শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-শ্রীম কথিত
চতুর্থ ভাগ
দশম খণ্ড
দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাখাল, মাস্টার, মহিমা প্রভৃতি সঙ্গে
========
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্র্রুয়ারী
শ্রীরামকৃষ্ণের হস্তে আঘাত — সমাধি ও জগন্মাতার সহিত কথা
ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সেই ঘরে অবস্থিতি করিতেছেন। বেলা তিনটা। শনিবার, ২রা ফেব্র্রুয়ারী, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; ২০শে মাঘ, ১২৯০ সাল, মাঘ শুক্লা ষষ্ঠী।
একদিন ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া ঝাউতলার দিকে যাইতেছেন; সঙ্গে কেহ না থাকাতে রেলের কাছে পড়িয়া যান। তাহাতে তাঁহার বাম হাতের হাড় সরিয়া যায় ও খুব আঘাত লাগে। মাস্টার কলিকাতা হইতে ভক্তদের নিকট হইতে বাড়্, প্যাড ও ব্যাণ্ডেজ আনিয়াছেন।
শ্রীযুক্ত রাখাল, মহিমাচরণ, হাজরা প্রভৃতি ভক্তেরা ঘরে আছেন। মাস্টার আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের চরণ বন্দনা করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিগো! তোমার কি ব্যারাম হয়েছিল? এখন সেরেছে তো?
মাস্টার — আজ্ঞে, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — হ্যাঁগা, “আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী” — তবে এরকম হল কেন?
ঠাকুর তক্তার উপর বসিয়া আছেন। মহিমাচরণ নিজের তীর্থদর্শনের গল্প করিতেছেন। ঠাকুর শুনিতেছেন। দ্বাদশ বৎসর পূর্বে তীর্থদর্শন।
মহিমাচরণ — কাশী সিক্রোলের একটি বাগানে একটি ব্রহ্মচারী দেখলাম। বললে, “এ-বাগানে কুড়ি বছর আছি। কিন্তু কার বাগান জানি না।” আমায় জিজ্ঞাসা করলে, “নৌকরী কর বাবু?” আমি বললাম, না। তখন বলে, “কেয়া, পরিব্রাজক হ্যায়?”
নর্মদাতীরে একটি সাধু দেখলাম, অন্তরে গায়ত্রী জপ কচ্ছেন — শরীরে পুলক হচ্ছে। আবার এমন প্রণব আর গায়ত্রী উচ্চারণ করেন যে যারা বসে থাকে তাদের রোমাঞ্চ আর পুলক হয়।
ঠাকুরের বালকস্বভাব, — ক্ষুধা পাইয়াছে; মাস্টারকে বলিতেছেন, “কি, কি এনেছ?” রাখালকে দেখিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।
সমাধি ভঙ্গ হইতেছে। প্রকৃতস্থ হইবার জন্য ঠাকুর বলিতেছেন — “আমি জিলিপি খাব”, “আমি জল খাব!”
ঠাকুর বালকস্বভাব, — জগন্মাতাকে কেঁদে কেঁদে বলছেন — ব্রহ্মময়ী! আমার এমন কেন করলি? আমার হাতে বড় লাগছে। (রাখাল, মহিমা, হাজরা প্রভৃতির প্রতি) — আমার ভাল হবে? ভক্তেরা ছোট ছেলেটিকে যেমন বুঝায় — সেইরূপ বলছেন “ভাল হবে বইকি!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি) — যদিও শরীর রক্ষার জন্য তুই আছিস, তোর দোষ নাই। কেননা, তুই থাকলেও রেল পর্যন্ত তো যেতিস না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানভাব — “ব্রহ্মজ্ঞানকে আমার কোটি নমস্কার” ]
ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইলেন। ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন —
“ওঁ ওঁ ওঁ — মা আমি কি বলছি! মা, আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে বেহুঁশ করো না — মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না। আমি যে ছেলে! — ভয়তরাসে। — আমার মা চাই — ব্রহ্মজ্ঞানকে আমার কোটি নমস্কার। ও যাদের দিতে হয়, তাদের দাও গে। আনন্দময়ী! আনন্দময়ী!”
ঠাকুর উচ্চৈঃস্বরে আনন্দময়ী! আনন্দময়ী! বলিয়া কাঁদিতেছেন আর বলিতেছেন —
“আমি ওই খেদে খেদ করি (শ্যামা)।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি ৷৷”
ঠাকুর আবার মাকে বলিতেছেন — “আমি কি অন্যায় করেছি মা? আমি কি কিছু করি মা? — তুই যে সব করিস মা! আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী! (রাখালের প্রতি, সহাস্যে) দেখিস, তুই যেন পড়িস নে। মান করে যেন ঠকিস না।
ঠাকুর মাকে আবার বলিতেছেন — “মা, আমি লেগেছে বলে কি কাঁদছি? না। —
“আমি ওই খেদে খেদ করি (শ্যামা)।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি ৷৷”
============
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি
কি করে ঈশ্বরকে ডাকতে হয় — “ব্যাকুল হও”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বালকের ন্যায় আবার হাসিতেছেন ও কথা কহিতেছেন — বালক যেমন বেশি অসুখ হলেও এক-একবার হেসে খেলে বেড়ায়। মহিমাদি ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সচ্চিদানন্দ লাভ না হলে কিছুই হল না বাবু!
“বিবেক-বৈরাগ্যের ন্যায় আর জিনিস নাই।
“সংসারীদের অনুরাগ ক্ষণিক — তপ্ত খোলায় জল যতক্ষণ থাকে — একটি ফুল দেখে হয়তো বললে, আহা! কি চমৎকার ঈশ্বরের সৃষ্টি!
“ব্যাকুলতা চাই। যখন ছেলে বিষয়ের ভাগের জন্য ব্যতিব্যস্ত করে, তখন বাপ-মা দুজনে পরামর্শ করে, আর ছেলেকে আগেই হিস্যা ফেলে দেয়। ব্যাকুল হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। তিনি যে কালে জন্ম দিয়েছেন, সে কালে তাঁর ঘরে আমাদের হিস্যা আছে। তিনি আপনার বাপ, আপনার মা — তাঁর উপর জোর খাটে! ‘দাও পরিচয়। নয় গলায় ছুরি দিব!”
কিরূপে মাকে ডাকিতে হয়, ঠাকুর শিখাইতেছেন — “আমি মা বলে এইরূপে ডাকতাম — ‘মা আনন্দময়ী! — দেখা দিতে যে হবে!’ —
“আবার কখন বলতাম — ওহে দীননাথ — জগন্নাথ — আমি তো জগৎ ছাড়া নই নাথ! আমি জ্ঞানহীন — সাধনহীন — ভক্তিহীন — আমি কিছুই জানি না — দয়া করে দেখা দিতে হবে।”
ঠাকুর অতি করুণ স্বরে সুর করিয়া, কিরূপে তাঁহাকে ডাকিতে হয়, শিখাইতেছেন। সেই করুণ স্বর শুনিয়া ভক্তদের হৃদয় দ্রবীভূত হইতেছে, — মহিমাচরণ চক্ষের জলে ভাসিয়া যাইতেছেন।
মহিমাচরণকে দেখিয়া ঠাকুর আবার বলিতেছেন —
“ডাক দেখি মন ডাকার মতন কেমন শ্যামা থাকতে পারে!”
===========
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি
শিবপুর ভক্তগণ ও আমমোক্তারি (বকলমা) — শ্রীমধু ডাক্তার
শিবপুর হইতে ভক্তেরা আসিলেন। তাহারা অত দূর হইতে কষ্ট করিয়া আসিয়াছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। সার সার গুটিকতক কথা তাহাদিগকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিবপুরের ভক্তদের প্রতি) — ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য। বাবু আর বাগান। ঈশ্বর ও তাঁর ঐশ্বর্য। লোকে বাগানই দেখে, বাবুকে চায় কয়জনে?
ভক্ত — আজ্ঞা, উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সদসৎ বিচার। তিনি সত্য আর সব অনিত্য — এইটি সর্বদা বিচার। ব্যাকুল হয়ে ডাকা।
ভক্ত — আজ্ঞে, সময় কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ — যাদের সময় আছে, তারা ধ্যান-ভজন করবে।
“যারা একান্ত পারবে না তারা দুবেলা খুব দুটো করে প্রণাম করবে। তিনি তো অন্তর্যামী, — বুঝছেন যে, এরা কি করে! অনেক কাজ করতে হয়। তোমাদের ডাকবার সময় নাই, — তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও। কিন্তু তাঁকে লাভ না করলে — তাঁকে দর্শন না করলে, কিছুই হল না।”
একজন ভক্ত — আজ্ঞা, আপনাকে দেখাও যা ঈশ্বরকে দেখাও তা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ও-কথা আর বলো না। গঙ্গারই ঢেউ, ঢেউ-এর কিছু গঙ্গা নয়। আমি এত বড় লোক, আমি অমুক — এই সব অহংকার না গেলে তাঁকে পাওয়া যায় না। ‘আমি’ ঢিপিকে ভক্তির জলে ভিজিয়ে সমভূমি করে ফ্যালো।
[কেন সংসার? ভোগান্তে ব্যাকুলতা ও ঈশ্বরলাভ ]
ভক্ত — সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কামিনী-কাঞ্চন দিয়ে তিনি ভুলিয়ে রেখেছেন।
ভক্ত — কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন, তাঁর ইচ্ছা?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তাহলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না।
“চালের আড়তে বড় বড় ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই-মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই-মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো সমস্ত রাত কড়র মড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না।
“কিন্তু দেখো, একসের চালে চৌদ্দগুণ খই হয়। কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপ চিন্তা করলে রম্ভা তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।”
ভক্ত — তাঁকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুলতা কেন হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভোগান্ত না হলে ব্যাকুলতা হয় না। কামিনী-কাঞ্চনের ভোগ যেটুকু আছে সেটুকু তৃপ্তি না হলে জগতের মাকে মনে পড়ে না। ছেলে যখন খেলায় মত্ত হয়, তখন মাকে চায় না। খেলা সাঙ্গ হয়ে গেলে তখন বলে, “মা যাব।” হৃদের ছেলে পায়রা লয়ে খেলা কচ্ছিল; পায়রাকে ডাকছে, “আয় তি তি!” করে! পায়রা লয়ে খেলা তৃপ্তি যাই হলো, অমনি কাঁদতে আরম্ভ করলে। তখন একজন অচেনা লোক এসে বললে, আমি তোকে মার কাছে লয়ে যাচ্ছি আয়। সে তারই কাঁধে চড়ে অনায়াসে গেল।
“যারা নিত্যসিদ্ধ, তাদের সংসারে ঢুকতে হয় না। তাদের ভোগের বাসনা জন্ম থেকেই মিটে গেছে।”
[শ্রীমধু ডাক্তারের আগমন — শ্রীমধুসূদন ও নাম মাহাত্ম্য ]
পাঁচটা বাজিয়াছে। মধু ডাক্তার আসিয়াছেন। ঠাকুরের হাতটিতে বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতেছেন। ঠাকুর বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। আর বলিতেছেন, ঐহিক ও পারত্রিকের মধুসূদন।
মধু (সহাস্যে) — কেবল নামের বোঝা বয়ে মরি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কেন নাম কি কম? তিনি আর তার নাম তফাত নয়। সত্যভামা যখন তুলাযন্ত্রে স্বর্ন-মণি-মাণিক্য দিয়ে ঠাকুরকে ওজন কচ্ছিলেন, তখন হল না! যখন রুক্মিণী তুলসী আর কৃষ্ণনাম একদিকে লিখে দিলেন, তখন ঠিক ওজন হল!
এইবার ডাক্তার বাড় বাঁধিয়া দিবেন। মেঝেতে বিছানা করা হইল, ঠাকুর হাসিতে হাসিতে মেঝেতে আসিয়া শয়ন করিতেছেন। সুর করিয়া করিয়া বলিতেছেন, “রাই-এর দশম দশা! বৃন্দে বলে, আর কত বা হবে!”
ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। ঠাকুর আবার গাহিতেছেন — “সব সখি মিলি বৈঠল — সরোবর কূলে!” ঠাকুরও হাসিতেছেন, ভক্তেরাও হাসিতেছেন। বাড় বাঁধা হইয়া গেলে ঠাকুর বলিতেছেন —
“আমার কলকাতার ডাক্তারদের তত বিশ্বাস হয় না। শম্ভুর বিকার হয়েছে, ডাক্তার (সর্বধিকারী) বলে, ও কিছু নয়, ও ঔষধের নেশা! তারপরই শম্ভুর দেহত্যাগ হল১
১ শম্ভু মল্লিকের মৃত্যু — ১৮৭৭
=============
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি
মহিমাচরণের প্রতি উপদেশ
সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে অধর কলিকাতা হইতে আসিলেন ও ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। ঘরে মহিমাচরণ, রাখাল, মাস্টার। হাজরাও এক-একবার আসিতেছেন।
অধর — আপনি কেমন আছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (স্নেহমাখা স্বরে) — এই দেখো! হাতে লেগে কি হয়েছে। (সহাস্যে) আছি আর কেমন!
অধর মেঝেতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাহাকে বলিতেছেন, “তুমি একবার এইটে হাত বুলিয়া দাও তো!”
অধর ছোট খাটটির উত্তর প্রান্তে বসিয়া ঠাকুরের শ্রীচরণ সেবা করিতেছেন। ঠাকুর মহিমাচরণের সহিত আবার কথা কহিতেছেন।
[মূলকথা অহেতুকী ভক্তি — “স্ব-স্বরূপকে জানো” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) — অহেতুকী ভক্তি, — তুমি এইটি যদি সাধতে পার, তাহলে বেশ হয়।
“মুক্তি, মান, টাকা, রোগ ভাল হওয়া, কিছুই চাই না; — কেবল তোমায় চাই। এর নাম অহেতুকী ভক্তি। বাবুর কাছে অনেকেই আসে — নানা কামনা করে; কিন্তু যদি কেউ কিছুই চায় না কেবল ভালবাসে বলে বাবুকে দেখতে আসে, তাহলে বাবুরও ভালবাসা তার উপর হয়।
“প্রহ্লাদের অহেতুকী ভক্তি — ঈশ্বরের প্রতি শুদ্ধ নিষ্কাম ভালবাসা।”
মহিমাচরণ চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার তাহাকে বলিতেছেন, “আচ্ছা, তোমার যেমন ভাব সেইরূপ বলি, শোন।
(মহিমার প্রতি) — “বেদান্তমতে স্ব-স্বরূপকে চিনতে হয়। কিন্তু অহং ত্যাগ না করলে হয় না। অহং একটি লাঠির স্বরুপ — যেন জলকে দুভাগ কচ্ছে। আমি আলাদা, তুমি আলাদা।
“সমাধিস্থ হয়ে এই অহং চলে গেলে ব্রহ্মকে বোধে বোধ হয়।”
ভক্তেরা হয়তো কেহ কেহ ভাবিতেছেন, ঠাকুরের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে? তা যদি হয়ে থাকে তবে উনি ‘আমি’ ‘আমি’ করিতেছেন কেন?
ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন — ‘আমি’ মহিম চক্রবর্তী, — বিদ্বান, এই ‘আমি’ ত্যাগ করতে হবে। বিদ্যার ‘আমি’তে দোষ নাই। শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য “বিদ্যার আমি” রেখেছিলেন।
“স্ত্রীলোক সম্বন্ধে খুব সাবধান না থাকলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। তাই সংসারে কঠিন। যত সিয়ান হও না কেন, কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে কালি লাগবে। যুবতীর সঙ্গে নিষ্কামেরও কাম হয়।
“তবে জ্ঞানীর পক্ষে স্বদারায় কখন কখন গমন দোষের নয়। যেমন মলমূত্রত্যাগ তেমনই রেতঃত্যাগ — পায়খানা আর মনে নাই।
“আধা-ছানার মণ্ডা কখন বা খেলে। (মহিমার হাস্য) সংসারীর পক্ষে তত দোষের নয়।”
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ]
“সন্নাসীর পক্ষে খুব দোষের। সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সন্ন্যাসীর পক্ষে স্ত্রীলোক, — থুথু ফেলে থুথু খাওয়া।
“স্ত্রীলোকদের সঙ্গে সন্ন্যাসী বসে বসে কথা কবে না। — হাজার ভক্ত হলেও। জিতেন্দ্রিয় হলেও আলাপ করবে না।
“সন্ন্যাসী কামিনী-কাঞ্চন দুই-ই ত্যাগ করবে — যেমন মেয়ের পট পর্যন্ত দেখবে না, তেমনি কাঞ্চন — টাকা — স্পর্শ করবে না। টাকা কাছে থাকলেও খারাপ! হিসাব, দুশ্চিন্তা, টাকার অহংকার, লোকের উপর ক্রোধ, কাছে থাকলে এই সব এসে পড়ে। — সূর্য দেখা যাচ্ছিল মেঘ এসে সব ঢেকে দিলে।
“তাইতো মারোয়াড়ী যখন হৃদের কাছে টাকা জমা দিতে চাইলে, আমি বললাম, ‘তাও হবে না — কাছে থাকলেই মেঘ উঠবে।’
“সন্ন্যাসীর এ কঠিন নিয়ম কেন? তার নিজের মঙ্গলের জন্যেও বটে, আর লোকশিক্ষার জন্য। সন্ন্যাসী যদিও নির্লিপ্ত হয় — জিতেন্দ্রিয় হয় — তবু লোকশিক্ষার জন্য কামিনী-কাঞ্চন এইরূপে ত্যাগ করবে।
“সন্ন্যাসীর ষোল আনা ত্যাগ দেখলে তবে তো লোকের সাহস হবে! তবেই তো তারা কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে চেষ্টা করবে!
“এ-ত্যাগশিক্ষা যদি সন্ন্যাসী না দেয়, তবে কে দিবে!”
[জনকাদির ঈশ্বরলাভের পর সংসার — ঋষি ও শূকরমাংস ]
“তাঁকে লাভ করে তবে সংসারে থাকা যায়। যেমন মাখম তুলে জলে ফেলে রাখা। জনক ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তবে সংসারে ছিলেন।
“জনক দুখান তরবার ঘোরাতেন — জ্ঞানের আবার কর্মের। সন্ন্যাসী কর্মত্যাগ করে। তাই কেবল একখানা তরবার — জ্ঞানের। জনকের মতো জ্ঞানী সংসারী গাছের নিচের ফল উপরের ফল দুই-ই খেতে পারে। সাধুসেবা, অতিথি-সৎকার — এ-সব পারে। মাকে বলেছিলাম, ‘মা, আমি শুঁটকে সাধু হব না।’
“ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পর খাওয়ারও বিচার থাকে না। ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি ব্রহ্মানন্দের পর সব খেতে পারত — শূকরমাংস পর্যন্ত।”
[চার আশ্রম, যোগতত্ত্ব ও শ্রীরামকৃষ্ণ ]
(মহিমার প্রতি) — “মোটামুটি দুই প্রকার যোগ — কর্মযোগ আর মনোযোগ, — কর্মের দ্বারা যোগ আর মনের দ্বারা যোগ।
“ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ আর সন্ন্যাস — এর মধ্যে প্রথম তিনটিতে কর্ম করতে হয়। সন্ন্যাসীর দণ্ডকমণ্ডলু, ভিক্ষা পাত্র ধারণ করতে হয়। সন্ন্যাসী নিত্যকর্ম করে। কিন্তু হয়তো মনের যোগ নাই — জ্ঞান নাই, ঈশ্বরে মন নাই। কোন কোন সন্ন্যাসী নিত্যকর্ম কিছু কিছু রাখে, লোকশিক্ষার জন্য। গৃহস্থ বা অন্যান্য আশ্রমী যদি নিষ্কামকর্ম করতে পারে, তাহলে তাদের কর্মের দ্বারা যোগ হয়।
“পরমহংস অবস্থায় — যেমন শুকদেবাদির — কর্ম সব উঠে যায়। পূজা, জপ, তর্পণ, সন্ধ্যা — এই সব কর্ম। এ-অবস্থায় কেবল মনের যোগ। বাহিরের কর্ম কখন কখন সাধ করে — লোকশিক্ষার জন্য। কিন্তু সর্বদা স্মরণমনন থাকে।”
============
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্র্রুয়ারী
মহিমাচরণের শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ ও ঠাকুরের সমাধি
কথা কহিতে কহিতে রাত আটটা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে শাস্ত্র হইতে কিছু স্তবাদি শুনাইতে বলিলেন। মহিমাচরণ একখানি বই লইয়া উত্তর গীতার প্রথমেই পরব্রহ্মসম্বন্ধীয় যে শ্লোক তাহা শুনাইতেছেন —
“যদেকং নিষ্কলং ব্রহ্ম ব্যোমাতীতং নিরঞ্জনম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং বিনাশোৎপত্তিবর্জিতম্ ৷৷”
ক্রমে তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোক পড়িতেছেন —
“অগ্নির্দেবো দ্বিজাতীনাং মুনীনাং হৃদি দৈবতম্।
প্রতিমা স্বল্পবুদ্ধীনাং সর্বত্র সমদর্শিনাম্ ৷৷”
অর্থাৎ ব্রাহ্মদিগের দেবতা অগ্নি, মুনিদিগের দেবতা হৃদয়মধ্যে — স্বল্পবুদ্ধি মনুষ্যদের প্রতিমাই দেবতা, আর সমদর্শী মহাযোগীদিগের দেবতা সর্বত্রই আছেন।
“সর্বত্র সমদর্শিনাম” — এই কথা উচ্চারণ করিবামাত্র ঠাকুর হঠাৎ আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। হাতে সেই বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ভক্তেরা সকলেই অবাক্ — এই সমদর্শী মহাযোগীর অবস্থা নিরীক্ষণ করিতেছেন।
অনেকক্ষণ এইরূপে দাঁড়াইয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন। মহিমাচরণকে এইবার সেই হরিভক্তির শ্লোক আবৃত্তি করিতে বলিলেন। মহিমা নারদপঞ্চরাত্র হইতে আবৃত্তি করিতেছেন —
অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্।
নান্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্ ৷৷
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্।
নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্ ৷৷
বিরম বিরম ব্রহ্মন্ কিং তপস্যাসু বৎস।
ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্।
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্তরীঞ্চ ৷৷
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা! আহা!
[ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ড — তুমিই চিদানন্দ — নাহং নাহং ]
শ্লোকগুলির আবৃত্তি শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইতেছিলেন। কষ্টে ভাব সংবরণ করিলেন। এইবার যতিপঞ্চক পাঠ হইতেছে —
যস্যামিদং কল্পিতমিন্দ্রজালং, চরাচরং ভাতি মনোবিলাসম্।
সচ্চিৎসুখৈকং জগদাত্মরূপং, সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্ ৷৷
“সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্” — এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন, “যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”
এইবার পাঠ হইতেছে নির্বাণষট্কম্ —
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ু —
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽ হং শিবোঽ হম্ ৷৷
যতবার মহিমাচরণ বলিতেছেন — চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্, ততবারই ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন —
“নাহং! নাহং — তুমি তুমি চিদানন্দ।”
মহিমাচরণ জীবন্মুক্তি গীতা থেকে কিছু পড়িয়া ষট্চক্রবর্ণনা পড়িতেছেন। তিনি নিজে কাশীতে যোগীর যোগাবস্থায় মৃত্যু দেখিয়াছিলেন, বলিলেন।
এইবার ভূচরী ও খেচরী মুদ্রার বর্ণনা করিতেছেন, ও সাম্ভবী বিদ্যার।
সাম্ভবী; — যেখানে সেখানে যায়, কোন উদ্দেশ্য নাই।
[পূর্বকথা — সাধুদের কাছে ঠাকুরের রামগীতাপাঠ শ্রবণ ]
মহিমা — রামগীতায় বেশ বেশ কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) –তুমি রামগীতা রামগীতা কচ্ছো, — তবে তুমি ঘোর বেদান্তী! সাধুরা কত পড়ত এখানে।
মহিমাচরণ প্রণব শব্দ কিরূপ তাই পড়িতেছেন — “তৈলধারামবিচ্ছিন্নম্ দীর্ঘঘন্টানিনাদবৎ”! আবার সমাধির লক্ষণ বলিতেছেন —
“ঊর্ধ্বপূর্ণমধঃপূর্ণং মধ্যপূর্ণং যদাত্মকম্।
সর্বপূর্ণং স আত্মেতি সমাধিস্থস্য লক্ষণম্ ৷৷”
অধর, মহিমাচরণ ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
===========
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৩রা ফেব্র্রুয়ারী
উন্মাদ অবস্থা - সরলতা ও সত্যকথা
পরদিন রবিবার, ৩রা ফেব্র্রুয়ারী ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ২১শে মাঘ, ১২৯০ সাল। মাঘ শুক্লা সপ্তমী। মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুর নিজাসনে বসিয়া আছেন। কলিকাতা হইতে রাম, সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁহার অসুখ শুনিয়া। চিন্তিত হইয়া আসিয়াছেন। মাস্টারও কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের হাতে বাড় বাঁধা, ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।
[পূর্বকথা -- উন্মাদ, জানবাজারে বাস -- সরলতা ও সত্যকথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) -- এমনি অবস্থায় মা রেখেছেন যে ঢাকাঢাকি করবার জো নাই৷ বালকের অবস্থা!
“রাখাল আমার অবস্থা বােঝে না। পাছে কেউ দেখতে পায়, নিন্দা করে, গায়ে কাপড় দিয়ে ভাঙা হাত ঢেকে দেয়। মধু ডাক্তারকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব কথা বলছিল। তখন চেঁচিয়ে বললাম --‘কোথা গাে মধুসূদন, দেখবে এস, আমার হাত ভেঙে গেছে!
“সেজোবাবু আর সেজোগিন্নি যে ঘরে শুতে সেই ঘরে আমিও শুতাম! তারা ঠিক ছেলেটির মতন আমায় যত্ন করত। তখন আমার উন্মাদ অবস্থা। সেজোবাবু বলত, “বাবা, তুমি আমাদের কথাবার্তা শুনতে পাও?” আমি বলতাম, ‘পাই।
“সেজোগিন্নি সেজোবাবুকে সন্দেহ করে বলেছিল, যদি কোথাও যাও -- ভটচার্জি মশায় তােমার সঙ্গে যাবেন। এক জায়গায় গেল -- আমায় নিচে বসালে। তারপর আধঘন্টা পরে এসে বললে, “চল বাবা, চল বাবা। গাড়িতে উঠবে চল।' সেজোগিন্নি জিজ্ঞাসা কললে, আমি ঠিক ওই সব কথা বললুম। আমি বললুম, “দেখগা, একটা বাড়িতে আমরা গেলুম, -- উনি নিচে বসালে -- উপরে আপনি গেল, -- আধঘন্টা পরে এসে বললে, “চল বাবা চল।' সেজোগিন্নি যা হয় বুঝে নিলে।
“মাড়েদের এক শরিক এখানকার গাছের ফল, কপি গাড়ি করে বাড়িতে চালান করে দিত। অন্য শরিকরা জিজ্ঞাসা করাতে আমি ঠিক তাই বললুম।”
============
0 Comments