কথামৃত-কথা - স্বামী সত্যানন্দ
নিবেদন
ভারতবর্ষ বিশেষতঃ বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, মহাপুরুষগণের শ্রীচরনারবিন্দ স্পর্শে দেশের ভূমি পুনঃ পুনঃ বিশুদ্ধি লাভ করে। যখনই অবিশ্বাস ও মলিন ভােগ স্পৃহা দেশের বাতাবরণকে কলুষিত করে তখনই কোন লােকোত্তর মহাপুরুষেয় আবির্ভাবে এবং তাঁহার দিব্য দেহস্পর্শে বিশোধিত হয় আধ্যাত্মিক বায়ুমণ্ডল। আমার অবিকম্পিত বিশ্বাস যে ভারতবর্ষের অধ্যাত্মবিভূতি কখনই জড়বাদ ও ভােগবাদের দ্বারা অভিভূত হইবে না' তাহার প্রমাণ লােকাতিগ জ্ঞানবৈরাগী-প্রেমময় অপরােক্ষানুভূতিসম্পন্ন ধর্ম প্রবক্তা পুনঃ পুনঃ ভারতভূমিতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন । তাঁহাদের সংস্পর্শে যাঁহারা আসিবেন বা তাঁহাদের বাণী শ্রদ্ধার সহিত অধ্যয়ন কবিবেন ও মনন করিবেন তাঁহারা এই মহাপুরুষদের আধ্যাত্মিকতার উষ্ণস্পর্শ অতিক্রম করিতে পারিবেন না।মহাপুরুষদের বাণীর মধ্যে যে একটি ঐক্য, আধ্যাত্মিকতার প্রতিষ্ঠা, দিব্যভাব প্রতিষ্ঠা বিরাজমান তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু বৈশিষ্ট্য ও বিরাজমান। এই বৈশিষ্টোর প্রয়ােজন আছে। বিচিত্ররুচি মানবের বিচিত্র সমস্যা ও সংশয় নব নব আকার ও প্রকারে উদিত হইয়া তাহাকে যখন পীড়িত করে, অভিভূত করে, বিভ্রান্ত করে ; যখনই দুঃখ-দারিদ্র, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থা, প্রমাদ ও অবিচার মানচিত্তকে বিদ্রোহী ও ব্যাকলিত করে এবং তাহার প্রতিক্রিয়ারূপে জাগতিক কল্যাণের মৌলিক আধারের প্রতি তার চিত্ত অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধায় কলুধিত হয় তখনও এইরূপ অধ্যাত্মপ্রেরণার নবীনরূপে সৃষ্টির আবশ্যকতা দেখা দেয় ।
ভারতবর্ষে এক চরম দুর্দিনে ধর্মের গ্লানির সংকট মুহুর্তে নেমে এসেছিলেন করুনার প্লাবনে মহাসমন্বয়মুতি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব। বিজ্ঞানের আলােয় মানুষের মন তখন একদিকে জড়বাদে সমাচ্ছন্ন, অন্যদিকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসে পথহারা। এই পথহারাদের পথের দিশারী হতে হলে এদের মতই হতে হয়, তাই ঠাকুর বিজ্ঞানের দৃষ্টি নিয়ে ভগবৎ-প্রাপ্তির পথ দেখাতে সুরু করলেন। শুধু ব্যাকুলতাই হল সম্বল-শুধু চোখের জলে ভরা হল মঙ্গল ঘট । নিজের জীবন বলি দিয়ে কেনা হল মার আশিষ । এমনি করে সব প্রধান প্রধান ধর্ম মতের সাধনে সিদ্ধ হয়ে যখন অদ্বৈতসিদ্ধিতে মন অখণ্ডের ঘর থেকে আর নামতে চায় না, সেই সময় মাই আবার নামিয়ে আনলেন বিশ্বের কল্যাণে, অখণ্ড হতে খণ্ডের রাজ্যে'"বললেন ভাবমুখে থাক্।
কাণ পেতে যে কল্যাণ বাণী শুনতে চেয়েছিল বিশ্ব, সেই বাণী মা নিজেই শুনিয়ে গেলেন—ওরে তুই ভাবমুখে থাক। এমনি করেই কি ভাববাদের (আইডিয়ালিজিম) প্রতিষ্ঠা হল উনবিংশ শতকের জগতে। এমনি করে তিনবার মা'র আদেশে মায়ের দুলাল নামলেন সমাধির সপ্তলােক হতে। মরুর বুকে নেমেছিল কণ্ঠভরাতৃষাহরা অমৃতবরিষণ : যার কৃপাধারে শুধু বাংলা নয়, শুধু ভারত নয়, সমস্ত বিশ্ব অমৃতায়িত হচ্ছে। বিশ্বের উর্দ্ধে যেসব লোক আছে সেখানেও চলেছে হর্য প্লাবন আজ লােকে লােকে বসেছে নববােধনের মঙ্গলঘট আর আগমনীর মিলন মাঙ্গলিকে দিক দিক দেশ দেশ হচ্ছে অনুরণিত। (যুগে যুগে আর আসা )
শ্রীরামকৃষ্ণবাণী-মাভবতারিণীর বাণী—অপ্রাকৃত বাণী। যেমন ভাববাহী তেমন ক্লানবাহী দুইই শুধু সাধুদের জন্যই নয়, সকলের জন্য বটে। ঠাকুর যে সবার ঠাকুর, সবার মত করে বলেছেন বলেই তাে এত mass appealing হয়েছে।
এ শাশ্বত সার্বভৌম বাণীর মর্মোদ্ধার করতে সমর্থ কে? কে ইহার রহস্য উঘাটন করতে পারে ? যার জীবন একেবারে হারা হইয়াছে তাঁরই পরম আরাধ্যদেবতা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণপরমহংসদেবের জীবনধারায় তিনিই ত একমাত্র সমর্থী পুরুষ।
শ্ৰীমৎ স্বামী সত্যানন্দজী এরূপ একজন ঈশ্বরজানিত মহাপুৰুষ যাঁহার সমগ্র জীবনব্যাপীমহাসাধনায় দেখা যায় যে, বর্তমান ভােগোন্মত্ত পৃথিবীতে সমাজের মধ্যে মহাকোলাহলমুখর নগরীর ও শহরের বুকে থেকে আবাল্য অসাধ্য সাধনায় নিমগ্ন এক মহাজীবন-যেন ভোগমুখী প্রকৃতির এক বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বরূপ।
যাঁর সমগ্র জীবনে মহাব্ৰতম্বরূপ ছিল এই তপশ্বৰ্য্যা। সর্বাবস্থাতে এই তপস্যাকে অবলম্বন করে জীবনের পরম সতাকে জানবার জন্যে অন্তস্থ হয়ে চলেছেন এই মহাযােগী—যেন উপনিষদবর্ণিত তপব্রহ্মের মূর্ত্ত বিগ্রহ হয়ে।
বীরভূমজেলার সিউড়ীর পৈতৃকবাটীতে একাকী রহসিস্থিত হয়ে কখনও বা অর্ধাহারে কখনও বা অনশনে চলেছে জগৎ জননীকে পাওয়ার এক অতন্দ্র সাধনা। তাঁরই ইষ্ট দেবতা শ্রীশ্রীঠাকুর পরমহংসদেবের জীবনের সেই জ্বালাময়ী উৎকণ্ঠা, বিরহের সেই অসহ্য জ্বালা, মিলনের সেই আনন্দ মাধুৰ্য্য লাভের আত্যন্তিক আকুতি নিয়ে শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দজী দীর্ঘ ১৫ বৎসর কাল তাঁর জীবন-মরণ সাধনায় ব্রত ছিলেন। যার ফলে তাঁর জীবনধারা একেবারে তাঁর পরমারাধ্য দেবতার জীবনধারায় হারা হয়ে যায়। তাই দেখা যায় পরবর্তীকালে আশ্রমে নিত্যদিন স্বাধ্যায়ে তিনি শুধুমাত্র শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের মহাবাণীর মর্মোদঘাটনে চেস্টিত ছিলেন না, ইহাকে নানাভাবে অর্থাৎ বিজ্ঞানের আলােকে, দর্শনের আলােকে, নীতিবিজ্ঞানের আলােকে, মনস্তত্ত্বের আলােকে বিভিন্ন দিক দিয়ে আধুনিকযুগসম্মত ব্যাখ্যা তিনি পরিবেশন করিতেছেন যাতে বর্তমানে সংশয়বাদী ও যুক্তিবাদী মানুষের কাছে ইহা উপভােগ্য হয়। শ্রীরামকৃষ্ণমহাবাণীর উপরে ইহা এক নুতন আলােকপাতের প্রচেষ্টা।
বর্তমান ‘কথামৃত-কথা’ গ্রন্থখানি ইহাবই নিদর্শন। শ্রীমৎ স্বামী সত্যনন্দজীকৃত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণমহাবাণীর ভাষ্যের সবগুলি ধরে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে নি ; তবে যেটুকু তাঁর কৃপায় ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে সেগুলি সংগ্রথিত করেই প্রকাশিত হল এই “কথামৃত-কথা”। ইহা উপাদান প্রধানতঃ সংগ্রহ করা হয়েছে শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দজী রচিত বেদছন্দা নামক পাঁচখণ্ড গ্রন্থ হতে এবং সঙ্কলয়িত্রী সন্ন্যাসিনী সাধনপুরী মাতার ‘শ্রবণমঙ্গপম' নামক চার খণ্ড সঙ্কলন গ্রন্থ হতে। আরাে কিছু সাহায্য নেওয়া হয়েছে স্বামী শক্ত্যানন্দ মহারাজ ও ব্রঃ ব্রত চৈতন্য মহারাজের ডায়েরী হতে।
শেষে দুটী পরিশিষ্ট আছে। প্রথমটিতে ঠাকুরের বাণী ছাড়া আমাদের ও স্বামীজীর কিছু বাণীর ব্যাখ্যা আর দ্বিতীয়টীতে শ্রীরামকৃষ্ণমহাৰাণীর ভাবাবলম্বনে সঙ্গীত যাহা সকলের কাছে বিশেষ করে সঙ্গীতপিপাসুদের কাছে খুবই হৃদয়গ্রাহী হবে।
পরিশেষে উল্লেখযােগ্য যে শ্রীমৎ স্বামী সত্যানন্দজীর আশ্রিত সন্তান শ্রীনিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় “কথামৃত-কথা" গ্রন্থের মুদ্রণকার্যের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিয়াছেন। তিনি (ব্র: নিরঞ্জন চৈতন্য ) বর্তমানে আমাদের আশ্রমের। সাঁইথিয়া অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা কার্যে রত আছেন। আমাদের নিউ জয়কালী প্রেসও এ বিষয়ে সাধ্যমত সাহায্য করেছেন। আমরা ইহাদের সকলের দীর্ঘ কল্যাণময় ও সুস্থ জীবন কামনা করি।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণার্পণমস্ত
বইটি অনলাইনে পড়তে ও PDF Download করতে নিচে দেখুনঃ-
*****
=====
0 Comments