পঞ্চবিংশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

পঞ্চবিংশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, মাস্টার, পণ্ডিত শ্যামাপদ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

পঞ্চবিংশ খণ্ড~চতুর্থ ভাগ~শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত

=========

প্রথম পরিচ্ছেদ

সমাধিমন্দিরে — পণ্ডিত শ্যামাপদের প্রতি কৃপা
শ্রীরামকৃষ্ণ দু-একটি ভক্তসঙ্গে ঘরে বসিয়া আছেন। অপরাহ্ন, পাঁচটা; বৃসস্পতিবার, ২৭শে অগস্ট ১৮৮৫; ১২ই ভাদ্র, শ্রাবণ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া।
ঠাকুরের অসুখের সূত্রপাত হইয়াছে। তথাপি ভক্তেরা কেহ আসিলে শরীরকে শরীর জ্ঞান করেন না। হয়তো সমস্ত দিন তাঁহাদের লইয়া কথা কহিতেছেন — কখনও বা গান করিতেছেন।
শ্রীযুক্ত মধু ডাক্তার প্রায় নৌকা করিয়া আসেন — ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য ভক্তেরা বড়ই চিন্তিত হইয়াছেন। মধু ডাক্তার যাহাতে প্রত্যহ আসিয়া দেখেন, এই তাঁহাদের ইচ্ছা। মাস্টার ঠাকুরকে বলিতেছেন, ‘উনি বহুদর্শী লোক, উনি রোজ দেখলে ভাল হয়।’
পণ্ডিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্য আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন করিলেন। ইঁহার নিবাস আঁটপুর গ্রামে। সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখিয়া পণ্ডিত ‘সন্ধ্যা করিতে যাই’, বলিয়া গঙ্গাতীরে চাঁদনীর ঘাটে গমন করিলেন।
সন্ধ্যা করিতে করিতে পণ্ডিত কি আশ্চর্য দর্শন করিলেন। সন্ধ্যা সমাপ্ত হইলে ঠাকুরের ঘরে আসিয়া মেঝেতে বসিলেন। ঠাকুর মার নাম ও চিন্তার পর নিজের আসনেই বসিয়া আছেন। পাপোশের উপর মাস্টার। রাখাল, লাটু প্রভৃতি ঘরে যাতায়াত করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, পণ্ডিতকে দেখাইয়া) — ইনি একজন বেশ লোক। (পণ্ডিতের প্রতি) ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে যেখানে মনের শান্তি হয়, সেইখানেই তিনি।
[ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ও পণ্ডিত শ্যামাপদ — ‘সমাধিমন্দিরে’ ]
“সাত দেউড়ির পর রাজা আছেন। প্রথম দেউড়িতে গিয়ে দেখে যে একজন ঐশ্বর্যবান পুরুষ অনেক লোকজন নিয়ে বসে আছেন; খুব জাঁকজমক। রাজাকে যে দেখতে গিয়েছে, সে সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘এই কি রাজা?’ সঙ্গী ঈষৎ হেসে বললে, ‘না’।
“দ্বিতীয় দেউড়ি আর অন্যান্য দেউড়িতেও ওইরূপ বললে। দেখে, যত এগিয়ে যায়, ততই ঐশ্বর্য! আর জাঁকজমক! সাত দেউড়ি পার হয়ে যখন দেখলে তখন আর সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলে না! রাজার অতুল ঐশ্বর্য দর্শন করে অবাক্‌ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। — বুঝলে এই রাজা। — এ-বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই।”
[ঈশ্বর, মায়া, জীবজগৎ — অধ্যাত্ম রামায়ণ — যমলার্জ্জুনের স্তব ]
পণ্ডিত — মায়ার রাজ্য ছাড়িয়ে গেলে তাঁকে দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর সাক্ষাৎকারের পর আবার দেখে, এই মায়া-জীবজগৎ তিনিই হয়েছেন। এই সংসার ধোকার টাটি — স্বপ্নবৎ, — এই বোধ হয়, যখন ‘নেতি’, ‘নেতি’ বিচার করে। তাঁর দর্শনের পর আবার ‘এই সংসার মজার কুটি।’
“শুধু শাস্ত্র পড়লে কি হবে? পণ্ডিতেরা কেবল বিচার করে।”
পণ্ডিত — আমায় কেউ পণ্ডিত বললে ঘৃণা করে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওইটি তাঁর কৃপা! পণ্ডিতেরা কেবল বিচার করে। কিন্তু কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে। সাক্ষাৎকারের পর সব নারায়ণ দেখবে — নারায়ণই সব হয়েছেন।
পণ্ডিত নারায়ণের স্তব শুনাইতেছেন। ঠাকুর আনন্দে বিভোর।
পণ্ডিত — সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ৷৷[1]
শ্রীরামকৃষ্ণ — আপনার অধ্যাত্ম (রামায়ণ) দেখা আছে?
পণ্ডিত — আজ্ঞে হাঁ, একটু দেখা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ওতে জ্ঞান-ভক্তি পরিপূর্ণ। শবরীর উপাখ্যান, অহল্যার স্তব, সব ভক্তিতে পরিপূর্ণ।
“তবে একটি কথা আছে। তিনি বিষয়বুদ্ধি থেকে অনেক দূর।”
পণ্ডিত — যেখানে বিষয়বুদ্ধি, তিনি ‘সুদূরম্‌’, — আর যেখানে তা নাই, সেখানে তিনি ‘অদূরম্‌’। উত্তরপাড়ার এক জমিদার মুখুজ্জেকে দেখে এলাম বয়স হয়েছে — কেবল নভেলের গল্প শুনছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ — অধ্যাত্মে আর একটি বলেছে যে, তিনিই জীবজগৎ!
পণ্ডিত আনন্দিত হইয়া যমলার্জ্জুনের এই ভাবের স্তব শ্রীমদ্‌ভাগবত দশম স্কন্ধ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন —
কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাযোগিংস্ত্বমাদ্যঃ পুরুষঃ পরঃ।
ব্যক্তাব্যক্তমিদং বিশ্বং রূপং তে ব্রাহ্মণা বিদুঃ ৷৷
ত্বমেকঃ সর্বভূতানাং দেহস্বাত্মেনিদ্রয়েশ্বরঃ।
ত্বমেব কালো ভগবান্‌ বিষ্ণুরব্যয় ঈশ্বরঃ ৷৷
ত্বং মহান্‌ প্রকৃতিঃ সূক্ষ্মা রজঃসত্ত্বতমোময়ী।
ত্বমেব পুরুষোঽধ্যক্ষঃ সর্বক্ষেত্রবিকারবিৎ ৷৷
[শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ — ‘আন্তরিক ধ্যান-জপ করলে আসতেই হবে’ ]
ঠাকুর স্তব শুনিয়া সমাধিস্থ! দাঁড়াইয়াছেন। পণ্ডিত বসিয়া। পণ্ডিতের কোলে ও বক্ষে একটি চরণ রাখিয়া ঠাকুর হাসিতেছেন।
পণ্ডিত চরণ ধারণ করিয়া বলিতেছেন, ‘গুরো চৈতন্যং দেহি।’ ঠাকুর ছোট তক্তার কাছে পূর্বাস্য হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।
পণ্ডিত ঘর হইতে চলিয়া গেলে ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, আমি যা বলি মিলছে? যারা আন্তরিক ধ্যান-জপ করেছে তাদের এখানে আসতেই হবে।
রাত দশটা হইল। ঠাকুর একটু সামান্য সুজির পায়স খাইয়া শয়ন করিয়াছেন।
মণিকে বলিতেছেন, “পায়ে হাতটা বুলিয়ে দাও তো।”
কিয়ৎক্ষণ পরে গায়ে ও বক্ষঃস্থলে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন।
সামান্য নিদ্রার পর মণিকে বলিতেছেন, “তুমি শোওগে; — দেখি একলা থাকলে যদি ঘুম হয়।” ঠাকুর রামলালকে বলিতেছেন, “ঘরের ভিতরে ইনি (মণি) আর রাখাল শুলে হয়।”
—————–
১ গীতা [৬।২৯]
==========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যীশুখ্রীষ্ট (Jesus Christ)
প্রত্যূষ (২৮শে অগস্ট) হইল। ঠাকুর গাত্রোত্থান করিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। অসুস্থ হওয়াতে ভক্তেরা শ্রীমুখ হইতে সেই মধুর নাম শুনিতে পাইলেন না। ঠাকুর প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া নিজের আসনে আসিয়া বসিয়াছেন। মণিকে বলিতেছেন, আচ্ছা, রোগ কেন হল?
মণি — আজ্ঞা, মানুষের মতন সব না হলে জীবের সাহস হবে না। তারা দেখেছে যে, এই দেহের এত অসুখ, তবুও আপনি ঈশ্বর বই আর কিছুই জানেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — বলরামও বললে, ‘আপনারই এই, তাহলে আমাদের আর হবে না কেন?’
“সীতার শোকে রাম ধনুক তুলতে না পারাতে লক্ষ্মণ আশ্চর্য হয়ে গেল। কিন্তু পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পরে কাঁদে।
মণি — ভক্তের দুঃখ দেখে যীশুখ্রীষ্টও অন্য লোকের মতো কেঁদেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি হয়েছিল?
মণি — মার্থা, মেরী দুই ভগ্নী, আর ল্যাজেরাস ভাই — তিনজনই যীশুখ্রীষ্টের ভক্ত। ল্যাজেরাসের মৃত্যু হয়। যীশু তাদের বাড়িতে আসছিলেন। পথে একজন ভগ্নী (মেরী), দৌড়ে গিয়ে পদতলে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘প্রভু, তুমি যদি আসতে, তাহলে সে মরতো না।’ যীশু তার কান্না দেখে কেঁদেছিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সিদ্ধাই — Miracles]
“তারপর তিনি গোরের কাছে গিয়ে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন, অমনি ল্যাজেরাস প্রাণ পেয়ে উঠে এল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার কিন্তু উগোনো হয় না।
মণি — সে আপনি করেন না — ইচ্ছা করে। ও-সব সিদ্ধাই, Miracle তাই আপনি করেন না। ও-সব করলে লোকদের দেহেতেই মন যাবে — শুদ্ধাভক্তির দিকে মন যাবে না। তাই আপনি করেন না।
“আপনার সঙ্গে যীশুখ্রীষ্টের অনেক মেলে!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর কি কি মেলে?
মণি — আপনি ভক্তদের উপবাস করতে কি অন্য কোন কঠোর করতে বলেন না — খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধেও কোন কঠিন নাই। যীশুখ্রীষ্টের শিষ্যেরা রবিবারে নিয়ম না করে খেয়েছিল, তাই যারা শাস্ত্র মেনে চলত তারা তিরস্কার করেছিল। যীশু বললেন, ‘ওরা খাবে, খুব করবে; যতদিন বরের সঙ্গে আছে, বরযাত্রীরা আনন্দই করবে।’
শ্রীরামকৃষ্ণ — এর মানে কি?
মণি — অর্থাৎ যতদিন অবতারের সঙ্গে সঙ্গে আছে, সাঙ্গোপাঙ্গগণ কেবল আনন্দই করবে — কেন নিরানন্দ হবে? তিনি যখন স্বধামে চলে যাবেন, তখন তাদের নিরানন্দের দিন আসবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আর কিছু মেলে?
মণি — আজ্ঞা, আপনি যেমন বলেন — ‘ছোকরাদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন ঢুকে নাই; ওরা উপদেশ ধারণা করতে পারবে, — যেমন নূতন হাঁড়িতে দুধ রাখা যায়। দই পাতা হাঁড়িতে রাখলে নষ্ট হতে পারে’; তিনিও সেইরূপ বলতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বলতেন?
মণি — ‘পুরানো বোতলে নূতন মদ রাখলে বোতল ফেটে যেতে পারে।’ আর ‘পুরানো কাপড়ে নূতন তালি দিলে শীঘ্র ছিঁড়ে যায়।’
“আপনি যেমন বলেন, ‘মা আর আপনি এক’ তিনিও তেমনি বলতেন, ‘বাবা আর আমি এক’।” (I and my father are one.)
মণি — আপনি যেমন বলেন, ‘ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।” তিনিও বলতেন, ‘ব্যাকুল হয়ে দোরে ঘা মারো দোর খোলা পাবে!’ (Knock and it shall be opened unto you.)
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, অবতার যদি হয়, তা পূর্ণ, না অংশ, না কলা? কেউ কেউ বলে পূর্ণ।
মণি — আজ্ঞা, পূর্ণ, অংশ, কলা, ও-সব ভাল বুঝতে পারি না। তবে যেমন বলেছিলেন ওইটে বেশ বুঝেছি। পাঁচিলের মধ্যে গোল ফাঁক।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি বল দেখি?
মণি — প্রাচীরের ভিতর একটি গোল ফাঁক — সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে প্রাচিরের ওধারের মাঠ খানিকটা দেখা যাচ্ছে। সেইরূপ আপনার ভিতর দিয়ে সেই অনন্ত ঈশ্বর খানিকটা দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, দুই-তিন ক্রোশ একেবারে দেখা যাচ্ছে।
মণি চাঁদনির ঘাটে গঙ্গাস্নান করিয়া ঠাকুরের কাছে ঘরে উপনীত হইলেন। বেলা আটটা হইয়াছে।
মণি লাটুর কাছে আটকে চাইছেন — শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের আটকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ কাছে আসিয়া মণিকে বলিতেছেন, “তুমি ওটা (প্রসাদ খাওয়া) করো — যারা ভক্ত হয়, প্রসাদ না হলে খেতে পারে না।”
মণি — আজ্ঞা, আমি কাল অবধি বলরামবাবুর বাড়ি থেকে জগন্নাথের আটকে এনেছি — তাই রোজ একটি দুটি খাই।
মণি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন ও বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। ঠাকুর সস্নেহে বলিতেছেন, তবে তুমি সকাল সকাল এসো — আবার ভাদ্র মাসের রৌদ্র — বড় খারাপ।
========

Post a Comment

0 Comments