্ধে মত পরিবর্তনের কথা যাহা লেখা আছে, ত্রৈলোক্যের সামনে সেই কথা উত্থাপন করিবেন, ভক্তেরা ঠিক করিয়াছেন। গিরিশ কথা আরম্ভ করিলেন।তিনি ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, “আপনি যা লিখেছেন — যে সংসার সম্বন্ধে এঁর মত পরিবর্তন হয়েছে, তা বস্তুতঃ হয় নাই।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — এ-দিকের আনন্দ পেলে ওটা ভাল লাগে না, ভগবানের আনন্দলাভ করলে সংসার আলুনী বোধ হয়। শাল পেলে আর বনাত ভাল লাগে না!
ত্রৈলোক্য — সংসার যারা করবে তাদের কথা আমি বলছি, — যারা ত্যাগী তাদের কথা বলছি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-সব তোমাদের কি কথা! — যারা ‘সংসারে ধর্ম’ ‘সংসারে ধর্ম’ করছে, তারা একবার যদি ভগবানের আনন্দ পায় তাদের আর কিছু ভাল লাগে না, কাজের সব আঁট কমে যায়, ক্রমে যত আনন্দ বাড়ে কাজ আর করতে পারে না, — কেবল সেই আনন্দ খুঁজে খুঁজে বেড়ায়! ভগবানের আনন্দের কাছে বিষয়ানন্দ আর রমণানন্দ! একবার ভগবানের আনন্দের আস্বাদ পেলে সেই আনন্দের জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায়, তখন সংসার থাকে আর যায়।
“চাতক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, — সাত সমুদ্র যত নদী পুষ্করিণী সব ভরপুর! তবু সে জল খাবে না! ছাতি ফেটে যাচ্ছে তবু খাবে না! স্বাতী নক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য হাঁ করে আছে! ‘বিনা স্বাতীকি জল সব ধূর!”
[দুআনা মদ ও দুদিক রাখা ]
“বলে দুদিক রাখব। দুআনা মদ খেলে মানুষ দুদিক রাখতে চায়, আর খুব মদ খেলে কি আর দুদিক রাখা যায়!“ঈশ্বরের আনন্দ পেলে আর কিছু ভাল লাগে না। তখন কামিনী-কাঞ্চনের কথা যেন বুকে বাজে। (ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলিতেছেন) ‘আন্ লোকের আন্ কথা, কিছু ভাল তো লাগে না!’ তখন ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়, টাকা-ফাকা কিছুই ভাল লাগে না!”
ত্রৈলোক্য — সংসারে থাকতে গেলে টাকাও তো চাই, সঞ্চয়ও চাই। পাঁচটা দান-ধ্যান —
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি, আগে টাকা সঞ্চয় করে তবে ঈশ্বর! আর দান-ধ্যান-দয়া কত! নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ — আর পাশের বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না। তাদের দুটি চাল দিতে কষ্ট হয় — অনেক হিসেব করে দিতে হয়। খেতে পাচ্ছে না লোকে, — তা আর কি হবে, ও শালারা মরুক বাঁচুক, — আমি আর আমার বাড়ির সকলে ভাল থাকলেই হল। মুখে বলে সর্বজীবে দয়া!
ত্রৈলোক্য — সংসারে তো ভাল লোক আছে, — পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, চৈতন্যদেবের ভক্ত। তিনি তো সংসারে ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তার গলা পর্যন্ত মদ খাওয়া ছিল, যদি আর একটু খেত তা হলে আর সংসার করতে পারত না।
ত্রৈলোক্য চুপ করিয়া রইলেন। মাস্টার গিরিশকে জনান্তিকে বলিতেছেন, ‘তাহলে উনি যা লিখেছেন ঠিক নয়।’
গিরিশ — তা হলে আপনি যা লিখেছেন ও-কথা ঠিক না?
ত্রৈলোক্য — কেন, সংসারে ধর্ম হয় উনি কি মানেন না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হয়, — কিন্তু জ্ঞানলাভ করে থাকতে হয়, ভগবানকে লাভ করে থাকতে হয়। তখন ‘কলঙ্ক সাগরে ভাসে, তবু কলঙ্ক না লাগে গায়।’ তখন পাঁকাল মাছের মতো থাকতে পারে। ঈশ্বরলাভের পর যে সংসার সে বিদ্যার সংসার। কামিনী-কাঞ্চন তাতে নাই, কেবল ভক্তি, ভক্ত আর ভগবান। আমারও মাগ আছে, — ঘরে ঘটিবাটিও আছে, — হরে প্যালাদের খাইয়ে দিই, আবার যখন হাবীর মা এরা আসে এদের জন্যও ভাবি।
===========
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব
একজন ভক্ত (ত্রৈলোক্যের প্রতি) — আপনার বইয়েতে দেখলাম আপনি অবতার মানেন না। চৈতন্যদেবের কথায় দেখলাম।ত্রৈললোক্য — তিনি নিজেই প্রতিবাদ করেছেন, — পুরীতে যখন অদ্বৈত ও অন্যান্য ভক্তেরা ‘তিনিই ভগবান’ এই বলে গান করেছিলেন, গান শুনে চৈতন্যদেব ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের অনন্ত ঐশ্বর্য। ইনি যেমন বলেন ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা। তা বৈঠকখানা খুব সাজান বলে কি আর কিছু ঐশ্বর্য নাই?
গিরিশ — ইনি বলেন, প্রেমই ঈশ্বরের সারাংশ — যে মানুষ দিয়ে ঈশ্বরের প্রেম আসে তাকেই আমাদের দরকার। ইনি বলেন, গরুর দুধ বাঁট দিয়ে আসে, আমাদের বাঁটের দরকার। গরুর শরীরে অন্য কিছু দরকার নাই; হাত, পা কি শিং।
ত্রৈলোক্য — তাঁর প্রেমদুগ্ধ অনন্ত প্রণালী দিয়ে পড়ছে! তিনি যে অনন্তশক্তি!
গিরিশ — ওই প্রেমের কাছে আর কোন শক্তি দাঁড়ায়?
ত্রৈলোক্য — যাঁর শক্তি তিনি মনে করলে হয়! সবই ঈশ্বরের শক্তি।
গিরিশ — আর সব তাঁর শক্তি বটে, — কিন্তু অবিদ্যা শক্তি।
ত্রৈলোক্য — অবিদ্যা কি জিনিস! অবিদ্যা বলে একটা জিনিস আছে না কি? অবিদ্যা একটি অভাব। যেমন অন্ধকার আলোর অভাব। তাঁর প্রেম আমাদের পক্ষে খুব বটে। তাঁর বিন্দুতে আমাদের সিন্ধু! কিন্তু ওইটি যে শেষ, একথা বললে তাঁর সীমা করা হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও অন্যানা ভক্তদের প্রতি) — হাঁ হাঁ, তা বটে। কিন্তু একটু মদ খেলেই আমাদের নেশা হয়। শুঁড়ির দোকানে কত মদ আছে সে হিসাবে আমাদের কাজ কি! অনন্ত শক্তির খপরে আমাদের কাজ কি?
গিরিশ (ত্রৈলোক্যের প্রতি) — আপনি অবতার মানেন?
ত্রৈলোক্য — ভক্ততেই ভগবান অবতীর্ণ। অনন্ত শক্তির manifestation হয় না, — হতে পারে না! — কোন মানুষেই হতে পারে না।
গিরিশ — ছেলেদের ‘ব্রহ্মগোপাল’ বলে সেবা করতে পারেন, মহাপুরুষকে ঈশ্বর বলে কি পূজা করতে পারা যায় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্যের প্রতি) — অনন্ত ঢুকুতে চাও কেন? তোমাকে ছুঁলে কি তোমার সব শরীরটা ছুঁতে হবে? যদি গঙ্গাস্নান করি তা হলে হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত কি ছুঁয়ে যেতে হবে? ‘আমি গেলে ঘুচিবে জঞ্জাল’। যতক্ষণ ‘আমি’ টুকু থাকে ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি। ‘আমি’ গেলে কি রইল তা কেউ জানতে পারে না, — মুখে বলতে পারে না। যা আছে তাই আছে! তখন খানিকটা এঁতে প্রকাশ হয়েছে আর বাদবাকিটা ওখানে প্রকাশ হয়েছে, — এ-সব মুখে বলা যায় না। সচ্চিদানন্দ সাগর! — তার ভিতর ‘আমি’ ঘট। যতক্ষণ ঘট ততক্ষণ যেন দুভাগ জল, — ঘটের ভিতরে একভাগ, বাহিরে এক ভাগ। ঘট ভেঙে গেলে — এক জল — তাও বলবার জো নাই! — কে বলবে?
বিচারান্তে ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সঙ্গে মিষ্টালাপ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি তো আনন্দে আছ?
ত্রৈলোক্য — কই এখান থেকে উঠলেই আবার যেমন তেমনি হয়ে যাবে। এখন বেশ ঈশ্বরের উদ্দীপনা হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — জুতো পরে থাকলে, কাঁটা বনে আর তার ভয় নাই। ‘ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য’ এই বোধ ধাকলে কামিনী-কাঞ্চনে আর ভয় নাই।
ত্রৈলোক্যকে মিষ্টমুখ করাইতে বলরাম কক্ষান্তরে লইয়া গেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যের ও তাঁহার মতালম্বী লোকদিগের ভক্তদের নিকট বর্ণনা করিতেছেন। রাত নয়টা হইল।
[অবতারকে কি সকলে চিনিতে পারে? ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশ, মণি ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) — এর আকি জানো! একটা পাতকুয়ার ব্যাঙ কখনও পৃথিবী দেখে নাই; পাতকুয়াটি জানে; তাই বিশ্বাস করবে না যে, একটা পৃথিবী আছে। ভগবানের আনন্দের সন্ধান পায় নাই, তাই ‘সংসার, সংসার’ করছে।(গিরিশের প্রতি) — “ওদের সঙ্গে বকচো কেন? দুইই নিয়ে অছে। ভগবানের আনন্দের আস্বাদ না পেলে, সে আনন্দের কথা বুঝতে পারে না। পাঁচবছরের বালককে কি রমণসুখ বোঝানো যায়? বিষয়ীরা যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে, সে শোনা কথা। যেমন খুড়ী জেঠিরা কোঁদল করে, তাদের কাছ থেকে বালকেরা শুনে শেখে আর বলে, ‘আমার ঈশ্বর আছেন’, ‘তোর ঈশ্বরের দিব্য।’
“তা হোক। ওদের দোষ নাই। সকলে কি সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে ধরতে পারে? রামচন্দ্রকে বারজন ঋষি কেবল জানতে পেরেছিল। সকলে ধরতে পারে না। কেউ সাধারণ মানুষ ভাবে; — কেউ সাধু ভাবে; দু-চারজন অবতার বলে ধরতে পারে।
“যার যেমন পুঁজি — জিনিসের সেইরকম দর দেয়। একজন বাবু তার চাকরকে বললে, তুই এই হীরেটি বাজারে নিয়ে যা। আমায় বলবি, কে কি-রকম দর দেয়। আগে বেগুনওয়ালার কাছে নিয়ে যা। চাকরটি প্রথমে বেগুনওয়ালার কাছে গেল। সে নেড়ে চেড়ে দেখে বললে — ভাই, নয় সের বেগুন আমি দিতে পারি! চাকরটি বললে, ভাই আর একটু ওঠ, না হয় দশ শের দাও। সে বললে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি; এতে তোমায় পোষায় তো দিয়ে যাও। চাকর তখন হাসতে হাসতে হীরেটি ফিরিয়ে নিয়ে বাবুর কাছে বললে, মহাশয়, বেগুনওয়ালা নয় সের বেগুনের বেশি একটিও দেবে না। সে বললে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি।
বাবু হেসে বললে, আচ্ছা এবার কাপড়ওয়ালার কাছে নিয়ে যা। ও বেগুন নিয়ে থাকে, ও আর কতদূর বুঝবে! কাপড়ওয়ালার পুঁজি একটু বেশি, — দেখি ও কি বলে। চাকরটি কাপড়ওয়ালার কাছে বললে, ওহে এটি নেবে? কত দর দিতে পার? কাপড়ওয়ালা বললে, হাঁ জিনিসটা ভাল, এতে বেশ গয়না হতে পারে; — তা ভাই আমি নয়শো টাকা দিতে পারি। চাকরটি বললে, ভাই আর-একটু ওঠ, তাহলে ছেড়ে দিয়ে যাই; না হয় হাজার টাকাই দাও। কাপড়ওয়ালা বললে, ভাই, আর কিছু বলো না; আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি; নয়শো টাকার বেশি একটি টাকাও আমি দিতে পারব না। চাকর ফিরিয়ে নিয়ে মনিবের কাছে হাসতে হাসতে ফিরে গেল আর বললে যে, কাপড়ওয়ালা বলেছে যে নশো টাকার বেশি একটি টাকাও সে দিতে পারবে না! আরও সে বলেছে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি। তখন তার মনিব হাসতে হাসতে বললে, এইবার জহুরীর কাছে যাও — সে কি বলে দেখা যাক। চাকরটি জহুরীর কাছে এল। জহুরী একটু দেখেই একবারে বললে, একলাখ টাকা দেব।”
[ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি ]
“সংসারে ধর্ম ধর্ম এরা করছে। যেমন একজন ঘরে আছে, — সব বন্ধ, — ছাদের ফুটো দিয়ে একটু আলো আসছে। মাতার উপর ছাদ থাকলে কি সূর্যকে দেখা যায়? একটু আলো এলে কি হবে? কামিনী-কাঞ্চন ছাদ! ছাদ তুলে না ফেললে কি সূর্যকে দেখা যায়! সংসারী লোক যেন ঘরের ভিতর বন্দী হয়ে আছে!“অবতারাদি ঈশ্বরকোটি। তারা ফাঁকা জায়গায় বেড়াচ্চে। তারা কখনও সংসারে বদ্ধ হয় না, — বন্দী হয় না। তাদের ‘আমি’ মোটা ‘আমি’ নয় — সংসারী লোকদের মতো। সংসারী লোকদের অহংকার, সংসারী লোকদের ‘আমি’ — যেন চতুর্দিকে পাঁচিল, মাথার উপর ছাদ; — বাহিরে কোন জিনিস দেখা যায় না। অবতারাদির ‘আমি’ পাতলা ‘আমি’। এ ‘আমি’র ভিতর দিয়ে ঈশ্বরকে সর্বদা দেখা যায়। যেমন একজন লোক পাঁচিলের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, — পাঁচিলের দুদিকেই অনন্ত মাঠ। সেই পাঁচিলের গায়ে যদি ফোকর থাকে পাঁচিলের ওধারে সব দেখা যায়। বড় ফোকর জলে আনাগোনাও হয়। অবতারাদির ‘আমি’ ওই ফোকরওয়ালা পাঁচিল। পাঁচিলের এধারে থাকলেও অনন্ত মাঠ দেখা যায়; — এর মানে, দেহধারণ করলেও তারা সর্বদা যোগেতেই থাকে! আবার ইচ্ছে হলে বড় ফোকরের ওধারে গিয়ে সমাধিস্থ হয়। আবার বড় ফোকর হলে আনাগোনা করতে পারে; সমাধিস্থ হলেও আবার নেমে আসতে পারে।”
ভক্তেরা অবাক্ হইয়া অবতারতত্ত্ব শুনিতে লাগিলেন।
============
0 Comments