শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ
পঞ্চদশ খণ্ড
বলরাম-মন্দিরে রথের পুনর্যাত্রায় ভক্তসঙ্গে
===========
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা জুলাই
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্বধর্মসমন্বয়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বৈঠকখানায় ভক্তের মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। আনন্দময় মূর্তি! — ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।
আজ পুনর্যাত্রা। বৃহস্পতিবার। আষাঢ় শুক্লা দশমী। ৩রা জুলাই, ১৮৮৪। শ্রীযুক্ত বলরামের বাটীতে, শ্রীশ্রীজগন্নাথের সেবা আছে, একখানি ছোট রথও আছে। তাই তিনি ঠাকুরকে, পুনর্যাত্রা উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। এই ছোট রথখানি বারবাটীর দোতলার চকমিলান বারান্দায় টানা হইবে। গত ২৫শে জুন বুধবারে শ্রীশ্রীরথযাত্রার দিন, ঠাকুর শ্রীযুক্ত ঈশান মুখোপাধ্যায়ের ঠনঠনিয়া বাটীতে আসিয়া নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই দিনেই বৈকালে কলেজ স্ট্রীটে ভূধরের বাটীতে পণ্ডিত শশধরের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনদিন হইল, গত সোমবারে শশধর তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে দ্বিতীয়বার দর্শন করিতে গিয়াছিলেন।
ঠাকুরের আদেশে বলরাম শশধরকে আজ নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। পণ্ডিত হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করিয়া লোকশিক্ষা দিতেছেন। তাই কি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ভিতর শক্তিসঞ্চার করিবার জন্য এত উৎসুক হইয়াছেন?
ঠাকুর ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। কাছে রাম, মাস্টার, বলরাম, মনোমোহন, কয়েকটি ছোকরা ভক্ত, বলরামের পিতা প্রভৃতি বসিয়া আছেন। বলরামের পিতা অতি নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। তিনি প্রায় শ্রীবৃন্দাবনধামে তাঁহাদেরই প্রতিষ্ঠিত কুঞ্জে একাকী বাস করেন ও শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দর-বিগ্রহের সেবার তত্ত্বাবধান করেন। শ্রীবৃন্দাবনে তিনি সমস্ত দিন ঠাকুরের সেবা লইয়া থাকেন। কখনও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতাদি ভক্তিগ্রন্থ পড়েন। কখন কখন ভক্তিগ্রন্থ লইয়া তাহার প্রতিলিপি করেন। কখন বসিয়া বসিয়া নিজে ফুলের মালা গাঁথেন। কখন বৈষ্ণবদের নিমন্ত্রণ করিয়া সেবা করেন। ঠাকুরকে দর্শন করাইবার জন্য, বলরাম তাঁহাকে পত্রের উপর পত্র লিখিয়া কলিকাতায় আনাইয়াছেন। “সব ধর্মেই সাম্প্রদায়িক ভাব; বিশেষতঃ বৈষ্ণবদিগের মধ্যে; ভিন্ন মতের লোক পরস্পর বিরোধ করে, সমন্বয় করিতে জানে না” — এই কথা ঠাকুর ভক্তদের বলিতেছেন।
[বলরামের পিতার প্রতি সর্বধর্ম-সমন্বয় উপদেশ। ভক্তমাল; শ্রীভাগবত — পূর্বকথা — মথুরের কাছে বৈষ্ণবচরণের গোঁড়ামি ও শাক্তদের নিন্দা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতা প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) — বৈষ্ণবদের একটি গ্রন্থ ভক্তমাল। বেশ বই, — ভক্তদের সব কথা আছে। তবে একঘেয়ে। এক জায়গায় ভগবতীকে বিষ্ণুমন্ত্র লইয়ে তবে ছেড়েছে!
“আমি বৈষ্ণবচরণের অনেক সুখ্যাত করে সেজোবাবুর কাছে আনলুম। সেজোবাবু খুব যত্ন খাতির করলে। রূপার বাসন বার করে জল খাওয়ানো পর্যন্ত। তারপর সেজোবাবুর সামনে বলে কি — ‘আমাদের কেশবমন্ত্র না নিলে কিছুই হবে না!’ সেজোবাবু শাক্ত, ভগবতীর উপাসক। মুখ রাঙা হয়ে উঠল। আমি আবার বৈষ্ণবচরণের গা টিপি!
“শ্রীমদ্ভাগবত — তাতেও নাকি ওইরকম কথা আছে, ‘কেশবমন্ত্র না নিয়ে ভবসাগর পার হওয়াও যা, আর কুকুরের ল্যাজ ধরে মহাসমুদ্র পার হওয়াও তা!’ সব মতের লোকেরা আপনার মতটাই বড় করে গেছে।
“শাক্তেরাও বৈষ্ণবদের খাটো করবার চেষ্টা করে। শ্রীকৃষ্ণ ভবনদীর কাণ্ডারী, পার করে দেন, শাক্তেরা বলে, ‘তা তো বটেই, মা রাজরাজেশ্বরী — তিনি কি আপনি এসে পার করবেন? ওই কৃষ্ণকেই রেখে দিয়েছেন পার করবার জন্য’” (সকলের হাস্য)
[পূর্বকথা — ঠাকুরের জন্মভূমিদর্শন ১ ১৮৮০ — ফুলুই শ্যামবাজারের তাঁতী বৈষ্ণবদের অহংকার — সমন্বয় উপদেশ ]
“নিজের নিজের মত লয়ে আবার অহংকার কত! ও-দেশে, শ্যামবাজার এই সব জায়গায়, তাঁতীরা আছে। অনেকে বৈষ্ণব, তাদের লম্বা লম্বা কথা। বলে, ‘ইনি কোন্ বিষ্ণু মানেন? পাতা বিষ্ণু! (অর্থাৎ যিনি পালন করেন!) — ও আমরা ছুঁই না! কোন্ শিব? আমরা আত্মারাম শিব, আত্মারামেশ্বর শিব, মানি।’ কেউ বলছে, ‘তোমরা বুঝিয়ে দেও না, কোন্ হরি মান?’ তাতে কেউ বলছে — ‘না, আমরা আর কেন, ওইখান থেকেই হোক।’ এদিকে তাঁত বোনে; আবার এইসব লম্বা লম্বা কথা!”
[লালাবাবুর রানী কাত্যায়নীর মো-সাহেব রতির মার গোঁড়ামি ]
“রতির মা রানী কাত্যায়নীর মো-সাহেব; — বৈষ্ণবচরণের দলের লোক, গোঁড়া বৈষ্ণবী। এখানে খুব আসা যাওয়া করত। ভক্তি দেখে কে! যাই আমায় দেখলে মা-কালীর প্রসাদ খেতে, অমনি পালাল!
“যে সমন্বয় করেছে, সেই-ই লোক। অনেকেই একঘেয়ে। আমি কিন্তু দেখি — সব এক। শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্ত মত সবই সেই এককে লয়ে। যিনিই নিরাকার, তিনিই সাকার, তাঁরই নানা রূপ।
‘নির্গুণ মেরা বাপ, সগুণ মাহতারি,
কারে নিন্দো কারে বন্দো, দোনো পাল্লা ভারী।’
“বেদে যাঁর কথা আছে, তন্ত্রে তাঁরই কথা, পুরাণেও তাঁরই কথা। সেই এক সচ্চিদানন্দের কথা। যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।
“বেদে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ ব্রহ্ম। তন্ত্রে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ শিবঃ — শিবঃ কেবলঃ — কেবলঃ শিবঃ। পুরাণে বলেছে, ওঁ সচ্চিদানন্দঃ কৃষ্ণঃ। সেই এক সচ্চিদানন্দের কথাই বেদ, পুরাণ, তন্ত্রে আছে। আর বৈষ্ণবশাস্ত্রেও আছে, — কৃষ্ণই কালী হয়েছিলেন।”
১ শ্রীরামকৃষ্ণ শেষবার জন্মভূমি দর্শন সময়ে ১৮৮০ খ্রী: ফুলুই শ্যামবাজারে হৃদয়ের সঙ্গে শুভাগমন করিয়া নটবর গোস্বামী, ঈশান মল্লিক, সদয় বাবাজী প্রভৃতি ভক্তগণের সহিত সংকীর্তন করেন।
=============
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা জুলাই
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পরমহংস অবস্থা — বালকবৎ — উন্মাদবৎ
ঠাকুর বারান্দার দিকে একটু গিয়া আবার ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। বাহিরে যাইবার সময় শ্রীযুক্ত বিশ্বম্ভরের কন্যা তাঁহাকে নমস্কার করিয়াছিল, তাহার বয়স ৬/৭ বৎসর হইবে। ঠাকুর ঘরে ফিরিয়া আসিলে পর মেয়েটি তাঁহার সহিত কথা কহিতেছে। তাহার সঙ্গে আরও দু-একটি সমবয়স্ক ছেলেমেয়ে আছে।
বিশ্বম্ভরের কন্যা (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আমি তোমায় নমস্কার করলুম, দেখলে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কই, দেখি নাই।
কন্যা — তবে দাঁড়াও, আবার নমস্কার করি; — দাঁড়াও, এ পা’টা করি!
ঠাকুর হাসিতে হাসিতে উপবেশন করিলেন ও ভূমি পর্যন্ত মস্তক নত করিয়া কুমারীকে প্রতিনমস্কার করিলেন। ঠাকুর মেয়েটিকে গান গাহিতে বলিলেন। মেয়েটি বলিল — “মাইরি, গান জানি না!”
তাহাকে আবার অনুরোধ করাতে বলিতেছে, “মাইরি বললে আর বলা হয়?” ঠাকুর তাহাদের লইয়া আনন্দ করিতেছেন ও গান শুনাইতেছেন। প্রথমে কেলুয়ার গান, তারপর, “আয় লো তোর খোঁপা বেঁধে দি, তোর ভাতার এলে বলবে কি!” (ছেলেরা ও ভক্তেরা গান শুনিয়া হাসিতেছেন)
[পূর্বকথা — জন্মভূমিদর্শন১— বালক শিবরামের চরিত্র — সিওড়ে হৃদয়ের বাড়ি দুর্গাপূজা — ঠাকুরের উন্মাদকালে লিঙ্গপূজা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — পরমহংসের স্বভাব ঠিক পাঁচ বছরের বালকের মতো। সব চৈতন্যময় দেখে।
“যখন আমি ও-দেশে (কামারপুকুরে), রামলালের ভাই (শিবরাম) তখন ৪/৫ বছর বয়স, — পুকুরের ধারে ফড়িং ধরতে যাচ্ছে। পাতা নড়ছে, আর পাতার শব্দ পাছে হয়, তাই পাতাকে বলছে ‘চোপ্! আমি ফড়িং ধরব!’ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, আমার সঙ্গে ঘরের ভিতরে সে আছে; বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তবুও দ্বার খুলে খুলে বাহিরে যেতে চায়। বকার পর আর বাহিরে গেল না, উঁকি মেরে মেরে এক-একবার দেখছে, বিদ্যুৎ, — আর বলছে, ‘খুড়ো! আবার চকমকি ঠুকছে’।
“পরমহংস বালকের ন্যায় — আত্মপর নাই, ঐহিক সম্বন্ধের আঁট নাই। রামলালের ভাই একদিন বলছে, ‘তুমি খুড়ো না পিসে?’
“পরমহংসের বালকের ন্যায় গতিবিধির হিসাব নাই। সব ব্রহ্মময় দেখে — কোথায় যাচ্ছে — কোথায় চলছে — হিসাব নাই। রামলালের ভাই হৃদের বাড়ি দুর্গাপূজা দেখতে গিছিল। হৃদের বাড়ি থেকে ছটকে আপনা-আপনি কোন্ দিকে চলে গেছে! চার বছরের ছেলে দেখে পথের লোক জিজ্ঞাসা করছে, তুই কোথা থেকে এলি? তা কিছু বলতে পারে না। কেবল বললে — ‘চালা’ (অর্থাৎ যে আটচালায় পূজা হয়েছে)। যখন জিজ্ঞাসা করলে, ‘কার বাড়ি থেকে এসেছিস?’ তখন কেবল — ‘দাদা’।
“পরমহংসের আবার উন্মাদের অবস্থা হয়। যখন উন্মাদ হল, শিবলিঙ্গ বোধে নিজের লিঙ্গ পূজা করতাম। জীবন্ত লিঙ্গপূজা। একটা আবার মুক্তা পরানো হত! এখন আর পারি না।”
[প্রতিষ্ঠার পর (প্রতিষ্ঠা ১৮৫৫) পূর্ণজ্ঞানী পাগলের সঙ্গে দেখা ]
“দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরে একজন পাগল এসেছিল, — পূর্ণজ্ঞানী। ছেঁড়া জুতা, হাতে কঞ্চি — একহাতে একটি ভাঁড়, আঁবচারা; গঙ্গায় ডুব দিয়ে উঠে, কোন সন্ধ্যা আহ্নিক নাই, কোঁচড়ে কি ছিল তাই খেলে। তারপর কালীঘরে গিয়ে স্তব করতে লাগল। মন্দির কেঁপে গিয়েছিল! হলধারী তখন কালীঘরে ছিল। অতিথিশালায় এরা তাকে ভাত দেয় নাই — তাতে ভ্রূক্ষেপ নাই। পাত কুড়িয়ে খেতে লাগল — যেখানে কুকুরগুলো খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কুকুরগুলিকে সরিয়ে নিজে খেতে লাগল, — তা কুকুরগুলো কিছু বলে নাই। হলধারী পেছু পেছু গিয়েছিল, আর জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কে? তুমি কি পূর্ণজ্ঞানী?’ তখন সে বলেছিল, ‘আমি পূর্ণজ্ঞানী! চুপ!’
“আমি হলধারীর কাছে যখন এ-সব কথা শুনলাম আমার বুক গুর গুর করতে লাগল, আর হৃদেকে জড়িয়ে ধরলুম। মাকে বললাম, ‘মা, তবে আমারও কি এই অবস্থা হবে!’ আমরা দেখতে গেলাম — আমাদের কাছে খুব জ্ঞানের কথা — অন্য লোক এলে পাগলামি। যখন চলে গেল, হলধারী অনেকখানি সঙ্গে গিয়েছিল। ফটক পার হলে হলধারীকে বলেছিল ‘তোকে আর কি বলব। এই ডোবার জল আর গঙ্গাজলে যখন কোন ভেদবুদ্ধি থাকবে না, তখন জানবি পূর্ণজ্ঞান হয়েছে।’ তারপর বেশ হনহন করে চলে গেল।”
১ শ্রীযুক্ত শিবরামের জন্ম — ১৮ই চৈত্র, ১২৭২, দোলপূর্ণিমার দিনে (৩০শে মার্চ, ১৮৬৬ খ্রী:) ঠাকুরের এবার জন্মভূমিদর্শনের সময় তিন-চার বছর বয়স অর্থাৎ ১৮৬৯-৭০ খ্রী:।
============
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা জুলাই
পাণ্ডিত্য অপেক্ষা তপস্যার প্রয়োজন — সাধ্য-সাধনা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। ভক্তেরাও কাছে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — শশধরকে তোমার কেমন বোধ হয়?
মাস্টার — আজ্ঞা, বেশ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — খুব বুদ্ধিমান, না?
মাস্টার — আজ্ঞা, পাণ্ডিত্য বেশ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — গীতার মত — যাকে অনেকে গণে, মানে, তার ভিতর ঈশ্বরের শক্তি আছে। তবে ওর একটু কাজ বাকী আছে।
“শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে, কিছু তপস্যার দরকার — কিছু সাধ্য-সাধনার দরকার।”
[পূর্বকথা — গৌরী পণ্ডিত ও নারায়ণ শাস্ত্রীর সাধনা — বেলঘরের বাগানে কেশবের সহিত সাক্ষাৎ ১৮৭৫ — কাপ্তেনের আগমন ১৮৭৫-৭৬ ]
“গৌরী পণ্ডিত সাধন করেছিল। যখন স্তব করত, ‘হা রে রে নিরালম্ব লম্বোদর!’ — তখন পণ্ডিতেরা কেঁচো হয়ে যেত।
“নারায়ণ শাস্ত্রীও শুধু পণ্ডিত নয়, সাধ্য-সাধনা করেছিল।
“নারায়ণ শাস্ত্রী পঁচিশ বৎসর একটানে পড়েছিল। সাত বৎসর ন্যায় পড়েছিল — তবুও ‘হর, হর,’ বলতে বলতে ভাব হত। জয়পুরের রাজা সভাপণ্ডিত করতে চেয়েছিল। তা সে কাজ স্বীকার করলে না। দক্ষিণেশ্বরে প্রায় এসে থাকত। বশিষ্ঠাশ্রমে যাবার ভারী ইচ্ছা, — সেখানে তপস্যা করবে। যাবার কথা আমাকে প্রায় বলত। আমি তাকে সেখানে যেতে বারণ করলাম। — তখন বলে ‘কোন্ দিন মরে যাব, সাধন কবে করব — ডুব্কি কব্ ফাট্ যায়গা!’ অনেক জেদাজেদির পর আমি যেতে বললাম।
“শুনতে পাই, কেউ কেউ বলে, নারায়ণ শাস্ত্রী নাকি শরীরত্যাগ করেছে, তপস্যা করবার সময় ভৈরবে নাকি চড় মেরেছিল। আবার কেউ কেউ বলে, ‘বেঁচে আছে — এই আমরা তাকে রেলে তুলে দিয়ে এলাম।’
“কেশব সেনকে দেখবার আগে নারাণ শাস্ত্রীকে বললুম, তুমি একবার যাও, দেখে এস কেমন লোক। সে দেখে এসে বললে, লোকটা জপে সিদ্ধ। সে জ্যোতিষ জানত — বললে, ‘কেশব সেনের ভাগ্য ভাল। আমি সংস্কৃতে কথা কইলাম, সে ভাষায় (বাঙলায়) কথা কইল।’
“তখন আমি হৃদেকে সঙ্গে করে বেলঘরের বাগানে গিয়ে দেখলাম। দেখেই বলেছিলাম, ‘এঁরই ন্যাজ খসেছে, — ইনি জলেও থাকতে পারেন, ডাঙাতেও থাকতে পারেন।’
“আমাকে পরোখ করবার জন্য তিনজন ব্রহ্মজ্ঞানী ঠাকুরবাড়িতে পাঠিয়েছিল। তার ভিতরে প্রসন্নও ছিল। রাতদিন আমায় দেখবে, দেখে কেশবের কাছে খবর দিবে। আমার ঘরের ভিতর রাত্রে ছিল — কেবল ‘দয়াময়, দয়াময়’ করতে লাগল — আর আমাকে বলে, ‘তুমি কেশববাবুকে ধর তাহলে তোমার ভাল হবে।’ আমি বললাম, ‘আমি সাকার মানি।’ তবুও ‘দয়াময়, দয়াময়’ করে! তখন আমার একটা অবস্থা হল হয়ে বললাম, ‘এখান থেকে যা!’ ঘরের মধ্যে কোন মতে থাকতে দিলাম না! তারা বারন্দায় গিয়ে শুয়ে রইল।
“কাপ্তেনও যেদিন আমায় প্রথম দেখলে সেদিন রাত্রে রয়ে গেল।”
[মাইকেল মধুসূদন১ — নারাণ শাস্ত্রীর সহিত কথা ]
“নারায়ণ শাস্ত্রী যখন ছিল, মাইকেল এসেছিল। মথুরবাবুর বড়ছেলে দ্বারিকবাবু সঙ্গে করে এনেছিল। ম্যাগাজিনের সাহেবদের সঙ্গে মোকদ্দমা হবার যোগাড় হয়েছিল। তাই মাইকেলকে এনে বাবুরা পরামর্শ করছিল।
“দপ্তরখানার সঙ্গে বড়ঘর। সেইখানে মাইকেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি নারায়ণ শাস্ত্রীকে কথা কইতে বললাম। সংস্কৃতে কথা ভাল বলতে পারলে না। ভুল হতে লাগল! তখন ভাষায় কথা হল।
“নারায়ণ শাস্ত্রী বললে, ‘তুমি নিজের ধর্ম কেন ছাড়লে।’ মাইকেল পেট দেখিয়ে বলে, ‘পেটের জন্য — ছাড়তে হয়েছে।’
“নারায়ণ শাস্ত্রী বললে, ‘যে পেটের জন্য ধর্ম ছাড়ে তার সঙ্গে কথা কি কইব!’ তখন মাইকেল আমায় বললে, ‘আপনি কিছু বলুন।’
“আমি বললাম, কে জানে কেন আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার মুখ কে যেন চেপে ধরছে।“
[কামিনী-কাঞ্চন পণ্ডিতকেও হীনবুদ্ধি করে — বিষয়ীর পূজাদি ]
ঠাকুরকে দর্শন করিতে চৌধুরীবাবুর আসিবার কথা ছিল।
মনোমোহন — চৌধুরী আসবেন না। তিনি বললেন, ফরিদপুরের সেই বাঙাল (শশধর) আসবে — তবে যাব না!
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি হীনবুদ্ধি! — বিদ্যার অহংকার, তার উপর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বিবাহ করেছে, — ধরাকে সরা মনে করেছে!
চৌধুরী এম. এ. পাশ করিয়াছেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর খুব বৈরাগ্য হইয়াছিল। ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে প্রায় যাইতেন। আবার তিনি বিবাহ করিয়াছেন। তিন-চার শত টাকা মাহিনা পান।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — এই কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি মানুষকে হীনবুদ্ধি করেছে। হরমোহন যখন প্রথম গেল, তখন বেশ লক্ষণ ছিল। দেখবার জন্য আমি ব্যাকুল হতাম। তখন বয়স ১৭। ১৮ হবে। প্রায় ডেকে ডেকে পাঠাই, আর যায় না। এখন মাগকে এনে আলাদা বাসা করেছে। মামার বাড়িতে ছিল, বেশ ছিল। সংসারের কোনো ঝঞ্ঝাট ছিল না। এখন আলাদা বাসা করে পরিবারের রোজ বাজার করে। (সকলের হাস্য) সেদিন ওখানে গিয়েছিল। আমি বললাম, ‘যা এখান থেকে চলে যা — তোকে ছুঁতে আমার গা কেমন করছে।’
কর্তাভজা চন্দ্র (চাটুজ্যে) আসিয়াছেন। বয়ঃক্রম ষাট-পঁয়ষট্টি। মুখে কেবল কর্তাভজাদের শ্লোক। ঠাকুরের পদসেবা করিতে যাইতেছেন। ঠাকুর পা স্পর্শ করিতে দিলেন না। হাসিয়া বলিলেন, ‘এখন তো বেশ হিসাবি কথা বলছে।’ ভক্তেরা হাসিতে লাগিলেন।
এইবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের অন্তঃপুরে শ্রীশ্রীজগন্নাথ দর্শন করিতে যাইতেছেন। অন্তঃপুরে স্ত্রীলোক ভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করুবার জন্য ব্যাকুল হইয়া আছেন।
ঠাকুর আবার বৈঠকখানায় আসিয়াছেন। সহাস্যবদন। বলিলেন, ”আমি পাইখানার কাপড় ছেড়ে জগন্নাথকে দর্শন করলাম। আর একটু ফুল-টুল দিলাম।
“বিষয়ীদের পূজা, জপ, তপ, যখনকার তখন। যারা ভগবান বই জানে না তারা নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁর নাম করে। কেউ মনে মনে সর্বদাই ‘রাম’, ‘ওঁ রাম’ জপ করে। জ্ঞানপথের লোকেরাও ‘সোঽহম্’ জপ করে। কারও কারও সর্বদাই জিহ্বা নড়ে।
“সর্বদাই স্মরণ-মনন থাকা উচিত।”
১ শ্রীমধুসূদন কবি — জন্ম সাগরদাঁড়ি ১৮২৪; ইংলন্ডে অবস্থিতি ১৮৬২-৬৭; দেহত্যাগ ১৮৭৩। ঠাকুরকে দর্শন ১৮৬৮-র পরে হইবে।
==========
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা জুলাই
বলরামের বাড়ি, শশধর প্রভৃতি ভক্তগণ — ঠাকুরের সমাধি
শ্রীযুক্ত শশধর দু-একটি বন্ধু সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আমরা সকলে বাসকসজ্জা জেগে আছি — কখন বর আসবে!
পণ্ডিত হাসিতেছেন। ভক্তের মজলিস। বলরামের পিতাঠাকুর উপস্থিত আছেন। ডাক্তার প্রতাপও আসিয়াছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শশধরের প্রতি) — জ্ঞানের চিহ্ন, প্রথম — শান্ত স্বভাব; দ্বিতীয় — অভিমানশূন্য স্বভাব। তোমার দুই লক্ষণই আছে।
“জ্ঞানীর আর কতকগুলি লক্ষণ আছে। সাধুর কাছে ত্যাগী, কর্মস্থলে — যেমন লেকচার দিবার সময় — সিংহতুল্য, স্ত্রীর কাছে রসরাজ, রসপণ্ডিত। (পণ্ডিত ও অন্যান্য সকলের হাস্য)
“বিজ্ঞানীর স্বভাব আলাদা। যেমন চৈত্যদেবের অবস্থা। বালকবৎ, উন্মাদবৎ, জড়বৎ, পিশাচবৎ।
“বালকের অবস্থার ভিতর আবার বাল্য, পৌগণ্ড, যৌবন! পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি। উপদেশ দিবার সময় যুবার ন্যায়।”
পণ্ডিত — কিরূপ ভক্তি দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায়?
[শশধর ও ভক্তিতত্ত্ব-কথা — জ্বলন্ত বিশ্বাস চাই — বৈষ্ণবদের দীনভাব ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — প্রকৃতি অনুসারে ভক্তি তিনরকম! ভক্তির সত্ত্ব, ভক্তির রজঃ, ভক্তির তমঃ।
“ভক্তির সত্ত্ব — ঈশ্বরই টের পান। সেরূপ ভক্ত গোপন ভালবাসে, — হয়তো মশারির ভিতর ধ্যান করে, কেউ টের পায় না। সত্ত্বের সত্ত্ব — বিশুদ্ধ সত্ত্ব — হলে ঈশ্বরদর্শনের আর দেরি নাই; — যেমন অরুণোদয় হলে বুঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের আর দেরি নাই।
“ভক্তির রজঃ যাদের হয়, তাদের একটু ইচ্ছা হয় — লোকে দেখুক আমি ভক্ত। সে ষোড়শোপচার দিয়ে পূজা করে, গরদ পরে ঠাকুরঘরে যায়, — গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, — মালায় মুক্তা, মাঝে মাঝে একটি সোনার রুদ্রাক্ষ।
“ভক্তির তমঃ — যেমন ডাকাতপড়া ভক্তি। ডাকাত ঢেঁকি নিয়ে ডাকাতি করে, আটটা দারোগার ভয় নাই, — মুখে ‘মারো! লোটো!’ উন্মাদের ন্যায় বলে — ‘হর, হর, হর; ব্যোম, ব্যোম! জয় কালী!’ মনে খুব জোর জ্বলন্ত বিশ্বাস!
“শাক্তদের ওইরূপ বিশ্বাস। — কি, একবার কালীনাম, দুর্গানাম করেছি — একবার রামনাম করেছি, আমার আবার পাপ!
“বৈষ্ণবদের বড় দীনহীনভাব। যারা কেবল মালা জপে, (বলরামের পিতাকে লক্ষ্য করিয়া) কেঁদে ককিয়ে বলে, ‘হে কৃষ্ণ দয়া কর, — আমি অধম, আমি পাপী!’
“এমন জ্বলন্ত বিশ্বাস চাই যে, তাঁর নাম করেছি আমার আবার পাপ! — রাতদিন হরিনাম করে, আমার বলে — আমার পাপ!’
কথা কহিতে কহিতে ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া গান গাহিতেছেন:
আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি।
আখেরে এ দীনে না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শংকরী।।
নাশি গো ব্রাহ্মণ, হত্যা করি ভ্রূণ, সুরাপানাদি বিনাশী নারী।
এ-সব পাতক না ভাবি তিলেক, (ও মা) ব্রহ্মপদ নিতে পারি।।
গান – শিব সঙ্গে সদারঙ্গে আনন্দে মগনা।
সুধাপানে ঢল ঢল কিন্তু ঢলে পড়ে না মা!
গান শুনিয়া শশধর কাঁদিতেছেন।
দুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার,
দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে নিস্তার।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্য তুমি সে পাতাল,
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা দ্বাদশ গোপাল।
দশমহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার,
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার।
চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি তুমি বিশ্বমূল।
ত্রিলোকজননী তুমি ত্রিলোকতারিণী,
সকলের শক্তি তুমি (মা গো) তোমার শক্তি তুমি।
এই কয় চরণ গান শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন, গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর নিজে গান ধরিলেন:
যশোদা নাচাতো শ্যামা বলে নীলমণি,
সেরূপ লুকালে কোথা করালবদনী।
বৈষ্ণবচরণ এইবার কীর্তন গাইতেছেন। সুবোল-মিলন। যখন গায়ক আখর দিতেছেন — ‘রা বি ধা বেরোয় না রে!’ — ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।
শশধর প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতেছেন।
============
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা জুলাই
পুনর্যাত্রা — রথের সম্মুখে ভক্তসঙ্গে ঠাকুরের নৃত্য ও সংকীর্তন
ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হইল। গানও সমাপ্ত হইল। শশধর, প্রতাপ, রামদয়াল, রাম, মনোমোহন, ছোকরা ভক্তেরা প্রভৃতি অনেকেই বসিয়া আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন, “তোমরা একটা কেউ খোঁচা দেও না” — অর্থাৎ শশধরকে কিছু জিজ্ঞাসা কর।
রামদয়াল (শশধরের প্রতি) — ব্রহ্মের রূপকল্পনা যে শাস্ত্রে আছে, সে কল্পনা কে করেন?
পণ্ডিত — ব্রহ্ম নিজে করেন, — মানুষের কল্পনা নয়।
ডাঃ প্রতাপ — কেন রূপ কল্পনা করেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? তিনি কারু সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করেন না। তাঁর খুশি, তিনি ইচ্ছাময়! কেন তিনি করেন, এ খপরে আমাদের কাজ কি? বাগানে আম খেতে এসেছ, আম খাও; কটা গাছ, ক-হাজার ডাল, কত লক্ষ পাতা, — এ-সব হিসাবে কাজ কি? বৃথা তর্ক-বিচার করলে বস্তুলাভ হয় না।
ডাঃ প্রতাপ — তাহলে আর বিচার করব না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — বৃথা তর্ক-বিচার করবে না। তবে সদসৎ বিচার করবে, — কোন্টা নিত্য। কোন্টা অনিত্য। যেমন কাম-ক্রোধাদি বা শোকের সময়।
পণ্ডিত — ও আলাদা। ওকে বিবেকাত্মক বিচার বলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, সদসৎ বিচার [সকলে চুপ করিয়া আছেন]
(পণ্ডিতের প্রতি) — “আগে বড় বড় লোক আসত।”
পণ্ডিত — কি, বড়মানুষ?
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, বড় বড় পণ্ডিত।
ইতিমধ্যে ছোট রথখানি বাহিরের দুতলার বারান্দার উপর আনা হইয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, সুভদ্রা ও বলরাম নানা বর্ণের কুসুম ও পুষ্পমালায় সুশোভিত হইয়াছেন এবং অলঙ্কার ও নববস্ত্র পীতাম্বর পরিধান করিয়াছেন। বলরামের সাত্ত্বিক পূজা, কোন আড়ম্বর নাই। বাহিরের লোকে জানেও না যে, বাড়িতে রথ হইতেছে।
এইবার ঠাকুর ভক্তসঙ্গে রথের সম্মুখে আসিয়াছেন। ওই বারান্দাতেই রথ টানা হইবে। ঠাকুর রথের দড়ি ধরিয়াছেন ও কিয়ৎক্ষণ টানিলেন। পরে গান ধরিলেন — নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।
গান — যাদের হরি বলিতে নয়ন ঝরে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
ঠাকুর নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরাও সেই সঙ্গে নাচিতেছেন ও গাইতেছেন। কীর্তনীয়া বৈষ্ণবচরণ, সম্প্রদায়ের সহিত গানে ও নৃত্যে যোগদান করিয়াছেন।
দেখিতে দেখিতে সমস্ত বারান্দা পরিপূর্ণ হইল। মেয়েরাও নিকটস্থ ঘর হইতে এই প্রেমানন্দ দেখিতছেন! বোধ হইল, যেন শ্রীবাসমন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তসঙ্গে হরিপ্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছেন। বন্ধুবর্গসঙ্গে পণ্ডিতও রথের সম্মুখে এই নৃত্য গীত দর্শন করিতেছেন।
এখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ঠাকুর বৈঠকখানাঘরে আবার ফিরিয়া আসিয়াছেন ও ভক্তসঙ্গে উপবেশন করিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) — এর নাম ভজনানন্দ। সংসারীরা বিষয়ানন্দ নিয়ে থাকে, — কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ। ভজন করতে করতে তাঁর যখন কৃপা হয়, তখন তিনি দর্শন দেন — তখন ব্রহ্মানন্দ।
শশধর ও ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
পণ্ডিত (বিনীতভাবে) — আজ্ঞা, কিরূপ ব্যাকুল হলে মনের এই সরস অবস্থা হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরকে দর্শন করবার জন্য যখন প্রাণ আটুপাটু হয় তখন এই ব্যাকুলতা আসে। গুরু শিষ্যকে বললে, এসো তোমায় দেখিয়ে দি কিরূপ ব্যাকুল হলে তাঁকে পাওয়া যায়। এই বলে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে শিষ্যকে জলে চুবিয়ে ধরলে। তুললে পর শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলে, তোমার প্রাণ কিরকম হচ্ছিল? সে বললে, প্রাণ আটুপাটু কচ্ছিল।
পণ্ডিত — হাঁ হাঁ, তা বটে, এবার বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বরকে ভালবাসা, এই সার! ভক্তিই সার। নারদ রামকে বললেন, তোমার পাদপদ্মে যেন সদা শুদ্ধাভক্তি থাকে; আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রামচন্দ্র বললেন, আর কিছু বর লও; নারদ বললেন, আর কিছু চাই না, — কেবল যেন পাদপদ্মে ভক্তি থাকে।
পণ্ডিত বিদায় লইবেন। ঠাকুর বললেন, এঁকে গাড়ি আনিয়া দাও।
পণ্ডিত — আজ্ঞা না, আমরা অমনি চলে যাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — তা কি হয়! ব্রহ্মা যাঁরে না পায়ে ধ্যানে —
পণ্ডিত — যাবার প্রয়োজন ছিল না, তবে সন্ধ্যাদি করতে হবে।
[শ্রীরামকৃষ্ণের পরমহংস অবস্থা ও কর্মত্যাগ — মধুর নাম কীর্তন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — মা আমার সন্ধ্যাদি কর্ম উঠিয়ে দিয়েছেন, সন্ধ্যাদি দ্বারা দেহ-মন শুদ্ধ করা, সে অবস্থা এখন আর নাই।
এই বলিয়া ঠাকুর গানের ধুয়া ধরিলেন — ‘শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্যঘরে কবে শুবি, তাদের দুই সতীনে পিরিত হলে তবে শ্যামা মারে পাবি!’
শশধর প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
রাম — আমি কাল শশধরের কাছে গিয়েছিলাম, আপনি বলেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কই, আমি তো বলি নাই, তা বেশ তো, তুমি গিছিলে।
রাম — একজন খবরের কাগজের (Indian Empire) সম্পাদক আপনার নিন্দা করছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা করলেই বা।
রাম — তারপর শুনুন! আমার কথা শুনে তখন আর আমায় ছাড়ে না, আপনার কথা আরও শুনতে চায়!
ডাক্তার প্রতাপ এখনও বসিয়া। ঠাকুর বলিতেছেন — সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) একবার যেও, — ভুবন (ধাত্রী) ভাড়া দেবে বলেছে।
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার নাম করিতেছেন — রামনাম, কৃষ্ণনাম, হরিনাম করিতেছেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে শুনিতেছেন। এত সুমিষ্ট নামকীর্তন, যেন মধুবর্ষণ হইতেছে। আজ বলরামের বাড়ি যেন নবদ্বীপ হইয়াছে। বাহিরে নবদ্বীপ, ভিতরে বৃন্দাবন।
আজ রাত্রেই ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিবেন। বলরাম তাঁহাকে অন্তঃপুরে লইয়া যাইতেছেন — জল খাওয়াইবেন। এই সুযোগে মেয়ে ভক্তেরাও তাঁহাকে আবার দর্শন করিবেন।
এদিকে ভক্তেরা বাহিরের বৈঠকখানায় তাঁহার অপেক্ষা করিতেছেন ও একসঙ্গে সংকীর্তন করিতেছেন। ঠাকুর বাহিরে আসিয়াই যোগ দিলেন। কীর্তন চলিতেছে —
আমার গৌর নাচে।
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে।।
হরিবোল বলে বদনে গোরা, চায় গদাধর পানে,
গোরার অরুণ নয়নে, বহিছে সঘনে, প্রেমধারা হেম অঙ্গে।।
ঠাকুর আখর দিতেছেন —
নাচে সংকীর্তনে (শচীর দুলাল নাচে রে)।
(আমার গোরা নাচে রে) (প্রাণের গোরা নাচে রে)।
===========
0 Comments