স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
দশম খণ্ড
বিবিধ
================
আমার জীবন ও ব্রত
[২৭ জানুআরী ১৯০০ খ্রীঃ ক্যালিফোর্নিয়া, প্যাসাডেনা শেক্সপিয়ার ক্লাবে প্রদত্ত।]
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আজ সকালে আলোচনার বিষয় ছিল ‘বেদান্তদর্শন’। বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী হইলেও একটু নীরস ও অতি বিরাট।
ইতোমধ্যে আপনাদের সভাপতি এবং উপস্থিত কয়েকজন ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলা ‘আমার কাজ ও এতদিনের কার্যক্রম’ সম্বন্ধে কিছু বলিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করিয়াছেন। বিষয়টি কাহারও কাহারও নিকট আকর্ষণীয় হইতে পারে, কিন্তু আমার নিকটে নয়। বস্তুতঃ কেমন করিয়া যে আপনাদের নিকট এ-সম্বন্ধে বলিব, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না। এ-বিষয়ে এই আমার প্রথম বলা।
আমার ক্ষুদ্র শক্তি দ্বারা এতদিন কি করিবার চেষ্টা করিয়াছি, তাহা বুঝাইবার জন্য আপনাদিগকে কল্পনায় ভারতবর্ষে লইয়া যাইতেছি। বিষয়বস্তুর খুঁটিনাটি ও বৈচিত্র্য লইয়া আলোচনার সময় আমাদের নাই। একটি বৈদেশিক জাতির সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনাদের হৃদয়ঙ্গম করাও সম্ভব নয়। ভারতবর্ষের যথার্থ স্বরূপ কিছুটা আপনাদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিব।
ভারতবর্ষ একটি ভগ্নস্তূপে পরিণত বিশাল অট্টালিকার মত। প্রথম দর্শনে কোন আশাই জাগে না। এ এক বিগতশ্রী বিধ্বস্ত জাতি। কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরিয়া লক্ষ্য করিলে এই রূপের পশ্চাতে ভারতের আর একটি সত্য দেখিতে পাইবেন। মানুষটি যে-আদর্শ ও মূলনীতির বহিঃপ্রকাশ, সে-আদর্শ ও মূলনীতি যতদিন ব্যাহত বা বিনষ্ট না হয়, ততদিন মানুষটি বাঁচিয়া থাকে, ততদিন তাহার আশা আছে। আপনার পরিধানের জামা কুড়িবার চুরি হইয়া গেলেও তাহা আপনার মৃত্যুর কারণ হয় না। আর একটি নূতন জামা আনিতে পারিবেন। জামা এ-ক্ষেত্রে অপ্রধান। ধনবানের ধনরাশি অপহৃত হইলে তাহার প্রাণশক্তি অপহৃত হয় না। মানুষটি বাঁচিয়া থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিলে কি দেখিতে পাই, তাহা পরে বলিতেছি।
এ কথা সত্য যে, ভারতবর্ষ এখন আর একটি রাজনৈতিক শক্তি নয়, ভারতবর্ষ দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটি জাতি। নিজেদের শাসনকার্যে ভারতবাসীর কোন হাত নাই। ত্রিশকোটি পরাধীন দাস ভিন্ন ভারতবাসী আর কিছুই নয়। ভারতবাসীর জনপ্রতি মাসিক আয় গড়ে দুই শিলিং মাত্র। জনসাধারণের অধিকাংশের পক্ষে উপবাসই স্বাভাবিক অবস্থা। ফলে আয়ের বিন্দুমাত্র স্বল্পতা ঘটিলে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সামান্য দুর্ভিক্ষের অর্থ বহু লোকের মৃত্যু। এই দিক্ দিয়া দেখিলে শুধু ধ্বংসস্তূপ—আশাহীন ধ্বংসাবশেষই দেখিতে পাই।
কিন্তু আমরা জানি, ভারতবাসী কখনও ধনসম্পদের চেষ্টা করে নাই। পৃথিবীর যে- কোন জাতি অপেক্ষা বিপুলতর অর্থসম্পদের অধিকারী হইয়াও ভারতবাসী কোন দিন অর্থের জন্য লালায়িত হয় নাই। যুগ যুগ ধরিয়া ভারতবর্ষ এক শক্তিমান্ জাতি ছিল, কিন্তু তাহার কখনও ক্ষমতার লোভ ছিল না। অন্য জাতিকে জয় করিবার জন্য ভারতবাসী কখনও বাহিরে যায় নাই। নিজেদের সীমার মধ্যেই তাহারা সন্তুষ্ট ছিল, বাহিরের সহিত বিবাদে রত হয় নাই। ভারতীয় জাতি কখনও সাম্রাজ্য-লাভের আকাঙ্ক্ষা করে নাই। পরাক্রম ও সম্পদ এ-জাতির আদর্শ ছিল না।
তবে? ভারতবাসী ভুল করিয়াছিল কি ঠিক পথে চলিয়াছিল, তাহা এখানে আলোচ্য নয়। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে এই একটি জাতিই গভীরভাবে বিশ্বাস করিত—এই জীবনই একমাত্র সত্য নয়। ঈশ্বরই সত্য। সুখে দুঃখে তিনিই তাহার আশ্রয়স্থল। ভারতবর্ষের অধঃপতনকালে এইজন্যই সর্বপ্রথম ধর্মের অবনতি ঘটিয়াছিল। হিন্দুগণ ধর্মের ভাবে পানাহার করে, ধর্মের ভাবে নিদ্রা যায়, ধর্মের ভাবে বিচরণ করে, ধর্মের ভাবে বিবাহাদি করে, ধর্মের ভাবে দস্যুবৃত্তি করে।
আপনারা কি কখনও এমন দেশ দেখিয়াছেন? সেখানে যদি আপনি দস্যুদল গঠন করিতে চান, তবে দলের নেতাকে কোনরূপ ধর্ম প্রচার করিতে হইবে, তারপর কতকগুলি অসার দার্শনিকতত্ত্ব সূত্রাকারে প্রকাশ করিয়া বলিতে হইবে, ‘এই দস্যুবৃত্তিই ভগবান্-লাভের সবচেয়ে সুগম ও সহজ পন্থা’। তবেই নেতা তাহার দল গঠন করিতে পারিবে। অন্যথা নয়। ইহাতেই প্রতিপন্ন হয়, এ-জাতির লক্ষ্য ও প্রাণশক্তি—ধর্ম। এই ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ হয় নাই বলিয়াই জাতি এখনও বাঁচিয়া আছে।
রোমের কথা মনে করুন। রোমের জাতীয় লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠা ও উহার বিস্তার। যে মুহূর্তে এই সাম্রজ্যবাদে বাধা পড়িল, অমনি রোম চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া ধ্বংস হইল। গ্রীসের আদর্শ ছিল বুদ্ধিবৃত্তি। যে মুহূর্তে বুদ্ধির ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিল, গ্রীসও অতীতের গর্ভে বিলীন হইয়া গেল। ঠিক এই অবস্থাই বর্তমান কালের স্পেন ও অন্যান্য নবীন দেশগুলির হইয়াছে। প্রত্যেক জাতিরই এ পৃথিবীতে একটি উদ্দেশ্য ও আদর্শ থাকে। যতক্ষণ এই লক্ষ্যটির উপর কোন আঘাত না আসে ততক্ষণ বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও জাতি বাঁচিয়া থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই আদর্শটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে ঐ জাতিরও মৃত্যু ঘটে।
ভারতে সেই প্রাণশক্তি আজিও অব্যাহত। এই শক্তি ভারতবাসী কখনও ত্যাগ করে নাই। ভারতীয়দের সর্বপ্রকার কুসংস্কার সত্ত্বেও এই প্রাণশক্তি আজিও জাতির জীবনে সমভাবে প্রবাহিত। অতি ভয়ানক ঘৃণ্য কুসংস্কারসকল ভারতবর্ষে বর্তমান। তাহাতে কিছুই আসে যায় না। জাতির জীবনপ্রবাহ ও জীবনোদ্দেশ্য আজিও তেমনই আছে।
ভারতবাসীরা কোনকালেই একটি শক্তিশালী বিজয়ী জাতি হইতে পারিবে না। কোনদিন তাহারা রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হইবে না। এ-কাজ তাহাদের নয়। বিশ্বসভায় ইহা ভারতবর্ষের ভূমিকা নয়। ভারতের ভূমিকা কি? ভারতবর্ষের আদর্শ—ভগবান্, একমাত্র ভগবান্। যতদিন ভারতবর্ষ মৃত্যুপণ করিয়াও ভগবানকে ধরিয়া থাকিবে, ততদিন তাহার আশা আছে।
অতএব বিশ্লেষণান্তে আপনার সিদ্ধান্ত হইবে, বাহিরের এই দুঃখ-দারিদ্র্য অকিঞ্চিৎকর, ইহা অন্তরের মানুষটিকে মারিতে পারে নাই; সে মানুষটি আজিও বাঁচিয়া আছে, এখনও তাহার আশা আছে।
দেখিতে পাইবেন, সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়িয়া ধর্মবিষয়ক কার্যধারা চলিয়াছে। এমন একটি বৎসর আমার মনে পড়ে না—যে-বৎসর কয়েকটি নূতন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় নাই। স্রোত যত তীব্র হয়, ততই উহাতে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হইতে থাকে। সম্প্রদায়সমূহ অবনতির লক্ষণ নয়—জীবনের পরিচায়ক। সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরও বাড়িতে থাকুক। এমন দিন আসুক, যখন প্রত্যেক মানুষ এক একটি সম্প্রদায় হইয়া দাঁড়াইবে। সম্প্রদায় লইয়া কলহের কোন কারণ নাই।
এখন আপনারা নিজেদের দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। আমি কোনরূপ সমালোচনা করিতেছি না। এদেশের সামাজিক বিধিবিধান, রাজনৈতিক সংগঠন প্রভৃতি সব কিছুই ইহজীবনের যাত্রাপথ সুগম করিবার জন্য রচিত হইয়াছে। মানুষ যতদিন বাঁচিয়া থাকে, ততদিন খুব সুখে থাকিতে পারে। আপনাদের রাস্তাঘাটের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন—কি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন! কি সুন্দর সব শহর! কত উপায়েই না মানুষ অর্থোপার্জন করিতে পারে! জীবনের সুখ-সম্ভোগের কত পথ! কিন্তু যদি কেহ এখানে বলে, ‘আমি কোন কাজ করিতে চাই না, শুধু ঐ বৃক্ষতলে বসিয়া ধ্যান করিব’, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে জেলে যাইতে হইবে। কোন সুযোগই তাহাকে দেওয়া হইবে না—কোন সুযোগই নয়। সকলের সহিত তাল মিলাইয়া চলিলেই এ-সমাজে মানুষের বাঁচিয়া থাকা সম্ভব। ইহলৌকিক সুখসম্ভোগের মত্ততায় তাহাকে যোগ দিতে হইবে, অন্যথা মৃত্যু অনিবার্য।
ভারতবর্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। সেখানে যদি কেহ বলে, ‘পর্বতশিখরে ধ্যানাসনে বসিয়া নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া আমি আমার অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করিব’, সকলেই তাহাকে বলিবে, ‘যাও, ঈশ্বর তোমার সহায় হউন’। একটি কথাও তাহাকে বলিতে হইবে না। কেহ তাহাকে একখণ্ড পরিধেয় বস্ত্র দিবে, অনায়াসে তাহার অভাবপূরণ হইবে। কিন্তু যদি কেহ বলে, ‘এ-জীবনটা আমি একটু উপভোগ করিতে চাই’, অমনি সমস্ত দরজা তাহার নিকট বন্ধ হইয়া যাইবে।
আমি বলি, উভয় দেশের ধারণাই অযৌক্তিক। এদেশে যদি কেহ স্থির আসনে বসিয়া নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে চায়, তবে কেন সে সুযোগ পাইবে না, তাহা বুঝিতে পারি না। অধিকাংশ লোকে যাহা করে, প্রত্যেকের পক্ষেই এখানে কেন তাহাই কর্তব্য হইবে? আমি ইহার কোন কারণ দেখিতে পাই না। আবার ভারতবর্ষে কোন ব্যক্তি কেন ইহজীবনে সুখ-সম্ভোগ ও অর্থোপার্জন করিবে না, তাহারও কারণ খুঁজিয়া পাই না। কিন্তু দেখুন, জোর করিয়া কোটি কোটি লোককে তাহাদের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে। ইহা ঋষিমুনিদের অত্যাচার। এ-অত্যাচার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের, মনীষীদের, এ-অত্যাচার অধ্যাত্মবাদীর, জ্ঞানী পুরুষের। আর মনে রাখিবেন, অজ্ঞ-জনের অত্যাচার অপেক্ষা জ্ঞানবানের অত্যাচার অনেক বেশী শক্তিশালী। নিজেদের মত অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার জন্য জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা সহস্র বিধিনিষেধের প্রচলন করিয়াছেন। যে-সকল বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা অজ্ঞ-জনের সাধ্য নয়।
আমি বলি, এ অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। একজন আধ্যাত্মিক মহামানব সৃষ্টি করিবার জন্য কোটি কোটি মানুষকে বলি দিয়া লাভ নাই। যদি এমন কোন সমাজ গঠন করা সম্ভব হয়, যেখানে আধ্যাত্মিক মহামানবেরও আবির্ভাব হইবে, সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অন্যান্য সকলেও সুখে থাকিবে, ভাল কথা; কিন্তু যদি কোটি কোটি মানুষকে নিষ্পেষিত করিয়া একজন আধ্যাত্মিক মহামানব সৃষ্টি করিতে হয়, তাহা অন্যায়। বরং বিশ্ব-মানবের মুক্তির জন্য একজন মহাপুরুষের দুঃখভোগ শ্রেয়।
প্রত্যেক জাতির মধ্যে আপনাকে সেই জাতির বিশিষ্ট পন্থা অনুযায়ী কাজ করিতে হইবে। প্রত্যেক ব্যক্তির সহিত সেই ব্যক্তির নিজস্ব ভাষায় কথা বলিতে হইবে। ইংলণ্ড বা আমেরিকায় যদি ধর্মপ্রচার করিতে যান, তাহা হইলে রাজনৈতিক পন্থা অনুসারে আপনাকে কাজ করিতে হইবে। সেখানে পাশ্চাত্য রীতি অনুযায়ী ভোট-ব্যালট, প্রেসিডেণ্ট-নির্বাচন প্রভৃতি দ্বারা সংস্থা ও সমিতি গঠন করিতে হইবে, কারণ উহাই পাশ্চাত্যজাতির ভাষা ও রীতি। পক্ষান্তরে আপনি যদি ভারতবর্ষে রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু বলিতে চান, তাহা হইলে আপনাকে ধর্মের ভাষায় কথা বলিতে হইবে। অনেকটা এইভাবে বলিতে হইবেঃ যে-ব্যক্তি প্রত্যহ প্রাতে তাহার গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করিয়া রাখে, তাহার অশেষ পুণ্য হইবে, সে স্বর্গে যাইবে অথবা ঈশ্বর লাভ করিবে। ঐভাবে না বলিলে তাহারা শুনিবে না। এ শুধু ভাষার ব্যাপার। বিষয়বস্তু কিন্তু একই। কিন্তু কোন জাতির হৃদয়ে প্রবেশ করিতে হইলে আপনাকে সেই জাতির ভাষায় কথা বলিতে হইবে। কথাটি খুবই ন্যায়সঙ্গত—এ-বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করা আমাদের উচিত নয়।
আমি যে-সম্প্রদায়ভুক্ত, তাহাকে বলা হয় সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়। ‘সন্ন্যাসী’ শব্দের অর্থ ‘যে-ব্যক্তি সম্যকরূপে ত্যাগ করিয়াছে।’ ইহা অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। যীশুর জন্মের ৫৬০ বৎসর পূর্বে বুদ্ধও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁহার সম্প্রদায়ের অন্যতম সংস্কারক মাত্র। এত প্রাচীন এই সম্প্রদায়! পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদেও আপনি সন্ন্যাসীর উল্লেখ পাইবেন। প্রাচীন ভারতে নিয়ম ছিল যে, প্রত্যেক নরনারীকে শেষ জীবনে সমাজ হইতে বিদায় লইয়া একমাত্র স্বীয় মুক্তি ও ভগবৎ-চিন্তায় মনোনিবেশ করিতে হইবে। ইহা ছিল চরম ঘটনা—মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি বিশেষ। সুতরাং প্রাচীনকালে বৃদ্ধগণ সন্ন্যাস অবলম্বন করিতেন। পরবর্তী কালে তরুণ যুবকগণ সংসার ত্যাগ করিতে লাগিল। যুবকগণ কর্মঠ। বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া সর্বক্ষণ মৃত্যুচিন্তা করা তাহাদের পক্ষে অসম্ভব, সুতরাং তাহারা ধর্মপ্রচার, বিভিন্ন সম্প্রদায়-গঠন প্রভৃতি কার্যে ব্রতী হইল। এইরূপে যুবক বুদ্ধ তাঁহার মহান্ সংস্কারকার্য আরম্ভ করেন। তিনি যদি বৃদ্ধ হইতেন, তবে অবশ্যই নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়াই নীরবে নির্বাণ লাভ করিতেন।
সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় বলিতে ‘চার্চ’ বুঝায় না এবং সেই সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা পুরোহিত নন। পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। ভারতবর্ষে সমাজিক জীবনের অন্যান্য কাজের মত পুরোহিত-বৃত্তিও একটি জন্মগত পেশা। সূত্রধরের পুত্র যেমন সূত্রধর হয়, কর্মকারের পুত্র যেমন কর্মকার হয়, ঠিক সেইভাবে পুরোহিতের সন্তানও পুরোহিত হয়। পুরোহিতকে বিবাহ করিতে হয়। অবিবাহিতকে হিন্দুরা অসম্পূর্ণ মনে করে। তাই ধর্মগত আচার-অনুষ্ঠানে অবিবাহিতের অধিকার নাই।
সন্ন্যাসীদের সম্পত্তি থাকে না, তাঁহারা বিবাহ করেন না। তাঁহাদের কোন সংস্থা নাই। তাঁহাদের একমাত্র বন্ধন গুরুশিষ্যের বন্ধন। এই বন্ধনটি ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য। শুধু শিক্ষাদানের জন্য যিনি আসেন এবং সেই শিক্ষার জন্য কিছু মূল্যদান করিয়াই যাঁহার সহিত সম্বন্ধ চুকিয়া যায়, তিনি প্রকৃত শিক্ষক নন। ভারতবর্ষে ইহা সত্যসত্যই দত্তক গ্রহণের মত। শিক্ষাদাতা গুরু আমার পিতার অধিক, আমি তাঁহার সন্তান—সব দিক্ দিয়া আমি তাঁহার সন্তান। সর্বাগ্রে—পিতারও অগ্রে তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিব এবং তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিব; কারণ ভারতবাসীরা বলে, পিতা আমার জন্মদান করিয়াছেন, কিন্তু গুরু আমাকে মুক্তির পথ দেখাইয়াছেন, সুতরাং গুরু পিতা অপেক্ষা মহত্তর। আজীবন আমরা গুরুর প্রতি এই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পোষণ করি। গুরু-শিষ্যের মধ্যে এই সম্বন্ধই বর্তমান। আমি আমার শিষ্যদিগকে দত্তকরূপে গ্রহণ করি। অনেক সময় গুরু হয়তো তরুণ, শিষ্য বয়োবৃদ্ধ। তাহাতে কিছু আসে যায় না। শিষ্য সন্তান, সে আমাকে ‘পিতা’ বলিয়া সম্বোধন করিবে; আমাকেও তাহাকে পুত্র বা কন্যারূপে সম্বোধন করিতে হইবে।
এক বৃদ্ধকে আমি গুরুরূপে পাইয়াছিলাম, তিনি এক অদ্ভুত লোক। পাণ্ডিত্য তাঁহার কিছুই ছিল না, পড়াশুনাও বিশেষ করেন নাই। কিন্তু শৈশব হইতেই সত্যের প্রত্যক্ষানুভূতি লাভ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁহার মনে জাগিয়াছিল। স্বধর্ম-চর্চার মধ্য দিয়া তাঁহার সাধনার আরম্ভ। পরে তিনি অন্যান্য ধর্মমতের মধ্য দিয়া সত্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় একের পর এক সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ে যোগদান করিলেন। কিছুকাল তিনি সম্প্রদায়গুলির নির্দেশ অনুযায়ী সাধন করিতেন, সেই সেই সম্প্রদায়ের ভক্তদের সহিত বাস করিয়া তাহাদের ভাবাদর্শে তন্ময় হইয়া যাইতেন। কয়েক বৎসর পর আবার তিনি অন্য এক সম্প্রদায়ে যাইতেন। এইভাবে সকল সাধনার অন্তে তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন—সব মতই ভাল। কোন ধর্মমতেরই তিনি সমালোচনা করিতেন না; তিনি বলিতেন, বিভিন্ন ধর্মমতগুলি একই সত্যে পৌঁছিবার বিভিন্ন পথ মাত্র। আর তিনি বলিতেনঃ এতগুলি পথ থাকা তো খুবই গৌরবের বিষয়, কারণ, ঈশ্বরলাভের পথ যদি একটিমাত্র হইত, তবে হয়তো উহা একজন ব্যক্তির পক্ষেই উপযোগী হইত। পথের সংখ্যা যত বেশী থাকিবে, ততই আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে সত্যলাভের সুযোগ ঘটিবে। যদি এক ভাষায় শিখিতে না পারি, তবে আর এক ভাষায় শিখিবার চেষ্টা করিব, সকল ধর্মমতের প্রতি তাঁহার এমনই শ্রদ্ধা ছিল।
যে-সকল ভাব আমি প্রচার করিতেছি, সেগুলি তাঁহার চিন্তারাশিরই প্রতিধ্বনি মাত্র। ইহাদের একটিও আমার নিজস্ব নয় শুধু মন্দগুলি ছাড়া। আমার উক্তির মধ্যে যাহা মিথ্যা ও মন্দ, সেইগুলিই আমার। সত্য ও কল্যাণকর যে-সকল কথা আমি উচ্চারণ করিয়াছি, সবই তাঁহার বাণীর প্রতিধ্বনিমাত্র। আপনাদিগকে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার রচিত তাঁহার জীবনচরিত১পড়িয়া দেখিতে বলি।
তাঁহারই চরণপ্রান্তে কয়েকজন যুবকের সহিত একত্র আমি এই ভাবধারা লাভ করিয়াছি। তখন আমি বালকমাত্র। প্রায় ষোল বৎসর বয়সে আমি তাঁহার নিকট গিয়াছিলাম। অন্যান্য সঙ্গীদের কেহ আরও ছোট, কেহ বা একটু বড়। সবসুদ্ধ বার জন বা কিছু বেশী হইবে। সকলে মিলিয়া এই আর্দশ-প্রচারের কথা ভাবিলাম। শুধু প্রচার নয়, এই আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করিতে চাহিলাম। ইহার অর্থ—আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়া হিন্দুর আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধের করুণা, খ্রীষ্টানের কর্মপ্রবণতা ও ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ফুটাইয়া তোলা। প্রতিজ্ঞা করিলাম, ‘এই মুহূর্তেই আমরা একটি বিশ্বজনীন ধর্ম প্রবর্তন করিব; আর বিলম্ব নয়।’
আমাদের বৃদ্ধ গুরুদেব কখনও মুদ্রা স্পর্শ করিতেন না। সামান্য খাদ্য, বস্ত্র যাহা প্রয়োজনীয়, তাহাই তিনি গ্রহণ করিতেন, বেশী কিছু নয়। অন্য কোনরূপ দান তাঁহাকে নেওয়ান যাইত না। আশ্চর্য আধ্যাত্মিক ভাবরাশির সহিত এই নির্বিণ্ণতার ফলে তাঁহার কোনরূপ বন্ধন ছিল না। ভারতীয় সন্ন্যাসী আজ হয়তো রাজবন্ধু, রাজ-অতিথি—কাল তিনি ভিখারী, বৃক্ষতলশায়ী। সকলের সংস্পর্শে তাঁহাকে আসিতে হইবে। সর্বদা তাঁহাকে পরিভ্রমণ করিতে হইবে। প্রবাদ আছে, ‘গড়ান পাথরে শেওলা জমে না।’ গত চৌদ্দ বৎসরকাল আমি কোন স্থানে তিন মাসের বেশী থাকি নাই—সর্বদা ঘুরিয়াছি। আমরা সকলেই ঐরূপ করিয়া থাকি।
মুষ্টিমেয় ঐ কয়টি বালক এই মহান্ ভাবধারার প্রেরণায় নিজেদের জীবন গড়িয়া তুলিতে লাগিল। সর্বজনীন ধর্ম, দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি প্রভৃতি তত্ত্বের দিক্ দিয়া খুবই ভাল—কিন্তু কাজে এগুলি ফুটাইয়া তোলা চাই।
তারপর একদিন গুরুদেবের প্রয়াণকাল উপস্থিত হইল। সকলে মিলিয়া যথাসাধ্য তাঁহার সেবা করিলাম। আমাদের বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেহ ছিল না। এই সব অদ্ভুত ধারণা-পোষণকারী তরুণদের কথা কে-ই বা শুনিবে? অন্ততঃ ভারতবর্ষে তরুণেরা তো কিছুই নয়। একবার ভাবিয়া দেখুন, বারটি বালক মানুষের কাছে বড় বড় আদর্শের কথা বলিতেছে, সেই আদর্শ জীবনে পরিণত করিতে দৃঢ়সংকল্প। সকলেই হাসিত। হাসি হইতে ক্রমে গুরুতর বিষয়ে পরিণতি ঘটিত। রীতিমত অত্যাচার আরম্ভ হইল। ঠাট্টা-বিদ্রূপ যতই প্রবল হইয়া উঠিল, আমরাও তত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলাম।
তারপর আসিল দারুণ দুঃসময়—ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে এবং অন্যান্য ভ্রাতাদের পক্ষেও। কিন্তু আমার পক্ষে সে কি নিদারুণ দুর্ভাগ্য। একদিকে মা ও ভাইয়েরা। পিতার মৃত্যুতে আমরা তখন চরম দারিদ্র্যে উপনীত। বেশীর ভাগ দিন না খাইয়া থাকিতে হইত। পরিবারের একমাত্র আমিই আশা-ভরসা—সাহায্য করিবার উপযুক্ত ছিলাম। আমার সম্মুখে তখন দুইটি জগৎ। একদিকে মাতা ও ভ্রাতাদিগকে না খাইয়া মরিতে দেখিতে হইবে; অপর দিকে বিশ্বাস করিতাম যে, গুরুদেবের ভাবধারা ভারতের তথা জগতের পক্ষে কল্যাণকর, সুতরাং এই আদর্শ জগতে প্রচার করিয়া কার্যে পরিণত করিতেই হইবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই দ্বন্দ্ব চলিল। কখনও কখনও পাঁচ ছয় দিন ধরিয়া অবিরত প্রার্থনা করিতাম। সে কি হৃদয়-বেদনা! আমি তখন দারুণ যন্ত্রণা অনুভব করিতেছিলাম! তরুণ হৃদয়ের স্বাভাবিক স্নেহ আত্মীয়গণের দিকে টানিতেছে—অতি প্রিয়জনদের দুরবস্থা সহ্য করিতে পারিতেছি না। অপর পক্ষে সহানুভূতি জানাইবার একটি লোকও নাই। বালকের কল্পনার প্রতি কে সহানুভূতি দেখাইবে? যে কল্পনার জন্য অপরকে এত কষ্ট পাইতে হয়, সেই কল্পনার প্রতি কাহারই বা সহানুভূতি জাগিতে পারে? একজন ছাড়া কেহই সহানুভূতি জানাইল না।
সেই একজনের সহানুভূতিই আশা ও আশীর্বাদ বহন করিয়া আনিল। তিনি এক নারী। আমাদের মহাযোগী গুরুদেব তাঁহাকে অতি অল্প বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন। পতি যৌবনে ধর্মোন্মাদনায় মগ্ন থাকাকালে একবার পত্নী তাঁহার সহিত দেখা করেন। অতিশৈশবে বিবাহ হইলেও বড় না হওয়া অবধি পত্নী স্বামীকে বিশেষ দেখিতে পান নাই। পরবর্তী কালে পত্নীর সহিত দেখা হইলে পতি বলিলেন, ‘দেখ, আমি তোমার স্বামী। এই দেহের উপর তোমার দাবী আছে। কিন্তু বিবাহিত হইলেও যৌন-জীবন যাপন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এ বিষয়ে বিচারের ভার তোমাকেই দিলাম।’ পত্নী সাশ্রুনয়নে বলিলেন, ‘ভগবান্ তোমার সহায় হউন, তোমায় আশীর্বাদ করুন। আমি কি তোমাকে অধঃপাতে লইয়া যাইব? যদি পারি, তোমাকে সাহায্যই করিব। তুমি তোমার সাধনা লইয়া থাক।’
সেই নারী এরূপ প্রকৃতির ছিলেন। সাধনায় মগ্ন হইয়া স্বামী ক্রমে নিজের ভাবে সন্ন্যাসী হইয়া গেলেন। দূর হইতে পত্নী যথাশক্তি সাহায্য করিতে লাগিলেন। স্বামী যখন অধ্যাত্ম-জগতে এক বিরাট পুরুষ হইয়া দাঁড়াইলেন, স্ত্রী ফিরিয়া আসিলেন। বলিতে গেলে তিনিই তাঁহার প্রথম শিষ্যা। অবশিষ্ট জীবন তিনি স্বামীর সেবায় অতিবাহিত করিলেন। বাঁচিয়া আছেন, কি মরিয়া গিয়াছেন—ঐ লোকোত্তর মহাপুরুষের সে খেয়াল ছিল না। কথা বলিতে বলিতে তিনি এত তন্ময় হইয়া যাইতেন যে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর বসিলেও তাঁহার হুঁশ হইত না। জ্বলন্ত অঙ্গার! সদাসর্বদা তিনি ছিলেন এমনই দেহজ্ঞান-রহিত।
সেই নারী তাঁহারই সহধর্মিণী, তিনি ঐ বালকদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করিতেন; কিন্তু তাঁহার কোন শক্তি ছিল না। আমাদের অপেক্ষা তিনি দরিদ্র ছিলেন। যাহা হউক আমরা সংগ্রামে ঝাঁপ দিলাম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করিতাম যে, এই ভাবধারা একদিন সমগ্র ভারতবর্ষকে যুক্তিপরায়ণ করিয়া তুলিবে এবং নানা দেশ এবং নানা জাতির কল্যাণসাধন করিবে। এই বিশ্বাস হইতেই স্থির প্রতীতি জন্মিল যে, এই ভাবরাশি নষ্ট হওয়া অপেক্ষা কয়েক জন লোকের দুঃখ-বরণ করা ভাল। একজন মা ও দুইটি ভাই যদি মরে, কি আসে যায়? এও তো ত্যাগ। ত্যাগ কর—ত্যাগ ছাড়া কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না। বক্ষ চিরিয়া হৃৎপিণ্ড বাহির করিতে হইবে এবং সেই রক্তসিক্ত হৃদয় বেদীমূলে উৎসর্গ দিতে হইবে। তবেই তো মহৎ কার্য সাধিত হয়। অন্য কোন পথ আছে কি? কেহই সেই পথ আবিষ্কার করিতে পারে নাই। আপনাদের মধ্যে যে-কেহ কোন মহৎ কার্য সাধন করিয়াছেন, তাঁহাকেই ভাবিয়া দেখিতে বলি। সে কী বিরাট মূল্য! সে কী বেদনা! কী নিদারুণ যন্ত্রণা! প্রত্যেকের জীবনে প্রতিটি সফলতার পিছনে কী ভয়ানক দুঃখভোগ থাকে, তাহা তো আপনাদের সকলেরই জানা আছে।
এইভাবেই আমাদের সেই তরুণ দলটির দিন কাটিতে লাগিল। চারিপাশের সকলের নিকটে অপমান ও লাঞ্ছনাই পাইলাম। অবশ্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া অন্ন সংগ্রহ করিতে হইত। এখানে ওখানে দু-এক টুকরা রুটি মিলিত। একটি অতি পুরাতন ভগ্নপ্রায় বাড়ী বাসস্থান হিসাবে জুটিল, উহার তলায় গোখুরা সাপের বাসা, তাহাদের ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যাইত। অল্প ভাড়ায় বাড়ী পাওয়ায় আমরা সেই গৃহে গিয়া বাস করিতে লাগিলাম।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইল। ইতোমধ্যে ভারতের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিলাম। উদ্দেশ্য—ক্রমশঃ এই ভাবধারা প্রচারের চেষ্টা। দশ বৎসর কাটিয়া গেল—কোন আলোকরেখাই দেখিতে পাইলাম না! দশটি বৎসর! সহস্রবার হতাশা আসিল; কিন্তু একটি জিনিষ আমাদের সর্বদা আশান্বিত করিয়া রাখিয়াছিল—সেটি হইল আমাদের পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও গভীর ভালবাসা। প্রায় একশত নরনারী আমার চারিপাশে রহিয়াছে; কাল যদি আমি সাক্ষাৎ শয়তান হইয়া যাই, তাহারা বলিবে, ‘আমরা এখনও আছি! আমরা তোমাকে কখনই ত্যাগ করিব না!’ এই ভালবাসাই পরম আশীর্বাদ।
সুখে দুঃখে, দুর্ভিক্ষে যাতনায়, শ্মশানে, স্বর্গে বা নরকে যে আমাকে কখনই ত্যাগ করে না, সে-ই তো বন্ধু। এ বন্ধুত্ব কি তামাসা? এমন বন্ধুত্বের দ্বারা মোক্ষ-লাভও সম্ভব। আমরা যদি এমনভাবে ভালবাসিতে পারি, তবে এই ভালবাসাই আমাদের মুক্তি আনিয়া দিবে। এই বিশ্বস্ততার মধ্যেই একাগ্রতার সার নিহিত। যদি তোমার সেই বিশ্বাস, সেই শক্তি, সেই ভালবাসা থাকে, তবে জগতে তোমার কোন দেবার্চনার প্রয়োজন নাই। সেই দুঃখের দিনে এই ভালবাসাই আমাদের হৃদয়ে সদা জাগ্রত ছিল। সেই ভালবাসাই আমাদিগকে হিমালয় হইতে কন্যাকুমারিকা এবং সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত পরিচালিত করিয়াছিল।
সেই তরুণদলটি এইভাবে সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। ধীরে ধীরে আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে লাগিলাম। শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধাচরণ পাইলাম, সাহায্য আসিল অতি অল্পক্ষেত্রে। কারণ একটি দোষ আমাদের ছিল—আমরা ছিলাম দুঃখদারিদ্র্যে রুক্ষচিত্ত। জীবনে যাহাকে নিজের পথ নিজেই করিয়া লইতে হয়, সে একটু রুক্ষ হয়; শান্ত কোমল ও ভদ্র হইবার—‘ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়া’ ইত্যাদি বলিবার বেশী সময় তাহার থাকে না। নিজেদের জীবনেই আপনারা উহা সর্বদা লক্ষ্য করিয়াছেন। এইরূপ ব্যক্তি যেন একটি আধারে অযত্নরক্ষিত অমসৃণ হীরকখণ্ড।
আমরা ঠিক সেইরূপ ছিলাম। ‘কোন আপস চলিবে না।’—এই ছিল আমাদের মূলমন্ত্র। ‘ইহাই আদর্শ এবং এ আদর্শ কার্যে পরিণত করিতে হইবে। মরিয়াও—রাজার নিকট যেমন এ আদর্শ প্রচার করিব, চাষার নিকট তেমনি এ আদর্শ তুলিয়া ধরিব।’ স্বভাবতই আমরা বিরোধিতার সম্মুখীন হইলাম।
কিন্তু মনে রাখিবেন, ইহাই জীবনের অভিজ্ঞতা; যদি আপনি যথার্থই পরের মঙ্গল কামনা করেন, বিশ্বজগৎ আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াও কিছুই করিতে পারিবে না। আপনার শক্তির নিকট তাহারা পরাস্ত হইবেই। যদি আপনি আন্তরিক ও প্রকৃতই নিঃস্বার্থ হন, স্বয়ং ঈশ্বরের সমস্ত শক্তি আপনার মধ্যে জাগ্রত থাকিয়া সমস্ত বাধা বিপত্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করিবে। সেই বালকের দল এমনি ছিল। তাহারা ছিল প্রকৃতির হাত হইতে সদ্যোনিঃসৃত শিশুর মত পবিত্র; গুরুদেব বলিতেন, ‘ভগবানের বেদীমূলে আমি অনাঘ্রাত পুষ্প ও অস্পৃষ্ট ফলই নিবেদন করিতে চাই।’ মহাপুরুষের সেই বাণী আমাদিগকে সঞ্জীবিত করিত। কলিকাতার পথে তিনি যে-সব বালককে যেন কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন, তাহাদের ভবিষ্যৎ তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন। ‘এই ছেলেটি বা ঐ তরুণটি ভবিষ্যতে কী হয়, দেখিও’—তাঁহার এই ধরনের কথা শুনিয়া লোকে ঠাট্টা করিত। অবিচলিত বিশ্বাসে তিনি বলিতেন, ‘মা আমাকে ইহা দেখাইয়া দিয়াছেন। আমি নিজে দুর্বল হইতে পারি, কিন্তু মা যখন এরূপ বলিয়াছেন, তখন তাঁহার ভুল হওয়া কখনও সম্ভব নয়। এইরূপ হইবেই।’
দশটি বৎসর কোন আশার আলো ছাড়াই কাটিয়া গেল। ইতোমধ্যে আমার শরীর ভাঙিয়া পড়িতে লাগিল। কখনও রাত্রি নয়টায় একবেলা আহার কখনও ভোরে আটটায় একবেলা আহার, তাও আবার তিনদিন পরে—এবং সর্বদাই অতি সামান্য কদর্য অন্ন। পরিণামে শরীরের উপর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভিখারীকে কে-ই বা ভাল খাবার দেয়? আবার ভাল জিনিষ দিবার সামর্থ্যও ভারতবাসীর নাই। শুধু একবেলা আহারের জন্য বেশীর ভাগ সময় পায়ে হাঁটিয়া, তুষারশৃঙ্গ চড়াই করিয়া, কখনও দশ মাইল পথ দুর্গম পর্বত চড়াই করিয়া চলিয়াছি। ভারতবর্ষে রুটিতে খাম্বির দেয় না। কখনও কখনও এই খাম্বির-না-দেওয়া রুটি বিশ-ত্রিশদিন ধরিয়া সঞ্চিত রাখা হয়, তখন ইহা ইঁটের চেয়েও শক্ত হয়। ভিখারীকে সেই রুটির অংশ দেওয়া হয়। একবেলা আহারের বন্দোবস্ত করিবার জন্য আমাকে দ্বারে দ্বারে ফিরিতে হইত। তদুপরি এই ইঁটের মত শক্ত রুটি চিবাইতে গিয়া মুখ দিয়া রক্ত পড়িত। এই রুটি চিবাইতে সত্য সত্যই দাঁত ভাঙে। নদী হইতে জল আনিয়া একটি পাত্রে ঐ রুটি একটি পাত্রে ভিজাইয়া রাখিতাম। মাসের পর মাস ঐভাবে থাকিতে হইয়াছে—ফলে শরীর অবশ্যই খারাপ হইতেছিল।
তারপর ভাবিলাম, ভারতবর্ষে চেষ্টা করিয়াছি, এবার অন্য দেশে করা যাক। এমনি সময় আপনাদের ধর্ম-মহাসভার অধিবেশন হইবার কথা ছিল। ভারতবর্ষ হইতে একজনকে ঐ সভায় প্রেরণ করিতে হইবে। আমি তখন একজন ভবঘুরে। তবু বলিলাম, ‘ভারতবাসী তোমরা আমাকে প্রেরণ করিলে আমি যাইব। আমার কোন ক্ষতির ভয় নাই, ক্ষতি যদি হয় তাহাও গ্রাহ্য করি না।’ অর্থ সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। অনেক দিনের আপ্রাণ চেষ্টায় শুধু আসিবার খরচ যোগাড় হইল; এবং আমি এদেশে আসিলাম। ধর্ম-মহাসভার দুই-এক মাস পূর্বে আমি আসিলাম, এবং পরিচয়হীন অবস্থায় পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইলাম।
তারপর ধর্ম-মহাসভা আরম্ভ হইল, সেই সময় কতিপয় সহৃদয় বন্ধুর সহিত আলাপ হইলে তাঁহারা আমাকে খুবই সাহায্য করিলেন। কিছু কিছু অর্থ-সংগ্রহ, দুইটি পত্রিকা প্রকাশ প্রভৃতি যৎসামান্য কাজ আরম্ভ করিলাম। তারপর ইংলণ্ডে গেলাম। সেখানেও কাজ চলিল। সেই সময় আমেরিকায় থাকিয়াও ভারতের জন্য কাজ চালাইলাম।
ভারতের জন্য আমার পরিকল্পনা যেভাবে রূপ পাইয়াছে এবং কেন্দ্রীভূত হইয়াছে, তাহা এইঃ আমি আপনাদিগকে ভারতের সন্ন্যাসীদের কথা বলিয়াছি। কেমন করিয়া আমরা কোনরূপ মূল্য গ্রহণ না করিয়া অথবা একখণ্ড রুটির মূল্যে দ্বারে দ্বারে ধর্মপ্রচার করিয়া থাকি, তাহাও বলিয়াছি। সেইজন্যই ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের ব্যক্তিও ধর্মের মহত্তম ভাবরাশি ধারণ করে। এ সকলই এই সন্ন্যাসীদের কাজ। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা যায়—‘ইংরেজ কাহারা?’ সে উত্তর দিতে পারিবে না। হয়তো বলিবে, ‘পুঁথিতে যে-সব দৈত্যদানবের কথা আছে—ইংরেজরা তাহাদেরই বংশধর—তাই না?’ ‘তোমাদের শাসন- কর্তা কে?’ ‘জানি না।’ ‘শাসনতন্ত্র কি?’—তাহারা জানে না। কিন্তু দর্শনের মূলতত্ত্ব তাহারা জানে। যে ইহজগতে তাহারা দুঃখকষ্ট ভোগ করে, সেই জগৎ সম্বন্ধে তাহাদের ব্যবহারিক জ্ঞানেরই অভাব। এই সব লক্ষ লক্ষ মানুষ পরলোকের জন্য প্রস্তুত—এই কি যথেষ্ট? কখনই নয়। একটুকরা ভাল রুটি এবং একখণ্ড ভাল কম্বল তাহাদের প্রয়োজন। বড় প্রশ্ন এই, এ-সকল লক্ষ লক্ষ পতিত জনগণের জন্য সেই ভাল রুটি আর ভাল কম্বল কোথা হইতে মিলিবে?
প্রথমেই আপনাদিগকে বলিব, তাহাদের বিপুল সম্ভাবনা রহিয়াছে, কারণ পৃথিবীতে তাহারা সবচেয়ে শান্ত জাতি। তাহারা যে ভীরু, তা নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তাহারা অসুর-পরাক্রমে যুদ্ধ করে। ইংরেজের শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল ভারতীয় কৃষক-সম্প্রদায় হইতে সংগৃহীত। মৃত্যুকে তাহারা গ্রাহ্য করে না। তাহাদের মনোভাব এইঃ ‘এ জন্মের পূর্বে অন্তত বিশ বার মরিয়াছি, হয়তো তারপর আরও অসংখ্যবার মরিব। তাহাতে কী আসে যায়?’ তাহারা কখনও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে না। বিশেষ ভাবপ্রবণ না হইলেও যোদ্ধা হিসাবে তাহারা ভাল।
তাহাদের জন্মগত প্রবৃত্তি অবশ্য কৃষিকর্মে। আপনি তাহাদের সর্বস্ব কাড়িয়া লউন, তাহাদের হত্যা করুন, করভারে জর্জরিত করুন, যাহা ইচ্ছা করুন—যতক্ষণ তাহাদিগকে স্বাধীনভাবে ধর্ম আচরণ করিতে দিতেছেন, তাহারা শান্ত ও নম্র থাকিবে। তাহারা কখনও অন্যের ধর্মে হস্তক্ষেপ করে না। ‘আমাদের ভাবানুযায়ী ঈশ্বরের আরাধনা করিবার অধিকার আমাদের দাও আর সব কাড়িয়া লও’—ইহাই তাহাদের মনোভাব। ইংরেজরা যখনই ঐ জায়গায় হস্তক্ষেপ করে, অমনি গণ্ডগোল শুরু হয়। উহাই ১৮৫৭ খ্রীঃ সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ—ধর্ম লইয়া নির্যাতন ভারতবাসী সহ্য করিবে না। ভারতবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে গিয়াই বিশাল মুসলমান রাজ্যগুলি একেবারে ফাটিয়া বিলয় পাইল।
অধিকন্তু ভারতের জনসাধারণ শান্ত, নম্র, ভদ্র—সর্বোপরি তাহারা পাপাসক্ত নয়। কোনপ্রকার উত্তেজিত মাদকদ্রব্য প্রচলিত না থাকায় তাহারা অন্য যে কোন দেশের জনসাধারণ অপেক্ষা অনন্ত গুণে শ্রেষ্ঠ। এখানকার বস্তি-জীবনের সহিত তুলনা করিয়া আপনারা ভারতবর্ষের দরিদ্র জনসাধারণের সুন্দর নৈতিক জীবন বুঝিতে পারিবেন না। বস্তি মানেই দারিদ্র্য! কিন্তু ভারতবর্ষে দারিদ্র্যের অর্থ পাপ, অশ্লীলতা ও অপরাধ-প্রবণতা নয়। অন্যান্য দেশে এমন ব্যবস্থা যে, নোংরা ও অলস ব্যক্তিরাই দারিদ্র্য হয়! নগর-জীবন ও উহার বিলাসব্যসন চায়, এমন মূর্খ বা বদমাশ ব্যতীত আর কাহাকেও এ-সব দেশে দরিদ্র থাকিতে হয় না। তাহারা কিছুতেই গ্রামে যাইবে না। তাহারা বলে, ‘আমরা এই শহরেই বেশ ফূর্তিতে আছি। তোমরা অবশ্যই আমাদের আহার যোগাইবে।’ ভারতবর্ষের ব্যাপার এরূপ নয়, সেখানে গরীবেরা উদয়াস্ত খাটিয়া মরে, আর এক জন আসিয়া তাহাদের শ্রমের ফল কাড়িয়া লয়। তাহাদের সন্তানেরা উপবাসী থাকে। লক্ষ লক্ষ টন গম ভারতে উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও ক্বচিৎ কখনও একটি কণা কৃষকের মুখে যায়। আপনারা পশু-পক্ষীকেও যে শস্য খাওয়াইতে চান না, ভারতের কৃষক সেই শস্যে প্রাণধারণ করে।
এই পবিত্র সরল কৃষককূল কেন দুঃখভোগ করিবে? ভারতের নিমজ্জমান জনসাধারণ ও অবনমিত নারীসমাজের কথা আপনারা এত শুনিতে পান, কিন্তু কেহই তো আমাদের সাহায্য করিতে অগ্রসর হন না। অনেকে বলেনঃ ‘তোমরা যদি আমাদের নিজেদের স্বভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তন কর, তবেই তোমরা ভাল হইবে, তবেই তোমাদের সাহায্য করা চলে। হিন্দুদের সাহায্য করা বৃথা।’ কিন্তু ইঁহারা বিভিন্ন জাতির ইতিহাস জানেন না। ভারতবাসী যদি তাহাদের ধর্ম ও আনুষঙ্গিক রীতিনীতিগুলি পরিবর্তন করে, তবে আর ভারতবর্ষ থাকিবে না, কারণ ধর্মই ভারতবাসীর প্রাণশক্তি। ভারতীয় জাতিই লুপ্ত হইয়া গেলে আপনাদের সাহায্য গ্রহণ করিবার জন্য সেখানে আর কেহই থাকিবে না।
আর একটি মহৎ শিক্ষণীয় বিষয় আছে, বস্তুতঃ আপনারা কাহাকেও সাহায্য করিতে পারেন না। আমরা কে কাহার জন্য কি করিতে পারি? আপনি আপনার রীতি অনুসারে গড়িয়া উঠিতেছেন, আর আমি আমার ভাবে। সকল পথই শেষ পর্যন্ত রোমে আসিয়া মিলিত হয়—এ কথাটি মনে রাখিয়া আমি হয়তো আপনাদের জীবনে কিছুটা গতি সঞ্চার করিতে পারি। জাতীয় জীবন ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠে। এ পর্যন্ত কোন জাতিগত সভ্যতাই সম্পূর্ণ সার্থক হয় নাই। ঐ সভ্যতাকে কিছুটা আগাইয়া দাও, তবেই উহা স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছিবে। ঐ সভ্যতাকে আমূল পরিবর্তিত করিতে চেষ্টা করিবেন না। একটি জাতির প্রচলিত প্রথা, নিয়মকানুন, রীতিনীতি বাদ দিলে তাহার আর কী অবশিষ্ট থাকে? ঐগুলিই জাতিকে সংহত করিয়া রাখে।
কিন্তু অতি পণ্ডিত এক বিদেশী আসিয়া বলিলেন, ‘দেখ, তোমাদের সহস্র বৎসরের রীতিনীতি নিয়ম-কানুন ছাড়িয়া দিয়া আমার এই নিরেট পাত্রটি গ্রহণ কর।’—ইহা নিতান্ত মূর্খতা।
পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করিতে হইবে, কিন্তু এ-বিষয়ে আমাদের আর একটু অগ্রসর হইতে হইবে। সাহায্য করিতে গিয়া নিঃস্বার্থ হওয়ার প্রয়োজন। ‘আমি তোমাকে যেরূপ করিতে বলি, ঠিক সেরূপ করিলে তবে তোমায় সাহায্য করিব, নতুবা নয়।’—ইহার নাম কি সাহায্য?
অতএব হিন্দু যদি তোমাদিগকে আধ্যাত্মিক সাহায্য করিতে চায়, সে সাহায্যে নিয়ন্ত্রণের কোন প্রশ্ন থাকিবে না; সাহায্য—সেবা, পূর্ণ নিঃস্বার্থতা। আমি দিলাম, এখানেই উহা শেষ। আমার নিকট হইতে উহা চলিয়া গেল। আমার মন, আমার শক্তি, আমার যাহা কিছু দিবার আছে, সব দিয়াছি, দেওয়ার ভাব লইয়াই দিয়াছি, আর কিছু নয়। অনেক সময় দেখিয়াছি, যাহারা অর্ধেক পৃথিবী শোষণ করিয়া ফিরিয়াছে, তাহারাই ‘অসভ্য’ হিদেনদিগকে ধর্মান্তরিত করিবার কাজে কুড়ি হাজার ডলার দান করিয়াছে। কিসের জন্য? ঐ হিদেনদের উপকারের জন্য, না তাহাদের নিজেদের আত্মার পরিত্রাণের জন্য? একবার ভাবিয়া দেখুন দেখি।
পাপের সমুচিত ফল ফলিতেছে। আমরা মানুষেরা নিজের চক্ষুকেই ফাঁকি দিতে চাই। কিন্তু অন্তরের অন্তস্তলে স্ব-স্বরূপে তিনি সদা বিরাজিত। তিনি তো কোনদিন ভোলেন না। আমরা কোনদিনই তাঁহাকে প্রতারিত করিতে পারি না। তাঁহার চোখকে কখনই ফাঁকি দেওয়া যায় না। যথার্থ পরোপকারের প্রেরণা সহস্র বৎসর পরেও ফলবতী হয়। বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সুযোগ পাইলেই তাহা আবার বজ্রের মত ফাটিয়া পড়িতে চায়। আর যে ভাবাবেগের পশ্চাতে স্বার্থান্বেষী মনোবৃত্তি থাকে—সংবাদপত্রে শিরোনামার সমারোহ
এবং লক্ষ লক্ষ লোকের করতালি লাভ করিলেও উহার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবেই। আমি কোন প্রকার গর্ব করিয়া বলিতেছি না, কিন্তু মনে রাখিবেন—আমি আপনাদিগকে সেই মুষ্টিমেয় যুবকদের কথা বলিতেছি। আজ ভারতবর্ষে এমন একটি গ্রাম নাই, এমন নরনারী নাই, যাহারা তাহাদের কাজ জানে না এবং তাহাদিগকে আন্তরিক আশীর্বাদ করে না। এমন একটি দুর্ভিক্ষ নাই, যেখানে এই যুবকদল ঝাঁপাইয়া পড়িয়া যতগুলি মানুষকে পারে বাঁচাইবার চেষ্টা করে না। এই সেবা হৃদয়কে স্পর্শ করিবেই। দেশবাসী তাহাদের কথা জানিতে পারিয়াছে। যখনই সম্ভব, তাহাদের সাহায্য করুন, কিন্তু সেই সাহায্যের পিছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করিতেছে, লক্ষ্য রাখিবেন। স্বার্থপূর্ণ হইলে সেই দান দাতা বা গ্রহীতা—কাহারও উপকারে আসিবে না। সাহায্য যদি নিঃস্বার্থ হয়, তবে উহা গ্রহীতার পক্ষে কল্যাণকর হইবে, এবং লক্ষগুণ কল্যাণকর হইবে আপনার নিজের পক্ষে; আপনার জীবন যেমন সত্য, এ-কথা তেমনি নিশ্চিত সত্য, জানিবেন। জগদীশ্বরকে কখনও ফাঁকি দেওয়া যায় না। কর্মফলকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। সুতরাং আমার পরিকল্পনাগুলি ভারতের জনগণকে লক্ষ্য করিয়া। ধরুন, আপনি সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্যালয় স্থাপন করিতে শুরু করিলেন, তথাপি আপনি তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে পারিবেন না। কেমন করিয়া পারিবেন? চার বৎসরের একটি ছেলে বরং লাঙ্গল ধরিবে, অথবা অন্য কোন কাজ করিবে, তবু সে আপনার বিদ্যালয়ে পড়িতে যাইবে না। তাহার পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া অসম্ভব। আত্মরক্ষাই মানুষের প্রথম প্রেরণা। কিন্তু যদি পর্বত মহম্মদের কাছে না আসে, মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে। আমি বলি, শিক্ষা কেন দ্বারে দ্বারে যাইবে না? চাষার ছেলে যদি বিদ্যালয়ে আসিতে না পারে, তাহা হইলে কৃষিক্ষেত্রে অথবা কারখানায়—যেখানে সে আছে, সেখানেই তাহাকে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। ছায়ার মত তাহার সঙ্গে সঙ্গে যাও। শত সহস্র সন্ন্যাসী জনসাধারণকে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিদ্যা দান করিতেছেন; কেন এই সন্ন্যাসীরাই জাগতিক ক্ষেত্রেও বিদ্যাবুদ্ধি বিতরণ করিবেন না? জনসাধারণের কাছে তাঁহারা ইতিহাস বা অন্যান্য বহু বিষয়ের কথা বলিবেন না কেন? শ্রবণের মাধ্যমেই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা লাভ হয়। যে শিক্ষা আমরা মায়েদের কাছ হইতে কানে শুনিয়া লাভ করিয়াছি, উহাই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। গ্রন্থাদি অনেক পরে দেখা দিয়াছে। পুঁথিগত বিদ্যা কিছুই নয়। কানে শুনিয়া আমরাই চরিত্র-গঠনকারী শ্রেষ্ঠ নীতিসমূহ পাই। তারপর জনসাধারণের আগ্রহ যখন বাড়িবে, তখন তাহারা আপনাদের বইও পড়িবে। প্রথমে কাজ শুরু করিয়া দেওয়া যাক—ইহাই আমার মনোভাব।
দেখুন, আপনাদিগকে অবশ্যই বলিব সন্ন্যাস-ব্যবস্থায় আমি খুব বেশী বিশ্বাসী নই। ঐ ব্যবস্থার অনেক গুণ আছে, অনেক দোষও আছে। সন্ন্যাসী ও গৃহস্থদের মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য থাকা উচিত। কিন্তু ভারতে সন্ন্যাস আশ্রমের প্রতিই সমস্ত শক্তি আকৃষ্ট হইয়াছে। আমরা সন্ন্যাসীরা শ্রেষ্ঠ শক্তির প্রতীক। সন্ন্যাসী রাজার চেয়ে বড়। ভারতবর্ষে এমন কোন শাসক-নৃপতি নাই, যিনি ‘গৈরিকবসন’-ধারীর সম্মুখে বসিয়া থাকিতে সাহস করেন। তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়ান। যদিও এই সন্ন্যাসীরাই জনগণের আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন। তবুও ভাল লোকের হাতেও এত ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়। সন্ন্যাসীরা পৌরোহিত্য ও অধ্যাত্মজ্ঞানের মাঝখানে দণ্ডায়মান। তাঁহারা জ্ঞানবিস্তার ও সংস্কারের কেন্দ্রস্বরূপ! ইঁহারা ঠিক য়াহুদীদের ভাববাদীদের (Prophets) মত, এই মহাপুরুষগণ সর্বদা পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কুসংস্কার দূর করিবার চেষ্টা করিতেন। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরাও এই ধরনের। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও এতখানি ক্ষমতা সেখানে ভাল নয়। অন্য কোন উন্নততর পন্থা আবিষ্কার করিতে হইবে। কিন্তু স্বল্পতম বাধার পথেই কাজ করা সম্ভব। সমগ্র জাতির আত্মা সন্ন্যাসের পক্ষপাতী। আপনি ভারতবর্ষে গৃহস্থরূপে কোন ধর্ম প্রচার করুন, হিন্দু জনসাধারণ বিমুখ হইয়া প্রস্থান করিবে। যদি আপনি সংসার ত্যাগ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে হিন্দুরা বলিবে, ‘লোকটি ভাল, সংসার-ত্যাগী, খাঁটি লোক, মুখে যা বলে কাজেও তাই করে।’ আমি যাহা বলিতে চাহিতেছি, তাহা এই যে সন্ন্যাস একটি অসাধারণ শক্তির প্রতীক। আমরা এইটুকু করিতে পারি, ইহার রূপান্তর সাধন করিতে পারি, অন্য রূপ দিতে পারি—পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের হাতে অবস্থিত এই প্রচণ্ড শক্তির রূপান্তর ঘটাইতে হইবে, উহাই জনসাধারণকে উন্নত করিয়া তুলিবে।
পরিকল্পনাটি এতক্ষণে কাগজে কলমে সুন্দরভাবে লিখিত হইয়াছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমি আদর্শবাদের স্তর হইতেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছিলাম। এ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি শিথিল ও আদর্শবাদীই ছিল। যত দিন যাইতে লাগিল, ততই উহা সংহত ও নিখুঁত হইতে লাগিল; প্রকৃত কর্মক্ষেত্রে নামিয়া আমি উহার ত্রুটি প্রভৃতি লক্ষ্য করিলাম।
বাস্তব ক্ষেত্রে ইহার প্রয়োগ করিতে গিয়া আমি কী আবিষ্কার করিলাম? প্রথমতঃ এই সন্ন্যাসীদের কি ভাবে লোকশিক্ষা দিতে হইবে সেই বিষয়ে শিক্ষিত করিয়া তুলিবার কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন। যেমন ধরুন, আমার একটি লোককে আমি ক্যামেরা দিয়া পাঠাইলাম; তাহাকে ঐ-সকল বিষয়ে সর্বপ্রথম শিক্ষিত হইতে হইবে। ভারতবর্ষে প্রায় সব লোকই অশিক্ষিত, সুতরাং শিক্ষার জন্য প্রচণ্ড শক্তিশালী বহু কেন্দ্র প্রয়োজন। ইহার অর্থ কি দাঁড়ায়?—টাকা। আদর্শবাদের জগৎ হইতে আপনি প্রতিদিনের কর্মক্ষেত্রে নামিয়া আসিলেন।
আমি আপনাদের দেশে চার বৎসর ও ইংলণ্ডে দুই বৎসর কঠোর পরিশ্রম করিয়াছি। কয়েকজন বন্ধু আমাকে সাহায্য করিয়াছেন বলিয়া আমি কৃতজ্ঞ। তাঁহাদের একজন আজ আপনাদের মধ্যেই এখানে আছেন। আমেরিকান ও ইংরেজ বন্ধুরা আমার সঙ্গে ভারতে গিয়াছেন এবং অতি-সাধারণভাবে কাজের সূচনা হইয়াছে। কয়েকজন ইংরেজ সঙ্ঘে যোগদান করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে এক বেচারী তো অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়া ভারতে মৃত্যুই বরণ করিলেন। এক ইংরেজ দম্পতি অবসর গ্রহণ করিয়া, নিজেদের সামান্য যাহা কিছু সংস্থান আছে, তাহা দ্বারা হিমালয়ে একটি কেন্দ্র স্থাপন করিয়া শিক্ষা প্রচার করিতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে আমার দ্বারা স্থাপিত ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ (Awakened India) নামে একটি পত্রিকার ভার দিয়াছি। তাঁহারা জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাদান ও অন্যান্য কাজে ব্রতী আছেন। আমার আর একটি কেন্দ্র আছে কলিকাতায়। সকল বৃহৎ আন্দোলনই রাজধানী হইতে আরম্ভ করা প্রয়োজন। রাজধানী কাহাকে বলে? রাজধানী একটি জাতির হৃৎপিণ্ড। সমুদয় রক্ত হৃৎপিণ্ডে আসিয়া জমা হয়, সেখান হইতে সর্বত্র সঞ্চারিত হয়; তেমনি সব সম্পদ্, সব ভাবাদর্শ, সব শিক্ষা, সব আধ্যাত্মিকতা প্রথমে রাজধানীর অভিমুখে গিয়া সে-স্থান হইতে অন্যত্র সঞ্চারিত হয়।
আপনাদিগকে আমি আনন্দের সহিত বলি যে, সাধারণভাবে কাজটি আরম্ভ করিতে পারা গিয়াছে। কিন্তু ঠিক ঐরূপ কাজ আমি সমান্তরালভাবে মেয়েদের জন্যও করিতে চাই। আমার আদর্শ—প্রত্যেকে স্বাবলম্বী হইবে। আমার সাহায্য শুধু দূর হইতে। ভারতীয় নারী, ইংরেজ নারী এবং আশা করি, আমেরিকান নারীরাও এই ব্রত গ্রহণ করিবে। যখনই তাহারা কাজে হাত দিবে, অমনি আমি হাত গুটাইয়া লইব। কোন পুরুষ নারীর উপর হুকুম চালাইবে না। কোন নারীও পুরুষের উপর হুকুম চালাইবে না। প্রত্যেকেই স্বাধীন। যদি কোন বন্ধন থাকে, তবে তাহা কেবল প্রীতির বন্ধন। পুরুষ নারীর জন্য যাহা করিয়া দিতে পারে, তাহা অপেক্ষা নারী অনেক ভালভাবে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করিবে। পুরুষেরা মেয়েদের ভাগ্য গঠনের ভার গ্রহণ করাতেই নারীজাতির যত কিছু অনিষ্ট হইয়াছে। একটি প্রারম্ভিক ভুল লইয়া আমি কাজ শুরু করিতে চাই না। একটি ক্ষুদ্র ভ্রান্তি ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া চলিবে এবং শেষ অবধি এত বৃহৎ আকার ধারণ করিবে যে, উহাকে সংশোধন করা কঠিন হইয়া পড়িবে। সুতরাং আমি যদি ভুল করিয়া পুরুষকে নারীর কর্মধারা নির্ণয় করিবার কাজে লাগাই, তাহা হইলে নারীরা কখনও ঐ নির্ভরতার ভাব হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না—উহাই প্রথা হইয়া দাঁড়াইবে। কিন্তু আমার একটি সুবিধা আছে। আপনাদিগকে আমার গুরুদেবের সহধর্মিণীর কথা বলিয়াছি। আমাদের সকলেরই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কখনও আমাদের উপর হুকুম চালান না। সুতরাং ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কর্মের এই অংশটি নিষ্পন্ন করিতে হইবে।
========================
ভারতবন্ধু অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার
[৬ জুন, ১৮৯৬ খ্রীঃ লণ্ডন হইতে ‘ব্রহ্মবাদিন্’২ পত্রিকার জন্য লিখিত।]
‘ব্রহ্মবাদিন্’—সম্পাদক মহাশয়,
আমাদের ‘ব্রহ্মবাদিনের’ পক্ষে কর্মের আদর্শ চিরকালই থাকিবে—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন,’ কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কখনই নয়—তথাপি কোন অকপট কর্মীই খানিকটা জানাজানি এবং সমাদর লাভ না করিয়া কর্মক্ষেত্র হইতে বিদায় লইতে পারেন না।
আমাদের কার্যের আরম্ভ খুবই ভাল হইয়াছে, আর আমাদের বন্ধুগণ এই বিষয়ে যে দৃঢ় আন্তরিকতা দেখাইয়াছেন, শতমুখে তাহার প্রশংসা করিলেও পর্যাপ্ত বলা হইল বলিয়া বোধ হয় না। অকপট বিশ্বাস ও সৎ অভিসন্ধি নিশ্চয়ই জয়লাভ করিবে, আর এই দুই অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিও নিশ্চয়ই সর্ববিঘ্ন পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে।
কপট অলৌকিক জ্ঞানাভিমানী ব্যক্তিগণ হইতে সর্বদা দূরে থাকিবে। অলৌকিক জ্ঞান হওয়া যে অসম্ভব—তাহা নয়, তবে বন্ধুগণ, তোমরা জানিবে যে, আমাদের এই জগতে যাহারা এরূপ জ্ঞানের দাবী করে, তাহাদের মধ্যে শতকরা নব্বই-জনের কাম-কাঞ্চন-যশঃস্পৃহারূপ গুপ্ত অভিসন্ধি আছে, আর বাকী দশজনের মধ্যে নয়জন লোকের দরকার দার্শনিকগণের অপেক্ষা চিকিৎসকগণের সতর্ক মনোযোগ।
আমাদের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন—চরিত্রগঠন, যাহাকে ‘প্রতিষ্ঠিত প্রজ্ঞা’ বলা যায়। ইহা যেমন প্রত্যেক ব্যক্তির আবশ্যক, ব্যক্তির সমষ্টি সমাজেও তদ্রূপ। প্রত্যেক নূতন উদ্যম, এমন কি ধর্মপ্রচারের নূতন উদ্যমও জগৎ সন্দেহের চক্ষে দেখে বলিয়া বিরক্ত হইও না। তাহাদের অপরাধ কি? কতবার কত লোকে তাহাদিগকে প্রতারিত করিয়াছে! যতই সংসার কোন নূতন সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখে, অথবা উহার প্রতি কতকটা বৈরভাবাপন্ন হয়, ততই উহার পক্ষে মঙ্গল। যদি এই সম্প্রদায়ে প্রচারের উপযুক্ত কোন সত্য থাকে, যদি বাস্তবিক কোন অভাব-মোচনের জন্যই উহার জন্ম হইয়া থাকে, তবে শীঘ্রই নিন্দা প্রশংসায় এবং ঘৃণা প্রীতিতে পরিণত হয়। আজকাল লোকে ধর্মকে কোনরূপ সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-সাধনের উপায়রূপে গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সাবধান থাকিবে। ধর্মের উদ্দেশ্য ধর্ম। যে ধর্ম কেবল সাংসারিক সুখের উপায়স্বরূপ, তাহা আর যাহাই হউক, ধর্ম নয়। আর অবাধে ইন্দিয়সুখভোগ ব্যতীত মনুষ্যজীবনের অপর কোন উদ্দেশ্য নাই—এ-কথা বলিলে ঈশ্বরের এবং মানুষের বিরুদ্ধে ঘোরতর অপরাধ করা হয়।
যে ব্যক্তিতে সত্য, পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থপরতা বর্তমান, স্বর্গে মর্ত্যে বা পাতালে এমন কোন শক্তি নাই যে, তাঁহাকে চাপিয়া মারিতে পারে। এইগুলি সম্বল থাকিলে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড বিপক্ষে দাঁড়াইলেও একলা এক ব্যক্তি সেই প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হইতে পারে।
সর্বোপরি আপস করিতে যাওয়া বিষয়ে সাবধান! আমার এই কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে; কিন্তু সুখেই হউক, দুঃখেই হউক, নিজের ভাব সর্বদা ধরিয়া থাকিতে হইবে, দল বাড়াইবার উদ্দেশ্যে তোমার মতগুলি অপরের নানারূপ খেয়ালের অনুযায়ী করিতে যাইও না। তোমার আত্মাই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আশ্রয়, তোমার আবার অন্য আশ্রয়ের প্রয়োজন কি? সহিষ্ণুতা, প্রীতি ও দৃঢ়তার সহিত অপেক্ষা কর; যদি এখন কোন সাহায্যকারী না পাও, সময়ে পাইবে। তাড়াতাড়ির আবশ্যকতা কি? সমস্ত মহৎ কার্যেরই আরম্ভের সময় উহার প্রাণশক্তির অস্তিত্বই যেন ধরিতে পারা যায় না।
কে ভাবিয়াছিল যে, সুদূর বঙ্গীয় পল্লীগ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণতনয়ের জীবন ও উপদেশ এই কয়েক বৎসরের মধ্যে এমন দূরদেশে গিয়া পৌঁছিবে, যাহা আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নেও কখনও ভাবেন নাই? আমি ভগবান্ রামকৃষ্ণের কথা বলিতেছি। শুনিয়াছ কি, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার ‘নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন এবং যদি উপযুক্ত উপাদান পান, তবে আনন্দের সহিত তাঁহার জীবনী ও উপদেশের আরও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ-সম্বলিত একখানি গ্রন্থ লিখিতে প্রস্তুত আছেন! অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার একজন অসাধারণ ব্যক্তি। আমি কয়েক দিন পূর্বে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। প্রকৃতপক্ষে বলা উচিত, আমি তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে গিয়াছিলাম। কারণ যে-কোন ব্যক্তি শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসেন—তিনি নারীই হউন, পুরুষই হউন, তিনি যে-কোন সম্প্রদায়-মত বা জাতিভুক্ত হউন না কেন—তাঁহাকে দর্শন করিতে যাওয়া আমি তীর্থযাত্রাতুল্য জ্ঞান করি। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’—আমার ভক্তেরা যাহারা ভক্ত, তাহারা আমার সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত। ইহা কি সত্য নয়?
কেশবচন্দ্র সেনের জীবনে হঠাৎ গুরুতর পরিবর্তন কি শক্তিতে সাধিত হইল, অধ্যাপক প্রথমে তাহাই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হন; তারপর হইতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন এবং ঐগুলির চর্চা আরম্ভ করেন। আমি বলিলাম, ‘অধ্যাপক মহাশয়, আজকাল সহস্র সহস্র লোকে রামকৃষ্ণের পূজা করিতেছে।’ অধ্যাপক বলিলেন, ‘এরূপ ব্যক্তিকে লোকে পূজা করিবে না তো কাহাকে পূজা করিবে?’ অধ্যাপক যেন সহৃদয়তার মূর্তিবিশেষ। তিনি স্টার্ডি সাহেব ও আমাকে তাঁহার সহিত মধ্যাহ্ন-আহারের নিমন্ত্রণ করিলেন এবং আমাদিগকে অক্সফোর্ডের কতকগুলি কলেজ ও বোডলিয়ান পুস্তকাগার (Bodleian Library) দেখাইলেন। রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিলেন, আর আমাদিগকে এত যত্ন কেন করিতেছেন, জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের একজন শিষ্যের সহিত তো আর প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয় না।’
তাঁহাকে দেখিয়া বাস্তবিক আমি নূতন দৃষ্টিলাভ করিয়াছি। সুন্দর-উদ্যানসমন্বিত সেই মনোরম ক্ষুদ্র গৃহ, সপ্ততিবর্ষবয়ঃক্রম সত্ত্বেও তাঁহার স্থির প্রসন্ন আনন, বালসুলভ মসৃণ ললাট, রজতশুভ্র কেশ, ঋষি-হৃদয়ের কোন নিভৃত অন্তরালে গভীর আধ্যাত্মিকতার খনির অস্তিত্বসূচক সেই মুখের প্রত্যেক রেখা, তাঁহার সমগ্র জীবনের (যে-জীবন প্রাচীন ভারতের ঋষিগণের চিন্তারাশির প্রতি সহানুভূতি-আকর্ষণ, উহার প্রতি লোকের বিরোধ ও ঘৃণা-অপনয়ন এবং অবশেষে শ্রদ্ধা-উৎপাদনরূপ দীর্ঘকালব্যাপী দুঃসাধ্য কার্যে ব্যাপৃত ছিল) সঙ্গিনী সেই উচ্চাশয়া সহধর্মিণী, তাঁহার সেই উদ্যানের তরুরাজি, পুষ্পনিচয়, তথাকার নিস্তব্ধ ভাব ও নির্মল আকাশ—এই সমুদয় মিলিয়া কল্পনায় আমাকে প্রাচীন ভারতের সেই গৌরবময় যুগে লইয়া গেলে—যখন আমাদের ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ, এবং উচ্চাশয় বাণপ্রস্থিগণ বাস করিতেন—সেই অরুন্ধতী ও বলিষ্ঠাদির যুগে।
আমি তাঁহাকে ভাষাতত্ত্ববিদ্ বা পণ্ডিতরূপে দেখি নাই, দেখিলাম যেন কোন আত্মা দিন দিন ব্রহ্মের সহিত নিজের একত্ব অনুভব করিতেছে, যেন কোন হৃদয় অনন্তের সহিত এক হইবার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রসারিত হইতেছে। যেখানে অপরে শুষ্ক অবান্তর বিচাররূপ মরুতে দিশাহারা, সেখানে তিনি এক জীবনপ্রদ উৎসের সন্ধান পাইয়াছেন। তাঁহার হৃৎস্পন্দন প্রকৃতই উপনিষদের সেই ছন্দে ধ্বনিত হইতেছে, ‘তমেবৈকং জানথ আত্মানম্ অন্যা বাচো বিমুঞ্চথ’—সেই এক আত্মাকে জান, অন্য কথা ত্যাগ কর।
যদিও তিনি একজন পৃথিবী-আলোড়নকারী পণ্ডিত ও দার্শনিক, তথাপি তাঁহার পাণ্ডিত্য ও দর্শন তাঁহাকে ক্রমশঃ উচ্চ হইতে উচ্চে লইয়া গিয়া চৈতন্যসত্তার সাক্ষাৎকারে সমর্থ করিয়াছে, তাঁহার অপরা বিদ্যা বাস্তবিকই তাঁহাকে পরাবিদ্যালাভে সহায়তা করিয়াছে। ইহাই প্রকৃত বিদ্যা—বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্। জ্ঞান যদি আমাদিগকে সেই পরাৎপরের নিকট না লইয়া যায়, তবে জ্ঞানের সার্থকতা কি?
আর ভারতের উপর তাঁহার কী অনুরাগ! যদি আমার সে অনুরাগের শতাংশের একাংশও থাকিত, তাহা হইলে আমি ধন্য হইতাম। এই অসাধারণ মনস্বী পঞ্চাশ বা ততোধিক বৎসর ভারতীয় চিন্তারাজ্যে বাস ও বিচরণ করিয়াছেন, পরম আগ্রহ ও হৃদয়ের ভালবাসার সহিত সংস্কৃত সাহিত্যরূপ অনন্ত অরণ্যের আলো ও ছায়ার বিনিময় পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন, শেষে ঐ-সকল তাঁহার হৃদয়ে বসিয়া গিয়াছে এবং তাঁহার সমগ্র সত্তায় উহার রঙ ধরাইয়া দিয়াছে।
ম্যাক্সমূলার একজন ঘোর বৈদান্তিক। তিনি বাস্তবিকই বেদান্ত-রূপ রাগিণীর নানা স্বর-বিস্তারের ভিতর উহার প্রধান সুরটিকে ধরিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে, বেদান্ত সেই একমাত্র আলোক, যাহা পৃথিবীর সকল সম্প্রদায় ও মতকে আলোকিত করিতেছে, উহা সেই এক তত্ত্ব, সমুদয় ধর্মই যাহার কার্যে পরিণত রূপমাত্র। আর রামকৃষ্ণ পরমহংস কি ছিলেন? তিনি এই প্রাচীন তত্ত্বের প্রত্যক্ষ উদাহরণ, প্রাচীন ভারতের সাকার বিগ্রহ ও ভবিষ্যৎ ভারতের পূর্বাভাস—তাঁহার ভিতর দিয়াই সকল জাতি আধ্যাত্মিক আলোক লাভ করিবে। চলিত কথায় আছে, জহুরীই জহর চেনে। তাই বলি, ইহা বিস্ময়ের বিষয় না যে, ভারতীয় চিন্তাগগনে কোন নূতন নক্ষত্র উদিত হইলেই, ভারতবাসিগণ উহার মহত্ত্ব বুঝিবার পূর্বেই এই পাশ্চাত্য ঋষি উহার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং উহার বিষয়ে বিশেষ আলোচনা করেন!
আমি তাঁহাকে বলিয়াছিলাম, ‘আপনি কবে ভারতে আসিতেছেন? ভারতবাসীর পূর্বপুরুষগণের চিন্তারাশি আপনি যথার্থভাবে লোকের সমক্ষে প্রকাশ করিয়াছেন, সুতরাং ভারতের সকলেই আপনার শুভাগমনে আনন্দিত হইবে।’ বৃদ্ধ ঋষির মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, তাঁহার নয়নে এক বিন্দু অশ্রু যেন দেখা দিল, মাথা একটু নাড়িয়া ধীরে ধীরে এই কথাগুলি বলিলেন, ‘তাহা হইলে আমি আর ফিরিব না; আপনাদিগকে সেখানেই আমাকে চিতায় সমর্পণ করিতে হইবে।’ আর অধিক প্রশ্ন মানব-হৃদয়ের পবিত্র রহস্যপূর্ণ রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের ন্যায় বোধ হইল। কে জানে, হয়তো কবি যাহা বলিয়াছিলেন, ইহা তাহাই—
‘তচ্চেতসা স্মরতি নূনমবোধপূর্বম্ ৷
ভাবস্থিরানি জননান্তরসৌহৃদানি ৷৷’
তিনি নিশ্চয়ই অজ্ঞাতসারে হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ পূর্বজন্মের বন্ধুত্বের কথা ভাবিতেছেন। তাঁহার জীবন জগতের পক্ষে পরম মঙ্গলস্বরূপ হইয়াছে। ঈশ্বর করুন, যেন বর্তমান শরীর ত্যাগ করিবার পূর্বে তাঁহার জীবনে বহু বর্ষ কাটিয়া যায়।
==============
ডক্টর পল ডয়সন
১৮৯৬ খ্রীঃ ‘ব্রহ্মবাদিন্’-সম্পাদককে লিখিত।
দশ বৎসর অধিক অতীত হইল, কোন মধ্যবিত্ত পাদরির আটটি সন্তানের অন্যতম, জনৈক অল্পবয়স্ক জার্মান ছাত্র একদিন অধ্যাপক ল্যাসেনকে একটি নূতন ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে—ইওরোপীয় পণ্ডিতবর্গের পক্ষে তখনকার কালেও সম্পূর্ণ নূতন ভাষা ও সাহিত্য অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা-সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে শুনিল। এই বক্তৃতাগুলি শুনিতে অবশ্য পয়সা লাগিত না, কারণ এমন কি এখন পর্যন্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে কোন ইওরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিখাইয়া অর্থোপার্জন করা অসম্ভব—অবশ্য যদি বিশ্ববিদ্যালয় তাহার পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তবে স্বতন্ত্র কথা।
অধ্যাপক ল্যাসেন জার্মানীর সংস্কৃতবিদ্যা-প্রবর্তকগণের—সেই বীরহৃদয় জার্মান পণ্ডিতদলের একরূপ শেষ প্রতিনিধি। এই পণ্ডিতকুল বাস্তবিকই বীরপুরুষ ছিলেন, কারণ জ্ঞানের প্রতি পবিত্র ও নিঃস্বার্থ প্রেম ব্যতীত তখন জার্মান মনীষিগণের ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণের অন্য কি কারণ বিদ্যমান ছিল? সেই বহুদর্শী অধ্যাপক ‘শকুন্তলা’র একটি অধ্যায় ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। আর সেদিন আমাদের এই যুবক ছাত্রটি যেরূপ আগ্রহ ও মনোযোগের সহিত ল্যাসেনের ব্যাখ্যা শুনিতেছিল, এরূপ আগ্রহবান্ শ্রোতা আর কেহই সেখানে উপস্থিত ছিল না। ব্যাখ্যাত বিষয়টি অবশ্য চিত্তাকর্ষক ও আশ্চর্য বোধ হইতেছিল, কিন্তু আরও বিস্ময়কর ছিল সেই অপরিচিত ভাষা; উহার অপরিচিত শব্দগুলি—অনভ্যস্ত ইওরোপীয় মুখ হইতে উচ্চারিত হইলে উহার ব্যঞ্জনবর্ণগুলি যেরূপ কিম্ভূতকিমাকার শোনায়, সেইরূপভাবে উচ্চারিত হইলেও যুবককে অদ্ভুতভাবে মুগ্ধ করিয়াছিল। সে নিজ বাসস্থানে ফিরিল, কিন্তু যাহা শুনিয়াছিল, রাত্রির নিদ্রায় তাহা ভুলিতে পারিল না। সে যেন এতদিনের অজ্ঞাত অচেনা দেশের চকিত দর্শন পাইয়াছে, এই দেশ যেন তাহার দৃষ্ট অন্য সকল দেশ অপেক্ষা বর্ণে অধিকতর সমুজ্জ্বল; উহার যেমন মোহিনীশক্তি, এই উদ্দাম যুবক-হৃদয় আর কখনও তেমন অনুভব করে নাই।
তাহার বন্ধুবর্গ স্বভাবতই সাগ্রহে প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, কবে এই যুবকের তীক্ষ্ণ মেধা সম্যক পরিস্ফুট হইবে। তাঁহারা আশা করিয়াছিলেন, সে কোন উচ্চ-শিক্ষিতের বৃত্তিতে প্রবেশ করিয়া সাধারণের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হইবে, সর্বোপরি উচ্চ বেতন ও পদমর্যাদার ভাগী হইবে। কিন্তু কোথা হইতে এই সংস্কৃত আসিয়া জুটিল! অধিকাংশ ইওরোপীয় পণ্ডিত তখন ইহার নামও শুনেন নাই। আর উপার্জনের দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে—পূর্বেই বলিয়াছি, সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত হইয়া অর্থোপার্জন করা পাশ্চাত্য দেশে এখনও অসম্ভব ব্যাপার। তথাপি যুবকটির সংস্কৃত শিখিবার আগ্রহ অতি প্রবল হইল।
দুঃখের বিষয়, আধুনিক ভারতীয় আমাদের পক্ষে বিদ্যার জন্য বিদ্যাশিক্ষার আগ্রহটা কিরূপ ব্যাপার, তাহা বুঝাই কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তথাপি আমরা এখনও নবদ্বীপ, বারাণসী ও ভারতের কোন কোন স্থানে পণ্ডিতগণের ভিতর, বিশেষতঃ সন্ন্যাসীদের ভিতর বয়স্ক ও যুবক উভয় শ্রেণীর লোকই দেখিতে পাই, যাঁহারা এইরূপ জ্ঞান-তৃষ্ণায় উন্মত্ত। আধুনিক ইওরোপীয়ভাবাপন্ন হিন্দুদের বিলাসোপকরণশূন্য, তাহাদের অপেক্ষা সহস্রগুণে অধ্যয়নের অল্পসুযোগবিশিষ্ট, রাত্রির পর রাত্রি তৈল-প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে হস্ত লিখিত-পুঁথির প্রতি নিবদ্ধদৃষ্টি (যাহাতে অন্য যে কোন জাতির ছাত্রের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইত), কোন দুর্লভ পুঁথি বা বিখ্যাত অধ্যাপকের অনুসন্ধানে শত শত ক্রোশ ভিক্ষামাত্রোপজীবী হইয়া পদব্রজে ভ্রমণকারী, বৎসরের পর বৎসর যতদিন না কেশ শুভ্র হইতেছে এবং বয়সের ভারে শরীর অক্ষম হইয়া পড়িতেছে, ততদিন নিজ পঠিতব্য বিষয়ে অদ্ভুতভাবে দেহমনের সমুদয় শক্তি-প্রয়োগে নিযুক্ত—এইরূপ ছাত্র ঈশ্বরকৃপায় আমাদের দেশ হইতে এখনও একেবারে লুপ্ত হয় নাই। এখন ভারত যাহাকে নিজ মূল্যবান্ সম্পত্তি বলিয়া গৌরব করিয়া থাকে, তাহা নিশ্চয়ই অতীত কালে তাহার উপযুক্ত সন্তানগণের এরূপ পরিশ্রমের ফল। ভারতের প্রাচীন যুগের পণ্ডিতগণের পাণ্ডিত্যের গভীরতা ও সারবত্তা এবং স্বার্থগন্ধহীনতা ও উদ্দেশ্যের ঐকান্তিকতার সহিত আধুনিক ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষায় যে-ফল লাভ হইতেছে, তাহার তুলনা করিলেই আমার উপযুক্ত মন্তব্যের সত্যতা সুস্পষ্ট হইবে। যদি আমাদের দেশবাসিগণ অন্যান্য জাতির মধ্যে ভারতের ঐতিহাসিক অতীতযুগের উপযুক্ত নিজ পদগৌরব প্রতিষ্ঠিত করিয়া আবার উঠিতে চায়, তবে তাহাদের জীবনে যথার্থ পাণ্ডিত্যের জন্য স্বার্থহীন অকপট উৎসাহ ও সাগ্রহ চিন্তা আবার প্রবলভাবে জাগরিত হওয়া আবশ্যক। এইরূপ জ্ঞান-স্পৃহাই জার্মানীকে তাহার বর্তমান পদবীতে জগতের সমুদয় জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ না হউক, শ্রেষ্ঠগণের অন্যতম পদবীতে—উন্নীত করিয়াছে।
এই জার্মান ছাত্রের হৃদয়ে সংস্কৃত শিক্ষার বাসনা প্রবল হইয়াছিল। অবশ্য এই সংস্কৃত শিক্ষা পর্বতারোহণের মত সুদীর্ঘ ও কঠোর পরিশ্রমসাধ্য। এই পাশ্চাত্য বিদ্যার্থীর জীবন ও অন্যান্য সফলকাম বিদ্যার্থিগণের চিরপরিচিত কাহিনীর মত—তাঁহাদের সেই কঠোর পরিশ্রম, অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ কিন্তু অদম্য উৎসাহের সহিত নিজব্রতে দৃঢ়ভাবে লাগিয়া থাকিয়া যথার্থ বীরজনোচিত সাফল্য লাভের গৌরবময় পরিণতি। এইভাবে যুবকের অভীষ্ট সিদ্ধ হইল। আর এখন শুধু ইওরোপ নয়, সমগ্র ভারতও এই কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পল ডয়সনকে জানে। আমি আমেরিকা ও ইওরোপে অনেক সংস্কৃত শাস্ত্রের অধ্যাপক দেখিয়াছি, তাঁহাদের কেহ কেহ বৈদান্তিক ভাবের প্রতি অতিশয় সহানুভূতিসম্পন্ন। আমি তাঁহার মনীষা ও নিঃস্বার্থ কার্যে উৎসর্গীকৃত জীবন দেখিয়া মুগ্ধ। কিন্তু পল ডয়সন (অথবা ইনি নিজে যেমন সংস্কৃতে ‘দেবসেনা’ বলিয়া অভিহিত হইতে পছন্দ করেন) এবং বৃদ্ধ ম্যাক্সমূলারকে ভারতের ও ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীর সর্বাপেক্ষা অকৃত্রিম বন্ধু বলিয়া ধারণা হইয়াছে। কিয়েল নগরে এই উৎসাহী বৈদান্তিকের সহিত আমার প্রথম সাক্ষাত, তাঁহার ভারতভ্রমণের সঙ্গিনী ধীরপ্রকৃতি সহধর্মিণী ও তাঁহার প্রাণপুত্তলী বালিকা কন্যা, জার্মানী ও হল্যাণ্ডের মধ্য দিয়া আমাদের একসঙ্গে লণ্ডনযাত্রা এবং লণ্ডনে ও উহার আশেপাশে আমাদের আনন্দপূর্ণ দেখাসাক্ষাৎ—আমার জীবনের অন্যান্য মধুর স্মৃতিগুলির অন্যতম বলিয়া চিরকাল হৃদয়ে গ্রথিত থাকিবে।
ইওরোপের প্রথম যুগের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ সমালোচনাশক্তি অপেক্ষা অধিক কল্পনাশক্তি লইয়া সংস্কৃত-চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁহারা জানিতেন অল্প, সেই অল্প জ্ঞান হইতে আশা করিতেন অনেক, আর অনেক সময় তাঁহারা অল্পস্বল্প যাহা জানিতেন, তাহা লইয়াই বাড়াবাড়ি করিবার চেষ্টা করিতেন। আবার সেই কালেও ‘শকুন্তলা’কে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া মনে করার পাগলামিও একেবারে অজ্ঞাত ছিল না। ইহাদের পরে স্বভাবতই একদল প্রতিক্রিয়াশীল স্থূলদর্শী সমালোচকের অভ্যুদয় হইল, যাঁহাদিগকে প্রকৃত পণ্ডিত-পদবাচ্যই বলা যাইতে পারে না। ইঁহারা সংস্কৃতের কিছু জানিতেন না বলিয়াই হয়তো সংস্কৃত-চর্চা হইতে কোন ফললাভের আশা করিতেন না, বরং প্রাচ্যদেশীয় যাহা কিছু তাহাই উপহাস করিতেন। প্রথমোক্ত দলের—যাঁহারা ভারতীয় সাহিত্যে কল্পনার চক্ষে কেবল নন্দনকাননই দর্শন করিতেন, তাঁহাদের বৃথা কল্পনাপ্রিয়তার ইঁহারা কঠোর সমালোচনা করিলেন বটে, কিন্তু নিজেরা আবার এমন সব সিদ্ধান্ত করিতে লাগিলেন যে, বেশী কিছু না বলিলেও ঐগুলিকে প্রথমোক্ত দলের সিদ্ধান্তের মতই বিশেষ অসমীচীন ও অতিশয় দুঃসাহসিক বলা যাইতে পারে। আর এই বিষয়ে তাঁহাদের সাহস স্বভাবতই বাড়িয়া যাইবার কারণ—ভারতীয় ভাবের প্রতি সহানুভূতিশূন্য এবং চিন্তা না করিয়া অতি ক্ষিপ্র সিদ্ধান্তকারী এই-সকল পণ্ডিত ও সমালোচক এমন শ্রোতৃবর্গের নিকট তাঁহাদের বক্তব্য বিষয়গুলি বলিতেছিলেন, যাঁহাদের ঐ বিষয়ে কোন মতামত দিবার একমাত্র অধিকার ছিল তাঁহাদের সংস্কৃত ভাষায় সম্পূর্ণ অজ্ঞতা। এইরূপ সমালোচক পণ্ডিতগণের মস্তিষ্ক হইতে নানারূপ বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রসূত হইবে, তাহাতে বিস্ময়ের কি আছে! হঠাৎ বেচারা হিন্দুরা একদিন প্রাতঃকালে জাগিয়া দেখিল, তাহাদের নিজস্ব বলিয়া যাহা ছিল, তাহার কিছুই নাই—এক অপরিচিত জাতি তাহাদের নিকট হইতে শিল্পকলা কাড়িয়া লইয়াছে, আর একজাতি তাহাদের স্থাপত্য কাড়িয়া লইয়াছে, আর এক তৃতীয় জাতি তাহাদের প্রাচীন বিজ্ঞান সমুদয় কাড়িয়া লইয়াছে, এমন কি ধর্মও তাহাদের নিজস্ব নয়! হাঁ—ধর্মও এক পহ্লবী প্রস্তর-নির্মিত ক্রুশের সঙ্গে ভারতে আসিয়াছে! এইরূপ মৌলিক গবেষণা-পরম্পরারূপ উত্তেজনাপূর্ণ যুগের পর এখন অপেক্ষাকৃত ভাল সময় আসিয়াছে। এখন লোকে বুঝিয়াছে, যথার্থ গভীর বিদ্যাবত্তার কিছু মূলধন না লইয়া কেবল হঠকারিতাবশতঃ কতকগুলি আনুমানিক সিদ্ধান্ত করিয়া বসা, প্রাচ্যতত্ত্ব গবেষণা-ব্যাপারেও হাস্যোদ্দীপক ব্যর্থতাই প্রসব করে এবং ভারতের প্রাচীন ভাবধারাগুলিকে সদম্ভ অবজ্ঞা সহকারে উড়াইয়া দিলে চলিবে না। কারণ ঐগুলির মধ্যে এমন অনেক জিনিষ আছে, যাহা লোকে স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না।
সুখের বিষয়, ইওরোপে আজকাল একদল নূতন ধরনের সংস্কৃত পণ্ডিতের অভ্যুদয় হইতেছে, যাঁহারা শ্রদ্ধাবান্, সহানুভূতিসম্পন্ন ও যথার্থ পণ্ডিত। ইঁহারা শ্রদ্ধাবান্—কারণ ইঁহারা অপেক্ষাকৃত উচ্চদরের মানুষ, এবং সহানুভূতিসম্পন্ন—কারণ ইঁহারা প্রকৃতই বিদ্বান্। আর আমাদের ম্যাক্সমূলারই প্রাচীনদলরূপ শৃঙ্খলের সহিত নূতন দলের সংযোগগ্রন্থি। আমরা হিন্দুগণ পাশ্চাত্য অন্যান্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের অপেক্ষা ইঁহারই নিকট অধিক ঋণী। তিনি যৌবনে যুবকোচিত উৎসাহের সহিত যে সুবৃহৎ কার্য আরম্ভ করিয়া বৃদ্ধাবস্থায় সাফল্যে পরিণত করিয়াছিলেন, সেই কথা ভাবিতে গেলে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ইঁহার সম্বন্ধে একবার ভাবিয়া দেখ—হিন্দুদের চক্ষেও অস্পষ্ট লেখা প্রাচীন হস্তলিখিত-পুঁথি লইয়া দিনরাত ঘাঁটিতেছেন—উহা আবার এমন ভাষায় রচিত, যাহা ভারতবাসীর পক্ষেও আয়ত্ত করিতে সারাজীবন লাগিয়া যায়; এমন কোন অভাবগ্রস্ত পণ্ডিতের সাহায্যও পান নাই, যাঁহাকে মাসে মাসে কিছু দিলে তাঁহার মস্তিষ্ক কিনিয়া লইতে পারা যায়—আর ‘অতি নূতন গবেষণাপূর্ণ’ কোন পুস্তকের ভূমিকায় তাঁহার নামটির উল্লেখ মাত্র করিলে ইহার কদর বাড়িয়া যায়। এই ব্যক্তির কথা ভাবিয়া দেখ—সময়ে সময়ে সায়ণ-ভাষ্যের অন্তর্গত কোন শব্দ বা বাক্যের যথার্থ পাঠোদ্ধারে ও অর্থ-আবিষ্কারে দিনের পর দিন এবং কখনও কখনও মাসের পর মাস কাটাইয়া দিতেছেন। (তিনি আমাকে স্বয়ং এই কথা বলিয়াছেন), এবং এই দীর্ঘকালব্যপী অধ্যাবসায়ের ফলে পরিশেষে বৈদিক সাহিত্যরূপ অরণ্যের মধ্য দিয়া অপরের পক্ষে চলিবার সহজ রাস্তা প্রস্তুত করিয়া দিতে কৃতকার্য হইয়াছেন; এই ব্যক্তি ও তাঁহার কার্য সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখ, তারপর বল—তিনি আমাদের জন্য বাস্তবিক কি করিয়াছেন! অবশ্য তিনি তাঁহার বহু রচনার মধ্যে যাহা কিছু বলিয়াছেন, সেই-সবের সহিত আমরা সকলে একমত না হইতে পারি; এরূপ সম্পূর্ণ একমত হওয়া অবশ্যই অসম্ভব। কিন্তু ঐকমত্য হউক বা নাই হউক, এই সত্যটির কখনও অপলাপ করা যাইতে পারে না যে, আমাদের পূর্বপুরুষগণের সাহিত্য রক্ষা ও বিস্তার করিবার জন্য এবং উহার প্রতি শ্রদ্ধা উৎপাদনের জন্য আমাদের মধ্যে যে কেহ যতদূর সম্ভব আশা করিতে পারি, এই এক ব্যক্তি তাহার সহস্রগুণ অধিক করিয়াছেন, আর তিনি এই কার্য অতি শ্রদ্ধা-ও প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে করিয়াছেন।
যদি ম্যাক্সমূলারকে এই নূতন আন্দোলনের প্রাচীন অগ্রদূত বলা যায়, তবে ডয়সন নিশ্চয়ই যে উহার একজন নবীন অগ্রগামী রক্ষিপদবাচ্য, সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রখনিতে যে-সকল ভাব ও আধ্যাত্মিকতার অমূল্য রত্নসমূহ নিহিত আছে, ভাষাতত্ত্বের আলোচনার আগ্রহ অনেক দিন ধরিয়া সেগুলিকে আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রাখিয়াছিল। ম্যাক্সমূলার সেগুলির কয়েকটি সম্মুখে আনিয়া সাধারণের দৃষ্টিগোচর করিলেন এবং শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিৎ বলিয়া তাঁহার কথার যে প্রামাণ্য তাহারই বলে তিনি ঐ বিষয়ে সাধারণের মনোযোগ বলপূর্বক আকর্ষণ করিলেন। ডয়সনের ভাষাতত্ত্ব আলোচনার দিকে সেরূপ কোন ঝোঁক ছিল না। বরং তিনি দার্শনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত ছিলেন এবং প্রাচীন গ্রীস ও বর্তমান জার্মান তত্ত্বালোচনা-প্রণালী ও সিদ্ধান্তসমূহ তাঁহার বিশেষ জানা ছিল। ডয়সন ম্যাক্সমূলারের পথ অনুসরণ করিয়া অতি সাহসের সহিত উপনিষদের গভীর দার্শনিক তত্ত্বসাগরে ডুব দিলেন; তিনি দেখিলেন, ঐগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং বুদ্ধিবৃত্তি তপ্ত করে—তখন তিনি পূর্ববৎ সাহসের সহিত ঐ তথ্য সমগ্র জগতের সমক্ষে ঘোষণা করিলেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের মধ্যে একমাত্র ডয়সনই বেদান্ত সম্বন্ধে তাঁহার মত খুব স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন। অধিকাংশ পণ্ডিত যেমন ‘অপরে কি বলিবে’, এই ভয়ে জড়সড়, ডয়সন কখনও সেইরূপ মনে করেন নাই। বাস্তবিকই এই জগতে এমন সাহসী লোকের আবশ্যক হইয়াছে, যাঁহারা সাহসের সহিত প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে তাঁহাদের মতামত প্রকাশ করিতে পারেন। ইওরোপ সম্বন্ধে এ-কথা আবার বিশেষভাবে সত্য—সে দেশের পণ্ডিতবর্গ সমাজের ভয়ে বা অনুরূপ কারণে এমন সব বিভিন্ন ধর্মমত ও আচার-ব্যবহার দুর্বলভাবে সমর্থন করেন এবং সেগুলির দোষ চাপা দিবার চেষ্টা করেন, যেগুলিতে সম্ভবতঃ তাঁহাদের অনেকে যথার্থভাবে বিশ্বাসী নন। সুতরাং ম্যাক্সমূলার ও ডয়সনের এইরূপ সাহসের সহিত খোলাখুলিভাবে সত্যের সমর্থনের জন্য বাস্তবিক তাঁহারা বিশেষ প্রশংসার ভাগী। তাঁহারা আমাদের শাস্ত্রসমূহের গুণ-ভাগ-প্রদর্শনে যেরূপ সাহসের পরিচয় দিয়াছেন, সেইরূপ সাহসের সহিত উহার দোষভাগ—পরবর্তী কালে ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীতে যে-সকল গলদ প্রবেশ করিয়াছে, বিশেষতঃ আমাদের সামাজিক প্রয়োজনে উহাদের প্রয়োগ-সম্বন্ধে যে-সকল ত্রুটি হইয়াছে—তাহাও যেন সাহসের সহিত প্রদর্শন করেন। বর্তমান কালে আমাদের এইরূপ খাঁটি বন্ধুর সাহায্য বিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে—যাঁহারা ভারতে যে রোগ দিন দিন বিশেষ প্রবল হইয়া উঠিতেছে, উহার প্রতিকার করিতে পারিবেন। রোগটি হইল এইঃ একদিকে দাসবৎ প্রাচীন প্রথার অতি-চাটুকারিতা—প্রত্যেক গ্রাম্য কুসংস্কারকে আমাদের শাস্ত্রের সার সত্য বলিয়া ধরিয়া থাকিতে চায়, আবার অপরদিকে পৈশাচিক নিন্দাবাদ—যাহা আমাদের মধ্যে ও আমাদের ইতিহাসের মধ্যে ভাল কিছুই দেখিতে পায় না এবং পারে তো এই ধর্ম ও দর্শনের লীলাভূমি আমাদের প্রাচীন জন্মভূমির সমুদয় আধ্যাত্মিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে এখনই ভাঙিয়া চুরিয়া ধূলিসাৎ করিতে চায়। উপরিউক্ত ভারত বন্ধুগণ এই উভয়বিধ চূড়ান্ত একদেশী ভাবে, গতিরোধ করিতে পারেন।
=================
অধিকারিবাদের দোষ
বেলুড় মঠে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী শিষ্যগণের নিকট কথিত।
প্রাচীন ঋষিগণের উপর আমি অসীম শ্রদ্ধাভক্তিসম্পন্ন, কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁহাদের দোহাই দিয়া যেভাবে জনসমাজে লোকশিক্ষা প্রবর্তিত হইয়াছে, সেই শিক্ষাপ্রণালী আমি বিশেষ আপত্তিকর মনে করি। ঐ সময় হইতে স্মৃতিকারেরা সর্বদাই ‘ইহা কর, উহা করিও না’ ইত্যাদি-রূপ বিধিনিষেধ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু ‘কেন এই কাজ করিতে হইবে? কেন ইহা করিব না?’—বিধিনিষেধগুলির উদ্দেশ্য বা যুক্তি তাঁহারা কখনই দেন নাই। এইরূপ শিক্ষাপ্রণালী আগাগোড়া বড়ই অনিষ্টকর—ইহাতে যথার্থ উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হইয়া লোকের ঘাড়ে কতকগুলি অনর্থের বোঝা চাপান হয় মাত্র। এই বিধিনিষেধগুলির উদ্দেশ্য সাধারণ লোকের নিকট গোপন করিয়া রাখিবার এই কারণ প্রদর্শিত হইয়া থাকে যে, তাহারা ঐ উদ্দেশ্য বুঝিবার যথার্থ অধিকারী নয়—সেইজন্য তাহাদের নিকট বলিলেও তাহারা উহা বুঝিবে না। এই অধিকারিবাদের অনেকটা খাঁটি স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁহারা ভাবিতেন, তাঁহারা যে-বিষয়ে বিশেষ চর্চা করিয়া জ্ঞানলাভ করিয়াছেন, লোককে যদি তাহা জানাইয়া দেওয়া হয়, তবে তাহারা আর তাঁহাদিগকে আচার্যের উচ্চ আসনে বসাইবে না। এই কারণেই তাঁহারা অধিকারিবাদের মতটা বিশেষভাবে সমর্থন করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। সামর্থ্যরহিত বলিয়া যদি কোন লোককে তোমরা উচ্চ বিষয় জানিবার অনধিকারী বা অনুপযুক্ত মনে কর, তবে তো তোমাদের তাহাকে অধিক পরিমাণে শিক্ষা দিয়া যাহাতে সে ঐ তত্ত্বসকল বুঝিবার শক্তি-লাভ করিয়া উপযুক্ত হয়, সেজন্য চেষ্টা করা উচিত; তাহার বুদ্ধি যাহাতে মার্জিত ও সবল হয়, সূক্ষ্ম বিষয়সমূহ সে যাহাতে ধারণা করিতে পারে, সেজন্য তাহাকে অল্প শিক্ষা না দিয়া বরং বেশী শিক্ষা দেওয়াই তো উচিত। এই অধিকারিবাদ-মতাবলম্বিগণ—মানবাত্মার মধ্যে যে গূঢ়ভাবে সমুদয় শক্তি রহিয়াছে—এ কথাটা যেন একেবারে ভুলিয়া যান, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিই জ্ঞানের অধিকারী হইতে পারে, যদি তাহাকে তাহার ভাষায়, তাহার উপযোগিভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়। যে আচার্য অপরের জ্ঞানোন্মেষ করিতে পারিতেছেন না, তিনি তাঁহার শিষ্যগণের নিন্দা না করিয়া এবং উচ্চতর জ্ঞান তাহাদের জন্য নয়, এই বৃথা হেতুবাদে তাহাদিগকে চিরদিনের জন্য অজ্ঞান ও কুসংস্কারে ফেলিয়া না রাখিয়া তিনি যে তাহাদিগকে তাহাদের ভাষায়, তাহাদের উপযোগিভাবে শিক্ষা দিয়া তাহাদের জ্ঞানোন্মেষ করিয়া দিতে পারিতেছেন না, সেজন্য যেন বিরলে অশ্রুবিসর্জন করেন। সত্য যাহা, তাহা নির্ভয়ে সকলের সমক্ষে উচ্চৈঃস্বরে প্রকাশ করিয়া বল—দুর্বল অধিকারিগণের ইহাতে বুদ্ধিভেদ হইবে, এ আশঙ্কা করিও না। মানুষ নিজে ঘোর স্বার্থপর, তাই সে চায় না যে, সে যতদূর জ্ঞানলাভ করিয়াছে, অপরেও তাহা লাভ করুক—তাহার আশঙ্কা হয়, তাহা হইলে লোকে তাহাকে মানিবে না, সে অপরের নিকট হইতে যে-সকল সুযোগ-সুবিধা পাইতেছে, অন্যের নিকট হইতে যে বিশেষ সম্মান পাইতেছে, তাহা আর পাইবে না। সেইজন্য সে তর্ক করিয়া থাকে যে, দুর্বলচিত্ত লোকের নিকট উচ্চতম আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কথা বলিলে তাহাদের বুদ্ধি গুলাইয়া যাইবে। অতএব আমরা শ্লোক শুনি—
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্॥
কর্মাসক্ত অজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে জ্ঞানের উপদেশ দিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি তাহাদের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না। কিন্তু জ্ঞানী যুক্তভাবে কর্মসমুদয় স্বয়ং আচরণ করিয়া তাহাদিগকে কর্মে নিযুক্ত রাখিবেন।
আলোকের দ্বারা অন্ধকার দূর না হইয়া পূর্বাপেক্ষা গভীরতর অন্ধকারের সৃষ্টি হইয়া থাকে—এই স্ববিরোধী বাক্যে আমার বিশ্বাস হয় না। অমৃতস্বরূপ সচ্চিদানন্দ সমুদ্রে ডুবিলে মানুষ মরে—এ কথা যেমন, পূর্বোক্ত কথাটিও তদ্রূপ। কি অসম্ভব কথা! জ্ঞানের অর্থ—অজ্ঞানজ ভ্রমসমূহ হইতে মুক্ত হওয়া! সেই জ্ঞানের দ্বারা ভ্রম আসিবে—জ্ঞানালোক আসিলে মাথা গুলাইয়া যাইবে!! ইহা কি কখনও সম্ভব! এইরূপ মতবাদের উৎপত্তির প্রকৃত কারণ এই যে, মানুষ সাধারণ লোকের নিকট হইতে সম্মান হারাইবার ভয়ে খাঁটি সত্য যাহা, তাহা প্রচার করিতে সাহসী হয় না। তাহারা সনাতন সত্যের সহিত ভ্রমপূর্ণ কুসংস্কারগুলির একটা আপস করিতে চেষ্টা করে এবং সেইজন্য এই মতবাদের পোষকতা করে যে, লোকাচার ও দেশাচার মানিতেই হইবে। সাবধান, তোমরা কখনও এইরূপ আপস করিতে যাইও না; সাবধান, এইরূপে পুরাতন ভাঙাঘরের উপর এক পোঁচ চুণকাম করিয়া উহাকে নূতন করিয়া চালাইতে চেষ্টা করিও না। মড়াটার উপর কতকগুলো ফুল চাপা দিয়া উহার বীভৎস দৃশ্য ঢাকিতে যাইও না। ‘তথাপি লৌকিকাচারং মনসাপি ন লঙ্ঘয়েৎ’—তথাপি মনে মনেও লোকাচার লঙ্ঘন করিবে না—এইসব বাক্য গঙ্গাজলে ভাসাইয়া দাও। এইরূপ আপস করিতে গেলে ফল এই হয় যে, মহান্ সত্যগুলি অতি শীঘ্রই নানা কুসংস্কাররূপ আবর্জনাস্তূপের নীচে চাপা পড়িয়া যায়, আর মানুষ ঐগুলিকে পরম আগ্রহে সত্য বলিয়া গ্রহণ করে। এমন কি শ্রীকৃষ্ণ নির্ভীকভাবে গীতার যে মহান্ সত্যসমূহ প্রচার করিয়া গেলেন উহারাও পরবর্তী কালের শিষ্য প্রশিষ্যদের হাতে অসম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা লাভ করিয়াছিল। ফলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শাস্ত্রটির মধ্যে এমন অনেক জিনিষ ঢুকিয়াছে, যাহা মানুষকে পথভ্রান্ত করিতে পারে।
এই আপসের চেষ্টা আসে ঘোর কাপুরুষতা হইতে, লোকভয় হইতে। তোমরা নির্ভীক হও। আমার শিষ্যগণের সর্বোপরি খুব নির্ভীক হওয়া চাই। কোন কারণে কাহারও সহিত কোনরূপ আপস করা চলিবে না। উচ্চতম সত্যসমূহ অধিকারিনির্বিশেষে প্রচার করিতে থাক। লোকে তোমাকে মানিবে না অথবা লোকের সঙ্গে অনর্থক বিবাদ বাধিবে—এ ভয় করিও না। এইটি নিশ্চয় জানিও যে, সত্যকে পরিত্যাগ করিবার শত শত প্রলোভন সত্ত্বেও যদি তোমরা সত্যকে ধরিয়া থাকিতে পার, তোমাদের ভিতর এমন এক দৈব বল আসিবে, যাহার সম্মুখে মানুষ—তোমরা যাহা বিশ্বাস কর না, তাহা বলিতে সাহসী হইবে না। যদি তোমরা চতু্র্দশ বৎসর ধরিয়া সত্য পথ হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া ক্রমাগত সত্যের যথার্থ সেবা করিতে পার, তবে তোমরা লোককে যাহা বলিবে, তাহাকে তাহার সত্যতা বুঝিয়া স্বীকার করিতেই হইবে। এইরূপে তোমরা সর্বসাধারণের মহা কল্যাণ করিতে পারিবে, তোমাদের দ্বারা লোকের বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে, তোমরা সমুদয় জাতিকে উন্নত করিতে পারিবে।
=============
সন্ন্যাসী ও গৃহস্থ
[বেলুড় মঠে তদীয় সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী শিষ্যগণের নিকট কথাপ্রসঙ্গে বলেনঃ]
সন্ন্যাসীদের কার্যে যথা, মঠ ও মণ্ডলী-পরিচালনা, জনসমাজে ধর্মপ্রচার ও অনুষ্ঠানপ্রণালীর প্রবর্তন, ত্যাগ ও ধর্মমতামত-সম্বন্ধীয় স্বাধীন চিন্তার সীমানিরূপণ ইত্যাদিতে সংসারী ব্যক্তির কোন মতামত দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নহে। সন্ন্যাসী ধনী লোকের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখবে না—তার কাজ গরীবকে নিয়ে। সন্ন্যাসীর কর্তব্য পরম যত্নের সহিত প্রাণপণে গরীবদের সেবা করা আর এরূপ সেবা করতে পারলে পরমানন্দ অনুভব করা। আমাদের দেশের সকল সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের ভিতর ধনী লোকের তোষামোদ করা এবং তাদের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করার ভাব প্রবেশ করাতে সেগুলি উৎসন্ন যেতে বসেছে। যথার্থ সন্ন্যাসী যিনি, তাঁর কায়মনোবাক্যে এটা ত্যাগ করা উচিত। এভাবে ধনী লোকের পেছনে ঘোরা বেশ্যারই উপযুক্ত, সংসারত্যাগীর পক্ষে নয়। কাম-কাঞ্চনত্যাগীই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মূলমন্ত্র, সুতরাং ঘোর কাম-কাঞ্চনে মগ্ন ব্যক্তি কি করে তাঁর শিষ্য বা ভক্তরূপে পরিগণিত হতে পারে? তিনি ভগবতীর নিকট প্রার্থনা করতেন, ‘মা, কথা কইবার জন্যে আমার কাছে এমন একজন লোক এনে দে, যার ভেতর কাম-কাঞ্চনের লেশমাত্র নেই, সংসারী লোকের সঙ্গে কথা কয়ে কয়ে আমার মুখ জ্বলে গেল।’ তিনি আরও বলতেন, ‘সংসারী এবং অপবিত্র লোকের স্পর্শ আমি সহ্য করতে পারি না।’ তিনি ‘ত্যাগীর বাদশা’ ছিলেন—সংসারী লোক কখনও তাঁকে প্রচার করতে পারে না। সংসারী গৃহস্থ লোক কখনও সম্পূর্ণ অকপট হতে পারে না, কারণ তার কিছু না কিছু স্বার্থপর উদ্দেশ্য থাকবেই। ভগবান্ স্বয়ং যদি গৃহস্থরূপে অবতীর্ণ হন, আমি তাঁকে কখনও অকপট বলে বিশ্বাস করতে পারি না। গৃহস্থলোক যদি কোন ধর্মসম্প্রদায়ের নেতা হয়, তবে সে ধর্মের নামে নিজেরই স্বার্থসিদ্ধি করতে থাকে, আর তার ফল এই হয় যে, সম্প্রদায়টি একেবারে আগাগোড়া গলদে পূর্ণ হয়ে যায়। গৃহস্থগণ যে-সকল ধর্মান্দোলনের নেতা হয়েছেন, সবগুলিরই ঐ এক দশা হয়েছে। ত্যাগ ব্যতীত ধর্ম দাঁড়াতেই পারে না।
এই সময়ে একজন সন্ন্যাসী শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্বামীজী, ঠিক ঠিক কাঞ্চন ত্যাগ কাহাকে বলা যায়?’ স্বামীজী হেসে বললেনঃ হাঁ, তোর প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝেছি। সংসার ত্যাগ করে এসেই আমার এবং মঠের টাকাকড়ি রাখবার ভার তোর ওপর পড়েছে কিনা, তাই তোর মনে এই সন্দেহ হয়েছে। এখন এর মধ্যে বুঝতে হবে এইটুকু যে, উপায় আর উদ্দেশ্য। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্যে বিশেষ বিশেষ উপায় অবলম্বিত হয়ে থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায়, উদ্দেশ্য একই, কিন্তু তার জন্য বিভিন্ন দেশকালপাত্রে বিভিন্ন উপায় অবলম্বিত হচ্ছে। সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্য—নিজের মুক্তিসাধন এবং জগতের হিত করা—‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।’ আর ঐ উদ্দেশ্য-সাধনের প্রধান উপায়—কাম-কাঞ্চনত্যাগ। কিন্তু এটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ‘ত্যাগ’ অর্থে মনের আসক্তি-ত্যাগ—সর্বপ্রকার স্বার্থের ভাব ত্যাগ। নইলে আমি অপরের নিকট টাকা গচ্ছিত রাখলাম—হাতে টাকা ছুঁলাম না, কিন্তু টাকা দ্বারা যে-সব সুবিধে হয়, সব ভোগ করতে লাগলাম—তাকে কি আর ত্যাগ বলা যায়? যে সময়ে গৃহস্থেরা মনু ও অন্যান্য স্মৃতিকারগণের উপদেশ মেনে সন্ন্যাসী অতিথিদের জন্য তাদের খাদ্যের কিয়দংশ পৃথক্ করে রেখে দিতেন, সে-সন্ন্যাসীর পক্ষে কাছে পয়সা-কড়ি কিছু না রেখে ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবনধারণ করলে কাঞ্চনত্যাগের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত। এখন কিন্তু কাল-ধর্মে গৃহস্থের সে ভাব বড়ই কম—বিশেষতঃ বাঙলাদেশে তো মাধুকরী ভিক্ষের প্রথাই নেই। এখন মাধুকরী ভিক্ষের ওপর নির্ভর করে থাকবার চেষ্টা করলে অনর্থক শক্তিক্ষয়ই হবে,৩কিছু লাভ হবে না। ভিক্ষের বিধান কেবল সন্ন্যাসীর পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যদ্বয়ের সিদ্ধির জন্য, কিন্তু ঐ উপায়ে এখন আর সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। সুতরাং এ অবস্থায় যদি কোন সন্ন্যাসী নিজের জীবনযাত্রার উপযোগী মাত্র অর্থ সংগ্রহ করে যে উদ্দেশ্যে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন, তার সিদ্ধির জন্যে সমুদয় শক্তি প্রয়োগ করেন, তা হলে তাতে সন্ন্যাসধর্মের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতাচরণ হয় না। অনেক সময় লোকে অজ্ঞতাবশতঃ উপায়কেই উদ্দেশ্য করে তোলে। দু-একটা দৃষ্টান্ত ভেবে দেখ। অনেক লোকের জীবনের উদ্দেশ্য—ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ। তার উপায়রূপে সে টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করে। কিন্তু এখানেও উদ্দেশ্য ভুলে উপায়ের প্রতি এতদূর আসক্ত হয় যে, টাকা-সঞ্চয়ই করতে থাকে, তা ব্যয় করে যে ভোগ করবে, তার ক্ষমতা পর্যন্ত তার থাকে না। আরও দেখ, কাপড়-চোপড় কাচবার উদ্দেশ্য—শুচি ও শুদ্ধ হওয়া। কিন্তু আমরা অনেক সময়ে কাপড়-চোপড় শুধু একবার জলে ফেলে নিংড়িয়ে নিলেই শুচি হলাম মনে করি। এই-সব জায়গায় আমরা উপায়কে উদ্দেশ্যের আসনে বসিয়ে গোলমাল করে ফেলি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য কখনই ভুল করা উচিত নয়।
==========================
মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা
ধর্মালোচনা-প্রসঙ্গে কথিত
দক্ষিণ ভারতে অত্যন্ত প্রতাপশালী এক রাজবংশ ছিল। বিভিন্ন কালের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের জন্ম হইতে গণনা করিয়া কোষ্ঠী সংগ্রহ করিয়া রাখার একটি নিয়ম তাঁহারা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। তাঁহারা ঐ-সব কোষ্ঠীতে নির্দিষ্ট ভবিষ্যতের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করিয়া যাইতেন এবং পরে সঙ্ঘটিত বাস্তব ঘটনার সঙ্গে তুলনা করিতেন। প্রায় হাজার বৎসর ধরিয়া এইরূপ করার ফলে তাঁহারা কতকগুলি ঐক্য খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। সেইগুলি হইতে সাধারণ সূত্র নির্ণয় করিয়া এক বিরাট গ্রন্থ প্রণীত হইল। কালক্রমে সেই রাজবংশ লুপ্ত হইলেও, জ্যোতিষীদের বংশটি বাঁচিয়া রহিল এবং সেই গ্রন্থটি তাহাদের অধিকারে আসিল। সম্ভবতঃ এইভাবেই ফলিত জ্যোতিষ-বিদ্যার উদ্ভব হইয়াছিল। যে-সকল কুসংস্কার হিন্দুদের প্রভূত অনিষ্ট-সাধন করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে একটি হইল এই জ্যোতিষের খুঁটিনাটির প্রতি অত্যধিক মনোযোগ।
আমার ধারণা ভারতে ফলিত জ্যোতিষ-বিদ্যা গ্রীকগণই প্রথম প্রবর্তন করে এবং তাহারা হিন্দুগণের নিকট হইতে জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রহণ করিয়া ইওরোপে লইয়া যায়। ভারতে বিশেষ জ্যামিতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত অনেক পুরাতন বেদী দেখিতে পাওয়া যায় এবং নক্ষত্রের বিশেষ বিশেষ অবস্থানকালে কতকগুলি ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠিত হইত। সেজন্য আমার মনে হয়, গ্রীকগণ হিন্দুদের ফলিত জ্যোতিষ-বিদ্যা দিয়াছে এবং হিন্দুরা তাহাদের দিয়াছে জ্যোতির্বিজ্ঞান।
কয়েকজন জ্যোতিষীকে আমি অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী করিতে দেখিয়াছি, কিন্তু তাঁহারা যে কেবল নক্ষত্র বা সেই জাতীয় কোন ব্যাপার হইতে ঐ-সব উক্তি করিতেন, এইরূপ বিশ্বাসের কারণ আমি পাই নাই। অনেক ক্ষেত্রে তাহা নিছক অপরের মনকে বুঝিবার ক্ষমতা। কখনও কখনও আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সে-সব সম্পূর্ণ বাজে কথা।
লণ্ডনে আমার কাছে এক যুবক প্রায়ই আসিত এবং জিজ্ঞাসা করিত, ‘আগামী বছর আমার অদৃষ্টে কী আছে?’ আমি তাহার ঐরূপ প্রশ্নের কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। সে বলে, ‘আমার সব টাকাপয়সা নষ্ট হয়ে গেছে, আমি এখন খুবই গরীব।’ অনেকের কাছে টাকাই একমাত্র ভগবান্। দুর্বল লোকগুলি যখন সব কিছু খোয়াইয়া আরও দুর্বল হইয়া পড়ে, তখন তাহারা যত অপ্রাকৃত উপায়ে টাকা রোজগার করিবার ধান্ধায় থাকে এবং ফলিত জ্যোতিষ বা ঐ ধরনের জিনিষের আশ্রয় নেয়। ‘কাপুরুষ ও মূর্খরাই অদৃষ্টের দোহাই দেয়’—সংস্কৃত প্রবচনে এইরূপ আছে। কিন্তু যিনি শক্তিমান্ তিনি দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলেন, ‘আমিই আমার অদৃষ্ট গড়িব।’ যাহারা বৃদ্ধ হইতে চলিয়াছে, তাহারাই নিয়তির কথা বলে। যুবকেরা সাধারণতঃ জ্যোতিষের দিকে ঘেঁষে না। গ্রহসমূহের প্রভাব হয়তো আমাদের উপর রহিয়াছে, কিন্তু তাহাতে আমাদের বেশী কিছু আসে যায় না। বুদ্ধ বলিয়াছেন, ‘যাহারা নক্ষত্র গণনা, এরূপ অন্য বিদ্যা বা মিথ্যা চালাকি দ্বারা জীবকা অর্জন করে, তাহাদের সর্বদা বর্জন করিবে।’ তাঁহর উক্তি নির্ভরযোগ্য, কেননা তাঁহার মত শ্রেষ্ঠ হিন্দু এ পর্যন্ত কেহ জন্মান নাই। নক্ষত্রগুলি আসুক, তাহাতে ক্ষতি কি? একটি নক্ষত্র দ্বারা যদি আমার জীবন বিপর্যস্ত হয়, তবে আমার জীবনের মূল্য এক কানাকড়িও নয়। জ্যোতিষ-বিদ্যায় বা ঐ ধরনের রহস্যপূর্ণ ব্যাপারে বিশ্বাস সাধারণতঃ দুর্বল চিত্তের লক্ষণ; অতএব যখনই আমাদের মনে সে-সব জিনিষ প্রাধান্য লাভ করিতে থাকে, তখনই আমাদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ লওয়া, উত্তম খাদ্য খাওয়া ও উপযুক্ত বিশ্রাম গ্রহণ করা।
কোন ঘটনার ব্যাখ্যা যদি তাহার স্বকীয় প্রকৃতির মধ্য হইতে খুঁজিয়া পাওয়া যায়, তবে বাহিরে তাহার কারণ সন্ধান মত আহাম্মকি। জগৎ যদি নিজেই নিজেকে ব্যাখ্যা করে, তাহা হইলে বাহিরে ব্যাখ্যা খুঁজিতে যাওয়া নির্বোধের কাজ। মানুষের জীবনে এমন কিছু কি তোমরা কখনও দেখিয়াছ, যাহা তাহার নিজের শক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না? সুতরাং নক্ষত্র বা জগতের অন্য কিছুর নিকট যাইবার কি প্রয়োজন? আমার নিজের কর্মই আমার বর্তমান অবস্থার যথোচিত ব্যাখ্যা। স্বয়ং যীশুর বেলায়ও এই একই কথা। আমরা জানি, তাঁহার পিতা ছিলেন সামান্য একজন ছুতার মিস্ত্রী। তাঁহার শক্তির ব্যাখ্যা খুঁজিবার জন্য আমাদের অন্য কাহারও কাছে যাইবার প্রয়োজন নাই। যীশু তাঁহার নিজ অতীতেরই ফল, যে অতীতের সবটুকুই ছিল তাঁহার আবির্ভাবের প্রস্তুতিপর্ব। বুদ্ধ বারবার জীবদেহ গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং কিভাবে ঐ-সকল জন্মের মধ্য দিয়া তিনি পরিণামে বুদ্ধত্ব লাভ করিয়াছিলেন তাহারও বিবরণ তিনি দিয়াছেন। সুতরাং এগুলি ব্যাখ্যা করিবার জন্য নক্ষত্রের দ্বারস্থ হইবার প্রয়োজন আছে কি? নক্ষত্রগুলির সামান্য প্রভাব হয়তো থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাতে মনোযোগ না দিয়া এবং না ঘাবড়াইয়া আমাদের কর্তব্য হইল ঐগুলিকে উপেক্ষা করা। আমার সমস্ত শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কথা এইঃ যাহা কিছু তোমার আধ্যাত্মিক, মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতা আনে, তাহা পায়ের আঙ্গুল দিয়া স্পর্শ করিবে না। মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক শক্তি রহিয়াছে, তাহার বিকাশই ধর্ম। অনন্ত শক্তি যেন একটি স্প্রিং-এর ন্যায় কুণ্ডলীবদ্ধ হইয়া এই ক্ষুদ্র দেহের মধ্যে রহিয়াছে এবং সেই চাপা শক্তি ক্রমে বিস্তৃতিলাভ করিতেছে। নানা দেহ ধারণ করিয়া ইহা নিজেকে বিকাশ করিতে চায়। যে দেহগুলি এই বিকাশের অনুপযুক্ত, সেইগুলিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া ঐ শক্তি উন্নততর দেহ গ্রহণ করে। ইহাই মানুষের ইতিহাস—ধর্ম, সভ্যতা বা প্রগতির ইতিহাস। সেই বিশালবপু শৃঙ্খলিত দৈত্য প্রমিথিউসের বন্ধন ছিঁড়িয়া যাইতেছে। সর্বত্রই এই শক্তির বিকাশ। জ্যোতিষ প্রভৃতি অনুরূপ ভাবের মধ্যে কণামাত্র সত্য থাকিলেও সেইগুলি বর্জন করা উচিত।
একটি পুরানো গল্পে আছে, জনৈক জ্যোতিষী রাজার নিকট আসিয়া বলিল, ‘আপনি ছয় মাসের মধ্যে মারা যাইবেন।’ রাজা ভয়ে জ্ঞানবুদ্ধি হারাইয়া ফেলিলেন এবং তখনই তাঁহার মরিবার উপক্রম হইল। কিন্তু মন্ত্রী ছিলেন চতুর ব্যক্তি; তিনি রাজাকে বলিলেন যে, ঐ জ্যোতিষীরা নেহাতই মূর্খ। রাজা তাঁহার কথায় আস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন না। সুতরাং জ্যোতিষীরা যে নির্বোধ, তাহা রাজাকে দেখাইয়া দিবার জন্য জ্যোতিষীকে আর একবার রাজপ্রসাদে আমন্ত্রণ করা ছাড়া মন্ত্রী অন্য কোন উপায় দেখিলেন না। জ্যোতিষী আসিলে তাহার গণনা নির্ভুল কিনা মন্ত্রী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। জ্যোতিষী বলিল, তাহার গণনা ভুল হইতে পারে না, কিন্তু মন্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য সে আবার আদ্যোপান্ত গণনা করিয়া অবশেষে জানাইল যে, তাহা একেবারে নির্ভুল। রাজার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। মন্ত্রী জ্যোতিষীকে বলিলেন, ‘আপনি কখন মরিবেন, মনে করেন?’ উত্তরে সে বলিল, ‘বার বৎসরের মধ্যে।’ মন্ত্রী তাড়াতাড়ি তাঁহার তরবারিখানি বাহির করিয়া জ্যোতিষীর মুণ্ডচ্ছেদ করিলেন; তারপর রাজাকে বলিলেন, ‘দেখছেন, কত বড় মিথ্যাবাদী! এই মুহূর্তেই ইহার পরমায়ু শেষ হয়ে গেল।’
যদি তোমাদের জাতিকে বাঁচাইতে চাও, তবে ঐ-সব জিনিষ হইতে দূরে থাক। যাহা শ্রেয়ঃ তাহার একমাত্র পরীক্ষা হইল—উহা আমাদের বলবান্ করে। শুভের মধ্যেই জীবন, অশুভ মৃত্যুস্বরূপ। এই-সব কুসংস্কারপূর্ণ ভাব তোমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মত গজাইতেছে এবং বস্তুর যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণে অসমর্থ নারীগণই ঐগুলি বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত। ইহার কারণ—তাঁহারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করিলেও এখনও বোধশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হন নাই। কোন উপন্যাসের গোড়া হইতে কয়েক লাইনের একটি কবিতার উদ্ধৃতি মুখস্থ করিয়া কোন মহিলা বলেন—তিনি গোটা ব্রাউনিং জানেন। আর একজন খানতিনেক বক্তৃতা শুনিয়াই ভাবেন, তিনি জগতের সব কিছু জানিয়া ফেলিয়াছেন। মুশকিল এই, তাঁহারা নারীর সহজাত কুসংস্কারগুলি ছাড়িতে পারিতেছেন না। তাঁহাদের প্রচুর অর্থ আর কিছু বিদ্যা আছে; কিন্তু তাঁহারা যখন পরিবর্তনের এই মধ্যবর্তী অবস্থা অতিক্রম করিয়া শক্ত হইয়া দাঁড়াইবেন, তখনই সব ঠিক হইয়া যাইবে। এখন তাঁহারা কতকগুলি বচনবাগীশের হাতের পুতুল। দুঃখিত হইও না, কাহাকেও আঘাত করার ইচ্ছা আমার নাই, কিন্তু আমাকে সত্য বলিতেই হইবে। দেখিতে পাইতেছ না কি, তোমরা কিভাবে এ-সবের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হইতেছ? দেখিতেছ না কি, এই-সব মেয়েরা কতখানি ঐকান্তিক এবং সকলের অন্তর্নিহিত দেবত্ব কখনও মরিতে পারে না। সেই দিব্যভাবকে আহ্বান করিতে জানাই সাধনা।
যতই দিন যাইতেছে, প্রতিদিন ততই আমার ধারণা দৃঢ়তর হইতেছে যে, প্রত্যেক মানুষ দিব্যস্বভাব। পুরুষ বা স্ত্রী যতই জঘন্য চরিত্রের হউক না কেন, তাহার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিনাশ নাই। শুধু সে জানে না, কিভাবে সেই দেবত্বে পৌঁছিতে হয় এবং সেই সত্যের প্রতীক্ষায় আছে। দুষ্ট লোকেরা সর্বপ্রকার বুজরুকির সাহায্যে সেই পুরুষ বা স্ত্রীকে প্রতারিত করার চেষ্টা করিতেছে। যদি একজন অপরকে অর্থের জন্য প্রতারণা করে, তোমরা বল—সে নির্বোধ ও বদমাশ। আর যে অন্যকে অধ্যাত্মপথে প্রবঞ্চনা করিতে চেষ্টা করে, তাহার অন্যায় আরও কত বেশী! কী জঘন্য! সত্যের একমাত্র পরীক্ষা এই যে, ইহা তোমাকে সবল করিবে এবং কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে লইয়া যাইবে। দার্শনিকের কর্তব্য মানুষকে কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে লইয়া যাওয়া। এমন কি এই জগৎ, এই দেহ ও মন কুসংস্কাররাশি মাত্র; তোমরা অনন্ত আত্মা! আকাশের মিটমিট-করা তারাগুলি দ্বারা তুমি প্রতারিত হইবে! সেটা লজ্জার কথা। দিব্যাত্মা তোমরা—মিটমিট-করা ক্ষীণালোক নক্ষত্রগুলি তাহাদের অস্তিত্বের জন্য তোমারই কাছে ঋণী।
একদা হিমালয়প্রদেশে ভ্রমণ করিতেছিলাম, আমাদের সম্মুখে ছিল সুদীর্ঘ পথ। কপর্দকহীন সন্ন্যাসী আমরা; যানবাহন কোথায় পাইব? সুতরাং সমস্ত পথ আমাদের পায়ে হাঁটিতে হইল। আমাদের সঙ্গে ছিলেন এক বৃদ্ধ সাধু। কয়েকশত মাইল চড়াই-উৎরাইয়ের পথ তখনও পড়িয়া আছে—সেই দিকে চাহিয়া বৃদ্ধ সাধু বলিলেন, ‘কিভাবে আমি এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করিব? আমি আর হাঁটিতে পারিতেছি না; আমার হৃদযন্ত্র বিকল হইয়া যাইবে।’ আমি তাঁহাকে বলিলাম, ‘আপনার পায়ের দিকে তাকান।’ তিনি উহা করিলে আমি বলিলাম, ‘আপনার পায়ের নীচে যে-পথ পড়িয়া আছে, তাহা আপনিই অতিক্রম করিয়া আসিয়াছেন এবং সামনে যে-পথ দেখিতেছেন, তাহাও সেই একই পথ। শীঘ্রই সেই পথও আপনার পায়ের নীচে আসিবে।’ উচ্চতম বস্তুগুলি তোমাদের পায়ের তলায়, কারণ তোমরা দিব্য নক্ষত্র। এ-সব বস্তুই তোমাদের পায়ের তলায়। ইচ্ছা করিলে তোমরা নক্ষত্রগুলি মুঠিতে ধরিয়া গিলিয়া ফেলিতে পার, তোমাদের যথার্থ স্বরূপের এমনই শক্তি! বলীয়ান হও, সমস্ত কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠ এবং মুক্ত হও।
=====
ঐক্য
[১৯০০ খ্রীঃ জুন মাসে নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটিতে প্রদত্ত একটি বক্তৃতার স্মারকলিপি।]
ভারতে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক মতবাদ—হয় ঐক্যের একটি মূল ভাব অথবা দ্বৈতভাব থেকে বিকাশ লাভ করেছে।
মতবাদগুলি সবই বেদান্তের অন্তর্গত এবং বেদান্তের সাহায্যে ব্যাখ্যাত। তাদের শেষ সার কথা হল ঐক্যের শিক্ষা। যাঁকে আমরা বহুরূপে দেখছি, তিনিই ঈশ্বর। বস্তুজাত পৃথিবী এবং বহুবিধ ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান আমরা অনুভব করি, তবু মাত্র একটি সত্তাই বিদ্যমান।
এই-সমস্ত বিভিন্ন নাম কেবল সেই ‘এক’-এর প্রকাশের মাত্রাগত পার্থক্যকে দেখিয়ে দেয়। আজ যে কীট, কাল সে দেবতা। এই যে-সকল স্বাতন্ত্র্যকে আমরা এত ভালবাসি, সে-সবই এক অনন্ত সত্তার অংশমাত্র, এবং সেগুলির ভেদ কেবল প্রকাশের মাত্রায়। সেই অনন্ত সত্যকে জানাই মুক্তিলাভ।
উপাসনার প্রণালী সম্পর্কে আমাদের যতই বিভ্রান্তি ঘটুক না কেন, বস্তুতঃ মুক্তির জন্যই আমাদের সকল চেষ্টা। আমরা সুখও চাই না, দুঃখও চাই না; চাই মুক্তি। এই একটি লক্ষ্যের মধ্যেই আছে মানুষের সকল অতৃপ্ত তৃষ্ণার মূল রহস্য। হিন্দুও বলে, বৌদ্ধও বলে—মানুষের তৃষ্ণা হল অধিক ও অধিকতরকে পাবার জন্য একটি জ্বলন্ত অপূরণীয় আকাঙ্ক্ষা।
তোমরা আমেরিকানরা সর্বদা আরও সুখ আর সম্ভোগের সন্ধান করছ। এ-কথা সত্য যে, বাইরে তোমরা পরিতৃপ্ত হবে না, কিন্তু ভিতরে—গভীরে তোমরা যা খুঁজছ, তা হল মুক্তি।
এই বাসনার বিশালতা বস্তুতঃ মানুষের নিজের অনন্তত্বের লক্ষণ। যেহেতু মানুষ অনন্ত, তাই বাসনা এবং বাসনাপূর্তি অনন্ত আকার ধারণ করলেই সে পরিতৃপ্ত হতে পারে।
তাহলে কোন্ বস্তু মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে? কাঞ্চন নয়, সম্ভোগ নয়, সৌন্দর্য নয়। শুধু এক অনন্তই তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে, এবং সেই অনন্ত সে নিজেই। এ-কথা যখন সে উপলব্ধি করে, কেবল তখনই মুক্তি আসে।
‘এই বাঁশিটি তার রন্ধ্ররূপী সকল ইন্দ্রিয়, সকল চেতনা, অনুভূতি ও সঙ্গীত নিয়ে শুধু একটি রাগিণীই গাইছে। যে-বন থেকে তাকে ছেদন করা হয়েছিল, সেখানেই ফিরে যাবার সে প্রত্যাশী।’
‘—নিজেকে উদ্ধার কর নিজের দ্বারা,
নিজেকে ডুবতে দিও না কখনও,
কারণ তুমিই তোমার পরম বন্ধু,
আবার তুমিই তোমার পরম শত্রু।’
অনন্তকে সাহায্য করতে পারে কে? অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যে হাতখানা তোমার কাছে আসছে, তাকেও তোমার নিজেরই হাত হতে হবে।
ভীতি ও বাসনা—এই দুটি কারণই এ-সবের মূলে। কে তাদের সৃষ্টি করে? আমরা নিজেরাই। আমাদের জীবন যেন স্বপ্ন থেকে স্বপ্নান্তরে যাত্রা। অনন্ত স্বপ্নের স্রষ্টা মানুষ সীমাবদ্ধ স্বপ্ন দেখে চলেছে!
আহা! বাইরের কোন বস্তুই যে নিত্য বস্তু নয়—এ যে কী অপূর্ব আশীর্বাদ! এই আপেক্ষিক জগতে কিছুই চিরন্তন নয়—এ-কথা শুনে যাদের বুক কেঁপে ওঠে, তারা ঐ কথাগুলির অর্থ জানে না।
আমি যেন অনন্ত নীলাকাশ। আমার উপর দিয়ে এই নানা রঙের মেঘ ভেসে চলে যায়, কখনও বা এক মুহূর্ত থাকে, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি সেই চিরন্তন নীলই থেকে যাই। আমি সব কিছুর সাক্ষী, সেই চিরন্তন সাক্ষী। আমি দেখি বলেই প্রকৃতি আছে। আমি না দেখলে প্রকৃতি থাকে না। আমাদের কেহই কিছু দেখতে বা কিছু বলতে পারতাম না, যদি এই অনন্ত ঐক্য এক মুহূর্তের জন্যও ভেঙে যেত।
=============
হিন্দু ও গ্রীকজাতি
তিনটি পর্বত মানুষের অগ্রগতির সাক্ষীরূপে দণ্ডায়মানঃ হিমালয়—ভারতীয় আর্য-সভ্যতার, সিনাই—হিব্রু-সভ্যতার, অলিম্পাস—গ্রীক-সভ্যতার। আর্যগণ ভারতে প্রবেশ করিয়া ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অবিরাম কর্ম করিতে সমর্থ হইল না; সুতরাং তাহারা চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী হইয়া ধর্মের উন্নতিসাধন করিল। তাহারাই আবিষ্কার করিল যে, মানবমনের শক্তি সীমাহীন; অতএব তাহারা মানসিক ক্ষমতা আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করিল। ইহার মাধ্যমে তাহারা শিখিল যে, মানুষের মধ্যে এক অনন্ত সত্তা লুক্কায়িত আছে, এবং ঐ সত্তা শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করিতে চাহিতেছে। এই সত্তার বিকাশ-সাধনই তাহাদের চরম উদ্দেশ্য হইল।
আর্যজাতির অপর একটি শাখা ক্ষুদ্রতর ও অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত গ্রীস দেশে প্রবেশ করিল। গ্রীসের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক অবস্থা অনুকূল হওয়ায় তাহাদের কার্যকলাপ বহির্মুখ হইয়া পড়িল এবং এইরূপে তাহারা বাহ্যশিল্প ও বাহিরের স্বাধীনতার বিকাশ-সাধন করিল। গ্রীকজাতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অনুসন্ধান করিয়াছিল। হিন্দুগণ সর্বদাই আধ্যাত্মিক মুক্তি অন্বেষণ করিয়াছে। উভয় পক্ষই একদেশদর্শী। জাতীয় সংরক্ষণ অথবা স্বাদেশিকতার প্রতি ভারতীয়গণের তত মনোযোগ নাই, তাহারা কেবল ধর্মরক্ষায় তৎপর; অপর পক্ষে গ্রীকজাতির নিকট এবং ইওরোপে (যেখানে গ্রীক সভ্যতার ধারা অনুসৃত হইয়াছে) স্বদেশের স্থান অগ্রে। সামাজিক মুক্তি উপেক্ষা করিয়া কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য প্রযত্ন ক্রুটিবিশেষ, কিন্তু উহার বিপরীত অর্থাৎ আধ্যাত্মিক মুক্তি উপেক্ষা করিয়া কেবল সামাজিক মুক্তির জন্য যত্নবান হওয়া আরও দোষাবহ। আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক—উভয়বিধ মুক্তির জন্যই চেষ্টা প্রয়োজন।
=====================
মানুষ ও খ্রীষ্টের মধ্যে প্রভেদ
অভিব্যক্ত হয়ে গেলে জীবে জীবে অনেক প্রভেদ। অভিব্যক্ত জীবরূপে তুমি কখনও খ্রীষ্ট হতে পারবে না। মাটি দিয়ে একটি হাতী গড়, আবার সেই মাটি থেকেই একটি ইঁদুর গড়। তাদের জলে ডোবাও—দুটিই একাকার হয়ে যাবে। মৃত্তিকারূপে তাদের চিরন্তন ঐক্য, নির্মিত বস্তু হিসাবে তাদের চিরন্তন পার্থক্য। ঈশ্বর ও মানুষ—নিত্যই হল উভয়ের উপাদান। নিত্যরূপে সর্বব্যাপী সত্তারূপে আমরা সকলে এক; অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে ঈশ্বর চিরন্তন প্রভু এবং আমরা চিরন্তন ভৃত্য।
তোমাদের মধ্যে তিনটি জিনিষ আছেঃ দেহ, মন ও আত্মা। আত্মা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, মনের জন্ম-মৃত্যু আছে, এবং দেহেরও আছে। তুমি সেই আত্মা, কিন্তু সচরাচর তোমার ধারণা শরীরটাই বুঝি তুমি। এক ব্যক্তি যখন বলে, ‘আমি এখানে’ তখন সে শরীরটার কথাই ভাবে। তারপর আসে আর একটি মুহূর্ত, যখন তুমি সর্বোচ্চ স্তরে বিরাজ করছ; তুমি তখন বল না, ‘আমি এখানে’। তখন যদি কোন ব্যক্তি তোমাকে গালাগালি করে বা অভিশাপ দেয়, তোমার কোন ক্রোধ বা বিরক্তি হয় না, কারণ তুমি হলে আত্মা। ‘যখন নিজেকে মন বলে ভাবি, তখন হে চিরন্তন অগ্নি, আমি তোমার স্ফুলিঙ্গমাত্র। আর নিজেকে যখন আত্মা বলে অনুভব করি, তখন তুমি ও আমি অভেদ’—এক ভক্ত বলেছিলেন ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে। তাহলে মন আত্মার অগ্রবর্তী হয় কি করে?
ঈশ্বর যুক্তিবিচার করেন না; যদি সত্যই জান, তবে যুক্তিবিচার করবে কেন? গোটাকতক তথ্যকে জানবার জন্য এবং তার ভিত্তিতে কতকগুলি সাধারণ নিয়ম দাঁড় করাবার জন্য আমরা যে কীটের মত সন্ধান করে ফিরছি, সেই চেষ্টায় গড়ে ওঠা সমস্ত জিনিষগুলি আবার ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, এ-সবই আমাদের দুর্বলতার চিহ্ন।
মন ও যাবতীয় বস্তুর উপর আত্মা প্রতিফলিত হয়। আত্মার আলোকই মনকে চেতনায় স্পন্দিত করে। সব কিছুই আত্মার প্রকাশ; মনগুলি অসংখ্য দর্পণের মত। যাকে তোমরা ভালবাসা, ভয়, ঘৃণা, পুণ্য বা পাপ বল, সব কিছুই আত্মার প্রতিফলন; প্রতিফলকটি নিম্নস্তরের হলে প্রতিফলনও ভাল হয় ।
================
খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ কি অভিন্ন?
আমার একটা বিশেষ ধারণা হল বুদ্ধই খ্রীষ্ট হয়েছিলেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘পাঁচ-শ বছর পরে আবার আমি আসব’ এবং পাঁচ-শ বছর পরে খ্রীষ্ট এসেছিলেন। এঁরা সমগ্র মানব-প্রকৃতির দুই আলোকস্তম্ভ। দুটি মানুষ আবির্ভূত হয়েছিলেন—বুদ্ধ ও খ্রীষ্ট; এঁরা দুটি বিরাট শক্তি—দুটি প্রচণ্ড বিশাল ব্যক্তিত্ব, দুটি ঈশ্বর। জগৎটাকে তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন। পৃথিবীর যেখানেই সামান্য জ্ঞান আছে, সেখানেই মানুষ বুদ্ধ কিম্বা খ্রীষ্টের নামে মাথা নোয়ায়। তাঁদের মত আর হওয়া খুবই কঠিন, তবে আশা করি, আরও হবে। পাঁচ-শ বছর পরে এলেন মহম্মদ, আরও পাঁচ-শ বছর পরে প্রোটেষ্টাণ্ট তরঙ্গ নিয়ে এলেন লুথার, এবং তারপরে আবার পাঁচ-শ বছর কেটে গেছে। কয়েক হাজার বছরের মধ্যে যীশু ও বুদ্ধের মত দু-জন মানুষ জন্মান একটা বিরাট ব্যাপার। এমন দু-জন মানুষই কি যথেষ্ট নয়? খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ ঈশ্বর ছিলেন, অন্যেরা হলেন ধর্মাচার্য। এই দুজনের জীবন অনুশীলন কর এবং তাঁদের মধ্যে শক্তির বিকাশ লক্ষ্য কর—দেখ কী শান্ত, অপ্রতিরোধের জীবন—ঝুলিতে একটি কপর্দকও নেই, এমন দরিদ্র ভিক্ষুকের মত, সারা জীবন ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, ধর্মদ্রোহী ও নির্বোধ বলে কথিত—আর ভেবে দেখ, সমগ্র মানবজাতির উপর কী বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁরা মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
==============
পাপ থেকে পরিত্রাণ
অজ্ঞান থেকে মুক্তি পেলে তবেই আমরা পাপ থেকে নিস্তার পাব। অজ্ঞতাই কারণ, পাপ হল তার ফল।
====================
জগজ্জননীর কাছে প্রত্যাবর্তন
ধাত্রী যখন কোন শিশুকে উদ্যানে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে খেলা করতে থাকে, মা হয়তো তখন শিশুকে ঘরে ডেকে পাঠায়। শিশু তখন খেলায় মত্ত, সে বলে, ‘যাব না; আমি খেতে চাই না।’ খানিক বাদেই খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে শিশু বলে, ‘আমি মার কাছে যাব।’ ধাত্রী বলে, ‘এই দেখ নতুন পুতুল’, কিন্তু শিশুটি বলে, ‘না, না, পুতুল চাই না, আমি মার কাছে যাব’ এবং যতক্ষণ না যেতে পারে কাঁদতে থাকে। আমরা সবাই এক একটি শিশু। ঈশ্বর হলেন জননী। আমরা টাকাকড়ি, ধনদৌলত, ইহজগতের এইসব জিনিষ খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু সময় আসবেই, যখন আমাদের খেলা ভাঙবে; এবং তখন এই প্রকৃতিরূপ ধাত্রী আমাদের আরও পুতুল দিতে চাইলেও আমরা বলব, ‘না, ঢের হয়েছে, এবার ঈশ্বরের কাছে যাব।’
============================
ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র কোন ব্যক্তিসত্তা নেই
আমরা যদি ঈশ্বর থেকে অবিচ্ছিন্ন এবং তাঁর সঙ্গে সর্বদাই একসত্তা হই, তাহলে আমাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য বলে কি কিছুই নেই? হ্যাঁ আছে; তা হল ঈশ্বর। আমাদের ব্যক্তিসত্তা হল ঈশ্বর। তুমি এখন যা, সেটা যথার্থ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নয়। সে এক সত্যের দিকে তুমি এগিয়ে চলেছ। স্বাতন্ত্র্য কথাটার অর্থ হল যাকে ভাগ করা যায় না। আমরা এখন যে অবস্থায় আছি, তাকে কেমন করে স্বাতন্ত্র্যের অবস্থা বলবে? এখন এক ঘণ্টা তুমি এক-রকম চিন্তা করছ, আবার পরের ঘণ্টায় অন্যরকম এবং দু-ঘণ্টা পরে আর এক-রকম। স্বাতন্ত্র্য হল তাই, যা অপরিবর্তনীয়। বর্তমান অবস্থা চিরকাল বজায় থাকলে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ব্যাপার হবে, তাহলে চোর চিরকাল চোরই থেকে যাবে, বদমাশ চিরকাল থাকবে বদমাশ। শিশু অবস্থায় যে মরবে, তাকে চিরদিন শিশুই থাকতে হবে। প্রকৃত স্বাতন্ত্র্য হল তাই, যার কখনও পরিবর্তন হয় না এবং কখনও হবে না; এবং তা হল আমাদের অন্তরে সমাসীন ঈশ্বর।
ভারতবর্ষে যা কিছু কল্যাণকর, বিশুদ্ধ ও পবিত্র, সীতা বলতে তাই বুঝায়; নারীর মধ্যে নারীত্ব বলতে যা বুঝায়—সীতা তাই।
সীতা ধৈর্যশীলা, সহিষ্ণু, চির বিশ্বস্তা, চির বিশুদ্ধা পত্নী। তাঁর সমস্ত দুঃখের মধ্যে রামের বিরুদ্ধে একটিও কর্কশ বাক্য উচ্চারিত হয় নাই। সীতা কখনও আঘাতের পরিবর্তে আঘাত দেন নাই। ‘সীতা ভব!’—সীতা হও।
============
রামায়ণ-প্রসঙ্গে
[আলোচনামুখে ছোট ছোট মন্তব্য]
তাঁহাকেই পূজা কর, যিনি সর্বদা আমাদের নিকট রহিয়াছেন, আমরা ভাল অথবা মন্দ যাহাই করি না কেন, যিনি কখনও আমাদের পরিত্যাগ করেন না; কারণ ভালবাসা কখনও হীন করে না, ভালবাসায় বিনিময় নাই, স্বার্থপরতা নাই।
রাম ছিলেন বৃদ্ধ নৃপতির জীবনস্বরূপ; কিন্তু তিনি রাজা, সুতরাং তাঁহাকে অঙ্গীকার পালন করিতেই হইয়াছিল।
কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণ বলিয়াছিলেন, ‘রাম যেখানে গমন করিবেন, আমি সেখানেই যাইব।’
হিন্দুগণের নিকট জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ মাতৃসমা।
অবশেষে তিনি দিগন্তরেখার শেষ প্রান্তে অবস্থিত ক্ষীণ শশিকলার ন্যায় ম্লান ও কৃশ সীতাকে দেখিতে পাইলেন।
সীতা সতীত্বের প্রতিমূর্তি; স্বীয় পতি ব্যতীত অপর কোন পুরুষের অঙ্গ তিনি কদাচ স্পর্শ করেন নাই।
রাম বলিয়াছিলেন, ‘পবিত্র? সীতা পবিত্রতা স্বয়ং।’
নাটক ও সঙ্গীতমাত্রই ধর্ম। সঙ্গীতমাত্রেই—তাহা প্রেমের অথবা অন্য যে-কোন সঙ্গীত হউক না কেন—যদি কেহ তাহার সমগ্র হৃদয় সেই সঙ্গীতে ঢালিয়া দিতে পারে, তবে তাহাতেই তাহার মুক্তিলাভ। আর কিছু করিবার প্রয়োজন নাই। যদি কাহারও আত্মা সঙ্গীতে মগ্ন হয়, তবে তাহাতেই তাহার মুক্তি। লোকে বলে, সঙ্গীত একই লক্ষ্যে লইয়া যায়।
পত্নী সহধর্মিণী। হিন্দুকে শত শত ধর্মানুষ্ঠান করিতে হয়। পত্নী না থাকিলে একটি অনুষ্ঠানেও তাহার অধিকার নাই। পুরোহিত পতি ও পত্নীকে একত্র আবদ্ধ করিয়া দেন এবং তাঁহারা উভয়ে একসঙ্গে মন্দির প্রদক্ষিণ করে এবং শ্রেষ্ঠ তীর্থসমূহ পরিক্রমা করিয়া থাকে।
রাম দেহ বিসর্জন করিয়া পরলোকে সীতার সহিত মিলিত হইয়াছিলেন।
সীতা পবিত্র, বিশুদ্ধ এবং সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত।
======================
খ্রীষ্ট আবার কবে অবতীর্ণ হবেন?
এ-সব ব্যাপারেও আমি বিশেষ মাথা ঘামাই না। আমার কাজ হল মূলনীতি নিয়ে। ভগবান্ বার বার আবির্ভূত হন, আমি শুধু এ-কথাই প্রচার করি; রাম, কৃষ্ণ ও বুদ্ধরূপে তিনি ভারতে এসেছেন এবং আবার তিনি আসবেন। এ-কথা প্রায় স্পষ্টভাবেই দেখান যেতে পারে যে, প্রতি পাঁচশত বৎসর অন্তর পৃথিবী নিমজ্জমান হয় এবং তখন প্রচণ্ড একটা আধ্যাত্মিক তরঙ্গ আসে, আর সেই তরঙ্গের শীর্ষে থাকেন একজন খ্রীষ্ট।
সারা জগতে এখন একটা বিরাট পরিবর্তন আসছে এবং সেটি একই চক্রপথে ঘটছে। মানুষ দেখছে, সে জীবনের উপর আধিপত্য হারিয়ে ফেলেছে; তাদের গতি কোন্ দিকে? নিম্নে না ঊর্ধ্বে? ঊর্ধ্বে নিশ্চয়ই। নিম্নে কিরূপে হবে? ভাঙনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়; নিজের দেহ দিয়ে, জীবন দিয়ে সেই ফাটল ভরাট কর। তোমরা বেঁচে থাকতে কি করে দুনিয়াকে তলিয়ে যেতে দেবে?
===================================
১৮৯২-৯৩ খ্রীঃ মান্দ্রাজে গৃহীত স্মারকলিপি হইতে
হিন্দুধর্মের তিনটি মূল তত্ত্বঃ ঈশ্বর, আপ্তবাক্যস্বরূপ বেদ, কর্ম ও পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস। যদি কেহ ঠিক ঠিক মর্ম গ্রহণপূর্বক বেদ অধ্যয়ন করে, তবে উহার মধ্যে সে সমন্বয়ের ধর্ম দেখিতে পাইবে।
অন্যান্য ধর্মের সহিত হিন্দুধর্মের পার্থক্য এই যে, হিন্দুধর্মে আমরা সত্য হইতে সত্যে উপনীত হই—নিম্নতর সত্য হইতে ঊর্ধ্বতর সত্যে, কখনও মিথ্যা হইতে সত্যে নয়।
ক্রমবিকাশের দৃষ্টিতে বেদ অনুশীলন করা উচিত। একত্বের উপলব্ধিরূপ ধর্মের পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ধর্ম-চেতনার অগ্রগতির সমগ্র ইতিহাস উহার মধ্যে নিহিত রহিয়াছে।
বেদ অনাদি ও নিত্য। ইহার অর্থ এরূপ নয়—যেমন কেহ কেহ ভ্রমবশতঃ মনে করেন যে, উহার বাক্য (শব্দ)-সমূহই অনাদি, শাশ্বত; কিন্তু উহার আধ্যাত্মিক নিয়মসমূহই অনাদি। এই অপরিবর্তনীয় শাশ্বত নিয়মগুলি বিভিন্ন সময়ে মহাপুরুষ বা ঋষিগণ কর্তৃক আবিষ্কৃত হইয়াছে। ঐগুলির মধ্যে কতকগুলি বিস্মৃত ও কতকগুলি রক্ষিত হইয়াছে।
যখন বহু লোক বিভিন্ন কোণ ও দূরত্ব হইতে সমুদ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তখন নিজ নিজ দৃষ্টি অনুযায়ী সমুদ্রের এক একটি অংশ প্রত্যেকের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রত্যেকে বলিয়া থাকে, সে যাহা দেখিয়াছে, তাহাই প্রকৃত সমুদ্র; তাহাদের সকলের কথাই সত্য, কারণ তাহারা সকলেই সেই এক বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রের বিভিন্ন অংশ দেখিয়া থাকে। সেইরূপ যদিও বিভিন্ন শাস্ত্রে উক্তিসকল পৃথক্ ও পরস্পর-বিরোধী বলিয়া মনে হয়, সেগুলি সবই সত্য প্রকাশ করিয়া থাকে, কারণ ঐ-সকল উক্তি এক অনন্ত সত্তার বিভিন্ন বর্ণনা।
যখন কেহ সর্বপ্রথম মরীচিকা দেখে, তখন উহা তাহার নিকট সত্য বলিয়াই প্রতীত হয়, পরে তৃষ্ণা-নিবারণের বৃথা চেষ্টা করিয়া সে হৃদয়ঙ্গম করে যে, উহা মরীচিকা। কিন্তু ভবিষ্যতে যখনই ঐ দৃশ্য তাহার নয়নগোচর হয়, তখন উহা সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হওয়া সত্ত্বেও সে যে মরীচিকা দেখিতেছে, এ-ধারণা তাহার মনে সর্বক্ষণ বিরাজ করে। জীবন্মুক্তের নিকট মায়ার জগৎ এইরূপ।
যেমন কতকগুলি ক্ষমতা কোন বিশেষ পরিবারের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বর্তমান থাকে, তেমনি বৈদিক রহস্যের কতকগুলি কোন কোন পরিবারের মধ্যেই কেবল জানা ছিল। এই পরিবারগুলির বিলোপ-সাধনের সহিত ঐ-সকল রহস্যও অন্তর্হিত হইয়াছে।
বৈদিক শব-ব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা আয়ুর্বেদীয় বিদ্যা অপেক্ষা কম পূর্ণাঙ্গ ছিল না। শরীরের বহু অংশের বিভিন্ন নাম ছিল, যেহেতু যজ্ঞের জন্য তাহাদের পশু ব্যবচ্ছেদ করিতে হইত। সমুদ্র অর্ণবপোতে পূর্ণ বলিয়া বর্ণিত হয়। সমুদ্রযাত্রার ফলে সাধারণ লোক বৌদ্ধ হইয়া যাইবে, কতকটা এই আশঙ্কাহেতু পরবর্তী কালে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়।
বৌদ্ধধর্ম বৈদিক পৌরোহিত্য-ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে নব-গঠিত ক্ষত্রিয়-সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ। বৌদ্ধধর্ম হইতে উহার সার গ্রহণ করিয়া লইয়া হিন্দুধর্ম বৌদ্ধমতকে পরিত্যাগ করিয়াছিল। দাক্ষিণাত্যের সকল আচার্যের প্রচেষ্টা ছিল, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম উভয়ের মধ্যে মিলন স্থাপন। শঙ্করাচার্যের উপদেশের মধ্যে বৌদ্ধ প্রভাব দেখা যায়। তাঁহার শিষ্যগণ তাঁহার উপদেশ এতদূর বিকৃত করিয়াছিলেন যে, পরবর্তী কালের কোন কোন সংস্কারক আচার্যের অনুগামিগণকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন—ইহা ঠিকই হইয়াছে।
স্পেন্সারের ‘অজ্ঞেয়’ কি বস্তু? উহা আমাদের মায়া। পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ অজ্ঞেয়ের প্রসঙ্গে ভয় পান, কিন্তু আমাদের দার্শনিকগণ অজানার উদ্দেশ্যে একটি বিপুল অভিযান আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং উহাতে তাঁহারা জয়ী হইয়াছিলেন।
পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ শকুনির ন্যায় ঊর্ধ্বে বিচরণ করিয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে নিম্নে গলিত শবের প্রতি। অজানাকে তাঁহারা অতিক্রম করিতে পারেন না, অতএব পৃষ্ঠপ্রদর্শনপূর্বক সর্বশক্তিমান্ ডলারকেই পূজা করিয়া থাকেন।
জগতে উন্নতির দুইটি ধারা আছে—রাজনৈতিক ও ধর্মভিত্তিক। প্রথমটিতে গ্রীকরাই সব—আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রীসের প্রতিষ্ঠানগুলির সম্প্রসারণ মাত্র; শেষেরটিতে অর্থাৎ ধর্মের উন্নতির ব্যাপারে হিন্দুদেরই একচেটিয়া অধিকার।
আমার ধর্ম এরূপ একটি ধর্ম—খ্রীষ্টধর্ম যাহার একটি শাখা ও বৌদ্ধধর্ম যাহার বিদ্রোহী সন্তান।
যখন একটি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়—যাহা হইতে অপর পদার্থগুলির উপাদান সিদ্ধ হয়, তখনই রসায়নবিদ্যা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হয়। অন্যান্য শক্তিসমূহ যে-শক্তির বিভিন্ন অভিব্যক্তি, সেই মূল শক্তিপ্রাপ্ত হইলে পদার্থবিদ্যার উন্নতির অবসান ঘটে। সেইরূপ আধ্যাত্মিক একত্বের সন্ধান পাইলে ধর্মের ক্ষেত্রে উন্নতি করিবার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। হিন্দুধর্মে তাহাই ঘটিয়াছে।
বেদে নাই—এরূপ কোন ধর্ম-সম্বন্ধীয় নূতন ধারণা কোথাও প্রচারিত হয় নাই।
প্রত্যেক বিষয়ে দুই জাতীয় বিকাশ বর্তমান—বিশ্লেষণমূলক (analytical) ও সমন্বয়মূলক (synthetical)। প্রথমটিতে হিন্দুগণ অন্যান্য জাতিকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন। শেষেরটিতে তাঁহাদের স্থান শূন্য।৪
হিন্দুগণ বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ম বিষয় অনুধাবন করিবার ক্ষমতা অনুশীলন করিয়াছেন। এ পর্যন্ত কোন জাতি পাণিনির ন্যায় ব্যাকরণ উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হন নাই।
রামানুজের বিশিষ্ট কাজ হইতেছে জৈন ও বৌদ্ধদের হিন্দুধর্মে লইয়া আসা। রামানুজ মূর্তিপূজার একজন শ্রেষ্ঠ সমর্থক। তিনি প্রেম ও বিশ্বাসকে মুক্তিলাভের প্রকৃষ্ট উপায় বলিয়া নির্দেশ দিয়া গিয়াছেন।
এমন কি ভাগবতে জৈনদের চব্বিশ তীর্থঙ্করের অনুরূপ চব্বিশ অবতারের উল্লেখ আছে। ঋষভদেবের নাম উভয়ের মধ্যে বর্তমান।
যোগাভ্যাস করিলে সূক্ষ্ম বস্তু ধারণা করিবার ক্ষমতা হয়। সিদ্ধপুরুষ বিষয় হইতে গুণসমূহকে পৃথক্ করিয়া এবং বস্তুসত্তা প্রদানপূর্বক তাহাদের স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করিতে সমর্থ। অন্যান্য ব্যক্তিগণ হইতে এখানেই সিদ্ধপুরুষের শ্রেষ্ঠতা।
দুইটি বিপরীত বস্তু চরম অবস্থায় গিয়া সর্বদা মিলিত হয় এবং একরূপ দেখায়। শ্রেষ্ঠ আত্মবিস্মৃত ভক্ত, যাঁহার মন অনন্ত পরব্রহ্মের ধ্যানে মগ্ন এবং অত্যন্ত হীন মদ্যপায়ী উন্মাদ—এই দুইজনকে বাহ্যতঃ একরূপ দেখায়। সময় সময় উহাদের সাদৃশ্যহেতু একটিকে অপরটিতে পরিবর্তিত হইতে দেখিয়া আমরা আশ্চর্য হইয়া যাই।
অত্যন্ত দুর্বল-স্নায়ুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ধার্মিক হিসাবে কৃতকার্য হয়। তাহাদের মাথায় কিছু ঢুকিলে ঐ-বিষয়ে তাহারা অত্যধিক উৎসাহী হইয়া উঠে।
জনৈক ঈশ্বর-ভক্তকে উন্মাদ বলিয়া অভিযোগ করিলে তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, ‘এ-জগতে সকলেই উন্মাদ—কেহ কাঞ্চনের জন্য, কেহ কামিনীর জন্য এবং কেহ ঈশ্বরের জন্য। ডুবিয়া মরাই যদি মানুষের অদৃষ্ট হয়, তাহা হইলে পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবিয়া মরা অপেক্ষা দুগ্ধ-সাগরে ডুবিয়া মরাই শ্রেয়ঃ।’
অনন্ত প্রেমময় ঈশ্বর এবং মহৎ ও অনন্ত প্রেমের পাত্রকে নীলবর্ণরূপে চিত্রিত করা হয়। কৃষ্ণের রঙ নীল, সলোমনের৫প্রেমের ঈশ্বরের রঙও নীল। ইহা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যাহা কিছু গভীর ও অসীম, তাহাই নীল রঙের সহিত যুক্ত। এক অঞ্জলি জল গ্রহণ কর, উহার কোন রঙ নাই। কিন্তু গভীর বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকাও, দেখিবে উহা নীল। তোমার সন্নিহিত যে শূন্যস্থান, উহার কোন বর্ণ নাই, কিন্তু সীমাহীন আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে উহা নীল।
আদর্শবাদী হিন্দুদের মধ্যে যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব ছিল, ইহাই তাহার প্রমাণ। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের কথাই ধর। হিন্দুর চিত্রকলায় কি দেখিতে পাও? সর্বপ্রকার কিম্ভূতকিমাকার ও অস্বাভাবিক মূর্তি। হিন্দু মন্দিরে কি নজরে পড়ে? ‘চতুর্ভঙ্গ’ নারায়ণ বা ঐ-জাতীয় কোন মূর্তি। কিন্তু কোন ইতালীয় পট অথবা গ্রীসদেশীয় মূর্তি সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখ, ইহাদের মধ্যে প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণের কি অপূর্ব প্রকাশ! প্রদীপ হস্তে একটি নারীর চিত্র-অঙ্কনের জন্য হয়তো একজন বিশ বৎসর ধরিয়া নিজ হাতে প্রদীপ জ্বালিয়া বসিয়াছিল।
হিন্দুগণ আত্মসমীক্ষাপ্রসূত বিজ্ঞানসমূহে উন্নতি করিয়াছিলেন। বিভিন্ন-প্রকৃতি মানুষের জন্য বেদে বিভিন্ন ধর্মাচরণের বিধান দেওয়া হইয়াছে। বয়স্ককে যাহা শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহা শিশুকে শিক্ষা দেওয়া চলে না।
গুরু হইবেন মানুষের চিকিৎসক। তিনি শিষ্যের প্রকৃতি অবগত হইয়া তাহার পক্ষে যাহা সর্বাপেক্ষা উপযোগী, সেই প্রণালী শিক্ষা দেবেন।
যোগাভ্যাসের অসংখ্য পথ আছে। কোন কোন প্রণালী কোন কোন ব্যক্তির পক্ষে উৎকৃষ্ট ফল প্রদান করিয়াছে। কিন্তু ঐগুলির মধ্যে সাধারণভাবে সকলের পক্ষে দুইটির গুরুত্ব অধিক—(১) ইন্দ্রিয় ও মনের যাবতীয় প্রত্যয়কে লয় করিয়া চরম সত্যে পৌঁছান, (২) আমিই সব, তুমিই সমগ্র বিশ্ব, এইরূপ চিন্তা করা। দ্বিতীয় পদ্ধতির সাধককে প্রথমটি অপেক্ষা দ্রুততর লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিলেও উহা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ নয়। সাধারণতঃ ঐ প্রণালী-অবলম্বনে মহা বিপদের আশঙ্কা আছে এবং ইহা সাধককে বিপথে পরিচালিত করিয়া উদ্দেশ্য-লাভে বিঘ্ন জন্মায়।
খ্রীষ্টধর্মে ও হিন্দুধর্মে উপদিষ্ট প্রেমের মধ্যে পার্থক্য এই যে, খ্রীষ্টধর্ম প্রতিবেশীকে ভালবাসিতে শিক্ষা দেয়, কারণ আমরা ইচ্ছা করি যে, প্রতিবেশীরাও আমাদিগকে ভালবাসুক। হিন্দুধর্মে প্রতিবেশীদিগকে আত্মবৎ ভালবাসিতে—বস্তুতঃ তাহাদের মধ্যে আমাদের স্বরূপ উপলব্ধি করিতে বলে।
সচরাচর একটি বেজিকে লম্বা শিকলে বাঁধিয়া কাঁচের আলমারিতে রাখা হয়, যাহাতে সে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতে পারে। আলমারির বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইলেও কোন বিপদের আভাস পাইলেই সে একলাফে কাঁচের আলমারিতে ঢুকিয়া পড়ে। যোগী এই পৃথিবীতে এভাবেই বিচরণ করেন।
সমগ্র বিশ্ব এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা; ইহার একপ্রান্তে জড় জগৎ ও অপর প্রান্তে ঈশ্বর—কতকটা এইরূপ ভাব দ্বারা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের নীতি ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে।
বেদের বহু উক্তি সগুণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব-জ্ঞাপক। দীর্ঘকাল উপাসনার ফলে ঋষিগণ ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন এবং অজ্ঞাত রাজ্যের রহস্য উদ্ঘাটন করিয়া জগৎকে ইহা যাচাই করিতে আহ্বান করিয়াছেন। দাম্ভিক লোকেরাই ঋষি-নির্দেশিত পথ অনুসরণ না করিয়া এবং তাঁহাদের উপদেশ পালন না করিয়া সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচরণ করে। এখনও পর্যন্ত এমন কেহ সাহসপূর্বক বলিতে পারে নাই যে, ঋষিদের নির্দেশ যথাযথ পালন করিয়াও তাহার কোন প্রকার অনুভূতি হয় নাই এবং ঋষিগণ মিথ্যাবাদী। এরূপ বহু লোক আছে, যাহারা বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ পরীক্ষার মধ্য দিয়া গিয়া উপলব্ধি করিয়াছে যে, ঈশ্বর তাহাদিগকে ত্যাগ করেন নাই। জগৎ এরূপ যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি আমাদিগকে কোন সান্ত্বনা না দেয়, তবে আত্মহত্যাই শ্রেয়ঃ।
একজন ধার্মিক প্রচারক প্রচারকার্যে বাহিরে গিয়াছিলেন। অকস্মাৎ কলেরায় আক্রান্ত হইয়া তাঁহার তিনটি পুত্র মারা যায়। ঐ ব্যক্তির পত্নী প্রিয় পুত্র তিনটির মৃতদেহ একখণ্ড বস্ত্রে আবৃত করিয়া গৃহের ফটকে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। স্বামী প্রত্যাবর্তন করিলে তিনি তাঁহাকে ঐ স্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘স্বামিন্, আপনার নিকট কেহ কোন দ্রব্য গচ্ছিত রাখিয়াছিলেন এবং আপনার অনুপস্থিতিকালে আসিয়া হঠাৎ উহা ফেরৎ লইয়া গিয়াছেন। আপনি কি সেজন্য দুঃখিত হইবেন?’ স্বামী উত্তর দিলেন ‘নিশ্চয় নয়।’ তখন পত্নী তাঁহাকে গৃহের মধ্যে লইয়া গিয়া বস্ত্রখণ্ড সরাইয়া মৃতদেহ তিনটি তাঁহাকে দেখাইলেন। স্বামী শান্তভাবে উহা সহ্য করিয়া শবদেহগুলি যথোচিত সৎকার করিলেন। বিশ্বের যাবতীয় ঘটনার নিয়ন্তা করুণাময় ঈশ্বরের অস্তিত্বে যাঁহাদের বিশ্বাস দৃঢ়, তাঁহারা ঐরূপ মনোবলের অধিকারী হন।
অখণ্ডকে কখনও চিন্তা করা যায় না। সীমাবচ্ছিন্ন না হইলে আমরা কোন বস্তুর ধারণা করিতে পারি না। অনন্ত ঈশ্বরকে সান্তরূপেই ধারণা ও পূজা করা সম্ভব।
জন ব্যাপটিস্ট ছিলেন একজন ‘এসীন’ (Essene)। উহা এক বৌদ্ধসম্প্রদায়বিশেষ। দুইটি শিবলিঙ্গকে আড়াআড়িভাবে স্থাপন করিলেই উহা খ্রীষ্টধর্মের ক্রুশে পরিণত হয়। প্রাচীন রোমের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও বৌদ্ধপূজার্চনার চিহ্ন দৃষ্ট হয়।
দক্ষিণ ভারতে কতকগুলি ‘রাগের’ বা সুরের প্রচলন আছে। ঐ রাগগুলিকে স্বতন্ত্র মনে করা হইলেও প্রকৃতপক্ষে প্রধান ষড়্রাগ হইতেই ঐগুলির উৎপত্তি। দক্ষিণ ভারতের সঙ্গীতে মূর্চ্ছনা বা শব্দের দোদুল্যমান স্পন্দনের প্রয়োগ খুব কম। সেখানে পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহারও দুর্লভ। দক্ষিণদেশের বীণাযন্ত্র প্রকৃত বীণা নয়। আমাদের সামরিক সঙ্গীত বা সামরিক কবিতা—কোনটাই নাই। ভবভূতি কিয়ৎপরিমাণে বীররসপ্রিয় কবি।
যীশুখ্রীষ্ট ছিলেন সন্ন্যাসী। তাঁহার ধর্ম মূলতঃ কেবল সন্ন্যাসীদের উপযোগী। তাঁহার শিক্ষার সারমর্ম—‘ত্যাগ কর’; আর অধিক কিছু নাই। এই শিক্ষা কতিপয় বিশেষ অধিকারীরই উপযোগী।
‘অপর গাল ফিরাইয়া দাও’—এই শিক্ষা কার্যতঃ অসম্ভব, অসাধ্য। পাশ্চাত্যগণ ইহা জানে। যাহারা ধর্মলাভের আকাঙ্ক্ষা করে, যাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণত্ব-লাভ, তাহাদের জন্যই ঐ উপদেশ। সাধারণ লোকের ধর্ম হইল—‘নিজ অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হও।’ সন্ন্যাসী ও গৃহস্থ—সকলের নিকট একই প্রকার নৈতিক উপদেশ প্রচার করা যাইতে পারে না।
সকল সাম্প্রদায়িক ধর্মই ধরিয়া লইয়াছে যে, সব মানুষই সমান। বিজ্ঞান কিন্তু উহা সমর্থন করে না। মানুষের শারীরিক পার্থক্য অপেক্ষা মানসিক পার্থক্য অধিক। হিন্দুধর্মের একটি মূল নীতি হইল প্রত্যেক মানুষই পৃথক্—বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এমন কি, মদ্যপ ও বেশ্যাসক্তের জন্যও হিন্দুধর্মে কিছু মন্ত্রের বিধান রহিয়াছে।
নীতি একটি আপেক্ষিক শব্দ। জগতে বিশুদ্ধ নীতি বলিয়া কোন পদার্থ আছে কি? ঐ ধারণা কুসংস্কার মাত্র। প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই আদর্শের দ্বারা বিচার করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক যুগের প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষ অবস্থার অধীন। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবের পরিবর্তনও অপরিহার্য। এক সময়ে গোমাংস-ভক্ষণ নীতিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইত। তখন জলবায়ু শীতল ছিল এবং খাদ্য-শস্যের ব্যবহার বিশেষ প্রচলিত ছিল না। খাদ্যের মধ্যে মাংসই ছিল প্রধান, সুতরাং সেই যুগে ও সেই সময়ে মাংস একরূপ অপরিহার্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে গোমাংস-ভক্ষণ নীতিবিরুদ্ধ বলিয়া গণ্য হয়।
ঈশ্বরই একমাত্র অপরিবর্তনীয়। সমাজ চলমান। জগৎ শব্দের অর্থ যাহা অনবরত চলিতেছে। ঈশ্বর অচল।
আমার কথা হইতেছে—‘সংস্কার’ নয়, কিন্তু ‘অগ্রসর হও—চরৈবেতি।’ জগতে উহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে আমরা নিজদিগকে বিভিন্ন অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলার মধ্যেই জীবনের সকল রহস্য নিহিত। উহাই জীবন-বিকাশের অন্তর্নিহিত মূল নীতি। বহিঃপ্রকৃতি আমাদিগকে দাবাইয়া রাখিতে চায়, উহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে আমরা নিজদিগকে বিভিন্ন অবস্থার উপযোগী করিয়া তোলার অথবা পরিবেষ্টনীর সহিত খাপ-খাওয়াইয়া চলিবার ক্ষমতা লাভ করি। পরিবর্তিত অবস্থার উপযোগী করিয়া তোলার ক্ষমতা যাহার মধ্যে বেশী, সে-ই দীর্ঘজীবী হইয়া থাকে। আমি এই তত্ত্ব প্রচার না করিলেও সমাজ পরিবর্তিত হইতেছে ও হইবেই। মানুষকে হয় বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, নতুবা অনাহারী থাকিতে হইবে—এই প্রয়োজনই জগতে কার্য করিতেছে, খ্রীষ্টান ধর্ম অথবা বিজ্ঞান নয়।
হিমালয়ের মহোচ্চ শিখরেই জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। যদি কেহ সেখানে কিছুকাল বাস করে, তবে পূর্বে সে যতই অস্থির-চিত্ত থাকুক না কেন, অবশ্যই মানসিক শান্তি লাভ করিবে।
ঈশ্বর যাবতীয় বিশ্ব-বিধানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। ঈশ্বরের সত্যকে একবার জানিতে পারিলে অন্যান্য সব কিছুকে ইহার অধীন বলিয়া ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। পতনশীল বস্তুগুলির ক্ষেত্রে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ-নিয়মের যে স্থান, ধর্মের ক্ষেত্রে ঈশ্বরেরও সেই স্থান।
প্রত্যেক পূজাই উচ্চস্তরের প্রার্থনা। যে-ব্যক্তি ধ্যান অথবা মানস-পূজা করিতে অক্ষম, তাহার পক্ষেই পূজা বা আনুষ্ঠানিক অর্চনার প্রয়োজন। তাহার পক্ষে কোন স্থূল বস্তু প্রয়োজন।
সাহসী ব্যক্তিরাই অকপট হইতে পারে। সিংহের সহিত শৃগালের তুলনা কর।
ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে যাহা কিছু ভাল, তাহাকে ভালবাসা শিশুর পক্ষেও সম্ভব। কিন্তু ভয়ঙ্কর ও দুঃখজনক বস্তুকেও ভালবাসিতে হইবে। সন্তান যখন দুঃখ দেয়, তখনও পিতা তাহার প্রতি স্নেহ পোষণ করেন।
শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার, তিনি মানবজাতির উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। গোপীলীলা প্রেমধর্মের পরাকাষ্ঠা, এই প্রেমে সকল ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং পরম মিলন ঘটে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রচার করিয়াছেন, ‘আমাকে পাইবার জন্য অন্যান্য সকল বন্ধন ত্যাগ কর’—গোপীলীলায় এই তত্ত্ব অভিব্যক্ত হইয়াছে। ভক্তিতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য বৃন্দাবন-লীলার শরণ লও। এ-বিষয়ে বহু সংখ্যক পুস্তক আছে। ভক্তি ভারতবর্ষের সর্বজনীন ধর্ম। হিন্দুজাতির বৃহত্তম অংশ শ্রীকৃষ্ণের অনুবর্তী।
দরিদ্র, ভিক্ষুক, পাপী, পুত্র, পিতা, পত্নী—শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই ঈশ্বর। আমাদের সর্বপ্রকার মায়িক সম্বন্ধের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বদ্ধ হইয়া তিনি এগুলিকে পবিত্র করেন এবং পরিণামে মুক্তি প্রদান করেন। শ্রীকৃষ্ণ-ভগবান্ দার্শনিক ও পণ্ডিতের নিকট নিজেকে লুকাইয়া রাখেন, প্রকট হন অজ্ঞ ও শিশুর নিকট। শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বাস ও প্রেমের দেবতা—পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁহাকে পাওয়া যায় না। গোপীদিগের নিকট প্রেম ও ঈশ্বর এক বস্তু। তাহারা জানিত শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের মূর্ত বিগ্রহ।
দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তব্য শিক্ষা দিতেছেন, বৃন্দাবনে প্রেম। তাঁহার বংশধরগণ দুর্বৃত্ত বলিয়া তিনি তাহাদের পরস্পরের বিনাশ নিবারণ করেন নাই।
ঈশ্বর সম্বন্ধে য়াহুদী ও মুসলমানগণের ধারণা যে, তিনি একজন আদালতের বড় বিচারক। আমাদের ঈশ্বর বাহিরে কঠোর, কিন্তু অন্তরে প্রেম ও করুণায় পূর্ণ।
অদ্বৈতবাদ কি, তাহা না বুঝিয়া কেহ কেহ উহার উল্টা অর্থ করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ আবার কি? পাপ-পুণ্যের কি প্রভেদ—এগুলি সব মানুষের কুসংস্কার। ফলে তাঁহাদের আচরণে তাঁহারা কোন নৈতিক সংযম পালন করেন না। ইহা নিছক বদমাশি। এই ধরনের প্রচারের দ্বারা প্রভূত অনিষ্ট হয়।
পাপ ও পুণ্য—অনিষ্টকর পাপ ও হিতকর পুণ্য—এই দুই প্রকার কর্মের দ্বারা দেহ গঠিত। শরীরে কণ্টক বিদ্ধ হইলে ঐ কণ্টকটি তুলিয়া ফেলিবার জন্য অপর একটি কণ্টকের প্রয়োজন, পরে দুইটিই ফেলিয়া দিতে হয়। সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত কেহ পুণ্যরূপ কণ্টকের দ্বারা পাপরূপ কণ্টক দূর করেন। ইহার পরও তিনি জীবনধারণ করিতে পারেন এবং শুধু পুণ্য অবশিষ্ট থাকায় তাঁহার দ্বারা পুণ্যকর্মই অনুষ্ঠিত হয়। জীবন্মুক্তের মধ্যে কিঞ্চিন্মাত্র পুণ্য অবশিষ্ট থাকায় তিনি জীবিত থাকেন, কিন্তু তিনি যাহা কিছু করেন, তাহাই শুদ্ধ।
যাহা কিছু উন্নতির দিকে লইয়া যায়, তাহাই পুণ্য; যাহা হইতে আমাদের অবনতি, তাহাই পাপ। মানুষের মধ্যে তিন প্রকার গুণ আছে—পশুত্ব, মনুষ্যত্ব ও দেবত্ব। যাহা দেবত্বের উৎকর্ষ সাধন করে, তাহাই পুণ্য। যাহা দ্বারা পশুভাব বৃদ্ধি পায়, তাহাই পাপ। পাশব প্রকৃতি নাশ করিয়া মনুষ্যত্ব লাভ করিতে হইবে—অর্থাৎ প্রেমিক ও দয়ালু হইতে হইবে। এই অবস্থাও অতিক্রম করিয়া তোমাদিগকে সচ্চিদানন্দস্বরূপ হইতে হইবে—অগ্নির তেজ অথচ দাহ নাই, অপূর্ব প্রেম অথচ জাগতিক প্রেমের দুর্বলতা নাই, দুঃখবোধ নাই।
ভক্তি দুই প্রকার—বৈধী ও রাগানুগা। শাস্ত্রের অনুশাসনে দৃঢ় বিশ্বাসকে ‘বৈধী ভক্তি’ বলে। রাগানুগা ভক্তি পাঁচ প্রকার—(১) শান্ত—খ্রীষ্টধর্মে ইহা রূপায়িত হইয়াছে। (২) দাস্য—রামের প্রতি হনুমানের আচরণে উহা পরিস্ফুট। (৩) সখ্য—শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অর্জুনের ভাবের মধ্য দিয়া উহা প্রকাশিত। (৪) বাৎসল্য—শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বসুদেবাদির যে-ভাব, তাহাই বাৎসল্য। (৫) মধুরভাব—শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীগণের জীবনে মধুরভাবের (পতি-পত্নীর সম্বন্ধ) বিকাশ দেখা যায়।
কেশবচন্দ্র সেন সমাজকে একটি ডিম্বাকার (elliptic) কক্ষে পরিভ্রমণশীল গ্রহের সহিত তুলনা করিয়াছেন। ঈশ্বর কেন্দ্রগত সূর্য। গ্রহকক্ষের যে-বিন্দুটি সূর্যের নিকটতম, সমাজ কখনও সেই বিন্দুটির মত ঈশ্বরের সমীপবর্তী হয়, আবার কখনও সূর্য হইতে সর্বাপেক্ষা দূরে অবস্থিত বিন্দুটির ন্যায় ঈশ্বর হইতে দূরে সরিয়া যায়। অবতার আসিয়া ইহাকে ঈশ্বরের সমীপবর্তী করেন। পরে আবার ইহা দূরে সরিয়া যায়। কেন ঐরূপ হইবে? বলিতে পারি না। অবতারের প্রয়োজন কি? সৃষ্টির কি প্রয়োজন ছিল? ঈশ্বর কেন আমাদের সকলকে পূর্ণ করিয়া সৃষ্টি করেন না? ইহাই লীলা, ইহা আমাদের জ্ঞানের অগোচর।
মানুষ ব্রহ্মত্ব লাভ করিতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর হইতে পারে না। যদি কেহ ঈশ্বরত্ব লাভ করিয়া থাকেন, তবে তাঁহার রচিত সৃষ্টি দেখাও। বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি তাঁহার নিজের কল্পনামাত্র। ঐ সৃষ্টিকে বিশ্বামিত্রের নিয়মে চলিতে হইত। যদি যে-কেহ স্রষ্টা হইতে পারেন, তবে বহু নিয়মের সংঘর্ষের ফলে এই জগতের অবসান ঘটিবে। জগতের ভারসাম্য এরূপ সুন্দর যে, যদি একটি পরমাণুরও সাম্যাবস্থা ভঙ্গ কর, তবে সমগ্র জগৎ লয়প্রাপ্ত হইবে।
এমন সব মহাপুরুষ হইয়া গিয়াছেন, যাঁহাদের সহিত আমাদের বিপুল পার্থক্য কোন গাণিতিক অঙ্ক দ্বারা নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু ঈশ্বরের সহিত তুলনায় তাঁহারাও জ্যামিতিক বিন্দুমাত্র। অনন্তের সহিত তুলনায় সবই অকিঞ্চিৎকর। ঈশ্বরের সহিত তুলনা করিলে বিশ্বামিত্র একটি ক্ষুদ্র মনুষ্য-পতঙ্গ ব্যতীত আর কি?
আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে ক্রমবিকাশ-নীতির আদি প্রবর্তক হইলেন পতঞ্জলি।
জীব সাধারণতঃ পারিপার্শ্বিক অবস্থা অপেক্ষা দুর্বল, নিজেকে ঐ অবস্থার উপযোগী করিবার জন্য সংগ্রাম করিতেছে। কখনও কখনও তাহার ঐ উপযুক্ততা লাভের প্রচেষ্টা প্রয়োজনকে ছাড়াইয়া যায়। উহার ফলে তাহার সমগ্র শরীরের জাত্যন্তর ঘটে। নন্দী একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁহার পবিত্রতা এত বেশী হইয়াছিল যে, মানব-শরীরের পক্ষে উহা ধারণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং তাহার দেহকোষস্থিত পরমাণুগুলি দেব-দেহে পরিণত হইয়াছিল।
প্রতিযোগিতারূপ ভয়ঙ্কর যন্ত্রই সবকিছুকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। যদি বাঁচিয়া থাকিতে চাও তো নিজেকে যুগোপযোগী করিয়া তুলিবার চেষ্টা কর। আমরা যদি আদৌ বাঁচিয়া থাকিতে চাই, তাহা হইলে আমাদিগকে বিজ্ঞাননিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হইতে হইবে। মানসিক শক্তিই প্রকৃত বল। ইওরোপীয়দিগের সংগঠন-ক্ষমতা তোমাদের শিক্ষা করা আবশ্যক। তোমাদের নিজেদের শিক্ষিত হওয়া এবং মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ প্রথা রহিত করিতেই হইবে।
এই-সকল চিন্তা সমাজে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। তোমরা সকলেই ইহা জান, কিন্তু তোমরা কেহই ইহা কার্যে পরিণত করিতে সাহস কর না। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধিবে কে? উপযুক্ত সময়ে এক অদ্ভুত মহাপুরুষের আগমন হইবে। তখন সকল ইঁদুরই সাহস লাভ করিবে।
যখনই কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়, তখন সমুদয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাঁহার জন্য প্রস্তুত থাকে। তিনি যেন উটের পিঠের শেষ তৃণখণ্ডের মত। তিনি যেন কামানের গোলার স্ফুলিঙ্গ। তাঁহার কথায় কিছু একটা আছে—আমরা তাঁহার জন্য পথ প্রস্তুত করিতেছি।
কৃষ্ণ কি চতুর ছিলেন? না, চতুর ছিলেন না। যুদ্ধ নিবারণ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। দুর্যোধনই যুদ্ধ বাধাইয়াছিল। কিন্তু একবার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে উহা হইতে নিবৃত্ত হওয়া উচিত নয়—কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তির ইহাই ধর্ম। পশ্চাৎপদ হইও না, উহা কাপুরুষতার পরিচায়ক। একবার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে উহা অবশ্যই সম্পন্ন করিতে হইবে, এক ইঞ্চিও আর নড়া উচিত নয়—অবশ্য ইহা কোন অন্যায় কার্যের জন্য নয়। এই যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ।
শয়তান নানা ছদ্মবেশে আসে—ক্রোধ ন্যায়ের বেশে, কামনা কর্তব্যের রূপ লইয়া। শয়তানের প্রথম আবির্ভাব লোকে জানিতে পারিলেও পরে ভুলিয়া যায়। যেমন উকিলের বিবেকবুদ্ধি—প্রথমে তাহারা বেশ বুঝিতে পারে যে, সমস্তই দুষ্টামি (বদমাশি)—তারপর মক্কেলের প্রতি তাহাদের কর্তব্যবুদ্ধি আসে। অবশেষে তাহারা কঠোর হয়।
যোগিগণ নর্মদার তীরে বাস করেন, সেখানকার জলবায়ু সমভাবাপন্ন বলিয়া তাঁহাদের বাসের পক্ষে উত্তম। ভক্তগণ অবস্থান করেন বৃন্দাবনে।
সিপাহীরা শীঘ্র মারা যায়; প্রকৃতি ত্রুটিপূর্ণ; মল্লবীরগণের শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যু ঘটে। ভদ্রশ্রেণী সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী, আর দরিদ্রেরা সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু। কোষ্ঠবদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে ফলাহারই উপযুক্ত হইতে পারে। মস্তিষ্কের কাজ করিতে হয় বলিয়া সভ্য মানুষের বিশ্রাম প্রয়োজন এবং খাদ্যের সহিত তাহাকে মশলা ও চাটনি গ্রহণ করিতে হয়। অসভ্য লোকেরা প্রতিদিন চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল হাঁটে, সাদাসিধা খাদ্যই তাহাদের রুচিকর। আমাদের ফলগুলি সবই কৃত্রিম এবং স্বাভাবিক আম অতি সামান্য ফল। গমও কৃত্রিম।
ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া দেহে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয় কর।
গৃহস্থের আয় অনুযায়ী ব্যয় করিবার নিয়ম আছে। সে আয়ের এক চতুর্থাংশ পরিবারবর্গের ভরণপোষণ, এক চতুর্থাংশ দানকার্যে, এক চতুর্থাংশ নিজের জন্য ব্যয় করিবে এবং এক চতুর্থাংশ সঞ্চয় করিবে।
বহুত্বে একত্ব, সমষ্টিতে ব্যষ্টি—ইহাই সৃষ্টির রীতি।
শুধু কারণকে অস্বীকার করিতেছ কেন? কার্যকেও অস্বীকার কর। কার্যের মধ্যে যাহা কিছু আছে, তাহা সবই কারণের মধ্যে রহিয়াছে।
খ্রীষ্টের জীবন মাত্র আঠার মাস সাধারণের নিকট প্রকাশিত ছিল। ইহার জন্য তিনি বত্রিশ বৎসর ধরিয়া নীরবে নিজেকে প্রস্তুত করিয়াছিলেন। সর্বসাধারণের সংস্পর্শে আসিবার পূর্বে মহম্মদের চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছিল।
ইহা সত্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় জাতি-প্রথা আবশ্যক হয়। যাহাদের কোন বিশেষ কার্যের প্রবণতা আছে, তাহারা একশ্রেণীভুক্ত হয়। কিন্তু কোন বিশেষ ব্যক্তির শ্রেণী নির্ণয় করিবে কে? কোন ব্রাহ্মণ যদি মনে করেন, অধ্যাত্মবিদ্যাচর্চায় তাঁহার বিশেষ ক্ষমতা আছে, তাহা হইলে প্রকাশ্যভাবে শূদ্রের সহিত মিলিত হইতে তিনি ভয় পান কেন? কোন বলবান্ অশ্ব কি নিস্তেজ অশ্বের সহিত দৌড়ের প্রতিযোগিতা করিতে ভয় পায়?
‘কৃষ্ণ–কর্ণামৃতের’ রচয়িতা ভক্ত বিল্বমঙ্গলের জীবনী উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারেন নাই বলিয়া তিনি নিজের দুইটি চোখ উৎপাটন করিয়াছিলেন। বিপথগামী ভালবাসাও যে পরিণামে প্রকৃত প্রেমে পরিণত হইতে পারে তাঁহার জীবন উহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
অত্যন্ত আগে ধর্মের ক্ষেত্রে উন্নতি এবং সর্ববিষয়ে সূক্ষ্মদৃষ্টি—এই দুইটির জন্য হিন্দুগণ সর্বদা উচ্চতর তত্ত্ব লইয়া ব্যাপৃত থাকিতেন। ইহার ফলে তাঁহারা ঐহিক বিষয়ে বর্তমান অবস্থায় পতিত হইয়াছেন। হিন্দুগণকে পাশ্চাত্যের নিকট কিঞ্চিৎ বস্তুতন্ত্রবাদ শিক্ষা করিতে হইবে এবং ইহার পরিবর্তে পাশ্চাত্যকে কিছু আধ্যাত্মিকতা শিখাইতে হইবে।
তোমাদের নারীগণকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও। তারপর তাহারাই বলিবে, কোন্ জাতীয় সংস্কার তাহাদের পক্ষে আবশ্যক। তাহাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে কথা বলিবার তোমরা পুরুষরা কে?
ভাঙ্গী ও পারিয়াগণের বর্তমান অধঃপতিত অবস্থার জন্য দায়ী কাহারা? আমাদের হৃদয়হীন ব্যবহার ও সেই সঙ্গে অদ্ভুত অদ্বৈতবাদ-প্রচার—ইহা কি আঘাতের উপর অপমান নয়?
এই জগতে সাকার ও নিরাকার পরস্পর সম্বদ্ধ। নিরাকারকে সাকারের মধ্য দিয়াই প্রকাশ করা যাইতে পারে, আবার নিরাকারের পটভূমিতেই সাকারকে চিন্তা করা যাইতে পারে। আমাদের চিন্তারই বাহ্যরূপ জগৎ। প্রতিমা ধর্মেরই অভিব্যক্তি।
ঈশ্বরে যাবতীয় জীবপ্রকৃতি বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ আমরা কেবল মানব-প্রকৃতির মধ্য দিয়াই তাঁহাকে দর্শন করিতে পারি। যেমন পিতা বা পুত্ররূপে আমরা মানুষকে ভালবাসি, তেমনি ঈশ্বরকে ভালবাসিতে পারি। নর ও নারীর মধ্যে যে প্রেম, তাহাই প্রবলতম প্রেম, উহাও আবার যত গোপনীয় হইবে ততই দৃঢ়তর হইবে। এই প্রেম শ্রীভগবানের প্রতি কিভাবে প্রযুক্ত হইতে পারে, তাহা রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মধ্য দিয়াই ব্যক্ত হইয়াছে।
মানুষ পাপী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে—এ-কথা বেদে কোথাও কোথাও নাই। মানুষকে পাপী বলা মনুষ্যত্বের ঘোরতর অমর্যাদা করা।
সত্যকে সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করার অবস্থা লাভ করা সহজ নয়। সেদিন সমগ্র চিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত বিড়ালটিকে কেহ খুঁজিয়া পায় নাই, যদিও চিত্রের অধিকাংশ স্থান ব্যাপিয়াই বিড়ালটি ছিল।
কাহাকেও আঘাত করিয়া তুমি স্থিরভাবে বসিয়া থাকিতে পার না। সৃষ্টি এক অদ্ভুত যন্ত্র। ঈশ্বরের প্রতিশোধ হইতে পরিত্রাণ লাভের উপায় নাই।
কাম অন্ধ, মানুষকে নরকে লইয়া যায়। ভালবাসাই প্রেম, ইহা স্বর্গে লইয়া যায়।
কৃষ্ণ-রাধার প্রেমে কামের লেশ নাই। রাধা কৃষ্ণকে বলেন, ‘তুমি যদি আমার বুকে পদা স্থাপন কর, তাহা হইলে আমার সকল কাম দূরীভূত হইবে।’ ভগবানের প্রতি অনুরাগ হইলে কাম চলিয়া যায়, তখন থাকে শুধু প্রেম।
জনৈক কবি এক রজকিনীকে ভালবাসিতেন। স্ত্রীলোকটির পায়ে গরম ডাল পড়িয়াছিল, তাহার ফলে কবির চরণ পুড়িয়া যায়।
শিব ঈশ্বরের সুশান্ত প্রকাশ, কৃষ্ণে প্রকাশ ঈশ্বরের মাধুর্য। প্রেম ঘনীভূত হইয়া নীলরঙে পরিণত হয়। নীলরঙ প্রগাঢ় প্রেমের দ্যোতক। সলোমন ‘কৃষ্ণ’কে দর্শন করিয়াছিলেন। এখানে (ভারতে) অনেকেই কৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছে।
এখনও হৃদয়ে বিশুদ্ধ প্রেম জাগিলে রাধাকে দর্শন করা যায়। রাধা হইয়া যাও এবং মুক্ত হও। নান্যঃ পন্থাঃ। খ্রীষ্টানেরা সলোমনের সঙ্গীতের মর্মগ্রহণ করিতে পারে না। তাহাদের মতে—ইহা চার্চের প্রতি খ্রীষ্টের গভীর অনুরাগের প্রতীক—ভবিষ্যদ্বাণী। তাহাদের নিকট ঐ সঙ্গীত অর্থহীন এবং সেজন্য উহার সম্পর্কে কোন কাহিনী সৃষ্টি করে।
হিন্দুগণ বুদ্ধকে অবতার বলিয়া বিশ্বাস করে। ঈশ্বরের প্রতি তাহাদের দৃঢ় বিশ্বাস। ভগবান্ আছেন কি নাই, বৌদ্ধেরা তাহা জানিবার চেষ্টা করে না। কশাঘাত করিয়া আমাদিগকে কর্মে তৎপর করিবার জন্যই বুদ্ধের আবির্ভাব। সৎ হও, রিপুগুলি দমন কর। তখন নিজেই জানিতে পারিবে, দ্বৈত বা অদ্বৈত দর্শনের কোন্টি সত্য—তত্ত্ব এক বা বহু। বুদ্ধ হিন্দুধর্মের একজন সংস্কারক ছিলেন।
একই ব্যক্তির মধ্যে মাতা দেখেন সন্তানকে, আবার পত্নী দেখেন অন্যভাবে। ইহার ফলও বিভিন্ন। মন্দ ব্যক্তি ঈশ্বরের মধ্যে দেখে মন্দ, ধার্মিক তাঁহার মধ্যে দেখেন পুণ্য। ঈশ্বরকে সকল রূপেই চিন্তা করা যায়। প্রত্যেকের ভাব অনুযায়ী তিনি রূপ পরিগ্রহ করেন। বিভিন্ন পাত্রে জল বিভিন্ন আকার ধারণ করে, কিন্তু সকল পাত্রেই জল আছে। অতএব সকল ধর্মই সত্য।
ঈশ্বর নিষ্ঠুর, আবার নিষ্ঠুর নন। তিনি সর্বভূতে আছেন আবার নাই। অতএব তিনি পরস্পরবিরুদ্ধ-ভাবময়। প্রকৃতিও পরস্পর-বিরোধী ভাবরাশি ব্যতীত আর কিছুই নয়।
===================
ভাবী সভ্যতার দিঙ্নির্ণয়
শুধু আধ্যাত্মিক জ্ঞানই আমাদের দুঃখরাশির আত্যন্তিক নিবৃত্তি করিতে পারে। অন্য যে-কোন জ্ঞান কিছু সময়ের জন্য মাত্র আমাদের অভাব মিটাইতে পারে। আত্মজ্ঞানের উন্মেষ হইলেই অভাববোধ চিরতরে বিদূরিত হয়।
দৈহিক শক্তির বিকাশ অবশ্যই বড় কথা; বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধী যন্ত্রসমূহের মধ্য দিয়া মনীষার যে অভিব্যক্তি দেখা যায়, তাহাও অদ্ভুত বটে; তবুও আত্মিক শক্তি জগতের উপর যে প্রভাব বিস্তার করে, তাহার তুলনায় এই সব শক্তি নগণ্য।
যন্ত্র কখনও মানুষকে সুখী করিতে পারে নাই, কখনও পারিবে না। যাহারা যন্ত্রসভ্যতার মাহাত্ম্য প্রচার করে, তাহাদের মতে যন্ত্রের মধ্যেই সুখ নিহিত। বাস্তবিকপক্ষে সুখের উদ্ভব ও স্থিতি মনেই। মন যাহার বশে, সে-ই কেবল সুখী, অপর কেহ নয়। সমগ্র পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করিবার শক্তিও যদি পাও, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেকটি পরমাণুকে যদি করতলগত করিতে পার, তাহাতেই বা তোমার কি লাভ? বস্তুতঃ প্রকৃতিকে জয় করিবার জন্যই মানুষের জন্ম; পাশ্চাত্য জনগণ ‘প্রকৃতি’ বলিতে স্থূল অর্থাৎ বহিঃপ্রকৃতিকেই বুঝিয়া থাকে। অশেষ শক্তির আধার নদী, পর্বত, সাগর প্রভৃতি অসংখ্য বৈচিত্র্যের সমাবেশে এই বহিঃপ্রকৃতি সত্যই বিরাট! কিন্তু ইহা অপেক্ষাও এক মহত্তর প্রকৃতি—মানুষের অন্তর্জগৎ। এই অন্তর্জগতের সমীক্ষাতেই প্রাচ্যপ্রতিভা সম্যক বিকশিত হইয়াছে, যেমন বহির্জগতের ক্ষেত্রে প্রতীচ্য প্রতিভা।
পাশ্চাত্য দেশে ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জগৎ যেমন সত্য, প্রাচ্যে অতীন্দ্রিয় জগৎ সেইরূপ। মানব জাতির অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্য আদর্শের প্রয়োজন রহিয়াছে; বোধহয় সে প্রয়োজন আরও বেশী।
পার্থিব ক্ষমতায় শক্তিশালী জাতিগুলি মনে করে যে, ঐ শক্তিই একমাত্র কাম্য, উহাই প্রগতি ও সংস্কৃতি; যাহাদের বিত্ত-লালসা নাই, ঐহিক প্রতাপ নাই—তাহারা বাঁচিয়া থাকিবার অযোগ্য। পক্ষান্তরে অন্য কোন জাতি মনে করিতে পারে—নিছক জড়বাদী সভ্যতা একান্ত নিরর্থক! প্রত্যেকটিরই নিজস্ব গুরুত্ব ও মহিমা আছে। এই দুইটি আদর্শের মিলন ও সামঞ্জস্যই হইবে বর্তমানকালের মীমাংসা।
=============
পত্রালাপে প্রশ্নোত্তর
[ভগিনী নিবেদিতার কয়েকটি প্রশ্ন ও স্বামীজীর সংক্ষিপ্ত উত্তরঃ ১৯০০ খ্রীঃ ২৪ মে, সান্ ফ্রান্সিস্কো]
প্রশ্ন—পৃথ্বীরায় ও চাঁদ যখন কান্যকুব্জে স্বয়ম্বরে যেতে মনঃস্থ করেন, তখন তাঁরা কাদের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন—তা মনে করতে পারছি না।
উত্তর—উভয়েই চারণের বেশে গিয়াছিলেন।
প্র—পৃথ্বীরায় যে সংযুক্তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, তা কি এই জন্য যে, সংযুক্তা ছিলেন অসামান্যা রূপসী এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দুহিতা? সংযুক্তার পরিচারিকা হবার জন্য তিনি কি নিজের একজন দাসীকে শিখিয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং এই বৃদ্ধা ধাত্রীই কি রাজকুমারীর মনে পৃথ্বীরায়ের প্রতি ভালবাসার বীজ অঙ্কুরিত করেছিল?
উ—পরস্পরের রূপগুণের বর্ণনা শুনে ও আলেখ্য দেখে তাঁরা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আলেখ্য-দর্শনে নায়ক-নায়িকার মনে পূর্বরাগের সঞ্চার ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন রীতি।
প্র—কৃষ্ণ যে গোপবালকদের মধ্যে প্রতিপালিত হয়েছিলেন, তার কারণ কি?
উ—এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, কৃষ্ণ কংসকে সিংহাসনচ্যুত করবেন। পাছে জন্মের পর কৃষ্ণ কোথাও গোপনে লালিত পালিত হন, সেই ভয়ে দুরাচার কংস কৃষ্ণের পিতামাতাকে (যদিও তাঁরা ছিলেন কংসের ভগ্নী ও ভগ্নীপতি) কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল এবং এই আদেশ দিয়েছিল যে, সেই বৎসরে রাজ্যের মধ্যে যত বালক জন্মাবে, সকলকেই হত্যা করা হবে। অত্যাচারী কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই কৃষ্ণের পিতা কৃষ্ণকে গোপনে নদী পার করেছিলেন।
প্র—তাঁর জীবনের এ অধ্যায় কিভাবে শেষ হয়?
উ—অত্যাচারী কংসের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে তিনি নিজে ভাই বলদেব ও পালক-পিতা নন্দের সঙ্গে রাজসভায় যান। অত্যাচারী তাঁকে বধ করবার ষড়যন্ত্র করেছিল। তিনি অত্যাচারীকে বধ করলেন, কিন্তু নিজে রাজ্য অধিকার না করে কংসের নিকটতম উত্তরাধিকারীকে সিংহাসনে বসালেন। কর্মের ফল তিনি নিজে কখনও ভোগ করতেন না।
প্র—এই সময়কার কোন চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলতে পারেন কি?
উ—কৃষ্ণের এই সময়কার জীবন অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ। শৈশবে তিনি বড়ই দুরন্ত ছিলেন। দুষ্টামির জন্য তাঁর গোপিনী মাতা একদিন তাঁকে মন্থনরজ্জু দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্ত রজ্জু একত্র জুড়েও তার দ্বারা তিনি তাঁকে বাঁধতে পারলেন না। তখন তাঁর চোখ খুলে গেল, আর তিনি দেখলেন যে, যাঁকে তিনি বাঁধতে যাচ্ছেন, তাঁর দেহে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড অধিষ্ঠিত। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ভগবানের স্তুতি আরম্ভ করলেন। ভগবান্ তখন তাঁকে আবার মায়া দ্বারা আবৃত করলেন; আর তিনি শুধু বালকটিকেই দেখতে পেলেন।
পরব্রহ্ম যে গোপবালক হয়েছেন, এ-কথা দেবশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার বিশ্বাস হল না। তাই পরীক্ষা করবার জন্য একদা তিনি ধেনুগুলি ও গোপবালকদিগকে চুরি করে এক গুহার মধ্যে ঘুমপাড়িয়ে রেখে দিলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন যে, সেই-সব ধেনু ও বালক কৃষ্ণকে ঘিরে বিরাজ করছে! তিনি আবার সেই নতুন দলকে চুরি করলেন এবং লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, তারা যেমন ছিল, তেমনি সেখানেই রয়েছে। তখন তাঁর জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত হল, তিনি দেখতে পেলেন—অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড এবং সহস্র সহস্র ব্রহ্মা কৃষ্ণের দেহে বিরাজমান।
কালীয় নাগ যমুনায় জল বিষাক্ত করছিল বলে তিনি ফণার উপর নৃত্য করছিলেন। ইন্দ্রের পূজা তিনি বারণ করাতে ইন্দ্র কুপিত হয়ে এরূপ প্রবলবেগে বারিবর্ষণ আরম্ভ করলেন যেন সমস্ত ব্রজবাসী বন্যার জলে ডুবে মরে, তখন কৃষ্ণ গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন। কৃষ্ণ একটিমাত্র অঙ্গুলি দ্বারা গোবর্ধন পর্বতকে ছাতার মত ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন, আর তার নীচে ব্রজবাসিগণ আশ্রয় গ্রহণ করল।
শৈশব থেকেই তিনি নাগপূজা ও ইন্দ্রপূজার বিরোধী ছিলেন। ইন্দ্রপূজা একটি বৈদিক অনুষ্ঠান। গীতার সর্বত্র ইহা স্পষ্ট যে, তিনি বৈদিক যাগযজ্ঞের পক্ষপাতী ছিলেন না।
জীবনের এই সময়েই তিনি গোপীদের সঙ্গে লীলা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স পনর বৎসর।
=================
একটি অপরূপ পত্রালাপ
[এই পত্রালাপটি যথাযথভাবে উপভোগ করিতে হইলে পাঠকদের জানিতে হইবে, কোন্ ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া এই পত্রালাপ শুরু হয় এবং পত্র ব্যবহারকারীদের মধ্যে কী সম্বন্ধ ছিল। প্রথম পত্রের গোড়ার দিকে স্বামীজী লিখিয়াছেন, তিনি জোড় আঘাত দিয়াছেন। সেটা আর কিছু নয়, নিজ আচরণের সমর্থনে ১৮৯৫ খ্রীঃ ১ ফেব্রুয়ারী একটি অত্যন্ত কড়া চিঠি তিনি পত্রোদ্দিষ্টাকে লিখিয়াছিলেন। সেই অপূর্ব পত্রটিতে স্বামীজীর সন্ন্যাসী-সত্তা অগ্নিবৎ জ্বলিয়া উঠিয়াছে। এই কবিতাকার পত্রগুচ্ছ পড়িবার পূর্বে সেই পত্রটি পড়া প্রয়োজন। পত্রোদ্দিষ্টা মেরী হেল মিঃ ও মিসেস হেলের (স্বামীজী যাঁহাদের ফাদার পোপ ও মাদার চার্চ বলিতেন) দুই কন্যার একজন। ঐ দুই হেল-ভগিনী এবং তাঁহাদের সম্পর্কিত আরও দুই ভগিনীকে স্বামীজী নিজের ভগিনীর মত দেখিতেন, এবং তাঁহারাও স্বামীজীকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে গ্রহণ করিয়াছিলেন। স্বামীজীর কয়েকটি মূল্যবান্ চিঠি এই ভগিনীদের উদ্দেশে লেখা।
বর্তমান পত্রালাপে স্বামীজীকে এক নূতন আলোকে দেখা যায়—রঙ্গপ্রিয় অথচ একান্ত গম্ভীর পরিহাসের মধ্যেও তাঁহার জীবনের মূলভিত্তি ব্রহ্মজ্ঞান ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই পত্রালাপের প্রথম চিঠিটি নিউ ইয়র্ক হইতে ১৮৯৫ খ্রীঃ ১৫ ফেব্রুয়ারী লেখা। সম্পাদক]
শোন আমার বোনটি মেরী,
হয়ো না দুখী—যদিও ভারী
ঘা খেয়েছ, তবুও জান
জান বলেই বলিয়ে নাও—
আমি তোমায় ভালবাসি
সারাটা এই হৃদয় দিয়ে।
বলতে পারি বাজি রেখে—
সেই শিশুরা বন্ধু আমার
রইবে চির দুঃখে সুখে,
আমিও তাদের বন্ধু তেমন,
জান তুমি মেরী-শিশু
ভালভাবেই জান তাহা।
*সর্প যদি পদাহত ধরে তার ফণা,
অগ্নি যদি সমুদ্যত—শিখা লক্লক্,
প্রতিধ্বনি ঘুরে ফিরে রিক্ত মরুভূমে
দীর্ণবক্ষ সিংহ যবে গর্জে ঘোর রোষে।
বিদ্যুতের বাণবিদ্ধ মহামেঘরাশি
বন্যাশক্তি উন্মোচন করে বজ্রস্বরে,
সেইমত মহাপ্রাণ মুক্ত মহাদানে
আত্মা যবে আলোড়িত সত্তার গভীরে।
ম্লান হোক আঁখি-তারা, প্রাণ হোক ক্ষীণ,
বন্ধু নাই, প্রেম হোক অবিশ্বাসে লীন,
ভয়ঙ্কর ভাগ্য যদি হানে মৃত্যুভয়,
ঘনীভূত অন্ধকারে রুদ্ধ যদি পথ,
প্রকৃতি বিরূপ যদি ভ্রুকুটি-কুটিল
তব ধ্বংস চায় তবু জেন—তুমি সেই।
তুমি দিব্য, ধাও ধাও, সম্মুখেতে শুধু,
ধাও নিজ লক্ষ্য পানে নিত্যগতি ধরি।
দেব নহি, আমি নহি পশু কিম্বা নর,
দেহ নহি, মন নহি, নারী বা পুরুষ,
শাস্ত্র স্তব্ধ সবিস্ময়ে আমা পানে চাহি,
আমার প্রকৃতি ঘোষে—‘আমি সেই’ বাণী।
সূর্য চন্দ্র নক্ষত্রের জন্মিবার আগে
ছিনু আমি, যবে নাহি ছিল পৃথ্বী ব্যোম্,
নাহি ছিল মহাকাল, ‘সেও’ নাহি ছিল,
ছিলাম, রয়েছি আমি, রব চিরকাল।
এ পৃথিবী অপরূপা, এ সূর্য মহান্
চন্দ্রমা মধুর এত, তারকা আকাশ—
কার্য-কারণেতে বাঁধা সৃষ্টি সকরুণ
বন্ধনে জীবন তার, বন্ধনে মরণ।
মন তার মায়াময় জাল ছুঁড়ে দেয়,
বেঁধে ফেলে একেবারে নির্মম নিষ্পেষে;
পৃথিবী, নরক, স্বর্গ—ভাল ও মন্দের
চিন্তা আর ভাবনার ছাঁচ গড়ে ওঠে।
জেন কিন্তু—এ সকলই ফেনপুঞ্জবৎ
স্থান কাল পাত্র আর কার্য ও কারণ,
আমি কিন্তু ঊর্ধ্বচারী ইন্দ্রিয় মনের
নিত্য দ্রষ্টা সাক্ষী আমি এই সৃষ্টি মাঝে।
দুই নয়, বহু নয়, এক—শুধু এক,
তাইতো আমার মাঝে আছে সব ‘আমি’,
অনিবার তাই প্রেম,—ঘৃণা অসম্ভব;
‘আমি’ হতে আমারে কি সরান সম্ভব?
স্বপ্ন হতে জেগে ওঠ, বন্ধ কর নাশ
হও অভী, বল বীরঃ নিজ দেহ-ছায়া
ভীত আর নাহি করে, ওগো মৃত্যুঞ্জয়
আমি ব্রহ্ম, এই চির সত্য জ্যোতির্ময়।*৬
আমার কবিতা এই পর্যন্ত। আশা করি তোমরা সকলে কুশলে আছ। মাদার চার্চ এবং ফাদার পোপকে ভালবাসা জানিও। আমি এত ব্যস্ত যে মরবার সময় নেই, এক ছত্র লেখবার পর্যন্ত সময় নেই। অতএব ভবিষ্যতে যদি লিখতে দেরী হয় ক্ষমা কর।
তোমাদের চিরকালের
বিবেকানন্দ
মিস্ মেরী হেল উত্তরে লিখে পাঠালেনঃ
‘কবি হব আমি’ এই সাধনায়
সন্ন্যাসী মহাবীর
সুর ভেঁজে যান প্রাণ পণ রেখে,
নিতান্ত গম্ভীর।
ভাবে ও বচনে অজেয় যে তিনি
সন্দেহ কিছু নাই,
গোল এক শুধু ছন্দ নিয়েই
কেমন যে সামলাই!
কোন ছত্রটি অতি দীর্ঘ যে
কোনটি অতীব হ্রস্ব,
রূপ মেলে নাকো ভাবের সহিত—
কবিতা হয় না অবশ্য।
মহাকাব্য না গীতিকাব্য সে
কিম্বা চৌদ্দপদী?
সেই ভাবনায় খেটে খেটে হায়
হল অজীর্ণব্যাধি।
যতদিন থাকে ঐ কবি-ব্যাধি
অরুচি খাদ্যে তাঁর,
সে খাদ্য যদি নিরামিষ হয়,
লিয়ন৭ রাঁধুনী যার।
তবুও চলে না, চলিতে পারে না;
স্বামীজী ব্যস্ত অদ্য,
সযতনে রাঁধা খানা পড়ে থাক,
লিখিছেন তিনি পদ্য।
একদিন তিনি সুখাসীন হয়ে
একান্ত ভাবমগ্ন,
সহসা আলোক আসিয়া তাঁহার
চারিপাশে হল লগ্ন।
‘শান্ত ক্ষুদ্র কণ্ঠ’ একটি
নাড়া দিল ভাব তাঁর
শব্দ জ্বলিতে লাগিল যেমন
জ্বলন্ত অঙ্গার।
সত্যই তারা অঙ্গার যেন
আমার উপরে হায়
বর্ষিত হল, অনুতাপে মরি,
বোনটি যে ক্ষমা চায়।
ভর্ৎসনা-ভরা পত্রের তরে
দুঃখের সীমা নাই,
বারবার বলি, ক্ষমা চাই আমি
চাই, চাই, ক্ষমা চাই!
যে-কটি ছত্র পাঠায়েছ তুমি,
তোমার ভগিনীগণ
নিশ্চয় জেন স্মরণে রাখিবে
বাঁচিবে যতক্ষণ।
কারণ তাদের দেখায়ে দিয়েছ
অতীব পরিষ্কার—
‘যাহা কিছু আছে, সব কিছু তিনি’
ইহাই সত্য সার।
উত্তরে স্বামীজী লিখলেনঃ
সেই পুরাকালে
গঙ্গার কূলে—করে রামায়ণ গান
বৃদ্ধ কথক বুঝায়ে চলেন
দেবতারা সব—কেমনে আসেন যান
অতি চুপে চুপে
সীতারাম-রূপে
আর, নিরীহ সীতার—চোখের জলেতে বান!
কথা হল শেষ
শ্রোতারা সকলে ঘরে ফিরে চলে
পথে যেতে যেতে মনের মাঝেতে
ভাসিছে কথার রেশ।
তখন জনতা হতে
একটি ব্যাকুল উচ্চ কণ্ঠ লাগিল জিজ্ঞাসিতে—
‘ঐ যে সীতারাম
কিছুই না বুঝিলাম,
কারা ওঁরা তাই বলে দিন আজ, যদি বুঝি কোন মতে।’
তাই মেরী হেল, তোমাকেও বলি—
আমার শেখান তত্ত্ব না বুঝে, সকলি করিলে মাটি!
আমি তো কখনও বলিনি কাকেও—
‘সব ভগবান্’—অর্থবিহীন অদ্ভুত কথাটি!
এটুকু বলেছি মনে রেখে দিও
ঈশ্বরই ‘সৎ’, বাকী যা অসৎ—একেবারে কিছু নয়।
পৃথিবী স্বপ্ন, যদিও সত্য বলে তা মানতে হয়!
একটি মাত্র সত্য বুঝেছি জীবন্ত ভগবান্
যথার্থ ‘আমি’— তিনি ছাড়া কিছু নয়!
পরিণামশীল এ জড়জগৎ আমি নয়, আমি নয়।
তোমরা সকলে জানিও আমার ভালবাসা অফুরান।
বিবেকানন্দ
মিস্ মেরী হেল লিখলেনঃ
বুঝতে পেরেছি অতি সহজেই
তফাতটা কোথা রইল—
তৈল-আধার পাত্রের সাথে
পাত্র-আধার তৈল!
সে তো সোজা অতি—সোজা প্রস্তাব
একটি প্রত্যবায়—
প্রাচ্য যুক্তি বুঝতে সাধ্য
শক্তি নাইকো হায়!
যদি ‘ভগবান্ কেবল সত্য
মিথ্যা যা কিছু আর,’
যদি ‘পৃথিবীটা স্বপ্ন’ তা হলে
রইল কি বাকী আর
ভগবান্ ছাড়া? তাইতো শুধাই
তুমি যে বলেছ দাদা,
‘বহু দেখে যারা তাদের মরণ’,
এবং বলেছ সাদা—
‘একের তত্ত্ব যাহারা বুঝেছে,
মুক্তি তাদের স্থির’—
তবুও আমার সামান্য কথা
বলিতেছি অতি ধীরঃ
সব কিছু তিনি, এই কথা ছাড়া
আর কিছু নাহি জানি,
আমি যদি থাকি, তাঁহার ভিতরে
আমারও ভিতরে তিনি।
স্বামীজী উত্তরে লিখলেনঃ
মেজাজটা খর, বালা অপূর্ব,
প্রকৃতির কিবা খেয়াল মরি!
সুন্দরী নারী, সন্দেহ নেই,
দুর্লভ-আত্মা কুমারী মেরী।
গভীর আবেগে ঠেলেঠুলে ওঠে
চাপা দিতে তার সাধ্য নাই,
দেখতেই পাই মুক্ত সত্তা
আগ্নেয় তার স্বভাবটাই।
গানে বাজে তার রাসভ-রাগিণী,
পিয়ানোতে বাজে মধুর রেশ!
ঠাণ্ডা হৃদয়ে সাড়া যে পায় না
মনেতে যাদের বরের বেশ!
শুনেছি ভগিনী তাদের মুখেতে
তোমার রূপের প্রভাব ঘোর!
সাবধানে থেক, নুয়োনা, প’রোনা
যত মধুর হোক—শিকল ডোর।
শীঘ্র শুনিবে আর এক সুর
চাঁদে-পাওয়া সেই তোমার সাথী;
তার সাধে বাদ তোমার কথায়,
নিবে যাবে তার জীবন-ভাতি।
এ-কটি পঙ্ক্তি ভগিনী মেরী,
প্রত্যুপহার গ্রহণ কর।
‘যেমন কর্ম তেমনি তো ফল’—
সন্ন্যাসী জেন জবাবে দড়।
===========
0 Comments