শ্রীরামকৃষ্ণ অসুখে অধৈর্য কেন?

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ 

দ্বাদশ খণ্ড
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, রাম, নিত্য, অধর, মাস্টার, মহিমা প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ অসুখে অধৈর্য কেন?

========

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৩শে মার্চ
শ্রীরামকৃষ্ণ অসুখে অধৈর্য কেন? বিজ্ঞানীর অবস্থা

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্নে সেবার পর রাখাল, রাম প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ নহে — এখনও হাতে বাড় বাঁধা। (আজ রবিবার, ১১ই চৈত্র, ১২৯০; কৃষ্ণা একাদশী; ২৩শে মার্চ, ১৮৮৪)।

নিজের অসুখ, — কিন্তু ঠাকুর আনন্দের হাট বসাইতেছেন। দলে দলে ভক্ত আসিতেছেন। সর্বদাই ঈশ্বরকথা প্রসঙ্গে — আনন্দ। কখনও কীর্তনানন্দ, কখনও বা ঠাকুর সমাধিস্ত হইয়া ব্রহ্মানন্দ ভোগ করিতেছেন। ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া দেখে। ঠাকুর কথা কহিতেছেন।

[নরেন্দ্রের বিবাহ-সম্বন্ধ — “নরেন্দ্র দলপতি” ]

রাম — আর মিত্রের (R. Mitra) কন্যার সঙ্গে নরেন্দ্রের সম্বন্ধ হচ্ছে। অনেক টাকা দেবে বলেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ওইরকম একটা দলপতি-টলপতি হয়ে যেতে পারে। ও যেদিকে যাবে সেইদিকেই একটা কিছু বড় হয়ে দাঁড়াবে।

ঠাকুর নরেন্দ্রের কথা আর বেশি তুলিতে দিলেন না।

(রামের প্রতি) — “আচ্ছা, অসুখ হলে আমি এত অধৈর্য হই কেন? একবার একে জিজ্ঞাসা করি কিসে ভাল হবে। একবার ওকে জিজ্ঞাসা করি।

“কি জানো, হয় সকলকেই বিশ্বাস করতে হয়, না হয় কারুকে নয়।

“তিনিই ডাক্তার-কবিরাজ হয়েছেন। তাই সকল চিকিৎসককেই বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ মনে করলে বিশ্বাস হয় না।”

[পূর্বকথা — শম্ভু মল্লিক ও হলধারীর অসুখ ]

“শম্ভুর ঘোর বিকার — সর্বাধিকারী দেখে বলে ঔষধের গরম।

“হলধারী হাত দেখালে, ডাক্তার বললে, ‘চোখ দেখি; — ও! পিলে হয়েছে।’ হলধারী বলে, ‘পিলে-টিলে কোথাও কিছু নাই।’

“মধু ডাক্তারের ঔষধটি বেশ।”

রাম — ঔষধে উপকার হয় না। তবে প্রকৃতিকে অনেকটা সাহায্য করে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঔষধে উপকার না হলে, আফিমে বাহ্যে বন্ধ হয় কেন?

[কেশব সেনের কথা — সুলভ সমাচারে ঠাকুরের বিষয় ছাপানো ]

রাম কেশবের শরীরত্যাগের কথা বলিতেছেন।

রাম — আপনি তো ঠিক বলেছিলেন, — ভাল গোলাপের — (বসরাই গোলাপের) গাছ হলে মালী গোড়াসুদ্ধ খুলে দেয়, — শিশির পেলে আরও তেজ হবে। সিদ্ধবচন তো ফলেছে!

শ্রীরামকৃষ্ণ — কে জানে বাপু, অত হিসাব করি নাই; তোমরাই বলছ।

রাম — ওরা আপনার বিষয় (সুলভ সমাচারে) ছাপিয়ে দিয়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ছাপিয়ে দেওয়া! এ কি! এখন ছাপানো কেন? — আমি খাই-দাই থাকি, আর কিছু জানি না।

“কেশব সেনকে আমি বললাম, কেন ছাপালে? তা বললে — তোমার কাছে লোক আসবে বলে।”

[লোকশিক্ষা ঈশ্বরের শক্তিদ্বারা — হনুমান সিং-এর কুস্তিদর্শন ]

(রাম প্রভৃতির প্রতি) — ”মানুষের শক্তি দ্বারা লোকশিক্ষা হয় না। ঈশ্বরের শক্তি না হলে অবিদ্যা জয় করা যায় না।

“দুইজনে কুস্তি লড়েছিল — হনুমান সিং আর একজন পাঞ্জাবী মুসলমান। মুসলমানটি খুব হৃষ্টপুষ্ট। কুস্তির দিনে, আর আগের পনেরদিন ধরে, মাংস-ঘি খুব করে খেলে। সবাই ভাবলে, এ-ই জিতবে। হনুমান সিং — গায়ে ময়লা কাপড় — কদিন ধরে কম কম খেলে, আর মহাবীরের নাম জপতে লাগল। যেদিন কুস্তি হল, সেদিন একেবারে উপবাস। সকলে ভাবলে, এ নিশ্চয়ই হারবে। কিন্তু সেই জিতল। যে পনেরদিন ধরে খেলে, সেই হারল।

“ছাপাছাপি করলে কি হবে? — যে লোকশিক্ষা দেবে তার শক্তি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসবে। আর ত্যাগী না হলে লোকশিক্ষা হয় না।”

[বাল্য — কামারপুকুরে লাহাদের বাড়ি সাধুদের পাঠশ্রবণ ]

“আমি মূর্খোত্তম।” (সকলের হাস্য)

একজন ভক্ত — তাহলে আপনার মুখ থেকে বেদ-বেদান্ত — তা ছাড়াও কত কি — বেরোয় কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কিন্তু ছেলেবেলায় লাহাদের ওখানে (কামারপুকুরে) সাধুরা যা পড়ত, বুঝতে পারতাম। তবে একটু-আধটু ফাঁক যায়। কোন পণ্ডিত এসে যদি সংস্কৃতে কথা কয় তো বুঝতে পারি। কিন্তু নিজে সংস্কৃত কথা কইতে পারি না।

[পাণ্ডিত্য কি জীবনের উদ্দেশ্য? মূর্খ ও ঈশ্বরের কৃপা ]

“তাঁকে লাভ করাই জীবনের উদ্দেশ্য। লক্ষ্য বিঁধবার সময় অর্জুন বললেন — আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, — কেবল পাখির চক্ষু দেখতে পাচ্ছি — রাজাদেরও দেখতে পাচ্ছি না, — গাছ দেখতে পাচ্ছি না — পাখি পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

“তাঁকে লাভ হলেই হল! সংস্কৃত নাই জানলাম।

তাঁর কৃপা পণ্ডিত মূর্খ সকল ছেলেরই উপর — যে তাঁকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়। বাপের সকলের উপরে সমান স্নেহ।

“বাপের পাঁচটি ছেলে, — দুই-একজন ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারে। আবার কেউ বা ‘বা’ বলে ডাকে, — কেউ বা ‘পা’ বলে ডাকে, — সবটা উচ্চারণ করতে পারে না। যে ‘বাবা’ বলে, তার উপর কি বাপের বেশি ভালবাসা হবে? — যে ‘পা’ বলে তার চেয়ে? বাবা জানে — এরা কচি ছেলে, ‘বাবা’ ঠিক বলতে পাচ্ছে না।”১

[ঠাকুর শ্রীরাককৃষ্ণের নরলীলায় মন ]

“এই হাত ভাঙার পর একটা অবস্থা বদলে যাচ্ছে — নরলীলার দিকে মনটা বড় যাচ্ছে। তিনি মানুষ হয়ে খেলা কচ্ছেন।

“মাটির প্রতিমায় তাঁর পূজা হয় — আর মানুষে হয় না?

“একজন সদাগর লঙ্কার কাছে জাহাজ ডুবে যাওয়াতে লঙ্কার কূলে ভেসে এসেছিল। বিভীষণের লোকেরা বিভীষণের আজ্ঞায় লোকটিকে তাঁর কাছে লয়ে গেল। ‘আহা! এটি আমার রামচন্দ্রের ন্যায় মূর্তি — সেই নবরূপ।’ এই বলে বিভীষণ আনন্দে বিভোর হলেন। আর ওই লোকটিকে বসন ভূষণ পরিয়ে পূজা আর আরতি করতে লাগলেন।

“এই কথাটি আমি যখন প্রথম শুনি, তখন আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল, বলা যায় না।”

[পূর্বকথা — বৈষ্ণবচরণ — ফুলুই শ্যামবাজারের কর্তাভজাদের কথা ]

“বৈষ্ণবচরণকে জিজ্ঞাসা করাতে বললে, যে যাকে ভালবাসে, তাকে ইষ্ট বলে জানলে, ভগবানে শীঘ্র মন হয়। ‘তুই কাকে ভালবাসিস?’ ‘অমুক পুরুষকে।’ ‘তবে ওকেই তোর ইষ্ট বলে জান্‌।’ ও-দেশে (কামারপুকুর, শ্যামবাজারে) আমি বললাম — ‘এরূপ মত আমার নয়। আমার মাতৃভাব।’ দেখলাম যে লম্বা লম্বা কথা কয়, আবার ব্যাভিচার করে। মাগীরা জিজ্ঞাসা করলে — আমাদের কি মুক্তি হবে না? আমি বললাম — হবে যদি একজনেতে ভগবান বলে নিষ্ঠা থাকে। পাঁচটা পুরুষের সঙ্গে থাকলে হবে না।”

রাম — কেদারবাবু কর্তাভজাদের ওখানে বুঝি গিছলেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও পাঁচ ফুলের মধু আহরণ করে

[“হলধারীর বাবা” — “আমার বাবা” — বৃন্দাবনে ফিরতিগোষ্ঠদর্শনে ভাব ]

(রাম, নিত্যগোপাল প্রভৃতি প্রতি) — “ইনিই আমার ইষ্ট” এইটি ষোল আনা বিশ্বাস হলে — তাঁকে লাভ হয় — দর্শন হয়।

“আগেকার লোকের খুব বিশ্বাস ছিল। হলধারীর বাপের কি বিশ্বাস!

“মেয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। রাস্তায় বেলফুল আর বেলপাতা চমৎকার হয়ে রয়েছে দেখে, ঠাকুরের সেবার জন্য সেই সব নিয়ে দুই-তিনক্রোশ পথ ফিরে তার বাড়ি এল।

“রাম যাত্রা হচ্ছিল। কৈকেয়ী রামকে বনবাস যেতে বললেন। হলধারীর বাপ যাত্রা শুনতে গিছিল — একবারে দাঁড়িয়ে উঠল। — যে কৈকেয়ী সেজেছে, তার কাছে এসে ‘পামরী!’ — এই কথা বলে দেউটি (প্রদীপ) দিয়ে মুখ পোড়াতে গেল।

স্নান করবার পর যখন জলে দাঁড়িয়ে — রক্তবর্ণং চতুর্মুখম্‌ — এই সব বলে ধ্যান করত — তখন চক্ষু জলে ভেসে যেত!

“আমার বাবা যখন খড়ম পরে রাস্তায় চলতেন, গাঁয়ের দোকানীরা দাঁড়িয়ে উঠত। বলত, ওই তিনি আসছেন।

“যখন হালদার-পুকুরে স্নান করতেন, লোকেরা সাহস করে নাইতে যেত না। খপর নিত — ‘উনি কি স্নান করে গেছেন?’

“রঘুবীর! রঘুবীর! বলতেন, আর তাঁর বুক রক্তবর্ণ হয়ে যেত।

“আমারও ওইরকম হত। বৃন্দাবনে ফিরতিগোষ্ঠ দেখে, ভাবে শরীর ওইরূপ হয়ে গিছল।

“তখনকার লোকের খুব বিশ্বাস ছিল। হয়তো কালীরূপে তিনি নাচছেন, সাধক হাততালি দিচ্ছে! এরূপ কথাও শোনা যায়।”

[পঞ্চবটীর হঠযোগী ]

পঞ্চবটীর ঘরে একটি হঠযোগী আসিয়াছেন। এঁড়েদের কৃষ্ণকিশোরের পুত্র রামপ্রসন্ন ও আরও কয়েকটি লোক ওই হঠযোগীকে বড় ভক্তি করেন। কিন্তু তাঁর আফিম আর দুধে মাসে পঁচিশ টাকা খরচা পড়ে। রামপ্রসন্ন ঠাকুরকে বলেছিলেন, “আপনার এখানে অনেক ভক্তরা আসে কিছু বলে কয়ে দিবেন, — হঠযোগীর জন্য তাহলে কিছু টাকা পাওয়া যায়।”

ঠাকুর কয়েকটি ভক্তকে বলিলেন — পঞ্চবটীতে হঠযোগীকে দেখে এসো, কেমন লোকটি।
===========

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৩শে মার্চ

ঠাকুরদাদা ও মহিমাচরণের প্রতি উপদেশ

‘ঠাকুরদাদা’ দু-একটি বন্ধুসঙ্গে আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। বয়স ২৭/২৮ হইবে। বরাহনগরে বাস। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ছেলে, — কথকতা অভ্যাস করিতেছেন। সংসার ঘাড়ে পড়িয়াছে, — দিন কতক বৈরাগ্য হইয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছিলেন। এখনও সাধন-ভজন করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি কি হেঁটে আসছ? কোথায় বাড়ি?

ঠাকুরদাদা — আজ্ঞা হাঁ; বরাহনগরে বাড়ি।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এখানে কি দরকার ছিল?

ঠাকুরদাদা — আজ্ঞা, আপনাকে দর্শন করতে আসা, তাঁকে ডাকি — মাঝে মাঝে অশান্তি হয় কেন? দুপাঁচদিন বেশ আনন্দে যায় — তারপর অশান্তি কেন?

[কারিকর; মন্ত্রে বিশ্বাস; হরিভক্তি; জ্ঞানের দুটি লক্ষণ ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — বুঝেছি, — ঠিক পড়ছে না। কারিকর দাঁতে দাঁত বসিয়ে দেয় — তাহলে হয় — একটু কোথায় আটকে আছে।

ঠাকুরদাদা — আজ্ঞা, এইরূপ অবস্থাই হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — মন্ত্র নিয়েছ?

ঠাকুরদাদা — আজ্ঞা, হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — মন্ত্রে বিশ্বাস আছে?

ঠাকুরদাদার বন্ধু বলিতেছেন — ইনি বেশ গান গাইতে পারেন।

ঠাকুর বলিতেছেন — একটা গাওনা গো।

ঠাকুরদাদা গাইতেছেন

প্রেম গিরি-কন্দরে, যোগী হয়ে রহিব।
আনন্দনির্ঝর পাশে যোগধ্যানে থাকিব ৷৷
তত্ত্বফল আহরিয়ে জ্ঞান-ক্ষুধা নিবারিয়ে,
বৈরাগ্য-কুসুম দিয়ে শ্রীপাদপদ্ম পূজিব।
মিটাতে বিরহ-তৃষা কূপ জলে আর যাব না,
হৃদয়-করঙ্গ ভরে শান্তি-বারি তুলিব।
কভু ভাব শৃঙ্গ পরে, পদামৃত পান করে,
হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা, বেশ গান! আনন্দনির্ঝর! তত্ত্বফল! হাসিব কাঁদিব নাচিব গাইব।

“তোমার ভিতর থেকে এমন গান ভাল লাগছে — আবার কি!

“সংসারেতে থাকতে গেলেই সুখ-দুঃখ আছে — একটু-আধটু অশান্তি আছে।

“কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগেই।”

“ঠাকুরদাদা — আজ্ঞা, — এখন কি করব — বলে দিন।

শ্রীরামকৃষ্ণ —  হাততালি দিয়ে সকালে বিকালে হরিনাম করবে — ‘হরিবোল’ — ‘হরিবোল’ — ‘হরিবোল’ বলে।

“আর একবার এসো, — আমার হাতটা একটু সারুক।”

মহিমাচরণ আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন।

(মহিমার প্রতি) — “আহা ইনি একটি বেশ গান গেয়েছেন। — গাও তো গা সেই গানটি আর একবার।”

ঠাকুরদাদা আবার গাইলেন, “প্রেম গিরি-কন্দরে” ইত্যাদি।

গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন — তুমি সেই শ্লোকটি একবার বলতো — হরিভক্তির কথা।

মহিমাচরণ নারদপঞ্চরাত্র হইতে সেই শ্লোকটি বলিতেছেন —

অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।
নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।

নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওটাও বল — লভ লভ হরিভক্তিং।

মহিমাচরণ বলিতেছেন —

বিরম বিরম ব্রহ্মন্‌ কিং তপস্যাসু বৎস।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্‌ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্‌।
ভব-নিগড়-নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — শঙ্কর হরিভক্তি দিবেন।

মহিমা — পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, সঙ্কোচ — এ-সব পাশ; কি বল?

মহিমা — আজ্ঞা হাঁ, গোপন করবার ইচ্ছা, প্রশংসায় কুণ্ঠিত হওয়া।

শ্রীরামকৃষ্ণ — দুটি জ্ঞানের লক্ষণ। প্রথম কূটস্থ বুদ্ধি। হাজার দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-বিঘ্ন হোক — নির্বিকার, যেমন কামারশালের লোহা, যার উপর হাতুড়ি দিয়ে পেটে। আর, দ্বিতীয়, পুরুষকার — খুব রোখ। কাম-ক্রোধে আমার অনিষ্ট কচ্ছে তো একেবারে ত্যাগ! কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁদ করে, চারখানা করে কাটলেও আর বার করবে না।

[তীব্র, মন্দা ও মর্কট বৈরাগ্য ]

(ঠাকুরদাদা প্রভৃতির প্রতি) — “বৈরাগ্য দুইপ্রকার। তীব্র বৈরাগ্য আর মন্দা বৈরাগ্য। মন্দা বৈরাগ্য — হচ্ছে হবে — ঢিমে তেতালা। তীব্র বৈরাগ্য — শাণিত ক্ষুরের ধার — মায়াপাশ কচকচ করে কেটে দেয়।

“কোনও চাষা কতদিন ধরে খাটছে — পুষ্করিণীর জল ক্ষেতে আসছে না। মনে রোখ নাই। আবার কেউ দু-চারদিন পরেই — আজ জল আনব তো ছাড়ব, প্রতিজ্ঞা করে। নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ। সমস্ত দিন খেটে সন্ধ্যার সময় যখন জল কুলকুল করে আসতে লাগল, তখন আনন্দ। তারপর বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে বলে — ‘দে এখন তেল দে নাইব।’ নেয়ে খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রা।

“একজনের পরিবার বললে, ‘অমুক লোকের ভারী বৈরাগ্য হয়েছে, তোমার কিছু হল না!’ যার বৈরাগ্য হয়েছে, সে লোকটির ষোলজন স্ত্রী, — এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে।

“সোয়ামী নাইতে যাচ্ছিল, কাঁধে গামছা, — বললে, ‘ক্ষেপী! সে লোক ত্যাগ করতে পারবে না, — একটু একটু করে কি ত্যাগ হয়! আমি ত্যাগ করতে পারব। এই দেখ, — আমি চললুম!’

সে বাড়ির গোছগাছ না করে — সেই অবস্থায় — কাঁধে গামছা — বাড়ি ত্যাগ করে, চলে গেল। — এরই নাম তীব্র বৈরাগ্য।

আর-একরকম বৈরাগ্য তাকে বলে মর্কট বৈরাগ্য। সংসারের জ্বালায় জ্বলে গেরুয়া বসন পরে কাশী গেল। অনেকদিন সংবাদ নাই। তারপর একখানা চিঠি এল — ‘তোমরা ভাবিবে না, আমার এখানে একটি কর্ম হইয়াছে।’

“সংসারের জ্বালা তো আছেই! মাগ অবাধ্য, কুড়ি টাকা মাইনে, ছেলের অন্নপ্রাশন দিতে পারছে না, ছেলেকে পড়াতে পারছে না — বাড়ি ভাঙা, ছাত দিয়ে জল পড়ছে; — মেরামতের টাকা নাই।

“তাই ছোকরারা এলে আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর কে কে আছে?

(মহিমার প্রতি) — “তোমাদের সংসারত্যাগের কি দরকার? সাধুদের কত কষ্ট! একজনের পরিবার বললে, তুমি সংসারত্যাগ করবে — কেন? আট ঘরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে হবে, তার চেয়ে এক ঘরে খাওয়া পাচ্ছ, বেশ তো।

“সদাব্রত খুঁজে খুঁজে সাধু তিনক্রোশ রাস্তা থেকে দূরে গিয়ে পড়ে। দেখেছি, জগন্নাথদর্শন করে — সোজা পথ দিয়ে সাধু আসছে; সদাব্রতর জন্য তার সোজা পথ ছেড়ে যেতে হয়।

“এতো বেশ — কেল্লা থেকে যুদ্ধ। মাঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলে অনেক অসুবিধা। বিপদ। গায়ের উপর গোলাগুলি এসে পড়ে!

“তবে দিন কতক নির্জনে গিয়ে, জ্ঞানলাভ করে, সংসারে এসে থাকতে হয়। জনক জ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিল। জ্ঞানের পর যেখানেই থাক তাতে কি?”

মহিমাচরণ — মহাশয়, মানুষ কেন বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁকে লাভ না করে বিষয়ের মধ্যে থাকে বলে। তাঁকে লাভ করলে আর মুগ্ধ হয় না। বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়, — তাহলে আর তার অন্ধকার ভাল লাগে না।

[ঊর্ধ্বরেতা ধৈর্যরেতা ও ঈশ্বরলাভ — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম ]

“তাঁকে পেতে হলে বীর্যধারণ করতে হয়।

“শুকদেবাদি ঊর্ধ্বরেতা। এঁদের রেতঃপাত কখনও হয় নাই।

“আর এক আছে ধৈর্যরেতা। আগে রেতঃপাত হয়েছে, কিন্তু তারপর বীর্যধারণ। বার বছর ধৈর্যরেতা হলে বিশেষ শক্তি জন্মায়। ভিতরে একটি নূতন নাড়ী হয়, তার নাম মেধা নাড়ী। সে নাড়ী হলে সব স্মরণ থাকে, — সব জানতে পারে।

“বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়। স্বপ্নদোষে যা বেরিয়ে যায়, তাতে দোষ নাই। ও ভাতের গুণে হয়। ও-সব বেরিয়ে গিয়েও যা থাকে, তাতেই কাজ হয়। তবু স্ত্রীসঙ্গ করা উচিত নয়।

“শেষে যা থাকে, তা খুব রিফাইন (Refine) হয়ে থাকে। লাহাদের ওখানে গুড়ের নাগরি সব রেখেছিল, — নাগরির নিচে একটি একটি ফুটো করে, তারপর একবৎসর পরে দেখলে; সব দানা বেঁধে রয়েছে — মিছরির মতো। রস যা বেরিয়ে যাবার, ফুটো দিয়ে তা বেরিয়ে গেছে।

“স্ত্রীলোক একেবারে ত্যাগ — সন্ন্যাসীর পক্ষে। তোমাদের হয়ে গেছে, তাতে দোষ নাই।

“সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সাধারণ লোকে তা পারে না। সা রে গা মা পা ধা নি। ‘নি’তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না।

“সন্ন্যাসীর পক্ষে বীর্যপাত বড়ই খারাপ। তাই তাদের সাবধানে থাকতে হয়। স্ত্রীরূপদর্শন যাতে না হয়। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও সেখান থেকে সরে যাবে। স্ত্রীরূপ দেখাও খারাপ। জাগ্রত অবস্থায় না হয়, স্বপ্নে বীর্যপাত হয়।

“সন্ন্যাসী জিতেন্দ্রিয় হলেও লোকশিক্ষার জন্য মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করবে না। ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও বেশিক্ষণ আলাপ করবে না।

“সন্ন্যাসীর হচ্ছে নির্জলা একাদশী। আর দুরকম একাদশী আছে। ফলমূল খেয়ে, — আর লুচি ছক্কা খেয়ে। (সকলের হাস্য)

“লুচি ছক্কার সঙ্গে হলো দুখানা রুটি দুধে ভিজেছে। (সকলের হাস্য)

(সহাস্যে) “তোমরা নির্জলা একাদশী পারবে না।”

[পূর্বকথা — কৃষ্ণকিশোরের একাদশী — রাজেন্দ্র মিত্র ]

“কৃষ্ণকিশোরকে দেখলাম, একাদশীতে লুচি ছক্কা খেলে। আমি হৃদুকে বললাম — হৃদু, আমার কৃষ্ণকিশোরের একাদশী করতে ইচ্ছা হচ্ছে। (সকলের হাস্য) তাই একদিন করলাম। খুব পেট ভরে খেলাম, তার পরদিন আর কিছু খেতে পারলাম না” (সকলের হাস্য)

যে কয়েকটি ভক্ত পঞ্চবটীতে হঠযোগীকে দেখিতে গিয়াছিলেন, তাঁহারা ফিরিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের বলিতেছেন — “কেমন গো — কিরূপ দেখলে? তোমাদের গজ দিয়ে তো মাপলে?”

ঠাকুর দেখিলেন, ভক্তরা প্রায় কেহই হঠযোগীকে টাকা দিতে রাজী নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধুকে টাকা দিতে হলেই তাকে আর ভাল লাগে না।

“রাজেন্দ্র মিত্র — আটশ টাকা মাইনে — প্রয়াগে কুম্ভমেলা দেখে এসেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম — ‘কেমন গো, মেলায় কেমন সব সাধু দেখলে?’ রাজেন্দ্র বললে — ‘কই তেমন সাধু দেখতে পেলাম না। একজনকে দেখলাম বটে কিন্তু তিনিও টাকা লন।’

“আমি ভাবি যে সাধুদের কেউ টাকাপয়সা দেবে না তো খাবে কি করে? এখানে প্যালা দিতে হয় না — তাই সকলে আসে। আমি ভাবি; আহা, ওরা টাকা বড় ভালবাসে। তাই নিয়েই থাকুক।”

ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। একজন ভক্ত ছোট খাটটির উত্তরদিকে বসিয়া তাঁহার পদসেবা করিতেছেন। ঠাকুর ভক্তটিকে আস্তে আস্তে বলিতেছেন — “যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। সাকাররূপও মানতে হয়। কালীরূপ চিন্তা করতে করতে সাধক কালীরূপেই দর্শন পায়। তারপর দেখতে পায় যে, সেই রূপ অখণ্ডে লীন হয়ে গেল। যিনিই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনিই কালী।””

===========

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ২৩শে মার্চ

মহিমার পাণ্ডিত্য — মণি সেন, অধর ও মিটিং (Meeting)

ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায় মহিমা প্রভৃতির সহিত হঠযোগীর কথা কহিতেছেন। রামপ্রসন্ন ভক্ত কৃষ্ণকিশোরের পুত্র, তাই ঠাকুর তাহাকে স্নেহ করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — রামপ্রসন্ন কেবল ওইরকম করে হো-হো করে বেড়াচ্ছে। সেদিন এখানে এসে বললে — একটু কথা কবে না। প্রাণায়াম করে নাক টিপে বসে রইল; খেতে দিলাম, তা খেলে না। আর-একদিন ডেকে বসালুম। তা পায়ের উপর পা দিয়ে বসল — কাপ্তেনের দিকে পা-টা দিয়ে। ওর মার দুঃখ দেখে কাঁদি।

(মহিমার প্রতি) —  ওই হঠযোগীর কথা তোমায় বলতে বলেছে। সাড়ে ছ আনা দিন খরচ। এদিকে আবার নিজে বলবে না।”

মহিমা — বললে শোনে কে? (ঠাকুরের ও সকলের হাস্য)

ঠাকুর ঘরের মধ্যে আসিয়া নিজের আসনে বসিয়াছেন। শ্রীযুক্ত মণি সেন (যাঁদের পেনেটীতে ঠাকুরবাড়ি) দু-একটি বন্ধুসঙ্গে আসিয়াছেন ও ঠাকুরের হাত ভাঙা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা পড়া করিতেছেন। তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে একজন ডাক্তার।

ঠাকুর ডাক্তার প্রতাপ মজুমদারের ঔষধ সেবন করিতেছেন। মণিবাবুর সঙ্গী ডাক্তার তাঁহার ব্যবস্থার অনুমোদন করিলেন না। ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “সে (প্রতাপ) তো বোকা নয়, তুমি অমন কথা বলছ কেন?”

এমন সময় লাটু উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন শিশি পড়ে ভেঙে গেছে।

মণি (সেন) হঠযোগীর কথা শুনিয়া বলিতেছেন — হঠযোগী কাকে বলে? হট্‌ (Hot) মানে তো গরম।

মণি সেনের ডাক্তার সম্বন্ধে ঠাকুর ভক্তদের পরে বলিলেন — “ওকে জানি। যদু মল্লিককে বলেছিলাম, এ-ডাক্তার তোমার ওলম্বাকুল, — অমুক ডাক্তারের চেয়েও মোটা বুদ্ধি।”

[শ্রীযুক্ত মাস্টারের সহিত একান্তে কথা ]

এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। তিনি খাটের পাশে পাপোশ পশ্চিমাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। এদিকে মহিমাচরণ পশ্চিমের গোল বারান্দায় বসিয়া মণি সেনের ডাক্তারের সহিত উচ্চৈঃস্বরে শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। ঠাকুর নিজের আসন হইতে শুনিতে পাইতেছেন ও ঈষৎ হাস্য করিয়া মাস্টারকে বলিতেছেন — “ওই ঝাড়ছে! রজোগুণ! রজোগুণে একটু পাণ্ডিত্য দেখাতে, লেকচার দিতে ইচ্ছা হয়। সত্ত্বগুণে অন্তর্মুখ হয়, — আর গোপন। কিন্তু খুব লোক! ঈশ্বর কথায় এত উল্লাস!”

অধর আসিয়া প্রণাম করিলেন ও মাস্টারের পাশে বসিলেন।

শ্রীযুক্ত অধর সেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসর হইবে। অনেক দিন ধরিয়া সমস্ত দিন আফিসের পরিশ্রমের পর ঠাকুরের কাছে প্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যার পার আসেন। তাঁহার বাটী কলিকাতা শোভাবাজার বেনেটোলায়। অধর কয়েকদিন আসেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিগো, এতদিন আস নাই কেন?

অধর — আজ্ঞা, অনেকগুণো কাজে পড়ে গিছলাম। ইস্কুলের দরুন সভা এবং আর আর মিটিং-এ যেতে হয়েছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ — মিটিং, ইস্কুল — এই সব লয়ে একেবারে ভুলে গিছলে।

অধর (বিনীত ভাবে) — আজ্ঞা সব চাপা পড়ে গিছল। আপনার হাতটা কেমন আছে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — এই দেখ এখনো সারে নাই। প্রতাপের ঔষধ খাচ্ছিলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর হঠাৎ অধরকে বলিতেছেন — “দেখো এ-সব অনিত্য — মিটিং, ইস্কুল, আফিস — এ-সব অনিত্য। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। সব মন দিয়ে তাঁকেই আরাধনা করা উচিত।”

অধর চুপ করিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ-সব অনিত্য। শরীর এই আছে এই নাই। তাড়াতাড়ি তাঁকে ডেকে নিতে হয়।১

“তোমাদের সব ত্যাগ করবার দরকার নাই। কচ্ছপের মতো সংসারে থাক। কচ্ছপ নিজে জলে চরে বেড়ায়; — কিন্তু ডিম আড়াতে রাখে — সব মনটা তার ডিম যেখানে, সেখানে পড়ে থাকে।

“কাপ্তেনের বেশ স্বভাব হয়েছে। যখন পূজা করতে বসে, ঠিক একটি ঋষির মতো! — এদিকে কর্পূরের আরতি; সুন্দর স্তব পাঠ করে। পূজা করে যখন ওঠে, চক্ষে যেন পিঁপড়ে কামড়েছে! আর সর্বদা গীতা, ভাগবত — এ-সব পাঠ করে। আমি দু-একটা ইংরেজী কথা কয়েছিলাম, — তা রাগ কল্লে। বলে — ইংরেজী পড়া লোক ভ্রষ্টাচারী!”

কিয়ৎক্ষণ পরে অধর অতি বিনীতভাবে বলিতেছেন —

“আপনার আমাদের বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয় নাই। বৈঠকখানা ঘরে গন্ধ হয়েছিল — আর যেন সব অন্ধকার!”

ভক্তের এই কথা শুনিয়া ঠাকুরের স্নেহ-সাগর যেন উথলিয়া উঠিল। তিনি হঠাৎ দণ্ডায়মান হইয়া ভাবে অধর ও মাস্টারের মস্তক ও হৃদয় স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। আর সস্নেহে বলিতেছেন — “আমি তোমাদের নারায়ণ দেখছি! তোমরাই আমার আপনার লোক!”

এইবার মহিমাচরণ ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — ধৈর্যতার কথা তখন যা বলেছিলে তা ঠিক। বীর্যধারণ না করলে এ-সব (উপদেশ) ধারণ হয় না।

“একজন চৈতন্যদেবকে বললে, এদের (ভক্তদের) এত উপদেশ দেন, তেমন উন্নতি করতে পাচ্ছে না কেন? তিনি বললেন — এরা যোষিৎসঙ্গ করে সব অপব্যয় করে। তাই ধারণা করতে পারে না। ফুটো কলসীতে জল রাখলে জল ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে যায়।”

মহিমা প্রভৃতি ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন! কিয়ৎক্ষণ পরে মহিমাচরণ বলিতেছেন — ঈশ্বরের কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন — যাতে আমাদের সেই শক্তি হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এখনও সাবধান হও! আষাঢ় মাসের জল, বটে, রোধ করা শক্ত। কিন্তু জল অনেক তো বেরিয়ে গেছে! — এখন বাঁধ দিলে থাকবে।

১ অধর কয়েক মাস পরেই দেহত্যাগ করিলেন।
===========

Post a Comment

0 Comments