পত্রাবলী-পরিশিষ্ট (পত্র সংখ্যাঃ ৫৪১-৫৫২)

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
অষ্টম খণ্ড

পত্রাবলী-পরিশিষ্ট (পত্র সংখ্যাঃ ৫৪১-৫৫২)

পত্রাবলী-পরিশিষ্ট (পত্র সংখ্যাঃ ৫৪১-৫৫২

পত্র সংখ্যা - ৫৪১
[মিস ইসাবেল ম্যাক্‌কিণ্ডলিকে লিখিত]
এনিস্কোয়াম্‌
২০ অগষ্ট, ১৮৯৪

প্রিয় ভগিনী,

তোমার অত্যন্ত সহৃদয় লিপিখানি এনিস্‌কোয়ামে আমার কাছে যথাসময়ে এসে পৌঁছেছে। আমি পুনরায় ব্যাগলিদের সঙ্গে আছি। তাঁরা যথারীতি সহৃদয়। অধ্যাপক রাইট এখানে ছিলেন না। তবে গত পরশু তিনি এসেছেন এবং একসঙ্গে আমাদের খুব ভাল কাটছে। এভানস্টনের মিঃ ব্রাডলি, যাঁর সঙ্গে তোমার এভানস্টনে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এখানে ছিলেন। কয়েকদিন বেশ নৌকাভ্রমণ করা গেছে এবং একদিন সন্ধ্যায় নৌকা উল্টিয়ে কাপড় জামা ও সবকিছু ভিজে একশেষ।

গ্রীনএকারে আমার চমৎকার কেটেছে। তাঁরা সকলেই নিষ্ঠাপরায়ণ ও সহৃদয়। ফ্যানি হার্টলি (Fanny Hartley) ও মিসেস মিল্‌স্ (Mrs. Mills) মনে হয় এতদিনে বাড়ী ফিরে গিয়েছেন।

ভাবছি এখান থেকে নিউ ইয়র্ক ফিরে যাব, অথবা বষ্টনে মিসেস ওলি বুলের কাছেও যেতে পারি। সম্ভবতঃ তুমি এ দেশের বিখ্যাত বেহালা-বাদক মিঃ ওলি বুলের কথা শুনেছ। ইনি তাঁর বিধবা পত্নী। মহিলাটি খুবই ধর্মশীলা। তিনি কেম্ব্রিজে বাস করেন এবং ভারত থেকে আনা কারুকার্যময় কাঠ দিয়ে তৈরী একখানা সুন্দর বৈঠকখানা তাঁর আছে। তিনি চান আমি যে-কোন সময়ে তাঁর কাছে যাই এবং তাঁর বৈঠকখানাটি বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করি। বষ্টন অবশ্য সব-কিছুর জন্যই একটি বৃহৎ ক্ষেত্র, কিন্তু বষ্টনের লোকেরা কোনকিছু যেমন তৎপরতার সঙ্গে গ্রহণ করে, আবার তেমনি তৎপরতার সঙ্গে ত্যাগ করে। অন্য দিকে নিউ ইয়র্কবাসীরা একটু ঢিলে হলেও যখন তারা কোন জিনিষ ধরে, তখন খুব শক্ত করেই ধরে।

আমার স্বাস্থ্য বরাবর বেশ ভাল যাচ্ছে এবং আশা করি, ভবিষ্যতেও যাবে। আমার সঞ্চয় থেকে খরচ করবার কোন কারণ এখনও ঘটেনি, তবু আমি বেশ ভালভাবেই কাটাচ্ছি। অর্থকরী সকল পরিকল্পনা আমি ত্যাগ করেছি, এখন শুধু এক-টুকরো খাদ্য ও মাথার উপর একটু আচ্ছাদন পেলেই সম্পূর্ণ তৃপ্ত থাকব এবং কাজ করে যাব।

আশাকরি গ্রীষ্মাবাসে আনন্দ উপভোগ করছ। দয়া করে আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিস হাউ (Miss Howe) এবং মিঃ ফ্র্যাঙ্ক হাউকে জানিও।

সম্ভবতঃ পূর্বের চিঠিতে তোমাকে বলা হয়নি যে, আমি কেমন করে গাছের নীচে ঘুমিয়েছি, থেকেছি এবং ধর্মপ্রচার করেছি এবং অন্ততঃ কয়েকদিনের জন্য আর একবার স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে নিজেকে পেয়েছি।

খুব সম্ভবতঃ আগামী শীতে নিউ ইয়র্ককেই আমার কেন্দ্র করব; এবং তা স্থির করেই তোমাকে জানাব। এ দেশে আরও থাকার বিষয়ে এখনও কিছু স্থির করতে পারিনি। আমি এ সকল ব্যাপার স্থির করতে পারি না। সময়ের অপেক্ষায় থাকব। প্রভু তোমাদের সকলকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, এই হল তোমাদের সদা-স্নেহশীল ভ্রাতার নিরন্তর প্রার্থনা—

বিবেকানন্দ

*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪২
[ইসাবেল ম্যাক‍্‍কিণ্ডলিকে লিখিত]

বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
ভারতের ডাক ও তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। ভারত থেকে বেশ কিছু সংবাদপত্রের অংশ কেটে আমার কাছে পাঠান হয়েছে। তুমি সেগুলি পড়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দেবে, তাই সেগুলি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ভারতের চিঠি লেখার ব্যাপারে গত কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত আছি। আরও দিন কয়েক বোষ্টনে থাকব। প্রীতি ও আশীর্বাদ।

সদা স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৩

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
গত রবিবার ব্রুকলিনে বক্তৃতা দিয়েছি। সন্ধ্যায় পৌঁছলে মিসেস হিগিন্স আমায় একটু সম্বর্ধনা করেন, এবং ডক্টর জেন্‌স্‌ (Janes) প্রভৃতি এথিক্যাল সোসাইটি (Ethical Society)-র কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কয়েকজন মনে করেন যে, এরূপ প্রাচ্যদেশীয় ধর্মপ্রসঙ্গ ব্রুকলিনের জনসাধারণের উপভোগ্য হবে না।

কিন্তু প্রভুর কৃপায় বক্তৃতা খুব সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। ব্রুকলিনের প্রায় আটশত গণ্যমান্য ব্যক্তি যোগদান করেন! যাঁরা মনে করেছিলেন বক্তৃতা সফল হবে না, তাঁরাই ব্রুকলিনে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করেছেন। আমার নিউ ইয়র্কের বক্তৃতামালা প্রায় প্রস্তুত, কিন্তু মিস থার্সবি নিউ ইর্য়কে না আসা পর্যন্ত তারিখ ঠিক করতে চাই না। এভাবে মিস ফিলিপ্‌স্‌—যিনি মিস থার্সবির বন্ধু, এবং যিনি আমার নিউ ইর্য়কের বক্তৃতামালার আয়োজন করছেন—মিস থার্সবির সহযোগিতায় প্রয়োজনবোধে সেখানে কিছু বন্দোবস্ত করতে চান।

হেল পরিবারের কাছে আমি বিশেষরূপে ঋণী এবং নববর্ষের প্রথম দিনে তাদের কাছে হঠাৎ এসে হাজির হব, ভেবেছিলাম। এখানে একটি নতুন পাগড়ি যোগাড় করবার চেষ্টাতে আছি। পুরানো পাগড়িটি এখানে আছে। কিন্তু বারবার কাচার ফলে সেটা এত ঢিলে হয়ে গিয়েছে যে, সেটা পরে লোকের কাছে যাওয়া যায় না। চিকাগোর ঠিক তেমনি একটা পাগড়ি পাব বলে মনে হয়।

আশা করি আপনার পিতা ইতোমধ্যে ভাল হয়েছেন। মিস ফার্মার, মিঃ ও মিসেস গিবন্স এবং ধার্মিক পরিবারটির সকলকে আমার প্রীতি জানাবেন।

সতত স্নেহের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—ব্রুকলিনে মিস কুরিং-এর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি বরাবরই সদয়। তাঁকে শীঘ্র চিঠি লিখলে আমার প্রীতি জানাবেন।

*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৪
[ইসাবেল ম্যাক‍্‍কিণ্ডলিকে লিখিত]
54 W. 33 St. N.Y.
২৭ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
তোমার চিঠিখানা পেয়ে এত আনন্দ হয়েছে যে, তা প্রকাশ করা যায় না। আমিও অনায়াসে চিঠিখানা আগাগোড়া পড়তে পেরেছি। অবশেষে কমলারঙ ঠাওরিয়ে সেই রঙের একটা জামা পেয়েছি, কিন্তু গরমের দিনে ব্যবহারের উপযোগী কোন জামা এ-পর্যন্ত পাইনি। যদি পাও, আমাকে অনুগ্রহ করে জানিও। এখানে নিউ ইয়র্কে তৈরী করে নেব। তোমার সেই অদ্ভুত ডিয়ারবর্ণ এভিনিউ-এর অযোগ্য দর্জি সাধু-সন্ন্যাসীর জামাও প্রস্তুত করতে জানে না।

ভগিনী লক্ এক লম্বা চিঠি লিখেছে এবং হয়তো উত্তরের দেরী দেখে আশ্চর্য হয়েছে। উৎসাহে সে অভিভূত হয়ে যায়; তাই আমি অপেক্ষা করছি এবং কি লিখব, জানি না। অনুগ্রহ করে তাকে বলবে—এই মুহূর্তে কোন স্থান নির্ধারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মিসেস পীক সদাশয়া মহীয়সী ও অত্যন্ত ধর্মশীলা হলেও বৈষয়িক ব্যাপারে আমার মতই বুদ্ধিমান, তবে আমি দিনদিন বুদ্ধিমান হচ্ছি। ওয়াশিংটনে মিসেস পীকের জানা কে একজন তাকে গ্রীষ্মাবাসের জন্য একটি জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।

কে জানে, সে প্রতারিত হবে কিনা? প্রতারণার এ এক অদ্ভুত দেশ; অন্যের ওপর সুবিধা নেওয়ার কোন-না-কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে শতকরা নিরানব্বই জনের। যদি কেউ মুহূর্তের জন্য কেবল একটু চোখ বন্ধ করে, তবেই তার সর্বনাশ! ভগিনী জোসেফাইন অগ্নিশর্মা। মিসেস পীক সাদাসিধে ভাল মহিলা। এখানকার লোকেরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যে, কিছু করবার আগে কয়েক ঘণ্টা আমাকে চারিদিকে তাকাতে হয়। সবই ঠিক হয়ে যাবে। ভগিনী জোসেফাইনকে একটু ধৈর্য ধরতে বলো। একজন বৃদ্ধার সংসার চালানর চেয়ে প্রতিদিন কিণ্ডারগার্টেন তোমার নিশ্চই আরও ভাল লাগছে। মিসেস বুলকে দেখেছ; তাঁকে এত নিরীহ ও শান্ত দেখে তুমি নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছ। মিসেস এডামসের সঙ্গে মাঝে মাঝে তোমার দেখা হয় কি? তার উপদেশে মিসেস বুল খুব উপকৃত হয়েছে। আমিও কিছু উপদেশ গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু কোন কাজে লাগল না; মিসেস এডাম‍স্ যেমন চাইছে, তাতে সামনের ক্রমবর্ধমান বোঝা নোয়ান যায় না। হাঁটবার সময় যদি সামনে ঝুঁকবার চেষ্টা করি, তাহলে ভারকেন্দ্র পাকস্থলীর উপরিভাগে আসে; কাজেই পুরোভাগে ডিগবাজি খেয়ে চলি।

ক্রোরপতি কেউ আসছে না, ‘কয়েক-সহস্র’পতিও নয়! দুঃখিত, খুব দুঃখিত!!! কি করতে পারি—যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আমার ক্লাসগুলি যে মহিলাতেই ভর্তি। … বেশ, ধৈর্য ধর। আমি চোখ মেলে রাখব, কখনও সুযোগ হারাব না। তুমি যদি কাকেও না পাও, অন্ততঃ আমার কুঁড়েমির জন্য তা নয়, জেনো।

সেই পুরাতন পথেই জীবন চলেছে। ক্রমাগত বক্তৃতা ও ধর্মপ্রসঙ্গ করে অনেক সময় বিরক্তি আসে, দিনের পর দিন চুপ করে থাকতে ইচ্ছা হয়।

তোমার স্বপ্ন শুভ হোক, কারণ সুখী হবার এটাই একমাত্র পথ।

সতত তোমার স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৫
54 W. 33rd St. New York
মে, ১৮৯৫

প্রিয়,
তোমাকে চিঠি লেখবার পর আমার ছাত্রেরা আবার এসেছে আমায় সাহায্য করবার জন্য; ক্লাসগুলি এখন খুবই সুন্দরভাবে চলবে, সন্দেহ নেই।
এতে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ শেখান ব্যাপারটা আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও বিশ্রাম যেমন প্রয়োজন, আমার জীবনে এও তেমনি প্রয়োজন।

তোমার
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমি ইংরেজী পত্রিকা ‘The Borderland’-এ—এর বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছি— ভারতে খুব ভাল কাজ করছে এবং হিন্দুরা যাতে তাদের ধর্ম বুঝতে পারে, সে বিষয়ে চেষ্টা করছে। আমি —র লেখায় কোনপ্রকার পাণ্ডিত্য দেখতে পাইনি, … অথবা কোন আধ্যাত্মিকতাও নয়। যাই হোক, যে জগতের ভাল করতে চায়, তার উদ্দেশ্য সফল হোক।

কত সহজেই এ সংসার ধাপ্পাবাজিতে ভুলে যায়! এবং সভ্যতার সূচনা থেকেই কত যে জুয়াচুরি বেচারা মানুষের মাথার ওপর জমছে!

*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৬
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
U. S. A.
মে (?), ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি ধর্মের গৌরব পুনঃস্থাপনের জন্য আবির্ভূত হই’—হে মহারাজ, ইহা পবিত্র গীতামুখে উচ্চারিত সেই সনাতন ভগবানের বাক্য, এই কথাগুলি জগতে আধ্যাত্মিক শক্তি-তরঙ্গের উত্থান-পতনের মূল সুর।
ধর্মজগতে এই পরিবর্তন বারংবার তাহার নূতন নূতন বিশিষ্ট ছন্দে প্রকাশিত হইতেছে; যদিও অন্যান্য বিরাট পরিবর্তনের ন্যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যগত প্রত্যেকটি বস্তুর উপর এই পরিবর্তনগুলিও প্রভাব বিস্তার করে, তথাপি শক্তি-ধারণে সমর্থ বস্তুর উপরেই তাহাদের কার্যকারিতা সমধিক প্রকাশ পায়।
বিশ্বগতভাবে যেমন জগতের আদিম অবস্থা ত্রিগুণের সাম্যভাব, এই সাম্যভাবের চ্যুতি ও তাহা পুনঃপ্রাপ্তির জন্য সমুদয় চেষ্টা লইয়াই এই প্রকৃতির বিকাশ বা বিশ্বজগৎ; যতদিন না এই সাম্যাবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসে, ততদিন এইভাবেই চলিতে থাকে। সীমাবদ্ধভাবে তেমনি আমাদের এই পৃথিবীতে যতদিন মনুষ্যজাতি এইভাবেই থাকিবে, ততদিন এই বৈষম্য ও তাহার অপরিহার্য পরিপূরক এই সাম্যলাভের চেষ্টা—দুই-ই পাশাপাশি বিরাজ করিবে। তাহাতে পৃথিবীর সর্বত্র ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিতর, উপজাতিগুলির ভিতর, এমন কি প্রত্যেকটি ব্যক্তিতে সুস্পষ্ট বিশেষত্ব থাকিবে।
অতএব নিরপেক্ষভাবে এবং সাম্য রক্ষা করিয়া সকলকে শক্তি প্রদত্ত হইলেও প্রত্যেক জাতিই যেন একটি বিশেষ প্রকার শক্তিসংগ্রহ ও বিতরণের উপযোগী এক-একটি অদ্ভুত যন্ত্র- স্বরূপ; ঐ জাতির অন্যান্য অনেক শক্তি থাকিলেও সেই শক্তিটিই তাহার বিশেষ লক্ষণরূপে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। মনুষ্যপ্রকৃতিতে একটি ভাবের তরঙ্গ উঠিলে, তাহার প্রভাব অল্প-বিস্তর সকলেই অনুভব করিলেও ঐ ভাব যে-জাতির বিশেষ লক্ষণ এবং সাধারণতঃ যে-জাতিকে কেন্দ্র করিয়া ঐ ভাবের আরম্ভ, সেই জাতির অন্তস্তল পর্যন্ত উহা দ্বারা আলোড়িত হয়। এই কারণেই ধর্মজগতে কোন আলোড়ন উপস্থিত হইলে তাহার ফলে ভারতে অবশ্যই নানাপ্রকার গুরুতর পরিবর্তন হইতে থাকিবে, ভারতকে কেন্দ্র করিয়াই বহুবিস্তৃত ধর্মতরঙ্গসমূহ বারংবার উত্থিত হইয়াছে, কারণ সর্বোপরি ভারত ধর্মের দেশ।
যাহা দ্বারা আদর্শলাভের সহায়তা হয়, মানুষ কেবল সেটিকেই বাস্তব বলে। সাংসারিক মানুষের নিকট যাহা কিছুর বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়, তাহাই বাস্তব; যাহার বিনিময়ে টাকা হয় না, তাহা অবাস্তব। প্রভুত্ব যাহার আকাঙ্ক্ষা, তাহার নিকট যাহাদ্বারা সকলের উপর প্রভুত্ব করিবার বাসনা চরিতার্থ হয়, তাহাই বাস্তব, বাকী সব কিছুই নয়। যাহা জীবনে বিশেষ প্রীতির প্রতিধ্বনি করে না, তাহার মধ্যে মানুষ কিছুই দেখিতে পায়
যাহাদের একমাত্র লক্ষ্য জীবনের সমুদয় শক্তির বিনিময়ে কাঞ্চন, নাম বা অপর কোনরূপ ভোগসুখ অর্জন করা, যাহাদের নিকট সমরসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদলের যুদ্ধযাত্রাই শক্তি-বিকাশের একমাত্র লক্ষণ, যাহাদের নিকট ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের একমাত্র সুখ, তাহাদের নিকট ভারত সর্বদাই একটা বিশাল মরুভূমির মত প্রতীয়মান হইবে; তাহাদের কাছে জীবনের বিকাশ বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহার পক্ষে ঐ মরুভূমির প্রতিটি দমকা বাতাস মারাত্মক।
কিন্তু যাঁহাদের জীবনতৃষ্ণা ইন্দ্রিয়জগতের অতি দূরে অবস্থিত অমৃতনদীর সলিলপানে একেবারে মিটিয়া গিয়াছে, যাঁহাদের আত্মা সর্পের জীর্ণত্বকমোচনের ন্যায় কাম, কাঞ্চন ও যশঃস্পৃহারূপ ত্রিবিধ বন্ধনকে দূরে ফেলিয়া দিয়াছে, যাঁহারা চিত্তস্থৈর্যের উন্নত শিখরে আরোহণ করিয়া তথা হইতে—ইন্দ্রিয়-বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণের ‘ভোগ’ বলিয়া কথিত আপাতমনোহর বস্তুর জন্য নীচজনোচিত কলহ, বিবাদ, দ্বেষহিংসার প্রতি প্রীতি ও প্রসন্নতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সঞ্চিত সৎকর্মের ফলে চক্ষু হইতে অজ্ঞানের আবরণ খসিয়া পড়ায় যাঁহারা অসার নামরূপের পারে প্রকৃত সত্যদর্শনে সমর্থ হইয়াছেন, তাঁহারা যেখানেই থাকুন না কেন, আধ্যাত্মিকতার জন্মভূমি ও অফুরন্ত খনি ভারতবর্ষ তাঁহাদের দৃষ্টিতে ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়; শূন্যে বিলীয়মান ছায়ার মত এই জগতে যিনি একমাত্র প্রকৃত সত্তা, তাঁহার সন্ধানরত প্রত্যেকটি সাধকের নিকট ভারত আশার আলোকরূপে প্রতীত হয়।
অধিকাংশ মানব তখনই শক্তিকে শক্তি বলিয়া বুঝিতে পারে, যখন অনুভবের উপযোগী করিয়া স্থূল আকারে উহা তাহাদের সম্মুখে ধরা হয়, তাহাদের নিকট যুদ্ধের উত্তেজনা শক্তির প্রত্যক্ষ বিকাশ বলিয়া প্রতীত হয়; আর যাহা কিছু ঝড়ের মত আসিয়া সম্মুখের সব কিছু উড়াইয়া লইয়া যায় না, উহা তাহাদের দৃষ্টিতে মৃত্যুস্বরূপ। সুতরাং শত শত শতাব্দীব্যাপী যে ভারতবর্ষ কোনরূপ বাধাদানে নিশ্চেষ্ট হইয়া বিদেশী বিজেতৃগণের পদতলে পতিত, জনতা সেখানে একতাহীন, স্বদেশপ্রেমের ভাবও যেখানে এতটুকু নাই—সেই ভারত তাহাদের নিকট বিকৃত অস্থিপূর্ণ দেশ, প্রাণহীন পচনশীল পদার্থের স্তূপ বলিয়া প্রতীত হইবে।
বলা হয়, যোগ্যতমই কেবল জীবনসংগ্রামে জয়ী হইয়া থাকে। তবে সাধারণ ধারণানুসারে যে-জাতি সর্বাপেক্ষা অযোগ্য, সে-জাতি দারুণ দুর্ভাগ্য সহ্য করিয়াও কেন বিনাশের কিছুমাত্র চিহ্ন প্রদর্শন করিতেছে না? তথাকথিত বীর্যবান্‌ ও কর্মপরায়ণ জাতিসমূহের শক্তি দিন দিন কমিয়া আসিতেছে, আর এদিকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ (?)’ হিন্দুর শক্তি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইতেছে, ইহা কিরূপে হইতেছে? এক মুহূর্তের মধ্যে যাহারা জগৎকে শোণিতসাগরে প্লাবিত করিয়া দিতে পারে, তাহারা খুব প্রশংসা পাইবার যোগ্য। যাহারা জগতের কয়েক লক্ষ লোককে সুখে-স্বচ্ছন্দে রাখিবার জন্য পৃথিবীর অর্ধেক লোককে অনাহারে রাখিতে পারে, তাহারাও মহৎ গৌরবের অধিকারী! কিন্তু যাহারা অপর কাহারও মুখ হইতে অন্ন কাড়িয়া না লইয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুখে রাখিতে পারে, তাহারা কি কোনরূপ সম্মান পাইবার যোগ্য নয়? শত শত শতাব্দী ধরিয়া অপরের উপর বিন্দুমাত্র অত্যাচার না করিয়া লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্য পরিচালনা করাতে কি কোনরূপ শক্তি প্রদর্শিত হয় না?
সকল প্রাচীন জাতির পুরাণেই দেখা যায়, বীরপুরুষদের প্রাণ তাঁহাদের শরীরের কোন বিশেষ ক্ষুদ্র অংশে ঘনীভূত ছিল। যতদিন সেখানে হাত পড়িত না, ততদিন তাঁহারা দুর্ভেদ্য থাকিতেন। বোধ হয় যেন প্রত্যেক জাতিরও এইরূপ একটি বিশেষ কেন্দ্রে জীবনীশক্তি সঞ্চিত আছে; তাহাতে হাত না পড়া পর্যন্ত কোন দুঃখবিপদই সেই জাতিকে বিনষ্ট করিতে পারে না।
ধর্মেই ভারতের এই জীবনীশক্তি। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বিস্মিত না হইতেছে, ততদিন জগতে কোন শক্তি তাহাদের ধ্বংস করিতে পারিবে না।
যে ব্যক্তি সর্বদাই স্বজাতির অতীতের দিকে ফিরিয়া তাকায়, আজকাল সকলেই তাহাকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে বলেন, এইরূপ ক্রমাগত অতীতের আলোচনাই হিন্দুজাতির নানারূপ দুঃখের কারণ। কিন্তু আমার বোধ হয়, ইহার বিপরীতটিই সত্য; যতদিন হিন্দুরা তাহাদের অতীত ভুলিয়া ছিল, ততদিন তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া অসাড় অবস্থায় পড়িয়াছিল। যতই তাহারা অতীতের আলোচনা করিতেছে, ততই চারিদিকে নূতন জীবনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতের ছাঁচেই ভবিষ্যৎকে গড়িতে হইবে, এই অতীতই ভবিষ্যৎ হইবে।
অতএব হিন্দুগণ যতই তাঁহাদের অতীত আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ ততই গৌরবময় হইবে; আর যে-কেহ এই অতীতকে প্রত্যেকের কাছে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিতেছেন, তিনিই স্বজাতির পরম হিতকারী। আমাদের পূর্বপুরুষগণের রীতিনীতিগুলি মন্দ ছিল বলিয়া যে ভারতের অবনতি হইয়াছে, তাহা নহে; এই অবনতির কারণ, ঐ রীতিনীতিগুলির যে ন্যায়সঙ্গত পরিণতি হওয়া উচিত ছিল, তাহা হইতে দেওয়া হয় নাই।
প্রত্যেক বিচারশীল পাঠকই জানেন, ভারতের সামাজিক বিধানগুলি যুগে যুগে পরিবর্তিত হইয়াছে। প্রথম হইতেই এই নিয়মগুলি এক বিরাট পরিকল্পনার প্রতিফলনের চেষ্টাস্বরূপ ছিল, কালক্রমে ধীরে ধীরে এগুলি বিকশিত হইবার কথা। প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এত দূরদর্শী ছিলেন যে, তাঁহাদের জ্ঞানের মহত্ত্ব বুঝিতে জগৎকে এখনও অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইবে। আর তাঁহাদের বংশধরগণের এই মহান্‌ উদ্দেশ্যের পূর্ণভাব ধারণা করিবার অক্ষমতাই ভারতের একমাত্র কারণ।
শত শত শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন ভারত তাহার প্রধান দুই জাতির—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের উচ্চাভিলাষপূর্ণ অভিসন্ধি-সাধনের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
একদিকে পুরোহিতগণ সাধারণ প্রজাদের উপর রাজাদের অবৈধ সামাজিক অত্যাচার নিবারণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই প্রজাগণকে ক্ষত্রিয়গণ আপনাদের ‘ন্যায়সঙ্গতভক্ষ্য’রূপে ঘোষণা করিতেন। অপর দিকে ক্ষত্রিয়গণই ভারতে একমাত্র শক্তিসম্পন্ন জাতি ছিলেন, যাঁহারা পুরোহিতগণের আধ্যাত্মিক অত্যাচার ও সাধারণ মানুষকে বন্ধন করিবার জন্য তাঁহারা যে ক্রমবর্ধমান নূতন নূতন ক্রিয়াকাণ্ড প্রবর্তন করিতেছিলেন, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছিলেন।
অতি প্রাচীনকাল হইতেই উভয় জাতির এই সংঘর্ষ আরম্ভ হইয়াছিল। সমগ্র শ্রুতির ভিতরেই ইহা অতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সাময়িকভাবে এই বিরোধ মন্দীভূত হইল, যখন ক্ষত্রিয়দের এবং জ্ঞানকাণ্ডের নেতা শ্রীকৃষ্ণ সামঞ্জস্যের পথ দেখাইয়া দিলেন। তাহার ফল গীতার শিক্ষা, যাহা ধর্ম দর্শন ও উদারতার সারস্বরূপ। কিন্তু বিরোধের কারণ তখনও বর্তমান ছিল, সুতরাং তার ফলও অবশ্যম্ভাবী।
সাধারণ দরিদ্র মূর্খ প্রজার উপর প্রভুত্ব করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বোক্ত দুই জাতির মধ্যেই বর্তমান ছিল, সুতরাং বিরোধ আবার প্রবলভাবে জাগিয়া উঠিল। আমরা সেই সময়কার যে সামান্য সাহিত্য পাই, তাহা সেই প্রাচীনকালের প্রবল বিরোধের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র, কিন্তু অবশেষে ক্ষত্রিয়ের জয় হইল, জ্ঞানের জয় হইল, স্বাধীনতার জয় হইল আর কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য রইল না, ইহার অধিকাংশই চিরকালের জন্য চলিয়া গেল।
এই উত্থানের নাম বৌদ্ধ সংস্কার। ধর্মের দিকে উহা কর্মকাণ্ড হইতে মুক্তি সূচনা করিতেছে, আর রাজনীতির দিকে ক্ষত্রিয় দ্বারা পুরোহিত-প্রাধান্যের বিনাশ সূচিত হইতেছে।
বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, প্রাচীন ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ যে দুই মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা উভয়েই—কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ক্ষত্রিয় ছিলেন। ইহা আরও বেশী লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, এই দুই দেবমানবই স্ত্রী-পুরষ জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্যই জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দিয়াছিলেন।
অদ্ভুত নৈতিক বল সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন মত ধ্বংস করিতে অত্যধিক সমুৎসুক ছিল। উহার অধিকাংশ শক্তিই নেতিমূলক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়াতে বৌদ্ধধর্মকে উহার জন্মভূমি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে হইল; আর যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, তাহাও বৌদ্ধধর্ম যে-সকল কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড নিবারণে নিয়োজিত হইয়াছিল, তদপেক্ষা শতগুণ ভয়ানক কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ডে পূর্ণ হইয়া উঠিল। যদিও উহা আংশিকভাবে বৈদিক পশুবলি নিবারণে কৃতকার্য হইয়াছিল, কিন্তু উহা সমুদয় দেশ, মন্দির, প্রতিমা, প্রতীক, যন্ত্র ও সাধুসন্তের অস্থিতে ভরিয়া ফেলিল।
সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের জন্য আর্য মঙ্গোলীয় ও আদিম প্রভৃতি ভিন্ন প্রকৃতির জাতির যে মিশ্রণ হইল, তাহাতে অজ্ঞাতসারে কতকগুলি বীভৎস বামাচারের সৃষ্টি হইল। প্রধানতঃ এই কারণেই সেই মহান্‌ আচার্যের উপদেশাবলীর এই বিকৃত পরিণতিকে শ্রীশঙ্কর ও তাঁহার সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় ভারত হইতে বিতাড়িত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এইরূপে মনুষ্যদেহধারিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান্ বুদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত জীবন-প্রবাহও পূতিগন্ধময় বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হইল; ভারতকে কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইল, যতদিন না ভগবান্ শঙ্করের আবির্ভাব এবং কিছু পরে-পরেই রামানুজ ও মধ্বাচার্যের অভ্যুদয় হইল।
ইতোমধ্যে ভারতেতিহাসের এক সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি অন্তর্হিত হইয়াছে। হিমালয় ও বিন্ধ্যের মধ্যবর্তী আর্যভূমি, যেখানে কৃষ্ণ ও বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাহা মহামান্য রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিগণের শৈশবের লীলাভূমি ছিল, তাহা এখন নীরব; আর ভারত উপদ্বীপের সর্বশেষ প্রান্ত হইতে, ভাষায় ও আকারে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এক জাতি হইতে, প্রাচীন ব্রাহ্মণগণের বংশধর বলিয়া গৌরবকারী বংশসমূহ হইতে বিকৃত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল।
আর্যাবর্তের সেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ কোথায় গেলেন? তাঁহারা একেবারে বিলুপ্ত, কেবল এখানে ওখানে ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্ব-অভিমানী কতকগুলি মিশ্র জাতি বাস করিতেছে। আর তাঁহাদের ‘এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশদগ্রজন্মনঃ’ পৃথিবীর সকল মানুষ আপন আপন চরিত্র শিক্ষা করিবে,৬২ এইরূপ অহঙ্কৃত, আত্মশ্লাঘাময় উক্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে অতি বিনয়ের সহিত দীনবেশে দাক্ষিণাত্যবাসীদের পদতলে বসিয়া শিক্ষা করিতে হইয়াছিল। ইহার ফলে ভারতে পুনরায় বেদের অভ্যুদয় হইল—বেদান্তের পুনরুত্থান হইল; এইরূপ বেদান্তের চর্চা আর কখনও হয় নাই, গৃহস্থেরা পর্যন্ত আরণ্যকপাঠে নিযুক্ত হইলেন।
বৌদ্ধধর্ম-প্রচারে ক্ষত্রিয়েরাই প্রকৃত নেতা ছিলেন এবং দলে দলে তাঁহারাই বৌদ্ধ হইয়াছিলেন। সংস্কার ও ধর্মান্তরকরণের উৎসাহে সংস্কৃত ভাষা উপেক্ষিত হইয়া লোকপ্রচলিত ভাষাসমূহের চর্চা প্রবল হইয়াছিল। আর অধিকাংশ ক্ষত্রিয়ই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃত শিক্ষার বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সুতরাং দাক্ষিণাত্য হইতে যে এই সংস্কার-তরঙ্গ আসিল, তাহাতে কিয়ৎপরিমাণে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণগণেরই উপকার হইল। কিন্তু উহা ভারতের অবশিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে অধিকতর ও নূতনতর বন্ধনের কারণ হইয়াছিল।
ক্ষত্রিয়গণ চিরকালই ভারতের মেরুদণ্ডস্বরূপ, সুতরাং তাঁহারাই বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার পরিপোষক। দেশ হইতে কুসংস্কার দূরীভূত করিবার জন্য বারংবার তাঁহাদের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হইয়াছে, আর ভারতেতিহাসে প্রথম হইতে তাঁহারাই পুরোহিতকুলের অত্যাচার হইতে সাধারণকে রক্ষা করিবার অভেদ্য প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান।
যখন তাঁহাদের অধিকাংশ ঘোর অজ্ঞানে নিমগ্ন হইলেন, এবং অপরাংশ মধ্য এশিয়ার বর্বর জাতিগুলির সহিত শোণিতসম্বন্ধ স্থাপন করিয়া ভারতে পুরোহিতগণের প্রাধান্য-স্থাপনে তরবারি নিয়োজিত করিল, তখনই ভারতে পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়া আসিল, আর ভারতভূমি একেবারে ডুবিয়া গেল। যতদিন না ক্ষত্রিয়-শক্তি জাগরিত হইয়া নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশিষ্ট জাতির চরণ-শৃঙ্খল মোচন করিয়া দেয়, ততদিন আর ভারত উঠিবে না। পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। নিজ ভ্রাতাকে অবনমিত করিয়া মানুষ স্বয়ং কি অবনত না হইয়া থাকিতে পারে?
জানিবেন, রাজাজী, আপনার পূর্বপুরুষগণের দ্বারা আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যঃ বিশ্বজগতের একত্ব। কোন ব্যক্তি নিজের কিছুমাত্র অনিষ্ট না করিয়া কি অপরের অনিষ্ট করিতে পারে? এই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের অত্যাচার-সমষ্টি চক্রবৃদ্ধিহারে তাঁহাদেরই উপর ফিরিয়া আসিয়াছে, এই সহস্রবর্ষব্যাপী দাসত্ব ও অপমানে তাহারা অনিবার্য কর্মফলই ভোগ করিতেছে।
আপনাদেরই একজন পূর্বপুরুষ বলিয়াছিলেন, ‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।’৬৩—যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা জীবদ্দশাতেই সংসার জয় করিয়াছেন। তাঁহাকে লোকে ভগবানের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাকে, আমরা সকলেই ইহা বিশ্বাস করি। তবে তাঁহার এই বাক্য কি অর্থহীন প্রলাপমাত্র? যদি তাহা না হয়, আর আমরা জানি তাঁহার বাক্য প্রলাপ নয়, তবে জাতি লিঙ্গ—এমন কি গুণ পর্যন্ত বিচার না করিয়া সমুদয় সৃষ্ট জগতের এই পূর্ণ সাম্যের বিরুদ্ধে যে-কোন চেষ্টা ভয়ানক ভ্রমাত্মক; আর যতদিন না এই সাম্যভাব আয়ত্ত হইতেছে, ততদিন কেহ কখনই মুক্ত হইতে পারে না।
অতএব হে রাজন, আপনি বেদান্তের উপদেশাবলী পালন করুন—অমুক ভাষ্যকারের বা টীকাকারের ব্যাখ্যানুসারে নহে, আপনার অন্তর্যামী আপনাকে যেরূপ বুঝাইয়াছেন, সেইভাবে। সর্বোপরি এই সর্বভূতে সর্ববস্তুতে সমজ্ঞানরূপ মহান্‌ উপদেশ পালন করুন—সর্বভূতে সেই এক ভগবানকে দর্শন করুন।
ইহাই মুক্তির পথ; বৈষম্যই বন্ধনের পথ। কোন ব্যক্তি বা কোন জাতি বাহিরের একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত বাহিরের স্বাধীনতা লাভ করিতে পারে না, আর সকলের মানসিক একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত মানসিক স্বাধীনতাও লাভ করিতে পারে না।
অজ্ঞান অসাম্য ও বাসনা—এই তিনটি মানবজাতির দুঃখের কারণ, আর উহাদের মধ্যে একটির সহিত অপরটির অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। একজন মানুষ নিজেকে অপর কোন মানুষ হইতে, এমন কি পশু হইতেও শ্রেষ্ঠ ভাবিবে কেন? বাস্তবিক সর্বত্রই তো এক বস্তু বিরাজিত। ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’৬৪ —তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার আবার তুমিই কুমারী।
অনেকে বলিবেন, ‘এরূপ ভাবা সন্ন্যাসীর পক্ষে ঠিক বটে, কিন্তু আমরা যে গৃহস্থ!’ অবশ্য গৃহস্থকে অন্যান্য অনেক কর্তব্য করিতে হয় বলিয়া সে পূর্ণভাবে এই সাম্য-অবস্থা লাভ করিতে পারে না, কিন্তু ইহা তাহাদেরও আদর্শ হওয়া উচিত। এই সমত্বভাব লাভ করাই সমগ্র সমাজের, সমুদয় জীবের ও সমগ্র প্রকৃতির আদর্শ। কিন্তু হায়, লোকে মনে করেঃ বৈষম্যই এই সমজ্ঞান-লাভের উপায়; অন্যায় কাজ করিয়া তাহারা যেন ন্যায়ের লক্ষ্যে—সত্যে পৌঁছিতে পারে!
ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতিতে বিষবৎ কার্য করে; মনুষ্যজাতির উপর অভিশাপস্বরূপ, সকল দুঃখের মূল কারণ—এই বৈষম্য। ইহাই শরীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক সর্ববিধ বন্ধনের মূল।
‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্বিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’৬৫
ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হিংসা করেন না, সুতরাং পরম গতি লাভ করেন। এই একটি শ্লোকে অল্প কথার মধ্যে সকলের উপযোগী মুক্তির উপায় বলা হইয়াছে।
রাজপুত আপনারা প্রাচীন ভারতের গৌরবস্বরূপ। আপনাদের অবনতি হইতেই জাতীয় অবনতি আরম্ভ হইল। লুণ্ঠিত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভাগ করিয়া লইবার জন্য নহে, জ্ঞানহীনগণকে জ্ঞানদানের জন্য ও পূর্বপুরুষদের পবিত্র বাসভূমির প্রনষ্ট গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য যদি ক্ষত্রিয়দের বংশধরগণ ব্রাহ্মণের বংশধরগণের সহিত সমবেত চেষ্টায় বদ্ধপরিকর হন, তবেই ভারতের উন্নতি সম্ভব।
আর কে বলিতে পারে, ইহা শুভ মুহূর্ত নহে? কালচক্র আবার ঘুরিয়া আসিতেছে, পুনর্বার ভারত হইতে সেই শক্তিপ্রবাহ বাহির হইয়াছে, যাহা অনতিদূরকালমধ্যে নিশ্চয়ই জগতের দূরতম প্রান্তে পৌঁছিবে। এক মহাবাণী উচ্চারিত হইয়াছে, যাহার প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, প্রতিদিনই যাহা অধিক হইতে অধিকতর শক্তিসংগ্রহ করিতেছে, আর এই বাণী পূর্ববর্তী সকল বাণী হইতেই অধিকতর শক্তিশালী, কারণ ইহা পূর্ববর্তী বাণীগুলির সমষ্টিস্বরূপ। যে বাণী একদিন সরস্বতীতীরে ঋষিগণের নিকট প্রকাশিত হইয়াছিল, যাহার প্রতিধ্বনি নগরাজ হিমালয়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হইতে হইতে কৃষ্ণ বুদ্ধ ও চৈতন্যের ভিতর দিয়া সমতল প্রদেশে নামিয়া সমগ্র দেশ প্লাবিত করিয়াছিল, তাহাই আবার উচ্চারিত হইয়াছে। আবার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে!
আর হে প্রিয় মহারাজ, আপনি সেই (ক্ষত্রিয়) জাতির বংশধর, যাঁহারা সনাতন ধর্মের জীবন্ত স্তম্ভস্বরূপ, অঙ্গীকারবদ্ধ রক্ষক ও সাহায্যকারী; আপনি রাম ও কৃষ্ণের বংশধর। আপনি কি এই কর্তব্য পালন না করিয়া দূরে থাকিবেন? আমি জানি, তাহা কখনই হইতে পারে না। আমার নিশ্চয় ধারণা, পুনরায় ধর্মের সাহায্যে আপনারই হস্ত প্রথমে প্রসারিত হইবে। হে রাজা অজিত সিং, যখনই আমি আপনার কথা ভাবি—যাঁহার মধ্যে আপনাদের বংশের সর্বজনবিদিত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সহিত এমন পবিত্র চরিত্র (যাহা থাকিলে একজন সাধুও গৌরবান্বিত হইতে পারেন) এবং সকল মানবের জন্য অসীম প্রেম যুক্ত হইয়াছে—যখন এইরূপ ব্যক্তিগণ সনাতন ধর্মের পুনর্গঠনে ইচ্ছুক, তখন আমি ইহার মহাগৌরবময় পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী না হইয়া থাকিতে পারি না।
চিরকালের জন্য আপনার উপর ও আপনার স্বজনগণের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক, আর আপনি পরের হিতের জন্য ও সত্যপ্রচারের জন্য দীর্ঘকাল জীবিত থাকুন, ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।

*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৭
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]

Thousand Island Park, N.Y.
C/o Miss Dutcher ১৮ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
রওনা হবার পূর্বদিন মিসেস স্টার্জিস্-এর এক চিঠি পেয়েছি, ৫০ ডলারের একখানা চেকও সঙ্গে আছে। পরদিনই তাঁর কাছে প্রাপ্তিস্বীকার পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি এর পর যখন তাঁকে চিঠি লিখবে, তখন আমার ধন্যবাদ ও প্রাপ্তিস্বীকারটা তাঁকে জানিয়ে দিও।
প্রাচীন হিন্দু প্রবচন ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’-ছাড়া এখানে বেশ সময় কাটছে। একই কথা, আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অগষ্টের প্রথম ভাগে চিকাগো যাচ্ছি। তুমি কখন রওনা হচ্ছ?
এখানকার বন্ধুরা সকলেই তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তোমার সর্বাঙ্গীণ সুখ শান্তি ও স্বাস্থ্য কামনা করি।
তোমার স্নেহের
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৮
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]

Thousand Island Park
২৯ জুলাই, ১৮৯৫
মা,
আপনার গৌরবময় সময় এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।
এখানে বেশ ভালভাবে সময় কাটছে। দু-একজন মহিলা সরাসরি ডেট্রয়েট থেকে এখানে এসেছেন আমাদের সঙ্গে থাকতে। তাঁরা বেশ পবিত্র ও ভাল। আমি থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড থেকে ডেট্রয়েটে এবং সেখান থেকে চিকাগোয় যাচ্ছি।
নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাস চলছে। আমার অনুপস্থিতিতেও তারা বেশ সাহসের সঙ্গে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। ভাল কথা, ডেট্রয়েট থেকে যে দু-জন মহিলা এসেছেন, তাঁরা ক্লাসে যোগদান করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভূতের ভয়। তাঁদের কে শিখিয়েছে, জ্বলন্ত এলকোহলের শিখায় একটু নুন দিলে কাল তলানি পড়ে, তাহলে সেটা হবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ। যা হোক, মহিলা দুটি বেশ ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। লোকে বলে, এই রকম ভূত বিশ্বজগতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পিতা লেগেট আপনার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব নিরুৎসাহ হয়েছেন। কারণ আজ পর্যন্ত তাঁর কোন চিঠি পাইনি। বেশ, দুঃখ আসে আসুক, বিচলিত না হওয়াই শ্রেয়। কাজেই তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।
জো জো-র সমুদ্রযাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকবে। শেষ রক্ষাই রক্ষা।
শিশুরা৭৮ জার্মানীতে বেশ আনন্দে আছে, নিশ্চয়। তাদের জাহাজ-ভর্তি ভালবাসা জানাবেন।
এখানকার সকলের ভালবাসা জানবেন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট আপনার জীবন আলোক-বর্তিকার মত হোক—এই কামনা করি।
আপনার পুত্র
তোমাদের বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৪৯

High View, Caversham, Reading
C/o E. T. Sturdy, Esq.,
১৮৯৬
প্রিয়—,
… প্রত্যেকে পূর্ণ উদ্যম প্রকাশ না করলে কি কোন কাজ সম্পন্ন হয়? ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’—সিংহহৃদয় কাজের মানুষের কাছেই লক্ষ্মীদেবী এসে থাকেন।
পেছন ফিরে তাকানর প্রয়োজন নেই। আগে চল! আমাদের চাই অনন্ত শক্তি, অফুরন্ত উৎসাহ, সীমাহীন সাহস, অসীম ধৈর্য, তবেই আমরা বড় বড় কাজ করতে পারব। … ইতি
তোমাদের স্নেহশীল
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৫০
ওঁ তৎ সৎ
England
মে (?) ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
পূর্বপত্রে যদি ভুল হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই পত্রে লিখি যে, কালী যে দিবস start (যাত্রা) করিবে, সেদিন কিম্বা তাহার আগে যেন E. T. Sturdy (স্টার্ডি)-কে চিঠি লেখে, যাহাতে সে যাইয়া তাহাকে জাহাজ হইতে লইয়া আসে। এ লণ্ডন শহর মানুষের জঙ্গল—দশ পনরটা কলিকাতা একত্রে—অতএব ঐ প্রকার না করিলে গোলমাল হয়ে যাবে। আসতে দেরী যেন না হয়, পত্রপাঠ চলে আসতে বলবে। শরতের বেলার মত যেন না হয়। বাকী বুঝে-সুঝে ঠিক করে নেবে।
কালীকে যাই হোক সত্বর পাঠাবে। যদি শরতের বেলার মত দেরী হয় তো কাহাকেও আসতে হবে না; ও-রকম গড়িমসির কাজ নয়। মহা রজোগুণের কাজ, আমাদের দেশময় খালি তমস্, আমাদের দেশে রজস্ চাই—তারপর সত্ত্ব, সে ঢের দূরের কথা। ইতি

নরেন্দ্র
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৫১
[ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষকে লিখিত]
বেলুড় মঠ, হাওড়া
৬ মার্চ, ১৮৯৯
প্রিয় মহাশয়,
আপনার অত্যন্ত সানুগ্রহ আমন্ত্রণের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার পত্রের উত্তর দিতে এত দেরী হল বলে বিশেষ দুঃখিত।
আমি সে-সময় খুব অসুস্থ ছিলাম এবং যাঁর উপর পত্রের উত্তর দেবার ভার ছিল, তিনি তা দেননি বলেই মনে হয়। আমি এইমাত্র তা জানতে পেরেছি।
আপনাদের সানুগ্রহ আহ্বানের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি। এই শীতকালেই আপনাদের ঐ অঞ্চল (পূর্ববঙ্গ) দেখব বলে সঙ্কল্প করেছিলাম। কিন্তু আমার কর্মের গতি অন্যরূপ। প্রাচীন বাঙলার সভ্যতার কেন্দ্র দেখবার আনন্দ পাবার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
আপনাদের সহৃদয়তার জন্য আবার ধন্যবাদ।
শুভার্থী
বিবেকানন্দ
*******************
পত্র সংখ্যা - ৫৫২
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

১৭১৯ টার্ক ষ্ট্রীট, সান ফ্রান্সিস্কো
২৮ মার্চ, ১৯০০
আশীর্বাদভাজন মেরী,
তোমাকে জানাচ্ছি আমি খুবই আনন্দে আছি। তার মানে এ নয় যে, একটা কুহেলিকাময় সুখবাদের দিকে আমি চলেছি, তবে দুঃখকে সহ্য করবার শক্তি আমার বেড়ে যাচ্ছে। এ দুনিয়ার সুখদুঃখের পূতিগন্ধময় বাষ্পের ঊর্ধ্বে আমি উঠে যাচ্ছি, এগুলি আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা স্বপ্নের রাজ্য, এখানে আনন্দ উপভোগই বা কি, আর কান্নাই বা কি; সে-সব স্বপ্ন বৈ তো নয়। তাই অচিরেই হোক, বিলম্বেই হোক সেগুলি ভাঙবেই। ওখানে তোমাদের সব কেমন চলছে? হ্যারিয়েট প্যারিসে খুব আনন্দে কাটাচ্ছে। তার সঙ্গে সেখানে নিশ্চয়ই দেখা করব। আমি একখানা ফরাসী অভিধান কণ্ঠস্থ করছি! কিছু টাকাও করছি; সকাল-সন্ধ্যা কঠোর পরিশ্রম চলছে, তা সত্ত্বেও আগের তুলনায় ভাল। সুনিদ্রা, সুপরিপাক ও সম্পূর্ণ অনিয়ম চলেছে।
তোমরা পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছ। এপ্রিলের শেষে চিকাগো যাব বলে মনে করছি। যদি না পারি, তবে নিশ্চয়ই তোমাদের চলে যাবার আগেই পূর্বাঞ্চলে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব।
ম্যাক‍্‍‍কিণ্ডলি ভগিনীরা এখন কি করছে? আঙুরের রস খেয়ে খেয়ে বুঝি মোটা হয়ে উঠছে? এগিয়ে যাও, জীবনটা স্বপ্ন ছাড়া আর কি! আর তাই বলে তুমি কি খুশী নও? আর আমি! লোকে চায় চিরন্তন স্বর্গ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, স্বয়ং তিনি ছাড়া আর কিছুই শাশ্বত নয়। আমি নিশ্চিত যে, একমাত্র তিনিই চিরন্তন স্বর্গ সহ্য করতে পারেন। এইসব বাজে জিনিষের চিরস্থায়িত্ব!
আমার পারিপার্শ্বিকের মধ্যে গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি। শীঘ্রই তা গর্জন শুরু করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি অচঞ্চল থাকব। এখনই তোমার চারপাশে কোন গুঞ্জন নেই। খুব দুঃখিত, অর্থাৎ দুঃখিত হবার চেষ্টা করছি, কারণ কোন কিছুর জন্যই আমি দুঃখিত হতে পারি না। সকল বোধের অতীত একটা শান্তি আমি লাভ করেছি, তা আনন্দ বা দুঃখের কোনটাই নয়, অথচ দুয়ের ঊর্ধ্বে। মাকে সে-কথা বল। গত দু-বছর ধরে মৃত্যু-উপত্যকার উপর দিয়ে শারীরিক ও মানসিক যাত্রা আমাকে এ বিষয়ে সহায়তা করেছে। এখন আমি সেই শান্তির সেই চিরন্তন নীরবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সকল বস্তুকে তার নিজের স্বরূপে আমি দেখছি, সব কিছুই সেই শান্তিতে বিধৃত, নিজের ভাবে পরিপূর্ণ। ‘যিনি আত্মতুষ্ট, যিনি আত্মরতি, তাঁরই যথার্থ শিক্ষালাভ হয়েছে’—এ জগতে এই বড় শিক্ষাটি আমাদের জানতে হয় অসংখ্য জন্ম এবং স্বর্গ ও নরকের মধ্য দিয়ে—আত্মা ছাড়া আর কিছুই কামনার বা আকাঙ্ক্ষার বস্তু নেই। ‘আত্মাকে লাভ করাই হল শ্রেষ্ঠ লাভ’, ‘আমি মুক্ত’, অতএব আমার আনন্দের জন্য দ্বিতীয় কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। ‘চির একাকী, কারণ আমি মুক্ত ছিলাম, এখনও মুক্ত এবং চিরকাল মুক্ত থাকব’—এই হল বেদান্তবাদ। এতকাল আমি এই তত্ত্বটি প্রচার করছি। তবে আঃ, কী আনন্দ!—প্রিয় ভগিনী মেরী, এখন প্রতিটি দিন তা উপলব্ধি করছি। হ্যাঁ, তাই—‘আমি মুক্ত’। আমি একা—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’’।

সচ্চিদানন্দে মগ্ন তোমার চিরকালের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—এখন আমি সত্যিকারের বিবেকানন্দ হতে চলেছি। তুমি কখনও মন্দকে উপভোগ করেছ? হাঃ! হাঃ! বোকা মেয়ে, সবই ভাল! যত সব বাজে। কিছু ভাল, কিছু মন্দ। ভাল-মন্দ দুই-ই আমার উপভোগ্য। আমিই ছিলাম যীশু এবং আমিই ছিলাম জুডাস ইস্ক্যারিয়ট; দুই-ই আমার খেলা, আমারই কৌতুক। ‘যতদিন দুই আছে, ততদিন ভয় তোমাকে ছাড়বে না।’ উটপাখীর মত বালির মধ্যে মুখ লুকিয়ে ভাবছ, কেউ তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না। সব কিছুই ভাল। সাহসী হও, সব কিছুর সম্মুখীন হও; ভাল আসুক, মন্দ আসুক—দুটিকেই বরণ করে নাও, দুই-ই আমার খেলা। আমার লভ্য ভাল বস্তু কিছুই নেই, ধরে থাকবার মত কোন আদর্শ নেই; পূর্ণ করবার মত উচ্চাভিলাষও নেই; আমি হীরের খনি, ভাল-মন্দের নুড়ি নিয়ে খেলা করছি। ভাল-মন্দ দুই-ই ভাল। মন্দ, তুমি এস, ভালর জন্য; ভাল, তুমিও এস। আমার সামনে দুনিয়াটা উল্টে-পাল্টে গেলেই বা আমার কি আসে যায়? আমি বুদ্ধির অতীত শান্তি; বুদ্ধি আমাদের কেবল ভাল-মন্দই দিতে পারে। আমি তার বাইরে, আমি শান্তি।

—বি
*******************

Post a Comment

0 Comments