ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
দ্বিতীয় ভাগ 

একাদশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে

একাদশ খণ্ড ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে

===========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৯ই ডিসেম্বর
ভক্তিযোগ ,সমাধিতত্ত্ব ও মহাপ্রভুর অবস্থা
রবিবার, ৯ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; (২৪শে) অগ্রহায়ণ, শুক্লা দশমী তিথি, বেলা প্রায় একটা-দুইটা হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে সেই ছোট খাটটিতে বসিয়া ভক্তদের সঙ্গে হরিকথা কহিতেছেন। অধর, মনোমোহন, ঠনঠনের শিবচ ন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, হরিশ ইত্যাদি অনেকে বসিয়া আছেন, হাজরাও তখন ওইখানে থাকেন। ঠাকুর মহাপ্রভুর অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা হত —

১. বাহ্যদশা — তখন স্থূল আর সূক্ষ্ম তাঁর মন থাকত।
২. অর্ধবাহ্যদশা — তখন কারণ শরীরে, কারণানন্দে মন গিয়েছে।
৩. অন্তর্দশা — তখন মহাকারণে মন লয় হত।

বেদান্তের পঞ্চকোষের সঙ্গে, এর বেশ মিল আছে। স্থূলশরীর, অর্থাৎ অন্নময় ও প্রাণময় কোষ। সূক্ষ্মশরীর, অর্থাৎ মনোময় ও বিজ্ঞানময় কোষ। কারণ শরীর, অর্থাৎ আনন্দময় কোষ। মহাকারণে যখন মন লীন হত তখন সমাধিস্থ। — এরই নাম নির্বিকল্প বা জড়সমাধি।

“চৈতন্যদেবের যখন বাহ্যদশা হত তখন নামসংকীর্তন করতেন। অর্ধ-বাহ্যদশায় ভক্তসঙ্গে নৃত্য করতেন। অর্ন্তদশায় সমাধিস্থ হতেন।”

মাস্টার (স্বগত) — ঠাকুর কি নিজের সমস্ত অবস্থা এইরূপে ইঙ্গিত করছেন? চৈতন্যদেবেরও এইরূপ হত!

শ্রীরামকৃষ্ণ — চৈতন্য ভক্তির অবতার, জীবকে ভক্তি শিখাতে এসেছিলেন। তাঁর উপর ভক্তি হল তো সবই হল। হঠযোগের কিছু দরকার নাই।

[ হঠযোগ ও রাজযোগ ]

একজন ভক্ত — আজ্ঞা, হঠযোগ কিরূপ?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হঠযোগে শরীরের উপর বেশি মনোযোগ দিতে হয়। ভিতর প্রক্ষালন করবে বলে বাঁশের নলে গুহ্যদার রক্ষা করে। লিঙ্গ দিয়ে দুধ ঘি টানে। জিহ্বাসিদ্ধি অভ্যাস করে। আসন করে শূন্যে কখন কখন উঠে! ও-সব বায়ুর কার্য। একজন বাজি দেখাতে দেখাতে তালুর ভিতর জিহ্বা প্রবেশ করে দিয়েছিল। অমনি তার শরীর স্থির হয়ে গেল। লোকে মনে করলে, মরে গেছে। অনেক বৎসর সে গোর দেওয়া রহিল। বহুকালের পরে সেই গোর কোন সূত্রে ভেঙে গিয়েছিল! সেই লোকটার তখন হঠাৎ চৈতন্য হল। চৈতন্য হবার পরই, সে চেঁচাতে লাগল, লাগ্‌ ভেলকি, লাগ্‌ ভেলকি! (সকলের হাস্য) এ-সব বায়ুর কার্য।

“হঠযোগ বেদান্তবাদীরা মানে না।

“হঠযোগ আর রাজযোগ। রাজযোগে মনের দ্বারা যোগ হয় — ভক্তির দ্বারা বিচারের দ্বারা যোগ হয়। ওই যোগই ভাল। হঠযোগ ভাল নয়, কলিতে অন্নগত প্রাণ!”
============

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৯ই ডিসেম্বর

ঠাকুরের তপস্যা — ঠাকুরের আত্মিয়গণ ও ভবিষ্যৎ মহাতীর্থ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নহবতের পার্শ্বে রাস্তায় দাঁড়াইয়া আছেন। দেখিতেছেন নহবতের বারান্দার একপার্শ্বে বসিয়া, বেড়ার আড়ালে মণি গভীর চিন্তামগ্ন। তিনি কি ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন? ঠাকুর ঝাউতলায় গিয়াছিলেন, মুখ ধুইয়া ওইখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিগো, এইখানে বসে! তোমার শীঘ্র হবে। একটু করলেই কেউ বলবে, এই এই!

চকিত হইয়া তিনি ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া আছেন। এখনও আসন ত্যাগ করেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার সময় হয়েছে। পাখি ডিম ফুটোবার সময় না হলে ডিম ফুটোয় না। যে ঘর বলেছি, তোমার সেই ঘরই বটে।

এই বলিয়া ঠাকুর মণির ‘ঘর’ আবার বলিয়া দিলেন।

“সকলেরই যে বেশি তপস্যা করতে হয়, তা নয়। আমার কিন্তু বড় কষ্ট করতে হয়েছিল। মাটির ঢিপি মাথায় দিয়ে পড়ে থাকতাম। কোথা দিয়ে দিন চলে যেত। কেবল মা মা বলে ডাকতাম, কাঁদতাম। ঞ্চঞ্চ

মণি ঠাকুরের কাছে প্রায় দুই বৎসার আসিতেছেন। তিনি ইংরেজী পড়েছেন। ঠাকুর তাঁহাকে কখন কখন ইংলিশম্যান বলতেন। কলেজে পড়াশুনা করেছেন। বিবাহ করেছেন।

তিনি কেশব ও অন্যান্য পণ্ডিতদের লেকচার শুনিতে, ইংরেজী দর্শন ও বিজ্ঞান পড়িতে ভালবাসেন। কিন্তু ঠাকুরের কাছে আসা অবধি, ইওরোপীয় পণ্ডিতদের গ্রন্থ ও ইংরেজী বা অন্য ভাষার লেকচার তাঁহার আলুনী বোধ হইয়াছে। এখন কেবল ঠাকুরকে রাতদিন দেখিতে ও তাঁহার শ্রীমুখের কথা শুনিতে ভালবাসেন।

আজকাল তিনি ঠাকুরের একটি কথা সর্বদা ভাবেন। ঠাকুর বলেছেন, “সাধন করলেই ঈশ্বরকে দেখা যায়,” আরও বলেছেন, “ঈশ্বরদর্শনই মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — একটু কল্লেই কেউ বলবে, এই এই। তুমি একাদশী করো। তোমরা আপনার লোক, আত্মীয়। তা না হলে এত আসবে কেন? কীর্তন শুনতে শুনতে রাখালকে দেখেছিলাম ব্রজমণ্ডলের ভিতর রয়েছে। নরেন্দ্রের খুব উঁচুঘর। আর হীরানন্দ। তার কেমন বালকের ভাব। তার ভাবটি কেমন মধুর। তাকেও দেখবার ইচ্ছা করে।

[পূর্বকথা — গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ — তুলসী কানন — সেজোবাবুর সেবা ]

গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ দেখেছিলাম। ভাবে নয়, এই চোখে! আগে এমন অবস্থা ছিল যে, সাদাচোখে সব দর্শন হত! এখন তো ভাবে হয়।

“সাদাচোখে গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ সব দেখেছিলাম। তারমধ্যে তোমায়ও যেন দেখেছিলাম। বলরামকেও যেন দেখেছিলাম।

“কারুকে দেখলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াই কেন জান; আত্মীয়দের অনেক কাল পরে দেখলে ওইরূপ হয়।

“মাকে কেঁদে কেঁদে বলতাম, মা! ভক্তদের জন্যে আমার প্রাণ যায়, তাদের শীঘ্র আমায় এনে দে। যা যা মনে করতাম, তাই হত।

পঞ্চবটীতে তুলসী কানন করেছিলাম, জপ-ধ্যান করব বলে। ব্যাঁকারির বেড়া দেবার জন্য বড় ইচ্ছা হল। তারপরেই দেখি জোয়ারে কতকগুলি ব্যাঁকারির আঁটি, খানিকটা দড়ি, ঠিক পঞ্চবটীর সামনে এসে পড়েছে! ঠাকুরবাড়ির একজন ভারী ছিল, সে নাচতে নাচতে এসে খবর দিলে।

“যখন এই অবস্থা হল, পূজা আর করতে পারলাম না। বললাম, মা, আমায় কে দেখবে? মা! আমার এমন শক্তি নাই যে, নিজের ভার নিজে লই। আর তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে; ভক্তদের খাওয়াতে ইচ্ছা করে; কারুকে সামনে পড়লে কিছু দিতে ইচ্ছা করে। এ-সব মা, কেমন করে হয়। মা, তুমি একজন বড়মানুষ পেছনে দাও! তাইতো সেজোবাবু এত সেবা করলে।

“আবার বলেছিলাম, মা! আমার তো আর সন্তান হবে না, কিন্তু ইচ্ছা করে, একটি শুদ্ধ-ভক্ত ছেলে, আমার সঙ্গে সর্বদা থাকে। সেইরূপ একটি ছেলে আমায় দাও। তাই তো রাখাল হল। যারা যারা আত্মীয়, তারা কেউ অংশ, কেউ কলা।”

ঠাকুর আবার পঞ্চবটীর দিকে যাইতেছেন। মাস্টার সঙ্গে আছেন, আর কেহ নাই। ঠাকুর সহাস্যে তাঁহার সহিত নানা কথা কহিতেছেন।

[পূর্বকথা — অদ্ভুত মূর্তি দর্শন — বটগাছের ডাল ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — দেখ, একদিন দেখি — কালীঘর থেকে পঞ্চবটী পর্যন্ত এক অদ্ভুত মূর্তি। এ তোমার বিশ্বাস হয়?

মাস্টার অবাক্‌ হইয়া রহিলেন।

তিনি পঞ্চবটীর শাখা হইতে ২/১টি পাতা পকেটে রাখিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এই ডাল পড়ে গেছে, দেখেছ; এর নিচে বসতাম।

মাস্টার — আমি এর একটি কচি ডাল ভেঙে নিয়ে গেছি — বাড়িতে রেখে দিয়েছি।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কেন?

মাস্টার — দেখলে আহ্লাদ হয়। সব চুকে গেলে এই স্থান মহাতীর্থ হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কিরকম তীর্থ? কি, পেনেটীর মতো?

পেনেটীতে মহাসমারোহ করিয়া রাঘব পণ্ডিতের মহোৎসব হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রায় প্রতি বৎসর এই মহোৎসব দেখিতে গিয়া থাকেন ও সংকীর্তন মধ্যে প্রেমানন্দে নৃত্য করেন, যেন শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তের কাছে ডাক শুনিয়া স্থির থাকিতে না পারিয়া, নিজে আসিয়া সংকীর্তন মধ্যে প্রেমমূর্তি দেখাইতেছেন।
===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৯ই ডিসেম্বর

হরিকথাপ্রসঙ্গে

সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের ছোট খাটটিতে বসিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। ক্রমে ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরদের আরতি আরম্ভ হইল। শাঁকঘন্টা বাজিতে লাগিল। মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর মাস্টারকে “ভক্তমাল” পাঠ করিয়া শুনাইতে বলিলেন। মাস্টার পড়িতেছেন

চরিত্র শ্রীমহারাজ শ্রীজয়মল

জয়মল নামে এক রাজা শুদ্ধমতি। অনির্বচনীয় তাঁর শ্রীকৃষ্ণ পিরীত ৷৷
ভক্তি-অঙ্গ-যাজনে যে সুদৃঢ় নিয়ম। পাসাণের রেখা যেন নাহি বেশি কম ৷৷
শ্যামল সুন্দর নাম শ্রীবিগ্রহসেবা। তাহাতে প্রপন্ন, নাহি জানে দেবী দেবা ৷৷
দশদণ্ড-বেলা-বধি তাঁহার সেবায়। নিযুক্ত থাকয়ে সদা দৃঢ় নিয়ম হয় ৷৷
রাজ্যধন যায় কিবা বজ্রাঘাত হয়। তথাপিহ সেবা সমে ফিরি না তাকায় ৷৷
প্রতিযোগী রাজা ইহা সন্ধান জানিয়া। সেই অবকাশকালে আইল হানা দিয়া ৷৷
রাজার হুকুম বিনে সৈন্য-আদি-গণ। যুদ্ধ না করিতে পারে করে নিরীক্ষণ ৷৷
ক্রমে ক্রমে আসি গড় ঘেরে রিপুগণ। তথাপিহ তাহাতে কিঞ্চিৎ নাহি মন ৷৷
মাতা তাঁর আসি করে কত উচ্চধ্বনি। উদ্বিগ্ন হইয়া যে মাথায় কর হানি ৷৷
সর্বস্ব লইল আর সর্বনাশ হৈল। তথাপি তোমার কিছু ভুরুক্ষেপ নৈল ৷৷
জয়মল কহে মাতা কেন দুঃখভাব। যেই দিল সেই লবে তাহে কি করিব ৷৷
সেই যদি রাখে তবে কে লইতে পারে। অতএব আমা সবার উদ্যমে কি করে ৷৷
শ্যামলসুন্দর হেথা ঘোড়ায় চড়িয়া। যুদ্ধ করিবারে গেলা অস্তর ধরিয়া ৷৷
একাই ভক্তের রিপু সৈন্যগণ মারি। আসিয়া বান্ধিল ঘোড়া আপন তেওয়ারি ৷৷
সেবা সমাপনে রাজা নিকশিয়া দেখে। ঘোরার সর্বাঙ্গে ঘর্ম শ্বাস বহে নাকে ৷৷
জিজ্ঞাসয়ে মোর অশ্বে সওয়ার কে হৈল। ঠাকুর মন্দিরে বা কে আনি বান্ধিল ৷৷
সবে কহে কে চড়িল কে আনি বান্ধিল। আমরা যে নাহি জানি কখন আনিল ৷৷
সংশয় হইয়া রাজা ভাবিতে ভাবিতে। সৈন্যসামন্ত সহ চলিল যুদ্ধেতে ৷৷
যুদ্ধস্থানে গিয়া দেখে শত্তুরে সৈন্য। রণশয্যায় শুইয়াছে মাত্র এক ভিন্ন ৷৷
প্রধান যে রাজা এবে সেই মাত্র আছে। বিস্ময় হইয়া ঞিহ কারণ কি পুছে ৷৷
হেনকালে অই প্রতিযোগী যে রাজা। গলবস্ত্র হইয়া করিল বহু পূজা ৷৷
আসিয়া জয়মল মহারাজার অগ্রেতে। নিবেদন করে কিছু করি জোড়হাতে ৷৷
কি করিব যুদ্ধ তব এক যে সেপাই। পরম আশ্চর্য সে ত্রৈলোক্য-বিজয়ী ৷৷
অর্থ নাহি মাগোঁ মুঞি রাজ্য নাহি চাহোঁ। বরঞ্চ আমার রাজ্য চল দিব লহো ৷৷
শ্যামল সেপাই সেই লড়িতে আইল। তোমাসনে প্রীতি কি তার বিবরিয়া বল ৷৷
সৈন্য যে মারিল মোর তারে মুই পারি। দরশনমাত্রে মোর চিত্ত নিল হরি ৷৷
জয়মল বুঝিল এই শ্যামলজীর কর্ম। প্রতিযোগী রাজা যে বুঝিল ইহা মর্ম ৷৷
জয়মলের চরণ ধরিয়া স্তব করে। যাহার প্রসাদে কৃষ্ণকৃপা হৈল তারে ৷৷
তাঁহা-সবার শ্রীচরণে শরণ আমার। শ্যামল সেপাই যেন করে অঙ্গীকার ৷৷

পাঠান্তে ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।

[ভক্তমাল একঘেয়ে — অন্তরঙ্গ কে? জনক ও শুকদেব ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার এ-সব বিশ্বাস হয়? তিনি সওয়ার হয়ে সেনা বিনাশ করেছিলেন — এ-সব বিশ্বাস হয়?

মাস্টার — ভক্ত, ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিল — এ-অবস্থা বিশ্বাস হয়। ঠাকুরকে সওয়ার ঠিক দেখেছিল কিনা — এ-সব বুঝতে পারি না। তিনি সওয়ার হয়ে আসতে পারেন, তবে ওরা তাঁকে ঠিক দেখেছিল কিনা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — বইখানিতে বেশ ভক্তদের কথা আছে। তবে একঘেয়ে। যাদের অন্য মত, তাদের নিন্দা আছে।

পরদিন সকালে উদ্যানপথে দাঁড়াইয়া ঠাকুর কথা কহিতেছেন। মণি বলিতেছেন, আমি তাহলে এখানে এসে থাকব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, এত যে তোমরা আস, এর মানে কি! সাধুকে লোকে একবার হদ্দ দেখে যায়। এত আস — এর মানে কি?

মণি অবাক্‌। ঠাকুর নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — অন্তরঙ্গ না হলে কি আস। অন্তরঙ্গ মানে আত্মীয়, আপনার লোক — যেমন, বাপ, ছেলে, ভাই, ভগ্নী।

“সব কথা বলি না। তাহলে আর আসবে কেন?

“শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য জনকের কাছে গিয়েছিল। জনক বললে, আগে দক্ষিণা দাও। শুকদেব বললে, আগে উপদেশ না পেলে কেমন করে দক্ষিণা হয়! জনক হাসতে হাসতে বললে, তোমার ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর কি গুরু-শিষ্য বোধ থাকবে? তাই আগে দক্ষিণার কথা বললাম।”
===========

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ৯ই ডিসেম্বর

সেবক হৃদয়ে

শুক্লপক্ষ। চাঁদ উঠিয়াছে। মণি কালীবাড়ির উদ্যানপথে পাদচারণ করিতেছেন। পথের একধারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর, নহবতখানা, বকুলতলা ও পঞ্চবটী; অপরধারে ভাগীরথী জ্যোৎস্নাময়ী।

আপনা-আপনি কি বলিতেছেন। — “সত্য সত্যই কি ঈশ্বরদর্শন করা যায়? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলিতেছেন। বললেন, একটু কিছু করলে কেউ এসে বলে দেবে, ‘এই এই’। অর্থাৎ একটু সাধনের কথা বললেন। আচ্ছা; বিবাহ, ছেলেপুলে হয়েছে, এতেও কি তাঁতে লাভ করা যায়? (একটু চিন্তার পর) অবশ্য করা যায়, তা নাহলে ঠাকুর বলছেন কেন? তাঁর কৃপা হলে কেন না হবে?

“এই জগৎ সামনে — সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জীব, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব। এ-সব কিরূপে হল, এর কর্তাই বা কে, আর আমিই বা তাঁর কে — এ না জানলে বৃথাই জীবন!

“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পুরুষের শ্রেষ্ঠ। এরূপ মহাপুরুষ এ-পর্যন্ত এ-জীবনে দেখি নাই। ইনি অবশ্যই সেই ঈশ্বরকে দেখেছেন। তা না হলে, মা মা করে কার সঙ্গে রাতদিন কথা কন! আর তা না হলে, ঈশ্বরের ওপর ওঁর এত ভালবাসা কেমন করে হল। এত ভালবাসা যে ভাবশূন্য হয়ে যান! সমাধিস্থ, জড়ের ন্যায় হয়ে যান। আবার কখন বা প্রেমে উন্মত্ত হয়ে হাসেন, কাঁদেন, নাচেন, গান!”
==========

Post a Comment

0 Comments