সপ্তম খণ্ড-রামকৃষ্ণ কথামৃত-চতুর্থ ভাগ

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

সপ্তম খণ্ড
দক্ষিণেশ্বরে গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তরঙ্গসঙ্গে

সপ্তম খণ্ড-রামকৃষ্ণ কথামৃত-চতুর্থ ভাগ

==========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৫ই ডিসেম্বর
প্রহ্লাদচরিত্র শ্রবণ ও ভাবাবেশ — যোষিৎসঙ্গ নিন্দা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে মেঝেতে বসিয়া প্রহ্লাদ চরিত্র শুনিতেছেন। বেলা ৮ টা হইবে। শ্রীযুক্ত রামলাল ভক্তমাল গ্রন্থ হইতে প্রহ্লাদিচরিত্র পড়িতেছেন।

আজ শনিবার, (১লা পৌষ) অগ্রাহায়ণ কৃষ্ণা প্রতিপদ; ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮৮ত খ্রীষ্টাব্দ। মণি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার পদছায়ায় বাস করিতেছেন; — তিনি ঠাকুরের কাছে বসিয়া প্রহ্লাদচরিত্র শুনিতেছেন। ঘরে শ্রীযুক্ত রাখাল, লাটু, হরিশ; কেহ বসিয়া শুনিতেছেন, — কেহ যাতায়াত করিতেছেন। হাজরা বারান্দায় আছেন।

ঠাকুর প্রহ্লাদচরিত্র কথা শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। যখন হিরণ্যকশিপু বধ হইল, নৃসিংহের রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ও সিংহনাদ শুনিয়া ব্রহ্মাদি দেবতারা প্রলয়াশঙ্কায় প্রহ্লাদকেই নৃসিংহের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। প্রহ্লাদ বালকের ন্যায় স্তব করিতেছেন। ভক্তবৎসল স্নেহে প্রহ্লাদের গা চাটিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “আহা! আহা! ভক্তের উপর কি ভালবাসা!” বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবসমাধি হইল! স্পন্দহীন, — চক্ষের কোণে প্রেমাশ্রু!

ভাব উপশমের পর ঠাকুর ছোট খাটখানিতে গিয়া বসিয়াছেন। মণি মেঝের উপর তাঁহার পাদমূলে বসিলেন। ঠাকুর তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঈশ্বরের পথে থাকিয়া যাহারা স্ত্রীসঙ্গ করে তাহাদের প্রতি ঠাকুর ক্রোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — লজ্জা হয় না। ছেলে হয়ে গেছে আবার স্ত্রীসঙ্গ! ঘৃণা করে না! — পশুদের মতো ব্যবহার! নাল, রক্ত, মল, মূত্র — এ-সব ঘৃণা করে না! যে ভগবানের পাদপদ্ম চিন্তা করে, তার পরমাসুন্দরী রমণি চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। যে শরীর থাকবে না — যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্মা, যতপ্রকার অপবিত্র জিনিস — সেই শরীর নিয়ে আনন্দ। লজ্জা হয় না!

[ঠাকুরের প্রেমানন্দ ও মা-কালীর পূজা ]

মণি চুপ করিয়া হেঁটমুখ হইয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন — তাঁর প্রেমের এ কবিন্দু যদি কেউ পায় কামিনী-কাঞ্চন অতি তুচ্ছ বলে বোধ হয়। মিছরির পানা পেলে চিটেগুড়ের পানা তুচ্ছ হয়ে যায়। তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করলে, তাঁর নামগুণ সর্বদা কীর্তন করলে — তাঁর উপর ভালবাসা ক্রমে হয়।

এই বলিয়া ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া ঘরের মধ্যে নাচিয়া বেড়াইতে লাগিলেন ও গান গাইতে লাগিলেন:

সুরধনীর তীরে হরি বলে কে, বুঝি প্রেমদাতা নিতাই এসেছে।
(নিতাই নইলে প্রাণ জুড়াবে কিসে)।

প্রায় ১০টা বাজে। শ্রীযুক্ত রামলাল কালীঘরে মা-কালীর নিত্যপূজা সাঙ্গ করিয়াছেন। ঠাকুর মাকে দর্শন করিবার জন্য কালীঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন। মন্দিরে প্রবিষ্ট হইয়া ঠাকুর আসনে উপবিষ্ট হইলেন। দুই-একটি ফুল মার চরণে দিলেন। নিজের মাথায় ফুল দিয়া ধ্যান করিতেছেন। এইবার গীতচ্ছলে মার স্তব করিতেছেন:

ভবহারা ভয়হারা নাম শুনেছি তোমার।
তাইতে এবার দিয়েছি ভার, তারো তারো না তারো মা।

ঠাকুর কালীঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাঁর ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় বসিয়াছেন। বেলা ১০টা হইবে। এখনও ঠাকুরদের ভোগ ও ভোগারতি হয় নাই। মা-কালী ও রাধাকান্তের প্রসাদি মাখন ও ফলমূল হইতে কিছু লইয়া ঠাকুর জলযোগ করিয়াছেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরাও কিছু কিছু পাইয়াছেন।

ঠাকুরের কাছে বসিয়া রাখাল Smiles’ Self-Help পড়িতেছেন, — Lord Erskine-এর বিষয়।

[নিষ্কামকর্ম — পূর্ণজ্ঞানী গ্রন্থ পড়ে না ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — ওতে কি বলছে?

মাস্টার — সাহেব ফলাকাঙ্ক্ষা না করে কর্তব্য কর্ম করতেন, — এই কথা বলছে। নিষ্কামকর্ম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তবে তো বেশ! কিন্তু পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ — একখানাও পুস্তক সঙ্গে থাকবে না। যেমন শুকদেব — তাঁর সব মুখে।

“বইয়ে — শাস্ত্রে — বালিতে চিনিতে মিশেল আছে। সাধু চিনিটুকু লয়ে বালি ত্যাগ করে। সাধু সার গ্রহণ করে।”

শুকদেবাদির নাম করিয়া ঠাকুর কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বুঝাইতেছেন?

বৈষ্ণবচরণ কীর্তনিয়া আসিয়াছেন। তিনি সুবোলমিলন কীর্তন শুনাইলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীযুত রামলাল থালায় করিয়া ঠাকুরের জন্য প্রসাদ আনিয়া দিলেন। সেবার পর — ঠাকুর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিলেন।

রাত্রে মণি নবতে শয়ন করিলেন। শ্রীশ্রীমা যখন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুরের সেবার জন্য আসিতেন তখন এই নবতেই বাস করিতেন। কয়েকমাস হইল তিনি কামারপুকুর শুভাগমন করিয়াছেন।
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৬ই ডিসেম্বর

শ্রীরাখাল, লাটু, জনাইয়ের মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় বসিয়া আছেন। সম্মুখে দক্ষিণবাহিনী ভাগীরথী। কাছেই করবী, বেল, জুঁই, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি নানা কুসুমবিভূষিত পুষ্পবৃক্ষ। বেলা ১০টা হইবে।

আজ রবিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর মণিকে দেখিতেছেন ও গান গাইতেছেন:

তারিতে হবে মা তারা হয়েছি শরণাগত।
হইয়া রয়েছি যেন পিঞ্জরের পাখির মতো ৷৷
অসংখ্য অপরাধী আমি, জ্ঞানশূন্য মিছে ভ্রমি।
মায়াতে মোহিত হয়ে বৎসহারা গাভীর মতো ৷৷

[রামচিন্তা — সীতার ন্যায় ব্যাকুলতা ]

“কেন? পিঞ্জরের পাখির মতো হতে যাব কেন? হ্যাক্‌! থু!”

কথা কহিতে কহিতে ভাবাবিষ্ট — শরীর, মন সব স্থির ও চক্ষে ধারা। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিতেছেন, মা সীতার মতো করে দাও — একেবারে সব ভুল — দেহ ভুল, যোনি, হাত, পা, স্তন — কোনদিকে হুঁশ নাই। কেবল এক চিন্তা — ‘কোথায় রাম!’

কিরূপ ব্যাকুল হলে ঈশ্বরলাভ হয় — মণিকে এইটি শিখাইবার জন্যই কি ঠাকুরের সীতার উদ্দীপন হইল? সীতা রামময়জীবিতা, — রামচিন্তা করে উন্মাদিনী — দেহ যে এমন প্রিয় তাহাও ভুলে গেছেন!

বেলা ৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। জনাইয়ের মুখুজ্জেবাবু একজন আসিয়াছেন — তিনি শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণের জ্ঞাতি। তাঁহার সঙ্গে একটি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ বন্ধু। মণি, রাখাল, লাটু, হরিশ, যোগীন প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন।

যোগীন দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরীদের ছেলে। তিনি আজকাল প্রায় প্রত্যহ বৈকালে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন ও রাত্রে চলিয়া যান। যোগীন এখনও বিবাহ করেন নাই।

মুখুজ্জে (প্রণামনন্তর) — আপনাকে দর্শন করে বড় আনন্দ হল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি সকলের ভিতরই আছেন। সকলের ভিতর সেই সোনা, কোনখানে বেশি প্রকাশ। সংসারে অনেক মাটি চাপা।

মুখুজ্জে (সহাস্য) — মহাশয়, ঐহিক পারত্রিক কি তফাত?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধনের সময় ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে ত্যাগ করতে হয়। তাঁকে লাভের পর বুঝা যায় তিনিই সব হয়েছেন।

“যখন রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হল দশরথ বড় ভাবিত হয়ে বশিষ্ঠদেবের শরণাগত হলেন — যাতে রাম সংসারত্যাগ না করেন। বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বিমনা হয়ে বসে আছেন — অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। বশিষ্ঠ বললেন, রাম, তুমি সংসারত্যাগ করবে কেন? সংসার কি তিনি ছাড়া? আমার সঙ্গে বিচার কর। রাম দেখিলেন, সংসার সেই পরব্রহ্ম থেকেই হয়েছে, — তাই চুপ করে রহিলেন।

“যেমন যে জিনিস থেকে ঘোল, সেই জিনিস থেকে মাখম। তখন ঘোলেরই মাখম, মাখমেরই ঘোল। অনেক কষ্টে মাখম তুললে (অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান হল); — তখন দেখছ যে মাখম থাকলেই ঘোলও আছে, — যেখানে মাখম সেইখানেই ঘোল। ব্রহ্ম আছেন বোধ থাকলেই — জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্বও আছে।”

[ব্রহ্মজ্ঞানের একমাত্র উপায় ]

“ব্রহ্ম যে কি বস্তু মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়েছে (অর্থাৎ মুখে বলা হয়েছে), কিন্তু ব্রহ্ম কি, — কেউ মুখে বলতে পারে নাই। তাই উচ্ছিষ্ট হয় নাই। এ-কথাটি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলাম — বিদ্যাসাগর শুনে ভারী খুশী।

“বিষয়বুদ্ধির লেশ থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। কামিনী-কাঞ্চন মনে আদৌ থাকবে না, তবে হবে। গিরিরাজকে পার্বতী বললেন, ‘বাবা, ব্রহ্মজ্ঞান যদি চাও তাহলে সাধুসঙ্গ কর’।”

ঠাকুর কি বলছেন, সংসারী লোক বা সন্ন্যাসী যদি কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে তাহলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না?

[যোগভ্রষ্ট — ব্রহ্মজ্ঞানের পর সংসার ]

শ্রীরামকৃষ্ণ আবার মুখুজ্জেকে সম্বোধন করে বলছেন, “তোমাদের ধন ঐশ্বর্য আছে অথচ ঈশ্বরকে ডাকছ — এ খুব ভাল। গীতায় আছে যারা যোগভ্রষ্ট তারাই ভক্ত হয়ে ধনীর ঘরে জন্মায়।”

মুখুজ্জে (বন্ধুর প্রতি, সহাস্যে) — শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি মনে করলে জ্ঞানীকেও সংসারে রাখতে পারেন। তাঁর ইচ্ছাতে জীবজগৎ হয়েছে। তিনি ইচ্ছাময় —

মুখুজ্জে (সহাস্যে) — তাঁর আবার ইচ্ছা কি? তাঁর কি কিছু অভাব আছে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — তাতেই বা দোষ কি? জল স্থির থাকলেও জল, — তরঙ্গ হলেও জল।

[জীবজগৎ কি মিথ্যা? ]

“সাপ চুপ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকলেও সাপ, — আবার তির্যগ্গতি হয়ে এঁকেবেঁকে চললেও সাপ।

“বাবু যখন চুপ করে আছে তখনও যে ব্যক্তি, — যখন কাজ করছে তখনও সেই ব্যক্তি।

“জীবজগৎকে বাদ দেবে কেমন করে — তাহলে যে ওজনে কম পড়ে। বেলের বিচি, খোলা বাদ দিলে সমস্ত বেলের ওজন পাওয়া যায় না।

“ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। বায়ুতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। সেই আদ্যাশক্তিতেই জীবজগৎ হয়েছে।”

[সমাধিযোগের উপায় — ক্রন্দন। ভক্তিযোগ ও ধ্যানযোগ ]

মুখুজ্জে — কেন যোগভ্রষ্ট হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ‘গর্ভে ছিলাম যোগে ছিলাম, ভূমে পড়ে খেলাম মাটি। ওরে ধাত্রীতে কেটেছে নাড়ী, মায়ার বেড়ি কিসে কাটি।’

“কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মন থেকে ওই দুটি গেলেই যোগ। আত্মা — পরমাত্মা চুম্বক পাথর, জীবাত্মা যেন একটি ছুঁচ — তিনি টেনে নিলেই যোগ। কিন্তু ছুঁচে যদি মাটি মাখা থাকে চুম্বকে টানে না, মাটি সাফ করে দিলে আবার টানে। কামিনী-কাঞ্চন মাটি পরিষ্কার করতে হয়।”

মুখুজ্জে — কিরূপে পরিষ্কার হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর জন্য ব্যকুল হয়ে কাঁদ — সেই জল মাটিতে লাগলে ধুয়ে ধুয়ে যাবে। যখন খুব পরিষ্কার হবে তখন চুম্বকে টেনে লবে। — যোগ তবেই হবে।

মুখুজ্জে — আহা কি কথা!

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর জন্য কাঁদতে পারলে দর্শন হয়। যোগ সিদ্ধ হলেই সমাধি। কাঁদলে কুম্ভক আপনি হয়, তারপর সমাধি।

“আর-এক আছে ধ্যান। সহস্রারে শিব বিশেষরূপে আছেন। তাঁর ধ্যান। শরীর সরা, মন-বুদ্ধি জল। এই জলে সেই সচ্চিদানন্দ সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। সেই প্রতিবিম্ব সূর্যের ধ্যান করতে করতে সত্য সূর্য তাঁর কৃপায় দর্শন হয়।

[সাধুসঙ্গ কর ও আমমোক্তারি (বকলমা) দাও ]

কিন্তু সংসারী লোকের সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার। সকলেরই দরকার। সন্ন্যাসীরও দরকার। তবে সংসারীদের বিশেষতঃ, রোগ লেগেই আছে — কামিনী-কাঞ্চনের মধ্যে সর্বদা থাকতে হয়।”

মুখুজ্জে — আজ্ঞা, রোগ লেগেই আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও — যা হয় তিনি করুন। তুমি বিড়ালছানার মতো কেবল তাঁকে ডাকো — ব্যাকুল হয়ে। তার মা যেখানে তাকে রাখে — সে কিছু জানে না; কখনও বিছানার উপর রাখছে, কখনও হেঁশালে।

[প্রবর্তক শাস্ত্র পড়ে — সাধনার পর তবে দর্শন ]

মুখুজ্জে — গীতা প্রভৃতি শাস্ত্র পড়া ভাল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — শুধু পড়লে শুনলে কি হবে? কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ খেয়েছে। ঈশ্বরকে দর্শন করা যায় — আবার তাঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়।

“প্রথমে প্রবর্তক। সে পড়ে, শুনে। তারপর সাধক, — তাঁকে ডাকছে, ধ্যান চিন্তা করছে, নামগুণকীর্তন করছে। তারপর সিদ্ধ — তাঁকে বোধ বোধ করেছে, দর্শন করেছে। তারপর সিদ্ধের সিদ্ধ; যেমন চৈতন্যদেবের অবস্থা — কখনও বাৎসল্য, কখনও মধুরভাব।”

মণি, রাখাল, যোগীন লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা এই সকল দেবদুর্লভ তত্ত্বকথা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

এইবার মুখুজ্জেরা বিদায় লইবেন। তাঁহারা প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। ঠাকুরও যেন তাঁদের সম্মানর্থ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

মুখুজ্জে (সহাস্যে) — আপনার আবার উঠা বসা। —

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আবার উঠা বসাতেই বা ক্ষতি কি? জল স্থির হলেও জল, — আর হেললে দুললেও জল। ঝড়ের এঁটো পাতা — হাওয়াতে যেদিকে লয়ে যায়। আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী।
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৬ই ডিসেম্বর
শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ও বেদান্ত সম্বন্ধে গুহ্য ব্যাখ্যা — অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ — জগৎ কি মিথ্যা? Identity of the Undifferentiated and Differentiated

জনাইয়ের মুখুজ্জেরা চলিয়া গেলেন। মণি ভাবিতেছেন, বেদান্তদর্শন মতে “সব স্বপ্নবৎ”। তবে জীবজগৎ, আমি — এ-সব কি মিথ্যা?

মণি একটু একটু বেদান্ত দেখিয়াছেন। আবার বেদান্তের অস্ফুট প্রতিধ্বনি কান্ট্‌, হেগেল প্রভৃতি জার্মান পণ্ডিতদের বিচার একটু পড়েছেন। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দুর্বল মানুষের ন্যায় বিচার করেন নাই, জগন্মাতা তাঁহাকে সমস্ত দর্শন১ করাইয়াছেন। মণি তাই ভাবছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত একাকী পশ্চিমের গোল বারান্দায় কথা কহিতেছেন। সম্মুখে গঙ্গা — কুলকুল রবে দক্ষিণে প্রবাহিত হইতেছেন। শীতকাল — সূর্যদেব এখনও দেখা যাইতেছেন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। যাঁহার জীবন বেদময় — যাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত বাক্য বেদান্তবাক্য — যাঁহার শ্রীমুখ দিয়া শ্রীভগবান কথা কন — যাঁহার কথামৃত লইয়া বেদ, বেদান্ত, শ্রীভাগবত গ্রন্থাকার ধারণ করে, সেই অহেতুককৃপাসিন্ধু পুরুষ গুরুরূপ করিয়া কথা কহিতেছেন।

মণি — জগৎ কি মিথ্যা?

শ্রীরামকৃষ্ণ — মিথ্যা কেন? ও-সব বিচারের কথা।

“প্রথমটা, ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করবার সময়, তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন, হয়ে যায়; — ‘এ-সব স্বপ্নবৎ’ হয়ে যায়। তারপর অনুলোম বিলোম। তখন তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন বোধ হয়।

“তুমি সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে উঠলে। কিন্তু যতক্ষণ ছাদবোধ ততক্ষণ সিঁড়িও আছে। যার উঁচুবোধ আছে, তার নিচুবোধও আছে।

“আবার ছাদে উঠে দেখলে — যে জিনিসে ছাদ তৈয়ের হয়েছে — ইট, চুন, সুড়কি — সেই জিনিসেই সিঁড়ি তৈয়ের হয়েছে।

“আর যেমন বেলের কথা বলেছি।

“যার অটল আছে তার টলও আছে।

“আমি যাবার নয়। ‘আমি ঘট’ যতক্ষণ রয়েছে ততক্ষণ জীবজগৎও রয়েছে। তাঁকে লাভ করলে দেখা যায় তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। — শুধু বিচারে হয় না।

“শিবের দুই অবস্থা। যখন সমাধিস্থ — মহাযোগে বসে আছেন — তখন আত্মারাম। আবার যখন সে অবস্থা থেকে নেবে আসেন — একটু ‘আমি’ থাকে তখন ‘রাম’ ‘রাম’ করে নৃত্য করেন!”

ঠাকুর শিবের অবস্থা বর্ণনা করিয়া কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন?

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার নাম ও তাঁহার চিন্তা করিতেছেন। ভক্তেরাও নির্জনে গিয়া যে যার ধ্যানাদি করিতে লাগিলেন। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে মা-কালীর মন্দিরে, শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে ও দ্বাদশ শিবমন্দিরে আরতি হইতে লাগিল।

আজ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতিয়া তিথি। সন্ধ্যার কিয়ৎক্ষণ পরে চন্দ্রোদয় হইল। সে আলো মন্দির শীর্ষ, চতুর্দিকের তরুলতা ও মন্দিরের পশ্চিমে ভাগীরথীবক্ষে পড়িয়া অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। এই সময় সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। মণি বৈকালে বেদান্ত সম্বন্ধে যে-কথার অবতারণা করিয়াছিলেন ঠাকুর আবার সেই কথাই কহিতেছেন।

[সব চিন্ময়দর্শন — মথুরকে খাজাঞ্চীর পত্র লেখা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — জগৎ মিথ্যা কেন হবে? ও-সব বিচারের কথা। তাঁকে দর্শন হলে তখন বোঝা যায় যে তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন।

“আমায় মা কালীঘরে দেখিয়া দিলেন যে মা-ই সব হয়েছেন। দেখিয়া দিলেন সব চিন্ময়! — প্রতিমা চিন্ময়! — বেদী চিন্ময়! — কোশাকুশি চিন্ময়! — চৌকাট চিন্ময়! — মার্বেলের পাথর — সব চিন্ময়!

“ঘরের ভিতর দেখি — সব যেন রসে রয়েছে! সচ্চিদানন্দ রসে।

“কালীঘরের সম্মুখে একজন দুষ্ট লোককে দেখলাম, — কিন্তু তারও ভিতরে তাঁর শক্তি জ্বলজ্বল করছে দেখলাম!

“তাইতো বিড়ালকে ভোগের লুচি খাইয়েছিলাম। দেখলাম মা-ই সব হয়েছেন — বিড়াল পর্যন্ত। তখন খাজাঞ্চী সেজোবাবুকে চিঠি লিখলে যে ভটচার্জি মহাশয় ভোগের লুচি বিড়ালদের খাওয়াচ্ছেন। সেজোবাবু আমার অবস্থা বুঝতো। পত্রের উত্তরে লিখলে, ‘উনি যা করেন তাতে কোন কথা বলো না।’

“তাঁকে লাভ করলে এইগুলি ঠিক দেখা যায়। তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।

“তবে যদি তিনি ‘আমি’ একেবারে পুঁছে দেন তখন যে কি হয় মুখে বলা যায় না। রামপ্রসাদ যেমন বলেছেন —

‘তখন তুমি ভাল কি আমি ভাল সে তুমিই বুঝবে।’

“সে অবস্থাও আমার এক-একবার হয়।

“বিচার করে একরকম দেখা যায়, — আর তিনি যখন দেখিয়ে দেন তখন আর একরকম দেখা যায়।”
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৭ই ডিসেম্বর
জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন — উপায় প্রেম
পরদিন (১৭ই ডিসেম্বর) সোমবার, বেলা আটটা হইল। ঠাকুর সেই ঘরে বসিয়া আছেন। রাখাল, লাটু প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত মধু ডাক্তারও আসিয়াছেন। তিনি ঠাকুরের কাছে সেই ছোট খাটটির উপরেই বসিয়া আছেন। মধু ডাক্তার প্রবীণ — ঠাকুরের অসুখ হইলে প্রায় তিনি আসিয়া দেখেন। বড় রসিক লোক।

মণি ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রণামনন্তর উপবেশন করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — কথাটা এই — সচ্চিদানন্দ প্রেম।

[ঠাকুরের সীতামূর্তি-দর্শন — গৌরী পণ্ডিতের কথা ]

“কিরূপ প্রেম? ঈশ্বরকে কিরূপ ভালবাসতে হবে? গৌরী বলত রামকে জানতে গেলে সীতার মতো হতে হয়; ভগবানকে জানতে ভগবতীর মতো হতে হয়, — ভগবতী যেমন শিবের জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন সেইরূপ তপস্যা করতে হয়; পুরুষকে জানতে গেলে প্রকৃতভাবে আশ্রয় করতে হয় — সখীভাব, দাসীভাব, মাতৃভাব।

“আমি সীতামূর্তি দর্শন করেছিলাম। দেখলাম সব মনটা রামেতেই রয়েছে। যোনি, হাত, পা, বসন-ভূষণ কিছুতেই দৃষ্টি নাই। যেন জীবনটা রামময় — রাম না থাকলে, রামকে না পেলে, প্রাণে বাঁচবে না!”

মণি — আজ্ঞা হাঁ, — যেন পাগলিনী।

শ্রীরামকৃষ্ণ — উন্মাদিনী! — ইয়া। ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে পাগল হতে হয়।

“কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হয় না। কামিনীর সঙ্গে রমণ, — তাতে কি সুখ! ঈশ্বরদর্শন হলে রমণসুখের কোটিগুণ আনন্দ হয়। গৌরী বলত, মহাভাব হলে শরীরের সব ছিদ্র — লোমকূপ পর্যন্ত — মহাযোনি হয়ে যায়। এক-একটি ছিদ্রে আত্মার সহিত রমণসুখ বোধ হয়।”

[গুরু পূর্ণজ্ঞানী হবেন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। গুরুর মুখে শুনে নিতে হয় — কি করলে তাঁকে পাওয়া যায়।

“গুরু নিজে পূর্ণজ্ঞানী হলে তবে পথ দেখিয়ে দিতে পারে।

“পূর্ণজ্ঞান হলে বাসনা যায়, — পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। দত্তাত্রেয় আর জড়ভরত — এদের বালকের স্বভাব হয়েছিল।”

মণি — আজ্ঞে, এদের খপর আছে; — আরও এদের মতো কত জ্ঞানী লোক হয়ে গেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ! জ্ঞানীর সব বাসনা যায়, — যা থাকে তাতে কোন হানি হয় না। পরশমণিকে ছুঁলে তরবার সোনা হয়ে যায়, — তখন আর সে তরবারে হিংসার কাজ হয় না। সেইরূপ জ্ঞানীর কাম-ক্রোধের কেবল ভঙ্গীটুকু থাকে। নামমাত্র। তাতে কোন অনিষ্ট হয় না।

মণি — আপনি যেমন বলেন, জ্ঞানী তিনগুণের অতীত হয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ — কোন গুণেরই বশ নন। এরা তিনজনেই ডাকাত।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওইগুলি ধারণা করা চাই।

মণি — পূর্ণজ্ঞানী পৃথিবীতে বোধ হয় তিন-চারজনের বেশি নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন, পশ্চিমের মঠে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায়।

ণি — আজ্ঞা, সে সন্ন্যাসী আমিও হতে পারি!

শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথায় কিয়ৎক্ষণ মণিকে এক দৃষ্টে দেখিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — কি, সব ছেড়ে?

মণি — মায়া না গেলে কি হবে? মায়াকে যদি জয় না করতে পারে শুধু সন্ন্যাসী হয়ে কি হবে?

সকলেই কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া আছেন।

[ত্রিগুণাতীত ভক্ত যেমন বালক ]

মণি — আজ্ঞা, ত্রিগুণাতীত ভক্তি কাকে বলে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে ভক্তি হলে সব চিন্ময় দেখে। চিন্ময় শ্যাম। চিন্ময় ধাম। ভক্তও চিন্ময়। সব চিন্ময়। এ-ভক্তি কম লোকের হয়।

ডাক্তার মধু (সহাস্যে) — ত্রিগুণাতীত ভক্তি — অর্থাৎ ভক্ত কোন গুণের বশীভূত নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ইয়া! যেমন পাঁচ বছরের বালক — কোন গুণের বশ নয়।

মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতেছেন। শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিক আসিয়া প্রণাম করিলেন ও মেঝেতে আসন গ্রহণ করিলেন।

মণিও মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর শুইয়া শুইয়া মণি মল্লিকের সঙ্গে মাঝে মাঝে একটি একটি কথা কহিতেছেন।

মণি মল্লিক — আপনি কেশব সেনকে দেখতে গিছলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ — এখন কেমন আছেন?

মণি মল্লিক — কিছু সারেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দেখলাম বড় রাজসিক, — অনেকক্ষণ বসিয়েছিল, — তারপর দেখা হল।

ঠাকুর উঠিয়া বসিলেন ও ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।

[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত — ঠাকুর “রাম রাম” করিয়া পাগল ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আমি ‘রাম’ ‘রাম’ করে পাগল হয়েছিলাম। সন্ন্যাসীর ঠাকুর রামলালকে লয়ে লয়ে বেড়াতাম। তাকে নাওয়াতাম, খাওয়াতাম, শোয়াতাম। যেখানে যাব, — সঙ্গে করে লয়ে যেতাম। “রামলালা রামলালা” করে পাগল হয়ে গেলাম।
=============

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৯শে ডিসেম্বর

বিল্বমূলে ও পঞ্চবটীতলায় শ্রীরামকৃষ্ণ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিল্ববৃক্ষের নিকট মণির সহিত কথা কহিতেছেন। বেলা প্রায় নয়টা হইবে।

আজ বুধবার, ১৯শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ (৫ই পৌষ, ১২৯০)। কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথি।

বিল্বতল ঠাকুরের সাধনভূমি। অতি নির্জন স্থান। উত্তরে বারুদখানা ও প্রাচীর। পশ্চিমে ঝাউগাছগুলি সর্বদাই প্রাণ-উদাসকারী সোঁ-সোঁ শব্দ করিতেছে, পরেই ভাগীরথী। দক্ষিণে পঞ্চবটী দেখা যাইতেছে। চতুর্দিকে এত গাছপালা, দেবালয়গুলি দেখা যাইতেছে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে কিন্তু হবে না।

মণি — কেন? বশিষ্ঠদেব তো রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, রাম, সংসার যদি ঈশ্বরছাড়া হয়, তাহলে সংসারত্যাগ করো।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিয়া) — সে রাবণবধের জন্য! তাই রাম সংসারে রইলেন — বিবাহ করলেন।

মণি নির্বাক্‌ হইয়া কাষ্ঠের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা বলিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইবার জন্য পঞ্চবটী অভিমুখে গমন করিলেন। বেলা ৯টা হইয়া গিয়াছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মণির কথা চলিতেছে পঞ্চবটীমূলে।

মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — জ্ঞান ভক্তি দুই-ই কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — খুব উঁচু ঘরের হয়। ঈশ্বরকোটির হয় — যেমন চৈতন্যদেবের। জীবকোটিদের আলাদা কথা।

“আলো (জ্যোতিঃ) পাঁচপ্রকার। দীপ আলোক, অন্যান্য অগ্নির আলো, চান্দ্র আলো, সৌর আলো ও চান্দ্র সৌর একাধারে। ভক্তি চন্দ্র; জ্ঞান সূর্য।

“কখনও কখনও আকাশে সূর্য অস্ত না যেতে যেতে চন্দ্রোদয় দেখা যায়। অবতারাদির ভক্তিচন্দ্র জ্ঞানসূর্য একাধারে দেখা যায়।

“মনে করলেই কি সকলের জ্ঞান ভক্তি একাধারে দুই হয়? আধার বিশেষ। কোন বাঁশের ফুটো বেশি, কোন বাঁশের খুব সরু ফুটো। ঈশ্বর বস্তু ধারণা কি সকল আধারে হয়। একসের ঘটিতে কি দুসের দুধ ধরে!”

মণি — কেন, তাঁর কৃপায়? তিনি কৃপা করলে তো ছুঁচের ভিতর উট যেতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু কৃপা কি অমনি হয়? ভিখারি যদি পয়সা চায়, দেওয়া যায়। কিন্তু একেবারে যদি রেলভাড়া চেয়ে বসে?

মণি নিঃশব্দে দণ্ডায়মান। শ্রীরামকৃষ্ণও চুপ করিয়া আছেন। হঠাৎ বলিতেছেন, হাঁ বটে, কারু কারু আধারে তাঁর কৃপা হলে হতে পারে; দুই-ই হতে পারে।

[‘নিরাকার সাধনা বড় কঠিন’ ]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় মণির সহিত কথা কহিতেছেন বেলা প্রায় ১০টা হইল।

মণি — আজ্ঞা, নিরাকার সাধন কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হবে না কেন? ও-পথ বড় কঠিন১। আগেকার ঋষিরা অনেক তপস্যার দ্বারা বোধে বোধ করত, — ব্রহ্ম কি বস্তু অনুভব করত। ঋষিদের খাটুনি কত ছিল। — নিজেদের কুটির থেকে সকালবেলা বেরিয়া যেত, — সমস্ত দিন তপস্যা করে সন্ধ্যার পর আবার ফিরত। তারপর এসে একটু ফলমূল খেত।

“এ-সাধনে একেবারে বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে হবে না। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ — এসব বিষয় মনে আদপে থাকবে না। তবে শুদ্ধমন হবে। সেই শুদ্ধমনও যা শুদ্ধ আত্মাও তা। মনেতে কামিনী-কাঞ্চন একেবারে থাকবে না —

“তখন আর-একটি অবস্থা হয়। ‘ঈশ্বরই কর্তা আমি অকর্তা’। আমি না হলে চলবে না এরুপ জ্ঞান থাকবে না — সুখে দুঃখে।

“একটি মঠের সাধুকে দুষ্টলোকে মেরেছিল, — সে অজ্ঞান হয়ে গিছল। চৈতন্য হলে যখন জিজ্ঞাসা করলে কে তোমায় দুধ খাওয়াচ্ছে। সে বলেছিল, যিনি আমায় মেরেছেন তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।”

মণি — আজ্ঞা হাঁ, জানি।

[স্থিতসমাধি ও উন্মনাসমাধি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, শুধু জানলে হবে না; ধারণা করা চাই।

“বিষয়চিন্তা মনকে সমাধিস্থ হতে দেয় না।

”একেবারে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ হলে স্থিতসমাধি হয়। স্থিতসমাধিতে দেহত্যাগ হতে পারে, কিন্তু ভক্তি-ভক্ত নিয়ে একটু থাকবার বাসনা আছে। তাই দেহের উপরেও মন আছে।

“আর এক আছে উন্মনাসমাধি। ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। ওটা তুমি বুঝেছ?”

মণি — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। বেশিক্ষণ এ-সমাধি থাকে না, বিষয়চিন্তা এসে ভঙ্গ হয় — যোগীর যোগ ভঙ্গ হয়।

“ও-দেশে দেয়ালের ভিতর গর্তে নেউল থাকে। গর্তে যখন থাকে বেশ আরামে থাকে। কেউ কেউ ন্যাজে ইট বেঁধে দেয় — তখন ইটের জোরে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে। যতবার গর্তের ভিতর গিয়ে আরামে বসবার চেষ্টা করে — ততবারই ইটের জোরে বাইরে এসে পড়ে। বিষয়চিন্তা এমনি — যোগীকে যোগভ্রষ্ট করে।

“বিষয়ী লোকদের এক-একবার সমাধির অবস্থা হতে পারে। সূর্যোদয়ে পদ্ম ফোটে, কিন্তু সূর্য মেঘেতে ঢাকা পড়লে আবার পদ্ম মুদিত হয়ে যায়। বিষয় মেঘ।”

মণি — সাধন করলে জ্ঞান আর ভক্তি দুই কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভক্তি নিয়ে থাকলে দুই-ই হয়। দরকার হয়, তিনিই ব্রহ্মজ্ঞান দেন। খুব উঁচু ঘর হলে একাধারে দুই-ই হতে পারে।

প্রণামপূর্বক মণি বেলতলার দিকে যাইতেছেন।

বেলতলা হইতে ফিরিতে দুপ্রহর হইয়া গিয়াছে। দেরি দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বেলতলার দিকে আসিতেছেন। মণি, সতরঞ্চি, আসন, জলের ঘটি লইয়া ফিরিতেছেন, পঞ্চবটীর কাছে ঠাকুরের সহিত দেখা হইল। তিনি অমনি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আমি যাচ্ছিলাম তোমায় খুঁজতে। ভাবলাম এত বেলা, বুঝি পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালো! তোমার চোখ তখন যা দেখেছিলাম — ভাবলাম বুঝি নারাণ শাস্ত্রীর মতো পালালো। তারপর আবার ভাবলাম, না সে পালাবে না; সে অনেক ভেবে-চিন্তে কাজ করে।
==========

Post a Comment

0 Comments